২১
রথীদা মানুষটার শেকড় সম্বন্ধে আমরা প্রত্যেকেই অজ্ঞ। এখানের একজন মানুষও জানে না রথীদার দেশ কোথায়, বাড়িতে কে কে আছেন অথবা আগে উনি কী করতেন! কেউ জানতে চাইলে, উনি চিরদিনই এড়িয়ে যান। যদি কেউ বেশি বাড়াবাড়ি করেন তাহলে হাব-ভাবে বুঝিয়ে দেন যে, তিনি নিজের ব্যাপারে অন্যের বেশি ইন্কুইজিটিভনেস্ পছন্দ করেন না। এখানে রথীদা আছেন গত পনেরো বছর। আমি ভালুমারে বদলি হয়ে এসেছি হান্টারগঞ্জ-জৌরী-পতাপ্পুরের জঙ্গলের এলাকা থেকে, তাও বেশ কয়েক বছর হয়ে গেল। হাজারিবাগ জেলার হান্টারগঞ্জ-জৌরীতে চিলাম দু’বছর মাত্র। তার আগে পালামৌ। পরেও পালামৌ। আমি আসার পর-পরই একদিন আমার ভালুমারের পূর্বসূরি নান্টুবাবু রথীদার সঙ্গে আমার আলাপ করিয়ে দেন। প্রথম দিনই রথীদা আমাকে বলেছিলেন, দ্যাখো সায়ন, আমার কেবল দুটি শর্ত আছে। প্রথম শর্ত হল, আমার সম্বন্ধে আমি যতটুকু বলি, বা জানাই, তার চেয়ে বেশিকিছু জানতে চেয়ো না। আর দ্বিতীয় শর্ত হল এই যে, সকাল দশটার আগে কখনও আমার বিনা অনুমতিতে আমার বাড়িতে এসো না।
শর্ত মেনে নিয়েছিলাম।
প্রথম শর্তের মানে বুঝতে কোনো অসুবিধে হয়নি। দ্বিতীয় শর্তর মানেও প্রাঞ্জল। আমি স্বভাবতই ভেবেছিলাম যে, উনি দেরি করে ঘুম থেকে ওঠেন এবং হয়তো যোগাভ্যাসটাস করেন। যাই-ই হোক এ-পর্যন্ত শর্ত দুটি মেনে চলেছি, অতএব কোনো ঝামেলা হয়নি। কিন্তু মাঝে মাঝেই রথীদা সম্বন্ধে জানতে ইচ্ছে করে। মানুষটার অতীত বলতে কি কিছুই নেই? অতীতকে এমন করে লুকিয়ে বেড়ায় একমাত্র খুনি আসামিরা। নয়ত সাধু-সন্তরা। রথীদাকে তো এই দুইয়ের কোনো পর্যায়েই ফেলা যায় না। একজন পণ্ডিত অথচ অমায়িক, কোনোরকম এয়ার-হীন অতি উদার মানুষ। ধর্ম সম্বন্ধে গোঁড়ামি নেই, পুজোআচ্চাও করেন না। সব কিছুই খান, অনেক বই পড়েন, ভালুমারের প্রত্যেকের ভালো ভাবেন এবং ভালো করেন। বলতে গেলে, বনদেওতার থানের বিরাট জটাজুট-সম্বলিত প্রাগৈতিহাসিক অশ্বত্থ গাছটাকে যেমন এ গ্রামের সকলে একটি চিরাচরিত প্রতিষ্ঠান বলে মেনে নিয়েছে, রথীদাকেও তেমনি। রথীদার বর্তমান অস্তিত্ব সম্বন্ধে এখানের বড় ছোট কারো মনেই কোনো সন্দেহ বা জিজ্ঞাসা নেই। নীরব জিজ্ঞাসা থাকলেও, হুলুক্ পাহাড়ের গুহাগাত্রের ছবিগুলির মতোই রথীদার অতীতও সেই জিজ্ঞাসার উত্তরে মূক, নিথর। যেভাবে রথীদা এ গ্রামের সকলের জন্য সবসময় ভাবেন ও করেন, বিপদে-আপদে অকাতরে অর্থব্যয় করেন, তাতে এ-কথা মনে হওয়ার বিন্দুমাত্র কারণ নেই যে, রথীদার অবস্থা স্বচ্ছল নয়। কিন্তু একথাটা একজন মহামূর্খের পক্ষেও বোঝা অসুবিধের নয় যে, এই স্বচ্ছলতার সামান্য এক অংশ ওঁর বাংলো সংলগ্ন এবং ভালুমার বস্তির শেষপ্রান্তে অবস্থিত জমি-জমার গেঁহুবাজরা ধান-মাকাই ইত্যাদি থেকে যা রোজগার হয় তা থেকে কখনোই আসতে পারে না। সেই ক্ষেত-খামারে যা হয়, তা থেকে নিজের সারা বছরের খাওয়ারটুকু রেখে, বাকিটা যারা চাষ করে তাদের মধ্যেই বিলিয়ে দেন। রথীদার যে অন্য কোনো সূত্রে আয় নিশ্চয়ই আছে, বা ছিল তা বোঝা যায়।
নান্টুবাবুই একদিন ডালটনগঞ্জ থেকে এখানে বেড়াতে এসে বলেছিলেন, ডালটনগঞ্জে যে ব্যাঙ্কে রমিদার অ্যাকাউন্ট আছে সেখানে তাঁর এক বন্ধু কাজ করেন। তাঁর কাছ থেকেই নাকি উনি শুনেছেন যে, রথীদার নামে ঐ ব্যাঙ্কেই ফিক্সড্ ডিপোজিট আছে মোটা টাকার। প্রতিমাসে তাঁর কারেন্ট অ্যাকাউন্টে সেই ফিক্সড্ ডিপোজিটের সুদ জমা পড়ে। তার থেকেই খরচ চালান রথীদা। মাঝে মাঝে আমার যে একটু গোয়েন্দাগিরি করতে সাধ হয় না এমন নয়। মানুষটার রহস্যটা কী এবং সেই রহস্য এমন করে লুকিয়ে রাখার চেষ্টাই-বা যে কেন তাও জানতে ইচ্ছে করে। কিন্তু সমস্ত গোয়েন্দাদেরই যেটা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন তা হচ্ছে সময়। হাতে অফুরন্ত সময় না থাকলে গোয়েন্দাগিরি করা যায় না। তাই আমার গোপন ইচ্ছাটা সফল করা হয়ে ওঠেনি।
রথীদা সেদিন আমাকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। ওঁর লোকে এসে তিতলিকে বলে গেছিল যে, আমি জঙ্গল থেকে ফিরে যেন ওঁর কাছে যাই এবং আজ রাতে যেন ওখানেই খাই। যেতে যেতে রাত হয়ে গেল। হুলুক্ থেকে ফেরার পথে রাস্তাতে একটি কালভার্ট ভেঙে ছিল। আমাদেরই অন্য কোনো ট্রাক ভেঙে থাকবে, তাই, ট্রাক থেকে কুলিদের নামিয়ে হাতে হাতে জঙ্গল এবং মাটি কেটে ডাইভার্সন তৈরি করে তবে ট্রাক পার করা গেল। ধুলোতে গা-মাথা একেবারে ভরে গেছিল। বাড়ি ফিরে চানটান করেই রথীদার কাছে গেলাম। গিয়ে দেখি, নানকুয়া বসে আছে।
আমাকে দেখেই রথীদা বললেন, শুনেছিস নাকি? নানকুয়া তো এদিকে বেশ গণ্ডগোল পাকিয়ে বসে আছে।
কী রকম?
মাহাতোকে মেরেছে। গোদা শেঠের দোকানে মানিয়ার ধারের টাকার অনেকখানি শোধ করে দিয়েছে। মনে, হি হ্যাজ থ্রোন দ্যা গলে টু দিজ গাইজ। এরপর কী হবে, বা হতে পারে; তা অনুমান করা শক্ত নয়। কী বলিস?
বললাম, তা ঠিক।
নানকুয়া কাল কিংবা পরশু খাদে চলে যাচ্ছে। ওকে বলেছি, কয়েক মাস আর এদিকে যেন না আসে। কিন্তু কথা শুনছে না ও।
নানকুয়া মেঝেতে বসে ছিল, কার্পেটের ওপর। আমার দিকে চেয়ে ও বলল, বাপ-দাদার গ্রামে ক’টা ঘেয়ো কুকুর আছে বলে আমি কোন দুঃখে আমার নিজের গ্রাম ছাড়তে যাব? তাহলে তো ওরা আরও পেয়ে বসবে। আর ভাববে নানকু ওরাওঁ ওদের ভয়ে পালিয়ে আছে। পালাতে হলে, ওরাই পালাক। নানকুয়া পালায় না।
ওরে গাধা! যারা যুদ্ধ করতে জানে, এমনকী পৃথিবীর বড় বড় সেনাপতিরাও পালাতে জানে। সময়মতো পালিয়ে যাওয়া বা পিছু হটে যাওয়াটাও যুদ্ধের একটা অঙ্গ, স্ট্র্যাটেজি। সাময়িকভাবে পালিয়ে বা পিছু হটে গেলেই যে হার হলো এমন মনে করা ভুল। তাতে অনেক সময় জিতটাই পোক্ত হয়। রথীদা বললেন।
নানকুয়া হাসল। বলল, আমি ওসব জানি না। আমি তো বড় সেনাপতি নই, ছোট সেনাপতি।
রথীদা নান্কুকে শুধোলেন, গোদা শেঠের দোকানে মানিয়ার আর কত ধার আছে রে?
একশ কত টাকা যেন।
টাকাটা আমি তোকে দিয়ে দিচ্ছি। তুই এখান থেকে যাওয়ার আগেই শোধ করে দিবি। আর মানিয়াকে বলে দিয়ে যাবি যে, এর পরেও কোনো হাঙ্গামা হলে যেন ও …. সঙ্গে সঙ্গে আমাকে খবর দেয়।
নানকুয়া বলল, আচ্ছা।
রথীদা আমাকে বললেন, তুই নিশ্চয়ই শুনেছিস, হীরু কী করেছে? নাম পাল্টেছে অ্যাফিডেভিট করে। জাতে উঠেছে। ভালুমারে এসেও নিজের মা-বাবা ভাই-বোনের সঙ্গে দেখা পর্যন্ত করেনি।
সে কী? আমি তো জানি না। আমি তো সারাদিন ক্যুপে থাকি। এখানের কম খবরই আমার কাছে পৌঁছয়। তিতলিরও তো সারাদিন কাজে-কর্মেই কাটে। ও-ও খবর রাখে কম।
তাহলে আর বলছি কী? আমার সঙ্গে ও দেখা করতে এসেছিল। পাঁচ মিনিটের জন্যে। কিন্তু কেন জানিস?
কেন?
রথীদা অন্যদিকে মুখ করে বললেন, ওরা বন্ধুর জন্যে হুইস্কি চাইতে এসেছিল। অবাক হয়ে বললাম, বলেন কী?
দু’বোতল বেশি ছিল আমার কাছে। দিয়ে দিয়েছিলাম। ও যে জুর সঙ্গে বা ভাইবোনের সঙ্গে দেখা করেনি তাও তো জানলাম নানকুয়ার কাছ থেকেই। জুগ্ নাকি মানিয়াকে দুঃখ করে বলেছে যে, পাগলা সাহেব আমার ছেলেটাকে মানুষ করতে গিয়ে এতবড় একটা জানোয়ার করে তুলল! এর চেয়ে আমার ছেলের লেখাপড়া না শেখাই ভালো ছিল।
বললাম, আপনি তাহলে সত্যিই ভুল লোককেই লেখাপড়া শিখিয়েছিলেন; কম্পিটিটিভ পরীক্ষায় বসিয়েছিলেন। সে যদি বড় হয়ে ফিরে এসে নিজের জাতের মানুষ, নিজের গ্রাম, নিজের আত্মীয়-পরিজনের জন্যে কিছুমাত্রই না করে; তাহলে সেই বড় হওয়ার মানে কী?
নানকুয়া বলল, গ্রাম বড় না হলে, গ্রামের মানুষকে টেনে তুলতে না পারলে দেশ কি শুধু শহরের বাবুদের ভালো নিয়েই আগে বাড়তে পারবে? সেই বড় হওয়া কি বড় হওয়া? গ্রাম বাদ দিয়ে এদেশের থাকে কী?
বোঝাই যাচ্ছিল যে, হীরুর ব্যাপারে রথীদা প্রচণ্ড শক্ড হয়েছিলেন। বললেন, আমি সে কথাই ভাবছি। হীরু আর ওর বন্ধুকে সঙ্গে করে নিয়ে এসে আমার সঙ্গে রাতে খেতে বললাম একদিন, তা পর্যন্ত এলো না। পাছে আমার কথাবার্তায় ওর বন্ধুর সামনে ওর ইমেজটা নষ্ট হয়। বুঝলি নানকুয়া, আমি যদি বিয়ে করতাম, তবে হীরুর মতো বা তোর মতোই আমারও ছেলে থাকত। তোরাও তো আমার ছেলেই। হীরু বলছিল, ওরা একটা জরুরি এনকোয়ারিতে এসেছে। এই বন-পাহাড়ে নাকি সিংভূম ডিস্ট্রিকট থেকে কিছু নকশাল ছেলে এসে লুকিয়ে আছে। তারা নাকি এই অঞ্চলের গ্রামের অল্পবয়সি ছেলেদের মাথা খাচ্ছে। গোপনে মিটিং করছে জঙ্গলে। অস্ত্র শিক্ষা দিচ্ছে। শ্রেণীশত্রু কারা, সে সম্বন্ধে জ্ঞান দিচ্ছে। হীরুদের ইনফরমেশান এইই যে, এই সব ঘুমন্ত গ্রামেও নাকি সন্ত্রাসবাদী কাজকর্ম শুরু হবে শীগগিরই। সেই সব কারণে ওরা তদন্তে এসেছে পটনা থেকে। সময় ছিলো না নাকি একেবারেই।
নানকুয়া মুখ নিচু করেই বলল, হীরু ভাইয়া নিজেই তো সবচেয়ে বড় শ্রেণীশত্রু। বেইমান, বিশ্বাসঘাতক, নিমকহারাম। যে নিজের গ্রামকে ভুলে যায়, মা-বাবাকে ভুলে যায়, চাকরির ভারে, ঘুষের টাকার গরমে যে বামুন-কায়েতের মেয়ে বিয়ে করে জাতে উঠতে চায় তার মতো শ্রেণীশত্রু আর কে আছে? আমরা আগে কখনও বড় হবার, দশজনের একজন হবার সুযোগ পাইনি। যখন সুযোগ পেল কেউ কেউ, তারা অমনি যারা এতোদিন আমাদের বঞ্চিত করেছে, মানুষ বলে মনে করেনি তাদের দলেই ভিড়ে গেল।
রথীদা একটা হুইস্কি ঢাললেন গ্লাসে।
বললেন, খাবি নাকি একটা? বড় ঠান্ডা পড়েছে আজকে।
নাঃ জর্দা পান রয়েছে মুখে। আমার ঠান্ডা লাগে না।
তুই যে দিলেও খাস্ না, এটা আমার খারাপ লাগে। মনে হয়, তুই এই ব্যাপারে আমাকে ছোট জাতের লোক বলে মনে করিস।
আমি হেসে উঠলাম। নানকুও।
আজকাল এ সব খেলেই তো বড় জাতের বড় মাপের বলে গণ্য হয় সকলে। রথীদা আপনি উল্টোটাই বললেন। আমি ছোট, ছোটই থাকতে চাই।
রথীদা বললেন, তথাস্তু! তুমি তাই-ই থাকো!
আত্মমগ্ন হয়ে রথীদা বললেন, এই জাত-পাত করেই দেশটা জাহান্নমে গেল। কী বলিস? এমন একটা দেশ! সোনার দেশ। কতকগুলো মিছিমিছি কারণ কিছুতেই এগোতে পারছে না। অটোপাসের মতো এইসব কারণগুলো পা জড়িয়ে আছে। এগোবে কী করে? আরও একটা ব্যাপার আছে। গভীর ব্যাপার। যে সব অফিসারদের তৈরি করছেন সরকার দেশ চালানোর জন্যে, তাঁদের ট্রেনিং-এর জন্যে মুসৌরিতে ইনস্টিটুউট আছে। সেই ইনস্টিটুউটে যে রকম শিক্ষা দেওয়া হয়, তা, প্রায় সাহেবি আমলের শিক্ষারই অনুরূপ। তাঁরা কাঁটা চামচে খান। লাউঞ্জ স্যুট পরে মদের গ্লাস হাতে টোস্ট প্রোপোজ করা শেখেন সেখানে। হীরুও শিখেছে নিশ্চয়ই। দেশ স্বাধীন হয়ে গেল। কিন্তু কোনো নেতা বা সরকারি আমলার শিকড় রইল না আর দেশের গভীরে। একমাত্র লালবাহাদুর শাস্ত্রী ছাড়া পুরোপুরি ভারতীয় পটভূমির কোনো লোক প্রধানমন্ত্রীই হলেন না আজ পর্যন্ত। যাঁরা হলেন, তাঁরা নামেই ভারতীয়, দেশের গরিবদের সঙ্গে, মাটির কোনো যোগাযোগই ছিল না তাঁদের। দেশটা চালানোর ভার এখনও সাহেবি-ভাবাপন্ন, ইংরিজি-শিক্ষিত, পশ্চিমি ভাবনায় দীক্ষিত কিছু লোকের হাতে। তাদের নিজেদের শিকড়গুলি যত দিন দেশের মাটিতে গভীর ভাবে না ছড়িয়ে যাচ্ছে, তারা এই দেশ শাসন করবে কী করে?
নানকু এবং আমি সমস্বরে বললাম, ঠিক!
বললাম, দেশটা তো ভালোই রথীদা। দেশের লোকেরাও ভালোই ছিল। এই অসৎ, ভণ্ড, পাজি নেতাগুলোই দেশটাকে চোরের দেশ বানিয়ে তুলল। ভণ্ডামির কম্পিটিশান্ লাগিয়ে, গণতন্ত্রকে একটা ফাতু বুলি করে তুলল এই তিরিশ বছব। এই শালারাই দেশের সবচেয়ে বড় শত্রু। কাগজে বক্তৃতা ঝাড়ে, প্যারালাল ইকনমি আর কালো টাকার সমস্যা সম্বন্ধে। কালো টাকা তৈরি করল কারা? তিরিশ বছর আগে ব্ল্যাকমার্কেটিয়ারদের ল্যাম্পপোস্টে ঝোলালে দেশে স্মাগলার আর ব্ল্যাকমার্কেটিয়ারদের এমন মোচ্ছব লাগত না। নেহরু বলেছিলেন যে, ঝোলাবেন। যত কালো টাকা দেশের নেতাদের আর কিছু সরকারি আমলাদের কাছে আছে, তার কণামাত্রও বোধহয় নেই অন্যদের কাছে। অথচ চোখ রাঙায় সবচেয়ে বেশি তারাই।
রান্নার লোকটিকে ডেকে রথীদা শুধোলেন, রান্নার কতদূর?
সে বলল, হয়ে এসেছে।
জানিস সায়ন, আজ নান্কু হাট থেকে সবচেয়ে বড় মোরগটা কিনে এনেছে আমার জন্যে।
নানকুর দিকে ফিরে বললেন, কী রে? বল্ নানকুয়া?
নাঃ। বলল নানকুয়া। তারপর বলল, চিপাদোহরের গণেশ মাস্টারবাবু এসেছিলেন গাড়ুর হাটে। সস্তায় মুরগি কিনবেন বলে। সবচেয়ে বড় মোরগটা ওঁরই কেনার ইচ্ছা ছিল। দরও দিয়েছিলেন ভালই। কিন্তু আমার জেদ চেপে গেল।
আমার দিকে চেয়ে নানকু হেসে বলল, বুঝলে, বাঁশবাবু। তোমরা এই বাবুরা, চিরদিনই আমাদের চোখের সামনে থেকে যা কিছু ভালো সবই কিনে নিয়ে গেছ। ছিনিয়ে নিয়ে গেছ যা-কিছুই আমাদের ভালোবাসার। সময় বদলাচ্ছে, বদলাবে। হাসতে হাসতে আবার বলল, বুঝলে, তাই আমি দর চড়িয়ে দিয়ে মাস্টারবাবুর হাত থেকে কেড়ে নিলাম মোরগটা। মাস্টারবাবুর মুখটা যদি দেখতে তখন!
রথীদা হো হো করে হেসে উঠলেন।
হাসিটা ভালো লাগলো না আমার। ভাবছিলাম, পৈতৃক রোজগারের ফিকসড্ ডিপোজিটের সুদের টাকায় স্বচ্ছল, হুইস্কি-খাওয়া রথীদা কোনোদিনও গণেশ মাস্টারের দুঃখটা বুঝবেন না! মধ্যবিত্ত, সাধারণ স্কুলে অল্প-স্বল্প লেখাপড়া শেখা আমরা যে এই কেরানিবাবুর দল, আজকে আমাদেরই সবচেয়ে বড় দুর্দিন। আমাদের পোশাকি ‘বাবু’ পদবিটাই রয়ে গেছে শুধু, বাইরে বেরোলে এখনও আমাদের ফর্সা, ইস্ত্রি-করা জামা-কাপড় পরে বেরোতে হয়। আমাদের মেয়েরা আব্রু রাখার জন্যে ন্যূনতম ভদ্র ও সভ্য পোশাক পরেন এখনও। বংশপরম্পরায় সাহিত্য ও সংগীতের সঙ্গে যোগসূত্র বাঁচিয়ে রাখতে এখনও বই এবং রেকর্ড কিনতে হয় একটা দুটো। ছেলেমেয়েদের এখনও স্কুলে-কলেজে পাঠিয়ে লেখাপড়া শেখাতে হয় আমাদের। নিজেরা খেয়ে কি না-খেয়ে। এবং এ সবই, এই দুর্দশা ও কষ্ট, উঠতি-বড়লোক নানকু বা পৈতৃক সম্পদে বড়লোক রথীদারা বুঝতে পারবেন না।
নানকুয়া আমার দিকে চেয়ে হাসল। বলল, কি বাঁশবাবু? রাগ করলে?
না রে নানকুয়া, ব্যাপারটা হচ্ছে এই যে, আমরা বাবু বলে পরিচিত হলেও আসলে তো কখনওই বাবু ছিলাম না! সরকারের, রেল কোম্পানির, চা বাগানের বা কয়লাখাদের মালিকের বা বড় বড় ঠিকাদারের আমরা কর্মচারিমাত্র। চিরদিনই তাই-ই ছিলাম। আমরা না ঘরকা না ঘাটকা। না সত্যিকারের পুরানো বাবুরা আমাদের দুর্দশা বোঝে, না বুঝিস তোরা; এই নতুন বাবুরা। আজকে তোর মতো কয়লাখাদের একজন শ্রমিক বা চা-বাগানের একজন শ্রমিক যা রোজগার করিস একা, এবং সপরিবারে তো বটেই; তা গণেশ মাস্টারের বা আমার মতো বাবুর রোজগারের অনেকগুণই বেশি। তোরা যে বেশি রোজগার করিস, এটা আনন্দের। তোরা অনেক কষ্ট করেছিস অনেকদিন। কিন্তু আমাদের, এই মধ্যবিত্ত বা নিম্নমধ্যবিত্তদের অবস্থাটাও ভাববার আমাদের জন্য কারুরই সমবেদনা নেই। আমরা নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে বসেছি, কৃষ্টিতে, শিক্ষায়, রুচিতে এবং জীবনেও। আমাদের কোনোই ভবিষ্যৎ নেই! আমাদের মতো মধ্যবিত্তরাই জানে তাদের অবস্থার কথা। আমাদের কথা নেতারা কেন ভাববে বল? আমাদের আর কটা ভোট? এদেশে এখন ভোট যার, সব তার। তোদের কথা না ভেবে যে তাদের উপায় নেই! এখন দায়ে পড়েই ভাবতে হবে। ভুজুংভাজুং দিয়ে আর কতদিন চলবে?
রথীদা কিছুক্ষণ চুপ করে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলেন। তারপর হঠাৎ বললেন, তুই কিন্তু খুব উত্তেজিত হয়ে গেছিস। স্বাস্থ্যের পক্ষে এটা ক্ষতিকর।
হাসবার চেষ্টা করলাম, কিন্তু পারলাম না।
সায়ন, ইটস্ অ্যা ম্যাটার অফ পারস্পেকটিভ্। তোর একার কথাই তুই ভাবছিস। তুই ভাবছিস, তোর নিজের বা তোর কাছাকাছি লোকদের ভালোর কথা। একটু থেমে বললেন, আমিও হয়তো তাই ভাবছি। কিন্তু যে-দেশের লোকে এখনও কান্দা-গেঁঠি খুঁড়ে খায়, শম্বরের সঙ্গে ভাল্লুকের সঙ্গে রেষারেষি করে বুনো কুল বা মহুয়া খেয়ে বেঁচে থাকে; সে দেশের বৃহত্তম সংখ্যার কারণে তোর ও আমার স্বার্থ বা ভালো-মন্দ বিসর্জন দেওয়ার সময় কি এখনও আসেনি? ভেবে দ্যাখ, যেসব দেশ এগিয়েছে, তারা সকলেই তাই দিয়েছে।
চটে উঠে বললাম, শুয়োরের বাচ্চার মতো মানুষের বাচ্চা পয়দা হবে, একগাদা অশিক্ষিত, স্বাস্থ্যহীন, ভবিষ্যহীন মানুষ প্রতি মুহূর্তে জন্মাবে বলেই তার খেসারৎ দিতে হবে অন্য সকলকে? জন্মরোধ করানো হয় না কেন? যে মা-বাবা ছেলে মেয়েকে খাওয়াতে পারে না, তাদের ছেলেমেয়ে হয় কেন। আমি জানি কেন হয়। ঐ ভোট। বেড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কোন ইঁদুর। কোন্ পার্টি আছে এখন দেশে, যে দেশের ভালো চায়? তারা শুধু তাদের ভালো চায়। জন্মরোধ করতে গেলে ভোট যে বেহাত হয়ে যাবে। আর ভোট বেহাত হলে, গদিও বেহাত। তাতে দেশের যা হয় হোক, দেশ জাহান্নমে যাক্।
রথীদা চুপ করে থাকলেন।
নানকুয়াকে বিচলিত দেখাল। কিঞ্চিৎ উত্তেজিতও।
কিন্তু নানকুয়াই ঠাণ্ডা গলায়, শান্ত চোখে আমার দিকে চেয়ে বলল, তুমি ঠিকই বলছো বাঁশবাবু। সবচেয়ে বড় সমস্যা এটাই। আমি সেদিন পাগলা সাহেবকে বলেছি যে, আমরা সকলে চাঁদা দেব। সেই চাঁদায় ভালুমারে একটা ফ্যামিলি প্ল্যানিং-এর স্কুল খুলতে হবে। মেয়েদের সবচেয়ে আগে বোঝাতে হবে এর সুফলের কথা তুমি কী বল বাঁশবাবু? করলে কেমন হয়?
নানকুয়ার চেয়ে আমি অনেক বেশি লেখাপড়া করেছি। শিক্ষিত সমাজেই আমার মুখ্যত ওঠা-বসা। তা সত্ত্বেও আমি অতখানি উত্তেজিত হয়ে উঠলাম আর নানকুয়া নিরুত্তাপ গলায় শান্তভাবে আমার সঙ্গে কথা বলতে পারল দেখে বড় লজ্জা লাগল। বললাম, খুবই ভালো। করো না, আমরাও চাঁদা দেব।
বাঁশবাবু! তুমি কিন্তু আমাদেরই একজন। মিথ্যামিথ্যি দূরে থাকতে চাইলে চলবে কেন? আমরা যারাই দেশকে ভালোবাসি, দেশের কথা ভাবি, তারা সকলেই একটা জাত! এতে কে ওরাওঁ, কে কাহার, কে ভোগ্তা, কে মুণ্ডা, কে দোসাদ, কে চামার অথবা তোমার মতো কে মুখার্জি বামুন তাতে কিছুই যায় আসে না। তাছাড়া আমি একটা কথা বলব? কিছু মনে করবে না বলো?
বলো।
না, আগে বলো যে মনে করবে না?
না।
অনেকক্ষণ আমার চোখের দিকে চেয়ে ও বলল, আমি তোমার চেয়ে কম ক্লাসে পড়েছি। তিতলি আমার চেয়েও কম পড়েছে এবং আমরা দু’জনেই এই জংলি গ্রামে বড় গরিবের ঘরে জন্মেছি বলেই মানুষ হিসেবে আমরা কি তোমার চেয়ে খারাপ? যে সুযোগ আমরা পাইনি, আমাদের যে সুযোগ দেওয়া হয়নি, তোমার মতো সাহিত্য পড়বার, গান শুনবার, ভালো ভালো বই পড়বার, সেই জন্যেই কি তোমরা আমাদের চেয়ে অন্যরকম? তোমার ছেলে যদি আমার মতো হতো, অথবা মেয়ে তিতলির মতো, তাহলেই তুমি আমাদের দুঃখটা কোথায়, কেন তা বুঝতে পারতে। তুমি এবং তোমাদের মতো অনেকেই আমাদের মধ্যেই আছো অথচ তবু তোমরা আমাদের কেউই নয়। তোমাদের মন পড়ে থাকে সব সময় কলকাতায় বা অন্য শহরে। বিয়ের কথা হলে, কলকাতা বা অন্য জায়গা থেকে তোমাদেরই সমাজের, তোমারই মতো শিক্ষিত মেয়ে আসে তোমাকে দেখবার জন্যে, তোমার সঙ্গে মেশবার জন্যে। তাই, তোমরা তোমরাই থেকে যাও। আমরা, আমরাই। আমরা তোমাদের বুঝি না; তোমরা বোঝ না আমাদের। আমরা এক হতে পারলাম না, এই সব মিছিমিছি কারণে। আর তোমাকেই বা কী বলব? আমাদের হীরুকে দেখছি না চোখের সামনে! ও কিন্তু আমাদের গর্বের একজন হয়েও আমাদের ঘেন্না করছে এখন। দ্যাখো। যেই সুযোগ পেয়েছে, অমনি তোমাদের একজন হয়ে গেছে পুরানো স্লেট মুছে ফেলে। বেইমান, হারামি, শালা!
রথীদাকে খুব আপসেট্ দেখালো এই কথায়।
নানকু আবার বলল, আসল কথাটা কী জানো বাঁশবাবু? সাহিত্যের খিদে, সংগীতের খিদে, সংস্কৃতির খিদের চেয়েও অনেক বড় একটা খিদে আছে। তার নাম পেটের খিদে। ছোটবেলা থেকে তুমি যে খিদেকে কখনও জানোনি। জানলে আমার সঙ্গে তর্ক করতে না তুমি! আমি এখন পেটভরে খেতে পাই। মোরগাও খাই মাঝে মধ্যে। কিন্তু যতক্ষণ ভালুমারের একজন মানুষের পেটেও সেই গন্গনে খিদে আছে, ততক্ষণে যাই-ই খাই না কেন, আমার কিছুতেই পেট ভরে না। আচ্ছা, বাঁশবাবু, তুমি তিনদিন একদম উপোস করে থাকো। তারপরই না হয় আমরা আবার আলোচনা করব সাহেবের বাড়িতে। এই বিষয়ে। একসঙ্গে তিনদিন কখনও না খেয়ে থেকেছো? একবার থেকে দ্যাখো।
রথীদা আরেকটা হুইস্কি ঢাললেন।
একটু হেসে বললেন, বেশ জমে গেছে তোদের তক্ক। কী বল্ সায়ন?