৩৯
একদিনের পক্ষে অনেকই ঘটনা ঘটে গেল। এখন রাত অনেক। জানালা খুলে, তার সামনে ইজিচেয়ার পেতে বসে আছি। প্রথমে রাতে তিতলিকে আদর করেছিলাম। মধ্যে যে অশেষ উত্তেজনা গড়ে উঠেছিল বিকেলে, তা এখন প্রশমিত। নারীকে বিধাতা গড়েছেন পুরুষের ঢেউ-ভাঙার তটভূমি করে। ঢেউ গর্জায়, ঢেউ ওঠে, ঢেউ পড়ে। কিন্তু সৃষ্টির প্রথম থেকে তটভূমি তার নীরব পেলব শান্তি দিয়ে পৃথিবীর সব সমুদ্রের
•ঢেউয়ের উচ্ছ্বাসকে শুষে নিয়েছে। শুষে নিজে নিজে আরও পেলব, কোমল হয়েছে ভাগ্যিস্ নারীকে গড়েছিলেন বিধাতা! নইলে পুরুষকে যে আদিগত কুলহীন, ডাইনি-কান্নার সমুদ্র হয়েই অনন্তকাল ধরে নিজের আর মনের মধ্যে আকুলি-বিকুলি করে আছড়ে মরতে হত!
তিতলি শেষ রাতে আদর খেতে খুব ভালোবাসে। যদিও মুখে কখনও বলে না কিছু। কিন্তু আমি বুঝতে পারি ঠিকই। বিশুদ্ধ ভারতীয় গ্রামীণ লজ্জায় রাঙিয়ে থাকে ও। আমি জানি না, ওই-ই আমাদের বন-পাহাড়ের সব নারীদের প্রতিভূ কি না। অবশ্য একজনকে দেখেই অন্য সকলের সম্বন্ধে ধারণা করি কী করে। ব্যক্তিমাত্রই যে আলাদা হাওয়া ছেড়েছে একটা। গরমের রুক্ষ দিনকে শীতল করে রাতচরা পাখি, জানোয়ার, সরীসৃপ আর কীট-পতঙ্গের গায়ের গন্ধ মেখে কত জানা ও অজানা ফুলের লতার, তৃণের শান্ত ধুলোর গন্ধ, গায়ে তার বালাপোষের মতো জড়িয়ে নিয়ে ছড়িয়ে যাচ্ছে সে হাওয়ায়। চিতলের হরিণের ডাক ভেসে আসছে থেকে থেকে। চমকে চমকে হরিণ আর হরিণীদের ডাক পৃথকভাবে উৎসারিত হচ্ছে রাতের জঙ্গলের প্রায়ান্ধকার গর্ভ থেকে।
মাহাতোর ক্রূর, নিষ্ঠুর হৃদয়হীন মুখ আর আমার হতভম্ভ, লজ্জিত চোখের সামনে জড়সড়, নিরুপায়, বিবস্ত্রা মুঞ্জরীর করুণ মুখচ্ছবি বারবারই ফুটে উঠেছে। ঐ লজ্জাকর অভিজ্ঞতার কথা মনে হতেই এও মনে হচ্ছে যে, বিধাতা নারীদের বড় সুন্দর করে যত্ন করে গড়েছেন। আবৃত অবস্থাতে যে নারী অতি সাধারণ, অনাবৃত হলে সেই-ই কত মোহময় সুন্দরী! মুণ্ড্রীর চুল ছড়িয়ে পড়েছিল তার বাঁ বুকের ওপর দিয়ে নাভি অবধি। রুক্ষু স্তনযুগলে ভীতত্রস্ত ঢেউয়ের দুলুনি লেগেছিল। প্রথম আকস্মিকতায় বুক দুহাত দিয়ে আড়াল করে রেখেই পরক্ষণেই বুক উন্মুক্ত করে দিয়ে দুহাত দিয়ে ঊরুসন্ধি আড়াল করেছিল মুঞ্জী স্বয়ংক্রিয়ভাবে রিফ্লেক্স অ্যাকশনে।
আমাদের দেশের গ্রামীণ নারীদের শালীনতাবোধ, লজ্জাবোধ নিয়ে ঠাট্টা করার অবকাশ নেই কোনো। শহরের বিত্তশালিনী, শিক্ষিতারা তাঁদের অর্ধনগ্নতাকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেন আজকাল। বিজ্ঞাপনে নারীদেহ প্রধান ব্যবহার্য জিনিস। কিন্তু সেই নগরকেন্দ্রিক ভারতবর্ষের নারীদের সঙ্গে আসল ভারতবর্ষের নারীদের মিল থাকলেও, তা সামান্যই। আসল ভারতবর্ষ যে এখনও ভালুমারেই ঘুমিয়ে পড়ে, থেমে আছে।
চমৎকার দেখাচ্ছে এখন, গভীর রাতের বাইরের প্রকৃতিকে। গরমের সময় জঙ্গলের নীচের আগাছা পরিষ্কার হয়ে যায়। তাই বহুদূর অবধি নজর চলে। পত্রশূন্য গাছেদের ডালে ডালে কাঁপন জাগিয়ে পত্রময় গাছ-গাছালির ডালে-ডালে উদাসী হাওয়াটা হঠাৎ কাঁপন জাগিয়ে নিজেকে মিলিয়ে দিচ্ছে। এই দিগন্তের গর্ভে অনেকই দিগন্ত লীন হয়ে থাকে; দেখা যায় না। আলাদা অস্তিত্ব থাকে না তখন হাওয়ার আর পরিবেশের; কাছের আর দূরের। বিশেষ করে রাতে। সব জড়িয়ে-মড়িয়ে মিলেমেশে এক হয়ে আছে। পরিপূর্ণতা, নিটোল সম্পৃক্ততা হাসছে যেন চতুর্দিকে। নিঃশব্দে।
ভাবছিলাম, মাহাতোকে কি নানকু সত্যিই বদলে দিয়ে গেল? ঠেলে তুলে জাগিয়ে দিয়ে গেল কি ভালুমারের মানুষগুলোকেও যুগযুগান্তের ঘুম থেকে? নান্কু যখন এমন দৃঢ়তার সঙ্গে একথা বিশ্বাস করে চলে গেল তখন তা সত্যি না হয়ে যায় না। গোদা শেঠ আর মাহাতোরা যদি নিজেদের লোভ আর মুনাফা একটু কমিয়ে সকলের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সত্যি সত্যিই দাঁড়ায় তাহলে ভালুমারের চেহারাই পাল্টে যাবে। এই মুহূর্তে, আজ রাতে, যত মানুষ শুয়ে শুয়ে এপাশ ওপাশ করতে করতে এই দীর্ঘ, তাপময় রাত ভোর হওয়ার অপেক্ষা করছে আর ভাবছে কী করে কালকের অন্ন জোটাবে, তাদের সমস্যার সুরাহা হতে পারে গোদা শেঠ আর মাহাতো পাশে এসে দাঁড়ালেই।
এখন সকলেই ঘুমচ্ছে। হীরু আর টুসি ওরাওঁ-এর মা-বাবা, আর ভাই লগন, রান্ধনীয়া চাচা, মানি-মুঞ্জরী, বুলকি-পরেশনাথ, লোহার চাচা, রথীদা, মাহাতো, গোদা শেঠ। একজন মানুষের ঘুম এক একরকমের। চামার দুখী, গাড়ু বস্তির কসাই আকবর মিঞা, ট্রাক-ড্রাইভার টুসু খালাসি রামনাথ ও চেতন, অশ্বত্থতলার পান বিড়ির দোকানি ভিখু, ডাইনির মতো গর্ভপাত-বিশেষজ্ঞা শনিচারোয়া আর তার বোন বিপাতিয়া, তিতলির মা, কত মানুষ! বিভিন্ন তাদের অবস্থা, বিভিন্ন তাদের জগৎ বিভিন্ন মানসিকতা, এই বস্তিতে থেকেও জটিলতায় এ অন্ধকারে কত বিভিন্ন তাদের পরিবেশ!
চিপাদোহরে ঘুমোচ্ছেন নিতাইবাবু গজেনবাবু আর গণেশ মাস্টার, ঘুমচ্ছে অনেক দূরের গহীন রাতের গ্রাম বউপালানো লাল্টু পাণ্ডে। ঘুমচ্ছেন আমার প্রান্ন মালিক রোশনলালবাবু। প্রত্যেক মানুষই এখন ঘুমের মধ্যে পাশ ফিরছে, শ্বাস ফেলছে, তার নিজ-নিজ সুখ-দুঃখ আশা-আকাঙ্ক্ষা ন্যায়-অন্যায়ের ভাবনা, পরদিনের ভাবনা, পরের মাসের ভাবনা, পরের বছরের ভাবনা ঘুমের মধ্যেই জলছবি হয়ে ঘুমন্ত মুখে ফুটে উঠেছে প্রত্যেকের।
কেউ কেউ ভাবছে, পরের জীবনের ভাবনা। কেউ বা ভাবছে, অন্যের ভালো করার যথা; কেউ ভাবছে, অন্যের ক্ষতি করার কথা, অন্যকে দুঃখী করার কথা।
আবার কেউ ভাবছে, কিছুমাত্র করে কীই বা লাভ?
কেউ বা ভাবছে, একাকী রাতের এই মুহূর্তে : মানুষ হয়ে মানুষ কেন জন্মায়? শুধু কি দু’বেলা খাবারই জন্যে? স্ত্রীকে রমণ করার জন্যে? সংসার প্রতিপালন করে বিশুদ্ধ সাদা পাঁঠা অথবা দুধেল, সুলক্ষণা লাল গাই-এর মতো নিরুপদ্রব অন্যনির্ধারিত নিশ্চিন্ত জীবনযাপন করার জন্যেই কি? লালটু পাণ্ডের মতো কবিরা হয়তো ভাবছে কবিতা মানুষ কেন লেখে? অন্যকে আনন্দ দেবার জন্যে? নিজেকে আনন্দিত করা জন্যে? টাকা রোজগার করার জন্যে? যশঃপ্রার্থী ভিখারি হবার জন্যে? না, অন্যতর এবং মহৎ কোনো কারণে?
এই মৃদুশব্দ, নিবিড় আলোছায়ার হাওয়া-বওয়া রাতে ভালুমারেরই মতো, বিরাট আসমুদ্র-হিমাচল ভারতের বন-পাহাড়, আর গ্রামগঞ্জের ছোট ছোট অসংখ্য ঘুমন্ত গ্রামগুলি ঘুমে, আধোঘুমো, কোটি কোটি মানুষই ভাবছে।
আর নানকু।
সেই অল্পবয়সি ছেলেগুলো?
ওরাও কি ভাবছে?
.
প্রকৃত ক্ষমতা সত্যিই কি বন্দুকের নলে নেই? আছে, মানুষের মনের জোরের মধ্যে? সত্যি! একই বিশ্বাসের ছায়ায় একত্রিত মানুষেরই মনের জোরের কাছে অন্য সব জোরই কি পরাভূত হয়? নানকু কি ঠিক জানে? সব সময়ই ঠিক?
বাইরে দূরে প্রস্তরাকীর্ণ শুকনো নালার মধ্যে দিয়ে বাঘের তাড়াখাওয়া শম্বরের দলের মতো রুখু হাওয়া ধেয়ে যাচ্ছে দামাল কলরবে। বৌ-কথা-কও ডাকছে। এই গভীর রাতে চাঁদের বনে চমক তুলে কোন অদেখা বৌএর মান ভাঙাতে নানা জাতের কাঠ-ঠোক্রা কাঠ ঠুকছে। কত যুগযুগান্ত ধরে না জানি এই বন আমার জন্যে তার সর্বস্বতা নিয়ে অপেক্ষা করে ছিল! কবে আমি আসব। এসে মিলিত হব তার সঙ্গে, আমার পরমার সঙ্গে সেই অভিলাষে। আমার গর্ভবতী, মানুষী ঘুমন্ত স্ত্রীকে পাশে নিয়ে শুয়ে এই গভীর গা-ছমছম রাতে আমার যেন হটাৎ মনে হল সাংসরিক সুখ আমার জন্যে নয়। আমি সংসারের নই। তার চেয়ে বড় কি না জানি না, তবে তার চেয়ে-অনেক গভীরতর কোনো কিছুর সঙ্গে আমার জন্ম-জন্মান্তরের যোগ ছিল। সেই যোগসূত্র আবার স্থাপিত হতে চলেছে। এক অমোঘ বোধের মধ্যে তলিয়ে যেতে যেতে বুঝতে পারছিলাম যে মনে মনে চিরদিনের জন্যে আমি বনেরই হয়ে গেলাম। এই জন্মের মতো, চিরজন্মের মতো। চাঁদের রাতে, সমস্ত পাহাড় বন যখন বন-জ্যোৎস্নায় এক আশ্চর্য রহস্যময় মায়ার ওড়নায় নিজেকে মুড়ে রাখে, তখন পাহাড়তলির গভীর রহস্যময় ঘনান্ধকার থেকে কপারস্মিথ পাখি ডাকতে থাকে টাকু-টাকু-টাকু…। হাওয়ার দোলা লেগে বাঁশবন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাঁশে বাঁশে ঘষাঘষি লেগে কট্কটি আওয়াজ ওঠে। সেই আওয়াজটাও কেমন যেন অপার্থিব। গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। কাকজ্যোৎস্নায় বন ভাসে। বনভাসি সাদা চাঁদে মসৃণ চিবি গাছের আন্দোলিত সারিগুলিকে নিচের উপত্যকায় মনে হয় একদল নগ্না শ্বেতাঙ্গিনী স্থির শরীরে হাত নেড়ে নেড়ে কোনো ফিফিসে সমবেত গান গাইছে। তাদের কামনার, তাদের বিরহের শ্বাস এই রাতের বনের দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে মাখামাখি হয়ে যাচ্ছে।
এমন সব রাতে, শিলাসনে বসে একা একা অনেক কথা মনে করতে ইচ্ছে করে আমার, না। পাশে আর কাউকে নিয়েই নয়। তিতলিকেও নয়। এমনকী জিন্ যদি আমাকে বিয়ে করতেন, তবু তাঁকে নিয়েও নয়। পরমার কাছে থাকলে কোনো দ্বিতীয়ারই ঠাঁই হয় না তখন
আজকাল আমার প্রায়ই অ্যাল্গারনন্ ব্লাকউডের নানা লেখার কথা মনে পড়ে। ওঁর কিছু কিছু লেখার মধ্যেও বিভূতিভূষণের লেখার মতো গা-ছম্ছম্ ব্যাপার আছে। মনের মধ্যে সেসব লেখা নানাপ্রকার প্রশ্ন জাগায়। ভৌতিক, আধিভৌতিক। যারা এমন পরিবেশে একা একা কখনও না থেকেছেন বা ঘুরেছেন বছরের পর বছর তারা আমার অশিক্ষা এবং কুসংস্কার নিয়ে হাসি-ঠাট্টা করতে পারেন। আমার পুরানো আমিও সেই আমিকে নিয়ে অনেক হাটি-ঠাট্টা করেছি একসময়। আজকাল কেন যেন পারি না। মনে হয়, নিজের মনের গভীরে যা বোধ করি, যা বিশ্বাস করি, তা প্রকাশ করতে লজ্জা কীসের? আমি তো শিরোপা চাই না কারো কাছ থেকেই। চাই না কারো পুরস্কার। যিনি আমার সৃষ্টিকর্তা তাঁর পুরস্কারই আমার কাছে যথেষ্ট। শহুরে, ইংরিজিকেতায় উচ্চশিক্ষিত, সর্বজ্ঞদের আমার কথা বোঝানোর কোনো ইচ্ছা বা দায় আমার নেই।