কোজাগর – ১৯

১৯

বইটা অনেকদিন হলো পড়ে আছে। রথীদার কাছ থেকে পড়তে এনেছিলাম। কিন্তু পড়া হয়ে ওঠেনি। আজ সকালে পড়া আরম্ভ করে শেষ করে ওঠা পর্যন্ত এবং তার পরও একটা ঘোরের মধ্যে আছি যেন। যে জগতকে ভালো করে জানি, এই অরণ্যানী ঝোপ-ঝাড়, ফুল-লতাপাতাকে, যাদের সঙ্গে এক নিবিড় একাত্মতা বোধ করে এসেছি চিরদিন, যাদের ভালোবেসেছি, তাদের প্রাণবন্ততার প্রকৃত স্বরূপ যে কী এবং কতখানি সে সম্বন্ধে কোনো স্পষ্ট ধারণা ছিল না।

গাছের অনুভূতি ও সাড়া দেবার ক্ষমতা যে আছে এ-কথা তো অনেকদিন আগেই আমাদের জানা। তারপর এ বিষয়ে কতদূর কী গবেষণা হয়েছে। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে, তার কোনো খোঁজই রাখিনি। রাখার কথাও ছিল না। বাঁশবাবু আমি। বাঁশ কাটি, ট্রাকে লাদাই করি, ইয়ার্ডে চালান দিই। আমার বিদ্যা-বুদ্ধিও এমন নয় যে, এসব বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার খোঁজ রাখতে পারি, সমস্ত রকম শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত এরকম জংলি জায়গায় বসে। তবে এই বইটি না পড়লে বঞ্চিত হয়ে থাকতাম এক মস্তবড় জানা থেকে। বইটির নাম : ‘দ্যা সিক্রেট লাইফ অফ প্লান্ট্স।’ যুগ্ম লেখক, পিটার টর্কিনস্ এবং ক্রিস্টোফার বার্ড।

এ বিষয়ে, মধ্যযুগ অবধি অ্যারিস্টটলের বক্তব্যই নাকি চালু ছিল। তাঁর মত ছিল গাছ-গাছালির প্রাণ থাকলেও অনুভূতি নেই। এরপর আঠারোশো শতাব্দীতে কার্ল ভন্ লিনে বললেন যে, গাছ-গাছালির প্রাণ আছে কিন্তু জীবজন্তু ও মানুষদের সঙ্গে তাদের তফাত এই-ই যে, তারা অনড়। চলাচলের ক্ষমতারহিত। লিনেরও পর উনিশশো শতাব্দীতে, পৃথিবী বিখ্যাত চার্লস ডারউইন্‌ লিনের মতকে উল্টে দিয়ে বললেন যে, উদ্ভিদরা মানুষ এবং জানোয়ারদের মতোই। তারা যে চলচ্ছক্তিহীন এ কথা ঠিক নয়। তবে তারা এই শক্তিতে তখনই শক্তিমান হয়ে তা প্রয়োগ করে; যখন তাদের সুবিধার জন্যেই তা করা প্রয়োজন মনে করে। বিনা প্রয়োজনে তারা চলাফেরা করে না। বিংশ শতাব্দীর গোড়াতে ভিয়েনার গুণী বৈজ্ঞানিক রাওল ফ্রাঁসে সবাইকে আবারও চমকে দিয়ে প্রথম বললেন যে, তা মোটেই নয়। গাছপালারা জীবজন্তু বা মানুষের মতোই সমান সৌন্দর্যের সঙ্গে, সমান অবলীলাতেই নড়াচড়া করে। তবে তারা তা এত আস্তে আস্তে করে যে, মানুষের চোখে সহজে তা ধরাই পড়ে না আমরা তেমন লক্ষ করে দেখি না বলেও। ফ্রাসেই প্রথম বললেন যে, এমন একটি উদ্ভিদ নেই যা গতিরহিত। একটি গাছ বা লতার বেড়ে উঠে পূর্ণাবয়ব হওয়ার মধ্যেই এক সুষম ছন্দোবদ্ধ সামগ্রিক গতিপ্রকৃতি নিহিত আছে। একটি লতানো লতা যাতে ভর দিয়ে লতিয়ে উঠবে তেমন ভরযোগ্য নিকটতম কিছুর দিকে গুড়ি মেরে এগোয়। যদি সেই ভরযোগ্য জিনিসটি সরিয়ে নেওয়া যায়, তবে দেখা যায় যে, লতাটিও মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যে মুখ ঘুরিয়েছে। তবে কি তারা দেখতে পায়? ওদের কি চোখ আছে? দুটি বাধার মধ্যে যদি কোনো লতাকে পুঁতে দেওয়া যায় তো দেখা যায় যে, সেই লতাটি বাধাগুলো এড়িয়ে নতুন কোনো ভরযোগ্য জিনিসের প্রতি ধাবমান হচ্ছে। এমন কী এও দেখা যায় যে, দৃষ্টির আড়ালে লুকিয়ে রাখা কোনো ভরযোগ্য জিনিসের প্রতিও সে এগিয়ে যাচ্ছে নির্ভুল ভাবে।

শুধু তাই-ই নয়, ফ্রাসের মতে, গাছ-গাছালি লতাপাতা সকলেই তাদের ইচ্ছামতো নড়ে চড়ে। তারা যা চায় সেই চাওয়া পাওয়াতে পর্যবসিত করতে তাদের যতটুকু কম বা বেশি চলা-ফেরা করা প্রয়োজন তা তারা নির্দ্বিধায় করে। ওদের এই ইচ্ছা ও চাওয়া-পাওয়ার ব্যাপার-স্যাপার মানুষের ইচ্ছে বা চাওয়া-পাওয়ার চেয়েও অনেক বেশি সফিস্টিকেটেড। ওরা বুঝতে পারে কোন্ পিঁপড়েরা ওদের রস চুরি করবে। যেই তেমন জাতের পিঁপড়েরা ওদের কাছাকাছি আসে, তখনই তারা তাদের নিজেদের বুজিয়ে ফেলে। যখন আবার খোলে, তখন শিশিরে ভেজা থাকে ওদের গা। পিঁপড়েরা তখন পিছল গা বেয়ে আর উঠতে পারে না।

আফ্রিকার অ্যাকাসিয়া গাছেদের মধ্যে যারা বেশি সফিস্টিকেটেড, তারা এমন কোনো কোনো জাতের পিঁপড়েদের আকর্ষণ করে নিয়ে আসে যে, সেই জাতের পিঁপড়েদের কটুস্ কুটুস্ কামড়ের ভয়ে রস-চুরি-করা অন্যজাতের পিঁপড়ে বা জিরাফ বা অন্য জানোয়ার সেই গাছেদের এড়িয়ে চলে। নিজেদের বাঁচাতে ওরা নিজেদের গায়ে কাঁটার সৃষ্টি করেছে যুগ-যুগান্তর ধরে। প্রকৃতিতে যা কিছু ঘটে, তার পিছনে নিশ্চয়ই কারণ থাকে। “লজ্জাবতী” লতারা তারা তাদের গায়ে পিঁপড়ে বা অন্য পোকা-মাকড় ওঠা মাত্র বা মানুষের আঙুলের ছোঁওয়া পাওয়া মাত্র মাথা লম্বা করে উঁচু হয়ে গিয়ে হঠাৎ পাতা গুটিয়ে ফেলে। আর ঐ অপ্রত্যাশিত আলোড়নে পিঁপড়ে বা পোকারা ভয় পেয়ে গড়িয়ে নিচে পড়ে যায়।

পৃথিবীতে পাঁচশরও বেশি মাংস-ভোজী প্ল্যান্টস্ আছে। জলা জায়গাতে তারা নাইট্রোজেন পায় না বলেই মাংসাশী হয়ে ওঠে। মাংসাশী গাছেদের শুধু মুখই নেই, পেটও আছে এবং তাদের শরীরে এমন সব যন্ত্রপাতি আছে যা দিয়ে তারা শুধু জীবন্ত প্রাণী শিকারই করে না, রক্ত, মাংস, চামড়া, মেদ বেমালুম হজম করে শুধু কঙ্কাল ফেলে রাখে।

গাছপালা লতাপাতা যে চেহারায়, যে আকৃতিতে বেড়ে ওঠে, তাতে তাদের আকৃতিগত উৎকর্ষ আমাদের মেধাবী ইঞ্জিনিয়রদেরও লজ্জা দেয়। ঝড়, তুফান, হ্যারিকেন, সাইক্লোন সব কিছুই সহ্য করে তারা তাঁদের নরম, আপাত-ভঙ্গুর সাবলীল শরীরে। মানুষের তৈরি বাড়ি-ঘর-বহুতল প্রাসাদ, কখনওই এমন নমনীয় অথচ দৃঢ় হয় না। গাছ যেমন ওপরে বাড়তে থাকে তেমনই সঙ্গে সঙ্গে সে ঘন হতে থাকে ডালপালায়; হাত-পা ছড়াতে থাকে দুধারে। আপাতদৃষ্টিতে আমরা দেখতে পাই না, কিন্তু ভালো করে তাকালেই দেখা যায় যে, একটি গাছের শরীরের মধ্যে মাধ্যাকর্ষণ ও বিপ্রকর্ষণের এক আশ্চর্য সুন্দর ভারসাম্য আছে।

মিসিসিপির প্রেইরি অঞ্চলে একরকমের সূর্যমুখী ফুল ফোটে। শিকারিরা সেই ফুল প্রথমে আবিষ্কার করেন। সেই ফুলের পাতারা নির্ভুলভাবে কম্পাসের কাঁটার দিক নির্দেশ করে। ইনডিয়ান লিকেরিস, যার বটানিকাল নাম, আরব্রাস প্রেকাটরিয়াস্; সমস্ত রকম বৈদ্যুতিক ও চৌম্বক অনুভূতিগুণসম্পন্ন। সবচেয়ে প্রথমে লান্ডানের কিউ গার্ডেনে (বটানিকাল গার্ডেন) উদ্ভিদ বিজ্ঞানীরা পরীক্ষা করে দেখেছিলেন যে, এই গাছেরা সাইক্লোন, হারিকেন, টর্নাডো, ভূমিকম্প, আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত এসব কিছু ঘটবার অনেক আগেই তার আভাস পায়। আবহাওয়াবিদরা এখন এদের সাহায্য নিয়ে থাকেন।

ফ্রাঁসে এও বলেছেন যে, গাছদের আমাদের চোখের চেয়েও সূক্ষ্ম ও তীব্র দৃষ্টিসম্পন্ন চোখ আছে। আমাদের চোখে যা ধরা পড়ে না সেই সব আলট্রাভায়োলেট ও ইনফ্রারেড রঙও তারা দেখতে পায়। তাদের কানে এমন সব সূক্ষ্ম শব্দতরঙ্গ ধরা পড়ে, যা আমাদের কানে পৌঁছয় না। শুধু তাইই নয়, গাছপালা লতা-পাতারা এক্স-রে এবং হাইফ্রিকুয়েন্সি টেলিভিশনের শব্দ-তরঙ্গতেও বিশেষ ভাবে সাড়া দেয়।

আমাদের ধর্ম, আমাদের সংস্কৃতি যে কত গভীর, কত প্রাচীন, কত দূরদৃষ্টিসম্পন্ন তা বারবার নতুন করে মনে হয়; যখন দেখি এই ফ্রাঁসের মতো বৈজ্ঞানিকেরও অবশেষে হিন্দু ধর্ম ও সাধুসন্ন্যাসীর শরণাপন্ন হতে হয়। বছর পঞ্চাশ আগে, যখন ফ্রাঁসে উদ্ভিদবিজ্ঞান সম্বন্ধে এইসব তথ্য প্রকাশ করলেন এবং বললেন যে, গাছেরাও ভালোবাসে এবং মানুষের ভালোবাসা ও ঘৃণাতে রি-অ্যাকট করে এবং গাছের ও উদ্ভিদজগতের সমস্ত ছোট বড় প্রাণী মানুষের চেয়ে কোনো অংশে ইতর নয়, তখন তাঁকে সকলেই অবিশ্বাস করেছিলেন। এবং ভালোভাবে নেন নি। তৎকালীন পশ্চিমি বৈজ্ঞানিকদের যা মর্মাহত করেছিল, তা হচ্ছে এই যে, ফ্রাঁসে বলেছিলেন উদ্ভিদজগতের এই প্রাণবত্তা, এই আশ্চর্য ক্রিয়াকলাপ, এদের ভালোবাসার ও ঘৃণা করার ক্ষমতা এবং মানুষের সঙ্গে একই ভাবতরঙ্গে মন বোঝাবুঝি; এ সবের মূলে কোনো অতিপ্রাকৃত ব্যাপার আছে। যিশুখ্রিস্টের জন্মের বহু আগে থেকে যে সব রশ্মি-প্রাণী, জিন-পরীদের মতো, হিন্দু-সাধুদের বর্ণিত দেবগণের মতো, এই পৃথিবীর তাবৎ ক্রিয়াকাণ্ডে লিপ্ত আছেন তাঁরাই আসলে উদ্ভিদজগতের এই আশ্চর্য প্রাণশক্তি ও হৃদয়বত্তার কারণ ঘটান। ‘দ্যা সিক্রেট লাইফ অফ প্লান্টস্’-এর লেখক স্বয়ং লিখেছেন : “দ্যা আইডিয়া ওজ কন্সিডার্ড বাই ভেজিটাল সায়ান্টিস্টস্ টু বি এজ চার্মিংলি জেনুইন এজ ইট ওজ হোপলেস্‌লি রোম্যান্টিক্।”

কিন্তু বর্তমানে এই ব্যাপারে যে সর পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে এবং যে সব ফল পাওয়া গেছে, তাতে ফ্রাঁসে যে সত্যদ্রষ্টা ছিলেন তা বোঝা যাচ্ছে। উদ্ভিদজগতের ওপর চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ নক্ষত্রের প্রভাব আছে বলে জানা যাচ্ছে; মনুষ্য-জগতেরই মতো। আমাদের শরীরের জলীভূত উপাদানের মতো উদ্ভিদজগতের প্রত্যেকের শরীরেই জলীভূত উপাদান আছে। এবং এই জলীভূত উপাদানের ওপর গ্রহ-নক্ষত্রের প্রভাব স্পষ্ট। মানুষের জন্ম, জীবন ও মৃত্যু যদি গ্রহনিচয়দ্বারা পরিচালিত হয়, তাহলে উদ্ভিদদেরও তাই-ই হচ্ছে। মানুষদের মধ্যে যাদের বাত আছে তাদের যদি অমাবস্যা ও পূর্ণিমাতে ব্যথা বাড়ে তাহলে বাত-সম্পন্ন গাছপালার গাঁটে গাঁটেও ব্যথা বাড়বে। ব্যাপারটা ভাবতেই আমার গা শিউরে উঠছে। আমি বৈজ্ঞানিক নই, কিন্তু ভগবানে বিশ্বাস আমার জন্মেছে প্রকৃতি থেকেই; প্রকৃতির মধ্যে এতো বছর থাকার কারণে ভগবানে বিশ্বাস জন্মেছে বলেই অমি ইডিয়ট : রোম্যান্টিক ফুল। কিন্তু এই বইটি পড়ে উঠে ভগবানে বিশ্বাস আমার দৃঢ়তর হচ্ছে। আমি যে একটি করৌঞ্জ ফুলের গাছকে ভালোবাসতে পারি অথবা ঠাকুমা-দিদিমার মতো কোনো মহুয়াকে, এবং তারাও যে আমার ভালোবাসায় সাড়া দিতে পারে এবং দেবে, এ কথাটা আমি কাল অবধিও জানতাম না। প্রকৃতিকে আমি ভালোবাসতাম তা সমগ্রতাতে। কোনো বিশেষ গাছ বা লতা বা ফুলকে আমি ভালোবাসি নি। ভালোবাসা যায় যে, তা জানতামও না। জানলাম যে, কোনো বিশেষ গাছের মৃত্যু কামনা করলে সে মরেও যেতে পারে। সে মেয়েদের মতো অভিমানী; তার সামনে দাঁড়িয়ে অন্য গাছের সঙ্গে তুলনা করে তাকে খারাপ বললে, সে অভিমানে, দুঃখে শুকিয়ে যায়। ভাবা যায়?

অল্প ক’দিন অগেই আমি তিতলিকে ঠাট্টা করেছিলাম। শেষ শীতের জঙ্গল থেকে ও মৃতপ্রায় দুটি রাহেলাওলা ফুলের চারা গাছ তুলে এনে একটা রান্নাঘরের বারান্দার সামনে আর অন্যটা কুয়োতলার পাশে লাগিয়েছিল। সেদিন আমি ওকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, কুয়োতলার গাছটা মরে গেল, অথচ রান্নাঘরের সামনের গাছটা সুন্দর বেড়ে উঠল কী করে?

তিতলি বলেছিল, বেশি সময়ই তো’ আমি রান্নাঘরে থাকি, তাই এই সামনের গাছটা সব সময় আমার নজর পায়, ভালোবাসা পায়; মনে মনে সব সময় ওকে বেড়ে উঠতে বলেছি। রান্নাঘরে পিঁড়ি পেতে ওর দিকে মুখ করেই তো’ বসে থাকি আমি। আর কুয়োতলার গাছে চোখ পড়ে যখন শুধু বাসন মাজি তখন। আমি তো’ আর এখানে চান করি না। চান তুমিই করো একা। আর তুমি তো’ আমার দিকে তাকিয়েই একটা ভালো কথা বলো না তার বদসীবি গাছের কথা!

আমি সেদিন হেসেছিলাম ওর কথা শুনে।

বলেছিলাম, দেখিস, তুই আবার যেন শুকিয়ে না যাস!

কিন্তু আজ এই বই পড়ে দেখেছি, এই ঘটনা হুবহু সত্যি। একই গাছ থেকে তিনটি পাতা ছিঁড়ে এক মহিলা একই বাড়ির তিন ঘরের ফুলদানিতে রেখেছেন। একটিকে ভালোবাসা হয়েছে, সকাল-সন্ধে শুভকামনা জানানো হয়েছে। এবং অন্যদের হয়নি। অন্যরা শুকিয়ে গিয়ে মরে গেছে কিন্তু যে ছিন্ন পাতাটিকে মহিলা ভালোবেসেছিলেন সে শুধু বেঁচেই রয়েছে তাই-ই নয়, শরীরের যে অংশ থেকে পাতা ছেঁড়া হয়েছিল, সে জায়গার ক্ষতও প্রায় শুকিয়ে এসেছে।

এই বইতেই একটা চ্যাপ্টার আছে তার নাম : “প্ল্যান্টস্ ক্যান রিড ইওর মাইন্ড।” এই অধ্যায়ের মার্সেল ভোগেল বলে একজন অসাধারণ মেধাসম্পন্ন উদ্ভিদবিজ্ঞানীর কথা আছে এবং বিশদ ভাবে বলা আছে, কীভাবে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্যে দিয়ে নিঃসংশয় হয়েছেন যে, উদ্ভিদজগতের সকলেই আমাদের মন পড়তে পারে। আমরা ভালোবাসলে ওরা ভালোবাসা জানায় স্পষ্টভাবে। আমরা ঘৃণা করলে ওরাও ঘৃণা করে। কে যে ফুল তুলতে বা পাতা ছিঁড়তে যাচ্ছে সে তারা দূর থেকেই বুঝতে পারে। যে গাছ কাটতে এসেছে কুড়ুল নিয়ে, তাকে তারা দূর থেকে চেনে এবং ভীষণ ভয় পায়। মুষড়ে পড়ে। যখন কাটা-গাছ পড়ে যায় মাটিতে তখনও গাছেদের এত কষ্ট হয় না; যতটা হয়, কেউ গাছ কাটবে বুঝতে পারলে। একেবারে আমাদের মতো। মৃত্যুর সময়টার চেয়ে যেমন মৃত্যু-ভয় আমাদের অনেক বেশি পীড়িত করে।

পঞ্চাশ বছর আগে ফ্রাঁসে যা বলে “হোপলেস্‌লি রোম্যান্টিক” আইডিয়ার জনক বলে পরিচিত হয়েছিলেন—সেই কথাই নতুন করে পৃথিবীকে শোনালেন বিংশ শতাব্দীর এই দশকে মার্সেল ভোগেল। উনি বললেন, ফ্রাঁসের মতটি শুধু মাত্র সাজেশসান্ নয়, আ ফাইন্ডিং অফ্‌ ফ্যাক্ট। ভোগেল বললেন : “আ লাইফ ফোর্স, আর কমিক্ এনার্জি, সারাউন্ডিং অল্ লিভিং থিংগস্ ইজ শেয়ারেবল এমাঙ্গ প্লান্টস্, অ্যানিম্যালস্ এন্ড হিউম্যানস্। গ্লু সাচ শেয়ারিং আ পার্সন অ্যান্ড আ প্লান্ট বিকাম ওয়ান। দিস ওয়াননেস্ মেকস্ পসিবল আ মিউচুয়াল সেন্সিটিভিটি অ্যালাওয়িং প্লান্ট অ্যান্ড ম্যান নট ওনলি টু ইন্টারকম্যুনিকে; বাট টু রেকর্ড দিজ কম্যুনিকেশানস্ ভায়া দ্য প্লান্ট অন আ রেকর্ডিং চার্ট।”

একজন জার্মান মিস্টিক ছিলেন। তাঁর নাম ছিল জ্যাকব বোমে। তিনি বলতেন যে, একটি বাড়ন্ত গাছ বা লতার দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে, হঠাৎ ইচ্ছে করলে তিনি সেই গাছের বা লতার সঙ্গে একাত্ম হয়ে যেতে পারতেন এবং তার সঙ্গে মনে মনে অঙ্গীভূতও হতে পারতেন। তখন তিনি অনুভব করতে পারতেন সেই উদ্ভিদসত্তার সংগ্রাম। তার আলোর দিকে ধাবিত হওয়ার জীবনসংগ্রাম তিনি স্পষ্ট বোধ করতেন তাঁর মনে, কল্পনার শরীরেও। তখন তিনি সেই গাছ বা লতার উচ্চাশার ভাগীদার হতেন, পুরোপুরি আলোর দিকে, সবুজ পাতার বা লতার দিকে হাত বাড়িয়ে।

জ্যাকব বোমে বলতেন, “হি ইউজড্ টু রিজয়েস উইথ্ আ জয়ালি গ্রোয়িং লিফ্।”

হিন্দু শাস্ত্রে আছে যে, লম্বা হাই তুলে মানুষ নিজেকে নতুন শক্তিতে ভরপুর করে নিতে পারে। যে-শক্তি সমস্ত এনার্জির উৎস। হিন্দু দর্শনের দুজন অল্পবয়সি . আমেরিকান ছাত্র, ভোগেল-এর বক্তব্য অনুসরণ করে উদ্ভিদজগৎ নিয়ে পরীক্ষা- নিরীক্ষা চালাতেন। একদিন ক্লান্ত হয়ে তাঁরা ল্যাবরেটরিতে বসে রয়েছেন, এমন সময় ওঁদের মধ্যেই একজন হাই তুললেন। হাই তুলতেই ল্যাবরেটরির মধ্যের একটি গাছ নেই হাইটি কুড়িয়ে নিল—জীবনীশক্তি হিসেবে। ওঁরা বিশ্বাস করেননি। তবু ব্যাপার পুরো অলীক বলে উড়িয়ে দিয়ে এই ঘটনা নিয়ে তাঁরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে গিয়ে আবিষ্কার করলেন যে, প্রত্যেক পাতার কোষে কোষে এক বৈদ্যুতিক এনার্জি বা জীবনীশক্তি ঘুরে বেড়াচ্ছে। এই নিরীক্ষা ওঁরা, ডঃ নর্মান গোল্ডস্টিন বলে ক্যালিফর্নিয়ার এক প্রফেসারের সাহায্য নিয়ে করেছিলেন একটি আইভি লতার ওপর। বর্তমানে ফন্টেস্ নিটেল্লা বলে একরকমের জলজ উদ্ভিদের ওপর পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাচ্ছেন এই ব্যাপারেই।

প্যাট্ প্রাইস্ বলে পুলিশের একজন প্রাক্তন বড়কর্তা এবং টেস্ট পাইলটের সাহায্যও নিয়েছেন ফন্টেস্ তাঁর মনের বিভিন্ন ভাবের ক্রিয়া নিটেল্লার ওপর ঘটাতে পারেন। নিটেল্লা লতাটি প্রাইসের মনের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ভাবনার তরঙ্গে সঙ্গে সঙ্গে সাড়া দিচ্ছে। এখন ফন্টেস্, ডঃ হাল পুটোফ্ নামে একজন পদার্থবিজ্ঞানী এবং প্রাইসের সহযোগিতায় দেখতে চাইছেন যে, প্রাইস্কে বহুদূর ধরা যাক, হাজার মাইল দূরে নিয়ে গেলেও তাঁর মনের ভাবনা ও ভাবতরঙ্গ নিটেল্লার ওপর প্রতিফলিত হয় কি না!

সামনে থাকলে একেবারে নির্ভুলভাবেই সাড়া দিচ্ছে নিটেল্লা।

হাজার মাইল দূর থেকেও কি তেমনি করেই দেবে?

একরকমের অর্কিড আছে, যাদের বটানিক্যাল নাম “ট্রিকোচেরোস্ পার্ভিফ্লোরাস।” তারা তাদের পাপড়িগুলোর গড়ন এমন করে তোলে যাতে হুবহু একজাতের স্ত্রী মাছির মতো দেখতে লাগে। ফলে সেই জাতে পুরুষ মাছিরা স্ত্রী মাছি বলে ভুল করে সেই পাপড়ির ওপরে মিলিত হতে চেষ্টা করে এবং তা থেকেই কি অর্কিডের ফুল ফোটে? রাতে যে সব ফুল ফোটে তাদের বেশির ভাগেরই রঙ সাদা হয় কেন? রাতের প্রজাপতি আর মদের আকৃষ্ট করার জন্যই কি? রাতের ফুলেরা তীব্রগন্ধী হয় কেন? অন্ধকারে যাতে গন্ধ চিনে মথ, প্রজাপতিরা আসতে পারে? সেই জন্যে?

আর এক জায়গায় পড়েছিলাম যে, মানুষের মূল ভাবাবেগ ও ক্রিয়াকলাপে উদ্ভিদজগৎ প্রচণ্ডভাবে অনুপ্রাণিত হয়। সে-কারণেই বোধহয় প্রাচীনকালে ক্ষেতে বীজ বোনার পর কোনো দেশে, সেই ক্ষেতেই স্ত্রী ও পুরুষ সঙ্গম করত, যাতে ফসল ভালো হয়।

আমি একা বারান্দার ইজিচেয়ারে বসে বসে ভাবছিলাম পশ্চিমে আকাশের দিকে চেয়ে; সত্যিই কি ফন্টেস্-এর এই পরীক্ষা সফল হবে? সফল হলে আমি তো’ কলকাতা, দিল্লি, বোম্বে যেখানে খুশি বসে আমার ভালুমারের বনজঙ্গলকে এমনি করেই ভালোবাসতে পারব। তারাও তাদের ভালোবাসর তরঙ্গ পাঠাতে পারবে আমার কাছে।

কী আশ্চর্য! ভাবলেও গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠছে।

আজ থেকে কোনো গাছপালার দিকে আর নৈর্ব্যক্তিক চোখে তাকাতে পারবো না। কোনো মানুষের মুখের দিকে, নারীর মুখের দিকে যেমন নৈর্ব্যক্তিক চোখে তাকানো যায় না; তেমন ওদের প্রতিও আর যাবে না। ওরা প্রত্যেকে যে আলাদা! আলাদা ওদের ব্যক্তিত্ব। ওরা ভালোবাসতে জানে, ওরা দূর থেকেও ভালোবাসতে পারে। ওরা দেখতে পায়, শুনতে পায়, ওদের মন আছে। হয়তো ওরা মানুষের চেয়েও ভালো। হয়তো আমাকে দুঃখ দেওয়া নারী জিন্-এর থেকেও অনেক ভালো। মেয়ে গাছেরা কি পৃথিবীর মেয়েদের মতোই দুঃখ দেয়? তেমনই নির্দয় হয় কি তারা?

এই যে উদ্ভাবন, একে কি বলব বৈজ্ঞানিক জয়-জয়কার? না কি বলব, যা আমি চিরদিনই বলি, তাই। এ উদ্ভাবন নয়, এ নিছক আবিষ্কার। যে শক্তি এই লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি গ্রহ নক্ষত্রকে চালিত করেছেন তিনিই সমস্ত প্রাণীকে, জীবকে, গাছকে, লতাপাতাকে এবং মানুষকেও কী অসীম সব ক্ষমতায় সম্পৃক্ত করে পাঠিয়েছেন। আমাদের ব্রহ্মাকেই কি মানতে হয় না? যিনি সৃষ্টিকারী!

একই শক্তি থেকে আমরা সকলে উদ্ভূত হয়েছি, সেই শক্তির নির্দেশে। তাঁরই সামান্য অঙ্গুলিহেলনে আমাদের বিনাশ। যতদিন যাচ্ছে ততই বিজ্ঞান ঝুঁকছে অবিশ্বাস আর নাস্তিক্যবাদ ছেড়ে বিশ্বাস আর আস্তিকতার দিকে। এই অদৃশ্য নিরাকার শক্তির অস্তিত্ব স্বীকার করে নেওয়ার প্রতি বৈজ্ঞানিকদের প্রবণতা দিনে দিনে কি গভীরতর হচ্ছে?

যেদিন এই গ্রহর বৈজ্ঞানিকরা এক বাক্যে স্বীকার করবেন যে, ঈশ্বর বা কোনো শক্তি আছেন এবং তাঁরা বড়ই ঘোরাপথে ভগবানেরই বিভিন্ন সৃষ্টি নেড়ে-চড়ে, কেটে-ছিঁড়ে তাঁর নির্বিবাদ অস্তিত্বের বিশ্বাসে এসে পৌঁছলেন; তখন আমি হয়তো বেঁচে থাকবো না। কিন্তু বেঁচে থাকলে আমার বড়ই আনন্দ হতো।

সূর্য পশ্চিমে হেলেছে। নরম বিষণ্ণ হলুদ আলোয় ভরে গেছে অরণ্যানী, ফসলতোলা ক্ষেত, দূরের টাড়। লাটাখাম্বায় জল তোলার আওয়াজ হচ্ছে ক্যাচোর ক্যাচোর করে। কী শান্তি চারিদিকে! এখানে ঈশ্বর থাকেন আমার মধ্যে; দৃশ্যমান, স্পর্শকাতর সবকিছুর মধ্যে। এ এক খোলামেলা দারুণ মন্দির। দরজাহীন, খিলানহীন, চুড়োহীন। পোকা-মাকড়, প্রজাপতি, মহীরূহ, গাছ, লতা, ঝোপ-ঝাড়, ফুল-পাতা, আমার মতো মানুষ সকলেই। নিত্য তার পুজো, নিঃশব্দে; অলক্ষে।

এই মুহূর্তে আমার ডেরার গেটের পাশের রাধাচূড়া কিছু কি ভাবছে?

কী ভাবছে?

ভারি জানতে ইচ্ছে করছে আমার। নিজেকেও জানতে ইচ্ছে করছে।

“আপনাকে এই জানা আমার ফুরাবে না, ফুরাবে না; সেই জানারই সঙ্গে সঙ্গে তোমায় চেনা।”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *