কোজাগরী লক্ষ্মীপূজার কথা
এক দেশে এক রাজা ছিলেন। তাঁর হাটে যে সকল জিনিস বিক্রি হত না, তিনি তা মূল্য দিয়ে কিনে নিতেন। একদিন এক কামার, একটা লোহার স্ত্রীমূর্তি গড়ে হাটে বিক্রি করতে এসেছিল, সেটা কেউ কিনলে না। তখন সে ব্যক্তি রাজপথে ফিরি করতে বেরুল। ‘তোমরা কেউ অলক্ষ্মী নেবে গো?’ এই বলে চীৎকার করতে লাগল। রাজা শুনতে পেয়ে সেই লোকটিকে ডাকিয়ে, তাকে উচিতমূল্য দিয়ে সেই মূর্তিটি কিনে নিলেন। তারপর তিনি সেইদিন সন্ধ্যার সময় তাঁর বাড়িতে একটি স্ত্রীলোকের কান্না শুনতে পেলেন। রাজা তাড়াতাড়ি গিয়ে দেখেন যে, ঠাকুরঘরে লক্ষ্মীর মতো একটি সুন্দরী স্ত্রীলোক বসে বসে কাঁদছেন। রাজা জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তুমি কে মা? কেন কাঁদছ?’ সেই স্ত্রীলোক বললেন, ‘আমি রাজলক্ষ্মী। অনেক দিন তোমার বাড়িতে আছি, আর থাকতে পারব না, তাই কাঁদছি।’ রাজা জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তুমি যাবে কেন মা? আমি কী অপরাধ করেছি?’ রাজলক্ষ্মী বললেন, ‘তুমি অলক্ষ্মী কিনেছ; আর আমি থাকব না। তবে তোমার বাড়িতে অনেক আদর-যত্ন পেয়েছি, তাই তোমাকে এই বর দিয়ে যাই যে, তুমি পশুপক্ষী, কীটপতঙ্গের কথা বুঝতে পারবে। আর আমার এই কথাটি স্মরণ রাখবে:
মানুষের সার আচার-ব্যবহার,
নারীর সার দমন।
ভোজনের সার ঘৃত,
নিশির সার জাগরণ।।
এই বলে মা লক্ষ্মী অন্তর্হিত হলেন। রাজা আর রাত্রে নিদ্রা যান না। একদিন দেখেন একটি স্ত্রীলোক বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাচ্ছেন। রাজা জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তুমি কে মা? কোথায় যাচ্ছ?’ সেই রমণী-মূর্তি বললেন, ‘আমি ভাগ্যলক্ষ্মী। তুমি অলক্ষ্মী কিনেছ, আমি আর থাকব না।’ এই বলে চলে গেলেন। রাজা আর একদিন একজন স্ত্রীলোককে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে দেখে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তুমি কে?’ তিনি বললেন, ‘আমি যশলক্ষ্মী। তুমি অলক্ষ্মী কিনেছ, তাই আমি তোমায় ছেড়ে যাচ্ছি।’ তার পর একদিন রাত্রে একটি পুরুষ-মূর্তি আর একটি স্ত্রী-মূর্তি বাড়ি থেকে চলে যাচ্ছেন দেখে, রাজা জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তোমরা কে?’ রমণী বললেন, ‘আমি কুললক্ষ্মী।’ পুরুষ-মূর্তি বললেন, আমি ধর্ম। ‘তুমি অলক্ষ্মী কিনেছ, তাই আমরা আর থাকব না।’ রাজা ধর্মকে বললেন, ‘ধর্ম! আমি সত্য প্রতিজ্ঞা রক্ষা করবার জন্য অলক্ষ্মী কিনেছি, আপনার বলেই রাজলক্ষ্মী, ভাগ্যলক্ষ্মী, যশলক্ষ্মীকে বিদায় দিয়েছি; কুললক্ষ্মীও ইচ্ছা করলে যেতে পারেন, কিন্তু আপনার কোনও মতে যাওয়া উচিত নয়। কারণ আমি তো আপনার মর্যাদা নষ্ট করিনি। যে সত্যধর্ম পালন করে, তাকে ত্যাগ করতে নেই।’ কুললক্ষ্মী চলে গেলেন; রইলেন কেবল ধর্ম।
রাজা যখন আহার করতে বসেন, তখন অনেকগুলি পিঁপড়ে এসে পাতের কাছে জমে। প্রতিদিন এরূপ হয়, রাজার দিন দিন অবস্থা মন্দ হতে লাগল। একদিন রানিকে বললেন, ‘দেখো আজ আমার কোনও তরকারিতে ঘি দিও না, ভাতেও ঘি দিও না।’ রানি রাঁধুনিকে বারণ করলেন, সেদিন রাজার কোনও খাবার জিনিসে ঘি দেওয়া হল না। রাজা আহারে বসলেন, সেই সময়ে সেই পিঁপড়েগুলি এসে পাতের কাছে ঘুরে-ফিরে বেড়াতে লাগল। আর পরস্পর বলতে লাগল, ‘দেখ ভাই, রাজা অলক্ষ্মী কিনে একেবারে গরিব হয়ে গেছে। আর ঘি পর্যন্তও খেতে পায় না।’ রাজা কথাটি শুনে হেসে ফেললেন। রানি বললেন, ‘মহারাজ! আপনি হাসলেন কেন?’ রাজা বললেন, ‘সে-কথা তোমায় বলব না; বললে আমি মরে যাব।’ রানি বললেন, ‘না, আপনাকে বলতেই হবে, আমি কোনও মতেই ছাড়ব না।’ রাজা বললেন, ‘তুমি যদি আমায় না-চাও, কেবল এই কথাটি জানতে চাও, তবে গঙ্গার তীরে চলো; যদি মৃত্যু হয় সেখানেই হবে।’ এই বলে রানিকে সঙ্গে করে নিয়ে গঙ্গার তীরে গেলেন। গিয়ে বললেন, ‘রানি, তুমি আমায় চাও, না, কথা চাও?’ রানি বললেন, ‘আমি কথা চাই।’ সেইখানে একটা ছাগল আর ছাগলি চরছিল, আর গঙ্গার মাঝখানে একটা ঘাসের মোট ভেসে যাচ্ছিল ছাগলি ছাগলকে বললে, ‘ওই ঘাসগুলো আমায় এনে দাও না, আমি খাই।’ ছাগল বললে, ‘আমি তোমার জন্যে ডুবে মরি আর কী! আমি তো আর রাজার মতো বোকা নই! রাজা যেমন স্ত্রীর কথায় মরতে এসেছে।’ রাজা তখন ছাগলের কথা বুঝতে পেরে রানিকে খুব প্রহার করে, সেই গঙ্গার তীরে জঙ্গলের মধ্যে ছেড়ে দিয়ে চলে গেলেন। রানি সেই গঙ্গার তীরে বনে বনে কেঁদে বেড়ান। রাজা আর কোনো খোঁজখবর করেন না। রানির আর দুর্দশার সীমা নেই।
একদিন সন্ধ্যার সময় শঙ্খঘণ্টার শব্দ শুনে রানি সেখানে গিয়ে দেখেন কতকগুলি মুনিকন্যা পিটুলির লক্ষ্মী ঠাকুর গড়ে তাতে রং মাখিয়ে ফুল তুলে চন্দন ঘষে নৈবেদ্য করে চিঁড়ে, পাটালি, নারিকেল দিয়ে পূজা করছেন। দেখে রানি বললেন, ‘তোমরা কী করছ গা?’ তাঁরা বললেন, ‘আজ আশ্বিন মাসের কোজাগরী পূর্ণিমা, তাই আমরা লক্ষ্মীপূজা করছি।’ রানি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এ পূজা করলে কী হয়?’ তাঁরা বললেন, ‘লক্ষ্মীর কাছে যে-যা বর মাগে তাই হয়; অলক্ষ্মী দূর হয়, মা লক্ষ্মীর কৃপা হয়।’ তখন রানি তাঁদের কাছে একটু পিটুলি চেয়ে নিয়ে, লক্ষ্মীঠাকুর গড়ে, পূজা করে, সেই লক্ষ্মীর প্রসাদ চিঁড়ে, নারিকেল খেয়ে, তাঁদের সঙ্গে সেইখানে রাত্রি জাগরণ করে রইলেন। ওখানে রাজার বাড়িতে যে লোহার অলক্ষ্মী ছিল, সেটা বিদেয় হল। যেমন হাতি, ঘোড়া, ধন, রত্ন ছিল, তেমনি আবার সব হল। রাজা সকালে উঠে ভাবছেন, হঠাৎ আমার আবার এসব কী করে হল! ধর্ম বললেন, ‘মহারাজ! ওই অলক্ষ্মীটা কিনেই আপনার অমঙ্গল ঘটেছিল। রানি বনে কোজাগরী লক্ষ্মীপূজা করেছেন, তাই অলক্ষ্মী দূর হয়ে রাজলক্ষ্মীর কৃপা হল। কেবল সত্যের কৃপায় আবার আপনার সব হল।’ তখন রাজা ধর্মকে নমস্কার করে নিজে সেই গঙ্গার তীরে বনে গিয়ে রানিকে খুঁজে, অনেক যত্ন করে সঙ্গে নিয়ে এলেন। বাড়িতে এসে খুব ঘটা করে লক্ষ্মীর পূজা করলেন; ভাগ্যলক্ষ্মী, যশোলক্ষ্মী, কুললক্ষ্মী আবার ফিরে এলেন। সেই থেকে পৃথিবীতে কোজাগরী লক্ষ্মীপূজা প্রচার হল।
কোজাগরী লক্ষ্মীপূজার কথা সমাপ্ত।