৩১
হাজারিবাগের পুলিশ ট্রেনিং কলেজটা অনেকখানি জায়গা জুড়ে। বিহারের অনেক পুরোনো কলেজ এটা। এখান থেকে অনেক বাঘা বাঘা ক্যাডার অসর পাস করে বেরিয়েছেন। অনেকানেক ডাকসাইটে অফিসার এখানে ট্রেনিং নিয়েছেন।
হীরু থাকে পাটনাতে। একজন ক্ষত্রী অসরের মেয়ের সঙ্গে সে ক্লাবে টেনিস্ খেলে। বিয়ের কথাবার্তা চলছে। তবে, হীরু ডি-আই-জি হবার আগে বিয়ে করতে চায় না। লাখ দশেক ক্যাশ জমিয়ে নেবে ততদিনে। পাটনার উপকণ্ঠে বেশ কিছু ক্ষেতি-জমিন নেবে, ট্রাক্টর কিনবে। কুলি ও রেজা নিয়ে আসবে বিভিন্ন জায়গা থেকে। যখন রিটায়ার করাব তখন একজন রাজার মতো থাকবে ও, অনেক মিনিস্টার এম-পিরা যেমন থাকে। বিয়েতেও নেবে লাখ পাঁচেক। নেবে না কেন? ডি-আই-জি জামাই ক’জনের হয়? বড় কষ্টের মধ্যে মানুষ হয়েছে ছোটবেলায়। বাবুগিরি কাকে বলে বামুন-কায়েত-ভূমিহারাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেবে হীরু ওরাওঁ ওরফে হীরু সিং।
সরকারি কোয়ার্টার্স দারুণ সাজিয়ে নিয়েছে হীরু। ফ্রিজ, টি-ভি, কার্পেট, এয়ার- কন্ডিশনার সব দিয়ে। ক্যাসেট্-প্লেয়ার-টেপ-রেকর্ডার, স্টিরিওফোনিক-সাউন্ড সিস্টেম, মানে, যে-সব না থাকলে শহরে আজকাল স্ট্যাটাস্ হয় না, তেমন সবকিছুই তার আছে। ইদানীং ভাবছে, নেপাল বর্ডার থেকে একটা ভিডিও আনবে। ঘরে বসেই ছবি দেখবে। যে-কোনো ছবি। ব্লু-ফিল্মও দেখবে মাঝে মাঝে।
হীরু প্রথমে ভেবেছিল যে, অসর হয়ে সে গ্রামেই ফিরবে। সেখানে কুয়ো বসাবে অনেকগুলো। ফ্রি প্রাইমারি স্কুল করবে। গ্রামের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা হয়ে থাকবে। মহাতো আর গোদা শেঠকে চাকর রাখবে।
পাগলা সাহেবের কাছে তার ঋণ অনেক। কিন্তু পাগলা সাহেব যতদিন ভালুমারে আছেন, ততদিন অন্য কেউই আর সেই আসনে বসতে পারবে না। হীরু সেকেন্ড-ইন-কম্যান্ড হতে চায় না। ভালুমারে গেলে সে সর্বেসর্বা হয়েই থাকতে চায়। তার সুন্দর সহকর্মী বন্ধু, যাকে সঙ্গে করে সে ভালুমারে গেছিল, সে এক বিহারী জমিদারের ছেলে। ছোটবেলা থেকে প্রাচুর্যের মধ্যেই সে মানুষ হয়েছে। ভালো থাকা, ভালো খানা-পিনা, ভালো পোশাক, ভালো মেয়েছেলে। হীরুরা যে বয়সে জীবনের মানে কী তা ভাবতে পর্যন্ত শুরু করে নি, ওর বন্ধু ততদিনে জীবনকে বেমালুম হজম করে ফেলেছে জোয়ানের আরক না-খেয়েই।
ও প্রায়ই হীরুকে বলে, দেশে এখন সরকারি কর্মচারীদেরই দিন। খাও-পিও-মৌজ্ করো। যিনা বানানে চাও; বানাও। কোই বোল্নেওয়ালা নেহী।
এও সে বলে যে, দেশ যখন পুরোপুরি কম্যুনিস্ট হয়ে যাবে, (হতে তো বাধ্য) ভুখা লোকগুলো তো আর চিরদিন এমনই করে ভুখা থেকেও চোখের সামনে আমাদের জলজ্যান্ত দেখে তা বরদাস্ত করবে না। তখন ঔর ভি মজা। টোটল কম্যুনিজমে সরকারি আমলাদের যা ক্ষমতা, তা ডিকটেটরশিপ, ডেমোক্রেসির আমলের চেয়েও অনেক বেশি। তখন তো হাতেই মাথা কাটব আমরা! আর যতদিন কম্যুনিজম-এর বুলি কপ্চে ভোট আদায় হচ্ছে, যতদিন জনগণের দুঃখে দিল্লির মসনদের মানুষরা চোখের জলের বন্যা বওয়াচ্ছেন; ভণ্ডামির বিজয়কেতন উড়ছে চতুর্দিকে, ততদিনই বা মজা কম কী? দিল্লি থেকে ফোন আসছে, একে মারো, ওকে ধরো। পুলিশ, ইনকাম-ট্যাক্স, এক্সাইজ, কাস্টমস্ কত ডিপার্টমেন্ট রয়েছে দেশে। তাদের বিবেকসম্পন্ন সাহসী, ন্যায়পরায়ণ সব অসররা দিল্লির অঙ্গুলি হেলনেই বিশেষ বিশেষ লোকের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বেন। হীরুরাই তো এখন বাঘের নখ, কুমিরের দাঁত। তাদের মতো মহাপরাক্রমশালী মুষ্টিমেয় ভাগ্যবান লোক আর দেশে কারা আছে?
হঠাৎ একদিন বিবেকের চুলকুনিতে হীরু ওর বন্ধুকে বলেছিল, দেশটার কথা ভাবতে হবে না?
হীরুর বন্ধু বলেছিল, শালা! দেশের কথা যাদের ভাবার, যাদের ভোট দিয়ে আম-জনতা পাটনা পাঠাচ্ছে, তারাই ভেবে অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছে! কোনোরকমে গদিটা ঠিক করে বানিয়ে নাও। যার কাছে যত টাকা সে ততবড় নেতা–অন্য নেতা কেনার ক্ষমতা তার সবচেয়ে বেশি। কম্যুনিজম আসতে আসতে আমাদের জীবন পার হয়ে যাবে। আমাদের মওত্ অবধি যার কাছে মাল আছে, ক্যাশ আছে; সে-ই সব ক্ষমতার মালিক। মুখে কম্যুনিজম-এর বুলি কপচাও আর পাক্কা ক্যাপিটালিস্ট বানাও নিজেকে। তবেই আখেরে কাজে দেবে। দেশ তো একটা কোম্পানি! কোম্পানিকা মাল্ দরিয়ামে ঢাল্। ওসব ফাল্গু ভাবনা এখানে ভেবে লাভ নেই। তোমাদের রভীন্দনাথ ঢাগোরের কী একটা গান আছে না, ওরে ভুরু, আই মীন ডরপোক্, তুম্হারা হাঁতোমে নেহি ভুবনকা ভার—ডরপোক্ আমীসে কোই কাম নেহী হোতা হ্যায়। আজকাল সব চীজোঁমে হিম্মৎ হোনা চাইয়ে। উসব ফজুল্ বাত মে দিমাগ মত্, ফাঁসাও–কাকা কাম্ করো—পাইসা বানাও—মউজ করো ছোক্রী লোটো–এ্যাইসা ওয়াক্ত, ঔর কভী নেহী আয়া, করেগা ইয়ার। ইয়ে মহান দেশ কা বরবাদী হামলোগোঁসেই পুরী হোগা। হাম্ তুম্, নেহী করনেসে দুসরেনে কর্ চল্লা হ্যায়। নেহী করোগে, তো তুম বুদ্ধ হ্যায়-এক নম্বরকা বুদ্ধু।
হীরু ভেবে দেখেছে যে, কথাটা ঠিকই। ব্যাড মানি ড্রাইভস্ এওয়ে গুড মানি। গ্রেশামস্ ল এখন এই দেশের সবচেয়ে প্রত্যক্ষ, দৃশ্যমান এবং অপ্রতিরোধ্য আইন। যা শুধু অর্থনীতির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য ছিল; তা এখন জীবনের সব ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।
হীরুও ঝুলে পড়েছে বনদেওতার নাম করে। ব্রাহ্মণ, কায়স্থ, ভূমিহার, ক্ষত্রিয়, সমস্ত উচ্চবর্ণের হিন্দুর সঙ্গে। নাম বদলে ফেলে তার যে প্রাথমিক আড়ষ্টতা ছিল, তাও কাটিয়ে ফেলেছে। কাঁটা-চামচে খানা খাচ্ছে, স্লিপিং-স্যুট পরে ঘুমোচ্ছে, কমোডে প্রাতঃকৃত্য করছে, অর্থাৎ মানুষ হতে হলে যা যা অবশ্য করণীয় বলে শিখেছে এদেশীয়রা সাহেবের কাছ থেকে তার সব কিছুই শিখে ফেলেছে এবং কায়মনোবাক্যে করছে হীরু। এই মহান দেশের মহান গণতন্ত্রের মহান আল্লাশাহীতে সে উচ্চমর্যাদায় সামিল হয়ে গেছে। ওরা এক দল। এবং সবচেয়ে শক্তিশালী দল। ওদের বিরুদ্ধে কারো কথা বলার উপায় নেই। মুখ খোলার উপায় নেই। খুলেই—খেল্ খতম্।
ভালো রকম কাঁচা টাকা করে নিতে পারলে হীরু ঠিক করেছে পোলিটিকাল লিডার হয়ে যাবে। ব্যস্স্। তখন তার টিকি ছোঁয় এমন সাধ্য কার আছে? রাজনীতির মতো এত বড় মুনাফার ব্যবসা দেশে আর দুটি নেই।
খবরের কাগজদেরও আর ওরা ভয় পায় না। বেশিরভাগ কাগজই এখন দিল্লির কোন্ দল সংখ্যাগরিষ্ঠ সেই দিকে চেয়ে বসে থাকে। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিয়ে যে শোরগোল শোনে ওরা; হীরুরা জানে যে, সেটার চেয়ে ফালতু আর কিছুই নেই। নিরানব্বুই ভাগ খবরের কাগজই তাদের স্বাধীনতা ব্যবহারই করে না। বি.এ, এম. এ পাস-এর সার্টিফিকেট সযত্নে আলমারিতে তুলে রেখে যদি কেউ অশিক্ষিতের মতো ব্যবহার করে তাহলে তার ডিগ্রির দাম রইল কোথায়? যে-সাংবাদিকরা আজকে কোনো পরাভূত নেতাকে গালিগালাজ করে, তার ব্যক্তিগত জীবনের কুৎসা রটিয়ে রম্রম্ করে বই বিক্রি করে; তারাই আবার সেই নেতাই ক্ষমতায় ফিরে এলে পরদিনই সাড়ম্বরে, আত্মসম্মানজ্ঞানহীন কুকুরের মতো তার পদলেহন করে। এরা আবার সাংবাদিক নাকি? ভয় করতে হবে এদের? ফুঃ!
এই দেশে ভয় করার কিছুমাত্রই নেই। যা খুশি তাই-ই করে যাও, যে-কোনো ক্ষেত্রে, যা দিল্ চায়; পকেট-ভর্তি কাঁচা টাকা রেখো—। সব ঠিক হো যায়গা, বে-ফিক্কর। যা একমাত্র চাই, তা শুধু বুকের পাটা। আর পুলিশ অফিসারেরই যদি বুকের পাটা না থাকবে, তবে থাকবে কার?
হীরু এখন টোটালি কনভার্টেট হয়ে গেছে। আগে কখনও-সখনও বাবা-মা-টুসি, লগন, পাগলা-সাহেব ইত্যাদিদের মুখ মনে পড়ত। এখন আর পড়ে না। শক্ত না হলে, পুরোনো কথা না ভুলতে পারলে জীবনে কখনও বড় হওয়া যায় না, ওপরে ওঠা যায় না। জানে হীরু।
ভালুমার এবং আশপাশের অঞ্চলে ইদানীং মাঝে মাঝেই গোলমাল হচ্ছে। সিংভূম এবং বোধহয় ওড়িশারও কিছু কিছু জায়গা থেকে একদল সন্ত্রাসবাদী ছেলে এসে আস্তানা গেড়েছে সেখানে। নইলে, অমন নির্বিরোধী, সর্বংসহ, কুকুর-বেড়ালের চেয়েও ঠান্ডা মানুষগুলো হঠাৎ এমন লম্বা-লম্বা কথা বলতে শুরু করল কী করে? কে তাদের এসব শিখোচ্ছে?
যেসব লোকাল রিপোর্ট ওরা পেয়েছে, তাতে নানকু বলে এক ছোকরার নাম আছে। সে নাকি ভালুমার বস্তির মোস্ট ইনফ্লুয়েন্সিয়াল লোকদের পেছনে লেগেছে। এবং প্রাণের ভয়ও দেখাচ্ছে। এ কোন নানকু? তাদের নানকু? নিশ্চয়ই সে নয়। সেই মুখচোরা ভালামানুষ ছেলেটি এই নানকু হতেই পারে না। গ্রামের মাহাতো আর গোদা শেঠ হীরুর কাছে দু’হাজার টাকা দিয়ে একটি লোক পাঠিয়েছিল—। ওরা নানকুকে খতম করতে চায়। ব্যাপারটা যেন পুলিশে চাপা পড়ে যায়। পুলিশের আর কিছুই করতে হবে না। টাকাটা হীরুর বন্ধু ফেরত দিয়েছে। প্রথমত দু’হাজার টাকাটা ওদের কাছে কোনো টাকাই নয়। দ্বিতীয়ত হীরু নিজের গ্রামে গিয়ে হুজ্জোতি করতে চায় না। বন্ধুকেই বলেছিল যেতে। বন্ধুর এত টাকা হয়ে গেছে—বাপ-ঠাকুর্দার টাকার ওপরে যে, এখন টাকা রাখার জায়গাই নেই। তার একমাত্র শখ এখন ছোরি।
যে লোকটি পাটনাতে এসেছিল ওদের সঙ্গে দেখা করতে তাকে হীরুর বন্ধু বলে দিয়েছিল যে, দুসরা রাতে যে ছোরিটি এসেছিল, তাকে সে আরেকবার চায়। আঃ কা কিম্তি চিজ! তা হলেই হবে। আর কিছু চায় না সে। ছোক্রাগুলোকে ঠান্ডা করে দিয়ে আসবে সে। শুধু ছোরির জোগান থাকলেই হবে।
লোকটি চলে গেলে, হীরু অবাক হয়ে বন্ধুকে জিজ্ঞেস করেছিল, দুসরা রাত মানে? তুমি কি ওখানে দু রাতে দুজনকে ভোগ করেছো নাকি?
আলবৎ। হর্ রাতমে নঈ চিড়িয়া! নেহি ত, মজা কেয়া?
হীরু তার গ্রামের সব মেয়েরই নাম জানত। তাই বলল, কী নাম তাদের?
বন্ধু বলল, প্রথম দিন তো বাংলোর চৌকিদার টিহুল না কার বউকে নিয়ে এসেছিল ধরে। তার নাম মনে নেই। মেয়েটির অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সবই ঠিকঠাক। গায়ের রঙও চমৎকার। কিন্তু কী যেন নেই। মানে কাচার।
কালচার?
অবাক হয়ে হীরু তাকিয়েছিল বন্ধুর দিকে। টিহুলের মুখটা মনে পড়ছিল। বাংলোর হাতার গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে-থাকা, তার খেলার সাথী টিহুল! তার বউ!
বন্ধু বলল, হ্যাঁ?
তবে দ্বিতীয় রাতে যে মেয়েটি….তাকে কে নিয়ে এসেছিল?
তাকে কেউ আনেনি, ভগবান পাঠিয়েছিল ইয়ার!
ভগবান পাঠিয়েছিল?
হ্যাঁ ইয়ার। আমি একা বসে ড্রিঙ্ক করছি, মেয়েটি দরজা খুলে সোজা ঘরে এল। আমার মনে হয়, ও বোধহয় কাউকে খুঁজতে এসেছিল। দারুণ মেয়ে। এই থুনির কাছটায় তোমার সঙ্গে দারুণ মিল ছিল মেয়েটির।
হীরুর দম বন্ধ হয়ে আসছিল। ধক্ ধক্ করছিল হৃৎপিণ্ড।
বলল, নাম মনে আছে?
আছে বইকি! টুসি! টুসিয়া!
হীরু মুখ নীচু করে বলল, সে টাকার জন্যে তোমার কাছে এসেছিল? মানে শরীর বেচতে?
বন্ধু বলল, নেহী ইয়ার! অনেক অনুনয় বিনয়ও করেছিল ছেড়ে দেবার জন্যে! কিন্তু রিভলবার দেখিয়ে নাঙ্গা করলাম। আঃ কেয়া চিজ। আজও ভাবলে আমার ঘুম আসে না। অবশ্য অনেক কেঁদেছিল মেয়েটা ভাইয়া! ভাইয়া! করে!
হীরু চুপ করে আছে দেখে বন্ধু বলল, কী হল? নিজের গ্রামের মেয়ে শুনে মন খারাপ হয়ে গেল। তোমার প্রেমিকাট্রেমিকা নাকি? তা আগে থাকতে বলে রাখবে তো আমাকে, মহুয়াডার চলে যাবার আগে।
হীরু তবুও চুপ করেই ছিল।
বলল, গ্রামের কথা মনে হলে মন খারাপ তো একটু হয়ই।
তারপর বলল, তোমার সঙ্গে আমি যাবো না ভেবেছিলাম ভালুমারে। কিন্তু যেমন সব রিপোর্ট আসছে, চল দুদিনের জন্যে দুজনেই ঘুরে আসি। এই হাজারিবাগের স্কুল থেকে ছাড়া পাওয়ার সময়ও তো হয়ে এল! ঢের হয়েছে! লেখাপড়া আর ভালো লাগে না।
রিফ্রেশার কোর্স শেষ হবে সামনের বুধবার। বৃহস্পতিবারে ফেয়ার ওয়েল। জানোই তো! শুক্রবারে পাটনা পৌঁছে যাব গাড়িতে। ডি আই জি, ডি ডি এবং সি বি আইয়ের ইনস্ট্রাকশানস্ অনুযায়ীই যা করার করব। আমাদের ইচ্ছায় তো আর যাওয়া হবে না ভালুমারে। যখন ওরা পাঠাবেন তখনই যেতে হবে, হীরুর বন্ধু বলল।
হীরু বলল, তা ঠিক।
বলেই বলল, মেয়েটাকে কি তুমি রেপ্ করে মেরে ফেলেছিলে নাকি?
হোঃ হোঃ করে হেসে উঠল বন্ধু। বলল, একবারে বুদ্ধ না হলে, কোনো মেয়েই রেপ্ করলে মরে না। ওদের মধ্যে একটা ইন-বর্ন মেকানিজম্ আছে। ওরা বুঝতে পারে, হয়তো অনেকে বহু পুরোনো প্রবাদে বিশ্বাসও করে যে, হোয়েন রেপ্ ইজ ইনএভিটেবল, হোয়াই নট এনজয় ইট? বলেই হো হো করে হেসে উঠল।
ওঃ। হীরু স্বগতোক্তি করল।
তারপর ট্রেনিং কলেজের কম্পাউন্ডের বড় বড় গাছগুলোর দিকে চেয়ে থাকল উদাস হয়ে। রাস্তার বাইরে হাজারিবাগ ক্লাব। উল্টোদিকে হান্নানের দোকান। তার পিছনে কাচারি। ডাইনে গেলে বুহি রোড—তার আগে বেরিয়ে গেছে বগোদর-সারিয়ার রাস্তা কোনো বিশেষ কিছুই দেখছিল না হীরু। উদ্দেশ্যহীনভাবে যেন অনন্তকাল ধরে বাইরের দিকে চেয়ে বসেছিল সে।
হীরুর মনটা বড় উচাটন হল। অনেক কথা, অনেক আশঙ্কা তার মনে ঝড় তুলল। টুসি বলে দ্বিতীয় কোনো মেয়েকে তো সে বস্তিতে চিনত না! তবে কি?
অ্যাফিডেভিট করে নাম চেঞ্জ করে, নিজেকে ভারতীয় বাদামি সাহেব বানিয়ে, প্রচুর টাকার মালিক হয়ে, ক্লাবে টেনিস খেলে, নারীসঙ্গ করে করে ও ভেবেছিল ওর যাবতীয় সংস্কার এবং ভালুমারের গোঁড়া, দেহাতি হীরুর তাবৎ হীরুত্ব ও মুছে ফেলেছে। ও আর কখনও পিছনে তাকাবে না। হি হ্যাজ বার্নট্ অল দ্যা ব্রিজেস্ বিহাইন্ড। কিন্তু…
সামনে একটা বড় কৃষ্ণচূড়া গাছ। তার শিকড় নেমে ছড়িয়ে গেছে এদিক ওদিক। সেদিকে তাকিয়ে থাকতে আর বাবার হাতটার কথা হঠাৎই মনে পড়ল হীরুর। কঠোর পরিশ্রমী, দীন-দুঃখী, তার জন্যে-গর্বিত, তার বাবার হাতের শিরাগুলো এই গাছের শিকড়েরই মতো ফুলে ফুলে উঠেছে। হঠাৎই কে যেন ওর বুকে আমূল কোনো তীক্ষ্ণ ছোরা বসিয়ে দিল। বাবা! মা! টুসিয়া। লগন। ওর মস্তিষ্কের মধ্যে দ্রুতপক্ষ পরিযায়ী পাখির মতো অনেক বোধ ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে ফিরে আসতে লাগল। ওর মনে হল ভালুমারের হীরু নামক একটি ছেলের প্রাণের শিকড় ছড়িয়ে অনেকই গভীরে প্রোথিত হয়ে আছে। হয়তো প্রস্তরীভূতও হয়ে গেছে। ওর বোধহয় সাধ্য নেই যে, সেই শিকড়কে…ও…
ওর পরীক্ষা পাস করার পরদিন থেকে হীরু এক চমৎকার স্বার্থপর খুশিতে ছিল, হীরু ওরাওঁ থেকে হীরু সিং-এ উন্নীত হয়ে। কিন্তু আজ সকালে তার বুকের কোথায় যেন চিড়িক্ চিড়িক্ করে কী একটা তীব্র যন্ত্রণা তাকে বড় পীড়িত করে তুলছে বারে বারে। কী জানি? কেন এমন হলো?
হীরু ড্রয়ার খুলে কাগজ ও খাম বের করে তার বাবা জুন্নু ওরাওঁকে চিঠি লিখতে বসল। লম্বা চিঠি। হীরুর মনে হলো এ চিঠি বোধহয় শেষ হবে না কোনোদিনও। এ তো চিঠি নয় কনফেশান্, এ এক আত্মশুদ্ধি প্রায়শ্চিত্তর দাখিলা, দাগ-নম্বর, খতিয়ান নম্বর সুদ্ধু; চিরদিনের জন্যে তার বাবার বুকের জমিতে জরিপ হয়ে বরাবরের মতো রেজিস্ট্রি হয়ে থাকবে। হীরু আবার পুরোনো ঘরে দুয়ার দিয়ে, ছেঁড়া আসন মেলে বসবে। হঠাৎই বড় বেদনার সঙ্গে হীরু অনুভব করল যে, বাহির পথে যে বিবাগী হিয়া ভ্রষ্ট নষ্ট হয়ে হারিয়ে গেছিল; তাকে যে ভালুমার বস্তির প্রত্যেক নারী পুরুষ এবং শিশু হাতছানি দিয়ে ডাকছে—বলছে, আয় আয় আমাদের হীরু ফিরে আয়রে তুই আমাদের কাছে, আয়রে আমাদের গর্বের হীরু। আমাদের পুরনো ওম্-ধরা বুকে ফিরে আয়।
চিঠি লেখা থামিয়ে, বাইরের বড় কৃষ্ণচূড়া গাছটার দিকে আবারও চাইল হীরু। পুলিশ সাহেব নয়; মানুষ হীরু। ওর দুচোখ জলে ভরে এল। যে জল, গঙ্গাজলের চেয়েও পবিত্র!