১৬
টুসিয়ার কাল সারারাত ভালো ঘুম হয় নি। ঘুমের মধ্যে বারবার চমকে চমকে উঠেছে। কতবার যে পাশ ফিরেছে, তা ওর মনে নেই। ভোরের পাখি ডাকাডাকি করার সঙ্গে সঙ্গেই বিছানা ছেড়ে উঠে, মা যা কাজের ভার দিয়েছিল, ও সে সব কাজ সারতে লেগেছে।
কাল টুসিয়া আয়নাতে দেখেছিল নিজেকে। এতদিন মা নিয়মিত তার শরীরের যত্ন করেছে। করৌঞ্জের তেল আর সাবানের কল্যাণে আর রোজ চুলের পরিচর্যায় তার রূপে যেন ছটা লেগেছে।
কালোর মধ্যে টুসিয়ার মতো এমন সুন্দরী প্রাণবন্ত মেয়ে এ-বস্তিতে আর দুটি নেই। সাধে কি আর নানকুয়ার পছন্দ হয়েছিল ওকে। ভেজ্জা নাচে সকলেই ওর জুড়ি হতে চায়। নানকু এখানে থাকলে, ও কিন্তু নানকু ছাড়া আর কারো সঙ্গেই নাচে না।
এগারোটার সময়ই বাবা আর তার আট বছরের ছোটভাই লগন বাস স্ট্যান্ডের দিকে রওনা দেবে আজ। বাসটা পৌঁছতে প্রায় সাড়ে বারোটা-একটা হবে। অনেক আগে থেকেই অপেক্ষা করবে ওরা। যদি কোনো কারণে বাস তাড়াতাড়ি এসে যায়। দাদা হীরু ও তার বন্ধুকে দুটো ঘরের মধ্যে, সবচেয়ে ভালো ঘরটা ছেড়ে দিচ্ছে ওর মা-বাবা। ওরা নিজেরা ঐ ক’টা দিন গরু-ছাগলের মতো গাদাগাদি করে থেকে যাবে এক ঘরে।
এ ক’দিন রোজ চৌপাইয়ে গরম জল ঢেলে ও রোদ দিয়ে খটমল মারা হয়েছে। সারাদিন রোদে দেওয়া কাঁথাকে নিজের নরম বুকের কাছে চেপে ধরে টুসিয়া তার অদেখা, অনাগত স্বামীর বুকের উষ্ণতাটুকু অনুমান করার চেষ্টা করেছে। মা গোঁদনি ধানের পায়েস্ রেঁধেছে।
গোদা শেঠের দোকানে রসদ-টসদ আনতে প্রায় পঞ্চাশ টাকা বাকি পড়ে গেছে টুসিয়ার বাবার। তা যাক্। ওরা সকলেই জানে শহরের বড় অসর তার দাদা, বলতে গেলে টাকার খনিরই মালিক। দাদা এলেই ধারধোর সব শোধ করে দেবে। মাইনে ছাড়াও তার দাদার অনেক উপরি রোজগার। সরকারি অসর হওয়ার মতো পয়মন্ত জীবিকা আজকাল খুব কমই আছে। জীবনে অভাব বলতে কিছুই থাকে না। যাই-ই চাওয়া যায়, তাই-ই নাকি পাওয়া যায়, তেমন তেমন জবরদস্ত চাকরিতে। তার দাদা এবং দাদার বন্ধু জবরদস্ত ডিপার্টে কাজ করে বলে শুনেছে টুসিয়া, তার বাবার কাছে। পুলিশের কাজ করে দাদা।
টুসিয়ার মা, শুয়োরের মাংসটা উনুনে চাপিয়ে, টুসিয়ার বাবাকে বিষম তাড়া-লাগালো। বলল, এখনও রওয়ানা হলে না? তোমার মতো বে-আক্কেলে মানুষ দেখি নি আর।
তারপর টুসিয়ার বাবা আর ভাই সূর্যের দিকে তাকিয়ে আর কোনো ঝুঁকি নেয়নি। আকাশে একটু মেঘ-মেঘ করেছে। সূর্যের ঘড়ি, ভুলও দেখাতে পারে। তাই-ই তারা সকাল সকালই রওয়ানা হয়ে গেছে।
বাস স্ট্যান্ডে পৌঁছে ওরা জানতে পেলো যে, বাস আসার সময়ের অনেক আগেই পৌঁছে গেছে ওরা। বাস আসতে আরো এক ঘণ্টা দেরি। তাতে ক্ষতি হয়নি কোনো। পথের পাশের চায়ের দোকানে বসে টুসিয়ার বাবা পথ-চল্লি ও থেমে-থাকা সব লোককেই এ খবরটা শুনিয়ে দিয়েছে, তার কেউ-কেটা ছেলে, ভারি সরকারি অর আজ গ্রামে আসছে। পঞ্চায়েত থেকে হীরুকে একটা সম্বর্ধনা দেবারও কথা উঠেছিল। কিন্তু হীরুর বাবা জুই বারণ করেছে। তার জানা নেই যে, ছেলে তা পছন্দ করবে কি করবে না। যে ছেলেকে সে জানতো, সে ছেলেতে এবং যে লায়েক ছেলেটি সবান্ধবে আজ আসবে পুরানো গাঁয়ে, তাদের দুজনের মধ্যে অনেক অমিল দেখবে হয়তো জুগ। তাই জুগ্ সাবধান হয়েছে। তার বেটা, হীরুয়া বেটা; বাবাকে সবদিক থেকে ছাড়িয়ে গেছে, তাই কি ছোট মাপের বাপকে হীরু আর সম্মান দেবে না?
নানা কথা মনের মধ্যে তোলপাড় করছে এ ক’দিন হলো। একথাও মনে হচ্ছে যে, হীরুর বন্ধুর যদি টুসিয়াকে পছন্দ না হয়? এই ছোট্ট জায়গায়, ছোট্ট গ্রামে বহিরাগত যুবকের সঙ্গে মেলামেশা করার পরও যদি সেই অসর ছেলেটি টুসিয়াকে বিয়ে না করে, তাহলে কি টুসিয়ার বিয়ে হবে ভবিষ্যতে? টি-টি পড়ে যাবে না গ্রামে!
নানকুয়াই বা কী বলবে? ও কি কথা বলবে তখন? যদি বলে, তাহলে অপমানই করবে হয়তো! নানকুয়া ছেলেটা ভালো। তবে, বড়ই গোঁয়ার-গোবিন্দ। তাছাড়া, কোথায় হীরুর বন্ধু আর কোথায় ও। কার সঙ্গে কার তুলনা! হনুমানজির সঙ্গে চুহার। তবে সেই ছেলেটি যদি টুসিয়াকে প্রত্যাখ্যান করে তাহলে কি নানকুয়াও প্রত্যাখ্যান করবে? স্বাভাবিক। তাহলে কী হবে?
বুড়ো আর বেশি ভাবতে পারে না। নিজের ভাবনা ভাবা অনেক সহজ। নিজের রক্তজাত সন্তানদের ভালোমন্দ এবং তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবনা, বড় অসহায়ের ভাবনা। নিজের হাতে কলকাঠি থাকে না, অথচ অন্যের কলকাঠি নাড়ার কারণে সুখ ও দুঃখের ভাগীদার হতে হয় বয়স্ক বা অবসর-প্রাপ্ত মা-বাবাকে। জুর বর্তমান অবস্থাটা বড়ই করুণ। বড়ই পরনির্ভর হয়ে রয়েছে সে।
জুগনু একটা সিগারেট ধরালো। চিরকাল বিড়ি খেয়ে এসেছে সে। কিন্তু আজকে তার অসর ছেলের যদি ইজ্জতে লাগে তার বাবা বিড়ি খেলে? অথবা, তার বন্ধু যদি ভাবে কিছু? তাই, সাদা ধবধবে সিগারেটটাকে দু-আঙুলের মধ্যে নিয়ে, কেউকেটা বেটা হীরুর আর তার বন্ধুর পথ চেয়ে বসে আছে, আর ভুস্-স্ ভুস্ করে অনভ্যস্ততায় সিগারেট টানছে।
বাসটা আসার সময় হয়ে এল। বুড়োর সিগারেট-ধরা আঙুল দুটি নিঃশব্দে এবং সকলের অগোচরে কাঁপতে লাগল। বুড়োর পিছনে আরও দু-একজন বুড়ো জমায়েত হয়েছে। ভালুমারের ছেলে হীরুকে অসর হয়ে ফিরে আসতে দেখবে তারা। একটা ঘটনার মতো ঘটনা ঘটতে চলেছে এই চুপচাপ, হুলুক্ পাহাড়ের পাঁচিলপাহারায় ছোট্ট বস্তির লাল-মাটির বুনো বুনো গন্ধভরা পথে।
বাসটাকে আসতে দেখা গেল। পিছনে লাল ধুলোর মেঘ উড়িয়ে বাসটা এসে স্ট্যান্ডে দাঁড়াল। কোলে একটা ছোট কালো পাঁঠা নিয়ে নামল একজন। মুরগি, লাউ, কুমড়ো, বাজরার বস্তা সব নামল একে একে। মানুষ-জন, মেয়ে বউ নামতে লাগল। যারা এখানে নামবে না, তারা জানালায় হাত রেখে মুখ বাড়িয়ে দেখতে লাগল। পানের পিক্ ফেলল পিচ্ পিচ্ করে দুজন। কন্ডাক্টর বাসের রেলিং দেওয়া ছাদে দাঁড়িয়ে একে একে প্রত্যেকের মালপত্র নামিয়ে দিল।
কিন্তু হীরু বা তার অদেখা বন্ধু কেউই নামল না সেই বাস থেকে।
জুগনু বুড়োকে পিছন থেকে অন্য এক বুড়ো শুধোলো, কী হল? বুড়োর অনভ্যস্ত অন্যমনস্ক আঙুলের ফাঁকে সিগারেট পুড়ে এল এবং হঠাৎ তার আঙুলে ছ্যাঁকা লাগতে হুঁশ হল বুড়োর।
টুসিয়ার ছোটভাই লগনও উদ্গ্রীব হয়ে তাকিয়ে ছিল বাসটার দিকে! তার দাদা কত কী উপহার দিয়ে নামবে বাস থেকে! অনেক কল্পনা করেছিল বাচ্চা ছেলেটা।
বাসটা কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে চলে গেলো হর্ন বাজিয়ে দিঠিয়ার দিকে।
আবার ধুলো উড়ল। ফেলে দেওয়া শালপাতা, কাগজ কুচি, এটা-সেটা, ধুলোর মেঘের মধ্যে ঘুরপাক খেতে লাগল। জুগনু বুড়ো বসে থাকা অবস্থা থেকে বাসটা আসার সঙ্গে সঙ্গে দাঁড়িয়ে উঠেছিল। দাঁড়িয়েই রইল স্থাণুর মতো।
ছোট ছেলে লগন হাত ধরে হ্যাঁচকা টান দিল।
বাড়ি যাবে না বাবা?
যাব।
বলে, বুড়ো বাড়ির পথে হাঁটতে লাগল।
আকাশে, চারপাশে রোদ ঝক্ক্, করছিল তখন। বুড়োর মনে হল তখন রাত হলে, ভালো হতো। কাউকে এই লজ্জার, অসম্মানের মুখ আর দেখাতে হতো না।
নিজেদের বাড়ির কাছাকাছি আসতেই দূর থেকে দেখতে পেল আমগাছ আর নিম গাছের ছায়ার ঘর দুটির সামনে টুসিয়ার মা দাঁড়িয়ে আছে পথের দিকে চেয়ে। ওদের একা আসতে দেখে জুর বৌ বোধ হয় ঘরের মধ্যে টুসিয়াকে কিছু বলে থাকবে। টুসিয়ারা দৌড়ে এল বাইরে। তারপর মা ও মেয়ে নির্বাকে ধীরে ধীরে মাথা নীচু করে হেঁটে আসা ক্লান্ত, ব্যথিত এবং চিন্তান্বিত জুগনু ও লগনের দিকে চেয়ে রইল।
টুসিয়ার ছোট ভাই-ই শুধু খেলো। মা, বাবা এবং টুসিয়া কেউই খেলো না। অনেক কিছু রেঁধেছিল মা। খাওয়ার মতো মানসিক অবস্থা ছিল না ওদের কারোই।
বিকেলে, বেলা পড়ে গেলে টুসিয়া গাছ-তলায় রোদে পিঠ দিয়ে বসে ছিল। বাবা একটু পর আবার যাবে বাস স্ট্যান্ডে। যদি বিকেলের বাসে তারা আসে।
ও হঠাৎ দেখল, টিহুল হেঁটে আসছে ওদের ডেরার দিকে।
টিহুল কাছে এসে বলল, হীরু এসেছে।
টুসিয়া চমকে উঠল।
ঘরের ভিতর থেকে টিহুলের গলা শুনে সকলে দৌড়ে বাইরে এল। জুগনু বলল, কোথায়? হীরু কোথায়?
ফরেস্ট বাংলোয়। দুপুরে এসেছে জিপ গাড়িতে করে, সঙ্গে অন্য একজন অসর। আমাকে দিয়ে খবর পাঠিয়েছে যে, মাত্র দুদিনের জন্যে এসেছে, অফিসেরই কাজে। এখান থেকে মহুয়াডারে যাবে।
এখানে থাকবে না? আসবে না? টুসিয়ার মা অবাক গলায় শুধোলো।
মনে হয় না।
টিহুল মুখ নিচু করে বলল।
তারপর বলল, বাড়িতে থাকা ওর পক্ষে সম্ভব নয়। তাছাড়া ভারী অসরের পক্ষে ঐরকম বাড়িতে থাকা কষ্টের। অসম্মানেরও। তোমরা ইচ্ছা করলে দেখা করতে পারো।
ওরা সকলে চুপ করে থাকলো। কেউই কোনো কথা বলল না।
হঠাৎ টিহুল বলল, হীরু নাম পালটেছে।
নাম পালটেছে?
বাবা, মা এবং মেয়ে একসঙ্গে বলে উঠল, ধরা গলায়।
হ্যাঁ, টিহুল বলল,। নাম মানে, পদবী। হীরু ওরাওঁ এখন হীরু সিং। এত বড় অসর বনে গিয়ে নিজেকে ও আর বন পাহাড়ের লোক বলে পরিচয় দিতে চায় না। ওর জিপের ড্রাইভারের কাছেই সব শুনলাম। ড্রাইভার বলছিল যে, পাটনাতে সাহেবের বাড়িতে মাংস ও শাকসবজি ঠান্ডা করার সাদা বাক্স আছে—ফিরিজ্ না কি বলে যেন। গান-বাজনা শোনার জন্যেও নানা রকম যন্ত্রপাতি আছে। বড় বিলিতি কুকুর আছে। সাহেব ক্লাবে যায়। একটা খেলা খেলে, যার নাম টিনিস্। ভালো অসর বলে খুব সুনাম সিং সাহাবের। মায়না ছাড়াও, মাসে দশ-পনেরো হাজার টাকা উপরি আছে। রাজার মতো থাকে সাহেব। আরো অনেক উন্নতি হয়ে যাবে সাহেবের।
তারপর টিহুল হঠাৎই বলল, শুনলাম, হীরু নাকি সাহেবের মতো কমোড ছাড়া টাট্টি করতে পারে না আজকাল।
কমোড? কমোড কী?
অবাক গলায় টুসিয়ার মা শুধোলো।
সে সাহেবদের টাট্টির চেয়ার।
চেয়ার কী?
কুর্সি।
টুসিয়ার মা বলল, একবারও ওর ছোট ভাই লগনের কথা, আমার কথাও জিজ্ঞেস করল না হীরু? টুসিয়ার কথা?
ভারী অসরের সামনে আমি কি যেতে পারি? আর্দালি এসে আমাকে খবর দিতে বলল, তাই-ই এসেছি।
আরদালি কী খবর দিতে বলল?
হীরুর বাবা শুধোলো।
টিহুল মুখ নিচু করে বলল, আরদালি বলল, জুনু ওরাওঁকে খবর দিতে, সিং-সাহাব এবারে দেখা করতে পারছেন না। জরুরি কাজে এসেছেন। এখান থেকে চলে যাবেন মহুয়াডারে। পরে এলে, দেখা করে নেবেন। যদি সময় হয়।
তারপর টিহুল বলল, আমি যাই। আমার জল ভরতে হবে বাংলোর ট্যাঙ্কিতে। সাহেবরা বিকেলে চান করবেন আবার। গরম জলও করতে হবে।
টিহুল কথা ক’টি বলেই আবার মুখ নামিয়ে নিল।
সরল টিহুল জানে যে, হীরু যে অপমানটা তার বাবা-মা ভাইবোনকে করল, সেটা তাদের একার অপমান নয়। এটা পুরো ভালুমার বস্তিরই অপমান। মনে পড়ল টিহুলের, ছোটবেলায় খেলতে খেলতে ও একবার ধাক্কা দিয়ে ফিলে দিয়েছিল হীরুকে, গোবরের মধ্যে। টিহুলকে হীরু “টিউলা ভাইয়া” বলে ডাকত। খেলার সাথী ছিল।
অপমান টিহুলের নিজেরও কম হয়নি।
হীরু যখন জিপ থেকে নামল, তখন টিহুল মহুয়া গাছতলায় দাঁড়িয়ে ছিল। হীরুর চোখ তাকে অবশ্যই দেখিছিল, ছেঁড়া জামাটা আর দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখা খাকি হাফ-প্যান্ট পরা অবস্থায়। কিন্তু হীরু তাকে দেখেও চেনেনি।
টিহুল জানে যে, টুসিয়ারা আর কখনও হীরুকে ফিরে পাবে না। ওরা ওর কেউই নয়। সিংসাহাব ভালুমারকে চিরদিনের মতোই ভুলে গেছে। যে ভালুমার বস্তি জুগনু ওরাওঁ-এর ছেলে হীরু ওরাওঁ-এর জন্য গর্বিত সেই ভালুমারকেই হীরু পুরোপুরি অস্বীকার করেছে। নাম বদল করে অস্বীকার করেছে জুর পিতৃত্ব পর্যন্ত।
টুসিয়া হঠাৎ লক্ষ করল যে, তার আট বছরের ছোট ভাইটা ওদের বাড়ির সামনের পাহাড়ী নালার শুকনো বুকে নেমে গিয়ে নুড়ি পাথর কুড়োচ্ছে দ্রুত হাতে, আর আকাশের দিকে প্রচণ্ড আক্রোশে সেই পাথরগুলো ছুড়ে চলেছে একটা একটা করে। ছোট্ট লগন জানে, ওর লক্ষ্যবস্তু ওর নাগালের বাইরে। তবু ছেলেমানুষি অবুঝ রাগে ও পাথর ছুড়েই চলেছে। লগনের রাগটা কিন্তু মিথ্যা! এবং রাগটা সত্যিই।
টুসিয়া শূন্য দৃষ্টিতে সেই দিকে চেয়ে ছিল আর গুণছিল।
পাথরগুলো অত দূরের ঝাঁটি জঙ্গলে ভরা বড় বড় কালো পাথরের টিলাতে গিয়ে শব্দ করে পড়ছে। শব্দ গুণছে টুসিয়া। চুরমার হওয়া স্বপ্নগুলোর। টুসিয়া গুণছে। এক, দুই, তিন, চার, পাঁচ, ছয়…। টুসিয়া গুণেই চলেছিল। কখন যে ছায়াগুলো দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়ে এসেছে, কখন পাখিরা সব ঘরে গেছে ডাকতে ডাকতে, কখন সূর্যটা হারিয়ে গেছে পশ্চিমের ঢালে, ঝুম্রীবাসার জঙ্গলের গভীরে কখন যে অন্ধকার নেমে এসেছে টুসিয়া এসবের কিছুই লক্ষ করেনি।
আলো এখন আর কোথাওই নেই। টুসিয়ার চারিদিকেই অন্ধকার। দারুণ অন্ধকার। হঠাৎ মা ডাকল। যেন বহুদূর থেকে, যেন অন্য কোনো দেশ থেকে।
—টুসিয়া; টুসিয়া।
হুঁ—উ—উ…
টুসিয়া জবাব দিল। যেন, ঘোরের মধ্যে।
মা বলল, কাঠগুলো জড়ো করাই আছে। একটু আগুন জ্বাল্। আজকে বড় শীত। ও বুঝতে পারছিল তা।
এত শীত আগে কখনও বোধ করেনি টুসিয়া। আজকে ওর নবীন, নরম উষ্ণতার স্বপ্নে স্বপ্নিল উৎসুক শরীর এবং কবোষ্ণ মনের দাঁড়ে দাঁড়ে শীতের পাখিরা একে একে এসে বসেছে সারে সারে। দূরাগত তাদের ডানায় বয়ে আনা বিদেশি শীতের ঝাপটায় ক্রমাগত কুঁকড়ে যাচ্ছে টুসিয়া। দিশি নানকুর পুরোনো প্রেমিকা টুসিয়া।