কোজাগর – ৪০

৪০

গরমের শেষে এসে পৌঁছানো গেল। এবার বর্ষা নামবে। ডালটনগঞ্জের গুজরাটে বিড়ি-পাতার ব্যবসায়ীদের বাড়ি বাড়ি বৃষ্টি না-নামার জন্য পুজো চড়েছে আবার! আর ভালুমারের ঘরে ঘরে প্রার্থনা, বৃষ্টি নামার জন্য। 

তিতলি কিন্তু খুব তাড়াতাড়ি লেখাপড়া শিখছে। হিন্দি, ইংরেজি এমনকী বাংলাও । আমার আর ওর নাম এখন ও বাংলায় লিখতে পারে। অবশ্য, শুধুই নাম। মুখার্জিকে এখন লিখছে মুকাজ্জি। 

আমি মুখোপাধ্যায়। মুখার্জি নই। মুকাজ্জি তো নই-ই আগে ও মুখার্জিই লিখতে শিখুক তারপর মুখোপাধ্যায়ের ঝামেলাতে যাব। ডালটনগঞ্জে একজন বাঙালি এস-ডি-ও ছিলেন। তাঁরই সুপারিশে আমার চাকরিটি হয়েছিল রোশনলালবাবুর কোম্পানিতে। ওঁকে বায়োডাটা পাঠিয়েছিলাম টাইপ করে। তার সঙ্গে একটা দরখাস্তও টাইপ করে নিয়ে নিজেই আমার নাম সই করে দিয়েছিলেন সায়ন মুখার্জি বলে। যদিও বায়োডাটাতে মুখোপাধ্যায়েই ছিল। সেই থেকে মুখোপাধ্যায়, মুখার্জি। 

ইংরিজি বাংলা দুই-ই শিখে নিতে পারলে হিন্দির সঙ্গে, তিতলি আমার সত্যিকারের বন্ধু হবে। ওকে রবীন্দ্রনাথ, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, জীবনানন্দ সব পড়াব। আধুনিক কবি ও লেখকদের লেখাও পড়ার। কত কী করব ওকে নিয়ে। শিক্ষা তো আর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাপ নয়। বিশ্ববিদ্যালয় তো শুধু বিদ্যা শিক্ষার ইচ্ছাটাকেই জাগরুক করে দিতে পারে কারো মনে। তার বেশি কিছু নয়। কে শিক্ষিত হবে আর কে হবে না, তা ত ঠিক হবে সেই স্নাতকোত্তর মানসিকতায় পৌঁছেই। এবং পরবর্তী জীবনে। 

এই দুপুরের অবসরের মুহূর্তে আমার অন্যতম প্রিয় বই ওয়াল হুইটম্যানের লিভস্ অফ্ গ্রাস পড়েছি বারান্দায় ইজিচেয়ারে বসে, খুঁটির ওপর দুই পা তুলে দিয়ে। যে লাইন ক’টি আমার চোখের সামনে আছে তার মানে যদি বুঝতে পারত তিতলি। আমার সঙ্গে যদি আলোচনা করতে পারত এই কবিতার কবিত্বগুণ নিয়ে! পারবে। আমি ঠিক জানি, আমাদের ছেলে অথবা মেয়ের সঙ্গে সঙ্গে ও-ও সবই শিখে নেবে। একটু দেরি হবে এই-ই যার বুদ্ধির কোনো অভাব নেই ওর, সুযোগের অভাব ছিল শুধু। 

বড় ভালো লাগে আমার এই বইখানি। কত বার যে পড়ি, বারে বারে, ঘুরিয়ে ফিরিয়ে, কখন পুরনো মনে হয় না! প্রতিবারই নতুন থেকে নতুনতর মানে ঠিকরোতে থাকে, রবীন্দ্রনাথের লেখারই মতো। এঁরাই হলেন লেখকের মতো লেখক, কবির মতো কবি, যাঁদের লেখা যত পুরনো হয় ততই বেশি মূল্যবান হয়ে ওঠে। 

তিতলিকে ইকোলজি বা পরিবেশতত্ত্ব সম্বন্ধে শেখাব পরে। ওর মধ্যে এমনিতেই এক গভীর ভগবৎ-বিশ্বাস আছে। কিন্তু সে বিশ্বাস, বজরঙ্গবলী, বা হনুমান-ঝাণ্ডা বা বনদেবতা থেকে সরিয়ে এনে নিরাকার অথচ সমস্ত আকার যেখানে দিগন্তে দিগন্তে অবলুপ্ত, পরিপ্লুত, সেই প্রকৃতি অথবা পরমাপ্রকৃতির মধ্যে স্থানান্তরিত করব। আজকাল ভগবান মানেন না কোনো কোনো শিক্ষিত মানুষ। তথাকথিত শিক্ষা আর চটকদার আধুনিকতা মানুষকে উগ্র দুর্বিনয়ের শিকার করেছে। ভগবৎ-বিশ্বাসটা আজকাল আউট-অফ-ফ্যাশান, প্রিমিটিভ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। অ্যাস্টিক্, মডার্ন, সায়েন্টিফিক হয়েছে মানুষ। তাদের বোঝাব কী করে? এই, জঙ্গলের গর্তে পড়ে-থাকা অশিক্ষিত বাঁশবাবু আমি, কীই বা আমার সাধ্য বা উপায়? এবং জ্ঞান? প্রশান্ত মহাসাগরের কোরাল রিফস্ এ একরকমের কীট হয়। তাদের নাম পাওলোলো। চাঁদের সঙ্গে তাদের যৌনজীবন এবং বংশবৃদ্ধি বাঁধা। এই কীটদের মধ্যে যারা প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ তাদের জননেন্দ্রিয় জননক্ষম হয়ে ওঠে প্রতি বছর চাঁদের শেষ পক্ষে এক বিশেষ দিনে, বিশেষ সময়ে, প্রত্যেক বছর এই আশ্চর্য ঘটনা ঘটে। ঘটে আসছে, হয়তো সৃষ্টির আদি থেকেই। মানুষ এ কথা জানল মাত্র এই সেদিন। আর জেনেই ভাবল, সবই জেনে ফেলেছে। ক্যালিফোর্নিয়ার কাছের প্রশান্ত মহাসাগারে এক রকমের ছোট্ট ছোট্ট মাছ দেখা যায়। তাদের নাম গ্রুনিয়ন। এই মাছেরা প্রতি বছর নাটকীয় ভাবে প্রজনন ক্রিয়া শেষ করে। মার্চ থেকে আগস্ট মাসের মধ্যে সমুদ্রের ভরাতম জোয়ারে তারা ডিম ছাড়ে। জোয়ার, ভাটার সঙ্গে তো চাঁদের সম্পর্ক নিবিড়ই। ভরা-জোয়ারের পর যখন ভাঁটি দিতে থাকে সমুদ্র, তখন মেয়ে গ্রুনিয়া তটভূমিতে আছড়ে পড়ে। বালিতে লেজ ঢুকিয়ে দিয়ে ডিম ছাড়ে বালির মধ্যে আর পুরুষ গুনিয়া সেই ডিমগুলোকে ফার্টিলাইজ করে দেয় সঙ্গে সঙ্গে। ভাটার টানে টানে বালির পরতের পর পরত তাদের ডিমকে যাতে আড়াল করে ঢেকে রাখতে পারে সেই জন্যেই তারা ভরা জোয়ারের অব্যবহিত পরই ভাটা দেওয়ার সময়ই এমন করে। যতদিন না সমুদ্র আবার ভরা জোয়ারে অতখানিই উপরে উঠছে, ততদিন, মানে দু’সপ্তাহ সময় পায় ডিমগুলো বালির নিচে তাপে থাকার। দু-সপ্তাহ পরে যখন আবার ভরা জোয়ারের ঢেউ এসে আছড়ে পড়ে বালি-চাপা ডিমগুলোর উপর, ততদিন ভিতরে ভিতরে প্রকৃতি তার কাজ শেষ করে রেখেছেন। ঢেউয়ের আঘাতে উল্টি-পাল্টি খেয়ে মাঝের পূর্ণাবয়ব বাচ্চা মেমব্রেন ছিঁড়ে বেরিয়ে সমুদ্রে সাঁতারে যায় অবলীলায়। 

কে এই সব কোটি কোটি পোকা, মাকড়, কীট-পতঙ্গ, পশু-পাখি, প্রত্যেকের হিসেব রাখেন চুল-চেরা? তাদের জন্ম, বাড়, মিলন, প্রজনন, মৃত্যুর? তাদের খাবার সংস্থান করেন কে? কে চন্দ্র সূর্য গ্রহ, তারাকে নিজের নিজের জায়গায় ঘূর্ণায়মান রেখে এত বড় বিশ্বসংসারকে ধারণ এবং পালন করেন? তিনি কি কেউ নন? আজকে তাঁর সামান্য ক্রিয়াকাণ্ড আবিষ্কার করতে পেরেছে বলে মানুষ ভাবে, আবিষ্কারকই নিয়ন্তা। 

আমার মা একটি গান গাইতেন। খাম্বাজ রাগে বাধা। ব্রহ্ম সঙ্গীত। “কেন ভোলো, মনে করো তাঁরে। যে সৃজন পালন করে এ সংসারে। সর্বত্র আছে গমন, অথচ নাহি চরণ কর নাহি করে গ্রহণ, নয়ন বিনা সকল হেরে। অনন্ত ব্রহ্মাণ্ড যার, দ্বিতীয় নাহিক আর, নির্বিকার বিশ্বাধার, কে পারে বর্ণিতে তাঁরে?” গানটি খুব সম্ভব নিমাইচরণ মিত্রের লেখা! ব্রহ্ম সঙ্গীতের বইয়েতেও আছে বোধহয় গানটি। আমার ভুলও হতে পারে। ছোটবেলার কথা। 

এতদিনে মানুষের টনক নড়েছে। মরুভূমিতে, সমুদ্রের তলায়, মহাকাশে সব জায়গায় তার নোংরা হাতে তৈরি পারমাণবিক, মহাপারমাণবিক ধ্বংসবীজ বানিয়ে, ফাটিয়ে খোদার ওপর খোকারী প্রতিনিয়ত করতে করতে আজ হঠাৎ এতদিন পরে বুঝতে পারছে সে, যে তার নিজেরই হাতে নিজের ছোটো সবুজ বাগান, শোবার ঘর, নিজের গোপনীয়তা, নির্জনতা আড়াল, শান্তি সবকিছুই নষ্ট করে ফেলতে বসেছে। 

কিন্তু বড় দেরি হয়ে যায় কি? উপায় কী আর আছে? আজকে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ আর শুধু রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, বা অর্থনৈতিক ব্যাপারেই একে অন্যের ওপর নির্ভরশীল নয়, আজ তারা সকলে মিলে অন্তত আংশিকভাবে একে অন্যের ভাগ্য নির্ধারণ করছে, করছে ভবিষ্যৎ। প্রকৃতিকে নষ্ট করার জন্যে, পরিবেশকে নষ্ট করার জন্যে, যা কিছু যে কোনো দেশ আজ করছে তাদের লোভে, তাদের অদূরদর্শিতায় তাদের আকাট মূর্খামিতে, সেই সব কিছুই নির্দিষ্টভাবে নির্ধারণ করছে অন্যদের সকলের অদৃষ্ট। আজকে ভালুমারের আকাশ, বাতাস, হাওয়া দূষিত হলে, জঙ্গল কেটে ফেললে, তার প্রভাব পড়বে হয়তো থাইল্যান্ডে অথবা চিনে অথবা রাশিয়াতে। ইউনাইটেড স্টেট্স-এর অথবা ইয়োরোপের আবহাওয়া দূষিত অথবা বন-জঙ্গলে নষ্ট হয়ে গেলে সেখানকার বাসিন্দাদের যতখানি ক্ষতি হবে ঠিক ততখানিই ক্ষতি হয়তো হবে আইসল্যান্ড অথবা সলোমান দ্বীপপুঞ্জের বাসিন্দাদের। প্রকৃতির সুন্দর সব পশু-পাখি, ফুল, গাছ, প্রজাপতি, মাছ যদি নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়, তবে তা হাজারিবাগের চায়ের দোকানিকে যেমন প্রভাবান্বিত করবে, তেমনি করবে আহমেদাবাদের কাপড়ের কলের মজদুরদের যেমন করবে বালিগঞ্জের রেস্তোরাঁর খদ্দেরদের অথবা লানডান্ শহরের একজন বাস ড্রাইভারকে কিংবা সেসেলস দ্বীপপুঞ্জের ছোট-আইল্যান্ড প্লেন-চালানো পাইলটদেরও। 

আমি জানি, উচ্চশিক্ষিত আধুনিক-মানুষরা এমনকী আমার ভবিষ্যতের ছেলেমেয়েরাও আমাকে নিয়ে হাসবে, আমাদের কোনো নিয়ন্ত্রা বা নির্দেশক বা পালক আছেন যে, একথা এই বিংশ একবিংশ শতাব্দীতে গভীরভাবে বিশ্বাস করার কারণে। কিন্তু একদিন তথাকথিত গর্বিত, শিক্ষিত, বিজ্ঞান-বিশ্বাসী মানুষ চোখের জলে অথবা পূর্ণ-অন্ধত্বে আমার বিশ্বাসে তাদের বিশ্বাস মেলাবে বিজ্ঞান মহৎ। কিন্তু ভগবৎ-বোধ মহত্তর। চরণ ছাড়াই যিনি সর্বত্র গমন করেন, নয়ন ছাড়াই যিনি সব দেখেন, কর করে গ্রহণ না করেও যিনি উষ্ণতা ছড়িয়ে দিতে জানেন পালিতদের হৃদয়ে, তাঁর সঙ্গে বিজ্ঞানের কোনো বিরোধিতা নেই। তিনি প্রচণ্ড, আদিগন্ত, অনন্ত, অন্ধকার রাত। আর বিজ্ঞান প্রদীপ। বিজ্ঞান তাকে অতিক্রম করতে পারে না, কখনও পারবে না, বিজ্ঞান শুধু তাকে আবিষ্কার করবে তার সামান্যতায়। বিজ্ঞানের দম্ভ, শিক্ষার গর্ব, সর্বজ্ঞতার মূর্খামি যতদিন না মানুষ ত্যাগ করতে পারছে, ততদিন তাকে তার সর্বনাশের পথ থেকে কেউই ফেরাতে পারবে না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *