১৮
সকাল থেকেই আজ হৈ হৈ চলেছে।
গণেশ মাস্টার আর গজেনবাবু এসেছেন চিপাদোহর থেকে জিপ নিয়ে। সঙ্গে গণেশের বারো বছরের এক দূর সম্পর্কের ভাইপো। সে তার মায়ের সঙ্গে এসেছে গণেশের কাছে, পালামৌর শীতে দিন কয় থেকে স্বাস্থ্য ভালো করে ফিরে যেতে। উত্তর কোলকাতার প্রায়ান্ধকার গলির মধ্যে বাস ওদের। উত্তেজনা বলতে, ক্যাম্বিশের বল দিয়ে গলিতে ক্রিকেট খেলা। এবং ফুটবল ক্রিকেট সিজনে একে-ওকে ধরে কোনোক্রমে একটু খেলা দেখা। তাও ক্বচিৎ-কদাচিৎ। তাই ছেলেটি এই বন-জঙ্গলে এসে কী যে করবে ভেবে পাচ্ছে না। এত অ্যাডভেঞ্চার! এত মজা! তার খুশি আর ধরে না। এই বয়সি ছেলেদের মতো প্রাণবন্ত, উৎসাহে ভরপুর ছেলেরা যে কোলকাতার মতো দম-বন্ধ শহরে তাদের প্রাণশক্তি কী ভাবে নিঃশেষ করে, তা সকলেই জানি আমরা। অথচ ওদের জন্যে কিছু মাত্রই করি না। আমরা সকলেই যার যার ভাবনা নিয়ে ব্যস্ত। যার অবস্থা খারাপ তার ভাবনা ক্ষুন্নিবৃত্তির, যেন-তেন প্রকারেণ। যে স্বচ্ছল, তার ভাবনা আরও ধনী হওয়ার। যে রাজনীতি করে, তার ভাবনা নেতা হওয়ার। যে নেতা, তার ভাবনা আরো কত বেশি ক্ষমতা, টাকা ও মেয়াদ করতলগত করা যায়। এই ছেলেদের কথা ভাবার সময় কার আছে?
ছেলেটার নাম বাপি। এই অল্পদিনেই বন-জঙ্গল পাহাড় দেখে ঘুরে বেড়িয়ে তার শারীরিক উন্নতি নিশ্চয়ই হয়েছে। মানসিক অবস্থার হেরফেরও বিলক্ষণ হয়েছে। কোলকাতার ইঁট-চাপা ঘাসের মতো ওর ফ্যাকাসে মনকে এই আলো হাওয়া, এই অসীম আকাশ এক সজীবতা এনে দিয়েছে। বাঁধন থেকে মুক্তি দিয়েছে। কিন্তু গজেনবাবু যেভাবে ছেলেটার কল্যাণে নিরন্তর লেগে আছেন তাতে তার কিছু অবনতিও যে হচ্ছে না এমনও নয়।
গজেনবাবু বললেন, বাপি তুমি ইংরিজি জানো?
বাপি লাজুক মুখে বলল, পড়ি তো! স্কুলে তো ইংরিজি পড়ি।
আচ্ছা, একটা কবিতা বলছি বাংলায় তার ইংরিজি ট্রানস্লেশান কী হবে বলো দেখি? এত লোকের সামনে ছুটিতে বেড়াতে এসে; হঠাৎ পড়াশুনোর মতো নীরব বিষয়ের অবতারণা করায় এবং তার ওপর ট্রানস্লেশান করতে বলায় বাপি একটু নিষ্প্রভ হয়ে গেল। কিন্তু তার অসহায়তা দেখেই গজেনবাবু দ্বিগুণ উৎসাহে বললেন, শোনো,
“বড় বড় বাঁদরের বড় বড় পেট
লঙ্কা ডিঙোতে করে মাথা হেঁট।”
বলো তো দেখি, এর ইংরিজি কী হবে?
বাপি এত শীতেও ঘেমে উঠল। মুখ লাল হয়ে গেল।
গজেনবাবু তখন তাকে রেহাই দিয়ে তার কাকাকে নিয়ে পড়লেন। বললেন, অলরাইট। ভাইপো পরে। আগে, কাকাই বলুক তো দেখি!
গণেশ মাস্টার চিপাদোহর স্টেশানে টক্কা-টরে-টরে-টক্কা করে। ইংরিজিতে চালান-ফালান, রসিদ ইত্যাদি লেখে। ভাষার, সে কথাই হোক আর লেখাই হোক, চর্চা না করলে মরচে পড়ে যায়। যতটুকু ইংরিজি শিখেছিল, তা কবে ভুলে মেরে দিয়েছে। এখানে ইংরিজি খবরের কাগজটা পর্যন্ত পায় না। পেলেও, রাখার পয়সা নেই।
এক ধরনের লোক আছেন, যারা বিনা প্রয়োজনে, ভাল ইংরিজি বলতে পারেন না এমন লোকেদের সঙ্গে খামোখা ইংরিজিতে কথা বলে শ্লাঘাবোধ করেন। তেমনই একজন শহুরে বাঙালি যাত্রী একদিন চিপাদোহর প্লাটফরমে পায়চারি করতে করতে ট্রেন অনেক লেট থাকায় হঠাৎ গণেশ মাস্টারের ঘরে ঢুকে পড়ে বলেছিলেন, হোয়াট্স্ দ্যা ম্যাটার? হোয়েন্ উইল দ্যা প্যাসেঞ্জার ট্রেইন এরাইভ্?
গণেশ মাস্টার ঘেড়ে গিয়ে টেলিফোনে বাঁ কান লাগিয়ে ডানহাত নেড়ে তাঁকে বলেছিল, আর বলবেন না স্যার। নো-রিপ্লাই টেলিফোনিং এন্ড টেলিফোনিং টু বাড়কাকনা এন্ড গেটিং ফেরোশাস। রিয়্যালি ফেরোশাস্।
এই বনে জঙ্গলে এমনিতেই ফেরোশাস্ জানোয়ার অনেকই আছে। তার ওপরে হঠাৎ অ্যাসিস্ট্যান্ট স্টেশান মাস্টারও যদি টেলিফোন করতে করতে ফেরোশাস্ হয়ে ওঠেন তাহলে ভয়ের ব্যাপার বই কি! ভদ্রলোক তক্ষুনি গণেশ মাস্টারকে বলেছিলেন, নো-হারি, নো-হারি টেক্ ইওর টাইম এন্ড প্লিজ লেট দি ট্রেইন কাম এট ইটস্ ওন সুইট উইল। বাট ফর গডস্ সেক্, ডোন্ট গেট ফেরোশাস্।
তার পর দিন থেকেই ‘গেটিং ফেরোশাস্’ কথাটা গজেনবাবুর কল্যাণে চিপাদোহরে চালু হয়ে গেছে।
গণেশ মাস্টার, ভাইপোর সামনে, তাকেও ইংরিজির এমন কঠিন পরীক্ষাতে বসানোয় মনে মনে গজেনবাবুর ওপরে খুবই চটে গেল। তারপর গম্ভীর মুখে বলল, এসব বাঁদরামোর কী মানে হয়? সি পি এম ত এই সব কারণেই ইংরিজি তুলে দিচ্ছে নিচু ক্লাস থেকে। ঠিকই করছে।
আমি অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে ছিলাম। কারণ আমার ইংরিজির জ্ঞান গণেশের চেয়ে সামান্য বেশি হলেও হঠাৎ এমন দুরূহ বাঙলা কবিতার ইংরিজি তর্জমা করা সাধ্যাতীত ছিল।
গজেনবাবু মুখ বিকৃত করে বললেন, বাঁদরের পেটের ইংরিজি জিগগেস্ করলেই যদি বাঁদরামো হয় তাহলে আমার তোমাকে বলার কিছুই নেই।
কী কারণে জানি না, গজেনবাবু মার্সিফুলি আমাকে সে যাত্রা স্পেয়ার করলেন। তারপর উপস্থিত সকলেই যখন ইংরিজি ভাষায় তেমন ব্যুৎপত্তি নেই বলে নীরবে স্বীকার করে নিলেন তখন গজেনবাবু নিজেই গর্ব গর্ব মুখে তর্জমা করলেন।
বললেন, ভেরি ইজি। শোনো বাপি! ট্রানস্লেশান করার আগে বাংলাটা ভালো করে মনোযোগ দিয়ে শুনবে। কী বলেছিলাম আমি তোমাকে?
বাপি বলল : “বড় বড় বাঁদরের বড় বড় পেট
লঙ্কা ডিঙোতে করে মাথা হেঁট।”
গজেনবাবু সিগারেটে গাঁজার কল্কের মতো একটা টান লাগিয়ে বললেন,
“বিগ্ বিগ্ মাঙ্কি, বিগ্ বিগ্ বেলি,
সিলোন জাম্পিং মে-লা-ঙ্ক-লি।”
আমি হেসে উঠলাম।
গজেনবাবু বললেন, এর জন্যেই তো বাঙালির কি হলো না। মুরোদ নেই এক রতি, মস্করা করতে বড়ই দড়। কেন? ঠিক হয় নি ট্রানস্লেশান?
ততক্ষণে বাপি মুখস্থ করে ফেলেছে। ঠিক হয়েছে কী ভুল হয়েছে তা নিয়ে তার বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নেই। তর্জমাটা কিন্তু তার খুবই পছন্দ হয়েছে : বার বার হাত নেড়ে বলে চলেছে :
“বিগ্ বিগ্ মাঙ্কি, বিগ্ বিগ্ বেলি,
সিলোন জাম্পিং মেলাঙ্কলি।”
কোলকাতা ফিরেই পাড়ার বন্ধুদের কবিতাটা বলে তাক্ লাগিয়ে দেবে বাপি।
মানিয়া সকালের দুধ নিয়ে এসেছিল। আর একটু দেরি করেই এসেছিল। বললাম, বড়ী দের্ কর্ দেলী মানিয়া আজ
ও চিন্তান্বিত মুখে বলল, কা করে বাবু, মাহাতো এসেছিল সকালে। নানকুয়ার সঙ্গে আমার বাড়িতেই হাঙ্গামা হল। বড় ভয়ে ভয়ে আছি বাবু। আপনারা একটু দেখবেন। পাগলা সাহেবকেও বলে রাখবেন, আপনারাই আমাদের ভরসা। ঐ নানকুয়া ছোঁড়াটার জন্যে আমাদের সর্বনাশ হবে একদিন।
মানিয়ার বাঁ গালে একটা কালো জন্মদাগ ছিল। বাপি সবিস্ময়ে তাকিয়ে থেকে, গজেনবাবুকে শুধোল, ওটা কীসের দাগ গজেন জেঠু? গজেনবাবু সঙ্গে সঙ্গে বললেন, ভূতের হাতের থাপ্পড়ের দাগ। এখানে কত রকমের ভূত আছে তার খবর রাখো? তোমার গণেশকাকু কিছুই বলে নি? তারপর বললেন, অনেক ভূত, দার্হা ভূত, চুরাই ভূত, ধড়্গগালিয়া ভূত!
গজেনবাবু থামতেই আমি বললাম, গজেন ভূত!
গজেনবাবু হেসে ফেললেন।
বললেন, কেন ওসব কথা বাচ্চার সামনে।
কথাটার একটা ইতিহাস ছিল।
প্রথম জীবনে যখন গজেনবাবু ডালটনগঞ্জে আসেন তখন বেকার ছিলেন। শরৎচন্দ্র বেঁচে থাকলে ওঁর ওই সময়কার ক্যারিয়ার নিয়ে একখানি গজেনকাণ্ড স্বচ্ছন্দে লিখতে পারতেন। সেই সময়ে ডালটনগঞ্জ শহর আজকের মতো ছিল না। বড় বড় গাছে ঘেরা লালমাটির কাঁচা রাস্তায় ভরা একখানি ঘুমন্ত গ্রাম যেন। সেই ঘুমন্ত, শান্ত ডালটনগঞ্জে যখন প্রতি শুক্রবারে হাট-ফিরতি দেহাতি লোকেরা সন্ধের পর বাড়ি ফিরত, কাছারির রাস্তার বড় গাছগুলির ছায়াচ্ছন্ন রাস্তা দিয়ে; তখন গজেনবাবু কোনো গাছের মগডালে বিকেল থেকে উঠে বসে থাকতেন। আর ওরা নিচে এলেই, গাছের ডাল ঝাঁকিয়ে : “ভুখু ভুখু খাঁ খাঁ, খাঁবো খাঁবো!” বলে চিৎকার করে উঠতেন। অমনি বেচারিরা মাঈরে, বাপ্পারে, দার্হারে বলে যে যার পুঁটলি ফেলে দিয়ে প্রাণের দায়ে পড়ি-কি-মরি করে দৌড়ে পালাতো। তখন গজেন ভূত গাছ থেকে নেমে পুঁটলিগুলো জড়ো করে বাড়িতে ফিরে আসতেন। তবে, লাভ বিশেষ হতো না। গরিব দেহাতিদের বেশি কিছু কেনার সামর্থ্যই থাকত না। কারো পুঁটলিতে একটু ছাতু, কারো নুন, কারো বা একটু আটা, কারো দুটো বেগুন, একটা লাউকি এই-ই সব। মাঝে মধ্যে কারো পুঁটলি থেকে ছেঁড়া জুতোও বেরুত। যা পেতেন তাই-ই সই। নাই মামার চেয়ে কানা মামা ভালো ছিল সেই সব দিনে।
যে ক্ষণজন্মা মানুষ ভূতের নাম ভাঙিয়েও খাওয়ার সাহস রাখেন তাঁকে মানুষ হয়েও ভয় না পেয়ে আমাদের কারোই উপায় ছিল না। কিন্তু গজেনবাবুর চরিত্রের অন্য একটা দিকও ছিল। সে-দিকটার কথা না বললে মানুষটির প্রতি অবিচার করা হয়। বহু বছর আগে ডালটনগঞ্জ শহরে একজন পাঞ্জাবি ভদ্রলোক একটি দিশি বিস্কুটের কারখানা করেছিলেন। গজেনবাবু তার কম্পিটিটর বনে গেলেন একটি বিস্কুটের কারখানা খুলে। হাতে-পায়ে ঠেসে ঠুসে ময়দা মাখা হতো। তাতে ময়ান টয়ান দিয়ে, ভালো করে লঙ্কার গুঁড়ো দিয়ে, বিস্কুট তৈরি হতো একেবারে বিশুদ্ধ দিশি প্রক্রিয়ায়। গজেনবাবুর কাছে যা শুনেছি তাতে আমি নিশ্চিত যে, মাঝে মাঝে তাঁর ম্যানেজারের লালরঙা দাড়িওলা রামছাগলের ছাগলাদ্যও বিস্কুটের সঙ্গে অনবধানে মিশে যেত। যখন দেখা গেল ক্রেতারা বলছে, এই বিস্কুটের অতিরিক্ত গুণ হচ্ছে এই-ই যে, তাঁর বিস্কুট মৃদু জোলাপের কাজও করে, তখন নিয়মিতই অনুপাতমতো ছাগলাদ্য মেশানো হতো। রামছাগলকে মাঝে মাঝে জোলাপ খাইয়ে যাতে ছাগলাদ্যর পরিমাণ বাড়ে তার চেষ্টাও করা হতো। পাঞ্জাবি ভদ্রলোককে গজেনবাবু পথে বসিয়ে দিলেন আরও একটি মারাত্মক হরকৎ করে। তাঁর কারখানার বিস্কুটের প্যাকেটে বজ্রঙ্গলীর ছবি ছেপে দিয়ে। প্যাকেটের ওপর ছাপা হল, হনুমানজি একটি বিস্কুটের গন্ধমাদন পর্বত হাতে করে উড়ে চলেছেন লেজ উঁচিয়ে। উত্তর কোলকাতার ব্রিলিয়ান্ট্ বাঙালি রেন্। গজেনবাবুর সঙ্গে হরিয়ানার সাদামাটা আড়িয়া পাঞ্জাবি পেরে উঠবেন কেন? হৈ-হৈ করে বিক্রি হতে লাগল বিস্কুট। গজেনবাবুর বিস্কুট খেয়ে ঠোঁট জ্বলে গেলেও, সরল, ধর্মপ্রাণ, দেহাতি লোকেরা বজ্রস্বলীর ছবিওলা প্যাকেট দেখে সেই বিস্কুটই কিনতে লাগল। তার ওপর ছাগলাদ্যর কী যে অ্যাডিশনাল এফেকট্ হতো তা কবরেজ মশাইরাই ভালো বলতে পারবেন।
কোলকাতায় সবে তখন নিওন-সাইন বেরিয়েছে—বিজ্ঞাপনে। কোলকাতা থেকে অডার দিয়ে গজেনবাবু নিওনের আলো আনালেন ডালটনগঞ্জে ফার্স্ট। সবুজ-রঙা হনুমানজি হলুদ বিস্কুটের গন্ধমাদন পর্বত হাতে দাঁড়িয়ে আছেন, আর তার লাল লেজ একবার উঠছে আর একবার নামছে।
ভিরমি খেয়ে গেলো লোকে। এমন মোক্ষম এবং এফেক্টিভ ক্রিয়েটিভ বিজ্ঞাপন তার আগে এ অঞ্চলে আর কেউই দেখেনি। বেচারি পাঞ্জাবি ভদ্রলোক! স্ত্রী ও ছেলে-মেয়ে নিয়ে উপোস যেতে লাগলেন। আর গজেনবাবুর তখন বৃহস্পতি তুঙ্গে। মার মার কাট্ কাট্ ব্যাপার। এমন সময় একদিন সেই ভদ্রলোকের স্ত্রী, ছেলেমেয়ের হাত ধরে এসে গজেনবাবুর কাছে একবারে কেঁদে পড়লেন। অমন যে রম্রমে ব্যবসা বিস্কুটের গন্ধমাদনের মতো টাকার গন্ধমাদন গড়ে উঠতে শুরু করেছে তখন গজেনবাবুর ঘরে, সেই ব্যবসা সেই দিন থেকেই এক বাক্যে তুলে দিলেন তিনি। ভদ্রমহিলাকে বললেন, ভাবিজি, আপ বেফিক্কর্ রহিয়ে। কাসে হামারা কারখানা বরাব্বরকে লিয়ে বন্ধ
সেদিন থেকে কারখানা সত্যি সত্যিই বন্ধ করে দিয়েছিলেন গজেনবাবু।
গজেনবাবুরা যে খাসির মাংস এনেছিলেন, তিতলি তাই-ই কষা মাংসের মতো করে রেঁধেছিল। গরম রুটি, কষা মাংস আর লেবুর আচার! এই মেনু ঠিক হয়েছিল দুপুরে। এমন সময় রামধানীয়া চাচা এসে হাজির। শালপাতাতে মুড়ে আধকেজি খানেক গড়াই মাছ নিয়ে। কোথাকার পাহাড়ী নালাতে ধরেছিল। আর কিছুটা চালোয়া মাছ। গড়াই, শোল মাছের মতোই দেখতে হয়, খেতেও। আর চালোয়া তা পুঁটির মতোই দেখতে।
গজেনবাবু বললেন, জীতে রহো চাচা!
তারপর তিতলিকে বললেন, লঙ্কার ফোড়ন দিয়ে সামান্য একটু হলুদ দিয়ে, নুন দিয়ে সেদ্ধ করে দে তো তিতলি শিগিরি।
তারপরই আমার দিকে তাকিয়ে, গলা নামিয়ে বললেন, একটু মহুয়া আনান না স্যার। চালোয়া মাছ দিয়ে মহুয়া যা জমবে না! আপনি স্যার আমাদের একেবারেই পাত্তা দেন না। ন মাসে ছ’মাসে আসি। তবুও।
বাপির দিকে চোখ ঠেরে, ওঁকে থামতে বললাম।
কিন্তু চোরা না শোনে ধর্মের কাহিনি!
বললেন বাপি? বাপিও কি একটু মহুয়া খাবে নাকি হে গণেশ মাস্টার?
গণেশ মাস্টার বাপির সামনে কী বলবে ভেবে না পেয়ে হঠাৎ বলে ফেলল, মহুয়া তো শম্বরে খায়, ভাল্লুকে খায়। গজেনবাবুও খান নাকি?
.
গজেনবাবু পকেট থেকে টাকা বের করে রামধানীয়াকে দিতে গেলেন। বললেন, লাও তো’ চাচা।
ওঁকে মান্য করে, আমি ঘরে গিয়ে টাকা এনে দিলাম। ঘরের মধ্যে থেকে শুনলাম, গজেনবাবু বাপিকে বলেছেন : শোনো বাপি, তোমাকে বলি। মহুয়া এক রকম ফল। ঐ যে মস্ত বড় ঝাঁকড়া গাছটা দেখেছো, ঐ গাছটার নাম মহুয়া। যখন বড় হবে, তখন পড়বে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও এই গাছটাকে কত ভালোবাসতেন। ভালোবাসতেন বলেই একটা বই লিখেছিলেন তিনি এই গাছ সম্বন্ধে। এবং তার নামও দিয়েছিলেন “মহুয়া”। বলেই গণেশের দিকে ঘুরে বললে, কী হে মাস্টোর? তুমিও কি এ তথ্য জানতে? বাপির কাকা? আমাকে সবসময়ই তোমরা আন্ডারএস্টিমেট করে গেলে।
ভাগ্যিস গজেনবাবু বলেননি যে, রবীন্দ্রনাথও মহুয়া ভালোবাসতেন বলেই বইয়ের নাম রেখেছিলেন মহুয়া
এই গাছগুলোই এখানের প্রাণ। গরমে প্রথমে এর ফল ফলে। গোল গোল, ঠিক গোল নয়, নিচের দিকটা একটু লম্বাটে, হলদে সাদা, সাদা রঙ ফলগুলোর। হাওয়ায় হাওয়ায় তখন কী যে মিষ্টি গন্ধ ভাসে তা…
আমি বলালম, ভাসে যে তারপর?
.
গজেনবাবু বাঁ হাতটা হাওয়ায় নাড়িয়ে বললেন, তখন মনটা কী রকম করে, কী রকম কী রকম করে, মনে হয় কবিতা লিখি।
কবিতাও লেখেন নাকি আপনি?
বাঙালির ছেলে কবিতা লিখবো না? তবে, জীবনে মাত্র দুটিই কবিতা লিখেছিলাম। গজেনবাবু গর্ব গর্ব গলায় বললেন।
.
গজেনবাবুর ওপর বদলা নেওয়ার সুযোগ পেয়ে গণেশ মাস্টার এবার চেপে ধরল। মাত্র দুটো লিখেছিলেন যখন, তখন তোমার নিশ্চয়ই মনে আছে। বলে ফেলো। উনি মাস্টারকে ডোন্ট-কেয়ার করে বললেন, তবে শোনো। প্রথম কবিতা যখন লিখি তখনও তো’ আমার পতিভের তেমন বিকেশ হয়নি।
কীসের বিকাশ হয়নি?
পতিভে, আর প্রতির্ভে, মানে প্রতিভা।
রেগে বললেন, এত বাধা দিলে কাব্য হয় না।
“এক ঠোঙা খাবার নিয়ে যায় শ্যামলাল,
তাই দেখে দূর থেকে মারলো ছোঁ চিল।”
বাপি হেসে উঠল। বলল, এমাঃ। এ কবিতায় মিল কোথায়?
আমরা সকলেই হেসে উঠলাম।
গজেনবাবু ধমকে বললেন, আধুনিক কবিতা এইরকম হয়। তাও তো’ আমি অত্যাধুনিক কবিতা লিখি না! বড় হও বুঝবে। তখন বুঝবে যে আজকালকার দিনে অনেকে যারা ইয়া ইয়া বড় কবি বলে কেটে যাচ্ছে, তাদের কবিতার চেয়ে এ কোনো অংশেই খারাপ নয়।
তারপর নিজেই বললেন, তুমি ছেলেমানুষ, তাই-ই তোমাকে বুঝিয়ে বলা যায়। এই কবিতার মিলটা হলো শ্যামলালের, ‘ল এবং চিলের ‘ল’ তে।