কোজাগর – ৩

ভোর হয়ে গেছে অনেকক্ষণ। ঘুম ভাঙার পর লেপের নিচে শুয়ে সামান্য সময় একটু আমেজ করি রোজ। তারপর কুয়োর ধুয়ো-ওঠা জলে চান করি। ততক্ষণে তিতলি চলে আসে। ওকে বলেছিলাম, আমার কাজ করতে হলে নোংরা হয়ে থাকলে চলবে না। শাড়ি অবশ্য আমিই কিনে দিয়েছি। সাবান-তেলেরও পয়সা দিতাম ওকে আলাদা করে। প্রথম আমার কাজে বহাল হওয়ার পর দেখতে দেখতে মাসখানেকের মধ্যেই ওর চেহারা বদলে গেল। রুক্ষ মুখে লাবণ্যর চিকণতা লাগল। চুলে সুগন্ধি তেলের গন্ধ। গোলা সাবানে, ঝরনার পাথরে সান-বাঁধানো কুয়োতলায় কাচা, পরিষ্কার শাড়ি-জামা পরত ও। ভোরের রোদ্দুরের গন্ধ গায়ে মাথায় মেখে সুস্নাতা তিতলি যখন বাঁশের বেড়ায় দরজা ঠেলে আমার এই পর্ণ-কুটিরের আঙিনায় হাসিমুখে ঢুকত তখন আমার মন খুশিতে ভরে উঠত। ও হাসত, গোলাপের পাপড়ির ওপরে রাত-ভর জমা-হওয়া টল্টলে শিশিরের মতো পবিত্রতায়। মুখে বলত, পরনাম বাবু।

আমি বলতাম, পরনাম

ওদের জ্ঞাতি-গোষ্ঠীরা কিন্তু কেউই ভোরে চান করে না। ও আমার দেখাদেখি ভোরে চান করার অভ্যেস করে ফেলেছিল।

উঠোনের একপাশে একটা ঝুমকো জবার গাছ ছিল। তাতে দুর্গা-টুনটুনি আর মৌটুসি পাখিদের মেলা বসত। সেই জবা গাছ থেকে কয়েকটা জবা, পাশের গ্যাঁদার ঝাড় থেকে গ্যাদা ছিঁড়ে এনে বসবার ঘরের ফুলদানিতে সাজাত। ওকে বলিনি কখনও। নিজেই করত। ওর মধ্যে এক আশ্চর্য সহজাত বুদ্ধি, সৌন্দর্য-জ্ঞান ও সুরুচি ছিল, যা ও, ওর পরিবেশ থেকে পায়নি। ওর সঙ্গে যে আমার শ্রেণীগত এক প্রচণ্ড বিভেদ আছে, ও তা জানত। আমি শিক্ষিত, “ভদ্রলোক”, শহুরে বামুনের ছেলে। আর ও অশিক্ষিতা, গ্রাম্য, এক “ছোটলোক” কাহারের মেয়ে। ও পরের কাছে কাজ করে খায়-পরে। আর আমি ওকে রুজি দিই। এটা ছিল আর্থিক-শ্রেণীগত বিভেদ। ও যেন সবসময়ই আমার খুব কাছে আসার চেষ্টা করত। সংকীর্ণ লোকেরা যাকে বলে “জাতে-ওঠা”-র চেষ্টা! কোনো বিশেষ উদ্দেশ্যে নয়। এমনিই। ঐ সদ্য-যুবতী মেয়েটির কাছে আমিই ছিলাম বাইরের পৃথিবীর একমাত্র জানালা। জানালা খোলা রেখে ও আলো বাতাস পেতে চাইত। আমাদের রীতি-নীতি, আচার-ব্যবহার, আমাদের শহুরে বাঙালি-রান্না আমার কাছ থেকে শুনে-শুনে রপ্ত করার খুবই চেষ্টা করত ও। মিষ্টি হেসে বলত, আমি পারছি? তোমার মনের মতো হতে পারছি?

আমি হাসতাম বন্য যুবতীর কথা শুনে।

বলতাম, এখনও পারিসনি। চেষ্টা করতে করতে কখনও হয়তো হয়ে উঠবি। তবে, আশা কম। সকলের দ্বারা কি সব হয়?

ও বলতো, দেখো। একদিন নিশ্চয়ই, পারব।

চান সেরে, ঘরে আমি জামা-কাপড় পরছিলাম। একটু পরেই ট্রাক আসবে। হুলুক্‌ পাহাড়ের ওপরে আমাদের কাজ হচ্ছে। এতক্ষণে মেট, মুনশী, কুলিরা সব কাজে লেগে গেছে। তাড়াতাড়ি নাস্তা করেই ট্রাকে উঠে চলে যাবো। ফিরব, সেই সূর্য ডোবার আগে! ততক্ষণ তিতলি আমার একার সংসারের মালকিন্ হয়ে থাকবে। ঘরের দেওয়ালে গেরুয়া মাটি আর রঙ মিলিয়ে ছবি আঁকবে। গোবর দিয়ে উঠোন নিকিয়ে রাখবে। আমার গামছা-পাজামা-পাঞ্জাবি ধুয়ে দেবে। অন্যান্য কাপড়-জামা, লেপ-বালিশ, প্রয়োজন মতো রোদে দেবে। চৌপাইতে খামল বাড়লে, চৌপাই বাইরে বের করে তাতে ফুটন্ত জল ঢেলে ছারপোকা মারবে। আমার জন্যে অনেক যত্নে রান্না করবে। সারাদিন এ-ঘর ও-ঘর, উঠোন কুয়োতলা এই-ই করে ও। ওর হাতের গুণে এই লক্ষ্মীছাড়া একা মানুষের সংসারও শ্রীময়ী হয়ে উঠেছে। আমার মতো ওরও খুব ফুলের শখ। ম্যানেজারবাবুকে বলে কলকাতার সাটস্ থেকে কিছু সিজন, ফ্লাওয়ারের বীজ আনিয়ে ছিলাম। পুর্টোলেকা, ডালিয়া, অ্যাস্টার এই সব। যত্ন করে লাগিয়েছে ও। উঠোনের দু-পাশে দুটো বোগোন-ভোলিয়া। রাধাচূড়া দুটো। ওগুলো সব ফরেস্ট বাংলোর মালির কাছ থেকে জোগাড় করা। ও-ই করেছে। মাঝে মাঝে আমি জঙ্গলে কোনো নতুন ফুল বা গাছ দেখতে পেলে চারা বা বীজ সংগ্রহ করে নিয়ে আসতাম। খুব আগ্রহ সহকারে ও সেগুলো বাঁচাবার এবং বড় করার চেষ্টা করতো। কিন্তু আশ্চর্য পাখি সম্বন্ধে ওর কোনো উৎসাহ ছিল না। ওদের কারোই নেই। জঙ্গলের মধ্যে যারা বাস করে, তারা তাদের পরিবেশ ও জগৎ সম্বন্ধে এতো কম উৎসুক যে নিজের চোখে না-দেখলে বিশ্বাস করাও মুশকিল। কোনো অপ্রধান গাছ দেখিয়ে নাম জিজ্ঞেস করলে এরা সকলেই বলে, কওন জান্তা? নতুন পাখি দেখালে বলে, কওন চিড়িয়া, কওন জানে? আসলে ওরা নিজেরাই জানে না যে ওরা নন্দনকাননের বাসিন্দা। অথচ নন্দনকাননের বাসিন্দাদেরই চোখ আর কান দিয়ে পাঠাননি বিধাতা। কিংবা হয়তো শরীরের যে একটা ন্যাক্কারজনক অংশ যার নাম জঠর, সেই জঠরের দাবাগ্নিতেই ওদের আর-সব শুভবোধ ও ঔৎসুক্য বুঝি চাপা পড়ে গেছে চিরতরে। সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত অবধি ঐ একই চিন্তা। অন্ন চিন্তা। দোষ দেখি না কোনো ওদের

জামা-কাপড় পরতে পরতে একটা পাখির ডাক শুনলাম। পাখিটা থেমে থেমে ডাকছিল প্রথমে। তারপরই ঘন ঘন ডাকতে লাগল দুটি পাখি। গলার আওয়াজে মনে হয় কোথাও কোনো চীনেমাটির জিনিস ভেঙে-চুরে যাচ্ছে বুঝি। ধাতব শব্দের কাছাকাছি একটা শব্দ। পাখি দুটো ডাকছে রাস্তার পাশের কোনো গাছ থেকে। এমন ডাক এর আগে কখনও শুনিনি।

তাড়াতাড়ি জামা-কাপড় পরে বাইরে এসেই দেখি, মানি প্রায় দৌড়তে দৌড়তে আসছে, হাতে দুধের লোটা নিয়ে। ক্ষমা-চাওয়া হাসি হেসে বলল, বড়ী দের্ হো গেল মালিক।

বললাম, তিতলি আছে। দুধ দিয়ে এসো ভিতরে।

আস্তে আস্তে গাছটার দিকে এগোলাম। একটা কাঠ টগরের মতো দেখতে বুনো ফুলের গাছ। এই গাছগুলো ভালুমার অঞ্চলেই বেশি দেখি। পাহাড়ের ওপরের দিকে ও নেই। আরো নীচে নেমে গেলেও নয়। পাখিটা নজরে এলো। অনেকটা ফিঙের মতো দেখতে। গলার কেশর ফুলিয়ে সঙ্গিনীর সঙ্গে প্রেম করছে। লেজটা একটা ত্রিকোণের মতো দেখাচ্ছে পিছন থেকে। পাখি দুটোকে নজর করার পর আস্তে আস্তে সাবধানে পিছিয়ে এসে হাঁক দিলাম, তিল, তিল….।

রান্নাঘর থেকে জবাব এলো, নাস্তা তৈয়ার হ্যায়।

নাস্তা নয়, বইটা আন্।

তিতলি রান্নাঘরে বারান্দায় এসে শুধোল, কওসা কিতাব? চিড়িয়াওয়ালা?

হ্যাঁ। তাড়াতাড়ি আন্।

তিতলি দৌড়ে সালিম আলির বইটা এনে দিলো। দিয়ে, আমার পাশেই দাঁড়িয়ে রইল।

বইটার পাতা খুলে পরপর তাড়াতাড়ি উল্টোতে উল্টোতে এক জায়গায় এসে থেমে গেলাম। তারপর পাতাটা খোলা অবস্থাতেই আস্তে আস্তে আবার পাখি দুটোর দিকে এগিয়ে গেলাম। ওরা প্রেমের খেলায় এমনই মেতে ছিল যে চারপাশের কোনো কিছুর প্রতিই ওদের হুঁশ ছিল না। আমি মিলিয়ে দেখলাম, হুবহু ছবির সঙ্গে মিলে যাচ্ছে। গলার স্বরের বর্ণনার সঙ্গেও মিলে যাচ্ছে। পাখি দুটোর নাম র‍্যাকেট্রেইল্ড ড্রঙ্গো। পাখি দুটোকে চিনতে পেরে ভারি ভালো লাগল।

কতক্ষণ ওখানেই উবু হয়ে বসে ছিলাম খেয়াল নেই। হঠাৎ পিছ থেকে কে যেন আমার কাঁধে হাত দিলো। ফিস্ ফিস্ করে ভয়ে ভয়ে বলল, বাবু

তাকিয়ে দেখি, তিতলি। তারপর তিতলির আঙুল যেদিকে তোলা ছিল, সেদিকে তাকিয়েই দেখি আমার সামনেই একটা খহি বাঁশের ঝাড়ের মধ্যে বাঁশে জড়িয়ে একটা প্রকাণ্ড শঙ্খচূড় সাপ রোদ পোয়াচ্ছে!

তিতলি কাঁধে খিচে আমাকে সজোরে পিছনে আকর্ষণ করল।

আমরা দু’জনেই সরে এলাম। ডেরার দিকে ফিরতে লাগলাম।

তিতলি বলল, তুমি এই করেই একদিন মরবে। নাস্তা ঠান্ডা হয়ে নেতিয়ে গেল। উনি পাখি দেখে বেড়াচ্ছেন! তোমার মা, মরে বেঁচে গেছেন তোমার হাত থেকে।

উঠোনে ঢুকলাম। ওর কথার কোনো জবাব দিলাম না।

ও এরকম করে প্রায়ই বলে। আমার শুনতে যে খারাপ লাগে, তা বলব না। এই সম্পূর্ণ অনাত্মীয়া মেয়েটির চোখে-মুখে আমার জন্যে দরদ, শঙ্কা, সহানুভূতি সব এমন করে হঠাৎ হঠাৎ আমার অন্ধকার অনাদরের জীবনে তারার মতো ফুটে ওঠে। বুকের মধ্যেটা যেন কীরকম করে ওঠে।

কত কীই যে ও বয়ে বেড়ায় ওর বুকে আমার জন্যে, ভেবে অবাক হই। ভালোলাগায়, এবং লজ্জাতেও মরে যাই। ভালোলাগাটা, ভালোলাগার কারণেই। লজ্জাটা, আমার জন্যে ও যা করে, যা ভাবে, আমি ওর জন্যে তার কণামাত্রই করি না; বা ভাবি না বলে।

ও যখন নাস্তা দিচ্ছিল, আমি বললাম, ঐ যে ট্রাকের শব্দ আসছে পাহাড়ের আড়াল থেকে। ইস্ ট্রাক এসে গেল। পাখি দেখতে গিয়ে, দেরি হয়ে গেল আজ

ট্রাক দশ মিনিট দাঁড়িয়ে থাকলে রামের বনবাসের মেয়াদ বাড়বে না। তুম্ ডাকে নাস্তা করকে, তব্‌ যাওগে। সারাদিনের জন্যে খেয়ে একেবারে বেরোনো! এমন- করলে শরীর থাকবে?

ধমক দিয়ে বললাম, তুই চুপ কর তো। বড় বেশি কথা বলিস।

ও আর কথা বলল না। দু-হাত হাঁটুর ওপর ছড়িয়ে দিয়ে মুখটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে বসে, চোখ নীচু করে আমার পাতে ও খাবার ঠিক ঠিকই দিচ্ছিল, কিন্তু তাকাচ্ছিল না আমার মুখে।

ট্রাকটা একটা প্রাগৈতিহাসিক দাঁতাল শুয়োরের মতো আওয়াজ করছিল ডেরার সামনে। ডিজেলের ট্রাক। কোম্পানির। ড্রাইভার রহমত্ এঞ্জিন বন্ধ করার প্রয়োজন মনে করে না। তেল পুড়লে তো মালিকের পুড়বে! ওর কী?

খাওয়া শেষ হলে তিতলি উঠে বলল, দুধ আনছি।

দুধ খাবো না।

কেন? ও আমার চোখের দিকে তাকালো। নীরবে কৈফিয়ৎ চাইল।

বিরক্তি গলায় বললাম, সময় নেই।

আমার ভাবটা এমনই, যেন দুধ খেয়ে আমি ওকেই ধন্য করব।

ও কথা না-বলে, দৌড়ে রান্নাঘরে গিয়ে টাটকা জ্বাল দেওয়া দুধ নিয়ে এলো

কাচের গ্লাসে করে। এসে আমার সামনে দাঁড়িয়ে থাকল।

আমি রুক্ষ চোখে একবার ওর দিকে তাকালাম।

ও আবার চোখ নামিয়ে নিলো। কিন্তু দুধের গ্লাসটা বাড়িয়ে দিলো আমার দিকে। কথা না-বলে, বারান্দার লোটাতে তোলা জলে মুখ ধুয়ে, তোয়ালেতে হাতমুখ মুছে, ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম।

শঙ্খচূড় সাপটা ট্রাকের শব্দ পেয়ে নিশ্চয়ই এতক্ষণে জঙ্গলের গভীরে চলে গেছে। প্রেমিক কালো পাখিটাও আর নেই। নেই তার সঙ্গিনীও।

ট্রাকের সামনের উঁচু সিট থেকে আমার ডেরার ভিতরটা দেখা যায়। রহমত্ যখন ট্রাকটা স্টার্ট করে হুলুক্ পাহাড়ের দিকে চলল, তখন ড্রাইভারের পাশের সিটে বসে দেখলাম, বারান্দার বাঁশের খুঁটিতে হেলান দিয়ে ঐভাবেই দু-হাতে দুধের গ্লাস হাতে নিয়ে তিতলি তখনও দাঁড়িয়ে আছে। মুখ নামানো। চোখ আনত। ও যেন কতদূরে চলে গেছে। ওখানে থেকেও ওখানে নেই।

হঠাৎ আমার বুকের মধ্যে বড় কষ্ট হলো ওকে ওভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে। ওর সঙ্গে বড়ই খারাপ ব্যবহার করি আমি। বিনা কারণে। সংসারে যাদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করা যায়, তেমন আপনজন কি খুব বেশি থাকে? কারোই? আসলে, ওকে কষ্ট দিয়ে আমি খুব আনন্দিত হই। ও যেন আমার পোষা হরিণ। বা আমার ছাগল-ছানা। কী কাকাতুয়া!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *