কোজাগর – ৩৭

৩৭

গোরীকে নেওয়ার পর শোনচিতোয়াটার আর কোনো খবর নেই মাসখানেক। হয়তো দূরের অন্য কোনো বস্তিতে গিয়ে আস্তানা গেড়েছে। লাতেহার আর কুরুর মাঝামাঝি টৌড়ি বস্তিতে জোর এনকেফেলাইটিস্ শুরু হয়েছে শোনা যাচ্ছে। লোক মরছে প্লেগের মতো। রীতিমতো মড়ক! কাক-উড়ান-এ গেলে জঙ্গলের মধ্যে মধ্যে এসব অঞ্চল ভালুমার থেকে একেবারেই দূরে নয়। চিতার তো মাত্র এক দেড়-দিনের পথ। হয়তো সেখানেই পৌঁছে ডোমদের কাজে সাহায্য করছে। গিয়ে থাকলেই ভালো। এখন ভালুমারের বস্তিতে শান্তি। লোকে একটু একটু সাহসীও হয়ে উঠেছে।

এইটেই ভয়ের কথা। যতক্ষণ না চিতাটা মারা পড়েছে বলে নিশ্চিন্ত হওয়া যাচ্ছে ততক্ষণে এক মুহূর্তের জন্যেও অসাবধান হবার উপায় নেই এ তল্লাটের কোনো গ্রামেই। হলেই অসবাধানতার মূল্য দিতে হবে জীবন দিয়ে। এখানে অনেকদিন লোক নেয় নি বলেই আমার কেমন গা ছম্ছম্ করে। কেবলই মনে হয়, কারো দিন ঘনিয়ে এসেছে।

কার?

বর্ষা নেমে গেছে বলেই যেদিন বর্ষা থাকে না, সেদিন বড়ো গুমোট থাকে ঘরে। নতুন বউ নিরাবরণ শরীরে পাশে শুয়ে থাকলে স্বাভাবিক কারণে গরম আরও বেশি লাগে। মাঝে মাঝে তিতলি বলে, দরজা খুলে চলো গিয়ে বাইরে বারান্দাতে বসি। চলো, জঙ্গলের পথে জ্যোৎস্নায় হাত-ধরাধরি করে ঘুরে বেড়াই। ময়ূর উড়াই, তিতির বটের; আসকদে ভয় পাওয়াই। আমার সাহস হয় না। নিজের জন্যে নয়। তিতলির জন্যে। তিতলির কারণেও নিজের জন্যে। আমার কিছু হলে, মেয়েটা ভেসে যাবে চিরদিনের জন্যে। বিয়ের পর একটা জিনিস লক্ষ করে চমকিত হচ্ছি। যে-তিতলিকে আমি এত বছর এত কাছ থেকে দেখেছি, তাকে শারীরিকভাবে জেনে, তার সঙ্গে মিলিত হয়ে, এক মুহূর্তেই যেন একেবারে কাছে চলে এসেছি। বিয়ের আগের জানা, আর এই জানাতে কত তফাত। তার বাম উরুর ঠিক মধ্যিখানের কালো তিলটি, তলপেটের হালকা-নীল জন্ম-দাগ, ডান স্তনের বাঁদিকে লাল-রঙা একগুচ্ছ তিল। সবসুদ্ধ ছ’টি। গুনেছিলাম একদিন। এসব যে মুখস্থ হয়ে গেছে শুধু তাই-ই নয়, কেবলই যেন মনে হচ্ছে, ওর আর আমার মধ্যে আড়লের কিছুমাত্র নেই; পৃথকীকরণের উপায় পর্যন্ত নেই। আমরা অঙ্গাঙ্গীভাবে এক। মনে এবং শরীরে।

তিতলিকে অনেক আদর করার পর, তিতলি যখন পরম পুলকের শ্রান্তিতে, নিরাপত্তার আনন্দে, ওর এককালীন অনিশ্চিতিতে ভরা শ্লথ, গন্তব্য-হীন জীবনের নদীর ঘাটে চিরদিনের মতো নিরুপদ্রব নিশ্চিন্তিতে বাঁধা-থাকার গভীর আশ্বাসে ওর মুখের উপর একটা হাত ভাঁজ করে শান্তির নিঃশ্বাস ফেলে ঘুমোয়, জানালা দিয়ে দুলি চাঁদের আলো এসে যখন ওর স্তনের বৃত্তে পড়ে তাকে কনকচাপা করে তোলে, যখন আলো ও কালোর আঙুল বুলোয় জানালার কাছের বোগোনভিলিয়া লতার দোলায়মান ছায়াটা, তখন অন্ধকার ঘরে ওর অলক্ষে ওর দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে আমার বুকের মধ্যে বড়ো কষ্ট হয়। তখন এক গভীর ভয়ের অন্ধকার সুগন্ধি স্নিগ্ধ চাঁদের আলোকে ঢেকে ফেলে। হুতোম পেঁচা বুকের মধ্যে চমক তুলে দুরগুম দুরগুম্ দুরগুম্ করে ডেকে ওঠে হঠাৎ। মনে হয়, এই-ই কি শেষ? এই-ই কি সব? তিতলি আর আমার সম্পর্কটা এখানেই কি এসে থেমে যাবে? সব দাম্পত্যসম্পর্ক কি এমনি করেই শেষ হয়? এর চেয়েও গভীরতর, আরো অনেক বেশি অর্থবাহী, ব্যাপ্তিসম্পন্ন; এর চেয়েও মূল্যবান এবং তীব্র অন্য কোনো বোধ কি আসবে না?

বাথরুমে যেতে যেতে শুনতে পাই বাইরে উঠোনে মাঝরাতের তক্ষক কথা কয় উদাস হাওয়ায় বলে ঠিক, ঠিক, ঠিক। আমি যেন বুঝতে পাই যে, বিবাহিত জীবনের এইটেই প্রথম অধ্যায়। তবুও অবুঝ মন অস্ফুটে বলে ওঠে, এমন সুখ জীবনে আর কী-ই বা থাকতে পারে?

তিতলি গর্ভবতী হবার পরই কেবলমাত্র আমি অবচেতনে বুঝতে পারি, টুসিয়ার হারিয়ে যাওযায় তার বাবা জুগনু ওরাওঁ-এর দুঃখের প্রকৃত গভীরতা। হীরুর ফাঁসি হওয়ার আশঙ্কায় যে ছায়া নামে জুগনু চাচার চোখের দৃষ্টিতে, তেমন ছায়া শ্রাবণের কালো উড়াল মেঘের আকাশও হুলুক্ পাহাড়কে দেয় নি কখনও। এমনই সজল, এমনই শান্ত, গভীর বিষাদমগ্ন সে ছায়া। এখন যেন একটু একটু করে বুঝতে পারি, মানিয়া, আর মুঞ্জুরী যখন খেতে কাজ-করা বুলকি আর পরেশনাথের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে থাকে, তখন তাদের সেই অনিমেষ দৃষ্টির তাৎপর্য।

বাথরুম থেকে ফিরে এসে তিতলিকে ডান বাহু দিয়ে জড়িয়ে শুয়ে থাকি। ও পাশ ফিরে আমার বুকের মধ্যে মুখ গোঁজে। মেয়েরা যতই উইমেনস্ লিব্‌ নিয়ে বিশ্বময় চেঁচামেচি করুক না কেন, বিধাতা কোথায় যেন পুরুষ-নির্ভর করে রেখেছেন প্রত্যেক নারীকে। নারীকে গ্রহীতা করে রেখেছেন, দাতা করেন নি। পরিপূর্ণতা দেন নি, পুরুষের সক্রিয় ভূমিকা ছাড়া। তাই-ই বোধ হয় তিতলির আমার বুকে মুখ রেখে শুয়ে থাকার শান্ত ভঙ্গিটির মধ্যে এমন এক নির্ভরতা, শান্তি ও নিশ্চিন্তি প্রতীয়মান হয় যে, আমার মনে হয়, এই বোধ ওকে অশেষ বিদ্যা, অঢেল টাকা, অথবা বিপুল ব্যক্তি-স্বাধীনতা এবং অন্য কোনো কিছুই কখনওই হয়তো দিতে পারত না।

সেদিন ভোরবেলাতে ঝমঝম্ করে বৃষ্টি নামল। এখানে যখন বৃষ্টি আসে তখন তার কিছুক্ষণ আগে থেকে দূরাগত একপ্রেস ট্রেনের মতো শব্দ শুনতে পাওয়া যায়। বন-পাহাড়ের মধ্যে দিয়ে দূরন্ত হাওয়ার সঙ্গে দ্রুতগামী বৃষ্টি এগিয়ে আসতে থাকে। রোদ ঢেকে যায় মেঘে, মেঘ ঢেকে যায় বৃষ্টির রুপোলি চাদরে। দূর থেকে ময়ূর-ময়ূরী কেঁয়া, কেঁয়া, কেঁয়া রবে এই বনের স্নিগ্ধ, মুগ্ধ মর্মবাণী ছড়িয়ে দেয় তাদের হৃদয়মথিত শব্দে। জঙ্গলে কোথাও কোথাও বুনো চাঁপা আর কেয়া ফোটে। দমক্ দমক্ হাওয়ায় হা-হা করে তাদের গন্ধ ছুটে আসে। ফুলেরই মতো রাশ রাশ গন্ধ ঝরে পড়ে নিঃশব্দে অলক্ষে।

একটা জিপের শব্দ পেলাম। জিপের শব্দটা আমার ডেরার সামনে এসেই থামল। দেখলাম, রোশনলালবাবু আর গজেনবাবু এসেছেন। সঙ্গে মালিকের সেই দুই মোসাহেব। ওঁরা একটা ছোট্ট বাকমতো কী বয়ে আনলেন।

অবাক হয়ে বললাম, কী ব্যাপার? আপনারা?

রোশনলালবাবু বললেন, আপনার কাছে ক্ষমা চাইতে এসেছি।

কীসের ক্ষমা?

ক্ষমা করবেন তো? আগে বলুন।

হেসেই বললাম, না শুনেই, বলি কী করে?

তিতলিকে ডেকে বললাম, ওঁদের কিছু খেতে দিতে, চা করতে।

তিতলি চায়ের বন্দোবস্ত করতে লাগল।

রোশনলালবাবু বললেন, নানকু তো ফেরার। শুনেছেন তো? তার ওপরে তিন তিনটে খুনের মামলা ঝুলছে।

শুনেছি। এক খুনও যদিও সে করেনি।

তা আমি জানি না। উনি বললেন। আমি তো আপনার বিয়েতে আসতে পারিনি। পাটনাতে ছিলাম।

জানি—তাতে কী হয়েছে?

ভাবছিলাম, পাটনাতে কি দেড়মাসই ছিলেন? আসেননি তো আসেননি!—এত বাহানা, একসকিউজ কীসের? আমি তো একপ্লানেশান্ চাইনি ওঁর কাছে।

আপনার স্ত্রীর জন্যে একটা প্রেজেন্ট এনেছি। আর আপনি নতুন জীবন আরম্ভ করছেন, স্বাধীন জীবন, সে জন্যে সামান্য কিছু টাকাও। আপনি আমার জন্যে অনেকেই করেছেন। আমাদের তো প্রভিডেন্ট ফান্ড, গ্র্যাচুইটি কিছুই নেই। এই পাঁচ হাজার টাকা আপনি রাখুন। আর এই সোনার হারটি আপনার স্ত্রীর জন্যে।

গজেনবাবু ভিতরে গেলেন তিতলির কাছে। গজেনবাবুরা কিন্তু সকলেই বিয়েতে এসেছিলেন একসঙ্গে। ট্রাকে করে, পুরো দল। মায় লালটু পাণ্ডে পর্যন্ত। লালটু সেদিন অনেক শায়ের শুনিয়েছিলো। নিতাইবাবু আর গণেশমাস্টার মহুয়া খেয়ে একেবারে আউট। সবচেয়ে মজা করেছিলেন গজেনবাবু। খুব নেশা করে এসে তিতলির পা জড়িয়ে ধরে, নমস্কার বৌদি বলে একেবারে মাটিতে পড়ে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম। তিতলির পাও ছাড়েন না, ওঠেনও না। শেষকালে, তাকে ওঠাতে না পেরে তিতলিকেই সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।

বস্তির লোকেরা সারারাত হাঁড়িয়া খেয়ে গেয়েছিল আর নেচেছিল। চার-চারটে বড়কা শুয়ার শেষ। ভাত লেগেছিল দু মণ চালের। সে রাতে যে হল্লাগুল্লা হয়েছিল তাতেই বোধহয় শোনচিতোয়া এ বস্তি ছেড়ে ভাগলা। আসলে, তিতলিকে আমি বিয়ে করবার সাহস রাখি কি রাখি না এই নিয়ে ওঁদের ওয়ান ইজ-টু ফোর বাজি লেগেছিল। গজেনবাবু বৃষ্টি হবে কি হবে না, ট্রাকের টায়ার ফাটবে কি ফাটবে না, এসব নিয়েও আকছার বাজি ধরে ফেলতেন। আমাকে তাতিয়ে দিয়ে কোনোক্রমে বিয়েটা করাতে পারলে, বড়ো লাভ ছিল গজেনবাবুর। ওদের মধ্যে চুক্তি এই হয়েছিল যে, ঐ বাজির টাকা দিয়ে বিরাট ফিস্টি হবে মীরচাইয়া ফসে। গনেজবাবুর আসার উদ্দেশ্য, আমাদের সেই ফিস্টিতে নেমন্তন্ন করতে। আমার সহকর্মীরা খারাপ মানুষ নন কেউই, কেবল সামান্য গোলমেলে। তবু তিতলিকে সচ্চরিত্র, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন শান্ত-স্বভাবের মেয়ে হিসেবে এদেরই সকলেরই পছন্দ ছিল। তবে এদের মধ্যে গণেশ মাস্টার যে একদিন আমার অনুপস্থিতিতে এসে পাঁচটাকার নোট দেখিয়ে তিতলিকে কুপ্রস্তাব দিয়েছিল, এ কথাটা তিতলি বিয়ের পর হাসতে হাসতে আমাকে একদিন বলে দিয়েছিল। বেচারি গণেশ! বহুদিন লজ্জায় এদিকে আর আসবে না।

আমার মালিক কিন্তু এসেছিলেন সম্পূর্ণ অন্য ধান্দাতে। এ কথা সে কথার পর বললেন নানকু নেই। আপনিই তো এখন ভালুমারের লিডার। সকলেই বলে। আপনার কথাতেই এখানকার এবং আশপাশের গাঁয়ের সকলে ওঠে-বসে। আপনি ওদের একটু-বুঝিয়ে-শুনিয়ে পুরোনো রেটেই কাজ করতে বলুন না। রোটাস্ ইণ্ডাস্ট্রিজ-এর গুদামের সামনে কুলিরা বসে রয়েছে। অন্য কোম্পানিগুলোরও তাই-ই হাল হবে। সব কাজ-কারবারই বন্ধ। পুরোনো রেট-এর ওপর, চার চার আনা করে দিনে বাড়িয়ে দিন কুলিদের। আর রেজাদের দশ পয়সা করে। সত্যিই এদের বড় পোভার্টি। এ পোভার্টি চোখে দেখা যায় না।

বললাম, আমি নেতা-ফেতা কিছুই নই। আপনি বাজে কথা শুনেছেন। এখানেই কিছু লোক ইচ্ছে করে এসব রটাচ্ছে। বোধহয় আমার ঘাড়েও কিছু কিছু মিথ্যে মামলা চাপিয়ে দিয়ে যাতে সহজে জেলে পুরতে পারে সেই জন্যে।

রোশনলালবাবু বললেন, সে কী কথা। আমি কি নেই? মরে গেছি? আপনাকে জেলে পুরলেই হল?

আপনার সঙ্গে যতক্ষণ মতে মিলছে, ততক্ষণ পারবে না। মতে না-মিললে আপনিই পুরিয়ে দেবেন। জেল আর খোঁয়াড়ে তফাত কী? পুরে দিলেই তো হল।

রোশনলালবাবু কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। হাসি হাসি মুখে।

বললাম, ওরা কত বাড়াতে বলছে?

একটাকা কুলিদের। আটআনা কামিদের

খুব বেশি বলছে কি? এই বাজারে?

তা নয়। তবে, আপনি তো জানেন, আমার সব সেন্টার মিলিয়ে উইক্‌লি পেমেন্ট হয় দশলাখ টাকা। সেই অঙ্কটা কতখানি বাড়বে বলুন। ব্যবসা চালানোই তো মুশকিল হবে।

তারপর একটু থেমে বললেন, আমার উইলি পেমেন্ট-এ যে টাকা বাঁচবে আপনার লিডারগিরিতে তার পাঁচ পার্সেন্ট, পার-উইক আপনার। আমার লোক এসে পৌঁছে দিয়ে যাবে হর্-হপ্তায়। সোজা হিসাব। আপনার কিছুই করতে হবে না। বসে খান। একটা ভালো মোকাম্ বানান। জমিন নিয়ে নিন। পাওয়ার টিলার কিনুন। ডিপ্-টিউবওয়েল লাগান। চারধারে একেবারে সোনা ফলিয়ে দিন। দুলহীনকে রানির মতো করে রাখুন। নোক্-নোক্রানি কাড়া-ভহিস গাই-বয়েল। মহাতোর থেকেও আপনি বেশি বড়লোক হয়ে যাবেন এক বছরের মধ্যে সায়নবাবু

আমার চোখের সামনে একটা দারুণ সুন্দর ছবি ফুটে উঠল। সুন্দর দামি পোশাকে আমার ছিপছিপে বউ তিতলি, পায়ে রুপোর পায়জোর পরে ঘুরে বেড়াচ্ছে; পেছনে দুজন নোক্রানি। একটি ছেলে আর একটি মেয়ে মায়ের পিছন পিছন আদিগন্ত ফসলফলা ক্ষেতে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। মানি, জুগ, লগন পরেশনাথ, লোহার-চাচা, রামধানীরা চাচা, টিহুল, ছেঁড়া-জামা আর লালমাটিতে-কাচা গামছার মতো ধুতি কোমরের কাছে গুটিয়ে নিয়ে কাজ করছে আমার সামনে—। আর কথায় কথায় বলছে, হাঁ মালিক, জি মালিক। ভট্ ভট্ শব্দ করে ডিজেল পাম্প চলছে। কুয়ো থেকে জল উঠে চারিদিকের ক্ষেতে ক্ষেতে গড়িয়ে যাচ্ছে; নালা বেয়ে, দৌড়ে। বাড়িতেও জেনারেটর চলছে। পাখা, ফ্যান। খুব গরম হলে ডেজার্টকুলার। পাঞ্জাব হরিয়ানা বড়ো বড়ো চাষিদের মতো আমারও রব্রবা। একটা সাদারঙা এয়ারকন্ডিশান গাড়ি—। আমার মালিকেরই মতো। কালো কাচ বসানো।

পরক্ষণেই স্বপ্ন ভেঙে গেল।

রোশনলালবাবু বললেন, কী ঠিক করলেন?

বললাম, আপনি ভুল শুনেছেন। নেতা-ফেতা আমি নই। আমি কেউই নই। তবে কাজ বন্ধ হয়ে থাকলে আপনার আর কতটুকু অসুবিধা। অসুবিধা তো ওদেরই। যারা দিন আনে দিন খায় তাদের।

সেকথা ওরা বুঝছে কোথায়? ওই নানকু হারামজাদাই সব বরবাদ করে দিল। বরবাদীর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে দেশটা প্রতিদিন।

চুপ করে রইলাম। ভাবছিলাম, নানকুও সেদিন ঠিক এই কথাই বলেছিল।

রোশনলালবাবু বললেন, আপনার হপ্তার টাকাটা কত হবে সেই কথা ভাবছেন কি? তা, কম করে দু হাজার থেকে পাঁচ হাজার। সব আপনারই ওপর। পাঁচে যদি রাজি না থাকেন, তো দশ হাজার করুন। শঁকা দশ।

কথা ঘুরিয়ে বললাম, এই শোনচিতোয়াটাকে ম্যান-ইটার ডিক্লেয়ার করছে না কেন? ফরেস্ট ডিপার্টমেন্ট?

খাচ্ছে তো এই জংলিগুলোকেই। পপুলেশান্ প্রবলেম সলভ্ হচ্ছে। আমাকে খেতো, আপনাকে খেতো, দেখতেন সঙ্গে সঙ্গে পারমিট বেরোত। এ শালারা বেঁচে থাকলেই বা কী, মরে গেলেই বা কী? চালু তো আছে দেশে একটাই ইন্ডাস্ট্রি। বাচ্চা পয়দা করার ইন্ডাস্ট্রি। কী বলেন?

তারপর বললেন, আপনি যদি আমার কথায় রাজি থাকেন, তা হলে আমি সাতদিনের মধ্যেই চিতা মারিয়ে দিচ্ছি। এই রাম-রাজত্বে কোন আইনটা কে মানছে মোশয়? আজই গিয়ে রঘুবীরকে পাঠিয়ে দিচ্ছি। আমার রাইফেল দিয়ে। যিস্কা বাঁরি ওহি নাচায়। রাংকা থেকে আনিয়ে নিচ্ছি ওকে। দেখবেন, শোনচিতোয়া পিটা যায় গাহি যায় গা! আমার লোক যদি সকলের সামনেও মারে, তবুও দেখবেন কোনও শালার বুকের পাটা হবে না যে আমাকে কিছু বলে।

পারমিট? পারমিট ইস্যু না করলে, মারবে কেমন করে?

গুলি মারুন। বলেই ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ সমূহের গুহ্যদেশ সম্বন্ধে অত্যন্ত একটা খারাপ কথা উচ্চারণ করলেন। তারপর বললেন, কী করব? বলুন রঘুবীরকে পাঠিয়ে দেব।

দিন না। এর সঙ্গে আমার কাজের সম্পর্ক কী? কতলোক আশীর্বাদ করবে আপনাকে। কত বাবা-মায়ের চোখের জল যে বইছে এই গ্রামে, কত স্ত্রীর, তা বলার নয়।

উসব্ বাত ছাড়ুন। সে তো কোয়েল-ঔরঙ্গা-আমানত্ দিয়েও ভি অনেকহি জল বইছে আমার বপন থেকে। জল দিয়ে আমি কী করব? আমি তো ফায়ার-বিগ্রেডের এজেন্সি নিইনি।

তাহলে, কী ঠিক করলেন?

আবার উনি বললেন।

বললাম, বসুন, চা-ই খান। এত তাড়া কীসের?

একবার ভাবলুম, পাঁচ হাজার টাকাটা ফেরত দিই। এটা আসলে উনি এনেছেন ঘুষ হিসেবে। গ্র্যাচুইটি হিসেবে দিলে তো প্রত্যেককেই দিতেন। আমার বিয়ের দিন শুনলাম, লালটু পাণ্ডেকে ছাড়িয়ে দেবেন মালিক। পাটনা থেকে বাবুর্চি আনবেন। চিপাদোহরে এয়ারকন্ডিশনাড্ গেস্ট হাউস হবে। এয়ারকন্ডিশানড্ গাড়ি করে গেস্টরা এসে জঙ্গলে মৌজ ওড়াবে। লালটু পাণ্ডেকে কি উনি গ্র্যাচুয়িটি দেবেন? এক পয়সাও দেবেন না। প্রভিডেন্ট ফান্ড? তাও কারো নেই। অথচ, এতজন,কর্মচারী ওঁর। সবই একা খেয়েছেন। উড়িয়েছেন। লোকদের দেখিয়েছেন যে, উনি কত বড়ো দিলদার লোক; কিন্তু নিজের কর্মচারীদের কথা ভাবার সময় হয়নি।

আপনি কি গ্র্যাচুয়িটি দেওয়া চালু করলেন? সকলকেই দিচ্ছেন? লালটুকেও দেবেন? ও চলে যাচ্ছে শুনলাম, চাকরি ছেড়ে।

মালিকের ভুরু দুটি কুঁচকে গেল। বললেন, এসব কথা বলার এক্তিয়ার আপনার নেই। আপনি আর আমার কোম্পানিতে নেই। চাকরি তো ছেড়েই দিয়েছেন। আপনার জন্যে এনেছিলাম নিতে হলে নিন্ নইলে নেবেন না।

জবাব না দিয়ে একটু ভাবলাম। গজেনবাবু ঠিক এই সময়ই ভিতর থেকে এলেন। এসেই চোখ টিপলেন আমাকে। কেন, বুঝলাম না।

ঠিক আছে। রেখেই দিচ্ছি। গজেনবাবুর পিছন পিছনই তিতলিও ঢুকল চা ও জলখাবার নিয়ে।

রোশনলাল হেসে, তিতলির গলায় বাক্‌স থেকে খুলে হারটা নিজেই পরিয়ে দিলেন। সত্যি সোনার হার! প্রায় পাঁচ ভরি হবে। এখন সোনার ভরি কত টাকা করে কে জানে? যে বাঁশের কারবারি, সোনার খবর সে কখনও রাখেনি। তিতলির একটাই মাত্র সোনার গয়না ছিলো। আমার মায়ের, গলার বিছে-হার। সেই বাঙালি ডিজাইন ওর যে বিশেষ পছন্দ হয়নি তা ওর মুখ দেখেই বুঝেছিলাম। কিন্তু এই হারটিতে পাটনার নামী এক দোকানের ছাপ। বিহারী ডিজাইন। চমকদার। খুব খুশি হল তিতলি। হাসল। হেসে, পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করল রোশনলালবাবুকে।

আমার গা ঘিন্-ঘিন্ করতে লাগল।

রোশনলালবাবু কিন্তু কিছুই খেলেন না।

বললেন, শরীর ভালো নেই।

বুঝলাম, তিতলি কাহারের মেয়ে তাই-ই খেলেন না কিছুই ওর হাতে।

মোসোয়েবরা জিপেই ছিল। তাদের ডেকে নামিয়ে গজেনবাবু চা-টা খাওয়ালেন। অন্যদের চা-টা খাওয়া হয়ে গেলে রোশনলালবাবু উঠলেন তাঁর প্রকাণ্ড ভুঁড়ি নিয়ে! বললেন, খ্যায়ের! আপনি ভালো করে আমি যা বললাম, তা ভেবে দেখুন সায়নবাবু আর কৌসিস্ করুন। কতদিন সময় চান? ভাবতে?

অন্তত মাসখানেক সময় দিন।

আমার মুখ ফসকে, অজান্তেই কথাটা বেরিয়ে গেল। কথাটা বলেই লজ্জিত বোধ করলাম।

দুমাসও করতে পারেন। এ বছর তিরিশে জুনের ত আর দুদিন বাকি। দরভাও ঠিক হলে পরের বছর থেকে কাজ চালু হবে। তবে, আমি তাড়াতাড়ি করছি এই যে, কসট সম্বন্ধে না জানলে, জঙ্গল ডাকতে অসুবিধা হবে। তাছাড়া, চারধারে গণ্ডগোল শুরু হল। নানা ধরনের গোলমাল। আপনারা তো দিব্যি এই স্বর্গে বাস করেন, কত জমিতে কত গোন্দনি তার কোনোই হিসেব রাখেন না। শেষ-মেষ ডিজেলের ঝামেলা না হয়। কোথাকার জল কোথায় গড়াবে কে বলতে পারে? চলো গজেনবাবু! রোশনলালবাবু ডাকলেন।

গজেনবাবু বললেন, অনেকদিন পর এলাম। তিতলির হাতের খাওয়ার একটু খেয়ে যাই। আমি ট্রাক ধরে, কী বাসে ফিরে যাব কাল।

রোশনলালবাবু ভুরু কুঁচকে উঠলেন হঠাৎ সন্দেহ। পরক্ষণেই বিগলিত বিনয়ের হাসি হাসলেন। যত বড় বানিয়া যে, সে তত বড় বিনয়ী। বিনয় হচ্ছে বানিয়াদের সবচেয়ে খতনাগ অস্ত্ৰ।

বললেন, বহুত্ আচ্ছা বাহ্। মজেমে রহিয়ে।

তারপর জিপে উঠতে উঠতে বললেন, মগর্ শোন্‌চিতোয়াকা বারে মে জারা ইয়াদ রাখিয়ে গা জি। উসকো ভোজন মত্ বন্‌না

রঘুবীরকে পাঠাবেন নাকি? আপনার রাইফেল দিয়ে?

খানে দিজিয়ে শালে লোগে কো। খানে দিজিয়ে কি ভরকর্ বিচারী জানোয়ারকো। উওভি ত ভগওয়ান্কাই প্যয়দা কিয়া হিয়া জীব্ হ্যায়?

জিপটা চলে গেল। রোশনলালবাবু, সামনের সিটে বিরাট কালো গোল একটা চরের তরমুজের মতো ভুঁড়ি নিয়ে, ভুঁড়ি ঝাঁকাতে-ঝাঁকাতে এবো-খেবড়ো পথে অদৃশ্য হয়ে গেলেন। রোশনলালবাবুর জিপ চলে যেতেই গজেনবাবু ওরিজিনাল ফর্ম-এ ফিরে এলেন। বললেন, অব্ বোলিয়ে বাঁশবাবু শাদীওয়ালা আমি ঔর বেগ শাদীওয়ালা পচানেকা তরীকা ক্যা হোতা হ্যায়?

আমি আর তিতলি দুজনেই হেসে উঠলাম।

কিন্তু শঙ্কিতও হয়ে উঠলাম। গজেনবাবুর মুখ। কি বলতে কি বলে ফেলবেন। অটোমোটিক্ স্টেনগানের গুলির মতো বেরোতে আরম্ভ করলে, আর থামতেই চায় না।

ভাবছিলাম, রাতে কোথায় থাকতে দেওয়া যায় ওঁকে। ঘর তো মোটে রান্নাঘর নিয়ে তিনখানা। এখন তিনখানারই দাবিদার আছে।

উনি যেন মনের কথাটা বুঝলেন। বললেন, দুপুরের খাওয়া-দাওয়ার পরই আমি চলে যাব অন্য কারো বাড়ি নয়তো রথীদার কাছে।

বললাম, রথীদা যে এখানে নেই।

নেই? কোথায় গেলেন? আপনার বিয়ের দিনও তো গিয়ে কত হাতে পায়ে ধরলাম ওঁকে। তারপরই উধাও হলেন নাকি? যাই বলুন আর তাই বলুন, আপনার বিয়েতে পর্যন্ত না থেকে উনি কিন্তু খুবই অন্যায় করেছেন?

একটা বড় শ্বাস ফেলে বললাম, ওঁর ন্যায় অন্যায় ওঁর। বিয়ের পরদিন মিষ্টি নিয়ে ওঁর বাড়িতে গেছি তিতলিকে নিয়ে। উনি আমার প্রণাম নিয়েছিলেন। তিতলিকে প্রণাম করতে দেন নি।

একটু বলেই, আমি তিতলিকে ডাকলাম।

তিতলি আসতেই খুব রেগে গেলাম আমি। আমার মুখ লাল হয়ে উঠল।

গজেনবাবু আমাকে দেখে অবাক হয়ে গেলেন।

বললাম, তোকে রথীদার বাড়ি থেকে ফেরার পথে কী বলেছিলাম আমি?

তিতলিও ভয় পেয়ে গেছিল আমার রণচণ্ডী মূর্তি দেখে।

তিতলি বলল, ভুলে গেছি মালিক।

তোকে বলি নি যে, যার-তার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করবি না। নিজে যাকে মন থেকে গভীর ভাবে ভক্তি না করিস কখনও লোক-দেখিয়ে তেমন কারো পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করবি না। বলেছিলাম, কিনা?

হ্যাঁ মালিক। তিতলি খুব ভয় পেয়েছিলো!

তাহলে তুই রোশনলালবাবুর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলি কেন?

তিতলি অবাক চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, বাঃ উনি যে তোমার মালিক! ওঁকে প্রণাম করব না? অজীব আদমি তুমি। কোনদিন বলবে, তোমাকে আমি প্রণাম করব না?

বজেনবাবু হেসে ফেললেন।

আমি রেগেই ছিলাম তখনও। বললাম, হাসবেন না। ওকে ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিতে দিন।

তিতলি উল্টে রেগে চলে গেল। বলল, কী যে হয় তোমার থেকে থেকে। মালিককে নাকি প্রণাম করলে দোষ!

আমি হতাশ হয়ে বাইরে তাকিয়ে রইলাম। বেচারি নানকু। কাদের ও স্বাধীনচেতা, মাথা-উঁচু বুক টান-টান করতে চাইছে? এই হৃদয় আর সংস্কারসর্বস্ব মানুষগুলোর কাছে মস্তিষ্কের দাম যে ছিটেফোঁটা নয়। যা তারা চিরদিন করে এসেছে, সয়ে এসেছে, বয়ে এসেছে, তাই-ই তারা করে যাবে।

গজেনবাবু বললেন, সায়দাবাবু, আপনার সঙ্গে একটা কথা আছে।

কী কথা?

রোশনলালবাবুর কথাটা ভালো করে ভাববেন।

চমকে উঠলাম। রোশনলালবাবু কি গজেনবাবুকে আমার পিছনে লাগিয়ে রেখে গেলেন নাকি?

তাতে আপনার লাভ?

বললেন, আমিও চাকরি ছেড়ে দেব। ভাবছি। অনেকদিন থেকেই ভাবছি। ভালুমার আর গাড়ুর মধ্যে একটা ডালভাঙা কল আর আটার চাকি বসাবো। বিস্কিটের ব্যবসার পর স্বাধীন ব্যবসা। আপনিও এই গ্র্যাচুইটির টাকাতে চাষ-বাস করুন। তারপর ঐ টাকা পেলে তো মার মার কাট কাট্।

ঐ দালালির টাকা! এদের ঠকিয়ে মালিকের কাছ থেকে কমিশন্?

ঠকাবেন কেন? নেগোসিয়েট্ করে যাতে রাজি হয় তেমনই রফা করবেন। একটা ওয়ার্কেবল সলিউশান্। তারপর যে কমিশন পাবেন, তা দিয়ে এদেরই ভালো করবেন। নিজের ভোগে নাই বা লাগাবেন।

কী রকম ভালো?

আপনার স্কুলটাকে ভালো করুন। একটা ছোটো ডিপেনসারি করুন, যেখানে যেখানে দরকার কুয়ো বসান্, ক্ষেতে ডিপ-টিউবওয়েল বসান, কতকগুলো বলদ কিনে একটা পুল-সিস্টেমে সেগুলো চাষের কাজে বিনি পয়সাতে ওদের দিন। সার দিন, বীজ দিন। কাজ করলে কি কম কাজ করার আছে না কি? জংলি জানোয়ারের যাতে ক্ষেতের ফসল তছনছ না করতে পারে তার এফেক্‌টিভ্ ব্যবস্থা নিন। এ সব আমি অনেকদিন থেকে ভাবছি। কিন্তু আমার দ্বারা এ সব ভালো কাজ-টাজ, শিকড় গেড়ে বসা কোথাওই হবে না। বিয়ে করার মতো একটা কাজ, যা এদেশে সব চেয়েই সোজা কাজ, তাই-ই করতে পারলাম না। আমাকে দিয়ে কি এত সব হবে? আমি হচ্ছি বর্ ফিলসফার। আপনাদের আইডিয়া জুগিয়েই খালাস।

অনেকক্ষণ গজেনবাবুর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলাম।

গজেনবাবুও উল্টে তাকালেন অনেকক্ষণ।

হঠাৎ গলা নামিয়ে বললেন, নানকুকে তো আপনি চেনেন।

আমি সাবধান হয়ে গিয়ে বললাম, নানকুকে, কে না চেনে?

তেমন চেনা নয়। নানকু, কী নিয়ে দিনরাত স্বপ্ন দেখে তা তো আপনি জানেন।

জানি।

বলেই বললাম, তা তো সকলেই জানে।

গজেনবাবু বললেন, আপনি তো মশাই পুলিশের টিকটিকির মতো কথা বলছেন। সকলে সব জানলেও, সব বোঝে না। মা কালী সব বোঝার ক্ষমতা সকলকে দেননি। দিলে আর দুঃখ কী ছিল? তারপর বললেন, নানকু আমার সঙ্গে দেখা করেছিল চিপাদোহরে। বলেছিল, গজেনবাবু আপনারা অল্প-স্বল্প পড়ালিখা শিখেও এই রোশনলালের টাকা-বানানোর তেলকলের বলদ হয়ে রইলেন সারাটা জীবন। আমাদের জন্যে কিছুই করলেন না। নিজেদের জন্যেও না। অথচ আমাদের মধ্যেই কাটিয়ে দিলেন পঁচিশ-তিরিশ বছর।

গজেনবাবু একটু চুপ করে থেকে দূরে তাকিয়ে বললেন, তারপর কী বলল জানেন? সেই নানকু ছোকরা আমাকে?

কী?

বলল, শ্বাস ফেলা আর প্রশ্বাস নেওয়ার নামই কি বেঁচে থাকা গজেনবাবু? বেঁচে থাকার মানে কি শুধু তাই-ই। কী বলব মশাই। ঠিক এমন করে আমার সঙ্গে কেউ কখনও কথা বলে নি। আমিও ইমপর্ট্যান্ট মানুষ! আমাকেও কেউ সিরিয়ালি নিতে পারে? জানেন, আমাদের ছোটবেলায় নর্থ ক্যালকাটার গরাণহাটার মাস্তান ছিল পোটেদা। আমাদের হীরো। তখনকার দিনেও সবসময় দু কোমরে দুটো আল্লাইসেন্সড্ রিভলবার গোঁজা থাকত। দু হাতের গুলি ছিল শালগাছের গুঁড়ির মতো শক্ত। বল, দ্যাখ্ গজা, কারো কাছে মাথা নোয়াবিনি—যদি বাপের ব্যাটা হোস, তবে কারো কাছেই মাথা নোয়াবিনি। কিন্তু কথাটা কী জানেন? সেই পোটেদার শিক্ষার মধ্যে একটা গায়ের জোরের ব্যাপার ছিল। প্রতিপক্ষকে শরীরের জোর দিয়েই হারাতে বলত পোটেদা। কিন্তু নানকুর কাছে কোনো অস্ত্র ছিল না। একটা ছুরি পর্যন্ত না। ওর দুটো চোখ জ্বলজ্বল করে জ্বলছিল আমার সঙ্গে কথা বলবার সময়। ছোক্রাটি কী যে করে দিয়ে গেল মশাই আমাকে। হঠাৎই মনে হল, সমস্ত জীবনটাই রোশলালবাবুর বাঁশের হিসেবে করে, তাস খেলে, মাল খেয়ে, আর ফালতু গেঁজিয়ে নষ্ট করে দিলাম। কারোর মতো কিছুই তো করলাম না। আজ কোলকাতায় ফিরলে আমায় কেউ নেবে না। চিনবেও না। আমি না ঘরকা না ঘাটকা। আমি ইদিশীই হয়ে গেছি। এইটাই এখন আমাদের দেশ। যেখানে বাস করলাম এতদিন তাকে নিজের দেশ বলে মেনে নিতে বাধা কোথায়? কোলকাতাই পরদেশ। তাই ঠিক করেছি, মাঝবয়সে এসে নানকু মহারাজের চেলা হয়ে যতটুকু পারি এদের জন্যেই করব বাকি জীবন। এটা আমার নিজের জন্যেই করা হবে। যে-মানুষ শুধু নিজের ও নিজের পরিবারের পেটের ভাত ও পরনের কাপড়ের সংস্থান করা ছাড়াও নিজের কাছে নিজে অন্য কিছু মানে বিশেষ কিছু একটা হয়ে উঠতে না পারে, সে বোধহয় মানুষ নয়। বড় দেরি করে বুঝলাম কথাটা।

আমি অবাক হয়ে গজেনবাবুর দিকে চেয়ে ছিলাম। ভাবিছিলাম নানকুর কথা। কী আছে ওর মধ্যে তা কে জানে? গজেনবাবুকেও এমন বদলে দিতে পারে? আশ্চর্য!

বললাম, সত্যি ছেলেটা একটা অসাধারণ ছেলে। রোগা-পটকা, নিরস্ত্র, কিন্তু ওর নাম করলে পাঁচটা বস্তির লোক সম্মানে মাথা নোয়ায়। দেখবেন ও একদিন দেশের খুব বড়ো নেতা হয়ে, দেশের কত উপকার করবে ও।

গজেনবাবু খ্যাঁক খ্যাঁক্ করে হাসলেন। বললেন, এটা গজেন বোসের পাণ্ডিত্যের হাসি। আপনি বড়ো বোকা সায়নবাবু। ওর মতো ভালো ছেলেকে কি এই পার্টি-সিসটেম কোলে করে আদর করবে? ব্যক্তির দাম দেয় না দল। কোনো দলই ব্যক্তিত্বেরও দাম দেয় না; যদি না সেই ব্যক্তি, ব্যক্তিত্ব বিকোতে রাজি থাকে দলের বা গোষ্ঠীর মতের কাছে! জানি না, নানকুর মতো ছেলেরা হয়তো কোনো নতুন দল গড়বে, যে দলের হাতে গড়ে উঠবে এক নতুন ভারতবর্ষ। কিন্তু এখন কোনো আশা দেখছি না। যা পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি তা ওর ভবিষ্যৎ। দেখতে পাবেন, হয় ওর মৃতদেহ নয় ওর সব স্বপ্নসাধ ছিন্নভিন্ন হয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে এই বিরাট সদাচলন্ত কনভেয়র্ বেল্টের পাশে। যা-কিছু ভালো, যা কিছু সৎ, সবকিছুকে অটোমেটিক্যালি ছুড়ে ফেলে দিচ্ছে এই অটোমেটিক্ নিঃশব্দ কনভেয়র্ বেল্ট। সায়নবাবু, নানকুর কোনো ভবিষ্যৎ নেই এই কালে, এই হতভাগা দেশে। বড়ো অভিশপ্ত কাল-এ।

তারপরই বললেন, গজেন বোস-এর মুখে বোধহয় এত বড়ো বড়ো কথা মানায় না। দূর শালা! গরমে গরমে বলে দিলাম আর কি! কিন্তু আমি সিরিয়ালি ভাবছি চাকরি ছেড়েই দেব। চলুন একসঙ্গে কিছু একটা করি। শুধু নিজেদের পেট ভরানোর জন্য নয়; কিছু একটা করার মতো করি। যা করে, মনে করতে পারি আমরা জাস্ট্ নিজেদের জন্যেই বাঁচি নি। কী পারি, না পারি সে-কথা আলাদা, কিন্তু পারার চেষ্টা করা; সেটাই বা কম কী?

বলেই, কিছুক্ষণ চুপ মেরে গেলেন। কামান থেকে গোলা বেরিয়ে যাবার অব্যবহিত পর কামান যেমন নিস্তব্ধ শান্ত হয়ে যায়; গজেনবাবু তেমনই শান্ত।

.

আমি দূরে চেয়ে ছিলাম।

হুলুক্ পাহাড়ের মাথার ওপর মেঘ জমেছিলো, স্তরের পরে স্তর। দিগন্তের ওপরে ধোঁয়া ধোঁয়া ভাব। মনে হয়, বিকেলের দিকে খুব বৃষ্টি হবে। চারধার থমথমে। টানা-টাড়ের দিকের ঝাঁটি জঙ্গল থেকে কালি-তিতির ডাকছে। ঝারিতালাও-এর দিক থেকে এক ঝাঁক হুইলিং ইংরিজি হরফ ভি-এর মতো ফরমেশানে উড়ে যাচ্ছে পশ্চিমে। একটা পাখি পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছে পুরো ঝাঁকটিকে। ভি হরফের সামনে সে একটা তিরের মতো এগিয়ে যাচ্ছে আত্মবিশ্বাসভরা দ্বিধাহীন দ্রুত পাখায়। ঝাঁকের অন্য পাখিরা শুরু তাদের নেতাকেই অনুসরণ করে যাচ্ছে ডানা নাড়িয়ে, নির্ভাবনায়, নিশ্চিন্তে….নিশ্চিন্তে আকাশের পুঞ্জীভূত মেঘের স্তব্ধ কালো ধমকানিকে উপহাসের সঙ্গে উপেক্ষা করে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *