কোজাগর – ৫

সমস্ত আকাশ আলোয় ভরে দিয়েছে রোদ। ঘন নীল উজ্জ্বল আকাশ। পাহাড়ী বাজ উড়ছে ঘুরে ঘুরে। কয়েক দানা শুকনো মকাই চিবিয়ে, একটা মকাই কোঁচড়ে নিয়ে পরেশনাথ কি পাহাড়ে যাচ্ছিল গোরুগুলোকে চরিয়ে আনতে। ফিরবে সেই সন্ধ্যাবেলা। মাহাতোর গোরু চরানোর ভার তার উপর। সাদা-লালে মিলিয়ে গোটা পনেরো গোরু। দিনে পঁচিশ নয়া করে পায় পরেশনাথ মাহাতোর কাছ থেকে।

ওদের বাড়ির সীমানা ছাড়িয়ে পাহাড়ে পাকদণ্ডীর পথ ধরবে ও, এমন সময় বুলকি পিছু ডাকল, এই ভাইয়া!

কা রে দিদি? পরেশনাথ দাঁড়িয়ে পড়ে শুধোলো।

বুলকি বলল, পাহাড়ে যাচ্ছিস? আমার জন্যে এক কোঁচড় কাঁকোড় ফল নিয়ে আসিস। মালা গাঁথব।

পরেশনাথ বিজ্ঞের মতো বলল, এতগুলো গোরু নজরে রাখা কী কম কথা? আমার সময় কই? ….আচ্ছা দেখবো, যদি হাতের কাছে পাই ত আনবো।

বুলকি বলল, বেশি বেশি, না?

পরেশনাথ গম্ভীর গলায় বলল, তুই বড় অবুঝ দিদি। তোর যা চাই, তা এক্ষুণি চাই! বলছি তো দেবো এনে। তবে আজই দেবো কি-না বলতে পারছি না।

বুলকি জেদ ধরল, না, আজই চাই, কাল হাট না? হাটে যাবো কাঁকোড়ের মালা

পরে।

পরেশনাথ জবাব না দিয়ে, একটা গোরুর পিঠে লাঠির বাড়ি মারল। তারপর একবারও ফিরে না-তাকিয়ে গভীর জঙ্গলের মধ্যের পাকদণ্ডীতে মিলিয়ে গেল।

এই পাহাড়-জঙ্গলের নেশায় বুঁদ হয়ে যায় পরেশনাথ। পেটের খিদে, পরনের কাপড়ের অভাব, সবকিছু ভুলে যায় ও।

একটু এগিয়ে যেতেই পাকদণ্ডীর বাঁকে শুকনো পাতা মাড়াবার মচ্‌মচ্ আওয়াজ হলো। বাঁক ঘুরতেই দেখলো টেটরা-চাচা। একটা ফালি-হওয়া জামা গায়ে দিয়ে কি পাহাড় থেকে পাকদণ্ডী বেয়ে নেমে আসছে।

পাহাড়ের ওপরে মুলেন সাহেবের বাংলো ছিল একসময়। শিকারে আসতো নাকি সাহেব। পরেশনাথ কখনও দেখেনি, তার বাবার মুখে শুনেছে। জন্ম থেকেই পরেশনাথ দেখে আসছে ঘন জঙ্গলের মধ্যে এই ভেঙেপড়া বাংলো: জঙ্গলের সঙ্গে আর আলাদা করা যায় না আজকাল। শুধু কিছু-কিছু শৌখিন গাছ মনে করিয়ে দেয় যে, একসময় এখানে মানুষের বাস ছিল। মাঝে-মাঝেই শোনচিতোয়া এসে আস্তানা নেয় এখানে। বিশেষ করে ঝড়-বৃষ্টির দিনে। একবার পরেশনাথ মুখোমুখি পড়ে গেছিল শাওন মাসের এক সকালে, একটার সামনে। চোখ দুটো কটা-হলুদ। তাহলে বুকের রক্ত হিম হয়ে যায়। শোনচিতোয়াটা কিছু বলেনি, পথ ছেড়ে নেমে গেছিল পাথরের আড়ালে পরেশনাথ ভয়ে আর এগোয়নি। এক-এক পা করে অনেকদূর পিছিয়ে এসে দৌড় লাগিয়েছিল বাড়ির দিকে।

টেটরা-চাচা ফলের ব্যবসা করে। টেটরা-চাচার মেয়ে তিতলি ঠিকাদার কোম্পানীর বাবুর বাড়িতে কাজ করে। বাঁশবাবু যাঁর নাম। পরেশনাথের বাবা মানিয়া তাঁকে ভালো চেনে। দুধ দেয় তাঁর বাড়ি। মাথায় একটা ঝুড়ি নিয়ে গেছিল টেটরা-চাচা মুলেন সাহেবের বাংলোর হাতায় এখনও যে পেয়ারা গাছ আছে, তা থেকে পেয়ারা পাড়তে। আমের দিনে আমও পাড়ে। ভাল্লুকদের সঙ্গে তখন টেটরা-চাচার রেষারেষি। গরমের সময় এইসব আমগাছের দখল নেয় ভাল্লুকেরা। মুলেন সাহেব মরার সময় সমস্ত আমবাগান যেন ওদেরই ইজারা দিয়ে গেছিল। গভীর জঙ্গলের মধ্যে বলে দিনের বেলাতেও ভাল্লুকেরা এখানে আমগাছে আম পেড়ে খায়। একবার একটা ভাল্লুক টেটরা-চাচাকে তাড়া করে পিছন থেকে এক খাবলা মাংস তুলে নিয়েছিল। একদিন ধুতি তুলে পিছনের গর্ত হয়ে-যাওয়া জায়গাটা দেখিয়েছিল টেটরা, পরেশনাথকে।

কোথায় চললে চাচা? পরেশনাথ হাসিমুখে বলল।

টেটরা হাসল। বলল, বাসারীয়া।

তারপর বলল, যাওয়া-আসাই সার। বস্তিতে পয়সা দিয়ে আমরুত্ খাবে এমন লোক কই? যেতে পারতাম যদি চিপাদোহর, তাহলে হয়তো স্টেশনে কী হাটে বিক্রি করতাম কিছু। যাওয়া-আসা অনেক খরচের। কিছুই নাফা থাকে না। সময়ও লাগে বিস্তর। দিনকাল বড় খারাপ রে পরেশনাথ!

পরেশনাথ বলল, হুঁ। ও জানে। ওর বাবা-মা সব সময়েই, উঠতে-বসতে খালি এই কথাই বলে : দিনকাল বড় খারাপ। দিন আর কাটতেই চায় না।

টেটরা মাথার ঝুড়িটা পথের পাশের পাথরে নামিয়ে রেখে একটা বিড়ি ধরালো। পরেশনাথকে শুধলো, তোর বাবা কেমন আছে? অনেকদিন দেখা হয়নি। আগের সপ্তাহে যখন হাটে গেছিলাম, তখন হাট ভেঙে গেছে। গোদা শেঠ পয়সা দিতে এতই দেরি করল যে, হাটে গিয়ে কিছু কিনতেই পারলাম না। অথচ সেই সকাল থেকে বসেছিলাম তার গদির বারান্দায়। বেচা-কেনা করল, হিসেব মেলাল, তারপর বাড়িতে খেতে গেল। খেয়ে-দেয়ে এসে ঢেকুর তুলতে তুলতে যখন পয়সা দিলো, তখন বেলা শেষ।

টেটরার এই কথায় কোনো অভিযোগ, অনুযোগ বা রাগ ছিল না। ঘটনা বলার মতো, যা ঘটেছিল, তাই-ই বলেছিল পরেশনাথকে। আস্তে আস্তে, থেমে থেমে, বিড়িতে সুখটান দিতে দিতে।

টেটরা পরেশনাথের বাবা মানিয়া, তাদের গ্রাম ও আশ-পাশের গ্রামের যত লোককে জানে-শোনে মানিয়ারা, তাদের কারো মধ্যেই কোনো উত্তেজনা নেই। অনাবৃষ্টি, অতিবৃষ্টি, ঝড়, দুর্যোগের মতোই প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়ম হিসেবে এখানকার সকলেই যার যার নিজের জীবনে এইরকমই হয়, বা হবে মনে মেনে নিয়েছে। পরেশনাথের বাবা যেমন নিয়েছে, পরেশনাথ, হয়তো পরেশনাথের ছেলে ও এই নির্লিপ্ত সর্বংসহ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বড় হবে। শিশু থেকে যুবক, যুবক থেকে বৃদ্ধ, তারপর একদিন নিদিয়া নদীর পাড়ের শ্মশানে চৌপাইতে করে চলে যাবে। জঙ্গলের পথে-পথে, পথের ধুলোয়, কাঠপুত্রী গাছের পাতায়, কাঁকোড়ের ঝোপে-ঝোপে ‘রাম নাম সত্ হ্যায়,’ ‘রাম নাম সত্ হ্যায়’ কথাগুলো কিছুক্ষণ ঠিকরে ফিরবে। তারপরই, আবার মন্থর, চাঞ্চল্যরহিত ঝিঁঝির ডাক, কথাগুলোকে গ্রাস করে ফেলবে।

টেটরা বিড়িটা শেষ করে উঠল।

ঝুড়ি থেকে দুটো পেয়ারা তুলে বলল, নেঃ, তুই একটা খাস, বুলকিকে একটা দিস। তারপর, চলে যাওয়ার আগে বলল, গাই-বয়েলগুলোকে ঢালের দিকে যেতে দিস না আজ। হাতি আছে। আমি আমরুত্ পাড়ার সময় ডাল ভাঙার শব্দ শুনেছি। পুরো দল আছে। কান খাড়া করে রাখিস আজ।

যখন পরেশনাথ একা বসে থাকে অলস দুপুরে, গাই-বয়েলগুলো যখন গলায় কাঠের ঘণ্টা দুলিয়ে চারিদিকে পটাস পটাস্ করে ঘাস পাতা ছিঁড়ে খায়, নরম রোদটা পিঠের ওপরে পড়ে, বুই-বুঁ-বুঁইই-ই-ই করে রোদের মধ্যে কাচপোকা ওড়ে, জঙ্গল থেকে নানারকম ফুলের গন্ধ, পাখির ডাক ভেসে আসে, কাঠের ঘণ্টাগুলো ঘুমপাড়ানি সুর তোলে, তখন পরেশনাথের ঘুম পেয়ে যায়। ঘুমের মধ্যে ও শোনে, তারা যেন কানের কাছে বলে, ‘রাম নাম সত্ হ্যায়’।

কথাটার মানে কী? মানে ও জানে। কিন্তু কথাটা বলা হয় কেন? রাম কি আছে? পরেশনাথের বাবা কথায় কথায় বলে, হায় রাম! বা হায় ভগ্যান।

ভগবান কি আছে? থাকলে, পরেশনাথের বাবা-মার এত কথার একটাও ভগবান শোনে না কেন? কেন খরগোশ এসে চীনেবাদাম খায়? দিনে হরেকরকম পাখি এসে কেন ফসল খেয়ে যায়?’ আর রাতে শুয়োর, হরিণ, শজারু? কেন এত কষ্টে পাথর-কেটে-করা বস্তির আশেপাশের ধানের ক্ষেতেও হাতির দল নেমে এক রাতে সমস্ত ফসল সাবাড় করে? কেন্ গোদা শেঠ টেটরা-চাচার সঙ্গে, তার বাবার সঙ্গে, এত এত লোকের সঙ্গে, এমন ব্যবহার করে? কেন এত ইচ্ছে থাকতেও ও একটাকা দিয়ে বুলকি দিদিকে একটা পুঁতির মালা কিনে দিতে পারে না? কেন? কেন?

পরেশনাথ ওর দিদিকে ভালোবাসে। দিদির মুখটা কী সুন্দর! মায়ের চেয়েও সুন্দর। কী সুন্দর করে কথা বলে দিদি। একবার পরেশনাথ বাসারীয়ার হাটে মোটরে করে কোথা থেকে যেন বেড়াতে-আসা দিদিরই সমবয়সি একটি মেয়েকে দেখেছিল। বাবুদের মেয়ে। তার কী সুন্দর জামাকাপড়, কী দারুণ লাল জুতো, মাথার চুল, হাসি, সব। আহা! পরেশনাথ ভাবে, ওর দিদির যদি অত সব থাকতো, তবে বুলকি দিদিকে না-জানি কী সুন্দরই দেখাতো!

ঠিক আছে, আজ কাঁকোড়ের ফল নিয়েই যাবে দিদির জন্যে। নেবেই খুঁজে পেতে, এক কোঁচড়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *