কোজাগর – ১৪

১৪

সকালে বেড়াতে বেরিয়েছিলাম, ঝুম্রীবাসার কাছের জংলি-সুঁড়িপথে। একটু গিয়েই পরেশনাথের সঙ্গে দেখা।

একটা ঝুড়ি মাথায় করে চলেছিল ও।

বললাম, কোনদিকে রে?

ও বলল, আমলকী কুড়োতে। গোদা শেঠ পঁচিশ নয়া করে দেবে এক এক ঝুড়িতে!

এক ঝুড়ি ভরতে কতক্ষণ লাগবে?

তা কী বলা যায়? তেমন গাছ পেলে অল্প সময়েই ভরে যাবে। নইলে তিন-চার ঘণ্টাও লেগে যেতে পারে। বললাম, চল্, আমি গাছ ঝাঁকাব, নয়ত পাথর মারব মগডালে; আর তুই কুড়োবি।

ও খুব খুশি হলো। আমার পায়ে পায়ে চলতে লাগল। একটু গিয়েই পথের ওপর একটা কাঠের সাঁকো। দুপাশে আসন, পন্নন্, গাম্হার আর শালগাছ। নিচের পাহাড়ী ঝরনাটা এখানে একটা দহ’র মতো সৃষ্টি করেছে। সেখানে জল বেশ গভীর। কিন্তু স্বচ্ছ। জলের মধ্যে বালির ওপরে ছোট ছোট মাছ সাঁতার কাটছে। গাছ-গাছালির ফাঁক-ফোকর দিয়ে রোদ এসে পড়েছে জলের ওপর। কতকগুলো কালো কালো পোকা চিড়িক্ চিড়িক্ করে জলছাড়া দিয়ে নড়ে বেড়াচ্ছে। পোকাগুলোর শরীরের মাঝের অংশটা বোধহয় স্বচ্ছ। কারণ জলের নিচে তাদের মাথা আর লেজের দিকের ছায়াই শুধু পড়ছে। ছায়াগুলো এমনভাবে পড়ছে যে, তিন-তিনটে বিন্দু দিয়ে গড়া অসংখ্য অসংলগ্ন ত্রিকোণাকৃতি এবং বিভিন্নমুখী দ্রুতগতি ছায়ায় ভিড় হয়েছে সেখানে। ঐ ছায়াগুলোকেও মনে হচ্ছে এক-রকমের জীবন্ত পোকা। দাঁড়িয়ে পড়ে, আমরা পোকাগুলোর খেলা দেখতে লাগলাম। আর জলের নিচে তাদের ছায়ার নাচ।

এই বনপথের আনাচে-কানাচে কত কী আশ্চর্য আপাততুচ্ছ অথচ অসাধারণ সব দৃশ্য ও অনুভূতি ছড়ানো আছে! এত শব্দ, এত রঙ, এত গন্ধ যে, যার চোখ কান আছে এবং অনুভব করার শক্তি আছে; তার পক্ষে এতে বিভোর না হয়ে থাকা সম্ভব নয়।

পরেশনাথ উত্তেজিত গলায় বলল, “পিল্লু”।

তারপর বলল, ভারি মজার পিল্লুগুলো, না?

অন্যমনস্ক গলায় ওকে বললাম, যা বলেছিস।

পিল্লু হচ্ছে, পিলুয়ার অপভ্রংশ। পিলুয়া মানে পোকা।

একটা কাঠঠোকরা কাঠ ঠুকছে বনের গভীরে। ভারি ছন্দোবদ্ধ, এক স্কেলে বাঁধা সুষম সে আওয়াজ। আরো গভীর বনের ছায়ায় বসে একটা ক্রো-ফ্রেজেন্ট ডেকে চলেছে গম্ভীর গলায়।

হঠাৎ উজ্জ্বল লালরঙা বড় একটা প্রজাপতি কোথা থেকে যেন উড়ে এল। একটু আগেও তাকে দেখিনি। “লাল তিতলি লাল তিল” বলতে বলতে ছোট্ট পরেশনাথ মুহূর্তের মধ্যে ঝুড়িটা ব্রিজের ওপর ধপ্ করে ফেলে দিয়েই নদীর দিকে দৌড়ে গেলো। তারপর উন্মাদের মতো দু-হাত তুলে নেমে গেল খাড়া পাড় বেয়ে। প্রজাপতিটা জলের কোণায় জল থেকে হাত দুয়েক উঁচুতে একবার স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পরক্ষণেই জলের ভিতরের দিকে উড়ে গেল, তারপর আবার ওপরে উঠে এল। এমনি করে দ্রুত উঠতে নামতে লাগল।

পরেশনাথ দৌড়ে দুহাত বাড়িয়ে প্রজাপতিটাকে ধরতে চেষ্টা করতে লাগল, এবং কী ঘটল বোঝাবার আগেই সঙ্গে সঙ্গে জলে পড়ে গেল। জল ছিট্‌কে উঠল মুহূর্তের মধ্যে। রোদ ঝিমিকিয়ে উঠল ছিকানো জলবিন্দুতে। সেই বনপথের অনামা পাহাড়ী নদীর ওপরে এক নিমেষের জন্যে একটা আস্ত হিরের খনির সব হিরে দেখা দিয়েই আবার মিলিয়ে গেল।

ব্রিজের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে দেখলাম যে, পরেশনাথ তলিয়ে যাচ্ছে স্বচ্ছ জলের নিচে। পোকাগুলো ভয় পেয়ে বিভিন্ন দিকে সরে যেতে লাগল। মাছের ঝাঁকে, হঠাৎ চিতাবাঘ দেখা চিতল হরিণের ঝাঁকের মতোই চমক্‌ লাগল।

পরেশনাথ কী সাঁতার জানে না? শহরের ছেলেরা না জানতে পারে, এরাও যে সাঁতার জানে না তা ভাবনারও বাইরে ছিল। ব্যাপারটা বুঝতে যতটুকু দেরি হল, তাতেই সময় যা নষ্ট হল। পরক্ষণেই আলোয়ানটা খুলে ফেলে জলে নেমে গেলাম। আমার কাঁধ অবধি জল। দুহাতে পরেশনাথকে তুলে ফেললাম। তখনও বেশি জল খায়নি ও। কিন্তু দম্ আটকে গেছিল। দম বন্ধ হওয়াতে, মুখ আর ঠোঁট একেবারে নীল হয়ে গেছিলো।

কিছুক্ষণ পর ও চোখ খুলে অস্ফুটে বলল, মাঈরে…মাঈ…! হাম ক্যা বুড় যাতা থা বাবু?

আমি আমার আলোয়ানটা ওর গায়ে জড়ালাম। ঐ শীতের সকালে হঠাৎ জলে পড়ে গিয়ে এবং ভয় পেয়ে কুঁকড়ে গেছিল পরেশনাথ।

প্রকৃতিস্থ হবার পর শুধোলাম, সাঁতার জানিস না তুই?

নাঃ। এখানে জল কোথায় যে, শিখব? বর্ষাকালে নালায় আমি আর বুলকি ঝাঁপা-ঝাঁপি করি বটে, কিন্তু অল্প জলে। মা জানে না। জানলে, মারবে।

প্রজাপতিটা তখনও জেলর ওপর উড়ছিল।

এই বর্ষায় তোকে সাঁতারকাটা শিখিয়ে দেব। আর এই শীতে, সাইকেলে চড়াও শেখাব।

সাইকেল?

পরেশনাথের চোখ মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল আনন্দে। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে ও অনেকক্ষণ ধরে লাল প্রজাপতিটার দিকে চেয়ে থেকে হঠাৎ গম্ভীর গলায় বলল, ঐ তিতলিটা কিন্তু খতরনাক্। ও-ই আমাকে জলে ডুবিয়ে মারছিল একটু হলে। ওটা একটা ভূত। আমি সব্বাইকে বলে দেব যেন কেউ লাল তিতলির পিছনে না দৌড়য়।

চুপ করে রইলাম।

ভাবছিলাম, আমার বাড়িতেও তো একটা তিতলি আছে। অবশ্য তার গায়ের রঙ এতোটা লাল নয়।

ছোট্ট পরেশনাথ আজ আর আমলকী কুড়োতে রাজি নয়। ঐ লাল তিতলি যে অমঙ্গলের দূত, অপ্রাকৃতিক কোনো ব্যাপার; সে সম্বন্ধে সে নিঃসন্দেহ। ও, ওর বাবা মানিয়ারই মতো। গভীর সব কুসংস্কার, ভৌতিক এবং আধিভৌতিক সব ভাব ও ভয় ওদের মস্তিষ্কে। আমার সাধ্য কী যে ওকে বোঝাই?

দুজনেই একেবারে ভিজে গেছিলাম। ওর হাতে একটা আধুলি দিয়ে যে যার পথে চললাম। পরেশনাথ চলে গেল সাঁকোর পিছনের অন্য সুঁড়িপথে ওর বাড়ির দিকে। আমি, যে পথে এসেছিলাম সে পথে।

একটু এগিয়ে গিয়েই দেখি, পথের বাঁদিকে হাঁটু সমান ঘাসবনে চার-পাঁচটি শম্বর দাঁড়িয়ে আছে। তখনও মাঠ ভেজা আছে শিশিরে একটু একটু। অনেকগুলো হলুদ প্রজাপতি উড়ছে মাঠটাতে। সবুজ জঙ্গলের পটভূমিতে দারুণ একটি কম্পোজিশন। বড় বড় হনুমানের একটা দল ঝাঁপাঝাঁপি করছে মাঠের পিছনের উঁচু উঁচু গাছগুলোতে। চোখ তুলেই একটা শিউলে শম্বর অনড় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সত্ত্বেও, আমাকে দেখতে পেল। দেখতে পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ওরা একসঙ্গে দৌড়ে পালাল জঙ্গলের গভীরে।

যদি একটা ভালো ক্যামেরা থাকত, তাহলে এত বছর ধরে যে সব ছবি তুলে রাখতে পারতাম তাতে হয়ত ঘর ভরে যেত। বন আর বন্যপ্রাণীর ছবি বিক্রি করে হয়ত বড়লোক হয়ে যেতে পারতাম। কিন্তু ভালো ক্যামেরা ও তার আনুষঙ্গিক যন্ত্রপাতি কেনার ক্ষমতা আমার নেই। রঙিন ফিল্ম কেনারও নেই। দ্বিতীয়ত, আগেই বলেছি যে, সব রকমের যন্ত্রপাতির সঙ্গেই আমার জন্মগত বিরোধ। সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘দেশে বিদেশে’তে পড়েছিলাম, চোখের থ্রি-পয়েন্ট-ফাইভ লেন্স দিয়ে ছবি তুলে মস্তিষ্কের ডার্করুমে রেখে দেওয়াতে বিশ্বাস করতেন তিনি। যখন খুশি ছেপে নিতেন যে কোনো সাইজে।

ফোটোগ্রাফি সম্বন্ধে আমার তেমন একটা পক্ষপাতিত্বও নেই। এই শম্বরদের ঘাসের মধ্যে দৌড়ে যাওয়া, এই সকালের গন্ধ, এর রূপ, এর রঙ এবং এর মধ্যে মিশে যাওয়া আমার মনের এইক্ষণের ভাবের সামগ্রিকতার কতটুকুই বা ধরতে পারতো ক্যামেরা! রঙিন ফিল্মই হোক আর মুভি ক্যামেরাই হোক, তারা শুধু এই সকালের এক ভগ্নাংশকেই ধরে রাখতে পারতো। উইথআউট রেফারেন্স টু দ্যা কনটেক্সট্। ন্যাচারলিস্ট-এর বিদ্যা ও পরিশীলিত মন আমার নেই। আমি কোনোদিন সালিম আলি বা এম কৃষ্ণান বা কৈলাস সাংখালা হতে চাই না। কখনও জিম করবেটের দরদের ভাগীদার হতে পারলে হয়তো হতে চাইতাম। এই কলমটুকু ছাড়া মূলধন আমার আর কিছুই নেই।

বাড়ি ফিরে চান-টান সেরে নিয়ে নাস্তা করলাম। রবিবারে একটু দেরিতে চান করি। সপ্তাহে এই একটা দিনের সারাদিনটাই আমার। আমার একার। নিরবচ্ছিন্ন অবসরের। তিতলিকে বলি একবেলাতেই রান্না সেরে ও-বেলাটা ছুটি নিতে। কিন্তু ও কথাটা পুরো শোনে না। আমাকে খাইয়ে-দাইয়ে বাড়ি চলে যায় দুপুরে। বিকেলে আবার আসে। চা করে খাওয়ায় দ্বিতীয় কাপ। প্রথম কাপ আমি নিজেই বানিয়ে খাই। তারপর রাতে খাবার গরম করে টাটকা রুটি বানিয়ে আমাকে খাইয়ে-দাইয়ে ও বাড়ি যায়।

প্রতি রবিবারই সকালটা এদিকে-ওদিকে ঘুরে বেড়াই বনে জঙ্গলে, যেখানে জিপ বা ট্রাক যাবার পথ নেই। কখনও সঙ্গে কেউ থাকে, কখনও বা একলাই। সারা সপ্তাহে নানা কাজে কর্মে, নানা মানুষের সঙ্গে মেলামেশায় মনের মধ্যে যেটুকু জট পাকিয়ে ওঠে এবং টেনশান্ গড়ে ওঠে সব আবার খুলে, ঝরে যায় বনে বনে হেঁটে বেড়ালে। নির্জন বনের মধ্যে একা একা হাঁটার মতো গভীর বিশুদ্ধ আনন্দ আর বেশি নেই। তাতে নিজেকে সম্পূর্ণভাবে আওয়াইন্ড করা যায়।

বইগুলি রথীদা রাঁচি থেকে জোগাড় করে এনেছিলেন। যাঁর বই তাঁকে ফেরত দিতে হবে তাড়াতাড়ি।

ফাগুয়ার গান—

“তার সুরেলা চুল ছড়ানো ছিল মাটিতে,
আমি ফুল তুলব।
সূর্যাস্তের সময় তার সুরেলা চুল ছড়ানো ছিল মাটিতে
আমি ফুল তুলব।
শোওয়ার সময় তার সুরেলা চুল ছড়ানো ছিল মাটিতে
আমি একটি সুন্দর ফুল তুলেছি।”

আরেকটা গান—

“এই নতুন সরসী খুব গভীর।
আগে আমি পালাই।
তারপর গিয়ে সবাইকে বলব।”

আরও একটা—

“এই মেয়েটা কে রে?
যে বলে, বিয়ে করবে না?
পাকা তেঁতুলের মতো যে নরম,
ভাগ্যিস তুই আমাকে এই মেয়ের কথা বলেছিলি—
ঈস্‌স্‌ কী তেঁতুলের মতো নরম রে!”

“সারহুল্”-এর গানও আছে। সারহুল উৎসব এখানকার ওরাওঁদের একউৎসব।

শাল গাছকে পুজো করে ওরা তখন। বসন্ত শেষে হয়।

যেমন—

ফড়িংগুলো বৃষ্টির মতো, উড়ছে
র এই সকাল,
আঃ! আষাঢ় শ্রাবণের এই সকাল
ফড়িংগুলো উড়ছেই, উড়ছেই উড়ছেই।

আসলে, এখানে ফড়িং বলতে নৃত্যরত ছেলেদের কথাই বলা হচ্ছে গানে।

সেইরকম অনেক আষাঢ়ে গানও আছে।

“পাহাড়ের গায়,
হলুদ শর্ষেক্ষেতে,
হরিণগুলি চরছিল।
একটি তীর ছুঁড়লাম,
দুটি তীর ছুঁড়লাম,
তিনটি তীর ছুঁড়লাম,
হায়!
ওরা কেবল লেজ নাচাল।”

এখানে হরিণ মানে যুবতী মেয়েরা।

ওমালির বই পড়তে পড়তে কতদিন আগে চলে যাই। তখন না জানি এই সব বন পাহাড় আরও কত সুন্দর, নির্মল ও নির্জন ছিল! ভাবতেও ভাল লাগে।

ছুটির দিনগুলোতে শোওয়ার ঘরের জানলার সামনে বসে পড়ি, অথবা ডাইরি লিখি। ছাতারে পাখিগুলো বাইরের পুটুসের ঝোপে নড়ে চড়ে বসতে বসতে অনর্গল কথা বলে। ঝুমকো জবার গাছে বুলবুলিদের মেলা বসে তখন। কত কথা যে বলে ওরা। ওদের শীষে শীষে শীতের মন্থর রোদ-ঝরা আধ-ঘুমন্ত ওম্-ধরা দুপুর সজীব হয়ে ওঠে। এ বন থেকে ও বনে টিয়ার ঝাঁক উড়ে যায় ট্যা ট্যা ট্যা করে হাওয়ায় চাবুক মেরে। দূরের ক্ষেতের ফসলের গন্ধ, রাখওয়ার ছেলেদের বাঁশির সুর, হাওয়ায় গড়িয়ে যাওয়া শুকনো শালপাতার ঝর্ ঝর্ শব্দ সব মিলিমিশে কেমন এক ঘুমপাড়ানি আমেজ আনে।

মাঝে মাঝে মুখ তুলে জানালা দিয়ে দূরে তাকাই। আদিগন্ত সবুজ প্রকৃতি শীতের রোদের সোনালি বালাপোষ মুড়ে ঝিম্ ধরে পড়ে থাকে। হুলুক পাহাড়ের উপত্যকায় তখন শকুন ওড়ে চক্রাকারে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *