কোজাগর – ৪

আমাদের বাঁশের কুপে এসে হুলুক্ পাহাড়ের গায়ে যখন ট্রাক থেকে নামলাম, তখন গা-মাথা ধুলোয় ভর্তি হয়ে গেছে। কুলির দল পৌঁছে গেছে আগেই। মেট ও মুনশীরা কাজের তদারকি করছে। বারোশো দশ নম্বর ট্রাকে বাঁশ লোডিং হচ্ছে।

প্রতি বছর কালীপুজোর পর থেকেই কাজ শুরু হয়। জঙ্গলের পথ-ঘাট খোলে! লাতেহার, চাঁদোয়া, চিপাদোহর, রাংকা, মারুমার, ভালুমার, প্রায় দু-হাজার বর্গমাইল জুড়ে কাজ হয় কোম্পানির। ডালটনগঞ্জ থেকে এক এক জায়গার দূরত্বও কম নয়। ডেহরি একশো বত্রিশ কিলোমিটার। চাতরা, টোরী এবং বাঘড়া মোড় হয়ে একশো পঞ্চাশ কিলোমিটার। মহুয়াডার, চিপাদোহর হয়ে একশো কিলোমিটার। বানারী একশো দশ কিলোমিটার। অন্যদিকে ভাণ্ডারীয়া ও রাংকার জঙ্গল দেড়শো কিলোমিটার। বেশিরভাগই জঙ্গলের মধ্যে কাঁচা রাস্তা। তাই এত বড় এলাকা সামলে কাজ করা বড় সোজা নয়। আমাদের কোম্পানির মালিকের বয়স পঞ্চাশ হবে। তা হলেও এত বড় ব্যবসা চালানো সোজা কথা নয়। আমাদের মতো যারাই আছে, তাদেরও মালিক নিজের লোকের মতোই দেখেন। তা-না হলে এই পাহাড়-জঙ্গলে বছরের পর বছর আমাদের পক্ষে পড়ে থাকা সম্ভব হয়তো হতো না। অবশ্য আমার কথা আলাদা। আদিমতম এই আশ্চর্য মেয়ের প্রেমে পড়ে গেছি যে আমি। আমাকে তাড়িয়ে দিলেও যাবো না এখান থেকে। এই মায়াবিনীর জালে যে একবার ধরা দিয়েছে, তার পালাবার সব পথই বন্ধ। এ জীবনের মতো জঙ্গলের সঙ্গে বুঁদ হয়ে জংলি হয়ে গেছি। জংলি হয়েই থাকতে হবে।

প্রতি বছর খুবই ধুমধাম করে কালীপুজো হয় ডালটনগঞ্জে। কোম্পানির হেড অফিসে। তারপরই সকলে যে যার চলে যায় নিজের কাজের জায়গায়। আমার এবার কালীপুজোয় যাওয়াই হলো না। ঔরঙ্গাবাদ থেকে সমীর তার বৌ-বাচ্চা নিয়ে জঙ্গল দেখতে আসবে লিখেছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এলোই না। কোনো খবর দিলো না।

বড় মামা উঠে-পড়ে লেগেছেন আমার বিয়ে দেওয়ার জন্যে। বাবা ছোটবেলাতেই মারা গেছেন। গত বছর মা মারা যাবার পর থেকে গুরুজন বলতে এই মামারাই। আমারই কোনো সহকর্মী উড়ো চিঠি লিখেছিল তাঁকে, কলকাতায়। বাঙালির যা ধর্ম লিখেছিল : আমি এক কাহার ছুঁড়ির সঙ্গে দিব্যি ঘর-গেরস্থালি গুছিয়ে বসেছি। এ-জন্মে সভ্যতার আলো নাকি আর দেখবারই সম্ভাবনা নেই! জানি না, তিতলি ও টেটরা একথা শুনলে আমাকে কী ভাববে। বড় মামার উৎসাহে ছোট মামা ও মামীমা পাত্রীর দাদা বৌদি ও পাত্রীকে নিয়ে এখানে আসবেন লিখেছিলেন কালীপুজোর সময়ে। সরেজমিনে তদন্ত করে যেতে। পাত্রীও পাত্রকে দেখতে পাবে চাক্ষুষ। জঙ্গলের এই দু-পেয়ে জানোয়ারকে! দেখতে পাবে তার ঘর-গেরস্থালি! বিয়ে হলে, যেখানে তাকে থাকতে হবে বাকি জীবন, সেই জংলি জায়গা। দেখা তো উচিত নিজের চোখে।

মাঝে মাঝে ভাবি, বিয়ে ব্যাপারটা সত্যি-সত্যিই ঘটে গেলে বোধহয় মন্দ হতো না। একজন কন্‌সিডারেট, বুদ্ধিমতী সঙ্গিনী। শিক্ষিতা, ঋতু গুহর মতো না হলেও মোটামুটি রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতে পারে; এমন চলনসই একজন সুশ্রী, নরম-স্বভাবের মিষ্টি মেয়ে। খিচুড়ি এবং ডাল-রুটি রাঁধতে পারলেই চলে যাবে।

মাঝে-মাঝেই অনেক কিছু কল্পনা করছি আজকাল। যাকে বলে, ইমাজিনিং থিংগস্। আমার না-হওয়া অ-দেখা বৌ-এর সঙ্গে অনেক গল্পটল্পও করছি। এমনকী মাঝে-মাঝে ছোটখাটো আদর-টাদরও করে দিচ্ছি। মনে মনে দু’জনে মিলে আবৃত্তি করছি, গান গাইছি। অদেখা, অনুপস্থিতকে পাশে নিয়ে, ঘুরে ঘুরে আমার এই আদিগন্ত নির্মল, আশ্চর্য সাম্রাজ্য দেখাচ্ছি। আর সে ভালোলাগায় শিহরিত হয়ে উঠেছে। কতরকমই না অভিব্যক্তি তার। সে আমাকে বলছে, আমি সারাজীবন তোমার এই সাম্রাজ্যের সম্রাজ্ঞী হয়ে তোমারই পাশে পাশে থাকতে চাই।

আমার এই এলাকাচিহ্নহীন সাম্রাজ্য ছোটই-বা কী? আই অ্যাম দ্য লর্ড অফ অল আই সার্ভে। আদিগন্ত। চতুর্দিকে।

মেয়েটিকে আমি দেখিনি। ছোটমামীমা লিখেছিলেন, চেহারার ও গুণের বর্ণনা দিয়ে। ছোটমামীর বর্ণনার সঙ্গে আমার কল্পনা মিশিয়ে আমার ভাবী বৌকে গড়ে নিয়েছি আমি। চোখে না-দেখে, বলতে গেলে, অন্যের বাঁশি শুনেই তাকে ভালোবেসে ফেলেছি। নিজেকে দেখাবার জন্য তার আমার কাছে কষ্ট করে আসার দরকার ছিল না আদৌ একদল লোকের সঙ্গে। বরং বিয়ের পর একা আমারই সঙ্গে এলে, এই হুলুক্ পাহাড়ের ভালুক-রঙা পিঠের ওপর মুহূর্তের জন্য স্থির হয়ে থাকা সকালের সূর্য, ফানুসের মতো ভাসতে-থাকা পূর্ণিমার চাঁদ, এই জঙ্গল, নদী, গাছ-গাছালি, পাখির জগতে তাকে চমৎকৃত, বিস্মিত, বিহ্বল করে দিতাম। এবং তার সেই সমস্ত প্রথম বিহ্বলতার সুযোগ, একলা স্বার্থপর এক্সপ্লোরারের মতো পুরোপুরি একাই এক্সপ্লয়েট করতাম।

আসলে, কাহার-ছুঁড়ির ব্যাপারটা যে কী, তা সকলে নিজ চোখে দেখে যান, সেটাই চাই বলে ওঁদের আসতে মানা করিনি। আমার মামারও কেউ কখনও আসেননি এইদিকে। ছোট মামা এলে খুশিই হবো! উনিও খুশি হবেন। কবি-প্রকৃতির মানুষ! ছোটমামাকে দেখে মনে হয়, মানসিকতায়, সার্থকদের চেয়ে ব্যর্থ কবিরাই বোধহয় অনেক বেশি কবি থাকেন।

ওঁদের তদন্তে বেচারি তিতলির চরিত্রে কী কলঙ্ক রোপিত হবে জানি না। তবে নিজের চরিত্র নিয়ে আমার নিজের কখনোই মাথা ব্যথা ছিল না। অ্যাকাউন্ট্যান্টরা বলেন যে, চরিত্র নাকি এমনই এক ইনট্যানজিবল অ্যাসেট যে থাকলেও প্রমাণ করা যায় না যে আছে, এবং না থাকলেও নেই বলে। মোস্ট ইনট্যানজিবল অফ অল ইনট্যানজিবল অ্যাসেটস্। তাই-ই, তা থাকাথাকি নিয়ে মাথা না ঘামানোই ভালো।

জঙ্গলের গভীর থেকে নীলরঙা লুঙির ওপর লাল সোয়েটার গায়ে মুনশী ইয়াসিন এগিয়ে এসে রেক্ এসেছে কিনা তার খবর করল।

ট্রাকে বাঁশ বোঝাই হয়ে এখান থেকে চলে যায় চিপাদোহরের ডিপোতে। সেখানে ইয়ার্ডে ওয়াগন লোডিং হবে। ওয়াগন শর্টেজের জন্যে কাজের খুবই ব্যাঘাত হয়। আজকাল রেক্ পাওয়া মহা ঝামেলা। পেলেও, তা অনিয়মিত। সবচেয়ে টেনশান হয় গরমের শেষে বা বর্ষার আগে। বৃষ্টি নেমে গেলে বাঁশ পচে যায়। কোনো কোনো বছর বৃষ্টির আগে আগে জঙ্গল থেকে বাঁশ ঢোলাই করে ডিপোতে সময় মতো পৌঁছে দিলেও, তা রেকের অভাবে বৃষ্টি নামার আগে পাঠানো সম্ভব হয় না। জঙ্গল-পাহাড়ের গরিব-গুরবোরা জুন মাসের প্রথমে যখন দু-হাত তুলে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে, বৃষ্টি নামাও হে ভগবান, বৃষ্টি নামাও, দুটো গোঁদনি বা সাঁওয়া ধান বুনি, আর কতদিন কান্দা গেঠি খুঁড়ে খেয়ে কাটাবো? বৃষ্টি নামাও! ঠিক তখনই ডালটনগঞ্জের বিড়িপাতা আর বাঁশের গুজরাটি ব্যবসায়ীরা বৃষ্টি না-নামার জন্যে পুজো দেয়। প্রার্থনা করে। ভগবান ঘুষে তৃপ্ত হন কি না জানি না, কিন্তু প্রায়ই দেখা যায়, তিনিও পয়সাওয়ালা ব্যবসাদারদের কথাই শোনেন। আর গরিব ভোগ্‌তা, মুণ্ডা, কাহার, ওরাওঁ, খাঁরওয়ার, লোহার, ভুঁইয়াররা সবাই হাহাকার করে।

যাঁরা বেলার ডানলোপিলো লাগানো, গিজার-বসানো বৈদ্যুতিক আলো ঝল্‌ বাংলোয় সবান্ধবে ও সপরিবারে থেকে, অভয়ারণ্যের ছাগলের মতো চরে-বেড়ানো পালে পালে হরিণ, বাইসন এবং অন্যান্য জীবজন্তু দেখেন, তাঁদের অনেকেই প্রাণিতত্ত্বরই মতো বাঁশতত্ত্বরও কোনো খোঁজ রাখেন না। অবশ্য না-রাখাই স্বাভাবিক। আর যে বাঁশ কথাটা মোটেই প্রীতিপ্রদ নয়, সেই বাঁশ নিয়েই আমার কাজ। অনেক রকম বাঁশই হয় পালামৌর জঙ্গলে-পাহাড়ে। খহি, সর্হি, বড়হি আর টেরা। ব্যাসের তফাত অনুযায়ী নামের তফাত। খহি বাঁশ হয় সরু। আঙুলের মতো। এইগুলোই ঘর-বাড়ি বানাতে লাগে। খহির চাহিদাও তাই বেশি। গয়া-রাজগীরের মগধী পানের বরজওয়ালারা পানের বরজ বানাবার জন্যে এই বাঁশ কেনেন। খহি আর সহির বান্ডিল হয় পঁচিশটায়। বড়হির বান্ডিল বারো এবং তেরোটা বাঁশে। টেরার বান্ডিলের আবার মজা আছে। দুটো বান্ডিল হয় আট বাঁশের। একটা ন-বাঁশের। ছ-বাসা বাঁশের বান্ডিল হয় ছ-বাঁশের। পাঁচ-বাসা হয় পাঁচ বাঁশের। টিরার তিন বান্ডিল মিলিয়ে ষোলো, আর নয় নিয়ে পঁচিশ হয়।

প্রত্যেকটি বাঁশ কাটা হয় বারো ফিট করে, বান্ডিল বাঁধবার সময়। বাকি টুকরোগুলোকে টোনিয়া বলে। এই টোনিয়া বা টুকরো বাঁশই চালান যায় কাগজের কলে মণ্ড তৈরির জন্য। কাগজ কল ভালো পয়সা দেয়। ফরেস্ট ডিপার্টমেন্ট ও রয়্যালটি পান, আমাদের কোম্পানি পায় হ্যান্ডলিং-এর পয়সা। পয়সা আগামও দেয় কোনো কোনো পেপার মিল। টোনিয়ার চেয়ে বেশি লাভ হয় খর্হি, সর্হি-বড়হি ইত্যাদিতে। এই সব বাঁশের্ গোড়া, ইংরেজিতে যাকে ‘ব্যাম্বু শুটস্’ বলে, তা দিয়ে দেহাতি মানুষেরা তরকারি ও আচার করে খায়

করিল্ হচ্ছে বাঁশের এক বছরের গোড়া। ছাল তুললে সাদা পাউডারের মতো বেরোয় তখন। দোর্সা, দু বছরের গোড়া। এ-দিয়ে নতুন বাঁশগাছ হয়। অথচ তিন বছরের গোড়া তোর্সা লাগালেও কিন্তু গাছ হয় না।

সমস্ত উদ্ভিদ জগতে ফুলই পরিপূর্ণতার প্রতীক। সার্থকতারও। তাই সাহিত্যে, উপমাতে আমরা মঞ্জরিত পুষ্পিত এইসব কথা দেখি। বাঁশ কিন্তু এর ব্যতিক্রমের অন্যতম। বাঁশগাছে ফুল এলে তার সঙ্গে যমদূতের পদধ্বনিও শোনা যায়। ফুল ফুটিয়েই বাঁশ তার অস্তিত্ব অনস্তিত্বে পর্যবসিত করে।

কুলি মেট, মুনশী সবাই ওরা কাজ করে। বহুদিনের সব শিক্ষিত, বিশ্বস্ত কর্মচারী। রহমত্ এবং অন্যান্য ড্রাইভাররা গাছের ছায়ায় বসে বিড়ি খায়। গল্প করে। কামিনদের সঙ্গে রসিকতা করে। এ-গাছ থেকে ও-গাছে মৌটুসী, বুলবুলি, টিয়া, মুনিয়া, ক্রো-ফেজেন্ট উড়ে উড়ে বেড়ায়। সহি বাঁশের চিকণ ডাল আর ফিফিনে পাতা তাদের উড়ে যাওয়ার ছন্দে ছন্দোবদ্ধ হয়ে দোল খায়। হাওয়া দিলে বাঁশে বাঁশে ঘষা লেগে কট্‌ট্ করে আওয়াজ ওঠে। হলুদ রোদে ফিকে হলুদ প্রজাপতি উড়ে বেড়ায়। প্রজাপতিকে এখানের মানুষ তিতলি বলে। কখনও দূরের বনে হনুমানের দল হুপ্ হুপ্ হুপ্ হুপ্ করে ডেকে ওঠে। ঝুপ্-ঝাপ্ করে এ-গাছ থেকে ও-গাছের মগডালে ঝাঁপিয়ে যায়। ক্বচিৎ বাঘের ডাকও ভেসে আসে। সেই ডাকে পাহাড় গম্ গম্ করে ওঠে।

সূর্যোদয়ের কিছুক্ষণ পরেই ওরা কাজ শুরু করে। শীতের দুপুরে একটুক্ষণ রোদে এবং গ্রীষ্মকালে ছায়ায় বসে, সঙ্গে করে নিয়ে-আসা কিছু খাবার খেয়ে নেয়। খিচুড়ি বা অন্যকিছু। ঝরনার জল খায় আঁজলা ভরে। আবার কাজ শুরু করে। কাজ ঠিক তেমন সময়ই শেষ হয়, যাতে সূর্য ডোবার আগে আগে কূপ-কাটা কুলিরা নিজ নিজ গ্রামে জঙ্গলের পথ বেয়ে পৌঁছতে পারে। যাদের গ্রাম, ট্রাকের ফেরার পথে, তারা বাঁশ-গাদাই করা ট্রাকের মাথায় চড়ে গান গাইতে গাইতে চলে যায়। তারপর যার যার গ্রামের কাছে রাস্তায় নেমে পড়ে।

এখানে যখন আমি প্রথম আসি, অনেক বছর আগে, তখন পুরো এলাকার চেহারাটাই একেবারে অন্যরকম ছিল। অনেকই সুন্দর ছিল। এখন তো গাড়ুবাজার অবধি রাস্তা পাকা হয়ে গেছে। মস্ত ব্রিজ হয়ে গেছে কোরেলের ওপরে। যে বেতলাতে এখন পাকা বাংলো, রাঁচি-কলকাতার নম্বরে-ভরা মোটর গাড়ি আর বৈদ্যুতিক আলোর জেল্লা; সেই বেলার পথে দিনের বেলাতেও হাতি, বাইসন, বাঘের জন্যে পথ-চলা মুশকিল ছিল। দু-পাশে জঙ্গল ঝুঁকে থাকতো, কাঁচা পথের লাল মাটির কী বিচিত্র গন্ধ বেরুত, বিভিন্ন ঋতুতে। পিচের রাস্তার গায়ের অমন গন্ধ নেই। প্রতি ঋতুতে তারা নতুন গন্ধবতী হয় না। পিচ রাস্তারা ব্যক্তিত্বহীন।

একবার নিউমোনিয়া হয়েছিল। গাড়ু থেকে চৌপাইতে করে আমাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল কোরেল পার করে গাড়ুর উল্টোদিকে। সেখান থেকে ছোট্ট বেডফোর্ড পেট্রোল-ট্রাকে করে ডালটনগঞ্জের সদর হাসপাতালে। আর এখন তো মহুয়াডার অবধি বাসই যাচ্ছে রোজ ডালটনগঞ্জ থেকে। আসছেও সব জায়গা ছুঁয়ে। যদিও দিনে একটি করে। এখন ডিজেল মার্সিডিসের গাঁগাঁক আওয়াজে নিস্তব্ধ জঙ্গল চমকে যায়। তখনকার ছোট ছোট পেট্রোলের গাড়িগুলোর আওয়াজও যেন মিষ্টি ছিল। মিষ্টি লাগতো পেট্রোলের গন্ধ। ডিজেলের ধোঁয়ায় এখন নাক জ্বালা করে।

সেইসব আশ্চর্য নিবিড় রহস্যময়তা, ভয় ও আনন্দ মিশ্রিত অসহায়তার সুখভরা দিনগুলি মরে গেছে। তাই এখন এই আজকের ভালুমারে এসেও কোনো শিক্ষিত শহুরে লোক নাক কোঁচকান, বলেন, থাকেন কী করে মশাই এমন গড় ফরসেক্ জায়গায়? তখন তাঁকে অনেক কথাই বলতে ইচ্ছা হয়।

কিন্তু সব কথা সকলের জন্য নয়।

আমাদের এই জঙ্গল-পাহাড়কে চাঁদনি রাতে অনেকই ভারি সুন্দর দেখেন। আমিও দেখি। কিন্তু জঙ্গল-পাহাড়ের অন্ধকার রাতের বুকের কোরকে যে ব্যক্তিত্বসম্পন্ন সুপুরুষ তাঁর সমস্ত আপাত দুজ্ঞেয়তা নিয়ে প্রতিভাত হন, তাঁর সৌন্দর্যও বড় কম নয়। পৌরুষের সংজ্ঞা বলেই মনে হয় এই নিরেট জমাট-বাঁধা অন্ধকারকে। সেই কালো সুপুরুষের পরিপ্রেক্ষিতেই চন্দ্রালোকিত রাতের নারীসুলভ মোহিনী সৌন্দর্য পরিপুতি পায়।

অন্ধকার রাতে, শীত খুব বেশি না-থাকলে জঙ্গলের মধ্যে অপেক্ষাকৃত খোলা জায়গায় কোনো উঁচু পাথরে বসে অথবা আমার মাটির বারান্দায় নারকোল দড়ির ইজিচেয়ারে বসে আকাশের দিকে চেয়ে থাকি। কত গ্রহ-নক্ষত্র, কাছে দূরে। একে অন্যকে ঘিরে ঘিরে ঘুরে চলেছে অনন্তকাল ধরে। ভালুমারের সকলের ‘পাগলা সাহেব’, যাঁর আসল নাম রথী সেন; সেই রথীদা বলেন, আকাশের দিকে তাকাবি, ভগবানকে প্রত্যক্ষ করবি।

ভগবান বলতে কী বোঝায়, এখনও নিজে তা বুঝিনি নিজের মতো করে। কখনও বুঝব কিনা, তাও জানি না। কিন্তু এত বছর জঙ্গলে-পাহাড়ে, প্রকৃতির মধ্য থেকে কোনো প্রচণ্ড শক্তিমান অদৃশ্য অপ্রত্যক্ষ কিন্তু অনুভূতিসাপেক্ষ কেউ যে আছেন, যিনি এই অসীম ব্রহ্মাণ্ডকে করতলগত করে কোটি কোটি বছর ধরে এই গ্রহ-নক্ষত্র নিচয়ের পরিবারকে শাসন করছেন, পালন করছেন; তাঁর প্রভাব এখানে নিশ্চিত অনুভব করি অমোঘ ভাবে। লক্ষ লক্ষ গ্রহ-নক্ষত্রের মধ্যে অতি নগণ্য এই আমাদের ছোট্ট পৃথিবী। সেই পৃথিবীর কীটাণুকীট, এই মনুষ্যাকৃতির একটি প্রাণী আমি। আমার একটা নামও আছে। সায়ন। সায়ন মুখার্জী। আমার ভূমিকার নিদারুণ নগণ্যতা নিজের কাছেই নিজেকে হাস্যাস্পদ করে তোলে মাঝে মাঝে। আমার স্বার্থপরতা, আমার অহমিকা, আমার ঈর্ষা, সুখ-দুঃখ, আশা-নিরাশা এসব নিয়ে কখনও উত্তেজিত হলেই আমি ভালুমারের আকাশে তাকাই। রাতের দিগন্তরেখার ওপরে হুলুক্ পাহাড়ের পিঠটা একটা অতিশয় প্রাগৈতিহাসিক জানোয়ারের পিঠ বলে মনে হয়। দিগন্তের কোনো দিকে হঠাৎ-ই কোনো তারা খসে যায়। শিহরিত হই। হাহাকার করি। পরমুহূর্তেই মনে মনে আনন্দে হাততালি দিয়ে উঠি। ঐ দূরের একটি অনামা অচেনা প্রজ্বলিত নক্ষত্র হয়তো পৃথিবী থেকে কোটি গুণ বড়। তার জ্বলে উঠেই ফুরিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে, এই ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে তার লীলাখেলার মেয়াদ শেষ হওয়ার তাৎক্ষণিক মুহূর্তেই, আমি আমার সামান্যতা সম্বন্ধে নতুন করে সচেতন হই। বড়ই কৃতজ্ঞ বোধ করি। বড় খুশি হয়ে উঠি। আনন্দে, এক নিঃস্বার্থ পবিত্র আনন্দে; আমার দু-চোখের কোণ ভিজে ওঠে। আমরা সকলেই সামান্য। কিন্তু এই পরিবেশে না-থাকলে, চোখ ও কানের আশীর্বাদে সম্পৃক্ত না হতে পারলে, কেমন করে জানতাম আমার ক্ষুদ্রতার মাপটা ঠিক কতখানি ক্ষুদ্র।

আকাশ ভরা কত তারা, কত অসংখ্য নক্ষত্রপুঞ্জ। কী সুন্দর সব তাদের নাম। কী উজ্জ্বল চোখে, কোটরা হরিণের ভয়-পাওয়া ডাকে গগম্-করা অন্ধকার রাতে তারারা আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। যেন জিজ্ঞেস করে, কেমন আছো? যেন বলে, তুমি যে তোমার ভূমিকা সম্বন্ধে সচেতন, সে কারণে আমরা তোমাকে ভালোবাসি। তাই-ই তো মাঝে মাঝে নিজের ডাইরিতে লিখি : “যে পাখির ভালোবাসা পেয়েছে, ফুলের ভালোবাসা, চাঁদের ভালোবাসা; তার অভাববোধ কি থাকতে পারে কোনো?”

চিত্রা, পূর্বফাল্গুনী, উত্তরফাল্গুনী, বিশাখা, অনুরাধা, কৃত্তিকা, রোহিণী শ্রবণা, শতভিষা, ক’টা নামই-বা আমি জানি? কতো ছায়াপথ? অয়নপথের কতো বিচিত্র সব লীলাখেলা চলেছে সৃষ্টির আদি থেকে? এই মহাবিশ্ব এবং এই মহাকালের প্রতি এক সুগভীর শ্রদ্ধা কি জন্মাত আমার এই তিরিশ বছরের হাস্যকর রকমের ছোট্ট জীবনে? এখানে না থাকলে? আমি যদি ভাগ্যবান না হব তো ভাগ্যবান কে?

রথীদা, কেন কী কারণে সব ছেড়ে-ছুড়ে এই জঙ্গলে টালির বাংলো-বাড়ি বানিয়ে একা এসে বসলেন, তা কেউই জানে না। এখানে কারোই সে-সব কথা জিজ্ঞেস করারও সাহস নেই তাঁকে। প্রতি মাসে ডালটনগঞ্জে যান একবার। ব্যাঙ্ক থেকে টাকা তোলেন, সারা মাসের খরচ। সেদিনেই ফিরে আসেন। তিনি বলতে গেলে ভালুমারের বাসিন্দাদের লোকাল গার্জেন। অসুখে হোমিওপ্যাথিক্ ওষুধ দেন। বিপদে পাশে দাঁড়ান। বিবাদে মধ্যস্থতা করেন। সমস্ত গরিব গুরবোর রক্ষাকর্তা তিনি।

কোন্ জাত? জিজ্ঞেস করলে বলেন, বজ্জাত।

বাড়ি কোথায়? বললে বলেন, পৃথিবী।

আত্মীয়স্বজন কেউ নেই? শুধোলে বলেন, আত্মীয় কথাটার ডেরিভেশান্ জানিস? যে আত্মার কাছে থাকে; সেই-ই তো আত্মীয়। তোরাই আমার আত্মীয়।

অদ্ভুত মানুষ। তাঁর কথা বলে শেষ করা যায় না। সাদা দাড়ি। ঘাড় অবধি নামানো সাদা চুল। খুব লম্বা। দোহারা।

কোন্ ধর্মাবলম্বী জিজ্ঞেস করলে, রথীদা হাসেন। বলেন, আমার ধর্ম, স্বধর্ম।

‘পূজা-পার্বণ’ বলে বহু পুরনো একটা মলাট-ছেঁড়া চটি বই উনি আমাকে পড়তে দিয়েছিলেন। রাতে পড়লাম সেদিন; “যদি খ্রীস্টপূর্ব চার হাজার পাঁচশো অব্দে ফাল্গুনী পূর্ণিমায় উত্তরায়ণ হয়, তাহা হইলে অন্তত ইহার দুই সহস্র বৎসর পূর্বে চৈত্রী পূর্ণিমায় উত্তরায়ণ হইত। অতএব আশ্বিন পূর্ণিমায় দক্ষিণায়ন হইত।

“ইহা হইলে পাইতেছি, অশ্বিনীর চতুর্দশ নক্ষত্র পশ্চিমে চিত্রা নক্ষত্রে রবি আসিলে দক্ষিণায়ন হইত। এখন আর্দ্রা প্রবেশে দক্ষিণায়ন হইতেছে। আর্দ্রা ছয়, চিত্রা চোদ্দ নক্ষত্র—আট নক্ষত্রের ব্যবধান। অতএব এখন হইতে অন্তত আট সহস্র বৎসর পূর্বের কথা। পুরাণ ইহার প্রমাণ, আশ্বিনী পূর্ণিমায় কোজাগরী ও আশ্বিনী অমাবস্যায় দীপালি পাইতেছি। ঋগ্‌বেদে এই কালের প্রমাণ অবশ্য আছে। কিন্তু সেখানে অশ্বিনী ও চিত্রার নামগন্ধও নাই। নক্ষত্রগুলি আছে, অন্য নামে আছে। যাঁহার চক্ষু আছে, তিনি দেখিতে পান, যাঁহার বর্ণজ্ঞান হইয়াছে তিনি পড়িতে পারেন। যে অন্ধ, সে কী দেখিবে! যে বধির, সে কী শুনিবে! ভারতের অতীত প্রত্যক্ষ হইয়া কথা কহিতেছেন…।”

আমি নিজে সর্বাংশে অশিক্ষিত। কোনো বিষয়েই বলবার মতো জ্ঞান আমার কিছু মাত্র নেই। কিন্তু এই সব দেখে-শুনে এবং পড়ে জানার ইচ্ছা, দেখার-ইচ্ছা, বড় প্রবল হয়ে ওঠে বারে-বারে। জীবনের তিরিশটা বছর বৃথাই নষ্ট করলাম বলেই মনে হয়, জানার মতো কিছুমাত্র না-জেনেই। এই দুঃখটাও যে হয়, এটাই একমাত্র সান্ত্বনা। জঙ্গলে, পাহাড়ে, প্রকৃতির বুকে শিশুর মতো লালিত-পালিত না হলে এই দুঃখবোধটুকু থেকেও হয়তো-বা বঞ্চিত হতাম। বঞ্চিত হয়ে, কূপমণ্ডূক আত্মসর্বস্ব, উচ্চমন্য, কেবলমাত্র স্বর্ণমুদ্রা অর্জনের শিক্ষাতেই শিক্ষিত হয়ে ডিজেলের ধুঁয়ো-ভরা কোনো বড় শহরে সারাজীবন খাই-খাই করে কাটিয়ে, ইঁদুরের মতো স্বার্থপরতায়, নিজেদের একে অন্যকে কাটাকুটি করে এই মানবজীবন শেষ করতাম। অসীম ব্রহ্মাণ্ড থেকে গ্রহ-নক্ষত্রের আকস্মিক স্খলনে, তাদের নিরুচ্চার নিঃশব্দ মৃত্যু এ-জন্মে তাহলে আর দেখা হতো না।

আমার এই ভালুমারে অতীত কথা বলে। সত্যিই কথা বলে। ক্ষুদ্র বুদ্ধিতে কেবলই মনে হয়, এই অতীতের যথার্থ অনুভবেই আমাদের প্রত্যেকের ভবিষ্যৎ নিহিত আছে। ছিল চিরদিন। এবং থাকবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *