২২
গজেনবাবু সেদিন যাওয়ার সময় অতর্কিতে প্রশ্ন করলেন, কী মশায়? আপনার ডাল গলল?
মানে?
অবাক হয়ে জিগেস করেছিলাম।
কলকাতা থেকে ডাল এলো, ডালটনগঞ্জ থেকে এত মোরগা-আন্ডা সঙ্গে নিয়ে, সব কি বরবাদ হল? ডাল গলাতে পারলেন, কি পারলেন না?
আমি হেসে ফেলেছিলাম।
বলেছিলাম, জানি না।
জানি না মানে? এখনও খবর পান নি? তাহলে, কেস্ গড়বড়। ডাল গলার থাকলে, সে কলকাতায় পৌঁছেই বালিশে উপুড় হয়ে শুয়ে নীল প্যাডে খস্ আতর মাখিয়ে এতক্ষণে লম্বা লম্বা চিঠি লিখে ফেলত অনেকগুলো। নাঃ মশাই! আপনি যে নাম ডোবালেন। নিজে যদি নাইই গলাতে পারলেন, তো আমাদের খবর দিলেন না কেন? আমি নান্টুকে পাঠাতাম। এই পালামৌর ফরেস্ট বাংলোয় কত বিদেশি মেমসায়েব নান্টুকে দেখে প্রেমে পড়ে গেলো। আর উনি তো কলকাতারই মেমসায়েব।
সত্যিই লজ্জিত হয়ে বলেছিলাম, খুবই অন্যায় হয়ে গেছে।
ওঁরা চলে যাওয়ার পর থেকেই সেই কথাই ভাবছি। গজেনবাবু মানুষটা বড় চাঁচাছোলা। সত্যি কথা, তা যতই নির্মম সত্যি হোক না কেন, মুখের ওপর একটুও না ভেবেচিন্তে এমন করে ছুড়ে দেন যে, হজম করাও মুশকিল হয়।
আজ ট্রাকের সঙ্গে একটা বড় মোরগা পাঠিয়ে দিয়েছি গণেশ মাস্টারের জন্যে। খুব বড় মোরগা। বাপি ও বাপির মাও এখনও ওর বাড়িতেই আছেন। অন্য দু-একজনকেও খেতে বলে দিতে পারবে গণেশ। যে মোরগাটা, নানকুয়া ওর হাত ছিনিয়ে কিনে এনেছিলো সেটা খেয়ে গণেশকে একটা বড় মোরগা পাঠাবো বলে ঠিকই করে রেখেছিলাম।
নানকুয়া ছেলেটা ভালো। তার দুটো চোখ সব সময় জ্বলজ্বল করে। কী যেন জ্বলে সব সময় ওর চোখে। বেশিক্ষণ চেয়ে থাকা যায় না চোখ দুটোতে। নানকুয়ার সেই কথাটা নিয়ে গত কয়েকদিন অনেকই ভেবেছি। এ কথাটা সত্যি যে, জন্মাবার পর থেকে খিদে পাওয়া সত্ত্বেও খেতে পাইনি এমন কখনওই হয়নি জীবনে! যদিও বড়লোক কখনওই ছিলাম না। তিতলির কারণে এই বনবাসেও আমার সাধ্য নেই যে, একদিনও কিছু না খেয়ে থাকি। কপালে হাত দিয়ে জ্বর এসেছে কি আসেনি পরীক্ষা করার পর জ্বর এলেও কিছু না কিছু খেতেই হবে। তাই মাঝে দুদিন যখন হুলুক্-এর ওপরের ক্যাম্পেই কাজের চাপে থাকতে হয়েছিল, তখন ইচ্ছে করে একদিন শুধুই জল খেয়ে ছিলাম। বড়ই কষ্ট! পরদিন সকালেই ক্যাম্পের কুলীকে বলে এক থালা যবের ছাতু আনিয়ে নুন কাঁচালঙ্কা দিয়ে খেয়ে তবে বাঁচি। তিনদিন না খেয়ে থাকার কোনো প্রশ্নই ওঠেনি। একদিনেই খিদের জ্বালা কাকে বলে তা মর্মে মর্মে বুঝেছিলাম।
দেশ-টেশ, জনগণ, রাজনীতি, রাষ্ট্রনীতি এসব আমার বিষয় নয়। আমি কবিমনের মানুষ। বাঁশবাবু হয়েই বাকি জীবনটা এই উদার অসীম পরিবেশে কাটাতে পারলেই আমি খুশি। আমার দ্বারা কোনো মহৎ কর্ম হবে না। সেসব করার ইচ্ছাও নেই। তবে, কেউ নতুন কিছু ভাবছে বা করছে দেখলে ভাল লাগে।
ট্রাক বিদায় করে দিয়ে এসে গরম জলে চান করেছি ভাল করে। তিতলি ধোওয়া পাজামা ও পাঞ্জাবি এবং বাড়িতে যে আলোয়ান জড়িয়ে থাকি, তা রেখে গেছে খাটের ওপর। জামা কাপড় পরে ইজিচেয়ারে বসেছি। তিতলি চা দিয়ে গেছে।
চায়ের গ্লাসটা হাতে নিয়েই জিগগেস করলাম, কী রেঁধেছিস?
ডিমের ঝোল আর ভাত। আজ ত সারাদিন ভাত খাওয়া হয়নি।
অন্যমনস্ক গলায় বললাম, না।
কয়েকদিন হল একটু অন্যমনস্কই আছি। ছোট-মামা ছোট-মামির কাছ থেকেও কোনো চিঠি এল না দেখে, মাঝে মাঝেই বড় দুর্ভাবনায় পায় আমাকে। নিরাপদে সকলে কলকাতায় পৌঁছেছিল তো? নারাণ সিং-এর সঙ্গে পরে দেখা হয়েছিল। তার কাছ থেকে খবর পেয়েছিলাম যে, সে রাঁচিতে ভালোমতই পৌঁছে দিয়েছিল ওঁদের এবং ট্রেন ছাড়া অবধি অপেক্ষাও করেছিল। অসুখ-বিসুখ করল কি কারও? জিন-এর কিছু হল? কী জানি? এই জংলি গর্তে বসে, ভেবে ভেবে আমি আর কী করতে পারি? এমন সময় তিতলি বলল, ভেবেছিলাম আজ পোলাউ আর মাংস রান্না করব। এমন একটা ভাল দিন আজকে।
চায়ে চুমুক দিয়েই, ওর দিকে তাকালাম।
ভাল দিন মানে?
খুবই ভাল দিন। তিতলি বলল।
একটু হাসবার চেষ্টা করে বলল, চিঠি এসেছে আজ অনেকগুলো। একসঙ্গে অনেকগুলো চিঠি।
ধীরে সুস্থে চায়ের গ্লাস টেবিলে নামিয়ে রেখেই যেন উত্তেজনার কোনোই কারণ ঘটেনি এমন ভাবে বললাম, এতক্ষণ দিস নি কেন? আন্ শিগগিরি।
আমি ভীষণরকম উত্তেজিত হব আশা করেছিল নিশ্চয়ই তিতলি। ও কেমন ব্যথিত, অবাক চোখে তাকাল আমার দিকে। তারপর নিজের বুকের মধ্যে থেকে, ব্লাউজের মধ্যে রাখা চারটে চিঠি একসঙ্গেই বের করে দিল আমায়। চিঠিগুলো গরম হয়েছিল ওর বুকের উত্তাপে। তাড়াতাড়ি উল্টে-পাল্টে দেখলাম। একটি ইনস্যুরেন্সের প্রিমিয়ামের নোটিশ। অন্যটি আমার এক বন্ধু লিখেছে দিঘা থেকে। আরেকটি ভারী চিঠি। কলকাতার একটি নামী সাপ্তাহিক পত্রিকা থেকে। গল্প পাঠিয়েছিলাম সেখানে। সম্পাদক ফেরত দিয়েছেন, অতি বিনয়ের সঙ্গে। আশাতীত ভদ্রতা!
অন্য সব চিঠি ফেলে রেখে প্রথমে ছোট মামিমার খামটা খুললাম। সঙ্গে আর একটি চিঠি। মেয়েলি হাতের লেখা। অচেনা। ছোট্ট চিঠিতে ছোটমামিমা লিখেছেন,
৩০/১২
কলকাতা
স্নেহের বাবা খোকা,
কী লিখব আর কেমন করে লিখব তা ভাবতে ভাবতেই এতদিন চলে গেল। আমার ও তোর ছোটমামার লজ্জা রাখার জায়গা নেই। তোর সামনে আমরা বোধ হয় আর কখনও বড়-মুখ করে কথা বলতে পারবো না।
আজকালকার মেয়েদের আদব-কায়দা কিছুই বুঝি না। খবর তো রাখিই না। বাণী ও রণও এ ব্যাপারে বিশেষ লজ্জিত। বাণীর চিঠিও সঙ্গে পাঠালাম।
জিন্ তোকে বিশেষই পছন্দ করেছে। অথচ বলছে যে, তোকে বিয়ে সে করতে পারবে না। কেন পারবে না, সে কথার জবাবও কেউই তার কাছ থেকে বের করতে পারেনি। তোর ছোটমামা ফেরার পথে রোশনবাবুর সঙ্গেও কথা বলেছিলেন তোর বদলির ব্যাপারে। তোর ছোটমামার মনে হয়েছিল যে জংলি জায়গা বলে জিন্-এর হয়তো অমত হতে পারে এ বিয়েতে। তাতে রোশনবাবু বলেছিলেন যে, এই কারণে যদি বিয়ে বন্ধ হয়ে যায়, তবে তোকে ডালটনগঞ্জে অথবা রাঁচিতে বদলি করে আনবেন। ডালটনগঞ্জেও ভালো স্কুল আছে। বাচ্চা হলে, তার বা তাদের পড়াশুনায়ও কোনো অসুবিধে হতো না।
যাই-ই হোক। সবই কপাল। তোর মাকে কথা দিয়েছিলাম মৃত্যুশয্যায়, সেই কথা রাখা হলো না। আমার মন এতই ভেঙে গেছে যে, নতুন করে অন্যত্র যে চেষ্টা করব সেই জোরটুকুও আর পাচ্ছি না। তোর ছোটমামা জিন-এর ব্যবহারে ভীষণই রেগে গেছেন। বলেছেন, ওর সঙ্গে এ জীবনে কোনো সম্পর্কই রাখবেন না। তাঁর বর্তমান মানসিক অবস্থায় তোকে কিছু আলাদা করে লেখা সম্ভব নয় বলেই লিখছেন না।
বাবা খোকা, তুই আমাদের ক্ষমা করিস্।
ইতি—তোর ছোটমামি
সঙ্গের চিঠিটি লিখেছেন বাণী।
১৯/১২
সুচরিতেষু
আমার বিশেষ কিছু লেখার নেই।
শুধু এইটুকু বলবার জন্যেই এই চিঠি লেখা যে, আমি যদি জিন্ হতাম তাহলে এমন সৌভাগ্য থেকে নিজেকে নিশ্চয়ই বঞ্চিত করতাম না। জিন্টা বড় বোকা! জিন্ বলেছে যে, সেও আপনাকে একটি চিঠি লিখবে।
তবে এখন নয়।
কখন লিখবে, সে নিজেই তা জানেনা। কিন্তু বলেছে যে, লিখবেই।
রণ কিছুতেই লিখতে পারছে না। তার বোনের অপরাধের জন্যে সে আপনার কাছে করজোড়ে ক্ষমা চাইছে। আমাকেও ক্ষমা করবেন।
ভালুমারের চারটে দিন আমার সারা জীবনের এক অমূল্য সম্পদ হয়ে থাকবে। সত্যি!
ইতি—বাণী চ্যাটার্জি
অন্য চিঠিগুলো তখন আর পড়ার উৎসাহ ছিলো না।
হঠাৎ তিতলি বলল, আবার চা নিয়ে আসছি। চা’টা তো একেবারে ঠাণ্ডা হয়ে গেল। লক্ষ করিনি যে তিতলি আমার মুখের দিকে চেয়েই এতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল। ওকে কিছু বলার আগেই লঘু পায়ে ও ঘর থেকে অদৃশ্য হয়ে গেল।
আমি ছাত্রাবস্থায় কখনও কোনো পরীক্ষায় ফের করিনি। যদিও দারুণ ভালো ছাত্র ছিলাম না। যে সব পরীক্ষায় বসার ইচ্ছা ছিল, আই-এ-এস, ডাবলু-বি-সি-এস সেইসব পরীক্ষায় বসার সুযোগ হয়নি। তার আগেই চাকরি নিয়ে পালামৌতে চলে আসতে হয়েছিল। কিন্তু যে সব পরীক্ষাতে বসার কথা ভেবেছি, সে সব পরীক্ষাতে কখনই অকৃতকার্য হবো ভাবিনি। বসতে পারলে, হয়তো অকৃতকার্য হতামও না। কিন্তু এটা একটা অন্য পরীক্ষা। এই পরীক্ষায় ফেল করার লজ্জা এবং গ্লানি বড় গভীর। আজ এই শীতের সন্ধেতে ভালুমারে আমার ডেরায় লণ্ঠনের আলোতে একা বসে থাকতে থাকতে এই মুহূর্তে হঠাৎ আমার লক্ষ লক্ষ বাঙালি মেয়ের কথা মনে হল। আমার মায়েরা, বোনেরা, আমার অপরিচিত লক্ষ লক্ষ মধ্যবিত্ত ঘরের বিবাহপ্রার্থী মেয়েদের কথা। সেসব অশিক্ষিত, আধা-শিক্ষিত, এমনকী শিক্ষিত মানুষেরাও আজ সিঙাড়া-রসগোল্লা খেয়ে বাড়ি বাড়ি পণ্য যাচাই করার মতো বিবাহযোগ্যা মেয়ে দেখে বেড়ান তাঁদের অপোগণ্ড ছেলেদের জন্য এবং অবলীলায় তাদের ফেল করান; তাঁরা কখনওই, আমি আজ যেমন করে বুঝেছি, তেমন করে সেই ফেল-করা মেয়েদের মনের কথা বুঝতে পারবেন না।
এই সমাজ যে, কতখানি ঘৃণিত এবং পুরুষশাসিত সে কথা জিন্ আমাকে এমন ভাবে সব সাবজেক্টে ফেল না করালে কখনও হয়তো বুঝেই উঠতে পারতাম না।
দেওয়ার মতো পণের টাকা বাবার নেই বলে কোনো মেয়ে ফেল করছে, কেউ ফেল করছে তার গায়ের রঙ চাপা বলে, কেউ করছে ইংরিজি মিডিয়াম স্কুলে লেখাপড়া শেখেনি বলে। কত কারণে, আজকেও এই নব্য-সভ্যতার দিনেও প্রতি সন্ধ্যায় ঘরে, সিনেমাতে, রেস্তোরাঁতে, আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে এবং যেখানেই এই প্রাগৈতিহাসিক মেয়ে-দেখা প্রথা চলছে সেইখানেই কত শত মেয়ে যে অনুক্ষণ ফেল করছে।
জিন্ বোধ হয় উইমেনস্ লিব্-এ বিশ্বাস করে। নারী-স্বাধীনতার ইতিহাসে জিন্ই বোধ হয় প্রথম বঙ্গীয় পুরুষদের এক অপোগণ্ড প্রতিভূ আমার মতো অক্ষম, কুদর্শন, অতি-সাধারণ এই বাঁশবাবুর ওপরে প্রতিশোধ নিল। এদেশীয় মেয়েদের যুগ-যুগান্ত ধরে অপমানিত হওয়ার প্রতিশোধ! বেশ মেয়েটা! জিন্। বাঁশবনের শেয়াল-রাজার কল্পনার সম্রাজ্ঞী।
তিতলি আসার আগেই, আমি পার্সটা খুলে, তার ভিতর থেকে সেই সুগন্ধি মেয়েলি চুলটিকে বের করলাম। কী লম্বা চুলটি। পার্সের মধ্যে থাকায় এখন আর সে সুগন্ধ নেই। আস্তে করে লণ্ঠনের ওপরে রাখলাম। চুলটি কুঁকড়ে উঠে পুড়তে লাগল। পুড়ে গেল আমার চোখের সামনে আমার স্বপ্নের জিনের চুল। আমার দীর্ঘদিনের কল্পনার শোলার সাজ।
তিতলি চা হাতে করে এঘরে এসেই নাক কুঁচকে এদিক-ওদিক তাকাতে লাগল। বলল, কী যেন পুড়ছে। বিচ্ছিরি গন্ধ বেরোচ্ছে একটা। হুঁ!
আবার পুড়বে কী?
ও কিছুক্ষণ সান্ত্বনা দেবার ভাষায় নীরবে আমার চোখে চেয়ে রইল। তারপর হঠাৎ বলল, কারো কপাল পুড়ছে।
বড় বেশি কথা বলছিস, তুই আজকাল। বড্ড বাড় বেড়েছে তোর। কপাল পুড়ছে মানে?
তিতলি লজ্জিত কিন্তু খুব খুশি গলায় বলল, তুমি মিছিমিছিই আমাকে বকছ, এই গন্ধটা আমার চেনা।
চেনা?
বিরক্ত এবং অবাক গলায় শুধোলাম, কীসের গন্ধ এটা?
হেসে বলল, নিশ্চয়ই কোনো মেয়ের কপাল পোড়ার গন্ধ। একমাত্র মেয়েরাই এই গন্ধ চেনে।
তারপরই জিভ কেটে বলল, তুমি আমার মালিক, আমি কি তোমার কপাল পোড়ার কথা বলতে পারি?
অপ্রতিভের মতো বললাম, তাড়াতাড়ি খাবার লাগা। আমার খিদে পেয়েছে। খেয়েই আমি ঘুমবো।
এক্ষুনি লাগাচ্ছি। বলেই ও চলে গেল।
আমি টেবিল থেকে ‘ক্ষণিকা’টি তুলে নিলাম। রথীদার কাছ থেকে এই একটি পাওয়ার মতো পাওয়া পেয়েছি। মনটা অশান্ত হলেই, খুলে বসি। পাতা ওলটাতেই চোখ পড়ল “বোঝাপড়ায়”।
“মনেরে আজ কহ, যে
ভালো মন্দ যাহাই আসুক
সত্যেরে লও সহজে।
কেউ বা তোমায় ভালোবাসে
কেউ বা বাসতে পারে না যে,
কেউ বিকিয়ে আছে, কেউ বা
সিকি পয়সা ধারে না যে।
কতকটাসে স্বভাব তাদের,
কতকটা বা তোমারো ভাই,
কতকটা এ ভবের গতিক,
সবার তরে নহে সবাই।
**
মনেরে আজ কহ, যে
ভালো মন্দ যাহাই আসুক,
সত্যেরে লও সহজে।”
বই বন্ধ করে ভাবছিলাম যে, এই দাড়িওয়ালা ঋষিতুল্য মানুষটি না থাকলে বাঙালির যে কী দশা হতো। মনের মধ্যে এমন কোনো ভাবই তো আজ পর্যন্ত অনুভব করলাম না, যা আমার সেই অনুভবের মুহূর্তর অনেক আগেই নিজস্ব অনুভবের চেয়েও নিখুঁত এবং পূর্ণতর করে আমার জন্যে এবং আমার মতো অনেকের জন্যে লিখে রেখে যাননি মানুষটি!
তিতলি একটু পর খাবার লাগিয়ে ডাকল আমাকে। পিঁড়ি পেতে, সবকিছু বন্দোবস্ত করে, সামনে একটা ছোট জলচৌকির ওপর লণ্ঠনটা রাখল, যাতে আমার পাতে আলো পড়ে। আমি জোড়াসনে বসে খাচ্ছিলাম। তিতলি ওর বাঁ হাঁটুর ওপরে বাঁ হাতটি রেখে, বাঁ হাতের পাতা বাঁ গালে চেপে ধরে, ডান হাতে হাতা নিয়ে বসে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল। রোজই খাওয়ার সময় ও আমার সামনে বসে থাকে, কিন্তু রোজ ওর নজর থাকে আমার পাতের দিকে। কী লাগবে না লাগবে তার দিকে। আজ ও আমার মুখেই তাকিয়ে ছিল বাড়িতে ফেরার পর থেকে। আমার মুখে কি কোনো দুঃখ, কোনো আশাভঙ্গের ছাপ ফুটে উঠেছিল?
হঠাৎ তিতলি একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, দিদিটা বড় বোকা!
আমার চোখ থেকে চোখ না সরিয়েই বলল, জিন্ দিদি।
বললাম, তোর তা দিয়ে কী দরকার? বোকা না চালাক সে, সে-ই বুঝবে। হঠাৎ তার কথা?
অভিমানের গলায় ও বলল, সব কিছুই লুকোও কেন তুমি বলো তো? আমি না হয় নোকরানি; কিন্তু তোমার কাছে থাকি সব সময়, তোমার সুখ-দুঃখের খবর জানা কি দোষ আমার? তুমি যদি দুঃখ পেয়ে থাকো, তোমার অযোগ্য কেউ যদি তার বোকামির কারণে তোমাকে দুঃখ দিয়ে থাকে তা হলে তুমি মনমরা হও কেন?
তারপরই বলল, আমাকে কি তুমি চিরদিনই ছেলেমানুষ ভাববে? আমি কি বড় হইনি এখনও? কিছুই কি বুঝি না? তোমার দুঃখে আমার দুঃখিত হওয়াও কি অপরাধের? যদি তোমার নোকরানির তাতে অপরাধ হয়ে থাকে, তা হলে মাপ করে দিও আমাকে। আরও কখনও তোমার সুখে সুখীও হবো না, দুঃখেও দুঃখী নয়। তোমরা তোমরা; আমরা আমরা। আমরা কি কখনও তোমাদের বুঝতে পারি? আমি এক গরিব কাহার নোকরানি। আর তুমি বাবু ব্রাহ্মণ, আমার মালিক।
খাওয়া থামিয়ে বললাম, তিতলি।
আমি ওকে বকিনি। ওকে প্রশ্রয়ও দিইনি। কিন্তু আমার গলার স্বরে এমন কিছু ছিল যাতে তিতলি আমার মনের কথা বুঝতে পারল। আশ্চর্য! তিতলি আমাকে যতটুকু বোঝে, যেমন করে বোঝে, এ পর্যন্ত সত্যিই কেউ তা বুঝল না!
তিতলি পূর্ণ দৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে রইল।
হঠাৎ ওর চোখের কোণা দুটি চিক্চিক্ করে উঠল।
আমার চোখে চোখ রেখেই ও বলল, তুমি নিজে আর কত কষ্ট পাবে আর আমাকেও যে কত কষ্ট পাওয়াবে তোমার কারণে, তা এক ভগবানই জানেন!
তারপরই বলল, আজ আর রাত করে পড়াশুনা করো না। খেয়েই শুয়ে পড়ো। কেমন?
হঠাৎ ও যেন আমর স্বর্গতা মা, আমার সুদূর-প্রবাসী বোন অথবা আমার কল্পনার স্ত্রী হয়ে গেল।
অজানিতেই মাথা নেড়ে বাধ্য ছেলের মতো বললাম, আচ্ছা!