কোথা কোথা খুঁজেছি তোমায়

কোথা কোথা খুঁজেছি তোমায়

‘অ্যাডলফ আইখম্যানের নাম শুনেছ?’

‘না স্যর। সে আবার কে?’

এই কথোপকথন হয়েছিল ১৯৬০ সালের ২৩ মে। স্থান: ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। প্রশ্নকর্তা ইসরায়েলের প্রথম প্রধানমন্ত্রী বেন গুরিয়ন। আর উলটো দিকে তাঁর এক তরুণ সহকারী য়িজাক য়াকোভি।

য়াকোভি সত্যিই জানত না যে, আইখম্যান আসলে কে। শুধু য়াকোভি কেন, তার মতো অনেক ইসরায়েলি তরুণই জানত না আইখম্যানের ব্যাপারে।

‘না’ শোনার পর বেন-গুরিয়ন য়াকোভিকে একবার আপাদমস্তক দেখে নিলেন। তারপর ঈষৎ গম্ভীর হয়ে বললেন, ‘আরে নায়কদের তো সবাই চেনে, দু-চারটে খলনায়কের নামও তো আমাদের মনে রাখা উচিত! এই অ্যাডলফ আইখম্যান নামের লোকটাই তোমার পরিবারের সবাইকে হত্যা করেছিল। এই জানোয়ারটাই ছিল হলোকাস্টের পরিচালক। ফাইনাল সলিউশনের প্রবর্তক। তোমাকে এ-ই পাঠিয়ে দিয়েছিল আউসভিৎসে।’

‘আচ্ছা স্যর, আমি ইহুদি হলেও ওরা আমাকে মেরে ফেলল না কেন?’

‘কারণ তোমার চুল সোনালি রঙের, আর চোখের মণি নীল। ওরা তোমাকে আর্য ভেবেছিল হে!’

একটু থেমে বেন-গুরিয়ন আবার বললেন, ‘আজ তুমি আমার সঙ্গে নেসেটে যাবে। সেখানে আমি একটা বিশেষ ঘোষণা করব। কী, অসুবিধা নেই তো?’

‘কী যে বলেন না আপনি! অসুবিধে আবার কীসের? কিন্তু কী ঘোষণা করবেন আজ?’ য়াকোভি জানতে চায়।

‘ওই যে আইখম্যানের কথা বললাম, ওকেই ধরে আনা হয়েছে!’

আইখম্যান। নাৎসি বাহিনীর নরপিশাচ। কত লক্ষ ইহুদি যে এরই পরিকল্পনায় ডেথ ক্যাম্পে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মরেছে তার ইয়ত্তা নেই। ইহুদিদের এভাবে নিকেশ করার থিওরি বের করেছিল এই আইখম্যানই— নাম দিয়েছিল ‘ফাইনাল সলিউশন’। হিটলারের পতন-পরবর্তী সময়ে অন্যান্য যুদ্ধ -অপরাধীদের মতোই জার্মানি থেকে হাওয়া হয়ে যায় আইখম্যান। আর তার অনুসন্ধান চলতে থাকে সারা বিশ্ব জুড়ে। তবে ইসরায়েলের নজর এড়িয়ে থাকার সাধ্য সম্ভবত স্বয়ং ঈশ্বরেরও নেই। আইখম্যানের হদিশ মেলে। তাকে ইসরায়েলে ধরে আনা ও তার বিচার রীতিমতো বিস্ময় জাগানো এক ঘটনা। গোটা পৃথিবীর নজর কেড়েছিল আইখম্যানের বিচার। সারা দুনিয়ার সামনে এসেছিল হলোকাস্টের নৃশংসতা ও বর্বরতার কাহিনি। আইখম্যানকে আর্জেন্টিনা থেকে কীভাবে ধরে আনা হল সেই কাহিনিই লিখলাম।

ন্যুরেমবার্গ ট্রায়ালের আগেই আইখম্যান জার্মানি থেকে গায়েব হয়ে গিয়েছিল এবং এমন ভাবেই হাওয়া হয়েছিল লোকটা যেন মাটিই তাকে খেয়ে ফেলেছে। সে বেঁচে আছে নাকি মারা গেছে সেটাও কেউ জানত না। সবাই ভুলতে বসেছিল আইখম্যানকে। আর এমন সময়েই আইখম্যানের খোঁজ পাওয়া গেল হঠাৎই এক অপ্রত্যাশিত জায়গা থেকে। খোদ জার্মানি থেকেই আইখম্যানের খবর এল।

১৯৫৭ সালের শেষ দিক। জার্মানির ফ্রাঙ্কফুট শহর থেকে ইসরায়েলের গুপ্তচর সংস্থা মোসাদের কাছে একটা খবর আসে।

কী খবর?

তার আগে দেখে নিই খবরটা দিলেন কে?

সংবাদটা দিয়েছিলেন হেসে’র অ্যাটর্নি জেনারেল ড: ফ্রিজ বাওয়ার। তিনি ছিলেন একজন ইহুদি। নাৎসি কনসেনট্রেশন ক্যাম্প থেকে কোনোক্রমে পালিয়ে বেঁচেছিলেন ভদ্রলোক। জার্মানি থেকে পালিয়ে তিনি প্রথমে ডেনমার্ক ও পরে সুইডেনে যান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর তিনি নিজের জীবন সঁপে দেন নাৎসিদের বিচার ও শাস্তির কাজে।

আইখম্যানের খবরটা পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মোসাদের পক্ষ থেকে বাওয়ারের সঙ্গে দেখা করার জন্য সাউল দারোম নামে একজন সিকিউরিটি অফিসারকে পাঠানো হল। কয়েক দিন পরে দারোম ফিরে এসেই সোজা আইজার হ্যারেলকে রিপোর্ট করলেন।

কী ছিল সেই রিপোর্টে?

‘আইখম্যান ইজ অ্যালাইভ! সে আর্জেন্টিনায় আছে।’

অ্যাডলফ আইখম্যান। নাৎসি জার্মান এসএস বাহিনীর লেফটেন্যান্ট কর্নেল। হলোকাস্টের কারিগর। ৬০ লক্ষেরও বেশি ইহুদির হত্যার একজন মূল চক্রী। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষের দিকে আইখম্যান একবার মিত্রবাহিনীর হাতে ধরাও পড়ে যায়। কিন্তু মিত্রবাহিনীর সেপাইরা বুঝতেই পারেনি যে, এ-ই হল কুখ্যাত আইখম্যান। সে তার পরিচয় দিয়েছিল অ্যাডলফ বার্থ নামে। বলেছিল, আমি একজন নাৎসি সৈনিক। সাধারণ সৈন্য। একজন সাধারণ যুদ্ধবন্দি হিসাবেই তাকে রাখা হয়েছিল। কড়া পাহারার ব্যবস্থাও করা হয়নি। আর সেই সুযোগেই ডিটেনশন ক্যাম্প থেকে সে পালিয়ে যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আইখম্যান কোথায় পালিয়েছে এই নিয়ে অনেক জল্পনা ছিল। গুজব ছিল যে, আইখম্যান সিরিয়া, মিশর, কুয়েত কিংবা দক্ষিণ আমেরিকাতে কোথাও ঘাপটি মেরে বসে আছে।

তা এত গভীর জলের মাছের সন্ধান কীভাবে পেলেন বাওয়ার?

সে আরেক অদ্ভুত কাহিনি। মাত্র কয়েক মাস আগে বাওয়ারের কাছে আর্জেন্টিনা থেকে একটা চিঠি আসে। চিঠির লেখক লোথার হারমান মিস্টার বাওয়ারের সম্পর্কে শুনেছেন ও জেনেছেন খবরের কাগজ পড়ে। তিনি এটাও জানতেন যে, নাৎসি অপরাধীদের মধ্যে আইখম্যান হল মোস্ট ওয়ান্টেড। ভদ্রলোকের মেয়ে সিলভিয়া এক যুবকের সঙ্গে প্রেম করছিল। কিন্তু প্রণয় কোনো কারণে পরিপূর্ণতা পায় না। মেয়েটি হতাশায় ভুগতে থাকে। হারমান মেয়ের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে জানতে পারে ছেলেটির নাম নিক আইখম্যান। খটকা লাগে এখানেই। ‘আইখম্যান’ পদবিটা শোনামাত্রই তাঁর শরীরে যেন বিদ্যুৎ খেলে যায়। নিশ্চয়ই এই ব্যাটাও খুনি অ্যাডলফ আইখম্যানের কোনো আত্মীয় হবে। তিনি সঙ্গে সঙ্গে চিঠি লেখেন বাওয়ারকে। লেখেন, এজেন্ট পাঠান; আইখম্যান এখানেই কোথাও লুকিয়ে রয়েছে।

বাওয়ারের ভয় ছিল এই কথা যেন জার্মান সরকারের কানে না যায়। কারণ, তাহলে আইখম্যানকে ধরার আশা আশাই থেকে যাবে। জার্মান বিচার বিভাগে অনেক প্রাক্তন নাৎসি ছিল। বাওয়ার জার্মান সরকারের ওপর বিন্দুমাত্র ভরসা করতেন না। বুয়েনস্ আইরেসের জার্মান এমব্যাসির কর্মীদেরও সন্দেহ করতেন বাওয়ার। করবেন না-ই বা কেন? একের পর এক নাৎসি যুদ্ধ-অপরাধীদের সাহায্য করে গেছে আর্জেন্টিনার গভর্নমেন্ট। তিনি ভাবতেন যে, আর্জেন্টিনাকে যদি আইখম্যানের কথা বলা হয় তাহলে হয়তো এমব্যাসি থেকেই কেউ তাকে সতর্ক করে দেবে, আর তখনই পাখি ফুড়ুৎ!

বাওয়ার চাইছিলেন আগে মোসাদ নিশ্চিত হোক যে, আর্জেন্টিনায় বসবাসকারী সন্দিগ্ধ লোকটাই আইখম্যান এবং তারপর ইসরায়েলের পক্ষ থেকে তাকে সমর্পণের দাবি করা হবে বা ধরে আনার ব্যবস্থা করা হবে।

সাউল দারোম হ্যারেলের টেবিলের ওপর একটা কাগজ রাখলেন। তাতে লেখা ছিল একটা ঠিকানা— ‘৪২৬১ কাইয়ে সাকাবুকো, অলিভোস, বুয়েনস আইরেস।’

জানুয়ারির শুরুতেই পাঠানো হল ইমানুয়েল তালমোর নামে মোসাদের স্পেশাল অপারেশন টিমের এক সদস্যকে। বাওয়ারের দেওয়া তথ্যের সত্যতা যাচাই করার জন্য তাকে পাঠানো হয়। তালমোর ফিরে এসে বললেন, ‘আইখম্যান ওই বস্তির মতো এলাকায় থাকতেই পারে না! আশেপাশে কোনো বাড়ি নেই। কারেন্টের কানেকশন অবধি যায়নি বাড়িটায়। একজন এক্স এসএস লেফটেন্যান্ট কর্নেল ওখানে কেন থাকবে? অত কষ্ট করে? আর আমি ও বাড়িতে যে মোটা ভদ্রমহিলাকে দেখলাম সে আইখম্যানের স্ত্রী ভেরা আইখম্যান হতেই পারে না।’

হ্যারেল ধাক্কা খেলেন বটে, কিন্তু দমে গেলেন না। তিনি এবার সরাসরি সেই ভদ্রলোকের সঙ্গে যোগাযোগ করতে চাইলেন, যিনি বাওয়ারকে চিঠি লিখে আইখম্যানের কথা জানিয়েছিলেন। বাওয়ারের কাছ থেকে খুব সহজেই তাঁর ঠিকানা পাওয়া গেল। লোথার হারমান থাকতেন করোনেল সুয়ারেজ শহরে, বুয়েনস আইরেস থেকে ৩০০ মাইল দূরে। বাওয়ার একটা চিঠি দিয়ে লিখলেন যে, এই চিঠির বাহককে যেন হারমান সবরকমে সহযোগিতা করেন।

১৯৫৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে তেল আভিভ পুলিশের হেড অফ ইনভেস্টিগেশন এফরেম হফস্টেটার পৌঁছলেন করোনেল সুয়ারেজ। ঘরে ঢুকে তিনি দেখলেন অতি সাধারণ পোশাক পরে একজন অন্ধ ব্যক্তি বসে আছেন। সঙ্গে এক যুবতী। অন্ধ ব্যক্তিই লোথার হারমান, আর মেয়েটি সিলভিয়া হারমান। হারমানকে তিনি নিজের পরিচয় দিলেন ফ্রিজ বাওয়ারের বন্ধু হিসাবে। নিজের আসল নাম গোপন করে বললেন, ‘মাইসেলফ কার্ল হাপার্ট।’

হারমান তাকে বললেন, ‘জার্মানিতে নাৎসিরা ক্ষমতায় আসার আগে আমি পুলিশে চাকরি করতাম। আমার বাবা-মাকে নাৎসিরা খুন করেছিল, আর আমাকে পাঠিয়ে দিয়েছিল ডাখাউতে। গেস্টাপো বাহিনীর মারের চোটে আমি অন্ধ হয়ে যাই। পরে আমি আর আমার স্ত্রী আর্জেন্টিনায় এসে সংসার পাতি।’

নিজের মেয়ের ব্যর্থ প্রেম এবং আইখম্যান পদবি শোনার পরের সব কথাই খুলে বললেন হারমান। ‘আমি চাই, আমার বাবা-মায়ের খুনিদের উচিত শাস্তি হোক,’ বলে কার্লের দিকে শূন্য দৃষ্টি নিয়ে হারমান তাকিয়ে রইলেন।

তিনি এরপর তাঁর মেয়ে সিলভিয়াকে সবকিছু খুলে বলতে বলেন। সিলভিয়া বলল, ‘প্রায় দেড় বছর আগে আমরা বুয়েনস আইরেসের কাছে অলিভোসে থাকতাম। ওখানেই নিক আইখম্যানের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। একদিন কথায় কথায় নিক বলে ফেলেছিল জার্মানরা সব ইহুদিদের শেষ করে দিলেই ভালো হত। কথাটা আমার গায়ে লেগে যায়। আসলে নিক আমার ইহুদি অরিজিনের ব্যাপারটা জানত না। আরেক দিন ও বলল যে, ওর বাবা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মান বাহিনীর একজন অফিসার ছিলেন। এভাবেই অনেক কথা বলত আমার সঙ্গে। বুয়েনস আইরেস থেকে আমরা চলে আসার পরেও আমাদের মধ্যে চিঠিপত্রের আদানপ্রদান চলতে থাকে। নিকের পাঠানো চিঠিতে ওর নিজের ঠিকানা লেখা থাকত না আর আমি চিঠি পাঠাতাম নিকের এক বন্ধুর ঠিকানায়। এটা শুনেই বাবার মনে সন্দেহ দানা বাঁধে।’

হারমান মেয়েকে নিয়ে একদিন অলিভোসে পৌঁছান। সিলভিয়া তার বন্ধুদের সাহায্যে নিকের বাড়ির ঠিকানাও জোগাড় করে ফেলে। তার সাকাবুকো স্ট্রিটের বাড়িতেও তারা পৌঁছে যায়। নিক তখন বাড়িতে ছিল না। সিলভিয়া একজন ভদ্রলোককে দেখে। টাকমাথা, সরু গোঁফ, চোখে চশমা ছিল। জানা গেল যে, তিনিই নিকের বাবা।

হারমান এবার বললেন যে, তিনি প্রয়োজনে সিলভিয়াকে নিয়ে আবার বুয়েনস আইরেস যেতে রাজি। হফস্টেটার এবার হারমানকে আইখম্যানের শনাক্তকরণের জন্য কয়েকটা জিনিস দিলেন— তার ফটো, তার আঙুলের ছাপ এবং আরও কিছু কাগজপত্র। কিছু টাকাও দেওয়া হল।

কয়েক মাস বাদে মোসাদের অফিসে হারমানের রিপোর্ট পৌঁছল। তাতে তিনি লিখেছিলেন, আইখম্যানের সবকিছুই জানা গেছে। সাকাবুকো স্ট্রিটের বাড়ির মালিক হল একজন অস্ট্রিয়ান, ফ্রান্সিসকো স্মিট। তিনি ডাণ্ডটো ও ক্লিমেন্ট পরিবারকে বাড়িটা ভাড়া দিয়েছিলেন। হারমান জোর গলায় দাবি করেন যে, স্মিটই আইখম্যান।

হ্যারেল এবার আর একজন এজেন্টকে পাঠালেন আর্জেন্টিনাতে, হারমানের কথার সত্যতা যাচাই করার দরকার ছিল। সেই এজেন্ট তারবার্তা পাঠাল, ‘ফ্রান্সিসকো স্মিট আইখম্যান নয়।’

এবার বিরক্ত হলেন। হারমান কি তবে বিশ্বাসযোগ্য নন? তিনি এই কেসটা বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন।

আইখম্যানের ব্যাপারটা সবাই প্রায় ভুলে যেতে বসেছিল। কারণ কেস বন্ধ হওয়ার পরে মাঝে কেটে গেছে দেড় বছর। এমন একটা সময়ে ফ্রিজ বাওয়ার ইসরায়েলে আসেন। তিনি কেস বন্ধ করে দেওয়ায় হ্যারেলের ওপর রেগেও ছিলেন। ভদ্রলোক সরাসরি দেখা করলেন অ্যাটর্নি জেনারেল হাইম কোহেনের সঙ্গে। তিনি বললেন যে, মোসাদ যদি না পারে তাহলে তিনি জার্মান সরকারকে ঘটনাটা জানাতে বাধ্য হবেন। বাওয়ার এবার একটা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য নিয়ে এসেছিলেন এবং তা ছিল— রিকার্ডো ক্লিমেন্ট ছদ্মনামে আইখম্যান আর্জেন্টিনাতেই আছে।

হ্যারেল ব্যাপারটা ধরে ফেললেন—- হারমান তাহলে ভুল করে ক্লিমেন্টের পরিবর্তে ফ্রান্সিসকো স্মিটের নাম বলেছিল। ভাড়াটে হিসাবে ক্লিমেন্ট পরিবারের নাম কিন্তু সে জানিয়েছিল। একজন দক্ষ মোসাদ এজেন্টকে পাঠালে কেসটা হয়তো অনেক আগেই মিটে যেত।

১৯৬০ সালের ফেব্রুয়ারির দিকে জ্বি আহারোনিকে বুয়েনস আইরেসে পাঠানো হল। দীর্ঘ দেহ, ছিপছিপে চেহারার ক্ষুরধার বুদ্ধিসম্পন্ন একজন মোসাদ এজেন্ট আহারোনি। তিনি সেখানে পৌঁছেই সেখানে বসবাসকারী এক ইহুদি বন্ধুর সাহায্য নিলেন। বন্ধুটি সাকাবুকো স্ট্রিটের সেই বাড়িতে গেলেন। যদি কোনো হদিশ মেলে। কিন্তু তাঁকে হতাশ হয়েই ফিরতে হল। বাড়ি খালি। শুধু কয়েক জন কাঠমিস্ত্রি ও রংয়ের মিস্ত্রি কাজ করছিল।

এরপর আরেক জনে পাঠানো হল বেলবয় হিসাবে। তার হাতে একটা উপহার যাতে লাগানো একটা কার্ড। কার্ডে লেখা— ‘ডিয়ার নিক,

‘ডিয়ার নিক, জন্মদিনের শুভেচ্ছা।’ রংমিস্ত্রিদের অনেক অনুরোধ করার পর একজনের কাছ থেকে নিকদের নতুন ঠিকানা পাওয়া গেল। সে বলে দিল, ‘ট্রেনে করে সান ফার্নান্ডো স্টেশনে যেতে হবে। তারপর ২০৩ নং বাস ধরে নামতে হবে আভিজেন্ডাতে সেখানে নামলে রাস্তাতেই একটা কিয়স্ক দেখা যাবে। তার ডান দিকে অন্য বাড়িগুলো থেকে দূরে ছোট্ট একটা ইটের বাড়ি দেখা যাবে। ওটাই ক্লিমেন্টদের বাড়ি।’

মোসাদের কাছে এটুকুই ছিল যথেষ্ট 1

পরের দিনই আহারোনি সেই পথেই বাড়িটার সামনে গিয়ে পৌঁছালেন। তিনি দরজায় নক করলেন। দরজা খুললেন একজন ভদ্রমহিলা। আহারোনি ভদ্রমহিলাকে বললেন, ‘আমি একটা আমেরিকান সেলাই মেশিন কোম্পানি থেকে এসেছি। আমরা আমাদের কারখানার জন্য জমি খুঁজছি। আপনাদের বাড়িটা আমরা কিনতে চাই।’

কথা বলার সময় তিনি নিজের হাতব্যাগে থাকা লুকোনো ক্যমেরার সাহায্যে ক্লিমেন্ট-হাউসের ছবি বিভিন্ন কোণ থেকে তুলে নিলেন

পরের দিন কাগজপত্র ঘেঁটে তিনি বার করলেন যে জমির মালিকানা রয়েছে ভেরা লিবেল ডি আইখম্যানের নামে। আর্জেন্টিনার নিয়ম অনুযায়ী মহিলাদের ক্ষেত্রে বিয়ের আগের ও পরের দুটো নামই দলিল নথিভুক্ত করার জন্য ব্যবহার করা হয়। রিকার্ডো ক্লিমেন্ট নিজের নামে জমি নথিভুক্ত করাননি।

এরপর কয়েক দিন ওই বাড়ির আশেপাশে চক্কর কাটলেন আহারোনি। কিন্তু ক্লিমেন্টের দেখা মিলল না। তবে তিনিও একটা বিশেষ দিনের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। দিনটা ছিল ২১ মার্চ। অ্যাডলফ আইখম্যান ও ভেরা লিবেলের পঁচিশতম বিবাহ বার্ষিকী। আহারোনি ধরেই নিয়েছিলেন যে, এই দিন নিশ্চয়ই আইখম্যান আসবে।

২১ মার্চ আহারোনি আবার ক্যামেরা নিয়ে গেলেন। বাড়ির ইয়ার্ডে তিনি একজন পুরুষের দর্শন পেলেন এবার। রোগা, টাকমাথা, মাঝারি উচ্চতার একজনকে দেখলেন। নাকটা ছিল বেশ লম্বা ও নাকের নীচে সরু গোঁফও ছিল। চোখে চশমা। ইন্টেলিজেন্স ফাইলের সঙ্গে সব হুবহু মিলে যাচ্ছিল।

ইসরায়েলে হ্যারেল বেন-গুরিয়নের বাড়িতে গিয়ে খবর গেল, ‘আমরা আইখম্যানকে আর্জেন্টিনাতে খুঁজে পেয়েছি। এবার তাকে ধরে আনতে পারব।’

বেন-গুরিয়ন সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিলেন— ‘ব্রিং হিম ডেড অর অ্যালাইভ!’ তারপর একটু থেমে বললেন— ‘ব্রিং হিম অ্যালাইভ। আমাদের তরুণ প্রজন্মের জন্য একটা দৃষ্টান্ত গড়ে তোলার দরকার আছে।’

হ্যারেলের সামনে এবার নতুন চ্যালেঞ্জ ছিল। আইখম্যানকে আর্জেন্টিনা থেকে অপহরণ করার চ্যালেঞ্জ। যদিও ব্যাপারটা বেআইনি, আর্জেন্টিনা শত্রু-রাষ্ট্র ছিল না। কিন্তু অপহরণ না করলে তাকে জীবিত আনাও অসম্ভব।

এই অপারেশনের জন্য একটা টিম তৈরি করা হল। তাতে রইল ১০ জন পুরুষ আর একজন মহিলা। এদের সংক্ষিপ্ত পরিচয় দেখে নেওয়া যাক-

১. রাফি ঈটান: তিনি দলের কমান্ডার। ঈটানের বাবা-মা রাশিয়া থেকে প্যালেস্টাইনে এসেছিল। এখানেই এক কিবুজে তাঁর জন্ম। একজন দুর্ধর্ষ ইনটেলিজেন্স অফিসার! ঠান্ডা মাথায় কতটা নৃশংস কাজ করা যায় সেটা ঈটানকে না দেখে বোঝা সম্ভব নয়। মাত্র ১২ বছর বয়সেই তিনি যোগ দিয়েছিলেন হেগানাতে। ইহুদিদের অনেক শত্রুকে তিনি নিজের হাতে হত্যা করেছেন। ইসরায়েলি ইন্টেলিজেন্স কমিউনিটিতে ঈটান কিংবদন্তীসম চরিত্র।

২. জ্বি মালকিন: এই দলের সহকারী কমান্ডার। তাঁর জন্ম পোল্যান্ডে। পরে প্যালেস্টাইনে এসে হেগানায় যোগ দেন। তাঁর ক্ষুরধার বুদ্ধি ও ছদ্মবেশ ধরার পটুতার জন্য তাঁকে এই মিশনে নেওয়া হয়।

৩. আভ্রাহাম সালোম: এই দলের ডেপুটি কমান্ডার। জন্ম অস্ট্রিয়াতে। ১৯৩৮ সালে নাইট অব শ্যাটারড গ্লাসের ঘটনার দিন প্রায় ৩০ জন ইহুদি-বিদ্বেষীর হাতে আক্রান্ত হয়েছিলেন। প্যালেস্টাইনে অনুপ্রবেশ করার পর তিনি হেগানাতে যোগ দেন ও পরে সিন বেটের কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের কমান্ডার হন। নিখুঁত পরিকল্পনা করা ও দক্ষতার সঙ্গে রসদ সরবরাহ করার ক্ষমতা ছিল তাঁর সহজাত।

৪. মোসে তাভর: লিথুয়ানিয়ায় জন্ম। শক্তসমর্থ, পেটানো চেহারা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশদের হয়ে লড়াই করা এক সৈনিক। অপহরণের জন্য এরকম শক্তিশালী লোকের প্রয়োজন ছিল। তবে অপহরণের চেয়ে সরাসরি আইখম্যানকে সরাসরি হত্যা করতেই বেশি উৎসাহী ছিলেন তিনি।

৫. সালোম দানি: জন্ম হাঙ্গেরিতে। তিনি একজন উঁচু দরের শিল্পী ও জালিয়াতিতে ওস্তাদ। তিনি ও তাঁর বোন হলোকাস্টের সময় নকল পারমিট বানিয়ে কনসেনট্রেশন ক্যাম্প থেকে পালিয়ে বেঁচেছিলেন। চুপচাপ ও শান্ত স্বভাবের মানুষ। বুয়েনস আইরেসে থেকে তিনি মোসাদ টিমের জন্য যাবতীয় জাল দস্তাবেজ তৈরি করবেন এটাই ঠিক করা হয়েছিল।

৬. য়াকভ গ্যাট: জন্ম ট্রানসিলভানিয়াতে। সিন বেটের একজন এজেন্ট। স্প্যানিশটা খুব ভালো বলতে ও বুঝতে পারতেন। আর্জেন্টিনার সরকারি ভাষা স্প্যানিশ। সুতরাং ভালো স্প্যানিশ জানা লোকের প্রয়োজন ছিল। তাঁর কাজ ছিল এজেন্টদের জন্য নিরাপদ বাড়ি খোঁজা ও গাড়ির মেরামত করা। ইনিও ছিলেন খুব ঠান্ডা মাথার লোক।

৭. য়েহুডিথ নিসিয়াহু: তিনি এই মিশনের একমাত্র মহিলা সদস্য। নেদারল্যান্ডে জন্ম। একজন মোসাদ এজেন্ট। ভাড়া বাড়িতে কেবলমাত্র পুরুষদের উপস্থিতি যাতে সন্দেহ তৈরি না করে এ জন্য তাঁকে এই মিশনে সামিল করা হয়েছিল।

৮. রিকজাক নেসের: জন্ম চেকোস্লোভাকিয়ায়। বয়সে তরুণ। সরল, সাদাসিধে ও নিরীহ চেহারার জন্য তাঁকে দলে নেওয়া হয়েছিল। তাঁর কাজ ছিল বাড়ি খোঁজা, গাড়ি এবং যাবতীয় সরঞ্জাম জোগাড় করা।

৯. য়োনা ইলিয়ান: তেল আভিভের একজন নামকরা ডাক্তার। টিমের কোনো সদস্য বা যাকে অপহরণ করা হবে তার যে কোনো রকম মেডিকাল ট্রিটমেন্টের জন্য তাঁকে দলে নেওয়া হয়। তাছাড়া আইখম্যানকে মাদক ইনজেক্ট করার প্রয়োজনেও তাঁকে লাগতই।

১০. এফরেদম ইলানি: তালা খোলার ব্যাপারে বিশারদ, আর আর্জেন্টিনার অলিগলি ছিল তাঁর চেনা। বুয়েনস আইরেসে ইসরায়েলি এমব্যাসি এবং টিমের সঙ্গে একমাত্র তিনিই যোগাযোগের মাধ্যম হিসাবে কাজ করবেন বলে ঠিক হয়েছিল।

১১. জ্বি আহারোনি: জন্ম জার্মানিতে। তিনি এই টিমের একমাত্র জার্মান ভাষা জানা সদস্য। সান ফার্নান্দোতে আইখম্যানের বাড়ি তিনিই খুঁজে বের করেন। তিনি ছিলেন সিন বেটের একজন ইনভেস্টিগেটর। ঠিক করা হয় যে, আইখম্যানের সঙ্গে একমাত্র তিনিই কথা বলবেন।

হ্যারেল নিজেও এই টিমের সদস্য ছিলেন। তিনিও পুরো মিশনে বুয়েনস আইরেসে থাকবেন এমনটাই ঠিক হয়েছিল।

এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে বিভিন্ন দিক থেকে ৪ জনের একটা টিম আর্জেন্টিনাতে ঢুকল। তাঁরা ওয়াকি টকি, ইলেকট্রনিক সরঞ্জাম, মেডিকাল কিট, সালোম দানির ভ্রাম্যমান ল্যাবের অংশবিশেষ (জাল পাসপোর্ট, এফিডেভিট বা জাল কাগজ বানাবার জন্য) আর্জেন্টিনাতে সুকৌশলে পাচার করে নিয়ে গিয়েছিলেন। বুয়েনস আইরেসে একটা অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া নেওয়া হয়, যার কোড নেম দেওয়া হয় ‘দ্য ক্যাসল’। পরের দিনই টিম রওনা দেয় সান ফার্নান্দোর উদ্দেশ্যে। তাঁরা যখন পৌঁছালেন, তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে। ২০২ নং রুটে ধীরে ধীরে এগোনোর সময়েই সৌভাগ্যবশত ক্লিমেন্টকে দেখা গেল। কোনোদিকে না তাকিয়ে সে সোজা তার বাড়িতে ঢুকে গেল। এজেন্টরা বুঝে গেছিল যে, ওই সময়টায় ক্লিমেন্ট (আইখম্যানের ছদ্মনাম) রোজ বাড়ি ফেরে। তখন ঠিক করা হয় যে, এভাবেই কোনো এক সন্ধ্যায় বাসস্টপ ও তার বাড়ির মাঝের রাস্তা থেকেই তাকে ধরে তুলে নেওয়া হবে গাড়িতে।

সেই রাতেই হ্যারেল ইসরায়েলে বার্তা পাঠান, অপারেশন করা সম্ভব।

আইখম্যানকে অপহরণ না হয় করা গেল, কিন্তু তাকে ইসরায়েলে কীভাবে নিয়ে যাওয়া যাবে?

এটা একটা চিন্তার বিষয় ছিল। এই সময় হ্যারেল জানতে পারেন যে, ২০ মে আর্জেন্টিনা পালন করতে চলেছে তাদের ১৫০তম স্বাধীনতা দিবস সেই অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার জন্য পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরা আসবেন। শিক্ষামন্ত্রী আব্বা এবানের নেতৃত্বে ইসরায়েলের একটা প্রতিনিধি দলও বিশেষ বিমানে চড়ে আসছে বলে জানা গেল। হ্যারেল এক সুবর্ণ সুযোগ দেখতে পেলেন। তিনি ওই বিমানে করেই আইখম্যানকে ইসরায়েলে পাঠানোর প্ল্যান করে ফেললেন।

বিমান বুয়েনস আইরেসে পৌঁছানোর কথা ১১ মে। পাইলটকে নির্দেশ দেওয়াই ছিল যেন একজন অভিজ্ঞ মেকানিককে নেওয়া হয়, যাতে প্রয়োজন পড়লে আর্জেন্টিনার ল্যান্ড ক্রু ছাড়াই যেন বিমান টেক অফ করতে পারে।

১ মে হ্যারেল ইউরোপিয়ান পাসপোর্টে বুয়েনস আইরেস পৌঁছান। ৯ মে একটি অ্যাপার্টমেন্টে টিমের সকল সদস্য একত্রিত হল। এই অ্যাপার্টমেন্টের কোড নেম দেওয়া হয়েছিল ‘হাইটস’।

ঠিক হল সাক্ষাৎ ও পরিকল্পনা করা হবে ক্যাফেগুলোতে। সকলেই জানত কোন সময়, কোন ক্যাফেতে হ্যারেল থাকবেন। ওই ক্যাফে থেকেই তিনি দলের লোকেদের নির্দেশ দিতেন।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জায়গা হিসাবে বেছে নেওয়া হল এয়ারপোর্টের রাস্তায় একটা অ্যাপার্টমেন্টকে। এর কোড নেম দেওয়া হয়েছিল ‘দ্য বেস’। আইখম্যানকে ধরে আনার পর এখানেই রাখার পরিকল্পনা করা হয়।

সব ঠিক করার পর ১০ তারিখে আইখম্যানকে অপহরণের প্ল্যান করা হয়। স্মুদলি হয়েও যেত। ঠিকই ছিল যে, ইসরায়েলি বিমান আসবে ১১ তারিখ। আর ১২ তারিখে সেই বিমানে আইখম্যানকে নিয়ে যাওয়া হবে ইসরায়েলে।

সব ঠিক চলছিল। কিন্তু শেষ মুহূর্তের একটা ঘোষণায় গোটা পরিকল্পনাটাই ভেস্তে যাওয়ার উপক্রম হল। আসলে প্রচুর সংখ্যক প্রতিনিধি এসে যাওয়াতে তাদের জায়গা দিতেই হিমশিম খেয়ে যাচ্ছিল আর্জেন্টিনা কর্তৃপক্ষ। তাই তারা ইসরায়েলকে জানিয়ে দেয় যে, ইসরায়েলি প্রতিনিধিরা যেন ১১ মে’র পরিবর্তে ১৯ মে এসে পৌঁছায়। সাংঘাতিক কাণ্ড! এর ফলে হ্যারেলের কাছে দুটো অপশন রইল। এক, অপহরণের দিন পিছিয়ে দেওয়া; দুই, ১০ মে অপহরণের পর আরও ৯ থেকে ১০ দিন আইখম্যানকে লুকিয়ে রাখা। দ্বিতীয় পরিকল্পনা ছিল অনেক বেশি ঝুঁকিপূর্ণ, কারণ আইখম্যানের পরিবার পুলিশে খবর দিলে পুলিশ তন্নতন্ন করে খোঁজা শুরু করে দেবে। আর দুর্ভাগ্যক্রমে তারা যদি মোসাদ এজেন্টদের কবজায় তাকে খুঁজে পায় তাহলে এক কেলেংকারি কাণ্ড হবে। কিন্তু হ্যারেল দ্বিতীয় বিকল্পটাই বেছে নিলেন। কেবল অপহরণের দিন একদিন পিছিয়ে ১০ তারিখের জায়গায় ১১ তারিখ করা হল। সময় ঠিক করা হল সন্ধ্যা ৭: ৪০ মিনিটে।

১১ মে, সন্ধ্যা ৬:৩০। দুটো গাড়ি রওনা দিল গন্তব্যের উদ্দেশ্যে। যে গাড়িতে আইখম্যানকে তোলা হবে, তার মধ্যে ছিলেন রাফি ঈটান, মোসে তাভর, জ্বি মালকিন ও জ্বি আহারোনি। জ্বি আহারোনি গাড়ি চালাচ্ছিলেন। দ্বিতীয় গাড়িটায় ছিলেন আভ্রাহাম সালোম, য়াকভ গ্যাট ও ড: ইলিয়ান। ড: ইলিয়ানের কাছে ছিল যন্ত্রপাতি ও ওষুধ ভর্তি একটা ব্যাগ।

৭:৩৫ নাগাদ দেখা গেল দুটো গাড়িকেই পার্ক করা রয়েছে গ্যারিবল্ডি স্ট্রিটে। তখন অন্ধকার নেমে এসেছে চতুর্দিকে। দুজন এজেন্ট গাড়ির হুড খুলে এমন ভান করতে থাকলেন যে কেউ দেখলে ভাববে যে, তাদের গাড়ি খারাপ হয়ে গেছে। আহারোনি কিন্তু গাড়ির স্টিয়ারিং ধরেই বসে রইলেন। আরেক জন নজর রাখছিলেন বাইরে— আইখম্যান আসছে কিনা।

ইহুদিরা নাৎসিদের কী পরিমাণে ঘেন্না করে তা বলে বোঝানো সম্ভব নয়। একজন এজেন্ট তো হাতে গ্লাভস পরে এসেছিলেন শুধুমাত্র এই কারণে যাতে সরাসরি আইখম্যানকে স্পর্শ না করতে হয়! দ্বিতীয় গাড়িটা খানিক দূরে একটা গলির মুখে আড়াআড়ি ভাবে দাঁড়িয়ে রইল। সেখানেও দুজন দাঁড়িয়েছিল গাড়ির বাইরে, আর একজন চালকের আসনে বসে ছিল। প্রতিটা সেকেন্ডের কাউন্টিং চলছিল। আর তাঁদের মনে তখন একটাই প্রশ্ন—- কোথায় আইখম্যান?

৭:৪০ নাগাদ একটা বাস এসে দাঁড়াল। নড়েচড়ে বসল সকলে। কিন্তু বাস থেকে কেউ নামল না। ঈটান বিড়বিড় করে বললেন, ‘এমনটা তো হওয়ার কথা নয়! তাহলে কি আগে থেকেই খবর পেয়ে গেছে?’

৭:৫০ নাগাদ আরো দুটো বাস পরপর এল। কিন্তু আইখম্যানের দেখা নেই। এবার সবার বুক দুরুদুরু করতে লাগল। আইখম্যান কি তবে বিপদের গন্ধ পেয়ে পালিয়েছে?

ঘড়িতে পাক্কা ৮টা বাজল। হ্যারেলের নির্দেশ ছিল ৮টা পর্যন্ত অপেক্ষা করার। ৮টার পর আর কেউ সেখানে থাকবে না। কিন্তু রাফি ঈটান ৮:৩০টা পর্যন্ত অপেক্ষা করবেন বলে ঠিক করলেন।

৮:০৫ নাগাদ আরেকটা বাস এসে থামল। বাস থেকে আইখম্যান ওরফে ক্লিমেন্ট নামল। তার ওপর প্রথম নজর পড়ে আভ্রাহাম সালোমের। গাড়ির কাছাকাছি আসতেই সালোম গাড়ির হেডলাইট জ্বালিয়ে দিল। কিছুক্ষণের জন্য চোখে ধাঁধা লেগে যায় ক্লিমেন্টের। সে হাত দিয়ে চোখ ঢেকে পাশ কাটিয়ে দ্রুত বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। জ্বি মালকিন তখন ক্লিমেন্টের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে স্প্যানিশে বলে, ‘এক মিনিট’। ক্লিমেন্ট তখন নিজের টর্চ লাইটটা খোঁজার জন্য পকেটে হাত ঢোকায়। এজেন্ট মালকিন ভাবলেন ক্লিমেন্ট বোধহয় পকেট থেকে পিস্তল বের করছে। তৎক্ষণাৎ তিনি ক্লিমেন্টের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন। ক্লিমেন্ট জোরে চিৎকার করার চেষ্টা করল। সঙ্গে সঙ্গে সব এজেন্ট তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, তাকে জাপটে ধরে তুলে নিয়ে গাড়ির ভেতরে শুইয়ে দিল। তার মুখ হাত দিয়ে চেপে রাখা হল, যাতে সে আর চিৎকার না করতে পারে। গাড়ি স্টার্ট দিয়ে এগোতে শুরু করে দিল। পিছু পিছু চলল দ্বিতীয় গাড়িটাও।

ক্লিমেন্টের হাত-পা বেঁধে ফেলা হল। মুখও বন্ধ করে দিল এজেন্টরা, যাতে সে আওয়াজ না করতে পারে। তার নিজের চশমা খুলে পরিয়ে দেওয়া হল

একটা কালো চশমা। আর জার্মান ভাষায় বলে দেওয়া হল, ‘নড়াচড়া করেছ কি মরেছ!’ এরপর অবশ্য গোটা রাস্তায় সে আর কোনো প্রতিরোধ করেনি। রাফি ঈটান এবার ক্লিমেন্টের শার্টের ভেতরে হাত ঢোকালেন। তার বাম বগলের তলায় আর পেটের ডান দিকে তিনি কিছু একটা খুঁজছিলেন।

কিন্তু কী খুঁজছিলেন ঈটান?

নাৎসি বাহিনীতে থাকা সকলের গায়ে গরম লোহার ছ্যাঁকা দিয়ে একটা দাগ বানানো হত। পার্মানেন্ট চিহ্ন। হুলিয়া। সেটারই সন্ধান করছিলেন ঈটান। পেয়েও গেলেন।

কাঙ্ক্ষিত নিশানের সন্ধান পেয়ে ঈটান মালকিনের দিকে তাকিয়ে ঘাড় নাড়লেন। মানেটা ছিল— হি ইজ আইখম্যান!

রাত ১০: ৫৫ নাগাদ গাড়িগুলো গিয়ে থামল ‘দ্য বেস’-এর সামনে। এটা সেই অ্যাপার্টমেন্ট, যেখানে আইখম্যানকে ধরে এনে লুকিয়ে রাখা হবে বলে ঠিক করা হয়েছিল। আইখম্যান অপহরণকারীদের মাঝে টলতে টলতে বাড়ির ভেতর ঢুকল। তার পোশাক খুলে সারা শরীর তল্লাশি করে নিল এজেন্টরা। হাঁ করিয়ে দেখে নেওয়া হল তার মুখের ভেতরটাও।

এরপর আরম্ভ হল ইনটারোগেশন। সবটাই জার্মান ভাষায়। টুপি কিংবা জুতোর মাপ, জন্মদিনের তারিখ, বাবা-মায়ের নাম এসব জিজ্ঞাসা করা হল। সে-ও রোবটের মতো জবাব দিতে থাকল।

‘তোমার জার্মান নাৎসি পার্টির কার্ড নম্বর?’

‘৪৫৩২৬।’

‘তোমার এসএস নম্বর?’

‘৬৩৭৫২।’

‘নাম?’

‘রিকার্ডো ক্লিমেন্ট।’

‘তোমার নাম কী-ই?’

দ্বিতীয় বারে সে উত্তর দিল, ‘অটো হেনিংগার।

তৃতীয় বার জিজ্ঞাসা করা হল, ‘তোমার নাম জানতে চাওয়া হচ্ছে।’

‘অ্যাডলফ আইখম্যান।’

জবাব শুনে সব এজেন্ট নিজেদের মধ্যে দৃষ্টি বিনিময় করলেন। এত সহজে যে সে নিজের পরিচয় স্বীকার করবে এটা কেউই ভাবেনি।

এবার নিজে থেকেই মুখ খুলল সে, ‘আমি অ্যাডলফ আইখম্যান। আপনারা ইসরায়েলি, তাই তো? শুনুন, হিব্রু কিছুটা জানি। ওয়ারশতে একজন রাবাইয়ের কাছে শিখেছিলাম।’

হ্যারেলকে তাঁর দলের দুজন সদস্য ওই রাতেই একটা ক্যাফেতে গিয়ে খবরটা দিলেন। আইখম্যানের স্বীকারোক্তির কথা শুনে দারুণ খুশি হলেন হ্যারেল।

এদিকে আইখম্যানকে ধরার পর ইসরায়েলি এজেন্টদের যতটা আনন্দ হয়েছিল, তার সঙ্গে একই ছাদের নীচে সময় কাটানো হয়ে উঠছিল ততটাই বিশ্রী ব্যাপার। যে খুনিটা এক সময়ে তাঁদের পরিজনদের হত্যা করেছে, সেই লোকটাকেই যত্ন করে লুকিয়ে রাখতে হচ্ছিল। দিন-রাত ২৪টা ঘণ্টা তার সমস্ত দরকার মেটাতে হচ্ছিল এজেন্টদেরই। আইখম্যানকে কোনো সময়েই একদমই একা ছাড়া হচ্ছিল না, এমনকী টয়লেটেও তাকে একা যেতে দেওয়া হচ্ছিল না। আর যাইহোক, তাকে আত্মহত্যা করতে দেওয়া যাবে না।

য়েহুডিথ নিসিয়াহু আইখম্যানের জন্য রান্না করতেন এবং তাকে খেতেও দিতেন। কিন্তু তার এঁটো বাসন ধুতেন না। আইখম্যানকে তীব্র ঘেন্না করতেন যে। প্রতি ২৪ ঘণ্টা অন্তর পালটে পালটে তাঁরা পাহারায় থাকতেন।

‘দ্য বেস’-এ কাটানো ১০ দিন ছিল তাঁদের জীবনের দীর্ঘতম দশটা দিন। সময় যেন কাটতেই চাইছিল না। আর ধরা পড়ার একটা ভয় তো সবসময়ই মাথায় ঘুরছিল।

আইখম্যানের সঙ্গে কথা বলত একমাত্র আহারোনি। আইখম্যান তার অপহরণকারীদের সব কথাই বিনা বাক্যব্যয়ে মেনে নিচ্ছিল। সে যেন নিজেকে ভাগ্যের হাতে সঁপে দিয়েচ্ছিল।

এদিকে আর্জেন্টিনাতে আইখম্যানের খোঁজ শুরু হয়ে গেছে। খোঁজ নেওয়া হচ্ছে হাসপাতালে, মর্গে ও থানায়। আর হ্যারেলের কানেও পৌঁছেছে এই কথা। তিনি তার টিমকে নির্দেশ দিয়েছিলেন— আইখম্যানকে কোনোভাবেই হাতছাড়া করা যাবে না। ঘরের ভেতর আরেকটা গুপ্ত ঘর বানানো হয়েছে যাতে পুলিশ এলে তাকে লুকিয়ে রাখা যায়। এমারজেন্সিতে তাকে বাইরে বার করার জন্য একটা আলাদা দরজার ব্যবস্থা করা হয়েছিল।

হ্যারেল অবশ্য এসব কিছু মাথায় রেখে বলেছিলেন, ‘যদি এর মধ্যে আর্জেন্টাইন পুলিশ তোমাদের নিতান্তই ধরে ফেলে, তাহলে একজন এজেন্ট একটা হাতকড়ার একদিক নিজের হাতে লাগাবে, আর অন্য দিকটা লাগাবে আইখম্যানের হাতে। তারপর হ্যান্ডকাফটার চাবিটা ছুড়ে ফেলে দেবে, যাতে কেউ খুঁজে না পায়। আর পুলিশকে বলবে যে, তোমরা ইসরায়েলি। হলোকাস্টের ঘৃণ্য অপরাধী আইখম্যানকে গ্রেফতার করেছ। তার বিচার হবে। এরপর তোমরা আমার নাম আর আমার হোটেলের ঠিকানাটাও দিয়ে দেবে। যদি তোমরা ধরা পড়ো, তাহলে আমারও অ্যারেস্ট হওয়া উচিত।’

এর কয়েক দিন পর মোসাদের টিম আইখম্যানের কাছ থেকে একটা লিখিত জবানবন্দি নেয়। তাতে সে লেখে যে, সে স্বেচ্ছায় বিচার প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করার জন্য ইসরায়েল যেতে প্রস্তুত।

১৮ মে তেল আভিভের নিকটবর্তী লড ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট থেকে ইসরায়েল এয়ারলাইন্সের ‘হুইসপারিং জায়েন্ট’ নামক বিমানটি ছাড়ল আর্জেন্টিনার উদ্দেশে। ইসরায়েলি প্রতিনিধি দল ছাড়া বিমানে কয়েক জন সাধারণ যাত্রীও ছিল। রোমে পৌঁছানোর পর আরও ৩ জন যাত্রী উঠল। কয়েক ঘণ্টা পরে তারা এয়ারলাইন্সের কর্মীদের ইউনিফর্মে বিমানের করিডরের মধ্যে চলাফেরা করতে লাগল। তাঁরা ছিলেন মোসাদ এজেন্ট। এদের মধ্যে একজনের নাম য়েহুদা কারমেল। মাত্র কয়েক দিন আগেই তাঁর বস তাঁকে নিজের চেম্বারে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। টেবিলের ওপর রাখা একটা ছবিতে তাঁর চোখ আটকে যায়। ওই ছবির সঙ্গে কারমেলের চেহারার অসম্ভব রকমের মিল ছিল। ছবিটা দেখেই সে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘এটা কার ছবি?’

‘অ্যাডলফ আইখম্যানের।’

এবার আরও বেশি অবাক হওয়ার পালা। তাকে জানানো হল যে, আইখম্যানের ডামি বা নকল হিসাবে তাঁকে একটা মিশনের জন্য আর্জেন্টিনা পাঠানো হবে। হ্যারেলের প্ল্যানই ছিল কারমেলকে একজন ইসরায়েল এয়ারলাইন্সের কর্মী হিসাবে আর্জেন্টিনায় নিয়ে যাওয়া ও তারপর তার ইউনিফর্ম আর পরিচয়পত্র ব্যবহার করে আইখম্যানকে তার জায়গায় ইসরায়েলে পাঠিয়ে দেওয়া। কারমেল যে পাসপোর্ট ব্যবহার করে আর্জেন্টিনায় গিয়েছিলেন সেখানে তাঁর নাম ছিল জিভ জিকরোনি।

আরেকটা ব্যাকআপ প্ল্যানও তৈরি করেছিলেন হ্যারেল। বুয়েনস আইরেসে এক আত্মীয়ের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন এক ইসরায়েলি ব্যক্তি মির বার- হোন। হ্যারেলের কাছে সেই খবর ছিল। হ্যারেল তাঁকে ডেকে পাঠিয়ে বললেন, ‘তুমি যখন তোমার আত্মীয়ের বাড়ি ফিরবে তখন তুমি ব’লো যে, তোমার একটা গাড়ি দুর্ঘটনা হয়েছিল আর তারপর থেকে তোমার মাথা ঘুরছে, গা গোলাচ্ছে আর খুব দুর্বল লাগছে। বলবে, ডাক্তার ডাকুন। ডাক্তার এসব দেখে খুব সম্ভবত তোমাকে হাসপাতালে ভর্তি হতে বলবে। তুমি হাসপাতালে ভর্তি হয়ে যাবে।

১৯ মে তুমি বলবে যে, তুমি এখন ভালো আছ এবং বাড়ি যেতে চাও। তোমাকে হাসপাতাল থেকে ডিসচার্জ করে দেবে এবং ডিসচার্জ সার্টিফিকেটে লেখা থাকবে তোমার অসুস্থতার বিবরণ।’ উপসর্গগুলোর নিখুঁত বিবরণ অবশ্য দিয়ে দিলেন ডক্টর ইলিয়ন।

মির বার-হোন শুধু অক্ষরে অক্ষরে হ্যারেলের আদেশ পালন করলেন। ৩ দিন ধরে তিনি বুয়েনস আইরেসের একটা হাসপাতালে পড়ে পড়ে অভিনয় করে গেলেন। ১৯ মে হাসপাতাল থেকে ছাড়াও পেলেন। আর তার এক ঘণ্টার মধ্যে হ্যারেলের হাতে পৌঁছে গেল তাঁর ডিসচার্জ সার্টিফিকেট, যাতে লেখা ছিল মির বার-হোনের গাড়ি দুর্ঘটনার ফলে লাগা আঘাতের চিকিৎসা করা হয়েছে।

এবার যদি আইখম্যানকে ইসরায়েল এয়ারলাইন্সের কর্মী হিসাবে পাঠানোর প্ল্যান ব্যর্থ হয়, তখন তাকে স্ট্রেচারে শুইয়ে মির বার-হোন হিসাবে বিমানে পাঠিয়ে দেওয়া হবে— এটাই ছিল হ্যারেলের পরিকল্পনা।

১৯ মে। ইসরায়েলের বিমান বুয়েনস আইরেসে অবতরণ করল। এই বিমানের ফিরে যাওয়ার কথা ২০ মে’র মধ্যরাতে।

হ্যারেল শেষ পর্যন্ত ঠিক করলেন, আইখম্যানকে ইসরায়েল এয়ারলাইন্সের কর্মী হিসাবেই পাঠাবেন। য়েহুদা কারমেল তাঁর ইউনিফর্ম আর ডকুমেন্ট মোসাদ টিমকে দিয়ে দিয়েছেন। এক্সপার্ট সালোম দানি ডকুমেন্টগুলোকে আইখম্যানের ছবির সঙ্গে মিলিয়ে এমনভাবে তৈরি করে দিলেন যে কারো সাধ্য নেই তাকে ধরে। কারমেলকে নতুন ডকুমেন্ট দিয়ে বলে দেওয়া হয় যেন কিছু দিনের মধ্যেই তিনি আর্জেন্টিনা ছেড়ে ইসরায়েলের ফিরে যান।

ওদিকে ‘দ্য বেস’-এ তখন আইখম্যানকে পাঠানোর তোড়জোড় চলছে। তাকে মাদক দিয়ে অচৈতন্য করা হল। তারপর আরম্ভ হল ক্লিনিং— অর্থাৎ, বাড়ি থেকে মোসাদ এজেন্টদের সমস্ত চিহ্ন মুছে ফেলার কাজ। এই ক’দিন ঘরে কী হয়েছে তার কোনো ট্রেস রইল না। বাকি যে বাড়িগুলোতে অন্য সদস্যরা ছিল সেখানেও একই কাজ করা হল।

২০ মে। রাত ৯টা। সব তৈরি। আইখম্যানকে স্নান করিয়ে, শেভ করিয়ে ইসরায়েল এয়ারলাইন্সের কর্মীদের ইউনিফর্ম পরিয়ে দেওয়া হল। তার পকেটে দেওয়া হল জিভ জিকরোনি নামের পরিচয়পত্র। ডাক্তার এবার আইখম্যানকে এমন একটা ইনজেকশন দিলেন যাতে সে ঘুমিয়ে পড়বে না ঠিকই, তবে তার চেতনাও পুরোপুরি থাকবে না। সে দেখতে পাবে, শুনতে পাবে এমনকী হাঁটতেও পারবে কিন্তু সে কোনো প্রতিক্রিয়া দিতে পারবে না।

হ্যারেল প্রত্যেক মোসাদ এজেন্টের জন্য আর্জেন্টিনা থেকে বেরোনোর আলাদা প্ল্যান তৈরি করেছিলেন। কিন্তু সব ঠিক থাকলে তারা এই বিমানে করেই যেতে পারবে। আর তার ব্যবস্থা করেই রেখেছে সালোম দানি। সকলের নকল পাসপোর্ট ও নকল স্ট্যাম্প সবকিছুই ছিল তৈরি।

রাত ১১টায় মোসাদ ও ইসরায়েল এয়ারলাইন্সের গাড়ি একে একে হাজির হল পার্কিং লটে। হ্যারেল যে গাড়িতে আইখম্যান ছিল তাদের উদ্দেশে বললেন–‘গুডলাক’। তারপর তিনি ছুটলেন টারমিনালের দিকে। তাকে বিমান ধরার জন্য চেক ইন করতে হবে যে। আইখম্যানকে বিমানকর্মীর ইউনিফর্মে বিমানে তোলা হল। দুজন ধরে ধরে আইখম্যানকে বিমানে নিয়ে গেল। তাকে বিমানে একটা উইন্ডো সিট দেওয়া হল। বাকি সবাই আইখম্যানকে কভার করে সিট দখল করল।

বাকি মোসাদ এজেন্টরা সকলে সাধারণ যাত্রী হিসাবেই বিমানে উঠলেন। হ্যারেলও ছিলেন। সালোম দানি প্রত্যেকের পাসপোর্ট এবং অন্যান্য কাগজপত্র এতটাই নিখুঁতভাবে বানিয়েছিল যে কারোর কোনো সন্দেহই হয়নি।

রাত ১২:০০। বিমান টেক অফ করার সময় হয়ে গেছে। হঠাৎ কন্ট্রোল টাওয়ার থেকে বলা হল, ‘প্লেন টেক অফ করবে না। পরবর্তী নির্দেশ না পাওয়া অবধি অপেক্ষা করুন!’ প্রত্যেকের তখন উত্তেজনায় ঘাম ছুটছে। হলটা কী? আর্জেন্টিনার পুলিশ কি খবর পেয়ে গেছে? এবার কি সবাই ধরা পড়ে যাবে? কয়েক মিনিটের রুদ্ধশ্বাস অপেক্ষার পর অবশেষে টেক অফ করার সিগনাল পাওয়া গেল। ধড়ে যেন প্রাণ ফিরল সবার। হ্যারেল স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন।

২২ মে সকালে বিমান লড বিমানবন্দরে ল্যান্ড করল। সকাল ৯:৩০টায় হ্যারেল বেন-গুরিয়নের অফিস পৌঁছলেন। হ্যারেলকে দেখে তিনি অবাক হয়ে বললেন, ‘আরে, তুমি কখন এলে?’

হ্যারেল বললেন, ‘জাস্ট দু’ ঘণ্টা আগেই…।’ আইখম্যানকে যে তাঁরা ধরে এনেছেন সে কথাও প্রধানমন্ত্রীকে জানালেন। কিন্তু এটা জানার পরও বেন- গুরিয়নের কোনো ভাবান্তর হল না।

তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘যাকে ধরে এনেছ, তুমি নিশ্চিত যে সে-ই আইখম্যান? ওই লোকটার বিরুদ্ধে যে কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার আগে যারা আইখম্যানকে দেখেছে, তাদের মধ্যে কয়েক জনকে ডেকে আনো। শনাক্তকরণ করা হোক।

হ্যারেলের নির্দেশ পালন করলেন। আইখম্যানকে চেনে বা দেখেছে এমন লোক আইখম্যানের সেলে গেল, কথা বলল ও তাকে শনাক্তও করল।

২৩ মে বিকেল ০৪:০০-তে বেন-গুরিয়ন নেসেটে ঘোষণা করলেন ৬০ লক্ষ ইহুদির হত্যাকারী আইখম্যানকে ইসরায়েলে ধরে আনা হয়েছে।

১৯৬১ সালের ১১ এপ্রিল থেকে আইখম্যানের বিচার শুরু হয় জেরুসালেমে। বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ার পর ১৯৬১ সালের ১৫ ডিসেম্বর তাকে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেওয়া হয়।

আইখম্যানকে এভাবে অপহরণ করে আনার ঘটনায় গোটা দুনিয়া সেদিন ইসরায়েলের নিন্দা করেছিল। বিচার প্রক্রিয়া ও শাস্তিদান দেখে মানবিকতার দোহাই দিয়েছিল অনেক দেশই। আর্জেন্টিনা বলেছিল— একটি স্বাধীন দেশের সার্বভৌমত্বে হস্তক্ষেপ করেছে ইসরায়েল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চিন, ফ্রান্স, ব্রিটেন সবাই আর্জেন্টিনার পাশে দাঁড়িয়েছিল। ইউনাইটেড নেশনস ইসরায়েলকে সতর্ক করেছিল, ভবিষ্যতে এরকম ঘটনা না ঘটে।

তবে আইখম্যানের বিচার শুধুমাত্র একজন অপরাধীর বিচার নয়। এ ছিল পৃথিবীর সামনে ভয়ানক নাৎসি বর্বরতার দলিল উন্মোচনের আয়োজন। হলোকাস্টের বীভৎসতা যাতে পৃথিবীর সামনে না আসে তার জন্য নাৎসিরা প্রায় সমস্ত প্রমাণ লোপাট করে দিয়েছিল। আইখম্যানের বিচার গোটা দুনিয়ার চোখ খুলে দেয়। পৃথিবী জানতে পারে হলোকাস্টের বীভৎসতার কাহিনি। আসলে আইখম্যান ছিল হলোকাস্টের সিম্বল, আর সেই চিহ্নটাকে বিশ্ববাসীর সামনে মেলে ধরে ইহুদিরা নিজেদের পিতৃপুরুষদের সম্মান জানিয়েছিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *