২৩
পরেশনাথ আর বুলকি শীতের দুপুরের বনে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। শুধুই ঘুরে বেড়াচ্ছিল বললে ভুল হবে। আসলে আমলকী কুড়োতে গেছিল। উপরন্তু বুলকির উদ্দেশ্যে ছিল কুঁচফল আর কাঁকোড় সংগ্রহ করার। কুঁচফল এই সময় হয়। শুকনো পাতার আড়ালে লুকিয়ে থাকে থোকা থোকা উজ্জ্বল রঙের ছোট ছোট ফলগুলো। আগেকার দিনে স্যাকরারা কুঁচ দিয়ে সোনার গয়না ওজন করতো দেখেছি; সোনার বাটখারার সঙ্গে। বুলকির বৈচিত্র্যহীন রুক্ষ বিবর্ণ জীবনে এই বিচিত্র বর্ণের ফলগুলোই একমাত্র বৈচিত্র্যের বাহন হয়ে আসে। রঙের বন্যায় ভেসে যায় ওর চোখ; ওর কিশোরী মন।
ভাইবোনে নিথর, ঝিন্ধরা জঙ্গলের মধ্যে মধ্যে আঁকাবাঁকা বনপথ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল। বাঁদিকে একটা মাঠমতো জায়গা। বহুদিন আগে ক্লিয়ারফেলিং হয়েছিল জঙ্গলে। সব গাছ, পরিষ্কার নিশ্চিহ্ন করে কাটা। হয়তো কখনও বনবিভাগ সেগুন কী শাল কী ইউক্যালিপটাস প্ল্যানটেশান করবেন। ইউক্যালিপটাস প্ল্যানটেশানের ওপর খুব রাগ দুই ভাই বোনের। ইউক্যালিপটাস গাছে পাখিরা বসে না, বাসা বাঁধে না, ইউক্যালিপটাস বনও তাই প্রাণহীন মনে হয়। পাখিরা আসে না। কারণ এই গাছে ফল হয় না; ফুল ধরে না, পোকামাকড় বাস করে না, তাই পাখিদের কোনো খাবারেরই সংস্থান নেই সেখানে। আর পাখিরা আসে না বলেই, বাসা বাঁধে না বলেই সাপ ও অন্যান্য প্রাণীদেরও কোনো ঔৎসুক্য নেই গাছগুলোর প্রতি।
পালামৌর এই বনে-পাহাড়ে একরকমের গাছ হয়, চিবি তার নাম। ভারি মসৃণ উজ্জ্বল তাদের কাণ্ড। প্রায় ইউক্যালিপটাসের মতোই। এই গাছগুলোকে মনে মনে উল্টো করে নিয়ে দেখলে গা শিরশির করে। প্রতিটি ডালের সংযোগস্থলকে মনে হয় নারীর জঘন এবং কাণ্ডগুলোকে মনে হয় ঊরু। কত বিচিত্র মাপের ও গড়নের হস্তিনী, পদ্মিনী, শঙ্খিনী নারীরা এইসব জঙ্গলে বৃক্ষীভূত হয়ে আছে যে, যদি কেউ তেমন করে চেয়ে দেখেন, তাহলেই তাঁর চোখে পড়বে।
পরেশনাথ আর বুলকি অতসব বোঝে না। অতসব বোঝার বয়সও হয়নি ওদের। জঙ্গলই ওদের বাড়িঘর। তবুও জঙ্গল কখনওই একঘেয়ে লাগে না ওদের চোখে। প্রতি ঋতুতে প্রকৃতি ওদের জন্যে নতুন সাজে সেজে আসেন। যদিও খিদের জ্বালায় আর কান্দাগেঁঠী খুঁড়ে খেতে খেতে ওদের সৌন্দর্যবোধ ভোঁতা হয়ে যাবে হয়তো ধীরে ধীরে একদিন, কিন্তু ওরা যেহেতু এখনও শিশু ও কিশোর, ওদের চোখ এখনও অনাবিল আছে। তাই এখনও সৌন্দর্য ওদের মনকে ঝরঝর্ করে নাড়া দেয়, শরতের হাওয়ায় আমলকী গাছের পাতার মতন।
হঠাৎ, পরেশনাথ চমকে দাঁড়াল, একাট চিতাবাঘ শীতের রোদের ঝলমল্ করা তার হলুদ-কালোয় জমকালো চামড়ার জামদানি শাল গায়ে, মাঠের সোনারঙা ঘাসে ঢেউ তুলে কোথায় যেন চলছে চুপিসারে। ওদের দেখে একবার চোখ তুলে তাকিয়েই নিজের পথে চলতে লাগলো বাঘটা। বুলকির হাতে ধরা পরেশনাথের ছোট্ট হাতের পাতা ঘেমে উঠলো উত্তেজনায়। একটু পরই একদল ছোট-বড় মাদী শম্বর ঢাংক্ ঢাংক্ করে ডাকতে ডাকতে জঙ্গলের ঝরে-পড়া শুকনো পাতায় তাদের খুরে খুরে মচমচানি তুলে ডানদিকের পাহাড়ের কচি-শালের জঙ্গলের ভিতর দিয়ে তাদের কালচে-লাল শরীর নিয়ে দৌড়ে গেলো। দুটো ময়ূর এই আলোড়নে ভয় পেয়ে কেঁয়া কেঁয়া রবে ভারী ডানায় ভরভর্ শব্দ তুলে উড়ে গেল পাহাড়ের গভীরে। তাদের নীলচে-সবুজ ডানায় লাল রোদকে চমকে দিয়ে। আমলকীর গাছ খুঁজে খুঁজে বুলকি আর পরেশনাথ একটা টিলার ওপর উঠে এল। ফলাভারাবনত আমলকী গাছে ছেয়ে আছে টিলাটা। চিতল হরিণের একটা দল একটু আগেই চরছিল এই টিলাতে; আধকামড়ানো আমলকীতে ছেয়ে আছে জায়গাটা আর ওদের নাদি আর খুরের দাগে। চিতাটা নিশ্চয়ই এই চিতল হরিণের দলের পিছনেই গেছে চুপিসারে। এখানে আলোর বুকের মধ্যেই কালো। জীবনের উষ্ণতার একেবারে আলোকিত অন্তস্তলে অন্ধকার। মৃত্যুর শৈত্য।
টিলার ওপরে উঠেই পরেশনাথ অবাক হয়ে গেল। সামনে যতদূর চোখ যায় জঙ্গলের সবুজ গড়িয়ে গিয়ে মিশেছে আকাশের নীলে। একটা পাহাড়ী নদীর সাদারেখা দেখা যাচ্ছে দূরে। কত মাইল দূরে, তা কে জানে। আজান্, সুন-সান্নাটা নদী।
পরেশনাথ বলল, গড়িয়ে গিয়ে এই জঙ্গল কোথায় থেমেছে রে দিদি?
বাড়কাকানা, করনপুরা, পান্নুয়ান্না টাঁড়ের দিকে। বিজ্ঞের মতো উত্তর দিল বুলকি। আসলে ও-ও জানে না। বড়দের মুখে শোনা কতগুলো অসংলগ্ন নাম বলে গেল শুধু পরপর। তার ছোটভাই পরেশনাথের কাছে ও হারতে চায় না। সে যে দিদি!
বুলকি নিচে দাঁড়াল, পরেশনাথ গাছে উঠে ডাল ঝাঁকাতে লাগল। পরেশনাথকে হনুমান বলে ভুল করে দূর থেকে হনুমানের দল হুপ্-হাপ্ করে ডেকে উঠল। টপাটপ্ করে আমলকী ঝরতে লাগল নিচে। বুলকি কুড়িয়ে কুড়িয়ে ঝুড়ি ভরতে লাগল।
এমন সময় পরেশনাথ হঠাৎ চিৎকার করে উঠল দিদি! দিদি!
পরেশনাথের ভয়ার্ত স্বরে চমকে উঠে বুলকি চকিতে চারধার দেখে নিল বাঘ কি বুনো কুকুরের দল কি হাতি এসেছে ভেবে। কিন্তু নাঃ! কোথাও কিছু নেই। চারদিকের জঙ্গল যেমন অচঞ্চল, নিথর, তেমনই আছে। বুলকি মুখ তুলে ওপরে পরেশনাথের দিকে তাকাল। পরেশনাথ আতঙ্কিত গলায় বুলকির দৃষ্টি আকর্ষণ করে গাছের ওপরের দিকে আঙুল তুলে বলল, তিতলি। দিদি, লাল-তিতলি। বুলকি দেখল, একটা বড় লাল-প্রজাপতি আমলকী গাছের মাথার কাছে উড়ছে আর বসছে। পশ্চিমের রোদ পাখায় পড়াতে তার লাল রঙটাকে এতই লাল দেখাচ্ছে যে, তার দিকে তাকানো যাচ্ছে না। ওটাকে তিতলি বলে বোঝাও যাচ্ছে না। অবাক হয়ে তিতলি দেখল যে, পরেশনাথের হাত আলগা হয়ে আসছে গাছ থেকে। মুহূর্তের মধ্যে পরেশনাথ সড় সড় করে ডাল বেয়ে নেমে আসতে লাগল, তারপর যখন মাটি থেকে হাত ছয়েক উপরে তখন পরেশনাথের পাও আলগা হয়ে গেল, ধুপ্ করে পরেশনাথ নিচে পড়ে গেল—পাথুরে জমিতে। পড়েই, মাঈরে! বলে, অজ্ঞান হয়ে গেল।
বুলকি ওর কোলে পরেশনাথের মাথাটা নিয়ে অনেকবার ডাকল, ভাইয়া ভাইয়া বলে। নাম ধরে ও বারবার ডাকল, পরেশনাথ, পরেশনাথ। কিন্তু পরেশনাথ সাড়া দিল না। চোখ খুলল না। কী করবে ভেবে পেল না বুলকি। এই জঙ্গলে কোথাও জলও নেই একটু যে, চোখে-মুখে দেবে। ওর সাধ্য নেই যে একা ও পরেশনাথকে ধরে জঙ্গলের বাইরে নিয়ে যায়। ওরা প্রায় এক ক্রোশ চলে এসেছে কুঁচফল, কাকড় আর আমলকী খুঁজতে খুঁজতে গভীর জঙ্গলে। বুলকি আবার ডাকল ভাইয়া, ভাইয়ারে-এ-এ-এ। পরেশনাথ তবুও নিরুত্তর; নিস্পন্দ।
ওপরে তাকিয়ে বুলকি দেখলো যে, সেই লাল তিতলিটা আমলকী গাছ ছেড়ে ওদের একেবারে মাথার ওপরে উড়ছে। ওপরে উঠছে; নিচে নামছে।
ঠিক এমন সময় নিস্তব্ধ বনের মধ্যে কোনো মানুষের পায়ের শব্দ শুনলো বুলকি। টিলার নিচের আঁকাবাঁকা বনপথে। সেদিকে এক দৃষ্টে চেয়ে রইল ও। এদিকে বস্তির কেউই আসে না। এলে, একমাত্র আসে ফরেস্ট গার্ডরা। আমলকীর ঝুড়িসুদ্ধু ফরেস্ট গার্ডের সামনে পড়লে এই নিয়ে নতুন ঝামেলা বাধাবে ওরা, বুলকি তা জানে। সব আমলকী—এমনকী ঝুড়িটা দিয়েও হয়তো নিষ্কৃতি মিলবে না বুলকির। ভাগ্যিস্ বুলকি এখনও ছোট আছে। বুলকির বয়স তেরো হয়ে গেলেই আর মুঞ্জরী বুলকিকে একা একা জঙ্গলে আসতে দেবে না কখনও। এখনও বুলকি তা জানে না। ঋতুস্নাতা মেয়েদের অনেক ভয়, অনেক রকম ভয়, এই নিথর নির্জন বনে। সে সব ভয়, বাঘের ভয়ের চেয়েও বেশি ভয়াবহ। বনে-পাহাড়ের অসহায় সহায়-সম্বলহীন মেয়েদের যে কতজনকে খাজনা দিতে হয়, কোনোরকম বাজনা ছাড়াই, তা এসব অঞ্চলের যে-কোনো যুবতী ও একসময়কার যুবতী মেয়ে মাত্রই জানে। যৌবনের ফুল বনফুলের মতোই বিনাআড়ম্বরে দলিত হয় বনপথে, বিনা প্রতিবাদে।
ভয় মিশ্রিত কৌতূহলের সঙ্গে অপাপবিদ্ধা বালিকা বুলকি চেয়ে রইল পথের দিকে, আগন্তুককে দেখবে বলে। হঠাৎই বাঁকের মাথায় বুলকি দেখতে পেলো কাড়ুয়াকে। এক হাতে তার তির ধনুক, অন্য হাতে দুটো পাটকিলে-রঙা বড় খরগোশকে কান ধরে ঝুলিয়ে নিয়ে আসছে কাড়ুয়া চাচা।
টিলার উপরে বসে-থাকা বুলকিদের দেখতে পায়নি কাড়ুয়া। বুলকির গলার স্বরও নিশ্চয়ই শোনেনি। শুনলে তার আসার ধরনে বুঝতে পারত ও। বুলকির ধড়ে প্রাণ এল। জোরে ডাকলো, চাচা, এ কাড়ুয়া চাচা।
মানুষের গলা পেয়েই কাড়ুয়া অভেস বশে মুহূর্তের মধ্যে সরে গেল জঙ্গলের আড়ালে। তারপর আড়াল থেকে বোধ হয় ভালো করে দেখে নিয়ে আবার বেরিয়ে এল। তারপর খরগোশ দুটো আর তির ধনুক জঙ্গলের আড়ালে লুকিয়ে রেখে দৌড়ে এল টিলার ওপরে।
বলল, কা বাত? কা রে বুলকিয়া?
বুলকি সব বলল।
কোথায় লাল তিতলি? বলেই কাড়ুয়া সেই লাল প্রজাপতিটাকে খুঁজতে লাগল। কিন্তু কোথাওই আর তাকে দেখা গেল না। কোনো মন্ত্রবলে তৃতীয় মানুষের আগমনে তিতলিটা যেন অদৃশ্য হয়ে গেছে। চারধারে অনেকখানি ফাঁকা জায়গা। তিতলিটা সরে গেলেও তাকে দেখতে পাওয়ার কথা ছিল।
বুলকির গা ছম্ছম্ করে উঠল। ভয়ে হাত পা অবশ হয়ে এল।
কাড়ুয়া পরেশনাথের পাশে হাঁটু গেড়ে বসে ওকে ঝাড়ফুঁক্ করতে লাগল। ওর হাতে হাত ঘষল। দৌড়ে গিয়ে ধনুকটাকে নিয়ে ধনুকের ছিলা শোঁকাল তাকে। বেশ কিছুক্ষণ পর পরেশনাথ চোখ খুলল। চোখ খুলেই, ভয়ে আবার চোখ বন্ধ করে ফেলল। কাড়ুয়া পরেশনাথকে তুলে বসালো। পরেশনাথ চোখ বুজেই বলল, তিতলি! ভয়ে ওর মুখ তখনো নীল হয়ে ছিল। কাড়ুয়া বলল, ভয় কীরে পরেশনাথ? আমাকে এ বনের বাঘে-হাতিতেও ভয় পায়, আমি থাকতে তিতলি কী করবে তোকে? পরেশনাথ বারবার মাথা নাড়ছিলো। জড়ানো গলায় বলেছিলো, দেওতার ভর আছে। ওটা এমনি তিতলি নয়। বহত খতরনাগ্। আমার মওত্ বয়ে আনবে ও। আমি স্বপ্ন দেখেছি। আরেক দিনও এসেছিল এই তিতলিটা সেদিন। বাঁশবাবু বাঁচিয়েছিলো আমাকে। সেবার আমাকে জলে ডুবিয়ে মারছিলো ও। আর আজকে গাছ থেকে ফেলে দিলো। শিউরে উঠে পরেশনাথ বলল, আমি আর কখনও জঙ্গলে আসবো না। কখনও না।
কাড়ুয়া বলল, পাগলামি করিস না। জংলি লোক আমরা, জঙ্গলই আমাদের জীবন, মা-বাপ। জঙ্গলে না এলে বাঁচবি কী করে? খাবি কী? তোর মন থেকে এই সব ভুল ভাবনা ঝেড়ে ফেল্। আমি ত একা একা রাতবিরেতে বনে জঙ্গলে ঘু’র বেড়াই। ক্রোশের পর ক্রোশ। কই কখনও তো আমি ভয়ের কিছু দেখিনি। যেখানে যেখানে ভয় আছে সেসব জায়গাই আমি জানি। সেদিকে যাইই-না। কিন্তু এখানে ভয়ের কী? ফাক জঙ্গল। গাঁয়ের এক ক্রোশের মধ্যে। এ জঙ্গলে দেওতা কি দার্হা কেউ নেই। জিন্-পরীরাও নেই। জিন্-পরীরা চাঁদনি রাতে কোথায় খেলা করে আমি জানি। তাদের আমি খেলতেও দেখেছি হোলির রাতে। তুই মিথ্যাই ভয় পাচ্ছিস। চল্ চল্ এবার তো হাঁটতে পারবি, যেতে পারবি তোরা একলা? আমলকীর ঝুড়ি এখানেই ফেলে রেখে যা না-হয়. আমি কাল পৌঁছে দেব তোদের বাড়িতে। নয়ত আজ রাতেই। তারপর হঠাৎ কাড়ুয়া রুক্ষ গলায় বলল, আর দ্যাখ্। কান খুলে শোন্, তোরা। আমার সঙ্গে দেখা হয়েছে তোদের আর আমার হাতে কী ছিল, তা যেন কেউই না জানে। তোদের বাবা মাও নয়। কেউ জানলে, বলেই, একটু চুপ করে থেকে ওদের দিকে একটা ভীষণ ভয়সূচক মুখভঙ্গি করে বলল, খুবই খারাপ হয়ে যাবে। মনে থাকে যেন। লাল-তিতলির চেয়েও ভয়ংকর আমি। বুঝেছিস্।
বুলকির হৃৎপিণ্ড স্তব্ধ হয়ে গেল। মাথা নেড়ে জানালো, বুঝেছে।
পরেশনাথ মুখে কিছু বলল না। বিস্ফারিত চোখের ভাষায় জানালো যে, সেও বুঝেছে।
পরেশনাথ বুলকির হাত ধরে ধীরে ধীরে ফিরে চলল সুঁড়িপথে তাদের বাড়ির দিকে।
কাড়ুয়া যে চোরা শিকার করে তা গ্রামের সকলেই জানে। দিনে তির ধনুক নিয়ে বেরোয়, যাতে শব্দ না শোনে কেউ। রাতে যায় বড় শিকারের খোঁজে খোঁজে টুপি পরানো গাদা বন্দুক হাতে নিয়ে, হুম্মকে বারুদ গেদে তাতে; দূর দূর গহীন জঙ্গলে, যাতে সেখান থেকে শব্দ না-ভেসে আসে ভালুমারে বা, অন্য কোনো বস্তিতেও।
কাড়ুয়া জানে যে, চুরি বিদ্যা বড় বিদ্যা যদি না পড়ে ধরা। হাতে-নাতে কেউ কখনও ধরতে পারেনি আজ অবধি কাড়ুয়াকে। যেদিন কোনো ফরেস্ট-গার্ড বা অফিসারের সঙ্গে মুখোমুখি হয়ে যাবে কাড়ুয়ার, সেদিন কাড়ুয়া যে মাথা নীচু করে হাতকড়া পরবে না একথাও ভালুমার বস্তির সকলে জানে। সে রক্ত কাড়ুয়ার নয়। কাড়ুয়া চাচা মানুষটা এমনিতে নম্র, বিনয়ী, নির্বিরোধী। কিন্তু মনে প্রাণে ও বড় স্বাধীন, বেসামাল; বেপরোয়া। মাথা সে একমাত্র নোয়াতে পারে এই বন-জঙ্গলেরই কাছে। কোনো মানুষের কাছে নয়। তাই এত কাড়াকাড়ি, এত ভয় সত্ত্বেও ও বন্দুকে বা তির ধনুককে ছাড়েনি।
বুলকির বাবা মানিয়া বলে, আমরা নেশা করি মহুয়ার। আর কাড়ুয়ার একটাই নেশা। বারুদের গন্ধের নেশা। ফোটা-বন্দুকের বারুদের গন্ধেই ও একমাত্র বুঁদ হয়ে থাকে তাই অন্য কোনো নেশাই পেতে পারেনি ওকে। কাড়ুয়া চাচা জেলে যাবার আগে যারা জেলে পুরতে যাবে ওকে, তাদেরই মেরে দেবে চাচা, নইলে নিজেকেই মেরে ফেলবে। কাড়ুয়া চাচার লাশকে বন্দি করা গেলেও যেতে পারে, কিন্তু কাড়ুয়া চাচাকে কেউ হাত-কড়া পরাতে পারবে না এ কথা ভালুমার বস্তির ছেলেবুড়ো যেমন জানে; ফরেস্ট-গার্ডরাও জানে। তাই কাড়ুয়ার গতিবিধি সম্বন্ধে আন্দাজ করতে পারলেও ওকে কেউই ঘাঁটায় না। বরং ও যে পথে গেছে বলে জানতে পায় তারা, সেই পথ এড়িয়েই চলে। এ বনে বাঘ অনেক : কিন্তু কাড়ুয়ার মতো বাঘ একটাও নেই।
জঙ্গল থেকে বেরোতে বেরোতেই সূর্য পশ্চিমে হেলে এল। বুলকি আর পরেশনাথ যখন ওদের বাড়ির কাছে পৌঁছল তখন সন্ধের আর দেরি নেই। পিঠছেঁড়া নীল ফ্রকটাতে শীত যেন ছুঁচের মতো বিঁধছে। পরেশনাথকে লাল-তিতলির ভয়টা তখনও আচ্ছন্ন করে ছিল। শীতের বোধ তার ছিল না। বেহুঁশ হয়ে পথ চলছিলো সে।
হঠাৎ বুলকি ও পরেশনাথ লক্ষ করল যে, ওদের ঘরের সামনে চার-পাঁচজন লোক দাঁড়িয়ে আছে। তাদের মধ্যে দূর থেকেই মাহাতোকে চিনতে পারল বুলকি। লম্বা লোকটা। দামি গরম পাঞ্জাবি পরে দাঁড়িয়ে আছে ওদের দিকে ফিরে। পরেশনাথ বুলকির ফ্রক ধরে দাঁড়িয়ে পড়ল। যেন বাড়ি যাবার ইচ্ছা নেই ওর।
বুলকি শক্ত করে ওর হাত ধরল। এই আচ্ছন্ন অবস্থায় আসন্ন রাতের অনিশ্চয়তায় ছোট্ট ভাইকে একা ছাড়বার সাহস নেই আর বুলকির। এমনিতেই দেরি হয়েছে বলে মায়ের কাছে নির্ঘাৎ মার খাবে আজ! তাড়াতাড়ি করার জন্যে পরেশনাথের হাত ধরে বুলকি আবার সরগুজা ক্ষেতের মধ্যে দিয়ে শর্টকার্ট করল।
সঙ্গে সঙ্গে মুঞ্জরী চেঁচিয়ে উঠল।
আসলে মুণ্ড্রী ভাবল, মা ওদের বকছে আবারও ক্ষেতের মধ্যে দিয়ে ওরা আসছে বলে। বুলকি আর ঘোরে-থাকা পরেশনাথ ওদের বাড়ির সামনে এসে পৌঁছতেই সঙ্গে সঙ্গে মাহাতো তার একজন অনুচরকে বলল, ধর ও ছোক্রাকে।
একটা তাগড়া লোক এসে পরেশনাথকে ধরল।
লোকটা বলল, বল্ তুই? কোথায় রেখেছিস টর্চটা।
মানিয়া কিছুই বলছে না দেখে, বুলকি অবাক হয়ে তাকাল তার বাবার দিকে। তাকিয়ে দেখল, বাবার নাক-মুখ মারের চোটে ফুলে গেছে। ঠোটের কষ বেয়ে রক্ত গড়াচ্ছে। কেবল তার মা মুঞ্জরী চোখে আগুন নিয়ে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে মাহাতোর মুখের দিকে চেয়ে।
মাহাতো বলল পরেশনাথকে, অ্যাই ছোঁড়া সেদিন হাটে যখন আমি উবু হয়ে বসেছিলাম কাপড়ের দোকানে তখন তুই আমার পকেট থেকে টর্চটা চুরি করেছিলি। কোথায় রেখেছিস বল্?
পরেশনাথ বলল, আমি, আমি….।
লোকটা ঠাস্ করে প্রচণ্ড এক চড় লাগাল পরেশনাথকে।
অন্য একটা লোক বলল, আমি তোকে নিতে দেখেছি টর্চটা। ছোট্ট লাল প্লাস্টিকের টর্চ তুই মাহাতোর পকেট থেকে তুলে নিনি?
মুঞ্জরী বলল, ছেলের বাপকে তো’ তোমরা অনেকই মারলে ছেলের অপরাধে, অতটুকু ছেলেকে আর কেন? ছেড়ে দাও। চুরি যে করেছে ও, তার প্রমাণ কী? চুরি করা জিনিস কি তোমরা পেয়েছো? মিথ্যা অপরাধ দিয়ে কী হবে? এতটুকু একটা ছেলে!
মাহাতো ঘুরে দাঁড়িয়ে মুঞ্জরীকে একটা অশ্লীল গাল দিয়ে লোকগুলোকে বলল, অ্যাই। তোরা যা তো ঘরের মধ্যে। খুঁজে দ্যাখ্ সব জিনিসপত্র। কোথায় লুকিয়ে রেখেছে টর্চটাকে? বের কর। তারপর দেখছি আমি বিচ্ছুর বাচ্চাকে।
মাহাতোর কথা শেষ হতে না হতেই লোকগুলো মানি ও মুঞ্জরীকে কিছু না বলেই ঘরের ভিতরে ঢুকে জিনিসপত্র তছনছ করে সেই ছোট্ট কল্পনার টর্চটা খুঁজতে লাগল। হাঁড়ি-কুড়ি, টিনের তোরঙ্গ, কাঁথা-বালিশ, সব লাথি মেরে, লাঠির বাড়ি মেরে ছত্রখান্ করে দিল। পরেশনাথের সম্পত্তি বলতে একটা মরচে-পড়া টিন ছিল ডালডার। টিনের উপর হলুদ-সবুজে লেখা ‘ডালডা’ নামটাও উঠে গেছে। একটা লোক সেই টিনটা উপুড় করে ঢাললো মেঝেতে। ঢালতেই দুটো কাচের মারবেল, টিনের বাঁশি, একটা ব্লেড, দু-টুকরো হয়ে-যাওয়া একটা চামড়ার বেল্ট, টুকিটাকি, বড়দের কাছে মূল্যহীন কিন্তু পরেশনাথের মতো একটি শিশুর কাছে মহামূল্যবান নানা জিনিস এবং একটা লাল রবারের বলের সঙ্গে….
বুলকি অবিশ্বাসের চোখে তাকিয়ে দেখল, একটা লাল ছোট্ট প্লাস্টিকের টর্চ। ওরা হৈ হৈ করে বাইরে এসে মাহাতোকে বলল, এইটা? এইটা আপনার টর্চ? মাহাতোর চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বলল, হ্যাঁ! এইই তো! কোথায় ছিল? লোকটা বলল, ঐ ছোকরার সম্পত্তির মধ্যে। ডালডার টিনের মধ্যে।
মাহাতো দাঁতে দাঁত চেপে বলল, ছোকরাকে বাঁধ ঐ আমগাছের সঙ্গে।
মুঞ্জরী, মানি ও বুলকিও পরেশনাথের সম্পত্তির মধ্যে ঐ টর্চটি দেখে বড় আশ্চর্য হয়ে গেছিল। প্রথমটা বোকা বনে চুপ করে ছিল, ওরা সকলে।
মুঞ্জরী বলল, চোর যখন ধরা পড়েছে তখন কোতায়ালিতে নিয়ে যাও; পুলিশে দাও। তুমি নিজেই কি কাজি? দেশে কি আইন নেই? চোরের যা শাস্তি তাই-ই পাবে ও! জেলে দাও ওকে। তারপর কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, তোমার পায়ে পড়ি, পায়ে পড়ি; অতটুকু ছেলেকে মেরো না।
কেন? তোদের নানকু মহারাজ সেদিন বলল না, পুরুষ মানুষ কোতায়ালিতে যায় না, নিজের ফয়সালা নিজেই করে। টর্চ চুরির জন্যে থানা-পুলিশ করবার সময় নেই আমার। বিচার যা করার আমিই করছি, করব এক্ষুণি। আমিই কাজি! তোরা সব শুনে রাখ। ভালুমারের কাজি এখনও আমিই।
মাহাতো পাঞ্জাবির পকেট থেকে একটা কালো রঙের লম্বা চাবুক বের করল। বুলকি জানে না ওটা দিয়েই তার বাবাকেও মেরেছিল কি-না ওরা। সপাং করে চাবুক পড়ল পরেশনাথের মুখে। পরেশনাথকে পিছমোড়া করে বুলকিদেরই গাই-বলদ বাঁধা দড়ি দিয়ে আমগাছে বেঁধেছিল ওরা। মা! মাঈ… বলে, চিৎকার করে উঠল ন’বছরের পরেশনাথ। বুলকি দৌড়ে গিয়ে পরেশনাথকে জড়িয়ে ধরল। ওদের বলতে লাগল, এই যে শোনো, ভাইয়া অজ্ঞান হয়ে গেছিল, অজ্ঞান হয়ে গেছিল একটু আগে। শোনো।
সপাং করে চাবুক পড়ল বুলকির পিঠেও। পিঠ-ছেঁড়া নীল ফ্রকটার ফাঁকে পিঠের উপরে সঙ্গে সঙ্গে কাঁকড়া বিছের মতো লাল হয়ে ফুটে উঠল চাবুকের দাগ। বাবাঃ, বলেই, বুলকি ছিটকে সরে এলো।
মানুষ নিজেকেই সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে। বড় আদরের ছোট্ট ভাইয়ের চেয়েও প্রত্যেক মমতাময়ী দিদিও নিজেকে বেশি ভালোবাসে। এমন এমন মুহূর্তে সেই সত্যটা ঝিলিক্ মেরে ওঠে। বুলকি এ কথাটা বুঝতে পেরে স্তম্ভিত হয়ে রইল। টুসিয়া যেমন সেদিন জেনেছিল রাতের বাংলোর ঘরে, চক্চকে রিভলবারের মুখোমুখি হয়ে যে, তার নিজের প্রাণকে সে তার ইজ্জত বা সম্ভ্রমের চেয়েও অনেকবেশি ভালোবাসে। তেমনি করেই জানল বুলকি। একটা অন্য জানা। মস্ত জানা।
চাবুকের পর চাবুক পড়তে লাগল ছোট্ট পরেশনাথের বুকে, মাথায়, মুখে। প্রতি চাবুকের ঘা দূরে দাঁড়ানো মুঞ্জরীর মুখেও পড়তে লাগল দু-ফণা সাপের মতো। এক ফণা ছোবল মারছিল শিশু ছেলের যন্ত্রণার শরিক হয়ে মুঞ্জুীকে। আর চাবুকের অন্য ফণা জর্জরিত করেছিল একটি চোরের মায়ের গ্লানিকে। পরেশনাথ এখন আর কোনো শব্দ করছে না। মাথাটা বুকের উপর ঝুলে পড়েছে। নড়ছেও না। বোধহয় মরে গেছে। বুলকি এক অদ্ভুত বোবা ধরা ঘড়ঘড়ে চাপা কান্না কেঁদে যাচ্ছিল। মানির চোখে জল ছিল না। হতভাগা, অযোগ্য, মরদহীন বাপ তার শিশুর দিকে এক দৃষ্টে চেয়ে বসেছিল! মুঞ্জরী দাঁড়িয়েছিল ঠোট কামড়ে। দুচোখ বেয়ে জলের ধারা নেমে তাকে অন্ধ করে দিয়েছিল। মুঞ্জরী অন্ধ হতেই চেয়েছিল, বধির হতেও; সেই মুহূর্তে।
অন্ধকারে একসময় চাবুকের শব্দ থামলে, চাবুকটাকে পকেটে পুরে মাহাতো বলল, আমি চললাম রে মানি। তোদের মুরব্বী নানকুয়া এলে বলিস যে, আমি এসেছিলাম। চোরের যা শাস্তি, তাই দিয়ে গেলাম। এগোতে গিয়ে থেমে দাঁড়িয়ে বুলকির সামনেই বলল, তোদের নানকুয়ার মার সঙ্গে আমি শুয়েছি বহুবার। রাণ্ডির ছেলেকে ভয় পাবার মতো মরদ মাহাতো নয়। ঐ রাণ্ডির বাচ্চাকেও একবার কায়দা মতো পেলে কী দশা করব তখন বুঝবে ও। তোদের সামনেই করব। আমার পা ছুঁইয়ে ক্ষমা চাওয়াব। নইলে এই বস্তি, এই জমিজমা, সব ছেড়ে-ছুড়ে চলে যাব আমি। ও ওতো চোর। তোরা সব চোর। তোরা সব বেইমান, নিমকহারাম; বজ্জাত। তোরা এই বস্তির গরিব মাত্রই চোর।
পরেশনাথের জ্ঞান এসেছিল মাঝরাতে। একবার চোখ খুলেই বলেছিল, দিদি! দিদি! মা! তিতলি। লাল— তিতলি আশ্চর্য। প্লাস্টিকের টর্চটার রঙও লাল ছিল। তিতলিটার মতন। আয়তনও তিতলিটারই মতো। অবাক হয়ে ভাবছিল বুলকি। টর্চটা কখন চুরি করল পরেশনাথ? আর কেনই বা চুরি করল? চুরি যে করেছে তাতে তো কোনোই সন্দেহ নেই, নইলে সেটা ওর টিনের মধ্যে এলোই বা কী করে? বুলকি ভাবছিল শুয়ে শুয়ে। বাইরে শিশির পড়ছিল ফিস্ ফিস্ করে।
ওরা গরিব, বড়ই গরিব, কিন্তু কেউ কখনও ওদের চোর বলতে পারেনি। মাহাতো আর মাহাতোর লোকজন কাল সকালেই সারা বস্তিতে একথা ফলাও করে বলবে। কাল থেকে বস্তিসুদ্ধু লোক ওদের চোর বলবে। ওর বাবাকে বলবে চোর—পরেশনাথের বাপ। ওকে বলবে চোরের দিদি। ছিঃ! ছিঃ! ভাইয়া।
মানি বাঁশবাবুর কাছে দুধ দিতে গেছিল অনেক রাত করে সেদিন। বাঁশবাবু ছিল না। তিতলি সব শুনে দাওয়াই দিয়েছিল অনেক রকম। সেগুলো লাগাচ্ছে মা আর মাঝে মাঝেই ঝুঁকে পড়ে পরেশনাথকে দেখছে। মুখটা ফুলে ফেটে বীভৎস হয়ে গেছে পরেশনাথের। চেনা যাচ্ছে না ওকে। বাবাকেও ওষুধ লাগিয়ে দিয়েছে বুলকি। ভাইয়াকে ও কি চিনত? ভাইয়া যে চোর তা কি ও জানতো আগে? ভাইয়া কি মরে যাবে? বেঁচে উঠবে তো এত মার খেয়েও? একথা মনে হতেই বুলকির চোখ জলে ভরে গেল। চোর হোক, কী ডাকাতই হোক, তার ভাইয়া যেন বেঁচে থাকে চিরদিন। ভাবল বুলকি। ভাইয়া না থাকলে, সেও বাঁচবে না।
সন্ধের পরে কাড়ুয়া চাচা এসেছিল আমলকীর ঝুড়িটি নিয়ে। কাড়ুয়া চাচা অন্ধকারে বিনা-আলোতে জংলি জানোয়ারের মতো চলাফেরা করে। বাঘের মতোই। যখন একেবারে কাছে চলে আসে, তখনই বোঝা যায় যে সে এসেছে! কাড়ুয়া চুপ করে দাঁড়িয়ে সব শুনল। মানিয়া কাঁদতে কাঁদতে সব বলছিল ওকে। মানিয়ার খুব যন্ত্রণা হয়েছিল। কিন্তু যেই পরেশনাথকে ওরা এইভাবে বেঁধে মারল অমনি ওর নিজের শারীরিক ব্যথার বোধ সবই ওকে ছেড়ে চলে গেল। পরেশনাথের জন্যে একটা তীব্র ব্যথা অনুভব করছে সে বুকের মধ্যে। সেটা মনের ব্যথা। কোনো শারীরিক ব্যথাই সে-ব্যথার মতো যন্ত্রণাদায়ক নয়।
কাড়ুয়া প্রশ্ন করল, মাহাতো নিজেই মারল পরেশনাথকে?
হ্যাঁ।
সঙ্গে আর কারা ছিল?
নাম জানি না। মনে হল ওরা অন্য বস্তির লোক। একজন বোধহয় গাড়ু বস্তির। খুন-খারাপি করে। হাটে দেখেছি কখনও সখনও। ওরা ভালুমারের নয়।
অন্ধকারে কাড়ুয়ার চোখ দুটো বাঘের মতো জ্বল জ্বল করছিল। কাড়ুয়া পুঙ্খানু-পুঙ্খভাবে চেহারা পোশাক ইত্যাদির কথা জিগগেস করছিল। মানিয়া বলল, আর কিছু জানি না কাড়ুয়া ভাইয়া। আমার কিছু আর মনে পড়ছে না। নানকুকে একটা খবর পাঠাতে পারো? ও যেন বস্তিতে না আসে। ওর খুব বিপদ। খুবই বিপদ ওর। আসলে মাহাতো যা করল আমাদের উপর তা নানকুকে শেখানোর জন্যেই। আমার মনে হচ্ছে, নানকুকে ওরা শেষ করে দেবে।
শেষ করে দেবে? নানকুকে?
তারপরই, যে-কথা কাড়ুয়া কোনোদিনও বলেনি কাউকে, কখনও সেই মুহূর্তের আগে এমন করে ভাবেওনি হয়তো, সেই কথাই বলে ফেলল হঠাৎ মানিয়াকে। বলল, নানকুকে মেরে ফেললেই নানকু মরবে না। নানকু কোনো একটা লোক নয়। নানকুর রক্ত ঝরালে সেই রক্তের বীজ থেকে এমন অনেক লোক লাফিয়ে উঠবে। একসময় নানকুয়া একা ছিল। আজ আর নেই।
মানিয়া ভয় পেয়ে বলল, তুমি কি মাহাতোকে গুলি করে মারতে চললে নাকি?
কাড়ুয়া খুব জোরে হাসল। এত জোরে কখনও হাসে না।
হাসতে হাসতে বলল, আমি যেদিন বন্দুক হাতে নেবো সেদিন মাহাতো তার মায়ের গর্ভে গিয়ে ঢুকলেও বাঁচবে না। জানো মানিয়া ভাইয়া, গুলি খেয়ে মরে যারা তারা হয় বড় বড় প্রাণ, নয় বড় বড় প্রাণী। বাঘের মতো! মাহাতোর কপালে অত মহান মওত্ নেই। আমার বন্দুক তো ইন্দুর-ছুঁচো মারার জন্য নয়। একটু থেমে বলল, তুমি নিশ্চিন্তে ঘুমোও। আর কাল সকালে উঠেই পাগলা সাহেবকে ঘটনার কথা জানিয়ে এসো। চলে যাবার সময়, দাঁড়িয়ে পড়ে কাড়ুয়া বলল, আর শোনো! আমি যে আজ এসেছিলাম, তোমার সঙ্গে যে আমার কথা হয়েছে এ বিষয়ে সে-কথা যেন কেউ ঘুণাক্ষরেও না জানে। তোমার বৌ ছেলেমেয়েকও বলে দেবে। একজনও যদি জানতে পারে, তাহলে খারাপ হয়ে যাবে।
কাড়ুয়ার চোখ দুটো আবারও জ্বলে উঠল অন্ধকারে জ্বল জ্বল করে।
মানিয়া ভয় পেয়ে বলল, আচ্ছা।
“খারাপ হয়ে যাবে” কথাটা এমন ভাবে বলল কাড়ুয়া যে, মার পাশে শুয়ে বুলকি ভয়ে কেঁপে উঠল।
মানিয়া ভাবছিল, অনেক খারাপই তো ইতিমধ্যে হয়েছে মানিয়ার। আরও খারাপের কথা ভাবার মনের জোর আর নেই।