কোজাগর – ৯

চিপাদোহরে কাজ ছিল। আমাদের কোম্পানির মালিক রোশনলালবাবুর সঙ্গে দেখা করতে হবে সেখানে। মুনাব্বর কাল বলে গেছে।

ডালমিয়া নগর, পাটনা, রাঁচি বা কলকাতায় না গেলে উনি রোজই বিকেলবেলায় ডালটনগঞ্জ থেকে চিপাদোহরে আসেন। প্রথমেই ডিপোতে ঘুরে আসেন একবার আলো থাকতে থাকতে। কত বাঁশ কোন্ জঙ্গল থেকে লাদাই হয়ে এসে সেখানে ঢোলাই হল, রেক্ কেমন পাওয়া যাচ্ছে? কত ওয়াগন মাল কোথায় গেল? সব খোঁজখবর নিয়ে তারপর ডেরায় ফেরেন।

এখন শীত, তাই সূর্য ডোবার আগে থেকেই ডেরার সামনে আগুন জ্বালানো হয়। ভয়সা ঘিয়ে ভাজা দুটি পানতুয়া এবং অনেকখানি চিনি দিয়ে এক কাপ দুধ খান উনি। চিপাদোহরের রোজকার বাঁধা বৈকালিক রুটিন রোশনবাবুর, এখানের সকলেই জানে।

যখন আসেন, তখন ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের কিছু লোক, রোহাটাস্ ইন্ডাস্ট্রিস, ইনডিয়ান পেপার পার্-এর কোনো লোক এবং স্থানীয় এবং ডালটনগঞ্জী বাঁশ-কাঠের ঠিকাদারদের কেউ কেউ আসেন। আগুন মধ্যে রেখে গোল হয়ে বসেন সকলে বেতের চেয়ারে। শীত বেশি থাকলে অফিস ঘরের খাপ্পার চালের নিচে মাথা বাঁচিয়ে আগুনের দিকে পা করে বসেন। টুকটাক গল্প হয়, কাজ শেষ হলে।

জংলি জায়গা, ছোটখাট খবর; কূপমণ্ডূকতার জগৎ এখানে।

শীতের দিনে মালিক রাত আটটা নাগাদ আর গরমের দিনে ন’টা নাগাদ উঠে চলে যান গাড়ি চালিয়ে। চল্লিশ কিলোমিটার পথ।

যতক্ষণ উনি চিপাদোহরে থাকেন, মেট মুনাব্বর, জঙ্গি জওয়ানের মতো চেহারা, ছ’ফিট লম্বা, সু-গঠিত কুচকুচে কালো পেটা শরীরের নীরব কর্মী, খাকি পোশাকে সটান দাঁড়িয়ে থাকেন গভর্নরের এ-ডি-সির মতো তার মালিকের ইজি চেয়ারের পাশে।

পাঁড়েজি ধবধবে ফিনফিনে, ফর্সা; খাঁটি ব্রাহ্মণ। বাড়ি আরা জেলায়। বেজাতের হাতে জল খান না। উনিও পায়ে নাগরা এঁটে, ধুতির ওপর গলাবন্ধ গরম দেহাতি পশমের কোট পরে প্রাণের দায়ে সিঁড়িতে উবু হয়ে বসে আগুন পোহান।

নানা জায়গা থেকে বেপারীরা আসে বাঁশ ও কাঠ কিনতে। সকলেরই খাওয়া-দাওয়া কোম্পানির ডেরায়, নিখরচায়। দূর দূর থেকে জঙ্গলের মধ্যে আসেন সকলে, যাঁরা দিনে দিনে ফিরতে না পারেন, তাঁদের রাতের শোওয়ারও ব্যবস্থা করতে হয়।

আমার মালিক লোক খারাপ নন। আমার বোন রানুর বিয়ের রাতে, আসবার সময় মা’কে তিনি বলেছিলেন, আপনি খুশি তো? কোনো কিছুতে খুঁত থাকলে আমাকে জানাবেন। ফুলশয্যার তত্ত্বের টাকাও আমি সায়নাবাবুকে দিয়ে গেলাম। কোনো ভাবনা নেই।

মা হাত তুলে আশীর্বাদ করে বলেছিলেন, সুখী হও বাবা।

কতরকম মানুষ দেখলাম এই দুনিয়ায়। আলাদা আলাদা তাদের চাওয়া, তাদের পাওয়া। একের কাছে যা সুখ, অন্যের কাছে তাই-ই অসুখ। যার সব আছে বলে অন্যদের ধারণা, তার মতো হাহাকারে ভরা মানুষ হয়ত দ্বিতীয় নেই। সুখ বা দুঃখকে আমরা নিজের নিজের পরিবেশ, মানসিকতা এবং অভিজ্ঞতা দিয়েই নিরূপণ করি, তাই নিজের সুখটাই অন্যের সুখ বলে মনে করি। ব্যক্তি বিশেষে, অবস্থা বিশেষে, পরিবেশ বিশেষে সুখের সংজ্ঞা যে কত পরিবর্তনশীল তা হৃদয় দিয়ে বোঝার ক্ষমতা আমাদের অনেকেরই নেই।

আজই দুপুরে এসেছিলাম ভালুমার থেকে ট্রাকে। আজ রাতটা চিপাদোহরেই কাটিয়ে ভোরে আবার মুনাব্বর-এর সঙ্গে ট্রাক নিয়ে গিদাই ড্রাইভারের সঙ্গে ভালুমার ফিরে যাব। এই চিপাদোহরেরই মেস্-এর রাঁধুনি বামুন লালটু পাণ্ডে। এমন একজন সৎ, পবিত্র চরিত্রের, কবি-স্বভাবের শান্ত চেহারার নির্মল মানুষ খুব কমই দেখেছি। লালটুর উজ্জ্বল অপাপবিদ্ধ চোখের দিকে তাকিয়ে আমার চিরদিনই নিজেকে বড়ো ছোটো লাগে। মানুষটার ছোটখাটো চেহারাও এই বন-পাহাড়েরই মতো খোলামেলা। মনে কোথাও এতটুকু কলুষ নেই।

লালটুর বাড়ি গাড়োয়াতে, খিলাওন্ গ্রামে। জাতে ও পূজারী বামুন। পূজাপাঠ করার কথা, আর করছে রাঁধুনি বামুনের কাজ। কিন্তু যে যত্ন ও নিষ্ঠার সঙ্গে ও রান্না করে, এবং এক-একবেলা পঞ্চাশ-ষাটজন লোককে আদর করে খাওয়ায়; তাতে তার পূজা-পাঠের চেয়ে কিছু কম পূর্ণ হয় বলে আমার মনে হয় না।

দোষের মধ্যে লালটুর একমাত্র দোষ একটু ভাঙ খাওয়া। ওকে ভালোবাসি বলে একটু বললাম কিন্তু ভাঙ ও বেশ বেশিই খেতো। মৌরী, গোলমরিচ, গোলাপ ফুল, শশার বীচি, পোস্ত এসব দিয়ে ভাঙ বেটে এবং সন্ধে লাগতে না লাগতেই তা খেয়ে মত্ত হয়ে থাকে ও। এবং ভাঙ খেলেই লালটুর মন বিরহী হয়ে ওঠে। মনে মনে সে তার প্রোষিতভর্তৃকা স্ত্রীকে কবিতা লেখে এবং তার স্ত্রীর জবাবও নিজেই রচনা করে।

গভীর জঙ্গলের মধ্যে কুলি মজুরদের সঙ্গে দিন কাটায় বলেই কাউকে অশিক্ষিত বলা যায় না। তাছাড়া স্কুল-কলেজে আমরা যা শিখেছি, সেইটেই শিক্ষা আর যারা স্কুলে-কলেজে পড়ার সুযোগ পায় না তাদের সব কিছুই অশিক্ষা একথা মনে করাটা বোধহয় ঠিক নয়। ঠিক নয় এই কারণে যে লালটু পাণ্ডের মতো অনেক মানুষকেই আমি নিজের চোখে দেখেছি। তাদের গ্রাম্য, নির্মল, নির্লিপ্ত পরিবেশ তাদের দারুণ কলুষহীন শিক্ষায় সুস্নাত করেছে। রামায়ণ মহাভারত থেকে তারা যে শিক্ষাকে নিজ নিজ জীবনে গ্রহণ করেছে, তাদের সঙ্গে আমার মতো দু-পাতা ইংরিজি-পড়া কেরানির ফালতু শিক্ষার কোনো তুলনাই হয় না। এ হচ্ছে একজন ভারতীয়র জন্মগত, সুসংস্কারগত শিক্ষা। তেমন লেখাপড়া শেখার সুযোগ পেলে লালটু যে যশস্বী কবি হতো এমন মনে করার যথেষ্টই কারণ ছিল।

রাতে খেতে বসে চিপাদোহরের লালটুকে নিয়ে অনেকেই রসিকতা করতেন। পরেশবাবু অনেকদিনের লোক। খেতে খেতে বললেন, আরে লালটু, শুনলাম তুই নাকি আজকাল হিদু-ড্রাইভারের বৌ-এর সঙ্গে লটর-পটর্ করছিস। তোর বৌ-এর প্রতি প্রেম কি উবে গেল?

গজেনবাবু বললেন, লেহ্ লটকা!

কিন্তু আমরা সকলেই জানতাম যে এসব মিথ্যে কথা। লালটু এবং লালটুর স্ত্রীর মতো দম্পতিই আদর্শ দম্পতি। এমন বিশ্বস্ততা এবং প্রেমই ভারতের আদর্শ। যা আমরা ভাবতেও পারি না। ক’জন শহুরে শিক্ষায় শিক্ষিত লোক শপথ করে বলতে পারেন যে, বিবাহিত জীবনে নিজের স্ত্রী এবং স্বামী ছাড়া অন্য কারো প্রতিই জীবনের দীর্ঘ পথে তাঁরা কখনও আকর্ষিত হননি? অথচ লালটুর মতো অরণ্যবাসের জীবনে, যেখানে পা-পিছলানো যায় এক টাকার বিনিময়ে জঙ্গলে, ঝোপে বা খড়ের গাদায় অক্লেশে এবং বিনা সমালোচনায়, সেখানেও সে পুরোপুরি বিশ্বস্ত। তার বিবাহিতা স্ত্রীই তার স্বপ্ন, তার আদর্শ। লালটু পাণ্ডের বুকে বসন্তের চাঁদনি রাতে তারই বিরহ-ভাবনা, প্রচণ্ড শীতের রাতে তারই কবোষ্ণতার উষ্ণতার স্বপ্ন। লালটু লালটুই!

পরেশবাবু যখন ঐ কথা বললেন, তখন লালটু খেসারির ডালের হাঁড়িতে হাতায় করে মনোযোগ সহকারে গাওয়া ঘি ঢালছিল। ঘুরে দাঁড়িয়েই হঠাৎ সে বলে উঠল—

“রোওশনী সুরজ সে হোতা হ্যায়
সিঁতারো সে নেহী,
মুহব্বত্ এক সে হোতা হ্যায়,
হাজারোসে নেহী।”

আমার গলায় রুটি আটকে গেল। এই শীতের রাতের লণ্ঠন-জ্বলা রান্না ঘরে কাঠের পিঁড়িতে বসে খেতে খেতে হঠাৎ এক আশ্চর্য জগৎ আমার চোখের সামনে খুলে গেল।

“আলো কেবল সূর্যই দিতে পারে।
তারারাও আলো দেয়; কিন্তু সে আলো কি আলো?
প্রেম হয় জীবনে একজনেরই সঙ্গে,
হাজার লোকের সঙ্গে কি প্রেম হয়?”

পরেশবাবু কথা ঘুরিয়ে বললেন, কি লালটু? তোর বউ এর চিঠি এলো না আর? কী লিখল সে চিঠিতে?

লালটুর স্ত্রী লেখাপড়া জানতো না। লালটুও জানে সামান্যই। কিন্তু লালটুর কল্পনাতে তার দূরের গ্রাম খিলাওন্ থেকে তার স্ত্রী নিত্য নতুন কবিতায় চিঠি পাঠাতো এবং লালটু তার জবাবও দিত কবিতায়। প্রতি সপ্তাহেই এমনি করে নতুন কবিতা শোনা যেত লালটুর কাছ থেকে।

পরেশবাবু বললেন, কী হল লালটু? এ সপ্তাহে খত্ আসে নি বুঝি?

এসেছে এসেছে। বলল, লালটু।

তারপর বলল, বউ লিখেছে :

“জল্‌কি শোভা কমল হ্যায়
ঔর থকি শোভা ফুল
ঔর মেরী শোভা আপ হ্যায় পতিদেব
হামে না যাইয়ে ভুল।”

অর্থাৎ, “জলের শোভা হচ্ছে গিয়ে পদ্ম আর স্থলের শোভা ফুল, আর আমার শোভা আপনি, আমার পতিদেব; আমাকে ভুলে যাবেন না।”

পরেশবাবু বললেন, জবাবে কী লিখলি তুই?

কী লিখেছি শুনুন—

“দিল্ তো করতা আউর মিঁলু
পরবীন্ উড়া না যায়,
কেয়া কহুঁ ভগওয়াসে কি
পঙ্খ দিয়া না জমায়।”

মানে, “প্রাণতো সবসময়েই করে যে তোমার সঙ্গে দেখা হোক, কিন্তু কী করব বল? আমি তো কবুতর নই যে, তোমার কাছে উড়ে যাব? ভগবান যে আমায় পাখাই দেন নি।”

আমাদের কোম্পানিতে যাঁরাই জঙ্গলের কাজে আছেন, তাঁদের মধ্যে প্রায় সবাই-ই অল্পবয়সি এবং ব্যাচেলর। এর মধ্যে গজেনবাবুই একমাত্র কনফার্মড ব্যাচেলর। বয়স হয় নি কিছুই, কিন্তু এরই মধ্যে কেমন বুড়োটে মেরে গেছেন। রসিক লোক। কিছু বটতলার বই, আর কামিনদের সঙ্গেই তাঁর সময় কাটে ভালো। মুখ দিয়ে সব সময় মদের গন্ধ বেরোয়। একেবারে ওরিজিনাল মানুষ। বিধাতা গজেনবাবুর প্রোটোটাইপ পৃথিবীর এদিকটিতে আর একটিও সৃষ্টি করেননি।

চিপাদোহরের রেলস্টেশনের ছোকরা অ্যাসিস্ট্যান্ট স্টেশন মাস্টার গণেশবাবু রোজ রাতে আসেন আড্ডা মারতে, এই ঠান্ডাতেও। মাথায় বাঁদুরে টুপি চাপিয়ে, হাতে টর্চ নিয়ে, লুঙ্গির ওপরে শেয়ালরঙা র‍্যাপার জড়িয়ে। ঘরের মধ্যে মাল্সার আগুনে ঘিরে বসে ওঁরা তাস-টাস খেলেন।

আমি কিছু পড়ার চেষ্টা করি।

রথীদা পাবলো নেরুদার ‘মেমোয়ার্স’, বইটা দিয়েছিলেন। মাঝামাঝি এসেছি। নেরুদার গদ্যটাও কবিতারই মতো। এর আগে রাসেলের ‘অটোবায়োগ্রাফি’ পড়িয়ে ছিলেন। তার আগে বার্নার্ড জিমিকের ‘সেরেঙ্গিটি শ্যাল নেভার ডাই’, তারও আগে থর হায়ারডালের ‘প্যাপিরাস্, কটিকি’। অদ্ভুত সব বিষয়ের ওপর বই। বিষয়ের কোনো সাযুজ্য অথবা মাথামুণ্ডু নেই।

অল্প ক’দিন আগে একটা বই পড়তে দিয়েছিলেন, গাছ-গাছালির যৌন জীবন, সংবেদনশীলতা এবং মানসিকতার ওপরে। বইটা এখনও পড়া হয় নি, পড়েই আছে। পড়তে হবে সময় করে। মাঝে মাঝে ভাবি, রথীদা এখানে না থাকলেও আমাকেও বোধহয় তাস পিটে, মাঝে মধ্যে মহুয়া বা রাম্ গিলে এবং সিনেমার ম্যাগাজিনে চোখ বুলিয়ে একবারেই অন্যদের মতো হয়ে যেতে হত। আমার “আমিত্ব” বলে কিছুই থাকতো না।

গজেনবাবু তাস ফেরাতে ফেরাতে বললেন, বাদলের বোনের বিয়ের কথা হচ্ছে কিন্তু গণেশ। এইবেলা মা-বাবাকে লিখে একটা ফয়সালা করে ফ্যাল। নইলে আঙুল চুষতে হবে পরে।

বাদল আমাদের টৌরীর কাজ দেখাশোনা করে। যদিও তার ওপরে আছেন কন্ঠেবাবু। নাম রেখেছেন গজেনবাবু, ক্যাট-জ্যাম্পিং রাইস। অর্থাৎ, উনি যে পরিমাণ ভাত থালায় নিয়ে খেতে বসেন তা কোনো হুলো বেড়ালের পক্ষেও লাফিয়ে ডিঙোনো সম্ভব নয়। বাদলের ছোট বোন চুমকি একবার চিপাদোহরে এসেছিল বাদলের সঙ্গে। কলেজে পড়ে। হাজারিবাগে না কোথায় যেন। চেহারাতে জয়া-ভাদুড়ী-জয়া-ভাদুড়ী ছাপ ছিল সামান্যই। মিষ্টি গলায় আরতি মুখার্জীকে নকল করে আধুনিক গান গাইত ভীষণ কাঁচা তেঁতুল খেতে ভালোবাসত। শুকনো লঙ্কার গুঁড়ো আর নুন মিশিয়ে।

চুমকির প্রেমে পড়ার পর চুরি জন্যে তেঁতুল পাড়তে গিয়ে গণেশ তেঁতুলগাছে উঠে পা-পিছলে ডালসুদ্ধ নিচে পড়েছিল। অতএব পা-ভেঙে তিনমাস ডালটনগঞ্জের হাসপাতালে। প্রাণ যে যায়নি, এই যথেষ্ট। কিন্তু বাদলের বোন চুম্‌কি অন্যান্য অনেক চুমকির মতোই আরো তেঁতুল খেয়ে ও আধুনিক গান গেয়ে ছুটি ফুরোলে আবার স্বস্থানে ফিরে গেছিল। গণেশকে হাসপাতলে একদিন দেখতে পর্যন্ত যায়নি।

গণেশ মাস্টার ছেলেটি একটু বেশিমাত্রায় রোম্যান্টিক। চাঁদ উঠলেই দেবব্ৰত বিশ্বাসের ঢঙে ‘আজ জ্যোৎস্নারাতে সবাই গেছে বনে’ গান গাইতে শুরু করে। শীতেই হোক, কী বর্ষাতেই হোক। তার মনে চুক্তি সম্বন্ধে একটা স্বপ্নিল কিছু গড়ে উঠেছিল। বাদলেরও আপত্তি থাকার কথা ছিল না, যদিও চুমকিকে কেউ বাজিয়ে দেখেনি, এই প্রস্তাবে সে চায় কি না

কিন্তু বাধা ছিল অন্যখানে।

লক্ষ লক্ষ নিরুপায় মধ্যবিত্ত বাঙালি চাকুরিজীবীর যেখানে বাধা। গণেশের বাবা সবে রিটায়ার করেছেন। দুটি ছোট বোন আছে, একজন অনেকদিনই বিবাহযোগ্যা। অন্যজনও বড় হয়ে উঠেছে। বোনেদের বিয়ে না হলে গণেশের বিয়ের প্রশ্নই ওঠে না।

আমাদের সকলেরই জানাশোনা এমন অনেক ছেলেও আছে যারা তাদের নিজেদের ব্যক্তিগত জীবন, নিজেদের ভবিষ্যৎ নষ্ট করে নি মা-বাবা, বা ভাই- বোনেদের মুখ চেয়ে। নিজের নিজের খুশিমতো বিয়ে করেছে, ছোট্ট সুখী স্বার্থপরতার দেওয়াল তুলে সংসার গড়েছে যারা। আশ্চর্য! তারা কিন্তু আজও ব্যতিক্রম। বেশিরভাগই গণেশদেরই মতো।

গণেশের বয়স হয়ত চল্লিশ পেরিয়ে যাবে দু-বোনের বিয়ে দিতে দিতে। তবুও হয়ত তাদের বিয়ে হবে না, কারণ তাদের মুখশ্রী নাকি গণেশরই মতো। যদিও গায়ের রঙ ফর্সা। কিন্তু তার ভবিষ্যৎ অন্ধকার জেনেও গণেশ অপেক্ষা করছে। এবং অপেক্ষা করবে।

ওদের ওইটুকুই আনন্দ। সারাদিন কাজের পর, এই তাসখেলা, এই গালগল্প, এই ছোটো জায়গার নানান কুৎসা ও রসের ভিয়েনে কোনোক্রমে হাঁপিয়ে-ওঠা অবকাশকে ভরিয়ে তোলা। সকালে দুটো আর বিকালে দুটো প্যাসেঞ্জার ট্রেন আসে যায় আপ-ডাউনে, আর কিছু মালগাড়ি। মাইনে ছাড়াও যে সামান্য উপরি রোজগার আছে তা দিয়েও বাড়িতে টাকা পাঠিয়ে লাউকির তরকারি আর অড়হড়ের ডাল ছাড়া কিছু খাওয়া জোটে না গণেশের। ওর ছুটির দিনে আমাদের চিপাদোহরের ডেরাতেই খায় গণেশ।

রোশনলালবাবু আমাদের সকলের কাছে বাদলের সমস্যার কথা শুনে একদিন বলেছিলেন, বুঝলে বাদল, দিয়ে দাও বোনের বিয়ে, গণেশের সঙ্গে। খরচের কথা ভেব না। কিন্তু সমস্যাটা বাদলের বোনের বিয়েজনিত ছিল না। ছিল, গণেশের দুই বোনের বিয়ে নিয়ে। সে কথা জেনে রোশনলালবাবু এও বলেছিলেন, লাগাও হে মাস্টার, এক বোনের বিয়ের খরচ আমিই দেব। যদি তাতে তোমার বিয়ে নির্বিঘ্ন হয় সেইমতো বাড়িতে চিঠিও লিখেছিল গণেশ বেচারা। কিন্তু বড়ো বোনের বিয়ে দেওয়া গেলেও ছোটো বোনের বয়স তখন পনেরো। মা, দুই বোনের বিয়ে দেওয়ার আগে ছেলের বিয়ের কথা মোটেই ভাবছেন না বলে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছিলেন।

আজকের দিনের অর্থনৈতিক কাঠামো মধ্যবিত্তদের মানসিকতার খোল-নলচে পালটে দিয়েছে। স্বামীর অবসর গ্রহণের পর পরিবারের রোজগারের একমাত্র উৎস, অ্যাসিস্ট্যান্ট স্টেশন মাস্টার ছেলের বিয়ে দিয়ে অজানা চরিত্রর পুত্রবধূর দয়া-নির্ভর হয়ে সেই উৎস হারাবার মতো সাহস গণেশের মায়ের ছিল না। আর্থিক অবস্থা অতি স্নেহময়ী বাঙালি মায়েদেরও বড়ো নিষ্ঠুর করে তুলেছে। পরেশবাবুর কাছে শুনেছি যে, গণেশের মা নাকি এ-ও লিখেছিলেন যে, বড়ো মেয়ের বিয়ের পর ছোটো মেয়ের এবং গণেশের বিয়ে একই সঙ্গে দেবেন যাতে ছেলের বিয়ের পণের টাকা দিয়েই ছোট মেয়ের বিয়েটাও হয়ে যায়।

লালচে বাঁদুরে-টুপি পরে বেঁটে-খাটো, ফর্সা, ছিপ্‌ছিপে গণেশ জোড়াসনে বসে তাস খেলছিল। ছোট্ট নাকটা বেরিয়ে ছিল টুপি থেকে আর মুখের একটা অংশ। লণ্ঠনের আলোটা স্থির হয়ে ছিল গণেশ-মাস্টারের মুখে। ঘরের কোণে, বসে, ওর দিকে চেয়ে, আমার হঠাৎই মনে হল যে, যারা যুদ্ধ করে, পাহাড় চড়ে, সমুদ্র ডিঙোয়, তারাই কি শুধু বীর? আর যারা তিল তিল করে নিজেদের যৌবন, নিজেদের সব সাধ-আহ্লাদ, নিজেদের খাওয়ার সুখ, পরার সুখ, শরীরের সব সুখকে এমন নির্বিকার নির্লিপ্তচিত্তে প্রতিদিন নিঃশব্দে গলা টিপে মারে, নিজের জন্মদাতা বা দাত্রী এবং ভাইবোনদের কারণে তারা কি বীর নয়? প্রতি মুহূর্তে নিজের সঙ্গে যুদ্ধে যে যোদ্ধা নিজেকে বার বার পরাজিত করে, সেও কি মহান যোদ্ধা নয়?

বাইরে পেঁচা ডাকছিল দুরগুম্ দুরগুম্ করে। কুকুরগুলো ভুক্ ভুক্ করে উঠলো। শেয়াল বা চিতা-টিতা দেখেছে হয়তো। দূরের রেল লাইনে ডিজেলের ভারী মালগাড়ি একটানা ঘড় ঘড় আওয়াজ তুলে রাতের শীতের হিমেল শিশির-ভেজা নিস্তব্ধতাকে মথিত করে চলে গেল বাড়কাকানার দিকে।

ওরা দান দিচ্ছিল, কথা বলছিল, তাস ফেটাচ্ছিল। আমি বইটা মুড়ে রেখে বালিশে মাথা দিয়ে আধো শুয়ে কম্বল গায়ে টেনে বসে ভাবছিলাম কী আশ্চর্য সুন্দর, প্রাগৈতিহাসিক অথচ কী দারুণ আধুনিক আমাদের দেশ।

এই ভারতবর্ষ!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *