তৃতীয় খণ্ড (স্নেহের চুমকিকে)
3 of 6

কোথায় কী

কোথায় কী

বনেদি মানুষের বনেদি ব্যাপার। ক্যালেন্ডারে মাস যেই শেষের পাতায় এসে কদম সাতেক এগিয়েছে, অমনি তাঁর শরীরে চেপে বসল নিভাঁজ গরম কোট। ফ্রেশ গরম ট্রাউজার। ইংলিশ ডিজাইনের শার্ট। বুকের কাছে দোল খাচ্ছে সিল্কের চওড়া নেকটাই। ঝকঝকে টাইপিন। কোটের বুকপকেট থেকে উঁকি মারছে দামি রুমালের লাজুক লেজ। পায়ে ঝকঝকে অকসফোর্ড শু। সংখ্যায় এঁরা কমে এলেও হঠাৎ হঠাৎ বেরিয়ে পড়ল কলকাতার রাস্তায়। কোথায় শীত তার ঠিক নেই। লোকে তালপাতার হাতপাখা নিয়ে ঘুরছে। গ্রে সার্জের শুট পরে কলকাতার খানাখন্দ টপকে চলেছেন এক কেতাবী মানুষ। পায়ে ডার্কট্যান ঝকঝকে অল-লেদার অকসফোর্ড শু। এইসব মানুষ অতীতে বসবাস করেন এবং আন্তরিক ভাবেই করেন।

ভীষণ উতলা হয়ে খুঁজতে থাকেন, কোথায় কমলালেবু। কোথায় কমলালেবু। নাগপুর টাগপুর হলে কমলা চলবে না, দার্জিলিং-এর কুয়াশা মাখা পাতলা খোসার চাই। যার ত্বকের অসংখ্য বিঁদ থেকে তেলের আভাস বেরিয়ে আসছে। শীত, শিশির, সোনালি রোদ, কমলালেবু, ইডেনে টেস্ট-ক্রিকেট। শীতের এরাই হল সভাসদ। কোথায় কমলালেবু? দার্জিলিং-এর রাজনীতিতে পাহাড়ের উপহার সমতলে আর নামতে পারে না। দেশের চেয়ে এখন রাজনীতি বড়, ভালোবাসার চেয়ে ঘৃণা। সত্যেন দত্ত বাংলার রূপ বর্ণনায় লিখেছিলেন, মাথায় যাহার কমলার ফুল। সেই সিলেট কেটে বেরিয়ে গেছে! দেশ বিভাগের তারোয়ালে কাটা পড়ছে আরও অনেক জেলা।

বিক্রেতা বললে, ‘সায়েব, এই তো কমলা।’ সায়েবটা অবশ্য সে শ্রদ্ধায় বলেনি, বলেছে ব্যঙ্গে। স্বাধীন ভারত একটি জিনিসকে চিরতরে হত্যা করেছে, সেটি হল বনেদিয়ানা। বনেদি কালচার। নব্বুই কোটির দেশে ওসব চলবে না। বনেদি সায়েবি মানুষটি অবাক হয়ে তাকালেন। যাকে পাতিলেবু ভেবেছিলেন, সেই জিনিস হল কমলালেবু। গত চল্লিশ বছরে সব কিছুর আকার-আকৃতি কমেছে। বেড়েছে শুধু বাড়ির আকার। তল থেকে বহুতল। আর বেড়েছে কালো টাকার পরিমাণ।

বনেদি মানুষটি এইবার উতলা হয়ে উঠলেন, ‘চিড়িয়াখানা।’ বড়দিনের মুখোমুখি একটা দিন সপরিবারে চিড়িয়াখানায় নয় ‘জু’-তে যেতে হবে। বনেদি মানুষরা এখনও ‘জু’-ই বলেন। কোথায় সেই চল্লিশের চিড়িয়াখানা। কোথায় সেই মায়াবী ময়দান। উত্তর থেকে একটি কালো সেডানবডি গাড়ি আসছে। যে গাড়িতে হাত-পা ছড়িয়ে স্বচ্ছন্দে ছ-সাত জন বসতে পারেন। গাড়ির চালক আমার এই বনেদি মানুষটি। বয়েসে তরুণ। সামনে সিঁথি। দু-ভাগ করা চুল। পমেড দিয়ে পাঠ করা! হালকা হেয়ার ব্রাশে চকচকে। যেন রুডলফ ভ্যালেন্টিনো। ঠোঁটে লম্বা সিগারেট! পরনে থ্রি পিস শুট। গাড়ির অন্যান্য যাত্রীদের দিকে তাকালে মনে হবে একগাড়ি সুখ ও শৌখিনতা চলেছে। ফুলোফুলো, তুলতুলে চেহারার এক জোড়া শিশু। পশমের সোয়েটারে কাবুলি বেড়ালের মতো নরম। মেয়েরা যেন সব সে যুগের কানন দেবী। গাড়ির পেছনে চলেছে ফলের টুকরি। সদ্য-তৈরি খাবার ঘি আর মশলার গন্ধে গাড়ির গন্ধকে চাপা দিয়ে দিয়েছে। মেয়েদের খোঁপায় একটি করে সাদা গোলাপ। গাড়ির কালো ভেলভেটের আসনে ধবধবে সরু সরু আঙুল। কোনও আঙুলে লাল রুবি, কোনও আঙুলে হীরে। বুকের কাছে দুলছে পেনডান্ট। কখনও হাসি, কখনও এক কলি গান, নীচু সুরে। বাচ্চারা মাঝে মাঝে লজেনস ফেলছে মুখে। মেয়েরা মুখে দিচ্ছে বড় এলাচের দানা। দাঁতে কাটছে কেউ লবঙ্গ।

উত্তর থেকে গাড়ি আসছে হয় চিৎপুর ধরে। না হয় কলেজস্ট্রিট। অথবা সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ। চিৎপুরে লেগে থাকত বাবু কালচারের শ্যাওলা! বনেদি বাড়ির গাড়ি বারান্দা। ঢালাই-করা গ্রিল। নেপাল হালুইকরের সাইনবোর্ড। নবীন ময়রার রসগোল্লা। কাঠের ব্লক তৈরি করছে গরানহাটার মিস্ত্রিরা। রাজস্থানী মারবেলের দোকানে পাথরে ছেনি ঠুকছে যোধপুরী শিল্পী। ওরিয়েন্টাল সেমিনারি দেখিয়ে মেয়েরা ছেলেদের বলেছে-রবি ঠাকুরের স্কুল। জোঁড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির ছাদে রবিশূন্য শীতের নীলচে মন-কেমন-করা আকাশ। নাখোদার মিনারে ঝকঝকে মোজেকের কাজ। তলায় লখনৌয়ের আতরওয়ালা ছোট ছোট তুলো জড়ানো কাঠি নিয়ে বসে আছে। শালের আঁচলে কাশ্মিরী কাজ। শীতের গন্ধ মাস্ক, রোজ, জিরানিয়াম। রয়ালের তাওয়ায় কাবাবের গুলি চনমন করছে।

কলেজ স্ট্রিট ধরে গাড়ি এল। ভালো-ভালো দোকান। শাড়ি। পশম। গন্ধদ্রব্য। সিনেমার মাথায় সে যুগের নায়ক-নায়িকা। নামকরা থিয়েটার রংমহল, শ্রীরঙ্গম। সাদামাটা থিয়েটারের পোস্টারে বাঘা বাঘা নাম। বিখ্যাত সব নাট্যকারের সাড়া-জাগানো পালা। হেদুয়ার ডানপাশে বিখ্যাত সন্দেশ পাড়া। বাঁ-পাশে স্বটিশ। স্বনামধন্যদের উদ্ভব কেন্দ্র। এসে গেল সেনেট বিশাল বিশাল থামের মাথায় রোমান ধাঁচের ছাঁদ। শীতের পায়রায় চেকনাই খোলে। থাম আর ছাদের খাঁজ থেকে নধর পায়রারা বেরিয়ে এসে গলা ফুলিয়ে দুলে দুলে বলতে চাইছে, বিশ্ব-বিদ্যালয় শান্তির স্থান। মেডিক্যাল কলেজের বিশাল গেট, বিপুল ফয়ার, রোমক সেনেটের ধরনের সোপান শ্রেণি, শীতে খানিক মৃত্যুর শীতলতা মিশিয়ে, মনে খানিক প্রিয়জন হারানোর বেদনা জাগিয়ে, পেছনে সরে গেল। গাড়ি চলে এলো ডক্টর বিধান রায়ের বাড়ির সামনে। সাঙ্গুভ্যালি। কমলালয়। বাঁয়ে বেঁকে বিখ্যাত মেট্রো। সায়েবপাড়া এসে গেছে। লনচ্যানি হোর্ডিং-এ। ডেবোরা কার। হোয়াইটওয়ে।

ময়দান যত এগিয়ে আসছে সবুজ-সবুজ গন্ধ। আরও শীত। আরও নীল বাতাস। মনুমেন্ট আকাশের নীল খুঁজছে। অবশেষে জু। সেই বিচিত্র বিলিতি গেট। জেব্রা রঙের সোয়েটার পরে বাচ্চাদের আর তর সইছে না। লন্ডন জু-এর মতো টিকিট কাউন্টার। গেট পেরিয়ে ভেতরে—ভিন্ন এক জগৎ। আরও আলো। আরও রোদ। বাঘের গন্ধ। পাখির গন্ধ। ফরসা মেয়েদের আরও ফরসা দেখাচ্ছে। এর কোথাও আফ্রিকা, কোথাও সুন্দরবন, পেরু, নিউগিনি, অস্ট্রেলিয়া, পাপুয়া। ডাকছে পাখি। হাঁক দিচ্ছে বাঘ। লেকে নেমেছে সাইবেরিয়ার শতশত পাখি। হায়! কোথায় সেই সব।

বনেদি মানুষটির শুট আছে। সে জেল্লা নেই। অকসফোর্ড জুতোর পালিশে আর মুখ দেখা যায় না। কোটের কাধ ভেঙে গেছে। সেডানবডি চোরবাজারে। তবু মাস শেষ পাতায় এলে তিনি হ্যাঙার থেকে শুট নামান। মনে মনে খোঁজেন কমলালেবু আর ফ্যামিলি অ্যালবামে তাকান, সেই সুন্দরীদের খোঁজেন। যারা ছিল সেদিনের সঙ্গী।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *