৪২
মাঝে একদিন চিপাদোহর-এ গেছিলাম। এখানে বড়ো হাট বসে। কিছু কেনাকাটার ছিল। হাটে অন্যান্যদের সঙ্গে যেমন হল; লালটু পাণ্ডের সঙ্গেও দেখা হল। লালটু রান্নাঘরেও যেমন রান্নাঘরের বাইরেও তেমন। সিদ্ধ অবস্থাতেও যা, অসিদ্ধ অবস্থাতেও তাইই। সবসময়ই একই মেজাজে আছে। তার যুবতী স্ত্রীর স্বপ্নে সে সদাই মশগুল। সবসময় তারই কথা তারই উদ্দেশে শের্ বানানো এবং দিনে রাতে রাজ্যের লোকের জন্যে রেঁধে এবং তাদের খাইয়ে আনন্দে থাকা।
কী লালটু? আছ কেমন?
ফাইন।
এই ফাইন কথাটা নিতাইবাবু ওকে শিখিয়েছেন। আজকাল মাঝে মাঝেই লালটু ফাইন, ভেরি গুড, থ্যাঙ্কউ ইত্যাদি বলে। আমাদের শহরগুলির মতোই গ্রামে-গঞ্জে, পাহাড়ে-জঙ্গলেও ধীরে ধীরে ইংরেজি সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ ঘটেছে। সংস্কৃতি ঠিক নয়, অপসংস্কৃতি। ওদেরই বা দোষ কী করে দিই! শহরের বড়ো বড়ো মানুষেরই এখন স্বদেশি ভাষা, স্বদেশি সংস্কৃতি, স্বদেশি আচার-ব্যবহার, স্বদেশি পোশাককে ছোট চোখে দেখেন। যখন আমরা ইংরেজের পরাধীন ছিলাম তখনও আমরা এতখানি হীনন্মন্যতায় ভুগতাম না। আমাদের পূর্বপুরুষরা খদ্দর পরে, মাদক বর্জন করে, চরকা কেটে বোমা বানিয়ে ইংরেজ তাড়ালেন দেশ থেকে। গান গাইলেন, “বিনা স্বদেশি ভাষা মিটি কি আশা?” আর দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ধীরে ধীরে আমরা ইঙ্গ-বঙ্গ সংস্কৃতির দিকে শ্লাঘার সঙ্গে ঝুঁকছি।
সেদিন ডালটনগঞ্জের একজন এস-ডি-ও সাহেবের বাড়িতে গিয়ে দেখি তাঁর ছেলে ইংরিজি-মাধ্যম স্কুলের নীল রঙা পোশাক পরে গলায় লাল নেংটি ইঁদুরের মতো এক বিঘৎ একটি ক্ষুদে টাই ঝুলিয়ে এনিড ব্লাইটন-এর বই পড়েছে দু’পা ছড়িয়ে বাইরের বারান্দাতে বসে। সাহেব গর্ব-গর্ব চোখে ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন, স্কুলে যাও বেটা। গাড়ি বের করছে ড্রাইভার
ছেলেটি হঠাৎ বিরক্ত গলায় বই নামিয়ে দু’পা আছড়ে বলল, ফাক্-ইট-ওল। ছেলের বাবা আমার দিকে গর্ব-গর্ব চোখে তাকালেন। তাঁর বারো বছরের ছেলে যে সাহেবদের চেয়েও বেশি সাহেব হয়ে উঠেছে এ কথা হৃদয়ঙ্গম করে বাবার মনে শ্লাঘা এবং সস্নেহ-মিশ্রিত এক তূরীর ভাব জাগরুক হল। মুখ দিয়ে দুপুরবেলার ফাঁকামাঠে দড়ি-বাঁধা বোকা পাঁঠারা যেমন অদ্ভুত এক ধরনের গদ-গদ জবজবে অস্ফুট আওয়াজ করে, তেমন আওয়াজ করলেন একটা।
আমি ছেলের বাবার দিকে চেয়ে মনে মনে বললাম, সত্যই সেলুকাস! কী বিচিত্ৰ এই দেশ।
আমি তো জঙ্গলের গভীরের একজন আধা-শিক্ষিত মানুষ। আমার দেখাদেখি বোঝাবুঝি আর কতটুকু! কিন্তু আজকাল কেবলি মনে হয়, সরকারি আমলা এবং বিত্তবান তথাকথিত শিক্ষিত ভারতীয়দের দেখে, এমন কী লালটু পাণ্ডেদেরও দেখে, তাইই হয়, তবে এই শুধুমাত্র ইংরিজি বিশারদ এবং বিত্তমান ভারতীয়দের দ্বারা এ দেশের বিন্দুমাত্রই উপকার হবে না বরং ভবিষ্যৎ কবরস্থই হবে। আজ এমন এক সারা দেশেই বোধহয় এই সর্বনাশী নিঃশব্দ অবক্ষয় কায়েম হয়ে বসেছে। যদি সত্যিই ঐতিহাসিক মুহূর্তে আমরা প্রত্যেকে এসে দাঁড়িয়েছি যে, আমাদের প্রত্যেককে ভারতীয়ত্বে, ভারতীয় সংস্কৃতিতে গর্বিত ও সম্পৃক্ত থাকতে হবে। নইলে, ভারত নামের এই বিরাট, একক, স্বরাট দেশ-এর অস্তিত্ব অচিরেই লোপ পাবে। গড়ে উঠবে ছোটো ছোটো স্বার্থপর, আত্মমগ্ন, খণ্ডরাজ্য। মাথা চাড়া দেবে বিচ্ছিন্নতাবাদ। টুকরো হয়ে যাবে, দীর্ণ-বিদীর্ণ হয়ে যাবে যুগযুগান্ত ধরে যে স্বপ্ন আমাদের পিতা-পিতামহ -প্রপিতামহ এবং আমরাও দেখে এসেছি তা।
বলেছিলাম লালটু পাণ্ডের কথা, তা থেকে কত কথাতেই এসে গেলাম। আসলে আমার এই ডাইরি কেউ কখনও দেখবে না, তা নিশ্চিত করে জানি। এই গোঁড়া অশিক্ষিত, জংগি, অলেখক মানুষের লেখা কোনো নামী-দামি পত্রিকার সম্পাদক প্রকাশের যোগ্য বলে কখনও বিবেচনাও করবেন না। তাছাড়া এই ব্যক্তিগত ডাইরি প্রকাশের কথাই বা উঠবে কেন? ডাইরি তো ডাইরিই! এ আমার মনেরই ছবি, অন্যমনের আয়নায়। এ তো অন্যকে দেখানোর জন্যে নয়। তাইই যা মনে আসে, যা ঘটে, যা ঘটতে পারে বলে মনে হয়, পরম্পরাহীন ভাবে যাই ভাবি যা শুনি তার সবই লিখে রাখি। এ’তে আমারই একার পড়বার জন্যে। তাই এ ভালো হল, কী মন্দ হল, তাতে কীই বা যায় আসে?
লালটু অনেকক্ষণ আমার সঙ্গে সঙ্গে ঘুরল। ওর বৌয়ের জন্য এক গোছ কাচের চুড়ি কিনে দিলাম। খুব খুশি হল ও। বলল, এ সপ্তাহের শেষেই দেশে যাবে। রোশনলালবাবু ছুটি দিয়েছে। জঙ্গল থেকে আমলকী জোগাড় করেছে দু’ বস্তা। আমলকী নিয়ে যাবে। বৌ তার আমলার আচার খেতে বড় ভালোবাসে। প্যাড়া আর গুজিয়া নিয়ে যাবে চিপাদোহর থেকে। আর যাবার আগে লাতেহার থেকে আনিয়ে নেবে পণ্ডিতদের দোকানের খাঁটি গিয়ে ভাজা কালাজাম। লালটুর চোখ-মুখ খুশিতে ঝল্মল্ করছিল।
হাট সেরে আমরা লংকার গুঁড়া দেওয়া ঝাল-বিস্কুট দিয়ে শালগাছতলায় বসে চা খেলাম। গজেনবাবুর অবস্থা দেখলাম কিঞ্চিৎ বেসামাল।
হাট থেকেই সরাসরি বাস ধরব ভেবেছিলাম। কিন্তু নিতাইবাবুর সঙ্গে দেখা হতে ছাড়লেন না। গজেনবাবুরা কেউই নেই। ডালটনগঞ্জে গেছেন। আজকে মালিকের ডেরা প্রায় ফাঁকা।
নিতাইবাবু বললেন, মালিকের চাকরি ছেড়েছেন তো কি? আমরা তো আপনাকে ছাড়ি নি। চলুন চলুন, চা খেয়ে যাবেন। বাসের দেরি আছে এখনও অনেক। ডেরাতে গিয়ে বসলাম উঠোনে। তখনও রোদ ছিল। তাই আমাগাছের ছায়াতে চেয়ারে টেনে বসলাম। আদা দিয়ে দারচিনি দিয়ে ফার্স্ট ক্লাস চা করতে বললেন নিতাইবাবু। সঙ্গে কুচো নিমকি। নিতাইবাবুর মস্ত শখ নানারকম রান্নার একপেরিমেন্ট করা। দিশি ব্যাঙের ছাতার সঙ্গে আনারস কুচি এবং দাহিলী-র পেট মোটা লঙ্কা কুচি মিশিয়ে উনি ওমলেট্ ভাজেন। একদিন, চিনা বাদাম, কোলকাতা থেকে আনা কাউঠার পিঠের সুস্বাদু মোটা কচ্কচ্ েচামড়া, (টুকরো করে কাটা) এবং তার মধ্যে কাঁচা আম এবং ডুমো ডুমো করে কাটা বাঘা ওল ফেলে খিচুড়ি রেঁধে খাইয়েছিলেন খেসারির ডাল দিয়ে। খেসারির ডালের যে খিছুড়ি হয়, তা আগে কখনও জানতাম না। বললেন, খান, আমার বানানো নিমকি খেয়ে দেখুন। নতুন একপেরিমেন্ট।
খেয়ে মরে যাব, না শুধুই অজ্ঞান হব? আগে বলবেন তো তা!
আরে! খেলে বার বার চেয়ে খেতে হবে। খান্তো আগে।
খেয়ে দেখি, শুকনা লংকার গুঁড়ো, জোয়ান, কালোজিরে এবং তার মধ্যে কারিপাতা ফেলে ময়দা মেখে, অল্প ময়ান দিয়ে নিমকি হয়েছে। এক্কেবারে লাজোয়াব!
আমার চোখ-মুখের ভাব লক্ষ করে খুব খুশি হয়ে বললেন; কেমন? কেমন? বলেছিলাম না।?
চা-ও এল।
আপনি খাবেন না?
দুস্স্। দেখছেন না সূর্য পশ্চিমে হেলে গেছে। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই সান্-ডাউন হয়ে যাবে। সান-ডাউনের পর কোনো অখাদ্য-কুখাদ্য খাই না আমি। লিভার খারাপ হয়ে যাবে।
আমরা বারান্দায় বসে আছি, এমন সময় দেখি একটি লোক হাতে একটি টেলিগ্রাম নিয়ে দৌড়ে এল।
সেরেছে!
স্বগতোক্তি করলেন নিতাইবাবু। এই বন-পাহাড়ের গভীরে টেলিগ্রাম সবসময়ই কোনো-না কোনো শোকের খবর বয়ে আনে। এই পর্যন্ত কাউকে শুনিনি যে, লটারির টিকিট পেয়ে লাখপতি হয়েছে বা কোনো বড়োলোকের মেয়ে কাউকে বিয়ে করতে চেয়েছে এমন খবর নিয়ে কারোই তার এলো।
কেক্রো হো? নিতাইবাবু শুধোলেন।
লাল্টু পাণ্ডেকো!
লালটু তো হাটেই আছে। কাল দেশ যাবে, বউয়ের জন্যে সওদা করছে। তা তারটা আমাকে দে, আমি পড়ে রাখি। আর লালটুকে ডেকেও পাঠাচ্ছি।
টেলিগ্রামটা খুলেই নিতাইবাবুর মুখ কালো হয়ে এল।
কী হয়েছে?
নিতাইবাবু কথা না বলে টেলিগ্রামটা আমার হাতে তুলে দিলেন। দেখি, লেখা আছে—ওয়াইফ ফ্লেড উইথ নাটা পাণ্ডে। কাম শার্প।
কী জানি, গাঁয়ের কোনো ইংরিজি জানা লোককে ধরে তার মা বা ছোট ভাই বা গাঁয়ের কোনো লোক এই তার পাঠিয়েছে। কাগজটা হাত থেকে নামাতে না-নামাতে দেখি লালটু দৌড়ে আসেছে উঠানের অন্য প্রান্ত থেকে। তার ঘাড়ে কাঁধে অনেক বাজার। বাজারের ভারে বেচারি নুয়ে আছে। সামনে এসে উদ্বিগ্ন গলায় বলল, কী খবর বাবু? তার? কীসের?
আমি চুপ করে রইলাম। নিতাইবাবুও চুপ।
কী করে খবরটা দেবেন বোধহয় বুঝে উঠেত পারছেন না। লালটু সরল এবং আতঙ্কিত মুখে শুধোল, মা?
নিতাইবাবু দুপাশে মাথা নাড়লেন।
ভাই?
আবারও মাথা নাড়লেন।
বোন?
আবারও তাই।
তারপরই বহু-উ-উ-উ-উ বলে এক অতর্কিত আর্তচিৎকার করে উঠে উঠোনের ধুলোতে পড়ে সে গড়াগড়ি করতে লাগল।
নিতাইবাবু আমাকে ইশারায় ডেকে উঠে গেলেন, চেয়ার ছেড়ে। লালটুর অন্য সহকর্মীরা সব দৌড়ে এল। লালটুর মুখে কথা নেই। কাটাপাঁঠার মতো সে ছট্ফট্ করছে যন্ত্রণায়।
নিতাইবাবু একটি ট্রাকের বন্দোবস্ত করলেন যাতে লালটু আজ রাতেই চলে যেতে পারে ডালটনগঞ্জ। তারপর সেখান থেকে ট্রেন বা বাস ধরবে। আমি কী বলব ভেবে পাচ্ছিলাম না। আমার গলার কাছে কী একটা জিনিস দলা পাকিয়ে উঠেছিল। নিতাইবাবু অস্তগামী সূর্যের লাল আলোয় রাঙা গভীর জঙ্গল আর ধূলিধূসরিত লাল মাটির পথের দিকে চেয়ে স্বগতোক্তি করলেন, বউ মরে গেছে জেনেই ও যাক। কারণ, যে বউকে এত ভালোবাসে, বৌকে নিয়ে যার এত কাব্যি; সে নিজে এ কথা সইতেই পারবে না যে, তার বউ ভেগে গেছে তার পাশের বাড়ির বোবা কিন্তু শক্ত সমর্থ হাট্টা কাট্টা সাইকেলের টায়ার সারানো মিস্ত্রির সঙ্গে
আপনি চেনেন না কি?
চিনি না? নিতাইবাবু বললেন। আমি যে লালটুর বাড়িতে গেছি ওর সঙ্গে। থেকেছি। ওর মা কত আদর যত্ন করছিল। তখনই বৌটাকে দেখে আমার কেমন মনে হয়েছিল। কেমন যেন, বুঝলেন, শরীরসর্বস্ব। মাথায় কোনো মাল নেই, কবিত্বটবিত্ব তো দুরের কথা। আসলে মেয়ে জাতটাই অমন মশায়। মুখ-সর্বস্ব আর শরীর-সর্বস্ব। আর কিছু বোঝে না ওরা; চিজ্ এক এক খানা।
অত দুঃখেও মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল, কী যে বলেন!
ঠিকই বলি। এখন লালটুর যন্ত্রপাতিতে কোনো গোলমাল ছিলো কী না তা বলতে পারব না। না-থাকলে, ঐ বউকে নিয়ে শের-শায়েরী ওড়াবার মতো ইডিয়ট্ লালটু ছাড়া আর কে হবে? আসলে মশাই, কোনো মেয়েছেলেকে নিয়েই কবিতা-টবিতা লেখার মানে হয় না। কবিগুলো আকাট্ ইডিয়ট্ সব। মেয়েছেলেরা যা বোঝে, তা আর যাইই হোক কবিতা নয়।
আমি চুপ করে রইলাম। ব্যাপারটার অভাবনীয়তা এবং লালটুর শোক আমাকে এতই অভিভূত করে ফেলেছিল যে কিছু বলার মতো অবস্থা ছিলো না।
লালটু তখন আমার নাম ধরে ডেকে, আমাকে দেখিয়ে ওর বৌ-এর জন্যে কিনে-দেওয়া কাচের চুড়িগুলো আছড়ে আছড়ে ভাঙছিল। রুমানিয়া, যে মেয়েটি কুয়ো থেকে জল তুলে ড্রামে আর ক্যানেস্তারায় ভরে সকাল-বিকেল, সে ছেঁড়া শাড়ি পরে লুব্ধ চোখে সুন্দর চুড়িগুলোর দিকে চেয়েছিল গাছতলায় দাঁড়িয়ে। প্রথমে চুড়িগুলোর জন্যে লোভ ছিল তার। কিন্তু এখন আর নেই। এক গভীর সমবেদনাতে আবিষ্ট হয়ে চেয়ে আছে সে। মনে হল, এখন চুড়ি ভাঙার শব্দ পৌঁছচ্ছে না পর্যন্ত ওর কানে!
প্যাঁ-অ্যাঁ-অ্যাঁ করে হঠা? কানফাটানো আওয়াজ করে সান্ধ্য প্রকৃতির এবং লালটুর শোকমগ্নতা ছিন্নভিন্ন করে দিয়ে বাসটা এসে দাঁড়ালো নাকের কাছে ধুলো উড়িয়ে
বললাম, থেকেই যাই আজ। ড্রাইভারকে দিয়ে একটা খবর পাঠিয়ে দিই বরং ভালুমারে। আজ বাসটা দেরীও করল খুব। অন্ধকার হয়ে গেলে তো মুশকিলে পড়ব। চিতা।
নিতাইবাবু বললেন, আমরা চিপাদোহরের খোঁদলে আছি, তাই। গাড়ুর রাস্তাতে পড়লে দেখবেন চারপাশ উলা। বেলা এখনও অনেক আছে। রাতের আগেই টিকিয়াউড়ান্ চালিয়ে পৌঁছিয়ে দেবে আপনাকে হালিম মিঞা। আর লালটুর জন্যে থাকবেন কোন দুঃখে। ওর বৌ সত্যি মরলেই ভালো হত। বেটী, শরীরের সুখের জন্য মজবুত বোবা লোকের সাথে ভেগেছে। আপদ গেছে। তার জন্য লালটু ইডিয়টা শোক করে করুক, কিন্তু আমার আপনার কী? আমার বউ মরলে কী পালালে আমি তো দাওয়াই দিতাম।
আপনার বউ নেই, তাই-ই, এ সব বলা সাজে।
বিয়ে করে বোকারা। আমার বিয়ে হয়েছে রাম্-এর সঙ্গে। স্ত্রীলিঙ্গ। RUM। রোজ রাতে তার সঙ্গে আমার মিলন। পালাবেও না, মরবেও না। RUM আছে, আর আছে দেওয়ালে সুন্দরীদের ক্যালেন্ডার। বিয়ে করে মরুন গে আপনারা, আপনাদের দিমাগ বিলকুল খারাপ।
তাড়াতাড়ি আমি লালটুর কাছে গিয়ে ওকে প্রবোধ দিয়ে এলাম। বললাম, নিতাইবাবু ট্রাক-এর বন্দোবস্ত করেছেন। লালটু কেঁদে কেঁদে বলল, আর কী হবে? গিয়ে তো দেখব হাদুয়া নদীর পাশে সে ছাই হয়ে গেছে।
বাসটা ছেড়ে ছিল। হালিম ড্রাইভার খাতির করে পাশে বসালো, পান খাওয়ালো কালা-পিলা-পাত্তি জর্দা দিয়ে। কিন্তু মনটা ঠিক গল্প করার মতো ছিল না। ভাবছিলাম, একদিক দিয়ে ভালোই হল। অমন খরবটা নিতাইবাবু চেপে যাওয়ায়, এখানে লালটু অসম্মান ও টিট্কিরির হাত থেকে তো বাঁচল। আর বৌ-এর মৃত্যু জেনে মনে মনে প্রস্তুত হয়ে গেলে পালিয়ে যাওয়া বৌ-এর জন্য তত কষ্ট আর হবে না। হয়তো সয়ে যাবে। নিতাইবাবু বুদ্ধিমানের কাজই করেছেন।
ভালুমারে যখন এসে নামলাম তখন অন্ধকার হয়ে গেছে। হালিম সকলকেই যতখানি পারে যার যার বাড়ির কাছে নামিয়ে দিল। বাস-স্ট্যান্ড জনশূন্য। আজ বাসের টায়ার বেতলার কাছে ফেটে যাওয়ায় এবং স্টেনিতে মস্ত গ্যাটিস্ লাগানো থাকায় আসতে দেরি হয়ে গেল। বাস থেকে নেমে তাড়াতাড়ি ডেরার দিকে চললাম। প্রায় দরজা অবধি পৌঁছে গেছি হঠাৎ হুলুক্ পাহাড়ের নিচের ঘন বনে হনুমানের দল হু-হু-হুপ্ করে প্রচণ্ড চিৎকার আর গাছে ঝাঁকাঝাঁকি শুরু করে দিল। টর্চ জ্বেলে দৌড়ে আমি ডেরার গেট পেরোলাম। তিতলি আমার শব্দ পেয়েই দরজা খুলে আমাকে টেনে নিল। খুব আতঙ্কিত হয়েছিল মা ও মেয়ে।
তিতলি দরজায় খিল দিয়ে রান্নাঘরে গেল। আমি বারান্দাতেই হাত মুখ ধুয়ে ঘরে গিয়ে খিল তুললাম। পাহাড়তলিতে এখন নানারকম আওয়াজ! পাখির ডাক। কোটরা হরিণের সাবধানবাণী। পুরুষ শিঙাল চিতল হরিণ ডাকছে তার যুবতীর দলকে। ময়ূর কঁকিয়ে কেঁদে উঠল। গরমের সন্ধ্যার এক বিশেষ ব্যক্তিত্ব আছে বনে জঙ্গলে। তার গায়ের গন্ধও সম্পূর্ণ আলাদা। গরম অবশ্য শেষ হতে চলল। এই সময়টাতেই ঝাঁঝে একবার ঝাঁঝাঁ করে সমস্ত প্রকৃতি। মনে হয়, কোনো কামার্তা মধ্যবয়সি নারী পরিতৃপ্ত না-হয়ে, প্রচণ্ড চাপা আক্রোশ নিয়ে, কবে বৃষ্টি এসে ঝাঁপিয়ে পড়বে তার সর্বাঙ্গে, চুমু খাবে, সোহাগ করবে, ভরে দেবে তার রুক্ষতার প্রতি অণু-পরমাণু সহজ জলজ ভালোলাগায়, তার অপেক্ষায় দিন গোনে।
হঠাৎই আমার খুব হাসি পেল। চিতাটার ভয়ে আমি আজ দৌড়ে এলাম। অথচ আমার নিজের কারণে, নিজের জন্যে কখনও ভয় পেয়েছি বলে মনে পড়ে না। তবে আজ পেলাম কেন? তিতলির জন্যে? যে-আসছে, তার জন্যে?
বোধহয় তাই। এ কথা বোধহয় সত্যি, খুবই সত্যি, যে একজন মানুষর জীবনের ভয় তার প্রাপ্তি ও সম্পত্তির সঙ্গে সমানুপাতে বাড়ে। যে কারণে, আমার চেয়ে রোশনলালবাবুর জীবনের ভয় অনেক বেশি। আমার চেয়ে গজেনবাবুর জীবনের ভয় কম। আগের আমির চেয়ে আজকের আমি অনেক বেশি ভীতু। এই কারণেই বোধহয় যাদের হারাবার কিছুমাত্র নেই সেই হ্যাভ্-নটা জীবনের ভয় তুচ্ছ করে দেশে দেশে, যুগে যুগে বিপ্লব করতে পেরেছে। আর হ্যাসরা তাদের স্বার্থপরতার ভয়েই কুঁকড়ে থেকেছে চিরদিন।
তিতলিকে আমি বোঝাব, আমার ছেলেকে আমি দেখাব, দেশটার নাম ভারতবর্ষ। এ-এক বিরাট স্বরাট দেশ। এটা আমেরিকাও নয়, রাশিয়াও নয়, এবং চীনও নয়। আমাদের সব সমস্যা আমাদেরই মোকাবিলা করতে হবে। অনেকগুলো বছর নষ্ট হয়েছে। মানুষকে মানুষের মতো বাঁচতে হবে, বাঁচবার সুযোগ দিতে হবে। তার সঙ্গে প্রকৃতির পশুপাখি, প্রাকৃতিক সম্পদকেও। ওয়ার্লড ওয়াইল্ড লাইফ ফান্ডের চেয়ারম্যন্ নেদারল্যান্ডের রাজকুমার কী করে জানবেন সেই সব মনুষ্যেতর মানুষদের কথা, যারা কান্দাগেঁঠি খুঁড়ে খায়, যারা ধরা-গলায় দীর্ঘশ্বাস ফেলে বনের মর্মরধ্বনির মতো গায় :
“চড়হলো আষাঢ় মাস বরষালে বনা, এ রাম
পহিলে মুঠ বুনলি গোঁন্দনি, হো এ রাম
চিনমিনা তিনদিনা-
গোঁলদনি আড্হাই দিনা, এ রাম
সাঁওয়া মাহিনা লাগ্ গেঁয়ো হো, এ রাম।”
কোন কথা থেকে কোন কথায় এসে গেলাম। ডাইরি লেখার অনেক রকম আছে। আমার এ ডাইরির সব অগোছালো, এলোমেলো। কখনও ফার্স্ট পার্সন সিঙ্গুলার নাম্বারে কথা বলছি। কখনও বা থার্ড পার্সন্-এ। কোথাও ডাইরি-লেখক উপস্থিত। কোথাও বা সে অনুপস্থিত থেকেও লিপিবদ্ধ করেছে সব কিছু। এই এলোমেলোমির সাফাই কী দেব জানি না। পাঠক-পাঠিকা এই অগোছালো, অনভিজ্ঞ, অলেখককে ক্ষমা করবেন।
একমনে একা বসে ভাবা ও পড়ার একটা মস্ত লাভ এই যে, নিজেকে একেবারে নিঃশেষে মুছে ভেলা যায় চেতনা থেকে। অন্য সবকিছুকে ম্যাগনিফাই করে।
কিন্তু হঠাৎ-ই বাদ সাধল পরেশনাথ। দৌড়ে এসে হুমড়ি খেয়ে পড়ে বলল, বাবা জ্বরে অজ্ঞান হয়ে রয়েছে আর মাহাতো এসেছে বাড়িতে বাঁশবাবু। মা তোমাকে এক্ষুণি নিয়ে যেতে বলল ডেকে।
আবার মাহাতো? বলছে কী?
চমকে উঠে বই ঘরে রেখে ওর সঙ্গে বেরিয়ে পড়লাম আমি। লাঠিটাকে হাতে তুলে নিলাম। তিতলিকে চেঁচিয়ে বললাম, আসছি রে—। যাচ্ছ কোথায়া? বলেই গর্ভিণীর ভাত-ঘুম ছেড়ে ঘর থেকে বেরিয়েই পরেশনাথকে দেখেই আন্দাজ করল ও।
লাঠি হাতে বীরপুরুষকে দেখে বলল, সাবধানে যাও। তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরবে। সত্যিকারের বীর হলে লাঠি লাগতো না। বীরত্ব অস্ত্রে থাকে না। থাকে বুকের মধ্যে। আমার নিজের মধ্যে যা নেই, তাই-ই লাঠি আমায় এনে দেবে, এমন মিথ্যে প্রত্যাশা করে।
পথে বেরিয়ে, পরেশনাথকে শুধোলাম, কী করছে রে মাহাতো?
ও সম্পূর্ণ নৈর্ব্যক্তিক গলায় বলল, করবে আবার কী? কিছুই করছে না। দরজার সামনে উবু হয়ে বসে আছে। মার সঙ্গে কথা বলছে।
হুঁ? তুই দাঁড়া একটু। বলেই, আবার ফিরে কিছু ওষুধ নিলাম মানির জন্যে।
জ্বর কত?
জ্বর কবে থেকে এসেছে?
কে জানে?
জানিস না তো, করিস কী বাড়ি বসে? তোর বাপ তা বুড়ো হল, এতরকম ঝামেলা, বাপের খবরটা নিতে পারিস না একটু? মাই-ই বা কী করছিল তোর?
মা ছিল নাকি?
সেরকম নৈর্ব্যক্তিক গলাতেই পরেশনাথ বলল।
ছিল না? গেছিল কোথায়?
মাহাতোর ঘর।
মাহাতোর ঘর? কবে?
সেই হাটের দিনের পরের দিন।
আর আসেনি?
না।
কেন?
কে জানে? মাহাতো এসে মাকে কুয়োতলায় ডেকে নিয়ে হাত ধরে কী সব বলল। অনেক কাঁদল। মা চলে গেল ওর সঙ্গে।
বুলকি কোথায়!
ডেরাতে।
বুলকি সব জানে?
হ্যাঁ। জানবার কী আছে? মাহাতো বলেছে, মাকে বিয়ে করবে। মাও রাজি বাবাকে ফেলে চলে যাবো আমরা দুজনে। মা আর আমি। ভালো খাব। ভালো পরব অনেকদিন দুঃখ করেছি, কান্দাগেঁঠি খুঁড়ে, শুখামহুয়া খেয়ে থেকেছি। এবার মাহাতোর ব্যাটা সাজব বাঁশবাবু। মাহাতোর বউ মরেছে গত পূর্ণিমায়। মাকে মাহাতোর খুব পছন্দ।
ঠাস্স্ করে চড় লাগালাম একটা পরেশনাথের গালে।
পরেশনাথ চমকে উঠল।
অবাক হয়ে তাকাল আমার দিকে। কিন্তু কাঁদল না। বলল, অনেকেই মেরেছে, তুমিও মারলে। মারলে, তো মারলে! মারলে আর লাগে না। মাহাতোর চেলারাই কী কম মেরেছে। মার খেয়ে ত আর পেট ভরে না বাঁশবাবু। যারা না খেয়ে থাকে, তারা জানে। তুমি কী বুঝবে? তোমার ঐ ইস্কুলেও আর আসব না। মাহাতো-বাবার গরু-বাছুর দেখাশোনা করব। মাহাতো-বাবা বলেছে। কত গরু আর মোষ আছে জানো? একটা মোষ আছে না, ইয়া বড়ো; নাম তার ভঁইষালোটন।
এবার আমার অবাক হবার পালা।
টাঁড়টা যখন পেরুচ্ছি, তখন মনে হল যেন একটু একটু মেঘ করেছে আকাশে। তারপর বুঝলাম মনের ভুল। গরমের শেষে পালামৌতে মরুভূমির মতো অবস্থা হয় এত বন-জঙ্গল থাকা সত্ত্বেও। লু-এর বহরে ঘর ছেড়ে বেরোনো যায় না। দিগন্তে মরীচিকার মতো বাষ্প, বৃষ্টির লোভ দেখায়, কিন্তু সে বাষ্প বাষ্প নয়, মনের ভুল। বৃষ্টি আসে না। বৃষ্টি লক্ষপতি বিড়িপাতা আর রোশনলালবাবুর মতো কোটিপতি ব্যবসায়ীর কথাই শোনে, ভালুমারের উপোসী মানুষগুলোর কথা সে কখনওই শোনে না।
টাড় পেরিয়ে আবার জঙ্গলে ঢুকলাম। ন্যাড়া, বিবাগী ধূলিধূসরিত জঙ্গল। হুলুক্ পাহাড়ের দিকে হাওয়াটা হা-হা করে ছুটে যাচ্ছে। এখন আর শুকনো পাতাও ওড়ে না। তারা পাথরে পাথরে, পাথুরে মাটিতে ধুলোর সঙ্গে গুঁড়িয়ে এক হয়ে আছে। পুটুসের ঝোপে এখনও পাতা থাকে। বড় শক্ত প্রাণ ওদের। মানির প্রাণের মতো। খাদ্য ও জল ছাড়া দিব্যি বেঁচে থাকে। তার ভিতরে তিতির বটের আর ছাতারে ছায়া খুঁজে বসে বসে গলা কাঁপিয়ে তৃষিত নিঃশ্বাস নেয়। তৃষ্ণায় ওদের উজ্জ্বল চোখগুলো উজ্জ্বলতর হয়ে ওঠে। আমাদের পায়ের শব্দ শুনে নড়ে-চড়ে বসে ওরা। উষ্ণ ঠোঁটের দীর্ঘশ্বাসে বৃষ্টিকে অভিশাপ দেয়, দেরি করার জন্যে। বেলা পড়লে ওরা প্রথমেই জলে যাবে, যেখানেই জল পাবে, মুঞ্জুরী যেমন গেছে নিরুপায়ে। জল খেয়ে তারপর অন্য কথা। জলই জীবন।
সামনে ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের খোঁড়া সেই গাড়ুহা। অনেকখানি গভীর। একটু হলেই পড়তাম ভিতরে। মানির মতোই। মানির মতোই আমিও চোখ এবং বোধহয় চোখের পাতাও খেয়ে বসে আছি। সময় মতো দেখেছিলাম ভাগ্যিস। দুপাশে ঢাল নামিয়েছে—একটি ঢালের পরই হঠাৎ প্রায় দশফিট গভীর বর্ষার জল জমিয়ে নতুন প্ল্যানটেশনে জল’ দেবে শীতে, বন-বিভাগ
চলতে চলতে রাগটা পড়ে এল! ভাবলাম আমার কী? যা খুশি করুক ওরা। এখন লাঠিটা হাতে করে আসায় লজ্জা লাগছিল। মুঞ্জী যদি মাহাতোকে বিয়ে করাই মনস্থ করে, এত কাণ্ডর পর, এখন তার ঘরণিই হতে চায়, তাতে আমার কী বলার আছে? ওদের ব্যক্তিগত ব্যাপার। আর তাই-ই যদি হবে, তাহলে আমাকেই বা ডাকলো কেন? আমি কি ওদের জমিদারির নোকর? যে, যখন ডেকে পাঠাবে তখনই যেতে হবে?
পরেশনাথ চলতে চলতে দাঁড়িয়ে পরে জম্পেস্ করে একটা ঢেকুর তুলল। সেই মুহূর্তে আমার মনে হল, পরেশনাথকে এত বছর দেখছি, কখনো ঢেকুর তুলতে দেখিনি। আমি কখনও ওকে এমন খাওয়াইনি, আদর করে বসিয়ে, যাতে খেয়ে পরিতৃপ্তিতে ঢেকুর তোলে।
বলল, বড্ড বেশি খাওয়া হয়ে গেছে। অভ্যেস তো নেই। মাহাতো-বাবা নিয়ে এসেছিল ঘিয়েভাজা, পুরি, আঃ! আলুর চোকা, মিষ্টি, ক্ষীর, বালুসাই, লাল কুমড়োর তরকারি, আমের সুখা-আচার। কতরকম মশলা দেওয়া তাতে। টক্টক্, মিষ্টি-মিষ্টি। দিদি খায় নি। বুদ্ধু।
আমি ওকে অগ্রাহ্য করে বললাম,—মানিয়া কী বলেছে তাই বল্?
কী বলবে? বাবা কাঁদছে শুধু সেদিন থেকে। কাঁদা ছাড়া বাবা আর কী করবে? কাঁদে আর নেশা করে, এই-ই…
পরেশনাথের দিকে আবার তাকালাম আমি।
বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো বুঝতে পারলাম হঠাৎ, বড়ো বেদনার সঙ্গে যে, আমি, এমন কী ওর জন্মদাদা মানিও ওর কেউ নয়। ওদের আমরা কেউই নই। যে ওদের দুবেলা পেট ভরে খেতে দেবে, সেইই ওদের সব। সে খাবার যত নোংরা হাত থেকেই আসুক না কেন? যত অসম্মানের সঙ্গেই তা দেওয়া হোক না কেন। পেটে এই গ্রীষ্ম শেষের দাবদাহের মতো খিদে থাকলে, বিদ্যা, শিক্ষা, বিবেক, ন্যায়-অন্যায়, এসবই বাহ্য, ফালতু, বইয়ে-পড়া রাজনীতির পুঁথিগত তত্ত্বে-ভরা ধূলির মতোই ফাঁকা, ন্যাড়া, অন্তঃসারশূন্য। ওদের মুক্তি নেই। আমাদের মুক্তি নেই। কারণ আমাদের সঙ্গে ওদের ভাগ্য শিকল দিয়ে বেঁধে দিয়েছেন বিধাতা কোন অদৃশ্য বন্ধনে, ওদের মুক্তি না ঘটিয়ে আমাদের কোনোক্রমেই মুক্তি নেই। ওদের মরণে আমাদেরও মরণ অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে আছে। বড় অসহায়তার সঙ্গে আমি অন্তরের মর্মস্থলে অনুভব করলাম যে তিতলিকে বিয়ে করে ওদের সমাজেরই একজনকে আমি আমার স্বার্থপর সুখের ছোট মাপের চড়াই পাখির জীবনে সম্পৃক্ত করে পাতি-বুর্জোয়াদের বংশবৃদ্ধিতে সাহায্য করছি মাত্র। আমি ওদের কেউই হতে পারিনি। হয়তো অবচেতনে কখনও হতে চাইওনি। আমার মহত্ত্ব মিথ্যা, মিথ্যা, মিথ্যা। আমার আমিত্ব মিথ্যা।
চলতে চলতে গরম জ্বালাধরা লু-এ চোখ জ্বলতে লাগলো। চোখ জ্বলতে, জ্বলতে, জ্বলতে কখন যেন চোখের কোণে বাষ্প জমে উঠল।
বাষ্পই কি? না, এও গ্রীষ্ম দিগন্তের তাপবাহী আর এক মরীচিকা?