কোজাগর – ৮

নানকুয়া ওর সমবয়সি সব ছেলের থেকে একেবারেই আলাদা। যখন অন্যান্যরা কয়লাখাদে কাজ করে প্রচুর পয়সা হাতে পেয়ে জামা-কাপড় ট্রানজিস্টর ঘড়ি, সানগ্লাস ইত্যাদি কিনে এবং মদ খেয়ে ওদের যুগ-যুগান্ত ধরে সঞ্চিত অতৃপ্ত সাধ-আহ্লাদের দিকে দ্রুতবেগে ধেয়ে যায় তখন ও একা বসে অনেক কিছু ভাবে। নিজের গ্রামে, অন্যদের গ্রামে, ঘুরে বেড়ায়। কী করে ওদের ভালো করা যায়, ওদের জ্ঞাতি-গোষ্ঠীর, ওদের সমস্ত শ্রেণীর; সেইসব নিয়ে মাথা ঘামায়।

নানকুয়ার বাবা টিগা অল্প বয়সে বসন্তের প্রকোপে অন্ধ হয়ে প্রায় পনেরো বছর পৃথিবীর আলো থেকে বঞ্চিত থেকে বিনা চিকিৎসায়, বিনা শুশ্রূষায় মারা যায়। অন্ধ স্বামী ও শিশুপুত্রকে ওর ধনহীন, জমিহীন, সহায়-সম্বলহীন মা কোনোক্রমে বাঁচিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করে। স্বামী, সুস্থ ও সক্ষম থাকাকালীনও বেঁচে থাকা তাদের পক্ষে দুঃসাধ্যই ছিল।

নানকুয়া মায়ের রঙ পায়নি, কিন্তু মুখশ্রী পেয়েছে। কাটা-কাটা, রাগী। মা ছিল এ তল্লাটের নামকরা সুন্দরী। সোনালি মিষ্টি গুড়ে যেমন মাছি পড়ে, তেমন করে কামার্ত পুরুষ পড়ত মায়ের ওপরে। ভন্ ভন্ করত তারা। জঙ্গলের সুঁড়িপথে, ঝরনার পাথরে, ফরেস্ট বাংলোর ঘরে মাকে নিয়ে ওরা চিরে চিরে মা-র সৌন্দর্য পর্যবেক্ষণ করত। আধুলিটা, টাকাটা ধরে দিত হাতে। মা ফেরার সময় শেঠের দোকান থেকে শুখা-মহুয়া বা বাজরার ছাতু কিনে আনত।

নানকুয়ার একটি ভাই অথবা বোন হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয় একসময়। তখন বুঝত না ও, এখন বোঝে যে, সেই অনাগত সন্তান ভূমিষ্ঠ হলে তার নিজের অন্ধ বাবার পিতৃত্বে হত না। জারজ সন্তানের জন্ম দিত তার মা, রসিয়া।

কিন্তু গোদা শেঠের দাদা, জোদা শেঠ তখন বেঁচে। মায়ের ঐরকম শারীরিক অবস্থাতেই সে মত্ত অবস্থায় তার লোকজনকে দিয়ে মাকে পাকড়াও করে নিয়ে গিয়ে এক কোজাগরী পূর্ণিমার রাতে ঝুম্‌রিবাসার নির্জন বাংলোয় রসিয়ার ওপর অত্যাচার করে। একা নয়, ইয়ার-দোস্তে মিলে। ওরা আদরই করতে চেয়েছিল। কিন্তু আদরের রকম ও আদরের বাড়াবাড়ি হলেই অত্যাচার ঘটে। এক্ষেত্রেও তাই-ই ঘটেছিল।

মা যখন বাড়িতে ফিরে আসে, তখনও আকাশে কোজাগরী পূর্ণিমার চাঁদ ছিল। তিনদিন অবিরল রক্তস্রাবের পর বিনা-চিকিৎসায় নানকুয়ার মাথায় হাত রেখে তার মা রসিয়া মারা যায়। নানকুয়ার জীবনের মহাকাশ থেকেও তার সবচেয়ে পরিচিত তারা খসে যায় নিঃশব্দে। সেই হারিয়ে যাওয়া প্রজ্বলিত তারা এক বিশেষ ভূমিকা রেখে যায় নানকুয়ার জন্যে, নানকুয়ার জীবনে। সেদিন থেকে কোজাগরী পূর্ণিমার ওপরই একটা আক্রোশ জন্মে গেছে নানকুয়ার।

নানকুয়া জানে ওই দারিদ্র্য ও অসহায়তার ইতিহাস ওর একার নয়। ওদের সকলের। নানকুয়া যতটুকু পড়াশুনা করেছে, তা পাগলা সাহেবেরই দয়ায়। স্কুলে পড়েছিল, ক্লাস সেভেন অবধি। কিন্তু স্কুল যা শেখায় নি তাকে, খুব কম স্কুল-ই যা শেখায় তা শিখেছে সে পাগলা সাহেবের কাছে। মানুষ হওয়ার শিক্ষা পেয়েছে নানকুয়া। মানুষকে মানুষ জ্ঞান করার শিক্ষা।

যে সময়ে এবং যে-দেশে অধিকাংশ শিক্ষাব্রতী, সাহিত্যিক, সমাজসংস্কারক এবং রাজনীতিকরা কেউ-ই নিজেদের কোনো দায়িত্বই পালন করেন না যে শুধু তাই-ই নয়, সে দায়িত্বকে আপন আপন স্বার্থ-কোলাহলের আবর্তের মধ্যে থেকে স্বচ্ছন্দে এবং উচ্চকণ্ঠে অস্বীকার পর্যন্ত করেন, পরম নিলজ্জতায়, সেই সময়ে এবং সেই দেশে জন্মেও নিজের অতিশয় সামান্য ক্ষমতার সমস্ত পরিপূর্ণতায় নিজের দায়িত্বটুকুকে ওর অজানিতেই স্বীকার করে ও। ওর শিরা-উপশিরার রক্তের এলোমেলো দৌড় ওকে সব সময় বলে যে, এই দেশে একটা বড়ো রকমের ওলট-পালট ঘটবার সময় এসেছে। হয়ত ঘটাবারও।

এক ছুটির দিনে বুলুক পাহাড়ে কিছুটা উঠে যখন ও একা বসে রোদ পোয়াচ্ছে, তখন হঠাৎ যেন তার ঘাড়ে ও পিঠে রোদের নরম আঙুলের পরশের সঙ্গে ওদের লক্ষ লক্ষ স্বজাতির, ওপর পিতা-প্রপিতামহের, ওর দুঃখিনী বহুচারিণী মায়ের আশীর্বাদের পরশ লাগে ওর পিঠে। পাহাড়ের ওপর থেকে আদিগন্ত জঙ্গল, গ্রাম, ক্ষেত-খামার, নদী চোখে পড়ে। গোরু ছাগল চরিয়ে বেড়ায় গাঁয়ের ছোট ছেলে-মেয়েরা। মাটির ঘরের সামনে ছেঁড়া মাদুর বিছিয়ে বসে, দেওয়ালে হেলান দিয়ে, অশক্ত, শীতবস্ত্রহীন বৃদ্ধ, রামধানীয়া চাচা সূর্য থেকে প্রতিকণা অণুপরমাণু উষ্ণতা, তা শক্ত হয়ে-যাওয়া খট্‌খটে হাড়ে শুষে নিতে চায় রাতের হিমের সঙ্গে লড়বার জন্যে। মকাই, অড়হর আর বাজরার ক্ষেতে রাখওয়ার ছেলেরা মন-উদাস-করা বাঁশি বাজায় মাচায় বসে। ঝরনা থেকে কলসী করে জল আনে লাল, হলুদ, নীল শাড়ি-পরা গাঁয়ের মেয়েরা। পাহাড়ের নিচে ঘন জঙ্গল থেকে ময়ূর ডেকে ওঠে কেঁয়া কেঁয়া কেঁয়া রবে। নানকুয়ার পাশের কেলাউন্দার ঝোপ থেকে ভরর্ ভরর্ করে বনমুরগির ঝাঁক উড়ে যায়, হঠাৎ। তাদের সোনালি, হলুদ-কালচে ডানায় শীতের রোদ রামধনু হয়ে চমকিয়ে যায়। নিচের পাহাড়ী নদীর শুকনো সাদা পেলব বালির বুক ধরে ভাব-গম্ভীর হেঁটে যায় একলা পাঁশুটে-রঙা শিঙাল গম্বর। দূরে গ্রামের কুয়োয় কেউ জল তোলে-ক্ষেতে জল দেয়। অবিরাম লাটাখাম্বার ওঠা-নামার ঘুমপাড়ানি ছন্দোবদ্ধ ক্যাচোর-ক্যাঁচোর শব্দ আসে কানে। খড় বোঝাই বয়েল গাড়ি গড়িয়ে যায় পথ বেয়ে, ধুলো উড়িয়ে, ক্যাচ-কোঁচ্ শব্দ করে। পথের ধুলোর গন্ধ, বয়েলের গায়ের মিষ্টি গন্ধ খড়ের মিষ্টি গন্ধে মিলেমিশে সমস্ত বেলা-শেষের দিনকে গন্ধবিধুর করে তোলে। এইসব টুকরো-টুকরো ছবি দেখতে দেখতে শব্দকণা শুনতে শুনতে নানকুয়ার চোখ ও কানের মধ্যে দিয়ে একটা ঘুমভাঙা দারুণ দেশের স্বয়ম্ভু ছবি সমস্ত শব্দ, গন্ধ অনুভূতিতে মঞ্জরিত হয়ে ওর মস্তিষ্কের কোষে কোষে ছড়িয়ে যায়। ওর নাকের পাটা ফুলে ওঠে, নিঃশ্বাস দ্রুততর হয়। এই হতভাগা লোকগুলোর জন্যে কিছু একটা করার জন্যে ওর সমস্ত মন, ওর হাত দুটো, ওর বোধ আকুলি-বিকুলি করে, কিন্তু কী করবে, কেমন করে করবে, তা ও বুঝতে পারে না।

নানকুয়া তার গ্রামের, তার দেশের আদিগন্ত, সূর্যস্নেহে সুধন্য বড় সুন্দর সেই রূপের দিকে অবাক স্তুতির চোখে চেয়ে ভালোবাসায় বুঁদ হয়ে থাকে।

নানকুয়া যেখানে বসেছিল, তার কিছু দূরেই একটি ঝরনা ছিল। এটি মীরচাইয়া প্রপাত থেকে নেমে এসেছে। ঝির্ ঝির্ করে জল চলছে পাথরের আড়ালে। কতরকম ফার্ন, শ্যাওলা, লতাপতা জন্মেছে-ঝরনার পাশে পাশে, পাথরের আনাচে কানাচে। তিনটি শিরীষ গাছ প্রহরীর মতো দাঁড়িয়ে আছে ঝরনার প্রবেশদ্বারে। জায়গাটার নাম নেই আলাদা। লোকে বলে মীরচাইয়াকা বেটি। মুখে মুখে মীরচাবেটিতে এসে দাঁড়িয়েছে। হঠাৎ সেখান থেকে ঠুং করে একটা আওয়াজ হল। কার পায়ের মল বাজল যেন পাথরে।

নানকুয়ার অন্যমনস্কতা কেটে গেল। হঠাৎ একটা দু-লাইনের গান মনে এলো ওর :

‘বিছিয়া ঠোক্‌লে টোঙ্গড়ী কা
শুন্‌কে জিয়া লাগ্ গিয়া।’

পাহাড়ের ওপরে কোথায় যেন মলের শব্দ শুনলাম। শুনেই মন ছুটে গেল সেখানে।

নানকুয়া উঠে পড়ে দেখতে গেল কে এসেছে ওখানে। তার গাঁয়ের সব মেয়েকেই সে চেনে। গ্রাম ছেড়ে এত দূরে ঘন জঙ্গলের মধ্যের মীরচা-বেটিতে কেউই জল নিতে আসে না। কোনো বিশেষ কারণ ছাড়া আসে না এখানে কেউই। কী কারণে? কে এলো?

আস্তে আস্তে এগিয়ে যেতে লাগল নানকুয়া। ছোটবেলা থেকে নিঃশব্দ পায়ে চলা-ফেরা করা অভ্যেস হয়ে গেছে ওদের। কিন্তু শীতকালে শুকনো পাতা মচ্‌মচ্ করে পায়ে পায়ে। পায়ের তলার চামড়া, জুতোর চামড়ার মতোই শক্ত হয়ে থাকে বন-জঙ্গলের মেয়ে-পুরুষের। খালি পায়ে পাথুরে জমিতে, পাহাড়ে পথ চলে চলে গোড়ালি অবধি সাদা হয়ে যায়। কী পুরুষ, কী মেয়ের। কিন্তু নানকুর পায়ে হাট থেকে কেনা প্লাস্টিকের জুতো। তবু সাবধানে যথাসম্ভব কম শব্দ করে আড়ালে আড়ালে এগোতে থাকল ও। যেই-ই এসে থাকুক, তাকে চমকে দেবে ও। মজা হবে।

যখন একটা খয়ের গাছের গোড়ায় পৌঁছে ও ঝরনার দিকে তাকালো, তখন উত্তেজনায় মনে হল ওর হৃৎপিণ্ডটা ছিঁড়ে বেরিয়ে যাবে।

বিস্ফারিত চোখে দেখল নানকুয়া, টুসিয়া একটা পাথরে বসে জলে পা ডুবিয়ে গায়ে সাবান মাখছে। শিরীষ গাছের পাতা পিছলে রোদ এসে পড়ছে তার কুঁচফল-লাল বুকে। পাশে ফিরে বসে আছে টুসিয়া। খোলা চুল নেমে এসেছে কোমর অবধি। চুলে আধো-ঢাকা তার নিতম্বকে একটা অতিকায় বাদামি লাল গোঁড় লেবুর মতো মনে হচ্ছে। একটা পা পাথরের ওপরে রেখে অন্য পা ডুবিয়ে দিয়েছে বহমান জলে।

নানকুয়া স্থাণুর মতো তাকিয়ে রইল সেখানে! না পারল পালাতে, না পারল এগোতে।

একটা ফিচফিচিয়া পাখি খয়ের গাছে বসেছিল। পাখিটা হঠাৎ নানকুয়াকে দেখতে পেয়ে ফিচ্‌ফিচ্ করে উত্তেজিত গলায় ডেকে খয়েরের সরু ডাল দুলিয়ে টুসিয়ার দিকেই উড়ে গেল।

টুসিয়াকে জামা-কাপড় পরা অবস্থায় ছোটবেলা থেকেই দেখেছে নানকুয়া। অনাবৃত, অন্যমনস্ক, তার ভালবাসার জনকে এই ঝরনাতলায় নরম রোদের মধ্যে দেখে টুসিয়ার নগ্ন নিভৃত বড় হয়ে-ওঠা সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে গেল নানকুয়া।

বিধাতা মেয়েদের এক আশ্চর্য ষষ্ঠবোধ দিয়ে পাঠান পৃথিবীতে। তাদের চোখ যা দেখতে পায় না, তাদের বোধ তা দেখতে পায়। ভালো শিকারিদের ষষ্ঠেন্দ্রিয়র মতো। হঠাৎ টুসিয়া মুখ ঘুরিয়ে খয়ের গাছের দিকে তাকাল। ফিফিচিয়া পাখিটার হঠাৎ ভয়-পাওয়া ডাক তার সহজাত বুদ্ধিকে বলেছিল পাখিটা কোনো জানোয়ার বা মানুষ দেখে ভয় পেয়েছে।

নানকুয়াকে দেখেই লজ্জায়, প্রায় কেঁদে ফেলল টুসিয়া। অজান্তে মুখ ফকে বেরিয়ে গেল, অসভ্য! কী অসভ্য!

নানকুয়া কী করবে ভেবে না পেয়ে দু হাতে মুখ ঢেকে ফেলল। টুসিয়াও তখন দু-হাতে বুক ঢেকে নায়ার দিকে পিছন ফিরে একলাফে পাথরের আড়ালে চলে গেছিল।

মুখ-ঢাকা অবস্থাতেই নানকুয়া বলল, আমি মলের শব্দ শুনে দেখতে এসেছিলাম, এসে দেখি…।

টুসিয়া রেগে বলল, তুমি যাবে কি-না বলো এখান থেকে, নইলে পঞ্চায়েতে বলব।

নানকুয়া বলল; বললে তো ভালোই হয়। আমার সঙ্গে তোর বিয়ে দেবে শাস্তি হিসেবে। আমি তো তোকে বিয়ে করতেই চাই।

করাচ্ছি বিয়ে? রাগের গলায় বলল টুসিয়া।

আবারও বলল, অসভ্য কোথাকার!

নানকুয়া যাবার সময় বলে গেল, টুঙরিতে বসে আছি। চান করে আয়। এক সঙ্গে নিচে নামব দুজনে।

টুসিয়া রেগে বলল, তুমি ভাগো। আমার তোমার সঙ্গে যেতে বয়েই গেছে।

টুঙরির ওপরে কিছুক্ষণ বসে রইল নানকুয়া। নানকুয়া জানত যে টুসিয়াকে এই পথেই নামতে হবে নিচে। এবং এও জানত যে, টুসিয়া খুশি হয়েছে ওকে দেখে! যদিও ঐ অবস্থায় দেখা দিতে চায় নি সে। মেয়েরা যে প্রিয়জনের অনেক অনুরোধে, অনেকে সোহাগে, নিজেকে চার দেওয়ালের নিশ্চিন্ততায় অনাবৃত করে, তাই বিনা আয়াসে কেউ তাদের উন্মুক্ত আকাশের নিচে অনাবৃত বে-আব্রু দেখতে পাক, তা তারা কখনও চায় না। স্বামীর ব্যবহারে ব্যবহারে পুরনো হয়ে যাওয়া স্ত্রী পর্যন্ত চায় না। আর টুসিয়া তো অনাঘ্রাতা!

এটা মেয়েদের সংস্কার। জন্মগত, যুগ-যুগ ধরে সঞ্চিত সংস্কার। এমন বিনা নোটিশে নিরাবয়ব হয়ে ধরা দিতে ওদের বড় অভিমানে লাগে। বোধহয় মনে করে সস্তা হয়ে গেল।

এতসব নানকুয়া জানতো না। ও শুধু ভালোলাগায় বুঁদ হয়ে বসে ছিল। তখনও ওর দু-কানের লতি গরম হয়ে ছিল। ওর শরীরের মধ্যে যে এমন সব রাসায়নিক প্রক্রিয়া ঘটতে পারে, অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলি সব এমন হঠাৎ জীবন্ত ও মহাপরাক্রান্ত হয়ে উঠতে পারে, ওর পাথরের মতো শক্ত চ্যাটালো বুকও যে এমন ধুক্‌ধুক্ করতে পারে এক তীব্র বেদনামিশ্রিত কিন্তু গর্হিত আনন্দের বাঙ্ময়বোধে, তা জঙ্গলের পথে বহুবার বাঘের মুখোমুখি হয়েও সে কখনও জানে নি। এ ভয় সে-ভয় নয়। এ একটা অন্যরকম, নতুন রকম, গা-শিরশিরানো ভয়

কুড়ি বছরের নানকুয়া এই প্রথম প্রকৃতির কোলের মধ্যে অন্য পরমা প্রকৃতির, নারী প্রকৃতির অনাবৃত রূপ দেখে প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে উঠল। আজ দুপুরে ওর জীবনে একটা বিশেষ ধাপ অজানিতেই অতিক্রম করল ও। গোঁফ-দাড়ি গজালেই পুরুষ, পুরুষ হয় না। আজ এই মুহূর্তে বড় তীব্র, এক মিশ্র বোধের মধ্যে সে কথা জানল।

শীতের বেলা ঝুপ্ করে পড়ে যায়। সূর্যটা হুলুক্ পাহাড়ের আড়ালে গেলেই সমস্ত টাড়ে, ক্ষেতে, জঙ্গলে ছায়ার আঁচল লুটোয়। ঝাঁটি জঙ্গল থেকে তিতির আর বটের ডাকতে থাকে। চিহাঁ চিহাঁ চিহাঁ করে। টিয়ার ঝাঁক দ্রুত পাখায় ছোটো ছোটো সবুজ তিরের মতো উড়ে যায় রাতের আশ্রয়ে। গ্রাম থেকে গোরু-বাছুর চরাতে যাওয়া বাচ্চা ছেলে-মেয়েদের উচ্চৈঃস্বরে ডাকে মায়েরা। গোরুর গলার গম্ভীর হাম্বা—আ-আ রব সন্ধ্যাকে স্বাগত জানায়। গোরু-ছাগলের পায়ে পায়ে ধুলো ওড়ে। মাটির ঘরগুলোর সমষ্টি থেকে উনুন ধরানোর ধুয়ো ওঠে কুণ্ডলী পাকিয়ে। সন্ধ্যার আগে আগে কুয়াশা, ধুলো, ধুঁয়ো ও নানা মিশ্র গন্ধ মিলে মিশে আসন্ন রাতের কালো বালাপোশে কোনো অনামা আতরের খুশ্ব মাখায়।

অন্যমনস্ক হয়ে গেছিল নানকুয়া। হুলুক্ পাহাড়ের পিঠের ছায়া পড়েছে নিচের ঘন জঙ্গলের গায়ে।

এমন সময় পিছ থেকে রিনরিনে গলায় টুসিয়া বলল, কত দিন, এই সব গুণ হয়েছে তোমার! ছিঃ ছিঃ। এই নাকি পাগলা সাহেবের শিক্ষা!

নানকুয়ার রক্ত মাথায় চড়ে গেল। খুব একটা খারাপ গাল দিয়ে বলল, মুখ সামলে কথা বল্।

কী বললে? টুসিয়া আহত গলায় বলল।

এইই দোষ নানকুয়ার। বড় মাথা গরম ওর। একটুতেই বড় রেগে যায়। এ জন্যেই ওর কিছু হবে না। ও জানে।

পরক্ষণেই ও হাত জোড় করে বলল, গাল দিলাম বলে রাগ করিস না। তুই তো জানিস্ তোকে আমি কত ভালোবাসি! তোকে এ কথা বলতে চাই না। তুই পাগলা সাহেবকে এর মধ্যে আনলি কেন?

টুসিয়া বলল, আমার কিছু বলার নেই।

সেদিন মুঞ্জরী মাসীর বাড়িতে গেছিলাম। মাসি বুলকিকে পাঠিয়েও ছিল তোকে ডেকে আনতে। তুই বাড়ি ছিলি না?

তুমি কি নিজে আসতে পারতে না? বুলকি কি তোমার দূত? আমি বাড়ি ছিলাম। ইচ্ছে করে আসিনি।

ইচ্ছে করে? কেন? নানকুয়া আবার ফুঁসে উঠল।

টুসিয়া বলল; এমনিই। আমার খুশি।

বলেই বলল, পথ ছাড়ো। কাল রাতে বাঘ খুব ডাকাডাকি করেছে পাহাড়ে। অন্ধকার হয়ে যাবে। আমার তাড়াতাড়ি বাড়ি পৌঁছতে হবে।

নানকুয়া ওর পাশে পাশে পাকদণ্ডী দিয়ে পাহাড়ে নামতে লাগল।

ছায়াচ্ছন্ন সোঁদা-গন্ধ পথের পাশে লজ্জাবতীর মতো একরকম ঝোপে লাল লাল ফুল ফুটেছে। নানকুয়া জানে না গাছটার নাম। কবে কোন সাহেব বীজ বা চারা এনে লাগিয়েছিল শিকার করেত এসে, কে জানে? গাছটা লজ্জাবতীর মতো। একরকমের লজ্জাবতীই। গায়ে হাত ছোঁয়ালেই পাতা বুজে যায়, লাজুকে মেয়ের চোখের মতো। সুন্দর লাল ময়ূর-শিখার মতো ফুল ফোটে গাছটায়। নানকুয়া দুটো ফুল ছিঁড়ে টুসিয়ার কাছে এগিয়ে গেল। বলল, তোকে চান করে ভারি সুন্দর দেখাচ্ছে। ফুল দুটো খোঁপায় গুঁজে নে।

থাক্। বলল টুসিয়া।

কিন্তু ফুল দুটো হাতে নিলো।

নানকুয়া বলল, আমাকে দে, আমিই গুঁজে দিচ্ছি।

বলে, নিজেই টুসিয়াকে দাঁড় করিয়ে গুঁজে দিলো ফুল দুটি। গুঁজে দিয়েই জোর করে টুসিয়াকে বুকের মধ্যে নিয়ে চুমু খেল।

ঐ দোষ ওর। বড় দোষ! কোনো কিছুই ভদ্রভাবে ধীরে সুস্থে করতে পারে না! জংলি তো!

এর আগেও দুবার চুমু খেয়েছিল নানকুয়া টুসিয়াকে। একদিন জেঠ শিকারের দিনে। অন্য দিন দশেরাতে। আজ টুসিয়াকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে একেবারে অন্যরকম অনুভূতি হল নানকুয়ার। এতদিন ওর পাথরের মতো শক্ত বুকের মধ্যে টুসিয়ার অদেখা বুকের ছোঁয়াই পেয়েছিল সে শুধু। আজ টুসিয়ার শাড়ি-জামার আড়ালে তা যেন দেখতে পেলো। ওর চোখে ভেসে উঠল জল-ভেজা রোদ-পিছলানো অনাবৃত টুসিয়ার নিভৃত শরীরটা।

টুসিয়া ভালোলাগর শব্দ করে উঠল যদিও, তবুও দু-হাত দিয়ে ওকে ঠেলে দিলো। বলল, চল্‌, হঠ।

তারপর নিচে নামতে নামতে টুসিয়া বলল, দাদা আসছে কালকে।

টুসিয়ার দাদা হীরু শহরে কলেজ থেকে বি.এ. পাস করেছে। তারপর তফসিলি উপজাতিদের জন্যে সংরক্ষিত আসনে সরকারি অফিসার হয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকারের পুলিশ অফিসার। পাটনাতে পোস্টেড এখন। দাদার জন্যে টুসিয়া এবং তার মা-বাবার অত্যন্ত গর্ব। হীরু পুরো গ্রামেরই গর্ব। ক’টা গ্রামের ওরাওঁ কাহার, দোসাদ, ভোগত, মুণ্ডাদের ছেলে এত ভারি অসর হয়?

দাদা যদি টুসিয়াদের সকলকে নিয়ে পাটনায় চলে যেতো, তাহলে খুব ভালো হতো। তার দাদা অনেক বড় হয়েছে, কিন্তু ওরা যেমন তেমনই রয়ে গেছে—তাই এই টানাপোড়েনে পড়ে ওদের অবস্থাটা অস্বাভাবিক হয়ে উঠেছে। অনেকদিন হল ভাইয়ার চিঠির রকম-সকম দেখে মনে হচ্ছিল টুসিয়ার ভাইয়া বদলে গেছে অনেক। আগের মতো আর নেই। আজকাল টাকা-ফাকাও বিশেষ পাঠায় না। মাঝে মাঝে একশো টাকা করে পাঠায়, তাও কয়েক মাস বাদে বাদে। অবশ্য ওদের কাছে তাই-ই অনেক টাকা। তবু পরিবারের একমাত্র ছেলে ও কৃতী ছেলে হিসেবে ভাইয়ার ওর জন্যে এবং বাবা-মায়ের জন্যে অনেক কিছুই করার ছিল।

টুসিয়ার দাদা হীরু যে এইবার তার এক বন্ধুকে সঙ্গে করে নিয়ে আসছে, সে খবরের বিশেষ তাৎপর্য ছিল টুসিয়ার মা-বাবার কাছে। টুসিয়ার কাছে তো নিশ্চয়ই। বাবাকে দাদা কী লিখেছিল জানে না টুসিয়া। কিন্তু মনে মনে স্বপ্ন দেখা শুরু করে দিয়েছিল। তার দাদার বন্ধু কেমন দেখতে হবে কে জানে? দেখতে যাই-ই হোক, পুরুষ মানুষের আবার রূপ! বিয়ের পর কোন ভারী শহরে থাকবে, কী ভাবে সেখানের আদব-কায়দা, রীতি-নীতিতে রপ্ত করবে নিজেকে, তা নিয়ে চিন্তাও করেছিল। তার ভাবা স্বামীর সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতে যাতে সে ক্যাবলা গ্রাম্য মেয়ে বলে ইম্‌তেহানে অকৃতকার্য না হয়, তার জন্যে একা একা জঙ্গলে টাড়ে এ ক’দিন অনেক মহড়াই দিয়েছে সে।

মা এই ক’দিন টুসিয়ার চুল বড় যত্নে বেঁধে দিচ্ছে। কোনো কাজই প্রায় করতে দিচ্ছে না। সব কাজই নিজে হাতে করছে। মুখে গোঁড়লেবু কেটে ঘষে লাগাচ্ছে। করৌঞ্জের তেল মাখাচ্ছে মুখে, শোবার সময়। এত যত্ন তার শরীর যে কখনও পেতে পারে, তা টুসিয়া স্বপ্নেও ভাবে নি। তার শরীরকে সুন্দর করা হচ্ছে ভবিষ্যতে একজনের ভোগের জন্যে। সে টুসিয়ার জীবনের পরম পুরুষ। তার পতি। দেওতা!

শিগগিরিই দাদা আসবে, আর ঠিক আজই এমন ভাবে, এমন পরিবেশে নানকুয়ার সঙ্গে তার দেখা হল বলে মনে মনে বড় বিরক্ত হয়েছিল টুসিয়া। ভীষণ আতঙ্কিতও ও। এতদিন ও ব্যাপারটাকে সকলের কাছেই গোপন করতে চেয়েছিল। নানকুয়াকে গোপন করে যদি তার বিয়ে পাকা হয়ে যেত তাহলে নানকুয়া হয়ত তাকে খুনই করে ফেলত। কে জানে? যা বদ্রাগী মানুষ! যা হয়েছে, ভালোই হয়েছে। দেওতা যা করেন মঙ্গলের জন্যে। নানকুয়াকে যা বলার বলে তার অপরাধী মনের ভার লাঘব করতে পারলে সে হালকাই বোধ করবে এখন

নানকুয়া চুপ করে ছিল। চুপচাপ হাঁটছিল।

হঠাৎ টুসিয়া নানকুয়ার হাতটা আদরে জড়িয়ে ধরল। বলল, অ্যাই তুমি কোনো বাগড়া দেবে না তো? আমার যদি ভালো বিয়ে হয়, সুখে থাকি আমি, তুমি… ।

নানকুয়াকে যেন সাপে কামড়েছে এমন ভাবে ও ছিটকে সরে গেল টুসিয়ার কাছ থেকে।

তারপর ঘৃণায় ভুরু কুঁচকে বলল, আমাকে তুই কী মনে করিস? আমি কি তোর মতো কামিনা? আমার নাম নান্‌কু। নানকু ওরাওঁ!

তারপর পথের পাশের একটা আমলকী গাছের ডাল থেকে আচমকা এক মুঠো পাতা ছিঁড়ে ফেলে নিজের মুঠির মধ্যে পিষতে-পিষতে দাঁতে দাঁত চেপে বলল, তুই আমার যোগ্য নোস্, আমার যোগ্য নোস্; একেবারেই নোস্।

বাকি পথ কেউই কোনো কথা বলল না। জঙ্গলের শেষে বড়ো মহুয়া গাছটার কাছে এসে পথটা যেখানে দু-দিকে ভাগ হয়ে গেছে, সেখানে পৌঁছে দুজনে দু-দিকে চলে গেল। নিঃশব্দে।

নানুক্ নিঃশব্দে বলল, তুই সত্যিই আমার যোগ্য নোস্ টুসি। তুই আমাকে চিনতে পারিসনি। হয়তো কখনওই চিনতে পারবি না! ভালোই হয়েছে। যা হচ্ছে তা ভালোই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *