কোজাগর – ৪৪

৪৪

বৃষ্টিটা এবারে আশ্চর্য করল। এরকম কোনো বছরই হয় না। প্রথম এসেই জাঁকিয়ে বসল, যেন ভরা শ্রাবণের বৃষ্টি। 

ভালুমারের সকলেরই আনন্দের শেষ নেই। ক্ষেতে ক্ষেতে সাঁওয়া, গোঁদনি, বাজরা, কিতারি, গেঁহু, সরগুজা, অড়রড কুল্থী, মটরছিম্মি এবং আরও নানা ফসল লাগাবার আগে মাটি যদি বর্ষণে নরম হয়ে যায় তবে ফসল ভালো যে হবে তাইই নয়, প্রত্যেকের মেহনতও কমে যাবে। আজও ভারতবর্ষের নব্বুই ভাগে বৃষ্টির ওপরই ফসল নির্ভর করে। 

আবহাওয়াও যেন সব জায়গাতেই কেমন বদলে যাচ্ছে। গরমের সময় নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়া, শীতের সময় গরম, বর্ষার প্রথমে অতিবর্ষণ, এ সব ভালুমারে বরং কম, অন্যান্য জায়গায়, বিশেষ করে যেখানে বনজঙ্গল নেই, সেখানে নাকি এই অনিয়মই প্রায় নিয়মে এসে দাঁড়িয়েছে। সকলের মুখেই শুনি। আমাদের এখানে গাছপালা যথেষ্ট থাকাতে প্রকৃতির ভারসাম্য এখনও হয়তো তেমন নষ্ট হয়নি। সমস্ত পৃথিবীকেই একদিন মানুষের এই হঠকারিতা আর লোভের দাম দিতে যে হবেই, সে বিষয় সন্দেহ নেই কোনো। 

পাহাড়ী নদীগুলিতে জলের ঢল নেমেছে। লাল ঘোলা জল, দীর্ঘদিনের জমে থাকা কাঠ-কুটো, ঝরা পাতা ধুলো-বালি, ভাসিয়ে নিয়ে চলেছে তাণ্ডব তোড়ে, কোয়েলের দিকে। কোয়েল ছাড়াও অনেক নামা ও অনামা নদী আছে ছোট ছোট, পাহাড় জঙ্গলের বুকের ভাঁজে ভাঁজে। তাদের দিকেও বয়ে চলেছে অসংখ্য ছোটো ছোটো গাড়হা আর নালা। মীরচা-বেটির রূপ খুলে গেছে এখন। শীতে যেখানে পিকনিক হয় আর গরমে কালো পাথররা যে অঞ্চল জুড়ে উষ্ণতা বিকীরণ করে উষ্ণ দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে তাদের চ্যাটালো কঠিন নিকষ কালো বিস্তৃত বুক থেকে, সেই মীরচাইয়া প্রপাতের পুরো চেহারাই এক মাসেই একেবারে বদলে গেছে। প্রকৃতির মতো নিত্য নতুন রূপে সাজতে, ন্যূনতম প্রসাধনে এমন নতুন হতে, নতুন ভাবে ভাবুক হতে আর কোনো মেয়েই বোধহয় জানে না। নয়া-ভালাও-এর প্রায় আধখানি জলে ভরে গেছে ইতিমধ্যেই। ভরে গেছে খানা খন্দ, ঢাল, পাহাড়তলির নীচু খাদ। অন্যন্য বছর শ্রাবণ মাসেও এমন হয় কি না সন্দেহ। প্রথম দিন কুড়ি তো একেবারে লাগাতার বৃষ্টি হল। সঙ্গে ঝড়। কত পাখি মরে গেল, ঠোঁট উঁচু করে ডানা দুমড়ে পা এলিয়ে, ঝরা পাতার ফ্যাকাসে গলিত স্তূপের মধ্যে রঙের চমক লাগিয়ে পড়ে রইল নিস্পন্দ হয়ে। বাড়ি থেকে বেরোনোই মুশকিল ছিল। এবেলা খিচুড়ি, ওবেলা খিচুড়ি। আর কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে বর্ষার রূপ দেখা। আমার মতো গ্রাম্য নিষ্কর্মাই, জানে এই কর্মহীন নিশ্চিন্ত অবসরের সুখ। শহরের হায় টাকা হায় টাকা ব্যস্ত মানুষদের জন্যে এইসব অতি সাধারণ অথচ অসাধারণ সুখ নয়। যে এর দাম দেবার জন্য প্রস্তুত, দাম দিতে জানে, সেইই শুধু এই গভীর আনন্দ পেতে পারে। 

ঝড়বৃষ্টিতে প্রায় সকলেই গৃহবন্দি হয়েছিল। কিন্তু তবু অনেকেরই আবার বেরোতেও হয়েছিল, পেটের জ্বালায়। একে তো গ্রীষ্মশেষে এমনিতেই সকলের দুরবস্থার একশেষ, তারপর গ্রীষ্ম উধাও হতে না হতেই এহেন বর্ষা! চিতাটাও বোধহয় ভালুমারের মানুষদের দুরবস্থার কথা জেনে গেছিল। একদিন সকালে টিহুল-এর দ্বিতীয় বউ সহেলীর বড়ো ছেলেটি যখন ঐ দুর্যোগের মধ্যে মায়ের অনুরোধে কোথায় কোথায় জল ভালো জমছে তা দেখে আসতে এবং জল পেয়ে মোরব্বারা কোন টাড়ে কেমন বাড়ল তাও দেখে আসতে বেরিয়েছিল সকাল বেলায়, ঠিক তখনই, চিতাটা তাকে চুপিসারে এসে ধরেছিল। বড় রাস্তা ছেড়ে ছেলেটা বড় জোর হাত পনেরো ঢুকেছিল জঙ্গলের ভিতরে। একটি বড়ো পিপ্পল গাছের গোড়াতে তাকে ধরে, সেই গাছেরই আড়ালে বসে তাকে দিন-দুপুরে ঝড়ের সোঁ সোঁ আওয়াজ আর মেঘের গর্জনের মধ্যে নির্বিঘ্নে খেয়ে সাফ্ করে চলে গেল। সহেলী দুপুর অবধিও খোঁজ করেনি। দিন-দুপুরে চিতার কথাটা মনেও আসেনি ওর। টিহুল ফিরলে বস্তিতে এসে দুজনে মিলে এর বাড়ি তার বাড়ি খুঁজেও যখন ছেলেকে পেলো না তখনই সকলে মিলে খুঁজতে খুঁজতে শেষ বিকেলে পড়ে-থাকা হাড় আর চুলসুদ্ধু অবিকৃত আতঙ্কিত চোখের শিশুমুখটিকে আবিষ্কার করেছিল ওরা। বিধাতার পরিহার বোধহয় একেই বলে। যে টিহুল, তার স্ত্রীর গর্ভধারণের কারণে ডাক্তারবাবুদের ওপর রাগ করেছিল মাসখানেক আগে, সেই-ই এখন শোকগ্রস্ততার মধ্যেও আশ্বস্তও হল। দুখানা হাত তো কম পড়ল। পেটের জ্বালা যেমন জ্বালা, তেমনই ওদের টানাপোড়েনের, সংসারে একজোড়া হাত হঠাৎ কমে যাওয়ার জ্বালাও বড়ো জ্বালা, হোক না সে ক্ষুদে হাত! পেটের রুটি, এখানে অনেক জোড়া হাতের সম্মিলিত মদতে বড়োই মেহনত করে জোগাড় করতে হয় যে! 

বৃষ্টিতে বেরুবার জো নেই। তার ওপর সহেলীর ছেলেকে শোচিতোয়া। দিন-দুপুরে নিয়ে যাওয়ার পর বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া কেউই ঘর ছেড়ে বেরোতে চাইছে না। ভয়কে চিরদিনের মতো জয় করার বিলাস এদের মানায় না। 

এখানকার সকলেই এখন চিতাটার নামোল্লেখ পর্যন্ত করে না, বলে শয়তান আরও বড় ভাবনার কথা যে, কেউ কেউ চিতাটার মধ্যে দৈবী ব্যাপারও দেখতে শুরু করেছে। একে নিধন করা যখন কাড়ুয়া ও পুলিশের রাইফেলধারীদের পক্ষেও সম্ভব হয়নি তখন এ যেন বনদেওতার আশীর্বাদধন্য শোচিতোয়া এ বিষয়ে তাদের বিশ্বাস ক্রমশই দৃঢ় হচ্ছে। 

সকাল থেকে অঝোর ধারা ঝরে এখন থেমেছে বৃষ্টিটা। তবে, আকাশে মেঘ রয়েছে। এই অস্বাভাবিক বৃষ্টি কবে যে থামবে, কে জানে। 

তিতলি একটু চিঁড়ে ভেজে দিল, সঙ্গে ডালমুট মিশিয়ে। বারান্দায় বসে চা আর চিঁড়েভাজা খাচ্ছি আর নোনা কথা ভাবছি। বিয়ের পর থেকে একটা অভাব বড়ই বোধ করছি। তিতলিকে যখন লেখাপড়া শেখানো সম্পূর্ণও হবে, তখনও ফাঁক থেকে যাবে অনেকই। আমার সাংস্কৃতিক ও শিক্ষাগত পটভূমির সঙ্গে তিতলির পটভূমির মস্ত ব্যবধান চিরদিনই থেকে যাবে। এ ফাঁকটার কথা আগে কখনও ভাবি নি। বুঝতে পারিনি। ও নর্মসহচরী, বিনিপয়সার নোক্রানি এবং আমার সন্তানের জননী হবে যদিও, তবু কখনই বোধহয় এ জীবনে আমার সখী হবে না। সখ্যতা শুধু সমান রুচি, সমান শিক্ষা, সমান মানসিকতার দুজন মানুষের মধ্যেই বোধহয় সম্ভব। এ কথা দিনে দিনে বড় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। নাই-ই বা হল। যারা বেড়া ভাঙতে চায়, তাদের ক্ষয়ক্ষতি লোকসান কিছু হয়ই। কিন্তু বেড়া ভাঙলে, তবেই না অনেকের পক্ষে এগিয়ে আসার পথ সুগম হবে। 

কোনো এক নাম-না-জানা পাখি ঠোঁটে করে কোন অচিন ফলের বীজ নিয়ে মন উদাস করা বিধুর স্বরে ডাকতে ডাকতে মেঘের মধ্যে সেই বীজ বপন করবে বলে উড়ে গেল। যতক্ষণ দেখা যায় ততক্ষণ পাখির উড়ান-পথের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে রইলাম। দিগন্ত আড়াল করে এক ঝাঁক বয়ের আর খয়ের গাছের ঝাঁকড়া ভিড়ের মধ্যে সে হারিয়ে গেল। মুখ ফিরিয়ে আবার পথে তাকালাম। 

চারদিক থেকে গায়ের গন্ধ উঠেছে। বন-বর্ষার গায়ে যে আশ্চর্য মিষ্টি তিক্তগন্ধ তার সঙ্গে বন-শরতের গায়ের গন্ধের অমিল আছে। পাখিটাকে বয়ের আর খয়েরের আড়ালের ওপারে আর খোঁজা হলো না, দেখা হলো না আমার স্বপনে বীজ বপনের মতো কী করে সে মেঘের মধ্যে বীজ বপন করে? সত্যিই পারল কি? ‘আমি কেবলই স্বপন করেছি বপন বাতাসে, দিন শেষে দেখি ছাই হল সব হুতাশে হুতাশে।’ বাঁশবাবুর নামী লেখক হওয়ার স্বপ্নর মতোই হয়তো পাখিরও কোনো স্বপ্ন সত্যি হলো না। কিন্তু পাখিটা, কি পাখি? আমি চিনি না এমন পাখি এদিককার জঙ্গলে বিশেষ দেখিনি। তবুও মাঝে মাঝে হঠাৎ হঠাৎ অচেনা পাখি চোখেও পড়ে। ভালো করে তাদের দেখা হয় না, তাদের দেখতে দেয় না তারা। আর দেখার পরই যদি না সালিম আলী বা হুইসলার সাহেবের বইয়ের কোনো পাখির সঙ্গে তাকে মেলাতে পারি, তাহলেই সে হারিয়ে যায়। তখন ভাবি, নাইই বা চিনলাম সব পাখিকে। কিছু অচিন পাখি, অচিন সুখ অচিন মুখ না থাকলে জীবন বোধহয় বড়োই একঘেয়ে হয়ে যেত। সবই জানার মতো গভীর অজ্ঞানতা বোধহয় আর কিছুই হতে পারে না। জানার সীমা তো থাকেই; থাকে না অজানার সীমা। 

গভীর রাতে, তিতলি যখন আমার পাশে পরম আশ্চস্তি ও নির্লিপ্তিতে আশ্লেষে ঘুমোয়, বাইরে ঝিঁঝি ডাকে একটানা, ঝারিতালাও-এর দিক থেকে ব্যাঙের একঘেয়ে ডাক এবং কখনও-সখনও সাপের ব্যাঙ ধরার আওয়াজ উঠোন থেকেও ভেসে আসে, তখন বিছানাতে উঠে বসে জানালা খুলে দিই। জানালা খোলাও বিপজ্জনক, শোচিতোটার জন্যে। তবে, ভাগ্যক্রমে আজ অবধি কখনও কারো ঘরে ঢুকে রাতে বা দিনে চিতাটা মানুষ নেয়নি। সেই-ই ভরসা। হাতের কাছে টাঙ্গিটা অবশ্য থাকে, লম্বা টাঙ্গি। 

ভালুমারের বর্ষারাতের আকাশে কোনোদিন চাঁদ থাকে, কোনোদিন থাকে না; আকাশ পরিষ্কার থাকলে বৃষ্টিভেজা বন-পাহাড়ে তারাদের আলো এক নরম সবুজাভ স্নিগ্ধতা মাখিয়ে দেয়। সেই সব মুহূর্তে আমার মনে হয়, আমার যেন অনেক বয়স। অনেক হাজার লক্ষ অযুত নিযুত কোটি বছর ধরে যেন এই পৃথিবীর জঙ্গলে জঙ্গলে আমি ঘুরে বেড়াচ্ছি। কত স্মৃতি, কত সুখবহ ও ভয়াবহ অভিজ্ঞতায় আমার মস্তিষ্ক ভরে রয়েছে। নড়লেই চড়লেই মাথার মধ্যে ঝুমঝুমির মতো তারা নড়ে-চড়ে বেজে ওঠে। তখন মনে হয়, তিতলির সঙ্গে আমি এক গুহাতে বাস করেছিলাম একসময়।। নগ্নাবস্থায়। তখনও মানুষ আগুন জ্বালতে শেখেনি, ধাতুর ব্যবহার শেখেনি, চাষ বাস করতে শেখেনি। কাড়ুয়ার মতো শুধুই শিকার করতে জানতাম তখন আমরা, পাথরের অস্ত্র দিয়ে। তখন ভাষা ছিল শুধু চোখের, আর শরীরের। তখন মানুষের একটামাত্রই জাত ছিল, যে জাতের নাম মানুষ। সে মানুষের মধ্যে ভাষার ব্যবধান ছিলো না, কারণ ভাষাই ছিলো না। অস্ফুট, ক্বচিৎ আওয়াজ করে একে অন্যের সঙ্গে যোগাযোগ করতাম তখন আমরা। বড়লোক গরিব ছিলো না, সাদা কালো ছিলো হয়তো, কিন্তু ঘৃণা ছিলো না, ব্রাহ্মণ চামারের মধ্যে ভাগাভাগি ছিলো না। অনেকদিন আগে হুলুক পাহাড়ে সেই গুহার মধ্যে পাথরের গায়ে শিকারিদের আঁকা ছবি দেখার পর রথীদার সঙ্গে আলোচনায় বসেছিলাম গুহার বাইরে। কাড়ুয়া এখনও সেই অতীত যুগেই পড়ে আছে এ কথা বলেছিলেন রথীদা। আমি বলেছিলাম, আমরা ভুল করে ট্রেনে চড়ে আজ যে সভ্যতা নামক অসভ্যতায় আমাদের উপনীত করেছি তার চেয়ে কি কাড়ুয়ার মতো শিকারি হয়ে থাকাই ভালো ছিলো না! 

কথাটা শুনে রথীদা বলেছিলেন, কথাটা ভেবে দেখার মতো! কত কথাই সেই সব সময়ে মনে আসে। আমার চারপাশে কতরকম শব্দ। কার পায়ের শব্দ? বনদেবীর? তার পায়ের শব্দ কেমন? 

ঋগ্বেদে বনদেবীর দারুণ বর্ণনা আছে। অমন রাতে সে সব কথা মনে পড়ে গা ছমছম করে। গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। 

“ও বনদেবী! ও বনদেবী! তুমি কখনও কোনো গ্রামে আসো না? তুমিও কি পুরুষমানুষদের ভয় পাও? তুমি দূরের দিগন্তে কেবলই মিলিয়ে যাও কেন? দেবী, আমাকে একদিন দেখা দাও। 

যখন ঘাসফড়িং, দূর জঙ্গলের ঘন বনে চরে বেড়ানো গুরু গভীর ডাকে সাড়ে দেয়, তাদের শিং ঝাঁকানোতেই গলার ঘণ্টা ডুং-ডুং করে বেজে ওঠে তখন মনে হয়, বনদেবী তুমি সেই গো-ঘণ্টার ডুং ডুঙানি শুনতে বোধহয় খুব ভালোবাসো। 

কখনও কখনও তোমাকে এক এক ঝলক মাত্র শুধু দেখা যায়, ঝাঁকি দর্শনে। এবং দূর থেকে তোমায় দেখে মনে হয় তুমি যেন দূরের টাড়ে ভাসমান মেঘের মতো ঘাস খুঁটে খাওয়া কোনো বনচারী গবাদি জীব। কখনও বা মনে হয় তুমি বুঝি দূর জঙ্গলের কোনো বন-চরিয়ালের অভিযানে ছেড়ে-যাও ঘর। রাতের বেলা তোমার গলার স্বর শুনে মনে হয় যেন বহুদূরের ধূলিধূসরিত বনপথ বেয়ে গরুর গাড়ি চলেছে ক্যাঁচোর কোঁচোর হৃদয়ভাঙা শব্দ তুলে। 

বনের মধ্যে তোমার গলার স্বর শুনে এক একবার মনে হয় গবাদি জীবের ডাক বুঝি। কখনও মনে হয়, জঙ্গলের গভীরে বুঝি কোনো নিষ্ঠুর কাঠুরের সদ্য কাটা মহীরূহ ভূতলশায়ী হল আর্তনাদে। যদি কেউ রাতে জঙ্গলে থাকে, তাহলে সুদূরে তোমার গলার স্বর শুনে তার মনে হতে পারে তা কোনো নারীর কান্না। 

বনদেবী, তুমি কারোই কোনো ক্ষতি করো না। ক্ষতি করো না শত্রুরও, যদি সে তোমার খুব কাছাকাছি আসার চেষ্টা না করে। বনের মিষ্টি ফল খেয়ে তুমি থাকো এবং বনের মধ্যে তোমার যেখানে খুশি সেখানেই বিশ্রাম করো। 

আমি বনদেবীর বর্ণনা করছি। তুমি সুস্নাতা, সুগন্ধি, সুবেশা। তুমি সব সময়ই সুপ্তা। যদিও নিজে হাতে তুমি কখনও চাষ করো না। এই পৃথিবীর সমস্ত কিছুরই তুমি মাতা।” 

এইরকম রাতে একা থাকলেই মনে হয় কত যুগ-যুগান্তরের কত কালের কবিরা আমার চারপাশে নীরবে দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁদের সস্নেহে অদৃশ্য দৃষ্টি আমি যেন আমার দু’ কাঁধের ওপর পড়েছে বলে অনুভব করি। বাইরে হাওয়া দেয়। জলভেজা পাতায় পাতায় শিরশিরানি ওঠে। গোঁড় লেবুগাছের ফুল থেকে এরকম অসভ্য গন্ধ বেরোয়। 

হঠাৎ তিতলি ঘুম ভেঙে বলে ওঠে, কী করছ তুমি? কী দেখছ? 

কিছু না। 

কিছু না কি আবার! 

কিছুই না। 

এই সময় আমাকে কেউ বিরক্ত করলে আমার ভীষণ রাগ হয়ে যায়। তিতলি হয়তো বোঝে না যে, আমার মতো এবং ওরও মতোই সমস্ত মানুষই একা। তার একক সত্তাটাই তার সবচেয়ে সত্য সত্তা। অথচ সেই একা মানুষ যতখানি বাঁচে তার সমস্ত সময়ই পরিবৃত্ত হয়ে, অন্যর ভাবনা, বুদ্ধি-দুর্বুদ্ধি দ্বারা চালিত হয়ে থাকে। সে নিজেকে নিজের করে, পরম নিজস্বতায় একটুও পায় না। 

তিতলির চোখে আজকাল প্রায়ই এক গভীর ভয়ও উঁকি মারতে দেখি। সেই ভয়ের স্বরূপ সে নিজেও জানে না, তার সমস্ত বুদ্ধি দু’হাতে জড়ো করেও, যে-মানুষকে তার মতো করে সে এ জীবনে পেয়েছে, যার শরীরের শরিক সে হয়েছে, তার মনের নাগাল না পেয়ে ছটফট করে। হীনন্মন্যতায় ভোগে। এই ক্ষেত্রে আমার আর ওর জাত আলাদা। 

আমি যা ভাবি, যা বলতে চাই, তা আমার এই ডাইরির অনেক পাঠিকা হয়তো নিশ্চয়ই বুঝবেন, কিন্তু মেয়ে হয়েও তিতলি কোনোদিনও বুঝবে না, যদিও ও আমার স্ত্রী। একই মানুষের মনের মধ্যেই কত বিভিন্ন মানুষ বাস করে এবং বাস করে বলেই, মানুষের কোনো সম্পর্কই পরম ও চূড়ান্ত সম্পর্ক নয়। সমস্ত সম্পর্কই অসম্পূর্ণ। শরীর অথবা মন কিছুমাত্র বাকি না রেখে অন্যকে দিতে চাইলেও অন্য মানুষকে কখনওই চূড়ান্ত ভাবে পাওয়া হয়ে ওঠে না। ফাঁক থাকেই। বাকি থাকেই কিছু। এই মুহূর্তে পৃথিবীর কোণে কোণে কোটি কোটি নারী কোটি কোটি পুরুষ হয়তো তার জীবনসাথীকে পরিপূর্ণ করে চাইছে। মনে হয়, এই পরিপূর্ণ করে পাওয়ার কামনাটাই ভুল। কেউ অন্যকে পরিপূর্ণ করে পেতে পারে না। আমরা আমাদের এক সামান্য অংশকেই মাত্র অন্যকে দিতে পারি। সে বন্ধুই হোক, শত্রুই হোক, জীবনসাথীই হোক, কী প্রেমিকাই হোক। আমাদের একাকীত্ব সম্পূর্ণতা পায় শুধু প্রকৃতিতেই, ভগবৎ বোধে। “আপনাকে এই জানা আমার ফুরাবে না ফুরোবে না, সেই জানারই সঙ্গে সঙ্গে তোমায় চেনা।” 

একদিন ঊর্বশী পুরুবাকে বলেছিলেন তোমার সঙ্গে, কথা বলে কী লাভ আমার পুরুরবা? প্রথম ভোরের মতো আমি মিলিয়ে গেছি, তোমার ঘরে ফিরে যাও তুমি। আমি হাওয়ার মতো। আমাকে ধরা যায় না।’ 

পুরুরবার মতোই আমি যখন গভীর দুঃখের সঙ্গে বলব তিতলিকে : “আমি একা একা হারিয়ে যাচ্ছি, আমি চলে যাচ্ছি আমার চৈতন্যের দিগন্তরেখায়, নেকড়েরা সেখানে ছিঁড়ে খাবে আমাকে, তুমি আমাকে ছেড়ে যেও না।” তখন হয়তো উর্বশী যেমন পুরুরবাকে বলেছিল তেমন করেই তিতলি চিরন্তন নারীর কথায় বলবে : “তুমি চলে যেও না, হারিয়ে যেও না, ভীষণ নেকড়েদের হাতে ছেড়ে দিও না নিজেকে। অমন নির্বুদ্ধিতা আমাদের মতো সামান্যা এক নারীর জন্যে। সখ্যতা বা বন্ধুত্ব কোনো নারীর মধ্যেই তুমি কখনও পাবে না। তা ভুল করে খুঁজতে যেও না কখনও। কারণ, নারীদের হৃদয় আধাপোষমানা শেয়ালনীদের মতো। কোনো নারীই কোনো পুরুষের পুরোপুরি বশে থাকে না, কখনও পোষ মানে না, এইই নারীর স্বভাবের গতির বিস্ময়ময় বিপন্নতা। অথবা নিঃসংশয় নিরাপত্তা।” 

এই গভীর সুষুপ্ত অরণ্যানীর মধ্যে আমি এমন একা-জাগার রাতে মৌন মহাকালের নীরব বার্তা শুনতে পাই। সেই সব মুহূর্তে আমার জাগতিক, সমস্ত পারিপার্শ্বিক আমার দেশীয় বোধাবোধ, আমার রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, ব্যক্তিক সমস্ত বিবেচনা এবং ভাবনাকে তুচ্ছ করে সবুজ অ্যাগী, লিভারওয়ার্ট, হর্সটেইলস্ ক্লাবব মসেস, জীনো-স্পার্মস্ অ্যাঙ্গিওস্পার্ম এবং গিংকোদের পূর্বসূরিদের বিরাটত্ব প্রচণ্ডভাবে ঘিরে রাখে। যে জঙ্গলে ডাইনোসররা ঘুরে বেড়াত একদিন, যে জঙ্গলে দু-ফিট বিস্তৃতির পাখার তেলাপোকারা আর ফড়িংরা উড়ে বেড়াত আর তাদের ধরে খেতো অতিকায় সব মাকড়সা আর বিছেরা, তাদের সকলকে মনশ্চক্ষে দেখতে পাই। আর ঠিক তখনই সেই মুহূর্তে, এই জীবন, এই কাল অনাদিকালের এক তুচ্ছতম ভগ্নাংশ হয়ে আমার কাছে প্রতীয়মান হয়। সেই আমি, অনাদি আমি, আমার আমি, একা আমি, যে আমিই একমাত্র সত্য, যে-আমির সঙ্গেই যুগযুগান্ত ধরে তারা মিলন চলেছে। “দেওয়া নেওয়া ফিরিয়ে দেওয়া জনম জনম এই চলেছে তোমায় আমায়, মরণ কভু তারে থামায়?” 

আমার ডেরার চারধারে, যতদূর মানুষের চোখ যায় আদিগন্ত শুধু ডেসিডুয়াস্ বনের রাজ্য। যখন তাদের দিকে এমন নির্জন সম্পূর্ণ একা অবস্থায় তাকাই তখন আমার গা শিরশির করে উঠে। আমি তো সেদিনের! এই বনরাজিনীলার বয়স ছত্রিশ কোটি বছর। বনরাজিনীলা তখন ছিলো না—তাদের পূর্বসূরিরা তখন সমুদ্রের মধ্যে থেকে প্রান্তিক এলাকা ছেড়ে ডাঙায় আসতে চেষ্টা করতে আরম্ভ করেছে শুধু মাত্ৰ। তারা প্রচণ্ড বাধা বিপত্তি তুচ্ছ করে জয়ী হয়েছিল। 

আনুমানিক বেয়াল্লিশ কোটি বছর আগে সমুদ্র ছেড়ে প্রস্তরাকীর্ণ নগ্ন ভূখণ্ডে প্রথম এই সবুজের নিশান ওড়ে। ভূখণ্ডের কঠিন প্রস্তরময় নগ্নতাকে নম্রসবুজ পরিধানে ঢেকে দিতে আরম্ভ করে তারা সেইই প্রথম। কোনও গাছ বা লতা বা ঝোপ যে এই বিজয়াভিযানে নেতৃত্ব দিয়েছিল তার খবর এখনও মানুষের কাছে অজানা। 

কত কথাই মনে হয়। রাত বাড়ে। বৃষ্টি ঝরে। ক্বচিৎ জোনাকির দল রাতের বেলায় চোখে-আলো পড়া হরিণের দলের সবুজ চোখের মতো ঝিকমিক্ করে ওঠে জলভেজা অন্ধকারে। ঝিঁঝিরা একটানা এক পর্দায় ডেকে চলে। মাঝে মাঝে স্বরের আরোহণ অবরোহণও ঘটে। মনে হয়, আমি একা। এই পৃথিবীতে আমি যেন অনন্তকাল ধরে বৃষ্টি ভেজা সুগন্ধি হাওয়ার মধ্যে জানালা খুলে বসে আছি। 

বসে বসে, কত কথাই মনে হয়। অনন্তকাল যেন স্তব্ধ হয়ে থাকে আমার খোলা জানালার সামনের নিবিড় অন্ধকার বনানীর মধ্যে। 

তুষারযুগের আগে ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার উদ্ভিদজগতে পরম সাদৃশ্য ছিল। একই রকম গাছাগাছালি, লতাপাতা তখন জন্মাত। কিন্তু, আজ ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার কোনো গাছগাছালি উদ্ভিদের মধ্যে আর মিল নেই। তুষারাচ্ছাদিত আদিগন্ত হিমবাহের চাপে যখন ইউরোপের অরণ্য দক্ষিণে নেমে আসছিল তখন পূর্ব-পশ্চিম জুড়ে দাঁড়িয়ে থাকা আল্পস্, পীরিনীজ, বালকানস্, ককেশাস্ ইত্যাদি পর্বতমালার পাদদেশে এসে তারা ঠেকে যায়। এই সমস্ত পর্বতমালার সবগুলিই তখন সম্পূর্ণ তুষারাবৃত ছিল, কারণ পৃথিবী তখনও গরম হয়ে ওঠেনি। সেই তুষারাবৃত পর্বতমালাতে তুষারবাহিত হয়ে এসে ঐ অরণ্যের বীজরা আর নতুন প্রাণের সঞ্চার করতে পারল না। এইভাবে তুষার যুগের আগের যতরকম উদ্ভিদ এবং অরণ্য তখন গড়ে উঠেছিল তাদের প্রত্যেকের প্রজাতিই বিনষ্ট হয়ে গেল। কিন্তু উত্তর আমেরিকাতে সমস্ত পর্বতমালা উত্তর থেকে দক্ষিণে দাঁড়িয়ে ছিল বলে তুষার নিপীড়িত ও তাড়িত উদ্ভিদ ও অরণ্যানী সেখানে অমন ভাবে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়নি। 

চারবার ঐ তুষারবাহরা এগিয়ে এসে আবারও পেছিয়ে গেল। নিউ ইংল্যান্ড থেকে মাত্র দশ হাজার বছর আগে তারা পেছিয়ে যায়। বরফ সরে গেল। পড়ে রইল জীবনরহিত, ক্ষতবিক্ষত, বরফবাহিত স্তূপীকৃত ধ্বংসস্তূপ কঙ্কালের মতো। এই দাঁত বের করা কঙ্কালসার বরফাবৃত পৃথিবীর ওপরেই নতুন করে উদ্ভিদেরা আবার তাদের সংসার পেতেছিল। একথা অনেক বিজ্ঞানী মনে করেন যে আজ আমরা তেমনই এক হিমবাহ অন্তবর্তী যুগে বাস করছি। আমার ভালুমার, চিপাদোহর, হুলুক্‌ গাড়ু কোয়েল, ঔরঙ্গা, মীচাবেটী আমাদের সকলের সব সুখ-দুঃখ আশা-আকাঙ্ক্ষা, হতাশা-দীর্ঘশ্বাস এবং আনন্দসমেত, একদিন হয়তো আবারও বরফের তলায় চলে যাবে। শুধু ভালুমারই নয়, সমস্ত ভারতবর্ষ, সমস্ত পৃথিবীর ভূখণ্ডে। 

যখনই তুমুল বৃষ্টি পড়ে, সারারাত ঘন ঘন বিদ্যুৎ চমকায়, বুকের মধ্যে কাঁপন তুলে বাজ পড়ে, আর নালা দিয়ে, গাড়ুহা দিয়ে, প্রতিটি আবৃত ও অনাবৃত খোয়াই দিয়ে তোড়ে কলরোল তুলে জল ছুটে চলে জানা থেকে অজানার দিকে, কামার্ত ও কামার্তা শেয়াল শেয়ালনীরা যখন পৈশাচিক ডাক ডাকে বৃষ্টিকে রমণ করতে করতে, হাওয়ার ধু-ধু পৃথিবী হয় মরুভূমি, নয় মৃত্যুর মতো শীতল রুক্ষ নগ্নতা অথবা অন্ধকারের রনবনানী ভয়ার্ত পাখিদের করুণ কাকলিতে যখন কাকলিমুখর হয়ে ওঠে, তখন আমি মনশ্চক্ষে দেখতে পাই সে ন্যূহ আবারও নৌকো ভাসিয়েছেন। এক-এক জোড়া প্রাণী নিয়ে। এখন কলি। ঘোর কলি। এক-জোড়া নিষ্পাপ মানুষ কি আছে এই অভিশপ্ত পৃথিবীতে যারা দুজন ন্যূহর নৌকোয় চড়বার যোগ্যতা রাখেন? বোধ হয় নেই। একবার ভয় হয়। কী হবে? তারপরই মনে হয়, যাক সব ভেসে যাক। ধ্বংস হয়ে যাক গর্বিত আত্মমগ্ন অন্ধ মানুষের নিজেরই কুৎসিত লালসার হাতে তার নিজের ইতিহাস, তার যা-কিছু ভাল, এবং তারই সঙ্গে শেষ হয়ে যাক সব ভণ্ডামি, ভেদাভেদ, অনাচার, আর অবিচার। আবার সেই হু হু হাওয়ার ধু-ধু পৃথিবীর; হয় মরুভূমি, নয় মৃত্যুর মতো শীতল রুক্ষ নগ্নতা, অথবা নিষ্ঠুর হিমবাহর বষল লীলা খেলা। আবার শুরু হোক উদ্ভিদ জগতের নতুন অভিযান। একটি একটি করে ফুল, ঘাস পাখি, ফল, প্রজাপতি, মানুষ, একটু একটু করে সততা, বিশ্বাস, আন্তরিকতা; ভালবাসা, সব ফিরে আসুক। 

সময়? 

যা লাগে লাগবে। যা লাগবে, তাইই নিরুপায়ে দিতে হবে। উপায় নেই, কোনো উপায় নেই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *