১৩
কাল রাতে লালুকে শোনচিতোয়াতে নিয়ে গেল। বারান্দাতে দু-তিনটে পুরনো চটের বস্তার ওপর লালু শুয়ে থাকত। ওর চিৎকারের তারতম্য দেখে বুঝতে পারতাম কী জানোয়ার দেখেছে ও। হাতি দেখলে গলা দিয়ে অদ্ভুত এক আহ্লাদী স্বর বের করত। শুয়োর হরিণ ‘বা শজারু ডেরার কাছাকাছি এলেই ওর লম্ফ-ঝম্ফর রকমই হতো আলাদা। খরগোশ বা শেয়াল দেখলে তেড়ে দৌড়ে যেতো ও বাইরে রাতবিরেতেও। কিন্তু বড় বাঘ আর শোন্ চিতোয়ার আঁচ পেলেই লালু একেবারে চুপসে যেতো। চুপ করে ও থাকত ঠিকই কিন্তু ওর অজানিতেই গলা দিয়ে একটা বিশ্রী ঘড়ঘড়ানি আওয়াজ উঠত! মুমূর্ষু রোগীর শ্বাসকষ্টর মতো। ও হয়ত জানত, ওর কপালের লিখন। টানা-টাড়ের দিকে বা ভালুমারের চারপাশের নিরবচ্ছিন্ন জঙ্গলের গভীরে ফেউ ফেউ করে যখন শেয়ালগুলো হেঁচুকি তুলে ডাকত গভীর অন্ধকার রাতে, তখন লালু যে বারান্দাতে আছে তা বোঝা পর্যন্ত যেতো না।
কালকে খাওয়া-দাওয়ার পর তিতলি টেটরার সঙ্গে চলে গেল। আমি কিছুক্ষণ ঘরে বসে লণ্ঠনের আলোতে পড়াশুনা করছিলাম। লালু খচ্মচ্ শব্দ করে গা চুলকোচ্ছিল। বারান্দাতে ওর হেঁটে বেড়ানোর আওয়াজ, ওর পায়ের নখের শব্দ সবই শুনতে পাচ্ছিলাম। তক্ষক ডাকল বার তিনেক বেড়ার ওপার থেকে। লালু কেয়ার করল না। দশটার মধ্যেই আমি শুয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎ একটা করুণ কুঁই কুঁই আওয়াজে আমার ঘুম ভেঙে গেল—পরক্ষণেই ঘরের দরজার পাল্লাতে বাইরে থেকে কোনো জানোয়ার যেন নখ দিয়ে আঁচড়াচ্ছে বলে মনে হল। ব্যাপারটা কী তা বুঝতেই একটু বেশিই সময় লেগে গেল আমার। লেপটা ছুড়ে ফেলে চৌপাই থেকে উঠে পড়লাম। বালিশের নিচ থেকে টর্চটা আর ঘরের কোণায় রাখা বর্শাটাকে তুলে নিয়ে দরজা খুলতে যেতেই মোটা শালকাঠের দরজার ওপরে কী যেন দড়াম্ করে আছড়ে পড়ল! যখন দরজা খুললাম, তখন দেখি লালু নেই, কিন্তু লেপার্ডের গায়ের বোঁটকা গন্ধে সারা বারান্দাটা ভরে রয়েছে।
লালু! লালু! বলে চিৎকার করে বারান্দাতে দাঁড়িয়েই আমি চারধারে টর্চের আলো ফেলতে লাগলাম। কিন্তু ঐ বিকট গন্ধ পাবার পর শুধুই বর্শা হাতে বাইরে বেরুবার মতো সাহস হল না। এক ঝলক আলোতে হঠাৎ দেখলাম, লালুকে মুখে করে একটা বিরাট চিতাবাঘ এক নিঃশব্দ লাফে ডেরার সাত ফিট মতো উঁচু কাঠের বেড়াটা · পেরিয়ে বাইরের অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে গেল। আমার গলা-ফাটানো লালু! লালু! ডাক শিশিরে-ভেজা বন-প্রান্তর ঘুরে চারদিক থেকে হাজার হাজার ডাক হয়ে দ্রুত ফিরে এল। কিন্তু লালু এল না।
স্থাণুর মতো দাঁড়িয়ে আমি বুঝতে পারলাম যে, লালু আর কোনোদিনও আসবে না।
অনেক বছর জঙ্গলে থাকাতে, অনেক কিছুকেই মেনে দিতে শিখেছি এখন বিনা প্রতিবাদে। আমার বন্দুক নেই, থাকলেও এই স্যাংচুয়ারি এলাকার মধ্যে গুলি ছোড়া অসম্ভব ছিল। গুলি করলে, জেলে যেতে হবে। অথচ আশ্রিত এক অবলা জীবকে আমারই ঘরের দরজার সামনে থেকে শোনচিতোয়ায় তুলে নিয়ে যাবে আর আমি কিছুই করতে পারব না!
জঙ্গলের বাঘ বা চিতাকে আমি ভয় পাই না, পাইনি কখনও। যতবারই দেখা হয়েছে তাদের সঙ্গে। কিন্তু যে-চিতা রক্তলোলুপ হয়ে আমার বাড়িতে এসে আমার আশ্রিত কুকুরকে ঘাড় কামড়ে ধরে নিয়ে গেল, তাকে ভয় না করে পারি না। ঠিক ভয়ও হয়ত নয়, হয়ত আক্রোশ। নিষ্ফল কিন্তু অতি তীব্র এক আক্রোশ। সে অনুভূতির শরিক যাঁরা না হয়েছেন, তাঁদের ঠিক বোঝানো সম্ভব নয়। তাৎক্ষণিক হতবুদ্ধি নিশ্চেষ্টতাটা কেটে যাওয়ার পর বুকের মধ্যে এমন কষ্ট হতে লাগল যে, কী বলব! বেচারি, বাঁচার জন্যে আমার ঘরের মধ্যে ঢুকে আসতে চাইছিল, অথচ আমি তাকে বাঁচাতে পারলাম না। কিংবা কে জানে, হয়ত আমাকেই বাঁচিয়ে দিল ও। একটু আগে দরজা খুললে ব্যাপারটা হয়তো অন্য রকম হতে পারত।
টাইগার-প্রোজেকট্ বা ওয়াইল্ড লাইফ ফান্ড ইত্যাদি সব কিছুরই কথা ভুলে গেলাম। শোনচিতোয়াটা যেন আমার আমিত্বকে গালে একটা বিরাশি সিক্কার থাপ্পড় কষিয়ে দিয়ে চলে গেল। লালু কিন্তু আমাকে অন্তত তিনবার সাপের মুখ থেকে বাঁচিয়েছিল, এবং একবার বাঁচিয়েছিল একটা এক্রা হাতির আক্রমণ থেকে। সে সব মুহূর্ত আমার স্মৃতিতে; বাকি জীবন গল্পই হয়ে থাকবে।
ভোর হতেই, কাড়ুয়ার কাছে গিয়ে পৌঁছলাম। কাড়ুয়া সবে লোটা হাতে ময়দান থেকে ফিরছিল। আমাকে দেখেই চৌপাই পেতে দিল। ওকে বললাম যা বলার বল। ও কিছুক্ষণ মুখের দিকে চেয়ে থেকে নিরুত্তাপের সঙ্গে অত্যন্ত ক্যাজুয়ালি বলল, শোনচিতোয় কুকুর বড় ভালোবেসে খায়। আর বাঘে খায় ঘোড়া; ধোপার গাধা।
রাগ হল ওর কথা শুনে। লালু তো একটি কুকুর মাত্র ছিল না আমার কাছে। ও যে লালু!
কাড়ুয়া, মনে হলো, আমার মনোভাব যেন কিছুটা বুঝল। তারপর বলল, আপনি যান। আমি একটু পর আপনার ডেরায় যাচ্ছি। গিয়ে যা করার করব।
তিতলি এসে সব শুনে খুব কান্নাকাটি করছিল। লালু ছিল তিতলির বড়ই আপনজন। ওর সঙ্গেই ছিল তার দিনভর আলাপচারী। একা একা থাকার, দীর্ঘ অবসরের সঙ্গী। যে-কোনো কুকুরের চোখে ভালোবেসে চাইলেই বোঝা যায় কী দারুণ বুদ্ধি ধরে তারা। মনিবের চোখের দৃষ্টি দিয়ে সে মনিবের কথা বোঝে। তার দুঃখে দুঃখী হয়, তার সুখে সুখী। বাড়ি ফিরলে, লেজ নেড়ে অভ্যর্থনা জানায়, বাড়িতে না থাকলে মনমরা হয়ে থাকে। স্বার্থহীন, প্রত্যাশাহীন এই ভালোবাসার কোনো সমতুল্য ভালোবাসা খুব কম মানুষের কাছ থেকেই পায় অন্য মানুষ।
লালু ছিল এক অতি সাধারণ, দেহাতি, পেডিগ্রীহীন কুকুর। ওর মা, চিপাদোহরে গারাজের পিছনে সাজিয়ে-রাখা পোড়া-মবিলের টিনের গাদার পাশে নোংরা কটন-ওয়েস্ট-এর মধ্যে ওকে আর ওর তিন ভাইকে জন্ম দিয়েছিল। ধর্মপ্রাণ পাণ্ডেজি তাদের দেখা-শোনা করেছিলেন। লালচে-রঙা গাঁট্টা-গোট্টা গাব্লু-গুবলু একটা কুকুরের বাচ্চাকে আমার হাতে তুলে দিয়ে পাণ্ডেজি বলেছিলেন, নিয়ে যান বাঁশবাবু। কুকুর কখনও নমকহারামি করে না। নমকহারামি আর অকৃতজ্ঞতা শুধু মানুষদেরই
রক্তে আছে।
যখন ছোট ছিল, প্রথম প্রথম আমার পায়ে পায়ে ঘুরে বেড়াত লালু। ফু—উ—উ—উ ফুক্, ফুক্, করে ডাকত। তখনও গলায় ভুক্-ভুক্ ডাক আসে নি। গোঁফদাড়ি ওঠে নি। সাবালক হয় নি লালু। তিতলির আদর-যত্নে দেখতে দেখতে ও বড় হয়ে উঠল। তিতলি ওর সঙ্গে কত কী যে গল্প করত, তা ওই জানে। আসলে তিতলির সঙ্গেই ছিল ওর বন্ধুত্বের সম্পর্ক, আমার সঙ্গে মনিব-কর্মচারীর। তিতলি যখন একা একা কী ভাবতে ভাবতে নিজের মনে দীর্ঘশ্বাস ফেলত, তখন লালুও সঙ্গে সঙ্গে তার সামনে ছড়ানো দুটি পায়ের ওপরে রাখা মুখে পৃথিবীর সব বিষণ্ণতা এনে ফু—স্-স্ করে দীর্ঘশ্বাস ফেলত, যেন তিতলির ব্যথাতেই ব্যথী হয়ে। এক টিপ নস্যি পরিমাণ ধুলো উড়ে যেত ওর নাকের সামনে থেকে হঠাৎ শ্বাস ফেলায়। অবাক লাগত, ওদের দুজনকে দেখে আমার। তিতলিকে এর রহস্য কী তা জিগগেস্ করলে বলত, সে কথা না-ই বা জানলে। তুমি মালিক, আর আমি নোক্রানি। একটা কুকুরও যা বোঝে, তা যদি একজন মানুষ না বোঝে; তাহলে বোঝাবুঝির দরকার নেই।
লালু সাবালক হবার পর, চরিত্রদোষ ঘটেছিল তার। নেড়িকুত্তারও একটা আলাদা পেডিগ্রী আছে। তারও চরিত্র আলাদা, স্বভাব আলাদা। সে পথের কুকুর বলেই যে ফেনা, তা মোটেই নয়। অন্তত আমার তো তাই-ই মনে হয়। রোশনলালবাবুর সঙ্গে কলকাতার এক প্রচণ্ড ধনী পাঞ্জাবি ভদ্রলোক বেড়াতে এসেছিলেন ভালুমারে একবার। স্বামী-স্ত্রী। সুন্দরী শালি, সাহেব ভায়রা-ভাই আর একটা দারুণ সুন্দর কুকুর সঙ্গে নিয়ে। তার গলাটা হরিণ-হরিণ দেখতে। মানে, গ্যাজেলের মতো। এত সুন্দর গ্রেফুল কুকুর আমি কখন দেখিনি। আমি অবশ্য কীই এবং কতটুকুই বা দেখেছি এ জীবনে। কুকুরটির জাত জিজ্ঞেস করতেই ভদ্রলোক বললেন, র্যাফায়েলের ছবি কখনও দেখেছেন? প্রিন্টও দেখেন নি? ওরিজিনালের কথা বলছি না আমি।
আমি খুব জোরে জোরে মাথা নেড়ে বলেছিলাম, না। এবং ভাবছিলাম, র্যাফায়েলের ছবির সঙ্গে এই কুকুরটির কী সম্পর্ক থাকতে পারে?
রাফায়েলের এক বিখ্যাত ছবিতে এই জাতের কুকুররা রয়েছে। এদের বংশলতিকা আমার আপনার বংশলতিকার চেয়েও অনেক উজ্জ্বল। বুঝেছেন?
ইচ্ছে হয়েছিল বলি যে, আমি না হয় বাঁশবাবু। বাঁশবাবুর আবার বংশলতিকা! কিন্তু আপনার এত বিনয় কেন?
ভদ্রলোক আবার বলেছিলেন, আজ থেকে তিন হাজার বছর আগে থেকে এই সালুকি কুকুররা মহা সমাদরে পারসিয়া, সীরিয়া এমনকী মিশরেও পালিত হতো।
কী নাম বললেন?
বোকার মতো শুধিয়েছিলাম। কখনও যে-নাম শুনিনি তার আগে।
সালুকি!
তারপর ইংরিজিতে বানান করে বলেছিলেন। সালুকি কুকুররা তখনকার দিনের নবাব-বাদশা রইস্ আদমিদের সঙ্গে গ্যাজেল শিকারে যেত। এত পুরনো ট্রাডিশন আর ব্যাক-গ্রাউন্ডের কুকুর আর দুটি নেই।
এসব কুকুরের কত দাম জানি না আমি। দাম হয়তো আমার চেয়েও বেশি হবে। কোথায় পাওয়া যায়, তাও অজানা। ভদ্রলোক বলেছিলেন, ইস্টার্ন ইন্ডিয়াতে একমাত্র তাঁর কাছেই আছে। সেই জন্যে এ কুকুরের মেটিং একটা প্রবলেম!
সে কথা শুনে মনে হয়েছিল মেটিং কারই বা না প্রবলেম্! মানুষই হন্যে হয়ে যায় সঙ্গিনী খুঁজতে আর এ তো কুকুর! যতই মহার্ঘ হোক-না সে! তবে, সালুকির চেহারার মধ্যে দারুণ একটা আভিজাত্য ছিল। পা দুটো, লেজ, কানের কাছে কী সুন্দর লোম, ঠিক পাখির পালকের মতো। সরু গলা, হরিণের মতো, আর তেমনই বুদ্ধি-উজ্জ্বল মুখখানি। আহা! ভগবান আমাকে যদি এমন একটি মিষ্টি মুখ দিতেন।
আমি আর তিতলি বারান্দাতে বসে চা খাচ্ছিলাম। আমি ইজিচেয়ারে, তিতলি বারান্দার কোণায়, কাঠের খুঁটিতে হেলান দিয়ে, রোদে পিঠ রেখে, পা ঝুলিয়ে বসে। দুজনের কেউই কোনো কথা বলছিলাম না। বারান্দার এক কোণে লালুর জন্যে পেতে রাখা চটগুলো পড়ে ছিল। তাতে লালুর অনেক লোম ঝরে পড়ে আছে। বারান্দাতে শোন্-চিতোয়ার গায়ের লোমও পড়ে ছিল কটা। আমি আর তিতলি দুদিকে তাকিয়ে লালুর কথা দুজনে দুজনের মতো ভাবছিলাম। এমন সময় কাড়ুয়া এল। তিতলি কাড়ুয়াকে চা আর মাঠী খেতে দিল। কাড়ুয়া বলল, কী চাও তুমি বাঁশবাবু?
আমি আর তিতলি চকিতে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলাম।
আমি কিছু বলার আগেই জলভরা চোখে তিতলি বলল, বদলা চাই।
কাড়ুয়া নিজের ডানহাতের তর্জনীটি ঠোটে ছোঁয়াল। তারপর বলল, লালুর হাড়গোড় নিয়ে আসছি আমি। উঠোনে কবর দিয়ে তার ওপর একটা ফুলের ঝাঁকড়া গাছ পুঁতে দিও তোমরা। তারপর তিতলির দিকে চেয়ে বলল, আমি শিকারি। শিকারিকে ঠান্ডা মাথায় সুযোগ খুঁজতে হয়। সময় সুবিধা মতো সবই হবে। তোর কথা রাখব, প্রমাণও দিয়ে যাব তোকে। তবে একটা কথা, এই ব্যাপার যদি বাঁশবাবু আর তুই ছাড়া আর কেউ জানে, তাহলে খুউব খারাপ হয়ে যাবে। আবার ও বলল টেনে টেনে, খুউব খারাপ।
কাড়ুয়ার কথা বলার আশ্চর্য ধরন দেখে মনে হল যে, কাড়ুয়া নিজেই একটি শোন্-চিতোয়া। কাড়ুয়া উঠে চলে গেল। বললাম, আমাকেও নিয়ে চল্ কাড়ুয়া। কাড়ুয়া যেতে নিষেধ করল। বলল, কী লাভ?
তারপর একা চলে গেল!
কাড়ুয়া হাড় নিয়ে ফিরে এসেছিল বেলা এগারোটা নাগাদ। বলল, খুব বড় চিতা, প্রায় বড় বাঘের মতো। তুমি আর একটু আগে ঘর থেকে বেরুলে তোমার অবস্থাও লালুর মতো হতে পারত। শিকারের সময় কোনো বাধা মানতে রাজি থাকে না ওরা। পুরুষের কাম চাগলে যেমন হয়, বুঝলে না! তাছাড়া, শোনচিতোয়ারা মাহাতোদের মতোই ধূর্ত। যা তারা চায়, তা যেমন করেই হোক না কেন, নিতে চায়। যিতনা-ভি-কিম্মত দে কর্।
আমরা তিনজনে মিলে লালুর হাড়কে কবর দিয়েছিলাম বেড়ার কোণাতে। গাড়ুর রেঞ্জার সাহেবকে বলে একটা ভালো জাতের ফুলের গাছ আনতে হবে। মৃত লালুর প্রতি যেটুকু সম্মান আমরা দেখাতে পারি, দেখাব। লালু যে কুকুরটির প্রতি বিশেষ আসক্ত ছিল, ভালুমার বস্তির মাঝামাঝি একজন দোসাদের বানির কুকুরী সে। কালো ছিপছিপে চেহারা। ফিগার ভালো কিন্তু ডান গালে একটা পোড়া দাগ। তার কালো রঙে তাতে আরও কালি লেগেছিল। কুকুরীটিকে আমার ভালোই লাগত, কিন্তু তিতলি কিছুতেই সহ্য করতে পারত না। ও এলেই পাথর ছুড়ে মারত। লালু, বেপাড়ায় গিয়ে মাস্তানী করলে তিতলি তাকে দড়ি দিয়ে বেঁধে রেখে শাস্তি দিত। জানি না, এই পর্ণকুটিরের দুটিমাত্র পুরুষ, আমি এবং লালু সম্বন্ধে এ কুটিরের একমাত্র মহিলা তিতলি এত ঈর্ষাকাতর ছিল কেন? মেয়েদের কথা, মেয়েরাই ভালো বলতে পারবে। আমরা যখন ‘লালুকে কবর দিচ্ছি, একটা আশ্চর্য কাণ্ড ঘটল। গর্ত খোঁড়ার পর, কাড়ুয়া আর আমি কবরে মাটি দিচ্ছি, তিতলি হাত দিয়ে মাটি সমান করে দিচ্ছে, ঠিক সেই সময়ে বুলেটের মতো গতিতে কী একটা জানোয়ার দৌড়ে এসে ঢুকলো ডেরার বেড়ার গেটের ভিতর দিয়ে। এসেই আমাদের পাশে দাঁড়িয়ে হাঁফাল কিছুক্ষণ।
সেই কালো কুকুরীটি!
হাঁফানি কমলে তিন চার সেকেন্ড নীরবে আমাদের মুখের দিকে সে চেয়ে নিল, তারপর মুখটা ওপরে তুলে এমন এক করুণ তীক্ষ্ণ অথচ মিশ্র স্বরে কেঁদে উঠল যে, আমার বুকের ভেতরটা ভেঙে যেতে লাগল। আমাদের মতো কথা বলতে না পেরেও যে এমনভাবে দুঃখ প্রকাশ করা যায়, তা ঐ কান্না না শুনলে কখনই বিশ্বাস করতাম না।
কুকুরীটি যেমন হঠাৎ এসেছিল, তেমন হঠাৎই চলে গেল। ওর প্রতি দয়াবশত তিতলি ওকে কী খেতে দেওয়া যায় ভাবছিল, কিন্তু ভাবনা শেষ হবার আগেই তিতলির দিকে একবার অভিমানের চোখে তাকিয়েই সে চলে গেল। আসার সময় প্রচণ্ড বেগে দৌড়ে এসেছিল আর ফেরার পথে খুবই আস্তে আস্তে হেঁটে ফিরে গেল। যেন তার পায়ে সময় অনন্তকাল বাঁধা।
কাড়ুয়া পুরো ব্যাপারটা লক্ষ করেছিল, কিন্তু কোনো কথা বলেনি। লালুর কবরে মাটি চাপা দেওয়া শেষ হবার পর, কুয়োতলাতে হাত-পা ধুতে ধুতে কাড়ুয়া হঠাৎ স্বগতোক্তি করল, বলল, কুকুরীটি মা হয়েছে।
কী করে জানলে? কাড়ুয়া চাচা? তিতলি শুধোল কাড়ুয়াকে।
কাড়ুয়া উত্তরে শুধু বলল, আমি জানি।
তিল সঙ্গে সঙ্গে বলল, ওর বাচ্চাদের মধ্যে থেকে একটা ছেলে বেছে নেব আমি। লালুর ছেলে থাকবে আমার কাছে। তারপর একটু থেমে বলল, তুমি ঠিক জানো ত কাড়ুয়া চাচা?
কাড়ুয়া তিতলির মুখের দিকে চেয়ে একটু বিরক্তি ভরে মাথা নাড়ল
বেশি কথার লোক নয় সে। বেশি কথা কখনও বলে না। শোনেও না কারো কাছ থেকে।
কোনোই আভিজাত্য ছিলো না লালুর। “সালুকি” ছিল না। সে ছিল মানুষের জগতে তার মনিব যেমন, তেমনই জীবজগতের অতি সাধারণ এক জীব! তাইই বোধহয় ওর ভাষাহীনতায় এবং আমার বাঙ্ময়তার সন্ধিতে কোথায়, কখন, কী এক নিবিড় সখ্যতা ও গভীর মমত্ববোধ জন্মে গেছিল, তা লক্ষ করিনি যতদিন ও ছিল। যেমন লক্ষ করি না, বা করলেও ভুলে যাই প্রতিদিনের পথের পাশে অনবধানে জন্মানো ব্যাঙের ছাতা অথবা রাহেলাওলা ফুলেদের। লালু আজকে হঠাৎ এইভাবে চলে গেল বলেই বুঝতে পারছি যে, ও আমার আত্মার কত কাছের ছিল। বলতে গেলে, আত্মীয়ই ছিল। যতখানি আত্মীয় ও ছিল, ঠিক ততখানি আত্মীয় বোধ হয় আমার অনেকানেক কাছের মানুষ অথবা রক্তসূত্রের আত্মীয়রাও নন। আমি, এই বাঁশবাবু, যদি কোনোদিন কোনো দৈব-দুর্ঘটনায় হঠাৎ যশস্বী হয়ে উঠতাম, বিত্তবান হতাম; লালু তাতে কেবল খুশিই হতো, লেজ নাড়তে নাড়তে লাফিয়ে আমার হাঁটুতে উঠতে চাইতো কিন্তু মানুষদের মতো ঈর্ষা, দ্বেষ ও দাদ-সদৃশ মানসিক অসুস্থতার শিকার সে কখনওই হতো না।