কোটা নাকি মেধা? জন্ম নাকি কর্ম?
অপরিকল্পিত কোটাব্যবস্থা হলো একটি দরিদ্র রাষ্ট্রকে পঙ্গু করার সর্বোত্তম উপায়। চাকরিতে দীর্ঘমেয়াদি কোটাব্যবস্থা বৈষম্য হ্রাস না করে বৃদ্ধি করে। এই ব্যবস্থা গরিব দেশের অগ্রগতির অন্তরায়। অবহেলিত জনগোষ্ঠীকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য শিক্ষিত ও দক্ষ করার ব্যবস্থা করতে হয়। পশ্চাৎপদ মানুষকে এগিয়ে নিতে প্রয়োজন হয়। বিনামূল্যে আধুনিক শিক্ষার ব্যবস্থা। আর তাদের জন্য কোটাব্যবস্থা থাকলে সেটারও নির্দিষ্ট মেয়াদ থাকবে। শত বছর ধরে কোটাব্যবস্থা চলতে পারে না। চাকরিতে কোটা থাকবে প্রতিবন্ধীদের জন্য। কারণ তারা প্রাকৃতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। কোটা থাকা দরকার হিজড়াদের জন্য। কারণ এই লিঙ্গের মানুষগুলো সমাজে নিগৃহীত। সমাজে তারা খুবই অবহেলিত।
আমার পাশের টেবিলের অযোগ্য সহকর্মী যদি বাবার সাহসিকতার সনদ দিয়ে চাকরি পান, তাহলে আমার কাজের স্পৃহা হ্রাস পাবে। এটা হলো খুবই সাধারণ একটি বিষয়। উন্নত দেশে প্রতিযোগিতা টিকিয়ে রাখা হয় কেন? কারণ এতে নেট প্রডাক্টিভিটি বাড়ে। টিকে থাকার জন্য সবাই সর্বোচ্চ চেষ্টাটা করেন। সমাজের অগ্রগতি হয় দ্রুত। তাছাড়া যে বিষয়ের ওপর আমার হাত নেই, সেটার কারণে আমি ক্ষতিগ্রস্ত হব কেন! আমার বাবা যদি যুদ্ধ করে। থাকেন, সেটা তিনি করেছেন। তিনি সম্মানিত হবেন। আমি যে তার। সন্তান, এটা তো আমি নির্ধারণ করিনি। তাঁর বীরত্বের সঙ্গে আমার জন্মের কোনো যোগসূত্র নেই। আমি যে কুমিল্লা জেলায় জন্মেছিলাম এতে আমার হাত নেই। আমি যে কোনো সরকারি চাকরিজীবীরা সন্তান (পোষ্য) নই, সেটাতে আমার হাত নেই। আমি যে কোন ৫ মইনরিটি গ্রুপে জন্ম নিইনি, সেখানে আমার হাত নেই। আমি যে = (২ানো মুক্তিযোদ্ধার সন্তান নই, সেখানেও আমার হাত ৯ ২ মানুষকে যেখানে শুধু জন্মের কারণে বঞ্চিত হতে হয়, সেখানে 5 বেতির অভিশাপ নেমে আসে। জন্মকে যখন কর্ম থেকে বড় করে। C. দেখা হয়, সেখানে কর্মবিশ্বাসীর সংখ্যা কমতে থাকে। কর্মস্পৃহ মানুষের সংখ্যাও হ্রাস পায়।
রাষ্ট্র একজন বীরের সন্তানদের খাবারের টাকা দেবে। পড়াশোনার জন্য খরচ দেবে। যোগ্য করার চেষ্টা করবে। বীরের সন্তান বলেই চাকরি দিয়ে ত্রিশ বছরের জন্য বসাতে পারে না। এটা খুবই আনপ্রডাক্টিভ! একটা সমাজ যখন এ ধরনের কাজ বছরের পর বছর করে, তখন বৈষম্য বাড়ে। মূল্যবোধ কমে। মিথ্যাশ্রয়ী ও সুযোগসন্ধানী মানুষের সংখ্যা বাড়ে। দীর্ঘদিন ধরে মুক্তিযুদ্ধ কোটা বহাল রাখায় বহু মানুষ নকল সার্টিফিকেট বানিয়েছে। সে মিথ্যা সার্টিফিকেট দিয়ে সুবিধা নিচ্ছে। সাম্প্রতিক প্রতিবেদনেও বলা হয়েছে দেশে প্রায় পঁচিশ হাজার ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদ আছে।
পশ্চাৎপদ এবং বঞ্চিত জনগোষ্ঠীকে তুলে আনার জন্য কোটার প্রয়োজন আছে। কিন্তু কোটাব্যবস্থার জন্য থাকতে হয় সুস্পষ্ট নীতি। সব চাকরিতে কোটা রাখা যায় না। কারণ সমাজে সবার কাজের ভূমিকা থাকলেও, সবার কাজের ইমপ্যাক্ট সমান নয়। যেমন ইউনিভার্সিটির শিক্ষক, প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা, আইনজীবী, হাসপাতালের ডাক্তার, গবেষক, বিজ্ঞানী ইত্যাদি পেশাগুলো হলো সমাজের ভিত। এই ধরনের পেশায় সর্বোচ্চ প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে নিয়োগ দিতে হয়। তা ছাড়া, কোটাব্যবস্থা একটা নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য চালু করা হয়। ধীরে ধীরে সেটাকে গুটিয়ে আনতে হয়। অথচ বাংলাদেশে প্রতিটি সরকার এই কোটাব্যবস্থাকে রাজনীতির সুবিধার্থে ব্যবহার করেছে। এক সরকারের চেয়ে অন্য সরকার আরও বেশি কোটাব্যবস্থা চালু করছে। এতে তাদের ভোট = তৈরি হয়। দুর্বল ব্যবস্থাপনার প্রতিযোগিতা তৈরি হয়েছে। রাজনীতিতে। ফলে কোনো সরকার আর কঠোর অবস্থানে তা পারে না। ভোট-ব্যাংক টিকিয়ে রাখার জন্য বরং আরও দুর্বল ব্যবস্থাপনা তৈরি করতে হয়। কী দুঃখজনক!
উন্নত দেশে কোটা আছে এবং সেটা প্রধানত মানুষকে শিক্ষিত হওয়ার সুযোগ দেওয়ার জন্য। তবে সেসব দেশে নকল সার্টিফিকেট তৈরির উপায় নেই। কিংবা কোটা দিয়ে একজন অযোগ্য ব্যক্তিকে চাকরি দেওয়া হয় না। শুধু ভোটের রাজনীতির জন্য যুগের পর যুগ। অপরিকল্পিতভাবে কোটাব্যবস্থা টিকিয়ে রাখা হয় না। প্রজন্মের পর প্রজন্ম সেটা চলে না। সব পেশার জন্য কোটা প্রয়োগ করা হয় না। দুনিয়ার বহু উন্নত সমাজে এখন চাকরিতে কোটাব্যবস্থাই প্রয়োগ। করা হয় না। ইউরোপ-আমেরিকায় বহু জাতের কিংবা ধর্মের লোকজন বাস করে। সেভাবে হিসাব করলে বহু শ্রেণির সংখ্যালঘ। সেসব দেশে আছে। তাই বলে কি ওরা কোটাব্যবস্থা পাচ্ছে?
বাংলাদেশের বেশির ভাগ মেধাবী ছেলেমেয়ের কোনো কোটা নেই। তাদের কোনো রাজনৈতিক যোগসূত্র নেই। ঘুষ দেওয়ার অর্থ নেই। ফোন করে সুপারিশ করার ক্ষমতাধর মামা নেই। সেসব ছেলেমেয়ে যখন সঠিক জায়গা থেকে বঞ্চিত হয়, রাষ্ট্রে তখন অভিশাপ নেমে আসে। এটাকে বলে ডিভাইন পানিশম্যান্ট–প্রাকৃতিক শাস্তি। যোগ্য ব্যক্তিরা যখন বঞ্চিত হন, তখন তাদের ভেতর কর্মস্পৃহা ও দেশপ্রেম হ্রাস পায়। সমাজের নেট প্রোডাক্টিভিটি কমে যায়। সমাজ পিছিয়ে পড়ে বহুগুণ। আমাদের রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রকেরা কি কখনো এটা উপলব্ধি করবেন!
সরকার সম্প্রতি কোটা বিলুপ্তির ঘোষণা দিয়েছে। প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির চাকরিতে কোটা না রাখার জন্য সুপারিশ করা হয়েছে। এটা খুবই যুগোপযোগী উদ্যোগ। এখন সেটা সঠিকভাবে বাস্তবায়নের মাধ্যমে, প্রতিটি ক্ষেত্রে মেধাবীদের মধ্যে তুমুল প্রতিযোগিতাকে প্রাধান্য দেওয়ার সময় এসেছে। তবেই বাংলাদেশ দাঁড়াবে দ্রুত ও শক্ত ভিতে।