১২
রথীদা বলেছিলেন, জিপ যখন আছে, ওঁদের মহুয়াডারে ঘুরিয়ে আন্। কলকাতার লোকেরা অনেকেই পালামৌ দেখতে এসে বেলা দেখেই চলে যান। মহুয়াডার অবধি গেলে একেবারে ক্রস-কান্ট্রি ট্যুওর হয়ে যাবে। পথে হাতি তো নিশ্চয়ই দেখতে পাবেন ওঁরা। অন্যান্য জানোয়ারও দেখতে পারেন। মহুয়াডারে যাওয়া-আসাটাই একটা এক্সপিরিয়েন্স। সারাজীবন মনে রাখবার মতো।
সেদিন সকাল সকাল নাস্তা করে আমরা বেরিয়ে পড়লাম। স্টিয়ারিংএ সিং। তার পাশে ছোটমামা এবং জিন্। পিছনে আমি, রণবাবু এবং বাণী। মামিমা আসেননি। বলেছেন, তোর মামা দেখলেই আমার দেখা হবে।
কৌটো করে কুচো নিম্কি, শেওই ভাজা, প্যাড়া এবং ফ্ল্যাস্কে করে চা সঙ্গে নিয়েছি আমরা। জিপ ছাড়বার পর থেকেই পথের দু-পাশে তাকিয়ে ছোটমামা কন্টিনিউয়াসলি “অপূর্ব” “অপূর্ব” বলে চলেছিলেন। জিন্ চুপচাপ। রণবাবুর কাঁধের ঝোলায় সালিম আলির বই, বাইনানকুলার, দামি ক্যামেরা। দেওঘরের কাছে রিখিয়াতে ওঁর এক বন্ধুর বাড়ি আছে। কবি বিষ্ণু দেরও বাড়ি আছে শুনেছি ওখানে। প্রায়ই যান নাকি সেখানে বার্ড-ওয়াচিং-এর জন্যে। মাঝে মাঝেই আমাকে প্রশ্ন করছেন, এটা কী গাছ? ওটা কী নদী? এটা কী ফুল? ঐ রাস্তাটা কোথায় গেছে?
যথাসাধ্য জবাব দিয়ে যাচ্ছি। বাণী মন্ত্রমুগ্ধের মতো চেয়ে আছেন জিপের পিছনে বসে, ক্রমাগত ফেলে-যাওয়া পথের দিকে। পথের লাল ধুলোর মেঘের উপর গাছ-গাছালির ফাঁক-ফোক দিয়ে রোদের ফালি এসে পড়ছে টর্চের তীক্ষ্ণ আলোর মতো। অবাক চোখে বসে আছেন বাণী।
দেখতে দেখতে আমরা দিঠিয়াতে এসে পৌঁছলাম। নদীর ওপরের কওয়েটা পেরিয়েই পথটা উঠে গিয়ে ডানদিকে মোড় নিয়েছে। বাঁদিকে ছোট্ট ফরেস্ট বাংলো। কবরী ফুলের গাছ, রাধাচূড়া, হলুদ, করবীতে ভরে গেছে চারপাশ। বাংলোর ড্রাইভে সারি করে লাগানো ইউক্যালিপটাস্। বাংলোটা ওঁরা নেমে দেখলেন। সামনে ছোট্ট বারান্দা, বড় বড় হাতাওয়ালা ইজিচেয়ার। সামনে একটা নিচু উপত্যকা মতো। আমরা গিয়ে বারান্দায় দাঁড়াতেই একজোড়া চিতল হরিণ দৌড়ে চলে গেল। বাংলোর নিচের ঢালে লাগানো অড়হর খাচ্ছিল ওরা। হুলুক্ পাহাড়টা এখানে আকাশ আড়াল করে দাঁড়িয়ে আছে। খুবই কাছে। পাহাড়ের মাথায় গুহাগুলো দেখা যাচ্ছে অন্ধকার গহ্বরের মতো। একটা ঝরনা প্রায় পাহাড়ের মাথায়। এখন শুকনো জলের সাদা দাগ দেখা যাচ্ছে কালো কালো বড় পাথরে।
ওঁরা সকলেই আনন্দ উত্তেজনায় অস্থির। কেবল জিন্ নীরব। মুখে কথা নেই। সঙ্গীদের ছেলেমানুষি ও উৎসাহের আতিশয্যে কিঞ্চিৎ বিরক্তি এবং অবাক হওয়ার দৃষ্টি চোখে।
ভয়ে ভয়ে বললাম, এখানে কি আমরা একটু গান শুনতে পারি?
ন্যাকা-বোকা লোকেরা যেমন করে কথা বলে, তেমনই করে বললাম। জিন্ আসার পর থেকে সত্যিই ন্যাকাবোকা হয়ে গেছি।
বাণী বললেন, এই জিন্ শুনছিস? শোনা-না বাবা একটা গান।
অসম্ভব। আমার গলা ভীষণ খারাপ। গলায় ব্যথা।
একটু আগেই পথের বাঁদিকে মীরচাইয়া ফল্স দেখিয়ে এনেছি ওঁদের। প্রকাণ্ড এলাকা জুড়ে কালো চ্যাটানো পাথর। শীতে শুকনো। পিক্নিক্ করার আইডিয়াল জায়গা। একটি ধারায় জল পড়ছে এখন। বর্ষাকালে ও পুজোর সময় এলে জলে ঢাকা থাকে পুরো জায়গাটা।
বাণী বললেন, আমরা ফেরার সময় এখানে বসে চা খাব কি সায়নবাবু?
যথা আজ্ঞা।
বললাম, মহুয়াডার অনেক দূরের পথ। এমন ভাবে থেমে থেমে গেলে ফিরতে কিন্তু রাত হয়ে যাবে। তাছাড়া বাড়েষার ঘাটের রাস্তাও খুব খারাপ। খুবই উঁচু ঘাট রাস্তা তো বরাবরই কাঁচা। হাতির উপদ্রবও আছে, তাই তাড়াতাড়ি গিয়ে তাড়াতাড়ি ফেরাই ভাল। সিংও তাড়া দিতে লাগল বারবার। হাতিকে বড় ভয় পায় ও। একবার ওর জিপ উল্টে দিয়ে ছিল! তাই বেশিক্ষণ থাকা হল না ওঁদের নিরবুদিয়া ফল্স এবং দিঠিয়াতে। বাংলো ছাড়িয়ে এসেই পথটা দুভাগ হয়ে গেছে। বাঁদিকের পথ চলে গেছে রুদ্ হয়ে লাত্। আর ডানদিকে বাড়েষাঁর-এর রাস্তা। বাড়েষাঁর যাবার গেট পেরিয়ে আমরা ঘাট চড়তে শুরু করলাম। ঘাটে ভীষণ শীত, একটুও রোদ নেই। গভীর জঙ্গলে-ঘেরা ছায়াচ্ছন্ন বন-পথ। মারুমারের কাছ থেকে একটা পথ জঙ্গলে জঙ্গলে চলে গেছে নেতারহাট। আরেকটা পথও গাড়ুর আগে থেকে চলে গেছে বানারীতে। সেখান থেকে ডানদিকে গেলে নেতারহাট, আর বাঁয়ে গেলে লোহারডাগা। পথটা বারেবার নানা পাহাড়ী নদীর ওপর দিয়ে চলে গেছে। একটা নদীর পাশে কতগুলো তাগড়া পোষা মোষ চরছিল। ছোটমামা চেঁচিয়ে উঠে সিং-এর স্টিয়ারিং-এ থাপ্পড় মেরে বললেন, বাইসন! বাইসন! স্টপ্!
অ্যাক্সিডেন্ট হতে হতে বেঁচে গেল খুব জোর। সিং বিরক্ত হল।
বাণী বললেন, খুব ফাঁড়া কাটল। জিপটা একটু বাঁদিকে রাখতে বলুন, একটু চা খাওয়ানো যাক সিংকে। খুবই চটেছে।
জিপ থামানো হলো। ছোটমামা ও রণবাবু নেমে নদীর ওপরের ব্রিজে দাঁড়িয়ে ছোটমামার “বাইসন” দেখতে লাগলেন। গলায় কাঠের ঘণ্টা-বাঁধা বড় বড় মোষ পুট্-পাট্ করে ঘাস ছিঁড়ে খাচ্ছিল! গলার কাঠের ঘণ্টা বাজছিল গম্ভীর বিধুর টুং টাং শব্দ করে, নদীর পাশে জঙ্গলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে
হঠাৎ রণবাবু চেঁচিয়ে উঠলেন, এই যে, সায়নবাবু দৌড়ে আসুন। এটা কী পাখি? বলেই, আমার যাওয়ার অপেক্ষা না রেখেই সালিম আলির বই খুলে ফেললেন। একবার বাইনানকুলার দিয়ে দেখেন আর একবার বইয়ের পাতা ওলটান। ঘন ঘন। বার বার।
আমি ওঁদের চায়ের গ্লাস হাতে করে নিয়ে গিয়ে দাঁড়ালাম।
পেয়েছি, পেয়েছি।
বললাম, পাখিটা কোথায়?
ঐ তো! বলে উনি আঙুল দিয়ে দেখালেন দুটো পাখি। উনি বই-এর পাতা থেকে নামটা পড়েই, আমার সঙ্গে হ্যান্ডসেক্ করলেন। গ্লাস থেকে চা চলকে পড়ল বাইনানকুলারে।
মিনিভেট্কে, স্কার্লেট বললে ঠিক বোঝানো যায় না। একেবারে অরেঞ্জ ফ্লেম্ কালার। পুরুষ পাখিটার ঐরকম রঙ, কিন্তু স্ত্রীর রঙ হলুদ। ডানাতে চীনাবাদামের খোসার রঙের খয়েরি মোটা বর্ডার দেওয়া।
রণবাবু বললেন, কোথায়ও দেখি নি কখনও, এমনকী রিখিয়াতেও না। তক্ষুণি পাখিদুটো জংলি আমের ডাল ছেড়ে উঠে গেল।
ওগুলো কী গাছ? অ্যাকাসিয়ার মতো অনেকটা। জানেন, একরকমের হলুদ অ্যাকাসিয়া হয় আফ্রিকাতে, নাম ইয়ালোফিভার অ্যাকাসিয়া। জলের কাছাকাছি হয়।
জানি না। এখানে তো দেখিনি।
এখানে কোথায় দেখবেন? ও তো আফ্রিকার গাছ। সোয়াহিলীতে বলে, মিগুংগা। রুয়েঞ্জোরী রেঞ্জ, চাঁদের পাহাড়, মানে মাউন্টেন অফ দ্যা মুন, আর কিলিম্যানজারোর কাছেও অনেক দেখা যায়। বলেই, ব্রিজ থেকে হাত বাড়িয়েই সেই গাছ থেকে একমুঠো পাথা ছিঁড়লেন। চোখের একেবারে কাছে এনে পাতাগুলোকে ভালো করে নিরীক্ষণ করতে লাগলেন।
আমার বুকে লাগল। রণবাবু অনেক জানেন, কিন্তু উনি কি জানেন না যে, গাছেদেরও প্রাণ আছে, তারাও ভালোবাসতে জানে, চুমু খায়? হঠাৎ আনন্দের আতিশয্যে একমুঠো পাতা ছেঁড়ার কী দরকার ছিল? অনেক বছর জঙ্গলে থাকাকালীন রণবাবুর মতো অনেক উৎসাহী লোক দেখেছি আমি। যাঁরা গাছ-গাছালি, জানোয়ার, পাখি সম্বন্ধে অনেক খোঁজ রাখেন, পড়াশুনা করেন। সত্যিকারের উৎসাহ আছে এঁদের সব বিষয়ে। এরকম লোক আরও বেশি থাকলে ভালো হতো এদেশে। কিন্তু এঁদের মধ্যে অনেকেই জ্ঞানের জন্যেই জ্ঞান আহরণ করেন, এবং হয়তো অন্যকে জ্ঞানদানের জন্যও কিছুটা
বনজঙ্গল, বন্যপ্রাণী, পাখি, প্রজাপতি সম্বন্ধে আমার উৎসাহটা এঁদের উৎসাহ থেকে কিছু আলাদা। আমার উৎসাহটা কবির। আমার এই ভালোলাগায় বুঁদ-হওয়া কবির চোখ, অনাবিল মন, কোনো জ্ঞান বা বিদ্যার জটিলতা দিয়ে আবিল করতে চাই না আমি। চাইনি কখনওই। এই ভোরের নরম সুগন্ধি শিশির-ভেজা বনে, পল্লবিত জংলি আমগাছের ডালে উড়ে এসে বসা এবং সত্যি না-হওয়া স্বপ্নর মতো হঠাৎ উড়ে-যাওয়া এই পথিপার্শ্বের ক্ষণিকের অতিথি পাখিদুটির ছবি ভাস্বর হয়ে থাকবে আমার স্মৃতিতে। তাদের গায়ের রঙ, তাদের গলার স্বর, তাদের ব্যস্তসমস্ত ভাব, তাদের উড়ে যাবার পর ঈষৎ আন্দোলিত ঘন সবুজ আমগাছের পাতাগুলি এসবই চিরস্থায়ী।
সাধারণত আমার পাখির নাম জানতে ইচ্ছে করে না। মানুষেরও বিদ্যাবুদ্ধি, অতীত-ভবিষ্যৎ, শিক্ষা-বিত্ত এসব কিছুই আমার ঔৎসুক্যর বাইরে। অত জানলে, জ্ঞানী হওয়া যায় নিঃসন্দেহে, কিন্তু নরম পাখি, কিংবা লজ্জাবতী লতা কিংবা জিন্-এর মতো অন্তর্মুখী স্বল্পবাক্ মানুষকে হয়তো তেমন করে ভালোবাসা যায় না। ভালোবাসার সমস্ত আনন্দ তো ভালোবাসারই মধ্যে। আমার মতো বোকারাই একমাত্র জানে সেই বোকামির সুখ। সেই নিক্কণিত সুমধুর আনন্দের অভিনবত্ব ও চকম জ্ঞানী ও বুদ্ধিমানেরা কোনোদিনও জানবেন না। কবির সঙ্গে বিজ্ঞানীর বিবাদ আছে। এবং থাকবেও। সভ্যতা যতদিন আছে এ নিয়ে তর্ক বা ঝগড়ার কোনো অবকাশ নেই।
আমরা চা খাচ্ছিলাম যখন, তখন হঠাৎ কোনো প্রাগৈতিহাসিক জানোয়ারের গর্জনের মতো গভীর জঙ্গলাবৃত পাহাড়ের ঘাটের উঁচু রাস্তা থেকে একটা পুরো-লাদাই মার্সিডিস ট্রাকের এঞ্জিনের আওয়াজ ভেসে এল। তারপর আওয়াজটা বাঁকে বাঁকে ঘুরে ফিরে স্পষ্ট হতে হতে আমাদের দিকে এগিয়ে আসতে লাগলো। সিং জিপটাকে একেবারে বাঁয়ে, সাইড করে রাখল ট্রাক যাবার পথ করে দিয়ে। আমরা ব্রিজ ছেড়ে সরে এলাম। একটু পরে ট্রাকটা আমাদের পিছনে ফেলে চলে গেল।
রণবাবু বললেন, এগুলো কী পাতা? পাহাড়-প্রমাণ পাতা নিয়ে কোথায় চললো। ট্রাকটা?
ছোটমামা বললেন, আরে, এগুলো বিড়ি পাতা। কী যেন নাম পাতাগুলোর? আহা! কী যেন, মনে করতে পারছি না। তোমরা সব শহরের লোক। কোনো খবরই রাখো না। আমাদের গিরিডিতে….
বললাম, বিড়িপাতা মানে, বলছ, কেন্দু পাতা তো—
হ্যাঁ, হ্যাঁ কেঁদ, মনে পড়েছে। তারপর বললেন, কেঁদ পাতা চলেছে বিড়িপাতার ব্যাপারীর গুদামে।
ওগুলো কিন্তু বিড়ি-পাতা নয় ছোটমামা। বিড়িপাতা প্রায় গোল দেখতে, এবং অনেক ছোটও হয়। কিন্তু বড়-বড় কালচে-সবুজ পাতাগুলোর নাম মহুলান্। এগুলো যাবে দক্ষিণ ভারতে।
দক্ষিণ ভারতে কেন? কী হয় এই পাতা দিয়ে? রণবাবু শুধোলেন।
ঠিক জানি না, তবে শুনেছি আমাদের এদিকে শালপাতা যেমন দোনার কাজে ব্যবহৃত হয়, দক্ষিণ ভারতে মন্দির-টন্দিরে নাকি এই পাতাও দোনার মতো ব্যবহৃত হয়। অন্য জায়গাতেও হতে পারে।
বাণী জিন্-এর কাছে চলে গেছিলেন, দরজার পাশে। ওঁকে খুব চিন্তিত দেখাচ্ছিল। ওঁকে বলতে শুনলাম, কী বলছিস রে তুই? আশ্চর্য! এমন সব জায়গা, তোর ভালো লাগছে না? তাহলে আমার কিছুই বলার নেই।
বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠল। আমার এই নির্বিবাদ মালিকানার রাজত্ব যদি জিন্-এর ভালো না লেগে থাকে, তবে এই নির্জন আরণ্য-পর্বতের রবিনসন ক্রুসোকেও নিশ্চয়ই ভালো লাগছে না। এ পর্যন্ত ধারণা ছিল নিজের সম্বন্ধে যে, আমাকেও ভালো লাগবে না কারোর, এমনটি হতেই পারে না। বোধহয় বেশির ভাগ মানুষই এই জন্মগত আত্মবিশ্বাস নিয়ে বড় হয়। তারপর জীবনের পথে এগোতে এগোতে ধীরে ধীরে বোধহয় এই ছেলেমানুষি বিশ্বাস ক্রমে ক্রমে চিড় খেতে থাকে। শেষে হয়তো একদিন এমনই হয় যে, আমাকে একজন কারোরও যে আদৌ ভালো লাগাতে পারে, এমন ভরসা পর্যন্ত হয় না। সে অবস্থাটা বড় করুণ। জানি না, কপালে কী আছে। আসলে জিন্-এর এই মৌনী অবস্থা আমাকে অনেক কিছু ভাবতে বাধ্য করছে। এমন দারুণ আনন্দের মিষ্টি সকালটা হঠাৎই কেমন তেতো লাগতে লাগল। বেলা সাড়ে বারোটা নাগাদ আমরা বাড়েষাঁর উপত্যকাতে নেমে এলাম। উঁচু বাড়েষাঁর ঘাট পেরিয়ে। বাড়েষাঁর জায়গাটা ছোট। চারধারে পাহাড়, মধ্যিখানে সমান জমি। কিছু ছাড়া ছাড়া জঙ্গল, কিছু ক্ষেত-খামার। কয়েকটা একলা বুড়ো মহুয়া গাছ ইতস্তত ছড়িয়ে। গাছগুলোর অনেক বয়স। অনেক দেখেছে গাছগুলো।
গাছতলায় জিপ দাঁড় করিয়ে আমরা পরমেশ্বরের দোকানের সামনের কাঠের বেঞ্চে বসে খাঁটি ঘিয়েভাজা পুরী, সিম-এর সবজি, আলুর চোকা এবং আঁওলার আচার দিয়ে দুপুরের খাওয়া সারলাম। তারপর ওর দোকানে খাঁটি দুধে-ফোটানো চা। চা খেতে খেতে হঠাৎ বাণী আবৃত্তি করে উঠলেন :
“ভালবেসেছিল তারাও, আমার মতো
সীমাহীন মাঠ, আকাশ স্বরাট্,
তারারাশি বাতাহত।
গড্ডলিকার সহবাসে উত্ত্যক্ত,
তারা খুঁজেছিল সাযুজ্য সংরক্ত,
কল্পতরুর নত শাখে সংসক্ত
শুক্ল শশীরে ভেবেছিল করগত।
নগরে কেবল সেবিল গরল
তারাও, আমার মতো।।”
বলেই বলল, বলুন তো মশাই কার কবিতা?
ছোটমামা বললেন, রবীন্দ্রনাথ, আর কার?
আমি বললাম, সুধীন্দ্রনাথ-সুধীন্দ্রনাথ গন্ধ পাচ্ছি। ঠিক কিনা জানি না।
রণবাবু চায়ের গ্লাস বেঞ্চে রেখে বাইনানকুলার দিয়ে দূরের ওক্সির জঙ্গল দেখতে দেখতে বললেন, কার সঙ্গে কার নাম।
বাণী চটে উঠে বললেন, যা করছ, তাই-ই করো। সব ব্যাপারেই তোমার কথা বলা চাই। চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট, কাব্যের কী বোঝো তুমি?
বলেই, আমার দিকে ফিরে বললেন, সায়নবাবু, আপনিই ঠিক। কিন্তু কোন্ কবিতার লাইন বলুন তো?
বিব্রত হয়ে বললাম, রণবাবু চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট, আর আমি তো বাঁশবনের লোক। অত কী জানি?
“নান্দীমুখ।” নান্দীমুখের লাইন।
বাণী বললেন।
এখানে আসার পথে আমরা কয়েকটি হরিণ, একটি চিতাবাঘ, কয়েকদল হনুমান এবং একটি হাতি দেখেছিলাম। সকলেই কল্কল্ করছিলেন। চারধারে তাকিয়ে আনন্দ আর উত্তেজনার শেষ নেই। উত্তেজনা শুধু নেই সিং ড্রাইভারের। এ পথে তাকে রোশনলালবাবুর নানা রকম অতিথি-টতিথি নিয়ে মাসে কয়েকবারই আসতে হয়। গাড়ির স্বাস্থ্য এবং পথের অবস্থাই তার একমাত্র ভাবনা। মনে মনে সে হিসেব কষে দেখছিল যে, এই সব অতি-উৎসাহী শহুরে বাবুদের নিয়ে অন্ধকার হবার আগে আগেই বাড়েষাঁড়ের ঘাট আবার পেরোতে পারবে কিনা। ঘাটের পথটা বড় সরু। হাতির দল মাঝে মাঝেই পথ আটকায়। অত উঁচু পাহাড়ের আঁকাবাঁকা পথে গাড়ি ব্যাক করারও অসুবিধে। সিং ছাড়াও আরও একজন নীরব এবং নির্লিপ্ত। দিঠিয়ার বাংলোতে একবার মাত্র এক মিনিটের জন্যে বাথরুমে যাওয়া ছাড়া জিন্ একবারও গাড়ি থেকে নামেননি। আমাকে একবার কাছাকাছি পেয়ে বলেছিলেন।…
নাঃ। অনেক কিছুই বলতে পারতেন যদিও কিন্তু বলেননি কিছুই।
ঝুরু ঝুরু করে শীতের হাওয়া বইছিল পাতায় পাতায়, মাটিতে শুকনো শালপাতা মচ্মচানি তুলে গড়িয়ে যাচ্ছিল। শীতার্ত প্রকৃতি একটু উষ্ণতার জন্যে হাহাকার করছিল। হয়তো করছিল আমার মনও। কিন্তু জিন্ জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে শুধু বলেছিলেন, আমাদের অন্য কোনো পথে ফিরে যাওয়ার উপায় নেই, না? ঐ সাংঘাতিক রাস্তা দিয়েই ফিরতে হবে?
হ্যাঁ। আমি বলেছিলাম।
কথাটাতে চমকে উঠেছিল জিন্! বলেছিল, ফেরবার কোনো পথই নেই আর?
না।
কথাটা বলতে পেরে এবং বলে খুশি হয়েছিলাম।
পরক্ষণেই জিন্ বলেছিলেন, আমরা আপনাকে খুব জ্বালাচ্ছি। অনেকই ট্রাব্ল দিলাম।
চা খেতে খেতে ভাবছিলাম, ভালুমার থেকে মহুয়াডারে আসার সবচেয়ে বড় আনন্দ ঐ পথটি। অমন সুন্দর পথকে যিনি সাংঘাতিক পথ বলতে পারেন, তিনি অসাধারণ মানুষ। আসলে এ ধরনের মানুষের কাছে বোধহয় পথটার কোনো দামই নেই। যে কোনো পথে গন্তব্যে পৌঁছতেই এঁরা ভালোবাসেন। গন্তব্যটাই এঁদের কাছে সব; সমস্ত। আমার কাছে যেমন পথটা অনেকখানি। কথাটা ভেবে খুব দুঃখ পেলাম।
খাওয়া-দাওয়ায় পর বাণী আর আমি দুটো পান খেলাম, কালা ও পিলা পাত্তি জর্দা দিয়ে। বাণী পিক্ ফেলে বললেন, আপনার সঙ্গে আমার এত বিষয়ে মিল মশাই যে, কী বলব! কোথায় যে লুকিয়ে ছিলেন এতদিন? রণবাবুর দিকে ফিরে আমাকেই বললেন, কিছুদিন আগে দেখা হলে কত ভালো হতো বলুন তো?
রণবাবু হোল্ডারে সিগারেট লাগাচ্ছিলেন। বললেন, এতো খেদের কী আছে? ছেলে-মেয়ে যখন হয়নি এখনও, লেট আসবি সেপারেটেড্ গ্রেসফুলি। তুমি এখানে থাকলে তো ভালোই। মাঝে মাঝে বার্ড-ওয়াচিং-র জন্যে আসা যাবে।
লজ্জা পেয়ে বললাম, উনি না থাকলেও আপনি যখন খুশি আসতে পারেন।
এখন বলছেন মশাই। পরে হয়তো চিনতেই পারবেন না।
এসব কী কথা? আমার প্রায় হয়ে যাওয়া সম্বন্ধীর মুখে এরকম হেঁয়ালি হেঁয়ালি কথা মোটেই ভালো লাগছিল না আমার।
জিন্ বলে উঠল, ছোটজেঠু, তুমি পাশে বসে এমন সিগার খেলে আমার বমি হয়ে যাবে। কী বিচ্ছিরি গন্ধ।
বাণী পিক্ মুখে আমাকে ইশারা করলেন সিংকে গাড়ি থামাতে।
আমি সিং-এর কাঁধে হাত রাখলাম, সিং ব্রেক কষল।
জিন্ বললেন, আবার কী হল?
বাণী কথা বলতে পারছিলেন না। আমাকে আর রণবাবুকে টপকে পিচিক্ করে পিক্ ফেললেন রাস্তার ধুলোয়।
জিন্ পিছন ফিরে অত্যন্ত বিরক্তির গলায় বললেন, সত্যি বৌদি! একজন মডার্ন মেয়ে হয়ে যে কী করে পান খাও আর পুচ্ পুচ্ করে পিক ফেলো সব সময় ভাবতে পারি না। একেবারে জংলি তুমি।
বাণী ঢোক গিলে, আমার দিকে আঙুল দেখিয়ে বললেন, পান মুখে, উ, ঊ, ও, আ, আ…আরেকজনও আছেন।
জিন্ সঙ্গে সঙ্গে আমাকে বলল, ওঃ! আই অ্যাম সরি। আমি, কিন্তু আপনাকে বলিনি। কিছু মনে করবেন না, ক্ষমা করবেন।
মেয়েটি বড়ই ভদ্র। শহরের মেয়েরা বোধহয় এরকমই হয় আজকাল। তাদের অকলঙ্ক উজ্জ্বল হৃদয়হীন ভদ্রতাটা বড় চোখে লাগে। ভর-দুপুরের সূর্যের মতো।
ওক্সিতে এসে পৌঁছলাম আমরা। চেকপোস্টে যে গার্ডটি নাকা খুললো তার একটি পা নেই।
রণবাবু শুধোলেন, ওর পায়ে কী হয়েছিল? একটি পা নেই দেখছি।
আসলে, চিপাদোহরে আমাদেরই একটা ট্রাকের তলায় পড়ে গেছিল ও। পা-টাই জখম, হয়েছিল। শেষে ডালটনগঞ্জের হাসপাতালে ওর প্রাণ বাঁচাবার জন্যে পাটা কেটে ফেলতে হয়েছিল। কিন্তু এই পরিবেশে, এমন উত্তর শুনে, রণবাবু হতাশ হবেন নিশ্চিত জেনেই আমি একটি তাৎক্ষণিক গল্প বানালাম। বললাম, একদিন সন্ধের সময় ও যখন এই গেট খুলছিল, একটা বাঘ এসে ওর পা কামড়ে ধরে। তারপর চেকপোস্টের লোকেরা হৈ-হল্লা করলে বাঘ পালিয়ে যায়। কিন্তু ওর পায়ে গ্যাংগ্রিন্ হয়ে পা পচে যায়। পা কেটে ফেলে ওর জীবন বাঁচানো হয়।
বাণী বললেন, কী সাংঘাতিক!
রণবাবু বললেন, কিন্তু জিম করবেট যে বলেছেন, বাঘ তো সচরাচর এমন করে মানুষের পা কামড়ে ধরে না। ধরলে, গলাই কামড়ে ধরে; নয়ত কাঁধ
বিপদে পড়লাম। কথাটা সত্যি। ইজিচেয়ারে বসে জঙ্গল সম্বন্ধে যাঁরা বই পড়ে সমস্ত জেনে ফেলেন তাঁদের আমি বাঘের চেয়েও বেশি ভয় পাই।
বললাম, জিম করবেটের এলাকা ছিল কুমায়ুন অঞ্চল। মুখ্যত। এখানের বাঘেরা হয়তো ভালো স্কুলে লেখাপড়া করেনি। তাই অসভ্যর মতো ব্যবহার করে।
রণবাবু কথাটা বিশ্বাস করলেন।
ছোটমামা বললেন, বুঝলি, আমার যখন বারো বছর বয়স তখন গিরিডির কাছের উশ্রী ফল্সএ পিকনিক করতে গিয়ে একটা চিতাবাগ দেখেছিলাম। সেটা কিন্তু আমার পা ধরবার মতলবেই ছিল।
বললাম, হয়তো তোমার কাছে ক্ষমা চাইতেও এসে থাকতে পারে কোনো কারণে।
দ্যাখ্ খোকা। সিরিয়াস্ ব্যাপার নিয়ে ইয়ার্কি করবি না কখনও।
বাণী বললেন, তারপর আপনি কী করলেন ছোটজেঠু?
যা সকলেই করে। তখন আর করার কী ছিল?
কী? গাছে উঠেছিলেন? বাণী শুধোলেন।
যাঃ।
প্রাণপণে দৌড়েছিলেন নিশ্চয়ই! রণবাবু বললেন।
ছোটমামা সজোরে সিগারেটটা বাইরে ছুড়ে ফেলে বললেন, নাঃ। ও দুটোর কোনোটাই করিনি। কারণ, মনে হয়েছিল, যে পা দুটি বাঘে ধরতে এসেছিল তার একটাও বুঝি আমার নেই।
তবে কী করেছিলে? আমি শুধোলাম এবার
ছোটমামা বললেন, একেবারে ফ্রিজ শট-এর মতো ফ্রিজ করে গেছিলাম। এবং ছোট-বাইরে। প্যান্টেই। ইন্স্ট্যান্টেনালি। আমি বলেই, সত্যিটা কবুল করলুম। অনেক বড় বড় শিকারিও চেপে যান।
সকলেই হো হো করে হেসে উঠলেন।
বাণী বললেন, কী খারাপ কথা বলতে পারেন না আপনি ছোটজেঠু।
কিন্তু আশ্চর্য। জিন্ হাসলেন না।
দূরে মহুয়াডারের মালভূমি দেখা যাচ্ছিল। আমার অনেকবার দেখা। তবুও বড় ভালো লাগে। চারধারে পাহাড়ঘেরা লালচে-গেরুয়া-বাদামিতে মেশানো বিস্তীর্ণ সমতল। হু হু করে হাওয়া বইছে মাইলের পর মাইল ফাঁকা জায়গাতে। সেই ছোট্ট শ্বেত শঙ্খিনী নদীটি ঘুরে গছে বাঁকে বাঁকে। জিপটা যখন এগোতে থাকে সেই উন্মুক্ত, উদোম শুদ্ধতার দিকে, আর আমাকে নীরবে হাতছানি দেয় দিক্চক্রবালে হাত ধরাধরি করে দাঁড়িয়ে-থাকা অর্জুনের গায়ের রঙের মতো নীল রঙের পাহাড়েরা, তখন প্রতিবারেই মনে হয়, শান্তি যদি পৃথিবীতে কোথাওই থাকে, তবে বোধহয় এখানেই, এখানেই : এখানেই।
যখন আমরা মহুয়াডারের মাঝামাঝি এসেছি, দূরে মহুয়াডার জনপদ দেখা যাচ্ছে, তখন জিন্ হঠাৎ বললেন, ক’টা বাজে দ্যাখো ত, ছোটজেঠু। আমার ঘড়িটা বন্ধ হয়ে গেছে।
ছোটমামা পাঞ্জাবির হাতা তুলে ঘড়ি দেখে বললেন, আড়াইটা।
জিন্ আতঙ্কিত গলায় বললেন, বৌদি এখানে আর দেরি করিস না তোরা বেশি। এখান থেকে ফিরে যাওয়ার আর পথ নেই।
আরে ফিরব তো সবাই-ই। এসেই ফিরে যাবার জন্যে এলিই বা কেন তুই? জিন্ জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে নৈর্ব্যক্তিক গলায় বললেন, ইচ্ছে মতো ফেরা যাবে না, তা আগে জানলে; কখনই আসতাম না।
বলার কিছুই ছিল না। আবারও লজ্জিত হলাম। লজ্জা পেতেই…
উল্টোদিক দিয়ে একটা ট্রাক আসছিল। ট্রাকের ড্রাইভার আমাদের জিপ এবং সিং ড্রাইভারকে দেখে থামাল। আমাদের কোম্পানিরই ট্রাক। কোনো কাজে এসেছিল এখানে।
ট্রাক ড্রাইভার সিংকে শুধোলো, কাদের নিয়ে এসেছ সিং?
বাঁশবাবু আর বাবুর মেহমানদের।
সিং বললো।
বাঁশবাবু আছেন নাকি? উল্লসিত হল সিং-এর কথা শুনে ড্রাইভার রামলগন।
ট্রাক থেকে নেমে, সিংকে একটু খৈনি দিল, তারপর জিপের পেছনে এসে আমাকে বলল, পরর্নাম বাবু।
পর্নাম।
আপনার ছাতাটা মেরামত হয়ে গেছে। জুতো জোড়াও। আমি কালই চিপাদোহার থেকে পাঠিয়ে দেব।
তাই দিও।
রামলগন আবার বলল, পরর্নাম।
আমিও যন্ত্রের মতো বললাম, পরনাম।
আমার উদাসীন ব্যবহারে রামলগন হয়তো একটু অবাকই হলো।
হঠাৎ জিন্ শুধোলেন, বাঁশবাবু? কার নাম?
আমি নিষ্কম্প গলায় বললাম, আমার নাম।
উনি বললেন, ও।
জিপ সুদ্ধু সকলেই স্তব্ধ হয়ে রইলেন। আমি ত বটেই, অনেকক্ষণ কেউই কোনো কথা বললেন না।
ডিজেলের জিপটা চললে যে এত শব্দ হয়, এই-ই প্রথম যেন সকলের সে বিষয়ে হুঁশ হল।