২
দেওয়ালির পরই ঝড়-বৃষ্টি হয়ে গেল একচোট। গাছ-গাছালি পড়ে গেল ঝড়ে। নালার পাশের নিচু জমিতে ধানগুলো তৈরি হয়ে গেছিল প্রায়, প্রায় সবই ঝরে গেল। পাখিও মরেছিল অনেক।
একটা নীলকণ্ঠ পাখিও।
মুঞ্জরী বলেছিল, এ বড় অলক্ষুণে ব্যাপার। মানিয়া শোনেনি সে-কথা। ঠিক শোনেনি বললে ভুল হয়। শুনেছিল, কিন্তু বিশ্বাস করতে সাহস হয়নি ওর। সমস্ত লক্ষণ শুভ থাকতেই এই ক’টা পেট চালানো বছরের তিনশো পঁয়ষট্টি দিনই যথেষ্ট কষ্টের। তাই অশুভ লক্ষণ আরও কী বয়ে আনবে, ভাবতেই ভয় করে মানির। আগে আগে রাতে একটা কুপি জ্বালিয়ে রাখত ঘরের কোণায়। যখন ছেলেমেয়ে হয়নি। কেরোসিনের দাম সস্তা ছিল তখন। এখন সারারাত কুপি জ্বালিয়ে রাখার কথা ভাবতেও পারে না। রাত-ভর জ্বললে পঞ্চাশ পয়সার কেরোসিন পুড়বে। জ্বালাবার সামর্থ্য যেমন নেই, আবার না-জ্বালিয়ে রাখলে অস্বস্তিও কম নয়। শীতকালটায় তাও সাপের ভয় নেই। কিন্তু বর্ষার দিনে বড় ভয় করে। খাপ্পার চালে ইঁদুরের দৌরাত্ম্য। জল ছুঁয়োয় জোরে বৃষ্টি হলে। সাপ এসে ইঁদুর ধাওয়া করে চালময়। কয়েক বছর আগে একটা কালো গহুমন্ সাপ ঝুপ্ করে পড়েছিল বুলকির মাথার কাছে। কোনোক্রমে সেটাকে মারে মানি। নিজেও মরতে পারত। তার ফণাধরা চেহারাটা মাঝে মাঝে এখনও মনে পড়ে। ওদের ঘরের পাশেই যে ঝাঁকড়া আম আর তেঁতুল গাছ-দুটো আছে, তাদের পাতা থেকে টুপটাপ করে শিশির ঝরে খাপ্পার ওপরে, ঘরের আশে-পাশে, ওদের আস্তানার চৌহদ্দির বাইরের ঘন জঙ্গলে, ফিস্ ফিস্ করে। বলদ দুটো যেখানে থাকে, সেই চালার মাথায়; জঙ্গল থেকে কিছু ডাল-পাতা কেটে এনে দিয়েছিল। এবারে যা ঠান্ডা! গরুটা বিইয়েছে। বাছুরটা আর গরুকে যত্নে রাখে মানিয়া।
পরেশনাথটার বড় নাক ডাকে। এতটুকু ছেলের এরকম নাকডাকা ভালো নয়। প্রথম রাতেই ঘুমোতে না পারলে আজকাল ঘুমই হয় না মানিয়ার। রাজ্যের চিন্তা এসে মাথায় ঘুরপাক খায়। মাথার মধ্যে অসহায়তার মোম গলে পুট্-পাট্ শব্দ করে। কিছু করার নেই। তবুও কেন যে ভাবনাগুলো মাথায় ভিড় করে আসে, জানে না মানিয়া। ওর জীবনটাও ঐ বলদ দুটোরই মতো হয়ে গেছে। স্থবির, পরনির্ভর। মুঞ্জরী কাৎ হয়ে শুয়ে আছে ন-বছরের মেয়ে বুলকিকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে, বিচালির ওপর ছেঁড়া কম্বলটা গায়ে দিয়ে। একদিন মানিও অমনি করে মুঞ্জরীকে জড়িয়ে শুয়ে থাকত। বুকের মধ্যে যুবতী মুঞ্জরীর নরম শরীরের সমস্ত উষ্ণতা কেন্দ্রীভূত হত। দু’জনে দুজনকে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে, বাইরের শীত, ওদের অন্তরের সমস্ত শীতকে একে অন্যের শরীরের ওমে সহনীয় করে তুলত তখন। সে সবও অনেক দিনের কথা। এখন পরেশনাথ ওর সঙ্গে শোয়। বয়স প্রায় সাত হয়ে গেল দেখতে। বড় বাপ-ন্যাওটা ছেলে। মানিয়া ঘুমন্ত পরেশনাথের কপালে একবার হাত বোলায় অন্ধকারে। মাল্সার মধ্যে কাঠ-কয়লার আগুনটাকে পরেশনাথের গায়ের আরও কাছে এনে দেয়। তারপরে কী মনে করে আবার সরিয়ে রাখে। শোওয়া বড় খারাপ পরেশনাথের। ঘুমের মধ্যে আগুনে হাত-পা না পোড়ায়! একবার পুড়িয়েছিল ওদের বড় মেয়ে জীরুয়া। জীরুয়ার কথা মন থেকে মুছে ফেলতে চায় মানিয়া। বড় কষ্ট পেয়ে মরেছিল মেয়েটা। সে-সব অনেক কথা। মনে আনতে চায় না। মাথার মধ্যে বড় ব্যথা করে ওর।
হঠাৎই ওর কান খাড়া হয়ে ওঠে। বাইরের ঘাস-পাতায় শিশির পড়ার শব্দ ছাপিয়ে অন্য একটা শব্দ শুনতে পায় ও। শিশির পড়ার শব্দের মতোই নরম। কিন্তু প্রাকৃতিক শব্দ নয় কোনো। নাঃ! আবার এসেছে। দাঁতে দাঁত ঘষে একটা আওয়াজ করল মানিয়া। উঠে বসে, নিভিয়ে-রাখা লণ্ঠনটাকে জ্বালাল। তিন চারটে কাঠি খরচ হয়ে গেল। আজকালকার দেশলাই! কত কাঠি-ই যে জ্বলে না! তার ওপর হিমে বারুদটা নেতিয়ে গেছে একেবারে। লণ্ঠনটা জ্বালিয়ে, পরেশনাথকে ডাকবে ভাবল। কিন্তু বড় মায়া হল। এই শীতের রাতে শত্রুকেও বাইরে যেতে বলতে মন সরে না। চোর-ডাকাতরাও ঘর ছেড়ে এক পা নড়ে না এমন রাতে। কিন্তু উপায় নেই। লিটা খুলল দরজার। একটা পাল্লা খুলতেই সারা গা হিম হয়ে গেল। টাঙ্গিটা কাঁধে ফেলে, লাঠিটা ডান হাতে নিল। আর বাঁ-হাতে লণ্ঠনটা। তারপর দরজাটা টেনে ভেজিয়ে দিয়ে বাইরে বেরোতে যাবে, এমন সময় মুঞ্জরী ঘুমভাঙা গলায় বলল, কওন্ চি?
মানি স্বগতোক্তির মতো বলল, খরগোশ।
মুঞ্জরী একটা পুরুষ-সুলভ অশ্লীল গাল দিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল একবার। তারপর পাশ ফিরে শুলো গুটি-শুটি হয়ে।
এই পাহাড়-জঙ্গলের শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা, এই খিদে, বছরের পর বছর এই অভাব মুঞ্জরীকে হিজড়ের মতো রুক্ষ করে দিয়েছে। সবই মানিয়ার দোষে। তার মরদের দোষ। যে মরদ আওরাতকে সুখে রাখতে পারে না, সে আবার মরদ কীসের?
লণ্ঠনটা হাতে নিয়ে যখন চীনেবাদামের ক্ষেতে পৌঁছল মানি, তখনও খরগোশগুলোর ভ্রূক্ষেপ নেই। পাট্কিলে-রঙা ধেড়ে দুশমনগুলো প্রায় আধখানা ক্ষেত সাবড়ে দিয়েছে। দেখেই অন্ধ ক্রোধে দৌড়ে গেল মানি। ধপাধপ্ লাঠি পিটল। যেন লাঠি দিয়েই ও মারতে পারবে ওদের। এবং ওর অন্য সমস্ত শত্রুদেরও।
দৌড়োতে গিয়ে, একটা গর্তে পা পড়ে, আছাড় খেল। বুকে চোট লাগল খুব। কিন্তু বুঝতে পেল না তেমন। সারা শরীর ঠান্ডায় অবশ হয়ে গেছে। লণ্ঠনটা ছিট্কে পড়ে গেল ওর হাত থেকে। কাচটা কোনোক্রমে বাঁচল। কিন্তু আলো নিভে গেল। উল্টে গিয়ে তেল গড়াতে লাগল। হামাগুড়ি দিয়ে গিয়ে হাতড়ে হাতড়ে লণ্ঠনটাকে সোজা করল মানিয়া। কেরোসিন তেল গড়ানোর চেয়ে ওর বুকের রক্ত গড়ানোও যে ভালো। লণ্ঠনটা হাতে নিয়ে যখন উঠে দাঁড়াল তখন খরগোশ সব পালিয়ে গেছে। ঢুকে গেছে লিপিটিয়ার ঝোপ পেরিয়ে ওপাশের ঢালের গভীর জঙ্গলে। একচিলতে চাঁদ মারমারের ঢালের দিকের আকাশে ঝুলে ছিল। চাঁদটাও শিশির লেপে কুঁকড়ে গেছে বলে মনে হচ্ছিল। পশ্চিমের চড়াই থেকে হঠাৎ হাতি ডেকে উঠল। বন-পাহাড় সেই তীক্ষ্ণ ও সংক্ষিপ্ত আওয়াজে চমকে উঠল। শিশির-ভেজা বনপাহাড়ে শব্দটা অনেক দূর অবধি গড়িয়ে গেল। ঝিঁ-ঝিঁ ডাকতে থাকল। একটা একলা টি-টি পাখি হুলুক্ পাহাড়ের দিক থেকে ডাকতে ডাকতে এদিকে উড়ে আসতে লাগল। জঙ্গলে কোনো চলমান কিছু দেখে থাকবে পাখিটা। শিশির-ভেজা আধ-ফোটা চাঁপাফুলের মতো আবছা-হলুদ ভিজে আলোয় পথ দেখে আবার ঘরে ফিরে এল মানিয়া। তারপর আগুনের মাল্সাটার ওপরে পায়খানায় বসার মতো করে বসল। পিছনটা ভালো করে সেঁকে নিল। ওর নাক দিয়ে জল গড়াচ্ছিল। হিমে নাকের ডগাটা যেন খসে গেছে। হাত দুটো প্রাণপণ ঘষতে থাকল। সেঁকা পাঁপড়ের সঙ্গে অন্য সেঁকা পাঁপড় ঘষলে যেমন আওয়াজ হয়, মানিয়ার হাত ঘষার তেমনি আওয়াজ হল।
পরেশনাথের বোধহয় ঘুম ভেঙে গেল। অস্ফুটে বলে উঠল, বাবা!
কিছু না রে, কিছু না। ঘুমো তুই! বলেই, মানিয়া ঘুমন্ত পরেশনাথের পিছনে আদরের চাপড় দিল। এই ‘বাবা’ ডাকটা মানিয়ার বুকের মধ্যে আজকাল কী-সব পাথর বাঁধা জিনিস তোলপাড় করে দেয়। শক্ত বড় কঠিন অনেক কিছু বোধ যেন বুকের মধ্যে গলে যেতে থাকে। প্রথম যৌবনে ও কখনও ছেলেমেয়ের প্রতি এমন অন্ধ টান অনুভব করেনি। আগুন সেঁকতে-সেঁকতে মানিয়া বুঝতে পারছিল, ও বুড়ো হয়ে আসছে। ওর দিন ফুরিয়ে আসছে। লণ্ঠনে তেল শেষ। এইবার দপ্ করে জ্বলে উঠেই, কোনো একদিন হঠাৎ নিভে যাবে মানি ওরাওঁ।
কিছুক্ষণ আগুন সেঁকে পরেশনাথের গায়ের সঙ্গে ঘেঁষে কাঁথাটা সর্বাঙ্গে জড়িয়ে নিয়ে শুয়ে পড়ল মানিয়া।
নাবালক ছেলের ধুলো মাখা গায়ের গন্ধে নিজের নাক ভরে নিয়ে মানিয়া ভাবতে লাগল, যদি বেঁচে থাকে, তবে আর কয়েক বছর বাদেই ও নিশ্চিত বিশ্রাম পাবে। মাদল বাজাবে, বড় জোর বজ্রা ক্ষেতে রাতের বেলায় মাচায় বসে শুয়োর হরিণ তাড়াবে, নয়তো দিনের বেলা সুগা তাড়াবে, মকাইয়ের ক্ষেতে সবাই ঘাসের মাদুর বানাবে আর সারাদিন রোদে বসে থাকবে। বস্তির বুড়োরা যেমন থাকে! তখন খুব করে রোদ পোয়াবে মানি। ওর একমাত্র ছেলে, বেটা, ওর বংশধর, ওর মরা-মুখে আগুন দেওয়ার জন্য দেখতে দেখতে জোয়ান যুবকে রূপান্তরিত হবে। সেদিন ওর জোয়ান লেড়কার ভরসা করতে পারবে মানিয়া। মানিয়া আজকাল প্রায়ই অনুভব করে পরেশনাথই ওর বীজ, বার্ধক্যের অভিভাবক রক্ষাকর্তা, ওর ভরন্ত ভবিষ্যৎ।
এতসব ভাবতে ভাবতে ঐ শীতের রাতেও মানিয়ার গা গরম হয়ে উঠল। ভালো লাগল খুব, ভবিষ্যতের কথা ভেবে। তারপরই, খারাপ লাগল হঠাৎ। চীনাবাদামগুলো সব গেল। যতটুকু বাকি আছে, তাও যাবে কয়েক রাতের মধ্যে। অথচ করার নেই কিছুমাত্র। নিজের ঔরসজাত পরেশনাথের গায়ের গন্ধে বুঁদ হয়ে ঐ প্রচণ্ড শীতার্ত অস্পষ্ট ভিজে রাতে, এক দারুণ সূর্যভরা উজ্জ্বল, উষ্ণ, স্পষ্ট ভবিষ্যতের কথা ভাবতে ভাবতে একসময় মানিয়া ওরাওঁ যখন ঘুমিয়ে পড়ল, তখন নালার মধ্যের মৈথুনরত শেয়ালরা হুক্কা হুয়া রবে মধ্যরাত ঘোষণা করল।