কোঙ্কণের সিংহ
পটভূমিকা
কোঙ্কণ। পশ্চিম ভারতের সমুদ্র উপকূল। উত্তরে বেসিন থেকে শুরু হয়ে দক্ষিণে কারওয়ার পর্যন্ত এর বিস্তার। সঙ্কীর্ণ, রুক্ষ এক উপকূল রেখা— চার-শো মাইল দীর্ঘ কিন্তু প্রস্থ চল্লিশ মাইলের বেশি নয়।
ভূবিজ্ঞানীদের অনুমান কোনো আগ্নেয়গিরির প্রচণ্ড আলোড়নে সমুদ্রের তলদেশ থেকে জেগে উঠেছে এই উপকূলভাগ। ধর্মবিশ্বাসী মানুষদের ধারণা ভগবান পরশুরাম লোভী ব্রাহ্মণদের সমগ্র পৃথিবী দান করার পর যখন দেখলেন তাঁর নিজের ঠাঁই নেই, তখন সমুদ্রকে শত যোজন দূরে ঠেলে সৃষ্টি করলেন এই উপকূল।
কঙ্করময়, প্রতিকূল, কোঙ্কণের উপকূল রেখা। এর প্রাকৃতিক পোতাশ্রয়গুলি কালো পাথরের দুর্গে সুরক্ষিত। এখানকার মাটি রুক্ষ, পাথুরে, কিন্তু তবু অবিশ্বাস্য সবুজের ছোপ চোখে পড়ে এই উপকূলভূমিতে। ভারতবর্ষের মানচিত্রেও এই অঞ্চল সবুজ রঙে চিত্রিত। পাহাড়ে পাহাড়ে কাজুবাদাম এবং কাঁঠালের জঙ্গল। সর্বক্ষণ লবণাক্ত হাওয়ায় পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জাতের আমের ফলন হয় এখানে। সারি সারি তাল গাছ শাড়ির আঁচলের মতো এই দীর্ঘ উপকূলের শোভাবর্ধন করেছে এবং সবুজ তটভূমিকে বর্ণাঢ্য করেছে রক্তজবা, মহুয়া, গুলমোহর ও শিমূলের তরঙ্গায়িত বর্ণ সমাহার। এখানকার অধিবাসীরা মেজাজী, সুরা ও সংগীতপ্রিয়, জলে-স্থলে তাদের সমান স্বাচ্ছন্দ্য।
পশ্চিমে আরবসাগর। পূর্বে পশ্চিমঘাটের পর্বতশ্রেণি খাড়া দেয়ালের মতো মাথা উঁচু করে যেন বিচ্ছিন্ন করেছে এই অঞ্চলকে। বন্ধুর, সূচিমুখী পর্বতশিখর। হানাদারদের গতিবিধি লক্ষ করার জন্য দুর্গম পর্বতশৃঙ্গে গড়ে উঠেছে দুর্গ। যখনকার কথা বলা হচ্ছে তখন পাহাড়ের চূড়ার সুরক্ষিত দুর্গে নিরাপত্তা বোধ করত মানুষ।
ভারতের যে অংশটা উপদ্বীপ, তার পশ্চিমাঞ্চলের প্রায় অর্ধেকটা জুড়ে যে ভূখণ্ড, তাকে বলা হত দাক্ষিণাত্য, মারাঠাদের বাসভূমি। কোঙ্কণ হল দাক্ষিণাত্যের অন্তর্ভুক্ত।
দাক্ষিণাত্যে তখন ঘোর বিশৃঙ্খলা। যুদ্ধবিগ্রহ লেগেই আছে। কোঙ্কণে কিন্তু চার মাস অনিবার্য কারণেই বন্ধ রাখতে হত যুদ্ধ। জুন মাসের গোড়ার দিকে সেখানে বাতাসের গতি যায় বদলে। বেগবান বায়ু সকলকে জানিয়ে দেয় দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমীর আসন্ন আগমন বার্তা। তারপর মুহুর্মুহু বজ্রপাতের সঙ্গে নামে মুষলধারে বৃষ্টি। প্রচণ্ড বর্ষা। জুলাই মাসের মাঝামাঝি বৃষ্টি আর বাতাসের বেগ স্তব্ধ করে দেয় সবকিছু। সমুদ্র হয়ে ওঠে উত্তাল। সহস্র ফণা বাসুকির মতো উদ্যত রোষে ফুঁসে ওঠে সমুদ্রের ঢেউ, তারপর শতধা হয়ে আছড়ে পড়ে তটভূমিতে। প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড উপলখণ্ড খড়ের টুকরোর মতো অসহায় হয়ে পড়ে সমুদ্র তরঙ্গে।
অবিরাম বৃষ্টির ধারা নির্দয়ভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ে দুরারোহ পাহাড়ের পার্শ্বদেশে। উন্মত্ত হয়ে ওঠে কোঙ্কণের সব পাহাড়ি নদী। সেই প্রচণ্ড বর্ষণে দিশেহারা হয়ে পড়ত মানুষ, থেমে যেত সব সামাজিক অভিযান, দুর্গ অবরোধ হত প্রত্যাহৃত। আক্রমণকারী আর আক্রান্ত দুই-ই তখন প্রার্থনা জানাত বরুণ দেবতাকে, ‘হে দেবতা, শান্ত হও, প্রসন্ন হও, তুলে নাও তোমার অবরোধ।’
এই হল কোঙ্কণের পটভূমিকা এবং এই পটভূমিকায় গড়ে উঠেছে এক বিস্ময়কর কাহিনি, যার নায়ক কানোজি আংরে।
দুই
দাক্ষিণাত্যে মুঘল এবং মারাঠাদের মধ্যে তুমুল লড়াই চলছে। দিল্লির বাদশা ঔরঙ্গজেব। আকবর হিন্দুদের প্রতি উদার নীতি অবলম্বন করেছিলেন, কিন্তু ঔরঙ্গজেব ছিলেন ধর্মান্ধ। হিন্দুদের মন্দির ধ্বংস করে তিনি তাদের ধর্মবিশ্বাসে আঘাত হেনেছিলেন। অমুসলমানদের উপর তিনি চাপিয়েছিলেন জিজিয়া কর। এই করের হার শেষপর্যন্ত দাঁড়িয়েছিল একজনের বাৎসরিক আয়ের শতকরা দশভাগ।
কিন্তু দাক্ষিণাত্যে মারাঠা জাতি তখন জেগে উঠেছে। শিবাজি তাদের এক জাতি, এক প্রাণে বেঁধে পত্তন করেছেন এক স্বাধীন হিন্দু রাষ্ট্র। চার-শো বছর ধরে মুসলমান সুলতানদের অধীনে থাকার পর মারাঠারা স্বাধীনতার স্বাদ পেয়েছে।
মুঘল এবং মারাঠাদের এই রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের ফলাফল বাজপাখির দৃষ্টিতে লক্ষ করছিল ইংরেজ, পোর্তুগিজ এবং ওলন্দাজ বণিকদল। স্থলে তখন মুঘলরা পরাক্রান্ত এবং সমুদ্রে পোর্তুগিজ। ইংরেজ বণিকরা আস্তে আস্তে থাবা বাড়াচ্ছে, খুব সতর্ক তারা। ইউরোপীয় বণিকদের নিজেদের মধ্যে কিন্তু প্রচণ্ড রেষারেষি।
কিন্তু তবু অষ্টাদশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে বিদেশি শক্তিদের যদি জিজ্ঞেস করা যেত, কে তোমাদের প্রধান শত্রু? তবে তারা নিশ্চয়ই পরস্পরের দিকে আঙুল তুলে দেখাত না, কিংবা মুঘল অথবা মারাঠাদেরও নাম করত না। তারা একবাক্যে বলত— কানোজি আংরে।
ইংরেজরা তাঁকে জলদস্যু আখ্যা দিয়েছিল। তাঁর বিরুদ্ধে আত্মরক্ষার জন্য আজকের মূল্যে বছরে তাদের প্রায় দশ লক্ষ পাউন্ড ব্যয় করতে হত। কানোজির ভয়ে তারা বোম্বাইয়ের চারদিকে পরিখা খনন করেছিল, তারপর পরিখার পিছনে তুলেছিল প্রাচীর। এমনকী তাঁকে ধ্বংস করার জন্য তাদের চিরশত্রু পোর্তুগিজদের সঙ্গেও হাত মিলিয়েছিল তারা।
কোঙ্কণের সমুদ্রপথে একা একা যাবার সাহস ছিল না কোনো বাণিজ্যপোতের। কোনো যুদ্ধজাহাজও নিরাপদ ছিল না। তারা দল বেঁধে যেত, সঙ্গে থাকত সশস্ত্র প্রহরী জাহাজ। বণিকদের মধ্যে তখন একটি প্রথাই দাঁড়িয়ে গিয়েছিল, নিরাপদে তাদের বাণিজ্যতরী বন্দরে পৌঁছে দিলে প্রহরী জাহাজের ক্যাপ্টেনকে তারা পাঁচ-শো টাকা যৌতুক দিত। স্থলে পরাক্রান্ত যে-ই থাকুক না কেন, সমুদ্রপথে যারাই তখন প্রভুত্ব করুক না কেন, অষ্টাদশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে মাত্র একজন মানুষই কোঙ্কণের উপকূলবর্তী সমুদ্রপথের ছিলেন একচ্ছত্র অধিপতি, তিনি— কানোজি আংরে।
* * *
কানোজি আংরে সম্বন্ধে কোঙ্কণে একটি প্রবাদ আজও লোকের মুখে মুখে শোনা যায়। যখন আট-নয় বছরের বালক, তখন তিনি এক ব্রাহ্মণ গুরুর গৃহে থেকে লেখাপড়া করতেন এবং গুরুর গোরু-বাছুর দেখাশোনা করতেন। একদিন একটি গাছের নীচে তিনি ঘুমিয়ে ছিলেন। ব্রাহ্মণ তাঁর খোঁজে গিয়ে দেখেন একটি গোক্ষুরসর্প ফণা বিস্তার করে রোদের তাপ থেকে তাঁকে রক্ষা করছে। ব্রাহ্মণের দৃঢ় ধারণা হল বালক উত্তরকালে নিশ্চয়ই রাজা হবে। তিনি কানোজির জন্ম-কুষ্ঠি বিচার করে দেখলেন গ্রহ-নক্ষত্র তাঁর অনুমানই সমর্থন করছে। তারপর থেকে ব্রাহ্মণ কানোজিকে উপযুক্ত শিক্ষা দিতে লাগলেন। ব্রাহ্মণ ছিলেন হরনাই গ্রামের অধিবাসী। ওটা ছিল মূল ভূখণ্ডে, সুবর্ণ দুর্গের কাছে। যুদ্ধবিধ্বস্ত কোঙ্কণে ওই গ্রামটি অনেকটা নিরাপদ বলেই বোধ হয় কানোজির পিতা তুকোজি, পুত্রকে ওই ব্রাহ্মণের হাতে সঁপে দিয়েছিলেন।
ব্রাহ্মণ যখন নিঃসংশয় হলেন যে, বালক উত্তরকালে সিংহাসনে আরোহণ করবে, তখন তিনি তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলেন তাঁর ভবিষ্যদবাণী সফল হলে শিষ্য তাকে কী গুরুদক্ষিণা দেবে?
‘আপনি যা চাইবেন’ উত্তর দিয়েছিল বালক।
‘যে ভূস্বামীর জমিতে আমি চাষবাস করছি শুধুমাত্র সে জমিটুকুই আমি চাই’, গুরু বলেছিলেন।
‘ওটা আপনারই হবে,’ বালক কথা দিয়েছিল।
কুড়ি বছর পরে যখন তিনি মারাঠা নৃপতির প্রধান নৌ-সেনাপতি (গ্র্যান্ড অ্যাডমিরাল), কোঙ্কণের হর্তা-কর্তা-বিধাতা, কানোজি তখন তাঁর গুরুকে ভোলেননি। জমিজমা দিয়ে সন্তুষ্ট করেছিলেন তাঁকে।
হরনাইয়ের সেই নাম-না-জানা ব্রাহ্মণ কিন্তু চমৎকার একটি কাজ করেছিলেন। তাঁর ছাত্র,ভারতবর্ষের সর্বকালের শ্রেষ্ঠ নৌ-সেনাপতিকে সংস্কৃত এবং দর্শনে উপযুক্ত শিক্ষা দিয়েছিলেন।
তিন
পুণার কাছে ছোট্ট একটি গ্রামের নাম অংগারওয়াড়ি। সেই গ্রামের নাম নিয়েছিলেন আংরেরা। ওঁদের আসল উপাধি শঙ্খপাল। কবে এবং কেন ওই পরিবার নিজ ভূমি ছেড়ে আরবসাগরের কোল-ঘেঁষা কোঙ্কণ উপকূলে বসবাস শুরু করেছিলেন তার সঠিক ইতিহাস জানা যায় না। তবে ইংরাজি ১৬৪০ সালে চাওলের কাছে বিজাপুরের সুলতান এবং পোর্তুগিজদের মধ্যে নৌযুদ্ধে কানোজির পিতা তুকোজি নাকি খুব বীরত্ব দেখিয়েছিলেন। বিজাপুরের নৌবাহিনী পরিচালনা করেছিলেন শিবাজির পিতা শাহজি। ওই যুদ্ধে পোর্তুগিজ নৌবহরকে পরাজয় স্বীকার করতে হয়েছিল। বোম্বাই এবং চাওলের মধ্যবর্তী উত্তর কোঙ্কণের উপকূল অঞ্চল বিজাপুর সুলতানের দখলে এসেছিল।
তুকোজি ছিলেন শাহজির সরাসরি অধীনে। চাওলের যুদ্ধের পর তিনি চাকরিতে ইস্তফা দেন। কুড়ি বছর পরে আবার তাঁর নাম শোনা যায়। শিবাজি তাঁকে সর্দারের পদে নিযুক্ত করেছিলেন। পিতা-পুত্র দুজনের অধীনেই কাজ করেছিলেন তুকোজি।
শিবাজির নৌবাহিনীতে অনেকদিন ছিলেন তিনি। কোঙ্কণে শিবাজির আধিপত্যে প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছিল জাঞ্জিরার সিদ্দিরা। (সিদ্দিদের প্রসঙ্গ নিয়ে যথাসময়ে আমরা আলোচনা করব)। তাদের সঙ্গে বহুবারই যুদ্ধ হয়েছিল শিবাজির নৌবাহিনীর। তুকোজি সেই যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। পরে সুবর্ণ দুর্গের সহকারী অধ্যক্ষের পদে উন্নীত হয়েছিলেন তিনি।
সমুদ্রের সঙ্গে তাই আংরেদের নিবিড় যোগাযোগ।
আবার সেই আগের কাহিনিতে ফিরে যাওয়া যাক। শিষ্যের ভবিষ্যৎ জানার পর ব্রাহ্মণ তাঁকে মূল্যবান পোশাক উপহার দিলেন, তাঁর প্রতি যত্নবান হলেন। অস্ত্র সম্বন্ধে কানোজির একটি সহজাত কৌতূহল ছিল এবং তরোয়াল সংগ্রহ ছিল একটি বাতিক। বিষয়টি লক্ষ করে ব্রাহ্মণ নিশ্চিত হলেন যে, তাঁর ভবিষ্যদবাণী বিফল হবে না।
লেখাপড়ার পর্ব শেষ হলে কানোজি সৈনিকের বৃত্তি গ্রহণের জন্য উন্মুখ হয়ে উঠলেন। ব্রাহ্মণ তাঁর জন্মকালীন নক্ষত্র বিচার করে এক শুভদিন দেখে তাঁকে সুবর্ণ দুর্গের অধ্যক্ষের কাছে প্রেরণ করলেন। বালকের বীরোচিত চেহারা অধ্যক্ষের মনে গভীর রেখাপাত করল। তিনি তাঁকে রক্ষীবাহিনীতে নিয়োগ করলেন। অল্পদিনের মধ্যেই কানোজি তাঁর বুদ্ধি এবং তৎপরতায় দুর্গাধ্যক্ষের মন জয় করে ফেললেন। তিনি বালকের প্রতি সদয় হয়ে উঠলেন। দুর্গের অন্যান্যদের সঙ্গেও কানোজির গড়ে উঠল সৌহার্দের সম্পর্ক। বেশ কিছু লোক তাঁর অনুগত হয়ে পড়ল।
তাঁর অনুগামীদের নিয়ে তিনি সিদ্দির অধিকৃত রাজ্যে হানা দিতে শুরু করলেন। লুঠের সামগ্রী কানোজি সবার মধ্যে সমানভাবে ভাগ করে দিতেন।
একবার এমন এক হানা দেবার সময় কানোজি আর তাঁর দলবল-সহ সিদ্দির সেনাদলের হাতে বন্দি হলেন। তাঁর হাতে আর পায়ে কাঠের বেড়ি পেরিয়ে সিদ্দির সৈন্যরা তাঁকে নিয়ে তাদের রাজধানী অভিমুখে যাত্রা করল। পথে একটি খাঁড়ির ধারে এক রাতে তারা তাঁবু ফেলল। শীতকাল। সৈন্যরা গনগনে আগুন জ্বালিয়ে আগুনের চারপাশে গোল হয়ে ঘুমোচ্ছে। কানোজির চোখে ঘুম নেই। সবাই যখন গভীর নিদ্রায় অচেতন, তিনি তাঁর হাত আর পায়ের কাঠের বেড়িতে আগুন ধরিয়ে দিলেন। হাত-পা পুড়ে গেল সেদিকে তাঁর ভ্রূক্ষেপ নেই, নিজেকে তিনি মুক্ত করলেন। তারপর ঘুমন্ত একজনের তরোয়াল তুলে নিয়ে পাঁচ-সাতজনকে হত্যা করে ঝাঁপিয়ে পড়লেন খাঁড়িতে। খাঁড়ি সাঁতরে পার হয়ে একটি গ্রামে পৌঁছুলেন তিনি। ওখান থেকে পরদিন সন্ধ্যায় অন্য একটি গ্রামে তিনি উপস্থিত হলেন। সিদ্ধির সৈন্যরা তাঁর অনুসরণ করে আসছে, যেকোনো মুহূর্তে ধরা পড়ে যাবার সম্ভাবনা। ক্ষুধার্ত, ক্লান্ত কানোজি এক বাড়িতে আশ্রয় ভিক্ষা করলেন। বাড়ির মালিক একজন মুসলমান ব্যবসায়ী। তিনি তাঁকে আশ্রয় দিলেন। ওই ব্যবসায়ীর কন্যা কয়েক সপ্তাহ আগে একটি সন্তান প্রসব করেছিল। ব্যবসায়ী তাকে এক প্রতিবেশীর বাড়িতে পাঠিয়ে কানোজিকে ওই নবজাতকের পাশে শুয়ে ঘুমোতে বললেন।
সিদ্দির সৈন্যরা অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই ওই বাড়িতে এসে পড়ল। গৃহস্বামীর প্রবল প্রতিবাদ সত্ত্বেও তারা বাড়ির ভেতর ঢুকে পড়ল। শোবার ঘরে নবজাতকের পাশে আপাদমস্তক কম্বলে মুড়ি দেওয়া একজনকে দেখে তারা ভেবেই নিল সে গৃহস্বামীর কন্যা। সুতরাং তাকে বিরক্ত না করে তারা চলে গেল। পরদিন সন্ধ্যায় ওখান থেকে বেরিয়ে পড়লেন কানোজি, নিরাপদে পৌঁছুলেন সুবর্ণ দুর্গে। সিদ্দির সৈন্যরা তখনও তাঁর অনুসন্ধান করছে।
বাল্যকালে আরও একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটেছিল কানোজির জীবনে। হরনাই গ্রামে থাকার সময় একজনের সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব হয়। ওই বালকের নাম বালাজি বিশ্বনাথ। ব্রাহ্মণ সন্তান। দুজনের স্বভাবে কোনো মিল ছিল না— একজন সৈনিক বংশের সন্তান, মাংসাশী, স্বভাবে আচরণে কিছুটা রুক্ষ প্রকৃতির, অসিবিদ্যা, অশ্বারোহণে পটু; অন্যজন ধর্মভীরু, নিরামিষাশী, বুদ্ধিজীবি এবং গ্রন্থকীট। কানোজির থেকে কয়েক বছরের বড়ো ছিলেন বালাজি বিশ্বনাথ। তিনি অসিচালনা কিংবা অশ্বারোহণ কোনোটাই জানতেন না। কিন্তু তবু দুজনের মধ্যে এক অসম বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল। কানোজি হরনাই ছেড়ে যাবার আগেই বিশ্বনাথ সিদ্দির পরিচালিত একটি লবণের কারখানায় কেরানির কাজ নিয়েছিলেন।
অনেক বছর পরে তাঁদের এই বন্ধুত্ব মারাঠা সাম্রাজ্যের ধারা বদলে দিয়েছিল, সৃষ্টি করেছিল নতুন ইতিহাস। কানোজি আর বালাজি স্ব স্বক্ষত্রে উন্নতির চরম সোপানে আরোহণ করেছিলেন, অধিকার করেছিলেন শীর্ষস্থান। তাঁদের যৌথ প্রচেষ্টায় মারাঠা সিংহাসনে দুজন দাবিদারের একজন মারাঠা নৃপতি বলে স্বীকৃত হয়েছিলেন, লাভ করেছিলেন সিংহাসন।
চার
১৬৭৪ সালের ৬ জুন রায়গড়ে শিবাজির অভিষেক হল। এই প্রথম একজন মারাঠা নিজ রাজ্যের অধিপতি হলেন। অভিষেকে ঘোষণা করা হল শিবাজির রাজ্য সমুদ্র পর্যন্ত বিস্তৃত। এর আগে ভারতবর্ষের কোনো নৃপতি বা সুলতান সমুদ্রে আধিপত্য বিস্তারে আগ্রহশীল হয়েছিলেন কিনা সে বিষয়ে মতভেদ আছে।
শিবাজির দাবি কিন্তু খেয়ালখুশিমতো একটি ব্যাপার নয়। মারাঠা সাম্রাজ্য গড়ে তোলার সঙ্গে সঙ্গে এক শক্তিশালী নৌবাহিনী গড়ে তোলার দিকেও সচেষ্ট হয়েছিলেন তিনি। কেউ কেউ বলেন সমুদ্রের প্রতি তাঁর তীব্র আকর্ষণ ছিল। যৌবনে বোম্বাইয়ের কাছে মাহাদে থাকার সময় সমুদ্রের প্রতি তাঁর অনুরাগ জন্মায়।
গোয়ায় পোর্তুগিজরা তাদের শক্ত ঘাঁটি থেকে শিবাজির ক্রমবর্ধমান নৌশক্তির উপর লক্ষ রাখছিল। শিবাজির সঙ্গে তারা সখ্যতার চুক্তিতে আবদ্ধ হল। ওখানকার ভাইসরয় দূত মারফত বহু উপঢৌকন পাঠালেন শিবাজিকে। এই প্রতিশ্রুতিও দিলেন যে, ন্যায্যমূল্যে তিনি শিবাজিকে কামান ও গোলাবারুদ সরবরাহ করবেন, কিন্তু তার পরিবর্তে শিবাজিকে প্রতিশ্রুতি দিতে হবে তিনি পোর্তুগিজদের জাহাজ আক্রমণ করবেন না।
অভিষেকের সময় শিবাজির নৌবাহিনীর হাতে ছোটোখাটো বাদ দিয়ে সাতান্নটি রণতরী ছিল, আর নৌসেনার সংখ্যা ছিল পাঁচ হাজারের ওপর। পাঁচ বছর পর প্রধান রণতরীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছিল ছেষট্টিতে। শিবাজিই বোধ হয় প্রথম ভারতীয় নৃপতি, যিনি উপকূল রক্ষার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেছিলেন।
নৌবাহিনী আর নৌবহর গড়ে তোলার সঙ্গে সঙ্গে উপকূলবর্তী দুর্গগুলি দখল করে চলেছিলেন শিবাজি। সামরিক গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটি সুরক্ষিত করার ব্যাপারেও তিনি উদ্যোগী হয়েছিলেন। কোঙ্কণের উপকূলে মোট তেরোটি দুর্গ তিনি নির্মাণ করেছিলেন, সংস্কার এবং সুরক্ষিত করেছিলেন আরও অনেক।
১৬৭৯ সালে বোম্বাইয়ের কাছে খান্দেরি দ্বীপ দখল করলেন শিবাজি। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রবল বিরোধিতা সত্ত্বেও তিনি সুরক্ষিত করলেন ওই দ্বীপ। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি জাঞ্জিরার সিদ্দির সহযোগিতায় তাঁকে ওখান থেকে বিতাড়িত করতে চেষ্টা করল। সিদ্দি কিন্তু তার মিত্রপক্ষের সঙ্গে প্রতারণা করলেন। তিনি খান্দেরির লাগোয়া আন্ধেরি দ্বীপটি দখল করে বসলেন।
সমুদ্রের উপকূলে শিবাজি শেষ যে দুর্গ নির্মাণ করেছিলেন সেটি খুব সম্ভব বোম্বাইয়ের কুড়ি মাইল দক্ষিণে। ওই ছোট্ট দ্বীপটি এতদিন মারাঠাদের একটি সাধারণ ফাঁড়ি হিসেবে গণ্য হত। শিবাজি ওখানে দুর্ভেদ্য এবং স্বয়ংসম্পূর্ণ একটি দুর্গ নির্মাণের কাজে হাত দিলেন। মিষ্টি জলের জন্য বিস্তর গভীর কূপ খনন ছাড়াও, তিনি ওই দ্বীপে জাহাজ তৈরির উপযুক্ত ব্যবস্থা গড়ে তুললেন। বাইরের সাহায্য ছাড়াই দুর্গরক্ষীরা যাতে দীর্ঘদিন বহিঃশত্রুর আক্রমণ প্রতিরোধ করতে পারে তাই এই ব্যবস্থা। ক্রমে ক্রমে মানুষের মুখে মুখে ওই দ্বীপের আসল নাম বদলে হয়ে গেল কোলাবা।
পরবর্তীকালে ওই কোলাবাই মারাঠা নৃপতিদের প্রধান নৌসেনাপতি আংরেদের মূল ঘাঁটিতে পরিণত হয়েছিল। ‘কোলাবার আংরে’ এই নামে পরিচিত হয়েছিলেন তাঁরা। তবে সেটা অনেক পরের ঘটনা।
কোলাবার প্রথম আংরে, কানোজির কাহিনিতে আসার আগে তখনকার রাজনৈতিক পটভূমিকা সম্বন্ধে কিছু আলোচনা করে নেওয়া যাক।
পাঁচ
পশ্চিম ইউরোপীয় দেশগুলির মধ্যে পোর্তুগিজরাই প্রথম ভারতে পদার্পণ করেছিল। ১৪৯৮ সালের ২২ মে ভাস্কো দা গামা মালাবারের উপকূল কালিকট বন্দরে উপনীত হলেন। কালিকটের রাজা জামোরিন তাঁকে সাদর সংবর্ধনা জানালেন, ব্যাবসাবাণিজ্যের অনুমতি দিলেন। ভাস্কো দা গামার পর এলেন আলবুকার্ক। নিষ্ঠুর রণোন্মাদ একটি মানুষ। পারস্য উপসাগরের উপকূল শহর কুরহাট দখল করার পর তিনি ওখানকার অধিবাসীদের নির্বিচারে হত্যা করেন, তারপর সমস্ত শহর জ্বালিয়ে দেন। গোয়া দখলের পর আলবুকার্ক জামোরিনকে আক্রমণ করলেন— যে জামোরিন বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন পোর্তুগিজদের উদ্দেশ্যে। সেখানেও নির্বিচারে ধ্বংসলীলার পর আলবুকার্ক জামোরিনকে হত্যা করে কালিকট ভস্মীভূত করলেন।
আলবুকার্ক আর তাঁর উত্তরসূরীরা প্রাচ্যে পোর্তুগিজ প্রাধান্য বিস্তারে উদ্যোগী হয়েছিলেন। এক হাতে তরবারি এবং অন্য হাতে ক্রুশবিদ্ধ যিশুমূর্তি নিয়ে পোর্তুগিজরা অভিযান চালিয়েছিল। ১৫০৭ সালে তারা দখল করল কোঙ্কণের চাওল আর ১৫০৮ সালে ধাওল। কয়েক বছর ধরে তারা বোম্বাইয়ে জাঁকিয়ে বসল। তাদের অত্যাচারে বহু লোক শহর ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হল। গোয়ার অ-ক্রিশ্চানদের উপর হুকুম হয়েছিল সূর্যাস্তের পর তাদের শহর ছেড়ে চলে যেতে হবে। অ-ক্রিশ্চানদের কাউকে নিজের ধর্ম পালন করতে দেখা গেলে তৎক্ষণাৎ তাকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হত।
পশ্চিম ভারতে গোয়া দাস ব্যবসায়ের প্রধান কেন্দ্র হয়ে দাঁড়িয়েছিল। পোর্তুগিজরা নিজেদের ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য আফ্রিকা থেকে দাস আমদানি করত এবং হাজার হাজার ভারতীয় বন্দিকে রপ্তানি করত ইউরোপের দাস বাজারে।
ভিনদেশিদের প্রতি কোঙ্কণে যে অনুকূল প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছিল, পোর্তুগিজদের ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা এবং অত্যাচারে তা বৈরী রূপ নিল। কোঙ্কণে পোর্তুগিজদের অভিযান অনেকখানি সীমিত ছিল বলা যায়। ব্যাবসাবাণিজ্যে শ্রীবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তারা আয়েশি হয়ে পড়ল। ভারতীয় নৃপতিদের সঙ্গে গড়ে তুলল কূটনৈতিক সম্পর্ক। অষ্টাদশ শতাব্দী শুরু হবার বহু পূর্বেই পোর্তুগিজদের দিক থেকে আক্রমণ-ভীতি যথেষ্ট হ্রাস পেয়েছিল। কোঙ্কণে মাত্র পাঁচটি ঘাঁটি ছিল তাদের— গোয়া, চাওল, বেসিন, থানা আর বোম্বাই। ভাইসরয় গোয়ায় বাস করতেন।
তবে সমুদ্রে তাদের প্রতিপত্তি তখনও প্রবল। পোর্তুগিজ শাসনকর্তার স্বাক্ষরিত অধিকারপত্র (কার্তাজ) ছাড়া কোনো ভারতীয় বাণিজ্যতরীর কোঙ্কণের সমুদ্র সীমানা ব্যবহার করার হুকুম ছিল না।
কানোজি আংরের উত্থান পোর্তুগিজদের কাছে বিরাট একটা প্রতিবন্ধক হয়ে দেখা দিয়েছিল সন্দেহ নেই। কানোজি ছাড়া একমাত্র ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জাহাজ পোর্তুগিজ কর্তৃত্ব স্বীকার করত না।
প্রাচ্যের অতুল সম্পদের সংবাদ ইংল্যান্ডে পৌঁছুতে দেরি হল না। ইংরেজ বণিকেরাও এগিয়ে এল। স্থাপিত হল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। ১৬০০ সালের শেষ দিনে রানি প্রথম এলিজাবেথ প্রাচ্যের সঙ্গে একচেটিয়া ব্যাবসার অধিকার দিলেন কোম্পানিকে।
তারও আট বছর পরে ক্যাপ্টেন হকিন্স ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রথম প্রতিনিধি হিসেবে ভারত অভিমুখে যাত্রা করলেন। তাঁর সঙ্গে ছিল মুঘল সম্রাটের নামে লেখা রাজা প্রথম জেমসের একটি চিঠি। হকিন্সের জাহাজ ‘হেক্টর’ ১৬০৮ সালে সুরাট স্পর্শ করল। সেই সময় সুরাট ছিল এক সমৃদ্ধ নৌবন্দর। পোর্তুগিজদের সেখানে একটি কারখানা এবং প্রাচীর বেষ্টিত হাবেলি ছিল। তাদের কিছু রণতরীও ছিল সেখানে। তবে সুরাট ছিল মুঘল সাম্রাজ্যের অংশ।
সুরাট থেকে ক্যাপ্টেন হকিন্স আগ্রা গেলেন, সম্রাট জাহাঙ্গীরের কাছে ইংল্যান্ডের রাজার চিঠি পেশ করলেন। জাহাঙ্গীর তাঁর প্রতি সৌজন্য প্রকাশে কার্পণ্য করলেন না, কিন্তু তাঁর দরবারে পোর্তুগিজরা তখন বেশ জাঁকিয়ে বসেছে। তাদের প্ররোচনায় হকিন্সের দৌত্য ব্যর্থ হল। ব্যাবসাবাণিজ্যের ব্যাপারে তেমন কিছু সুবিধা আদায় করতে পারলেন না তিনি। হতাশ হয়ে সুরাটে ফিরে গেলেন হকিন্স।
পোর্তুগিজদের এই বিরুদ্ধাচারণের শোধ নিল ইংরেজরা। ১৬১২ সালে চারটি ব্রিটিশ রণতরী সুরাটের কাছে কয়েকটি পোর্তুগিজ জাহাজ আক্রমণ করে দখল করল। তারপর ব্রিটিশ রণতরীর সেনারা তীরে অবতরণ করে সুরাট থেকে বিতাড়িত করল পোর্তুগিজদের। ইংরেজদের একটি ঘাঁটি স্থাপিত হল সেখানে।
তাদের শক্তির এই পরিচয়ের সুফল ফলতে দেরি হল না। পরের বছরই জাহাঙ্গীর সুরাটে একটি কারখানা নির্মাণের অনুমতি দিলেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে।
ক্রমে ব্যাবসা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে কোম্পানি আরও কলকারখানা স্থাপন করল। কোঙ্কণের রাজাপুর, কারওয়ার, বোম্বাই ইত্যাদি স্থানে ঘাঁটি গেড়ে বসল কোম্পানি।
অনেকটা যেন উত্তরাধিকার সূত্রেই কোম্পানির হাতে এল বোম্বাই। সুরাটে ঘাঁটি স্থাপনের প্রায় পঞ্চাশ বছর পরে পোর্তুগিজ রাজকুমারী ক্যাথারিনের সঙ্গে ইংল্যান্ডের রাজা দ্বিতীয় চার্লসের বিয়ের যৌতুক হিসেবে বোম্বাই ইংল্যান্ডের অধিকারে আসে। চার্লস বছরে দশ পাউন্ড ভাড়ায় বোম্বাই শহর ইজারা দিলেন কোম্পানিকে। সেই শুরু। এতদিন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাণিজ্য নিয়েই ব্যস্ত ছিল, দাক্ষিণাত্যের রাজনৈতিক কোন্দলে নাক গলায়নি। কিন্তু সেখানকার অবস্থা ক্রমেই জটিলতর হতে থাকায় ব্যবসার স্বার্থেই কোম্পানির নিজেদের কেন্দ্রগুলি সুরক্ষিত করা দরকার হয়ে পড়ল। তাদের বাণিজ্যিক জাহাজগুলিও সশস্ত্র করে তোলা হল। ইংরেজ বণিকরা যেখানে বসবাস করত সেখানে গড়ে উঠতে লাগল দুর্গ।
১৬৮৭ সালে সুরাট থেকে কোম্পানির সদর দপ্তর বোম্বাইয়ে স্থানান্তরিত করা হল। পরের বছরই ইংল্যান্ডের রাজা কোম্পানির কাছে শহরটা বিক্রি করে দিলেন।
ছয়
এবার জাঞ্জিরার কথায় আসা যাক। ওটা হল বোম্বাইয়ের তিরিশ মাইল দক্ষিণে একটি দ্বীপ। ওখানকার দুর্গ এত সুরক্ষিত এবং দুর্ভেদ্য যে, স্বয়ং শিবাজি অনেক চেষ্টা করেও তা দখল করতে পারেননি। জাঞ্জিরার সিদ্দিরা আবিসিনিয়া থেকে এসেছিল। ব্যাবসাবাণিজ্যের উদ্দেশ্যেই তারা এসেছিল বটে, কিন্তু তারা ছিল পেশাদারি নাবিক, যুদ্ধবিগ্রহে পটু। আফ্রিকায় ‘সেদি’ একটি সম্মানজনক উপাধি, তাই তারা নিজেদের ওই বলেই পরিচয় দিত। মারাঠারা অবশ্য সব কাফ্রীকেই ‘সেদি’ বলে অভিহিত করত। ‘সেদি’ থেকে শব্দটা দাঁড়ায় ‘সিদ্দি’।
সিদ্দিরা জাঞ্জিরায় কবে এবং কেমন করে এসেছিল তা সঠিক জানা যায় না। গল্পে আছে, ১৪৯৮ সালে আবিসিনিয়ার একজন দুঃসাহসী ওখানকার দুর্গাধ্যক্ষের কাছে তিন-শোটি বাক্স দ্বীপে নামাবার অনুমতি প্রার্থনা করে। সে জানায় বাক্সর ভেতর সূক্ষ্ম কারুকার্যপূর্ণ মাটির তৈরি জিনিসপত্র আছে, দুর্গের অধিবাসীদের কাছে বিক্রির আশায় সে নিয়ে এসেছে। তার প্রার্থনা মঞ্জুর হয়। বাক্সগুলি সাবধানে দুর্গের ভিতর নিয়ে আসতে দুর্গরক্ষীরা সাহায্যও করে। কিন্তু প্রত্যেক বাক্সের মধ্যে মাটির জিনিসের পরিবর্তে এক একজন সশস্ত্র সৈনিক লুকিয়ে ছিল। মাঝরাতে বাক্স থেকে বেরিয়ে তারা দুর্গ দখল করে।
সপ্তদশ শতাব্দীর গোড়া থেকে সিদ্দিরা বিজাপুরের সুলতানের সামন্ত হিসেবে জাঞ্জিরায় কর্তৃত্ব করছিল। দাক্ষিণাত্যের বেশিরভাগ অঞ্চল তখন ছিল বিজাপুরের সুলতানদের অধীনে। সপ্তদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি দক্ষিণ উপকূলে তারা বেশ জাঁকিয়ে বসেছিল। তাদের নৌবাহিনী ক্ষুদ্র হলেও যথেষ্ট শক্তিশালী ছিল।
বিজাপুর সুলতানের প্রতিনিধিরূপে ওই উপকূল রক্ষা এবং মুসলমান তীর্থযাত্রা#দের মক্কায় যাবার ব্যবস্থা করার দায়দায়িত্ব ছিল সিদ্দিদের। আশেপাশের কয়েকটি দুর্গও তাদের জিম্মায় দেওয়া হয়েছিল। এইসব দুর্গের রক্ষীদের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য কিছু লাগোয়া এলাকাও তাদের অধিকারে এসেছিল। পরবর্তীকালে সিদ্দিরা ওই এলাকা একটু একটু করে বিস্তার করে চলেছিল। শিবাজির আমলে জাঞ্জিরার চারপাশে প্রায় তিরিশ মাইল ভূখণ্ড তাদের দখলে ছিল।
সিদ্দিরা জাতে মুসলমান। তাদের রাজধানী ছিল দান্দা রাজাপুর, সে সময় একটি সমৃদ্ধশালী বন্দর। দান্দা রাজাপুরের খুব কাছেই জাঞ্জিরা, সমুদ্রবেষ্টিত এবং দুর্ভেদ্য তার দুর্গ।
সিদ্দিরা কিন্তু উত্তরাধিকার সূত্রে শাসনকর্তা পদের অধিকারী হত না। কোনো শাসকের মৃত্যু হলে বিজাপুরের সুলতান যাকে যোগ্য মনে করতেন তাকেই শাসক নিযুক্ত করতেন। বলা বাহুল্য, সুলতানের বিশ্বস্ত কারু ভাগ্যেই ওই সম্মান জুটত। তার উপাধি হত উজির, অর্থাৎ মন্ত্রী। সিদ্দিদের দুর্গরক্ষীদের মধ্যে বেশ কিছু মারাঠাও ছিল, কিন্তু তাদের রণতরীর নাবিক ও সোনারা সব ছিল কাফ্রী। সমুদ্রেই ছিল তাদের জীবন, যোদ্ধা হিসেবেও তাদের সুখ্যাতি ছিল।
ফলে ভারতের পশ্চিম উপকূলে, কোঙ্কণের বুকে, একাধারে সুদক্ষ নাবিক এবং কুশলী যোদ্ধাদের একটি উপনিবেশ গড়ে উঠল। ধর্ম তাদের আলাদা, স্থানীয় অধিবাসীদের আচার ব্যবহারের সঙ্গে তাদের বিস্তর প্রভেদ। এদের বংশধরদের আজও জাঞ্জিরার আশেপাশে দেখা যায়। সমুদ্রেই তাদের জীবিকা। নৌকায় উপকূল ধরে পারস্য এবং পূর্ব আফ্রিকার বন্দরে তারা ম্যাঙ্গালোরের লাল টালি, কারওয়ারের সেগুন, কাজুবাদাম, নারকেল ছোবড়ার আঁশ ইত্যাদি নিয়ে যায় এবং ফিরে আসে খেজুর, কার্পেট ইত্যাদি নিয়ে। সমুদ্রপথে ব্যাবসাই তাদের মূল উপজীবিকা। তবে মাঝে মাঝে সোনা-রুপার বাঁট কিংবা মাদক দ্রব্যের চোরাই চালানে তারা যে জড়িয়ে পড়ে না এমন নয়। পূর্বসূরীদের মতোই বেপরোয়া ওরা, রক্তে ওদের দুঃসাহসের নেশা।
সিদ্দি এবং মারাঠাদের মধ্যে অনেকটা যেন বংশগত শত্রুতা। শিবাজির প্রথম জীবনেই এই সংঘর্ষের সূত্রপাত। ১৬৪৮ সালে তিনি সিদ্দিদের রাজত্ব আক্রমণ করে তাদের একটি বিচ্ছিন্ন দুর্গ দখল করেন। ১৬৫৯ সাল থেকে শিবাজি প্রায় প্রতি বছরই সিদ্দিদের বিরুদ্ধে সৈন্যবাহিনী পাঠিয়েছিলেন। ১৬৭০ সালে ত্রয়োদশ আক্রমণের সময় শিবাজি স্বয়ং অভিযান পরিচালনা করেছিলেন। তিনি সেবার পূর্ণ শক্তি নিয়োগ করেছিলেন জাঞ্জিরার দুর্গ দখলের উদ্দেশ্যে। ওই একবারই সিদ্দিরা প্রায় আত্মসমর্পণ করে বসেছিল, কিন্তু শেষপর্যন্ত অসাধারণ মনোবল নিয়ে তারা দুর্গ রক্ষা করে। শিবাজিকে তাঁর অবরোধ তুলে নিয়ে ওখান থেকে চলে যেতে হয়েছিল।
সিদ্দিদের সেই সংকট মুহূর্তে বিজাপুরের সুলতান সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসেননি, তাই তারা বিজাপুরের সুলতানের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে ঔরঙ্গজেবের সঙ্গে চুক্তির প্রস্তাব করল। ঔরঙ্গজেবের সামন্ত হিসেবে তারা জাঞ্জিরা শাসন করবে। এমনকী বিজাপুরের যে নৌবহর তাদের হাতে আছে, মুঘলদের প্রয়োজনে তা সাহায্যের জন্য এগিয়ে যাবে, কিন্তু তার পরিবর্তে মারাঠাদের আক্রমণের হাত থেকে তাদের রক্ষা করতে হবে ঔরঙ্গজেবকে।
ঔরঙ্গজেব যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেলেন। তিনি তাদের প্রস্তাবে রাজি তো হলেনই, উপরন্তু নৌবহর রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ওদের শাসনকর্তা সিদ্দি কাশেমকে বাৎসরিক চার লাখ টাকা মঞ্জুর করলেন। সিদ্দি কাশেমকে তিনি ‘ইয়াকুত খাঁ’ এই সম্মানে ভূষিত করলেন।
তবে অল্প কিছুদিনের মধ্যেই সিদ্দিদের বুঝতে বাকি রইল না যে, সামরিক সাহায্যের ব্যাপারে বিজাপুরের সুলতানের মতো মুঘলরাও তাদের কর্তব্য সম্বন্ধে তেমন সচেতন নয়। ফলে সিদ্দিরা কখনো মারাঠাদের পক্ষে বিপদজনক হয়ে ওঠেনি, আবার মারাঠারাও সিদ্দিদের শৌর্য বীর্যকে সম্মানের চোখে দেখত। তারা বুঝতে পেরেছিল স্থলে যতই তারা পরাক্রান্ত শক্তিরূপে গণ্য হোক না কেন, সমুদ্রে আধিপত্য স্থাপন করতে না পারলে সিদ্দিদের কাবু করা যাবে না। চতুর্দিকে সমুদ্র বেষ্টিত জাঞ্জিরা দুর্গ যে দুর্জেয় তা শিবাজিও বুঝেছিলেন। তাই শক্তিশালী নৌবহর গড়ে তোলার দিকে তিনি মন দিয়েছিলেন। কিন্তু সেই নৌবহর সিদ্দিদের বিরুদ্ধে প্রয়োগ করা তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়নি। যে সাম্রাজ্য তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তাকে শক্ত বুনিয়াদের উপর স্থাপন করতে ব্যস্ত থাকতে হয়েছিল তাঁকে। তা ছাড়া মুঘলদের সঙ্গে তাঁর যুদ্ধের বিরাম ছিল না।
সাত
১৬৮০ সালে শিবাজি রায়গড়ে প্রাণত্যাগ করলেন। ঔরঙ্গজেব রাজসভার ঐতিহাসিক কাফি খাঁ এই ঘটনার উল্লেখ করে লিখলেন ‘কাফের জাহান্নমে গেছে।’ শিবাজির জ্যেষ্ঠ পুত্র শাম্ভাজি মারাঠা সিংহাসনে আরোহণ করলেন।
ওই সময় কানোজি আংরের বয়স এগারো। হরনাই গ্রামে সেই ব্রাহ্মণের গোরু চরিয়ে তিনি তাঁর কাছে শাস্ত্র পাঠ করছেন।
শাম্ভাজির সাহস ও বীরত্বের অভাব ছিল না, কিন্তু তাঁর সব গুণ নষ্ট হয়ে গিয়েছিল চারিত্রিক দোষে। তিনি উচ্ছৃঙ্খল, নিষ্ঠুর এবং অমিতাচারী ছিলেন।
‘পর্বতের মুষিকের’ মৃত্যুর সুযোগে ঔরঙ্গজেব দাক্ষিণাত্যে চরম আঘাত হানবার জন্য প্রস্তুত হলেন। তাঁর বিশাল বাহিনীর মধ্যে প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেল। দৈর্ঘ্যে কুড়ি মাইল আর প্রস্থে ছ-মাইল— ঔরঙ্গজেবের বিশাল বাহিনী এবার ঝাঁপিয়ে পড়বে মারাঠাদের ওপর।
এই আক্রমণের বিরুদ্ধে শাম্ভাজি সর্বশক্তি প্রয়োগ করবেন এটাই স্বাভাবিক, কিন্তু তিনি তখন জাঞ্জিরার সিদ্দির বিরুদ্ধে শক্তি ক্ষয়ে ব্যস্ত। তিনি মতলব আঁটছেন যে প্রণালীটা মূল ভূখণ্ড থেকে জাঞ্জিরাকে বিচ্ছিন্ন করেছে সেটা ভরাট করে স্থলপথে সিদ্দিকে আক্রমণ করবেন। তাঁর সেই পরিকল্পনা যে চমকপ্রদ এবং অভিনব সে বিষয়ে সন্দেহ নেই, কিন্তু সময়টা নিশ্চয়ই উপযোগী ছিল না। তাঁর আদেশে এই অমানুষিক কাজ শুরু হল।
এমন সময় খবর এল মুঘল অশ্বারোহী বাহিনীর একটি অগ্রগামী দল পঞ্চাশ মাইলের মধ্যে এসে পড়েছে। শাম্ভাজি তখন দাদোজি রঘুনাথের উপর জাঞ্জিরা অবরোধের ভার দিয়ে মুঘল অশ্বারোহী বাহিনীর মোকাবিলা করতে চললেন। অতর্কিত হানার পর হানা দিয়ে তাদের গতিরোধ করে দিলেন তিনি। তারপর চারদিক থেকে বন্ধ করে দিলেন তাদের সরবরাহের পথ। মুঘলদের যেই রসদে টান পড়ল, তিনি তাদের আক্রমণ করলেন। ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল মুঘল বাহিনী। সেনাপতি হুসেন আলি খাঁ বর্ষা নামার আগেই মূল বাহিনি নিয়ে পিছু হঠতে বাধ্য হল।
এদিকে লোকবল কমে যাওয়ায় প্রণালী ভরাট করার কাজ পরিত্যাগ করতে হল। তারপর নামল বর্ষা। প্রণালীর ওপারে দাদোজি রঘুনাথ দুর্গ অবরোধ করে বসে ছিলেন। তিনি অসহিষ্ণু হয়ে উঠলেন, বর্ষা শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করার ধৈর্য হারিয়ে ফেললেন। চল্লিশ ফুট উঁচু প্রাচীরে ঘেরা জাঞ্জিরার দুর্গ। যে সময় বর্ষার দাপট প্রচণ্ডতম, সেই আগস্ট মাসে তিনি ওই দুর্লঙ্ঘ এবং দুর্ভেদ্য দুর্গ আক্রমণ করে বসলেন। রণনীতিতে এমন মারাত্মক ভুলের বোধ হয় তুলনা নেই। পিচ্ছিল শিলাখণ্ডে পা হড়কে আর প্রচণ্ড সমুদ্রের ঢেউয়ে মারাঠা বাহিনীর প্রায় অর্ধেক প্রাণ হারাল। অবশিষ্ট যারা কোনো মতে প্রাচীর বেয়ে উপরে উঠেছিল, সিদ্দির বাহিনির হাতে অসহায়ের মতো তারা নির্মূল হয়ে গেল। মুষ্টিমেয় জীবিত অনুচর নিয়ে দাদোজি রঘুনাথ পালিয়ে বাঁচলেন।
মারাঠাদের পরাজিত করেই ক্ষান্ত হল না সিদ্দি। কাটা ঘায়ে নুনের ছিটের মতো সদলবলে পলায়মান মারাঠাদের পশ্চাদ্ধাবন করল। দাদোজি রঘুনাথের পত্নী তাদের হাতে বন্দি হলেন। এ অপমানের কথা মারাঠারা ভোলেনি।
১৬৮২ সালের অক্টোবর মাসে তিরিশটি মারাঠা রণতরী সিদ্দির নৌবহর ধ্বংস করার অভিপ্রায়ে সমুদ্র যাত্রা করল। সিদ্দির রণতরীর সংখ্যা ছিল অনেক কম, কিন্তু সমুদ্রে ছিল তাদের অবাধ স্বাচ্ছন্দ্য। কাশেম ইয়াকত খাঁর স্বয়ং তাঁর নৌবাহিনী পরিচালনা করলেন। তিনি সুযোগসন্ধানী শিবাজির মতো পছন্দমতো একটি জায়গা বেছে মারাঠা নৌবহরের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন। থানা নদীর মুখে দু-দলের দেখা হল। মারাঠা নৌবহর স্থলে অশ্বারোহী বাহিনীর আক্রমণের মতো ঝাঁপিয়ে পড়তে চেষ্টা করল সিদ্দির নৌবহরের উপর। নৌযুদ্ধে অমন আক্রমণ আত্মহত্যার শামিল। সিদ্দি কাশেমও এটাই চাইছিলেন। মারাঠা নৌবহর সম্পূর্ণ পরাজিত হল। তাদের পতাকাবাহী জাহাজ (ফ্ল্যাগ শিপ) ছাড়াও চারটে জাহাজ সিদ্দির দখলে এল, ডুবল বেশ কিছু। মজার কথা, মারাঠা নৌবহর পরিচালনা করেছিল একজন সিদ্দি। নিজের সম্প্রদায় ছেড়ে সে মারাঠা দলে যোগ দিয়েছিল। ওই যুদ্ধে আহত হয়ে তার মৃত্যু হয়।
এই অভিযানে কানোজিও অংশ নিয়েছিলেন, নৌযুদ্ধে এই তাঁর হাতেখড়ি। শোচনীয় এই পরাজয় থেকে নিশ্চয়ই তিনি ইতিহাসের পাঠ নিয়েছিলেন। যুদ্ধের সময় কখন বুদ্ধিমানের মতো পিছিয়ে আসা দরকার এই শিক্ষালাভ করেছিলেন তিনি। মারাঠা সেনাপতিদের সাহসের অভাব ছিল না, কিন্তু দূরদৃষ্টির বড়োই অভাব ছিল। এ দূরদৃষ্টি অর্জন করেছিলেন কানোজি। সাহস, দূরদৃষ্টি আর রণনীতির কৌশল— এই তিনের সমন্বয় ঘটেছিল তাঁর জীবনে।
যৌবনে কানোজির যে ছবি আমরা পাই তা হল— রোদে পোড়া তামাটে গায়ের রং, ভ্রমরকৃষ্ণ আঁখি, প্রশস্ত বক্ষ, অসমসাহসী, দক্ষ সাঁতারু, নিপুণ অসিচালক এবং একজন দক্ষ ঘোড়সওয়ার। অনাড়ম্বর ছিল তাঁর জীবনযাত্রা, পোশাকে এবং আহারে কোনো পারিপাট্য ছিল না। তাঁর অনুচরদের সাহচর্য তিনি পছন্দ করতেন। বই পড়া তাঁর ছিল প্রিয় নেশা আর ব্যবহারে তিনি ছিলেন সোজাসুজি, রেখে ঢেকে কিছু বলতেন না বা করতেন না। তাই অনেক সময় তাঁর বাক্যবাণ বৃশ্চিকের ন্যয় দংশন করত শ্রোতাকে।
একসময় যে বালকের বাতিক ছিল তরবারি সংগ্রহ করা, এখন যৌবনে সেই অসিই হয়েছে তাঁর জীবিকা। ভাবীকালের দুর্ধর্ষ নৌসেনাপতি কানোজি আংরের ভবিষ্যৎ স্থির হয়ে গেছে।
আট
ঔরঙ্গজেবের সুদীর্ঘ রাজত্বকালে তাঁর সাম্রাজ্যের আয়তন এত বিশাল ছিল যে, একটি ভ্রাম্যমান দলের পক্ষে তাঁর অধিকৃত জনপদ অতিক্রম করতে দু-বছরেরও বেশি সময় লেগে যেত।
মুঘলদের হাতে বিজাপুরের পতন ঘটল। সম্মিলিত মারাঠা প্রতিরোধও ভেঙে পড়ার উপক্রম। কেবলমাত্র দুর্গগুলি তখনও টিকে আছে। গোটা দাক্ষিণাত্যে প্রায় ৩৬৫টি দুর্গ ছিল। প্রতিটি দুর্গ সেসময় বিচ্ছিন্ন, বাইরে থেকে সাহায্য পাবার আশা সুদূরপরাহত।
ঔরঙ্গজেব ওইসব দুর্গ দখলের দিকে এবার দৃষ্টি দিলেন। দুজন সেনাধ্যক্ষকে এই কাজের জন্য মনোনীত করলেন তিনি। ইত্তিখাদ খাঁর উপর ভার পড়ল স্থলভূমির দুর্গ দখলের আর জাঞ্জিরার সিদ্দি, কাশেম ইয়াকুৎ খাঁর উপর হুকুম হল কোঙ্কণ উপকূলে সমস্ত মারাঠা দুর্গ দখলের। এই অভিযান শুরু হবার আগেই ঔরঙ্গজেবের গুপ্তচরের দল দুর্গাধ্যক্ষদের সঙ্গে গোপনে যোগাযোগ শুরু করে দিল। বিনা যুদ্ধে আত্মসমর্পণ করলে তাদের প্রচুর উপঢৌকন দেওয়া হবে আর তা না করলে পরিণাম হবে ভয়াবহ।
মুঘল আক্রমণের মুখে দুর্গগুলি মাটির কেল্লার মতো ভেঙে পড়তে লাগল। বেশ কিছু দুর্গ বিনা যুদ্ধে আত্মসমর্পণ করল। কোঙ্কণেও সাগরগড়, রাজকোট আর পালি আত্মসমর্পণ করল সিদ্দির কাছে। সিদ্দি এবার আক্রমণ করল সুবর্ণ দুর্গ (মারাঠা উচ্চারণ ‘দুর্গ’)। সালটা ছিল ১৬৮৮।
বোম্বাইয়ের প্রায় এক-শো মাইল দক্ষিণে সুবর্ণ দুর্গ। ওই দ্বীপের চারদিক সমুদ্র বেষ্টিত। পঞ্চাশ ফুট উঁচু দেওয়ালে ঘেরা দুর্গের এলাকা আট একর। তিনটি গভীর কূপ দুর্গরক্ষীদের তৃষ্ণা নিবারণ করে। দুর্গের অধ্যক্ষের নাম অচলজি মোহিতে।
ওই দুর্গে আরও একজন ছিলেন, তাঁর নাম কানোজি আংরে। তাঁর পদ তখন ‘সর্দার’, পঁচিশজন রক্ষী তাঁর অধীনে। কানোজির বয়স তখনও কুড়ি অতিক্রম করেনি। এই অল্প বয়সেই স্থলে ও জলে অনেক যুদ্ধে যোগ দিয়ে তিনি পাকাপোক্ত একজন সৈনিক হয়ে গেছেন। তাঁর সাহস আর দক্ষতার কাহিনি আস্তে আস্তে ছড়িয়ে পড়ছে।
সুবর্ণ দুর্গের তিনদিক অবরোধ করল সিদ্দির নৌবহর। চতুর্থ হল স্থলে অবতরণ করার জলপথ। সেখানেও পাহারা বসানো হল। পালাবার সব পথ বন্ধ।
দুর্গের ভিতর পঞ্চম বাহিনি তাদের কাজ করে চলেছে। আত্মসমর্পণ করো, নতুবা কেউ রক্ষা পাবে না। প্রচুর পুরস্কারের কথাও তারা জানাতে ভোলেনি।
চারদিক অবরোধ করে সিদ্দি অপেক্ষা করছে। অনর্থক রক্তক্ষয় না করে বাইরে থেকে দুর্গের সরবরাহ বন্ধ করে দিলেই আজ না হয় কাল দুর্গরক্ষীরা আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হবে। জয় সুনিশ্চিত।
দুর্গাধ্যক্ষকে আত্মসমর্পণের জন্য আহ্বান জানালেন কাশেম ইয়াকুৎ খাঁ, নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি দিলেন। অচলজি মোহিতে শেষপর্যন্ত সিদ্দির হাতে দুর্গ তুলে দিতে সম্মত হলেন। খবরটা জানাজানি হতে দেরি হল না। কানোজি আংরে অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হলেন। বিনা যুদ্ধে আত্মসমর্পণ! তিনি গোপনে রায়গড়ে শাম্ভাজির কাছে অধ্যক্ষের সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে দূত পাঠালেন, সেইসঙ্গে দুর্গ রক্ষার দায়িত্ব নিজের কাঁধে নেবার অনুমতি চাইলেন। শোনা যায় রাজা তাঁকে পূর্ণ অধিকার দিয়েছিলেন। তবে এ ঘটনা সত্যি নাও হতে পারে, কারণ রায়গড়ে গিয়ে রাজার অনুমতি নিয়ে ফিরে আসতে যেকোনো দূতের অন্ততপক্ষে তিনদিন লাগার কথা। তা ছাড়া দূতের পক্ষে রায়গড়ে পৌঁছেই শাম্ভাজির দর্শনলাভ সহজ ব্যাপার ছিল না।
যাই হোক, কানোজি আংরে খুব গোপনে তাঁর উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য মন্ত্রণা করেছিলেন— এ বিষয়ে সন্দেহ নেই, কারণ দুর্গে তখন পঞ্চমবাহিনি ছাড়াও অচলজি মোহিতের বিশ্বস্ত অনুচর কিছু ছিল। কিন্তু দুর্গের বাইরে দুজন এই সশস্ত্র বিপ্লবের উদ্যোগ আয়োজনের কথা জানতেন। তাঁদের একজন হলেন বালাজি বিশ্বনাথ, চিপলুনে সিদ্দির লবণ কারখানার একজন কেরানি। তিনি সিদ্দির সৈন্যদের চলাচলের খবর গোপনে পাঠাচ্ছিলেন কানোজিকে। অন্যজন হলেন একজন সাধু, ব্রহ্মেন্দ্র স্বামী। তাঁর কথায় পরে আসব। স্বামীজি কানোজি আংরের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে তাঁকে আশীর্বাদ করেছিলেন।
রাতারাতি কানোজি আর তাঁর সঙ্গীরা অচলজি মোহিতেকে বন্দি করে দুর্গের কর্তৃত্ব গ্রহণ করলেন। তাঁরা ঘোষণা করলেন শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে দুর্গা রক্ষা করা হবে। এরপরই কিন্তু কানোজি মস্ত একটা ভুল কাজ করে বসলেন। যে প্রণালীটা স্থলের সঙ্গে দ্বীপের যোগাযোগ রক্ষা করছিল সেখানে সিদ্দির বাহিনীর একাংশ মোতায়েন ছিল তা আগেই বলা হয়েছে। কানোজি দুর্গ থেকে বেরিয়ে তাদের আক্রমণ করলেন। বলা বাহুল্য, ওই আক্রমণ সফল হয়নি। কানোজি নিশ্চয়ই উপলব্ধি করেছিলেন শুধু সাহসে ভর করেই সুদক্ষ সেনাপতি হওয়া যায় না, সেইসঙ্গে কূটবুদ্ধিও দরকার।
তাঁর সেই ঝটিকা বাহিনীর বেশিরভাগই সিদ্দির সতর্ক সৈন্যদের হাতে ধরা পড়ল, কানোজি নিজেও বন্দি হলেন। তবে বেশিদিন তাঁকে বন্দি থাকতে হয়নি। যেমন করেই হোক বন্দিদশা থেকে পালিয়ে প্রায় এক মাইল চওড়া প্রণালী তিনি পার হলেন। আবার দুর্গে ফিরে এলেন তিনি। এই ঘটনায় যে শিক্ষা তিনি পেয়েছিলেন সারাজীবনে তা তিনি ভোলেননি। শত্রু পরিবেষ্টিত অবস্থায় দুর্গের ভিতরে থাকাই নিরাপদ, আত্মরক্ষার শ্রেষ্ঠ উপায়। বাইরের সাহায্য ছাড়া দুর্গ থেকে বেরিয়ে এসে শক্তিশালী শত্রুকে আক্রমণ করা মারাত্মক ভুল। যেকোনো অবরোধের সময় যতটা সম্ভব সরবরাহ মজুত রেখে এবং গোলাগুলির সীমিত ব্যবহারে মাটি কামড়ে দুর্গের ভিতর থাকাই বিচক্ষণ রণনীতি। কানোজি এবার তাই করলেন। তিনি জানতেন কিছুকাল শত্রুপক্ষকে এভাবে ঠেকিয়ে রাখতে পারলেই আসবে বর্ষা— কোঙ্কণের প্রচণ্ড বর্ষা। শত্রুপক্ষ তখন বেসামাল হয়ে যাবে। কানোজির উদ্দেশ্য সফল হল। বর্ষা নামবার আগে সিদ্দি কাশেম দুর্গ জয়ের আশা ত্যাগ করে নিঃশব্দে অবরোধ তুলে চলে গেলেন। বিজয়লক্ষ্মী জয়ের তিলক পরিয়ে দিলেন কানোজির ললাটে। তাঁর এই সাফল্যে শাম্ভাজি প্রীত হলেন, সুবর্ণ দুর্গের অধ্যক্ষ পদে নিয়োগ করলেন তাঁকে।
* * *
বালাজি বিশ্বনাথ সিদ্দির নৌবহর ও সৈন্য চলাচলের খবর কানোজিকে জানিয়েছিলেন— এ ব্যাপারটা আর গোপন রইল না। সিদ্দি তাঁকে চরম শাস্তি দেবেন বলে প্রতিজ্ঞা করলেন। ধূর্ত বালাজি বিশ্বনাথ সেই খবর পেয়ে সরে পড়লেন। সিদ্দি তাঁর ভাই জানোজির উপর প্রতিহিংসা নিলেন। তাঁকে একটা বস্তায় পুরে, বস্তার মুখ সেলাই করে জীবিত অবস্থায় সমুদ্রে ডুবিয়ে মারা হল।
বালাজি পুণায় এলেন। পুণায় তখন জোর সামরিক তৎপরতা চলছে। বালাজি বিশ্বনাথের মতো তীক্ষ্নবুদ্ধিসম্পন্ন এক যুবকের সেখানে কাজের অভাব হল না। তিনি শুধু বিদ্বানই ছিলেন না, একজন সুদক্ষ অর্থনীতিবিদও ছিলেন। ১৬৮৯ সালে এক মারাঠা সুবেদারের অধীনে খাজনা আদায় দপ্তরে তিনি যোগ দিলেন। ১৬৯৫ সালে সুবেদারের ঠিক নীচের পদে উন্নীত হলেন তিনি। তাঁর প্রধান কাজ ছিল পুণার চতুর্দিকে যে সেনাবহিনী ছাউনি ফেলত তাদের রসদ সরবরাহ করা। মজার কথা, একজন মারাঠা কর্মচারী হলেও, মুঘল সেনাবাহিনী যখন পুণায় এবং পুণার চতুর্দিকে ছাউনি ফেলত তখন তাদেরও তিনি মূল্যের বিনিময়ে রসদ সরবরাহ করতেন।
যুদ্ধরত মারাঠা আর মুঘল দু-পক্ষের অধিনায়করাই, বালাজির সাংগঠনিক দক্ষতায় এবং প্রয়োজনের সময় তাঁর সহযোগিতা আর তৎপরতায়, তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ ছিলেন।
যে মানুষটি একটি লবণের কারখানায় সামান্য কেরানির জীবন শুরু করেছিলেন, তিনি ধীরে ধীরে সৌভাগ্যের সোপান বেয়ে উপরে উঠছেন।
‘তুমি এ রাজ্যের সর্বোচ্চ পদ অলংকৃত করবে,’ ব্রহ্মেন্দ্র স্বামী এ কথা বলেছিলেন তাঁকে। স্বামীজির ভবিষ্যদবাণীর উপর গভীর আস্থা ছিল বালাজি বিশ্বনাথের।
নয়
১৬৮৯। মুঘল সেনাপতি তকরিব খাঁ এক গেরিলা বাহিনী নিয়ে মহারাষ্ট্রের ষাট মাইল অভ্যন্তরে বেপরোয়া এক আক্রমণ চালালেন। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল অতর্কিত হানা দিয়ে শাম্ভাজিকে বন্দি করা। গুপ্তচরদের মুখে গোপনে সব খবর সংগ্রহ করে তবেই তকরিব খাঁ এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। শাম্ভাজি তখন সঙ্গমেশ্বরের কাছে নদীর ধারে তাঁর প্রমোদ ভবনে বিলাসে দিন কাটাচ্ছেন। মুঘল সেনারা যখন সেখানে হানা দিল তখন তিনি পানোন্মত্ত। শাম্ভাজিকে বন্দি করে তুলাপুরে মুঘলদের শিবিরে নিয়ে যাওয়া হল। তুলা মানে ওজন। তুলাপুর অর্থ যে শহরে ওজন করা হয়। শাম্ভাজির পিতামহ, শিবাজির পিতা, শাহজি একবার বাজি ধরেছিলেন, তিনি একটি হাতির ওজন করতে পারেন। একটি মালবাহী নৌকায় তিনি একটি হাতিকে তুলেছিলেন। পরে হাতিকে নামিয়ে নৌকাটি তিনি বড়ো বড়ো পাথরে ভরতি করেছিলেন। হাতি সমেত নৌকাটি জলে যতটা ডুবেছিল ততটা ডোবার পর পাথরগুলি নামিয়ে ওজন করে তিনি হাতির ওজন বলে দিয়েছলেন। এই ঘটনার জন্য ওই জায়গার নাম হয়ে গিয়েছিল তুলাপুর।
ঔরঙ্গজেবের হুকুমে শাম্ভাজিকে একটি উটের পিঠে বেঁধে প্রকাশ্যে প্রদর্শন করা হল। তারপর একটি তপ্ত লৌহশলাকা তাঁর চোখের ভিতর ঢুকিয়ে জিভ কেটে ফেলা হল। পরে তাঁর শিরচ্ছেদ করে, দেহ টুকরো টুকরো করে কুকুরদের নিয়ে খাওয়ানো হল।
ঔরঙ্গজেব ভেবেছিলেন তাঁর এই নৃশংসতায় মারাঠারা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়বে, বশ্যতা স্বীকার করবে। কিন্তু ঘটনা হল ঠিক বিপরীত। শাম্ভাজির জীবিতকালে যে সব মারাঠা সর্দার তাঁর দুর্বিনীত আচরণে বীতশ্রদ্ধ হয়ে তাঁকে ত্যাগ করেছিলেন, তাঁরাই এই নৃশংসতার প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য দৃঢ়সংকল্প হলেন। মারাঠা জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে শিবাজি যে সাম্রাজ্য স্থাপন করেছিলেন, শাম্ভাজির কিছুকাল রাজত্বকালেই তাতে ভাঙন ধরেছিল।
আবার এক হলেন মারাঠা সর্দাররা। তাঁরা নিজে থেকে জড়ো হলেন রায়গড়ে, ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা সম্বন্ধে আলোচনার উদ্দেশ্যে মন্ত্রণায় বসলেন। শাম্ভাজির ছেলে শিবাজির (পরে যিনি নাম নিয়েছিলেন শাহু) বয়স তখন মাত্র ছয়। সর্দাররা ঘোষণা করলেন বালক শিবাজি প্রাপ্তবয়স্ক না-হওয়া পর্যন্ত শাম্ভাজির বৈমাত্রেয় ভ্রাতা রাজারাম রাজপ্রতিনিধিরূপে রাজকার্য পরিচালনা করবেন। সর্দাররা অনুধাবন করলেন শাম্ভাজিকে বন্দি এবং হত্যা করার সাফল্যে উৎসাহিত হয়ে মুঘল সেনাপতিরা রাজারামকেও বন্দি করার জন্য অনুরূপ প্রচেষ্টা করবে। তাই তাঁরা সিদ্ধান্ত নিলেন কোনো নির্দিষ্ট এক স্থানে রাজারামের থাকা চলবে না। মুসাফিরের মতো তিনি ঘন ঘন স্থান পরিবর্তন করবেন, গমন করবেন দুর্গ হতে দুর্গান্তরে এবং তাঁর গতিবিধি খুব গোপন রাখা হবে।
এমন অবস্থা যদি দাঁড়ায় যে, দুর্গগুলির পতন ঘটছে তবে হাজার মাইল দূরে, ভারতবর্ষের পূর্ব উপকূলে, মারাঠাদের ছোট্ট ঘাঁটি জিঞ্জিতে চলে যাবেন রাজারাম। মারাঠা সর্দাররা মুঘলদের সঙ্গে লড়াই চালিয়ে যাবেন।
এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে মারাঠা সর্দাররা খুব বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছিলেন, কারণ যখন তাঁরা ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে জল্পনা কল্পনা করছেন, ঠিক সেইসময় ঔরঙ্গজেবের সেনাপতি ইত্তিকাদ খাঁ শক্তিশালী এক বাহিনী নিয়ে এগিয়ে আসছিলেন রায়গড়ের দিকে।
বর্ষার শেষে রায়গড় অবরোধ করল মুঘল সৈন্য। কিন্তু সহজে রায়গড় দখল করা সম্ভব হল না। শিবাজির গড়া দুর্গগুলির মধ্যে ওটা ছিল অত্যন্ত সুরক্ষিত। প্রচুর খাদ্য আর গোলাবারুদ মজবুত ছিল ওই দুর্গে।
ইত্তিকাদ খাঁয়ের সাহায্যে এগিয়ে এসেছে জাঞ্জিরার সিদ্দি, কাশেম ইয়াকুত খাঁ। তাদের সম্মিলিত বাহিনী ১৬৯০ সালের বসন্তকালে রায়গড় দুর্গ প্রাচীর লক্ষ করে প্রচুর গোলাবর্ষণ করল, কিন্তু কোনো ফল হল না। মারাঠাদের মধ্যে একটা অদম্যভাব জেগে উঠেছে। তা ছাড়া প্রতিটি মারাঠাদের কাছে রায়গড় যেন একটা পীঠস্থান। রায়গড়েই শিবাজি সিংহাসনে আরোহণ করেছিলেন, সেখানেই তাঁর দেহাবসান ঘটেছে।
শেষপর্যন্ত বিশ্বাসঘাতকতার ফলে রায়গড় দুর্গ মুঘলদের হস্তগত হল। সূর্যজি পিসল নামে এক মারাঠা আর তার কিছু অনুচর ভিতর থেকে দুর্গের তোরণ মুঘলদের কাছে উন্মুক্ত করে দিল। প্রচুর জমিজমা পুরস্কারের লোভে এই ঘৃণ্য কাজ করেছিল বিশ্বাসঘাতকের দল।
রায়গড় দুর্গ মুঘলদের কবলিত হল, সেইসঙ্গে বন্দি হলেন ভবিষ্যৎ রাজা, বালক শিবাজি আর তাঁর মাতা। তাঁদের দুজনকেই ঔরঙ্গজেবের শিবিরে নিয়ে যাওয়া হল। শোনা যায় সম্রাট নাকি তাঁদের প্রতি সদয় ব্যবহার করেছিলেন। হয়তো শাম্ভাজির প্রতি নৃশংসতার পরিণাম তাঁর অনুশোচনার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তাঁর সেই আচরণই যে মারাঠা সর্দারদের ঐক্যবদ্ধ হতে সাহায্য করেছে— এই রূঢ় সত্য উপলব্ধি করেছিলেন তিনি।
কিন্তু রায়গড়ের পতন এবং মারাঠা সিংহাসনের ভবিষ্যৎ উত্তরাধিকারীর বন্দিদশা মারাঠাদের উজ্জীবিত অনুপ্রেরণাকে দমন করতে পারল না। ঔরঙ্গজেবের বিজয় বাহিনী দাক্ষিণাত্যে, বিশেষ করে সমতলভূমিতে ছড়িয়ে পড়তে থাকলেও বশ্যতা স্বীকারের কোনো চিহ্নই তারা দেখতে পেল না। আরও দুটি দুর্গ অবরোধ করল মুঘল সৈন্য, কিন্তু মারাঠা সর্দাররা সুপরিকল্পিতভাবে স্বাধীন দলে ভাগ হয়ে পালটা আক্রমণ শুরু করল। বিদ্যুৎ গতিতে অতর্কিতে সেনাদের ওপর চড়াও হয়ে তাদের বেশ কিছু হতাহত করে তারা সরে পড়ছে।
রাজারাম জিঞ্জিতে চলে যাওয়াই নিরাপদ মনে করলেন। কিন্তু যাবার আগে তিনি একটি ক্ষুদে মন্ত্রীসভা গঠন করে তাদের হাতে অবাধ ক্ষমতা অর্পণ করলেন। সামরিক দিক থেকেও কিছু গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা করলেন তিনি, নতুন কয়েক জন সেনাপতির নামও ঘোষণা করা হল। বহু মারাঠা সর্দারকে তিনি এমন সব দুর্গের অধ্যক্ষ নিযুক্ত করলেন যেগুলো তখন মুঘলদের হাতে।
নব নিযুক্ত সেনাপতিদের মধ্যে সিদ্দজি গুজ্জারের নাম ছিল। তাঁর উপর ভার পড়ল মারাঠা নৌবাহিনীর। সমুদ্র এবং স্থলপথে যেকোনো আক্রমণের হাত থেকে উপকূল রক্ষার দায়িত্ব ন্যস্ত হল তাঁর উপর। তাঁর নতুন পদমর্যাদা হল ‘সারখেল’ বা প্রধান নৌ-সেনাপতি।
সিদ্দজি গুজ্জারের অধীনে দুজন উপসেনাপতির নামও ঘোষণা করা হল। একজনের নাম ভগবানজি মোহিতে; অপরজন কুড়ি বছরের এক যুবক, অল্প কিছুকাল তাঁর নাম খুব শোনা যাচ্ছে। তিনি হলেন— কানোজি আংরে।
দশ
যেসব সামরিক প্রধানরা জিঞ্জিতে রাজারামের অনুগমন করেছিলেন, সিদ্দজি গুজ্জারও ছিলেন তাঁদের একজন। ফলে নৌবহর পরিচালনা এবং উপকূল রক্ষার দায়িত্ব পড়ল তাঁর দুই সহকারীর উপর। কোঙ্কণের উত্তর উপকূল, সুবর্ণ দুর্গ এবং ঘেরিয়া কানোজির কর্তৃত্বে এল, স্বাধীনভাবে তিনি ওই অঞ্চল রক্ষা করবেন।
শিবাজির মৃত্যুর সময়ে তাঁর নৌবহরে পাঁচ-শোটি জাহাজ ছিল। তবে কথাটা হয়তো অতিরঞ্জিত। সম্ভবত রণতরী, বাণিজ্য-জাহাজ, নৌকা সব ধরে এই সংখ্যা বলা হয়েছে। ঐতিহাসিকরা অবশ্য স্বীকার করেছেন যে, শিবাজি নানান আকারের দুশোটি যুদ্ধ জাহাজ নির্মাণ করেছিলেন।
শিবাজির মৃত্যুর মাত্র দশ বছরের মধ্যেই তাঁর শক্তিশালী নৌবহরের মাত্র কয়েকটি রণতরী অবশিষ্ট ছিল। তখনকার পোর্তুগিজ শাসনকর্তার উক্তি অনুযায়ী কানোজির ভাগে আট-দশটির বেশি রণতরী পড়েনি।
তখনকার মারাঠা নৌবহরে পাঁচরকম যুদ্ধজাহাজ ছিল। ঘুরাব, গালিভাত (মারাঠা উচ্চারণ অনেকটা ‘গলবত’), মাঁচোয়া, শিবার এবং পাল।
মাঁচোয়া বড়ো ধরনের মাছ ধরার নৌকা। উপকূল অঞ্চলে ব্যবহারের জন্য এর প্রয়োজন হত। পনেরো জনের বেশি মানুষ বহন করার ক্ষমতা ছিল না মাঁচোয়ার।
গালিভাত পাল তোলা, দাঁড়টানা নৌকা।
পাল, শিবার এবং ঘুরাব ছিল সমুদ্র উপযোগী মস্ত নৌকা বা জাহাজ। এগুলিতে দুটি থেকে তিনটি মাস্তুল আর পাল খাটানো থাকত।
সবচেয়ে বড়ো রণতরী ছিল ঘুরাব, দুটি এবং প্রায়ই তিনটি মাস্তুল থাকত ঘুরাবে। এগুলি দেড়শো থেকে তিন-শো টনের হত। দু-একটি আবার চার-শো টনের হত। তখনকার ইংরেজ এবং পোর্তুগিজ ক্ষুদে রণতরীর সঙ্গে ঘুরাবের তুলনা করা যায়। তবে ইউরোপীয় জাহাজের মতো অতটা সমুদ্রোপযোগী কোনো মারাঠা জাহাজই ছিল না। ঘুরাব ছিল অনেকটা হোঁতকা ধরনের, চওড়া কড়িকাঠযুক্ত। সামনের দিকটা দীর্ঘ এবং তরবারির ফলার মতো ছুঁচলো, জল থেকে সামান্য উঁচুতে থাকত। উন্মুক্ত সমুদ্রে ভীষণ দোলা খেত ঘুরাব। এমন একবার প্রচণ্ড দোলনে সমুদ্রপীড়ায় এত কাতর হয়ে পড়েছিলেন শিবাজি যে, তারপর থেকে কোনো নৌ-অভিযান স্বয়ং পরিচালনা করার বিশেষ আগ্রহ তাঁর ছিল না।
ঘুরাবের দু-পাশের ফোঁকর (পোর্ট-হোল) দিয়ে দুটি কামান থেকে গোলা বর্ষণ করা হত। ওই কামানগুলি ছিল নয় থেকে বারো পাউন্ডারের (pounder) মধ্যে। এ ছাড়াও বারো থেকে ষোলোটা কামান থাকত ঘুরাবে— এক একদিকে ছ-টি কী আটটি। ওই কামান থেকে ছয় থেকে নয় পাউন্ডের (pound) গোলা ছোড়া যেত। নাবিক ছাড়া ঘুরাবে সৈন্য থাকত দেড়শো থেকে দু-শো।
তবে ঘুরাব কদাচিৎ একা একা শত্রুর মোকাবিলায় এগিয়ে যেত। তাদের সঙ্গে থাকত বেশ কিছু গালিভাত। এগুলি ছিল দ্রুতগামী এবং অনায়াস ছিল এদের গতি, খুশিমতো দিক পরিবর্তনের পক্ষে উপযুক্ত। গালিভাতের ওজন সাধারণত সত্তর টনের বেশি হত না। আরও বড়ো হলে এগুলি ঘুরাবের পর্যায়ে পড়ত, কারণ দুটিরই মূল নকশা ছিল প্রায় একরকম। কিছু ইউরোপীয় লেখক ক্ষুদে ঘুরাবকে গালিভাত আর বড়ো গালিভাতকে ঘুরাব বলে ভুল করেছেন।
মারাঠা নৌবহরে গালিভাত ছিল মেরুদণ্ড। খুব দ্রুত দাঁড় টানা এবং পালতোলা নৌকা। গালিভাতের দুটি মাস্তুলের দ্বিতীয়টি ছিল একটু পলকা, আর প্রধান মাস্তুল খুব মজবুত, বড়ো এবং ত্রিকোণ। এগুলির পাটাতন বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই চেরা-বাঁশ দিয়ে তৈরি, ফলে কামানের ভার বহন করার ক্ষমতা থাকত না।
বড়ো গালিভাতের পাটাতন অবশ্য কাঠের হত এবং ছয় পাউন্ডার থেকে আট পাউন্ডার অথবা চার পাউন্ডারের কামান বহন করতে পারত। তবে এ ধরনের ভারী গালিভাত তেমন জনপ্রিয় ছিল না। আজও কোঙ্কণে কানোজি আংরের আমলের গালিভাত দেখতে পাওয়া যায়।
গালিভাতে চল্লিশ থেকে পঞ্চাশটি দাঁড় থাকত আর ঘণ্টায় চার মাইল ছিল তাদের গতি। স্বচ্ছন্দ, অনায়াস ভঙ্গিতে এগুলি খুশিমতো ঘোরাফেরা করত, ঠিক যেন নৌবাহিনীর অশ্বারোহী দল। ঘুরাবকে দড়ি দিয়ে বেঁধে শত্রু জাহাজের দিকে টেনে নিয়ে যাবার কাজে প্রায়ই লাগানো হত গালিভাতকে।
ঘুরাব আর গালভাত— এ দুটিই ছিল মারাঠাদের প্রধান রণতরী। পাল, শিবার এসব ছিল অনেকটা দো-আঁশলা জাতের নৌযান, ঘুরাব অপেক্ষা ছোটো কিন্তু গালিভাতের তুলনায় বড়ো।
আগ্নেয়াস্ত্র বলতে যে কামানের কথা আগে উল্লেখ করা হয়েছে, তা ছাড়া আর কিছু ছিল না। নৌবাহিনীর প্রধান অস্ত্র ছিল মারাঠাদের বাঁকা তরোয়াল আর ঢাল। শত্রুপক্ষের জাহাজে চড়াও হবার পর মুখোমুখি লড়াইয়ে তরোয়াল ছিল মোক্ষম অস্ত্র। অসিযুদ্ধে মারাঠারা অত্যন্ত দক্ষ ছিল। সংখ্যায় প্রবল প্রতিপক্ষকেও হাতাহাতি লড়াইয়ে নাজেহাল করার ক্ষমতা রাখত তারা। এ ছাড়া আর যা অস্ত্র রণতরীতে মজুত থাকত তা হল তির-ধনু, বল্লম আর পাথর। প্রচুর পাথর জমা থাকত মারাঠা রণতরীতে। কাছাকাছি শত্রুর জাহাজ লক্ষ করে বৃষ্টিধারার মতো প্রস্তর বর্ষণ করা হত।
রণতরীর কামান থেকে গোলা নিক্ষেপ করা হত সরাসরি লক্ষ্যবস্তু লক্ষ্য করে। গোলন্দাজি বিদ্যার তখন মাত্র শৈশব। তিন-শো গজের বাইরের নিশানা তখন প্রায় অসাধ্য ছিল। ধনুকের তির এবং বল্লম কিন্তু এক-শো গজ দূর পর্যন্ত ছুড়তে পারত সবাই। দক্ষ গোলন্দাজের দারুণ চাহিদা ছিল সে সময়। ফলে মারাঠা নৌবাহিনীতে নিযুক্ত গোলন্দাজদের যথেষ্ট খাতির ছিল, অবশ্য তাদের সংখ্যাও ছিল অল্প। ইউরোপীয় গোলন্দাজদের প্রচুর সমাদর ছিল। যেকোনো সাদা চামড়ার লোক ভালো কামান দাগতে জানার ভান করে দেশীয় রাজাদের অধীনে সহজেই মোটা মাইনের চাকরি পেয়ে যেত।
মারাঠা নৌবাহিনীর উর্দি বলে কিছু ছিল না। তাদের সঙ্গে আরও একটি জিনিস থাকত, সেটি হল দশ ফুট লম্বা একটি তামার ভেঁপু, কর্ণপটাহ বিদারক শব্দ হত ভেঁপু থেকে।
মারাঠারা উপকূল ঘেঁষে তাদের নৌবহর পরিচালনা করা পছন্দ করত। শত্রুর জাহাজ আর উপকূল— এ দুয়ের মাঝামাঝি থাকার ফলে নিজেদের উপকূলরক্ষী বাহিনীর কামানের সাহায্যে তাদের মস্ত সহায় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। সমুদ্রে যখন ঝড় উঠত কিংবা সমুদ্র অশান্ত থাকত তখন তারা উন্মুক্ত সমুদ্র পরিহার করে চলাই শ্রেয় মনে করত। শান্ত সমুদ্র তাদের পক্ষে ছিল আদর্শ, কারণ তাদের দাঁড় টানা নৌকাগুলি সহজেই শত্রুপক্ষের জাহাজের নাগাল ধরে ফেলত।
বর্ষার চার মাস ঘুণ-ধরা বা পোকায় খাওয়ার হাত থেকে নৌবহরকে রক্ষার জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া হত। গালিভাত এবং অন্যান্য ক্ষুদ্রাকৃতি তরীকে ডাঙায় টেনে হিঁচড়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হত গুহার নিরাপদ আশ্রয়ে, তারপর ঢেকে রাখা হত তালপাতার আচ্ছাদনে। তা ছাড়া নৌকার বিভিন্ন অংশ খুলে নারকেলের আঠা বা কষ ঘষা হত। আগস্টের শেষে খোলা অংশগুলি জুড়ে, পুরো নৌবহরকে পরিষ্কার করার পর আবার সমুদ্রে ভাসানো হত। ওই চার মাস নৌবাহিনীর বেশিরভাগ লোককেই ছুটি দেওয়া হত।
আড়াইশো বছর আগে মারাঠা নৌযুদ্ধের কথা কল্পনা করা যাক। একটি ঘুরাবকে দড়ি দিয়ে বেঁধে অবিশ্বাস্য ক্ষিপ্রতায় শত্রুপক্ষের জাহাজের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে কয়েকটি গালিভাত। ঘুরাবকে এমন জায়গায় এনে দাঁড় করানো হল যেখানে থেকে ওটার কামানগুলি সরাসরি বিপক্ষ জাহাজের পাল মাস্তুল লক্ষ্য করে গোলাবর্ষণ করতে পারে। তারপর গালিভাত। দু-পাশে কুড়িটা করে মোট চল্লিশটা দাঁড় সমান তালে, জল কেটে এগুচ্ছে। বাতাসে উড়ছে তাদের নীল আর সবুজ রঙের পতাকা। সব কটি ভেঁপু একসঙ্গে করছে উচ্চনাদ, ঢোলের শব্দে মৃত্যুর সঙ্কেত, আর মুক্ত তরবারি হাতে মারাঠা নৌ-সেনারা চিৎকার করছে ‘হর হর মহাদেও’। দাঁড়ের প্রতিটি টানে তারা লক্ষ্যবস্তুর নিকটতর হচ্ছে…
আমরা ঘটনা থেকে এগিয়ে যাচ্ছি। সুসংবদ্ধ মারাঠা নৌবহরের ইতিহাস অনেক পরের কাহিনি। কানোজির ভাগে যে আট-দশটি রণতরী জুটেছিল তা গালিভাত এবং তার থেকে নিকৃষ্ট জলযান ছাড়া আর কিছু নয়। হয়তো দু-একটি ঘুরাব থাকলেও থাকতে পারে, তবে যাই হোক, সিদ্দির তুলনায় কিছু নয়, কারণ সিদ্দির সেই সময় অনেক বেশি রণতরী ছিল।
তরুণ কানোজি যখন তাঁর নতুন পদ গ্রহণ করলেন, তখন রাজকীয় আদেশে তাঁর অধীনে এল দেড়শো মাইল উন্মক্ত সমুদ্র। কয়েকটি পুরোনো ক্ষতবিক্ষত রণতরী, মুষ্টিমেয় উপকূল দুর্গ এবং কয়েক-শো দুর্গরক্ষী— এই তাঁর প্রধান ভরসা। নিয়মিত মাইনে দিতে যদি না-ও পারেন তবু প্রায় তিন হাজার মুখের অন্ন জোগাতে হবে তাঁকে। রাজার আদেশে ওই খরচার টাকা আসবে মূল ভূখণ্ডের মধ্যবর্তী অঞ্চল থেকে। মজার কথা, ওইসব অঞ্চল তখন হয় মুঘলদের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে, নয় মুঘল বাহিনী সেখানে বিস্তার করেছিল তাদের আধিপত্য। তা ছাড়া মারাঠা নৌবাহিনীর লোকজনের নৈতিক মানোবলও সে সময় খুব নীচের দিকে।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দখলে বোম্বাই ক্রমেই বর্ধিষ্ণু এবং উন্নত শহরে পরিণত হতে চলেছে। সে সময় মালাবার জলদস্যুদের উপদ্রব বাণিজ্য জাহাজগুলির কাছে এক ঘোর সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তবে মালাবার জলদস্যু বলতে মালাবারের অধিবাসী মনে করলে ভুল হবে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অনেকেই তখন বোম্বেটেগিরি করে ব্যক্তিগত সম্পদ বৃদ্ধির চেষ্টায় ছিল। ঔরঙ্গজেবও বিশ্বাস করতেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বোম্বেটেদের মদত জোগাচ্ছে। উল্লেখযোগ্য, কুখ্যাত জলদস্যু উইলিয়াম কিড রাজাপুরের কাছে কোম্পানির কয়েকটি বাণিজ্য জাহাজের উপর দুঃসাহসিক আক্রমণ চালিয়ে প্রচুর ধনরত্ন লুণ্ঠন করেছিল।
১৬৯৫ সালে মালাবার জলদস্যুদের একচ্ছত্র সম্রাট হেনরি এভরি (Every) ঔরঙ্গজেবের বৃহত্তম জাহাজ লুঠ করে অবস্থা জটিল করে তুলল। ওই জাহাজে ঔরঙ্গজেবের দরবারের অনেক মহিলাও ছিলেন। তাঁরা মক্কায় তীর্থ সেরে ফিরছিলেন। এ ছাড়া জাহাজে পঞ্চাশ হাজার টাকা মূল্যের সোনা-রুপো ছিল। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ওই দুষ্কর্মের জন্য দায়ী নয় বলে ঘোষণা করলেও ঔরঙ্গজেব সে কথায় কান দিলেন না। তিনি সুরাটে কোম্পানির যে সব কর্মচারি ছিল তাদের বন্দি করলেন। বোম্বাইয়ের গভর্নর স্যার জন গেয়ার প্রতিবাদের জন্য সুরাটে গেলেন। ঔরঙ্গজেবের আদেশে তাঁকেও কারাগারে নিক্ষেপ করা হল। যাই হোক সম্রাটের বিশ্বাসভাজন অনুচরদের প্রচুর উৎকোচ দেবার ফলে শেষপর্যন্ত বিষয়টি ধামাচাপা পড়ল।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে মারাঠাদের প্রথম সংঘর্ষ ১৬৯৮ সালের শেষভাগে। বোম্বাই থেকে আগত কোম্পানির লবণ ভরতি দুটি জাহাজ পদম দুর্গের অধ্যক্ষ আটক করে বসল। দুর্গাধ্যক্ষ বণিকদের শুধু বন্দি করেই ক্ষান্ত হল না, বেদম প্রহার দিল তাদের। কয়েক দিন পর কুড়ি হাজার টাকা মুক্তিপণ দেবার শর্তে দুজন ছাড়া বাকি সবাইকে ছেড়ে দেওয়া হল। দুর্গের কিছু রক্ষীর পাহারায় বোম্বাই নিয়ে যাওয়া হল তাদের। বন্দি দুজন জামিনস্বরূপ দুর্গাধ্যক্ষের হাতে রইল। ইংরেজরা কিন্তু চটপট ওই রক্ষীদের বন্দি করে দাবি করল পদম দুর্গে যে দুজনকে আটক রাখা হয়েছে তাদের মুক্তি দিতে হবে।
ওই সময় জামিনদারদের বিষয়ে কেউ তেমন মাথা ঘামাত না। বোম্বাইয়ের গভর্নর স্যার জন গেয়ারকে ঔরঙ্গজেব বন্দি করেছিলেন, তাঁকে পর্যন্ত সাত বছর কারাবাস করতে হয়েছিল।
পদম দুর্গের অধ্যক্ষ এ ব্যাপারে আর মাথা ঘামাল না, কিন্তু ইংরেজরা দারুণ একটা চাল চালল। তারা ঘোষণা করল, ওই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটবে না এমন প্রতিশ্রুতি না পাওয়া পর্যন্ত বোম্বাই থেকে কোনো জাহাজ লবণ নিয়ে কোঙ্কণ উপকূলের কোথাও যাবে না।
পশ্চিম উপকূলে বোম্বাইকে কেন্দ্র করেই লবণ তৈরির সব কারখানা। সমগ্র দাক্ষিণাত্য তখন ওই লবণের উপর নির্ভরশীল। ইংরেজরা এই সুবিধের পূর্ণ সুযোগ গ্রহণ করল।
ফল ফলতে দেরি হল না। কানোজি আংরের নির্দেশে তাঁর সুবেদার বোম্বাইয়ের ডেপুটি গভর্নরকে লিখিত আশ্বাস দিল যে, পদম দুর্গে বন্দি দুজনকে মুক্তি দেওয়া হবে এবং ভবিষ্যতে কোম্পানির লোকজনের উপর হামলা করা হবে না। কোম্পানিও লবণবাহী জাহাজগুলিকে আবার পশ্চিম উপকূলে চলাচলের অনুমতি দিল।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দলিলপত্রে এই প্রথম কানোজি আংরের উল্লেখ পাওয়া যায়।
এগারো
জিঞ্জির পথে রাজারাম কয়েক বারই মুঘলদের হাতে ধরা পড়তে পড়তে বেঁচে গেলেন। ঔরঙ্গজেব যেন তাঁর সবকিছু পরিকল্পনা আগে থেকে জেনে ফেলেছিলেন। দাক্ষিণাত্যে মুঘলদের সমস্ত সুবেদার এবং বিভিন্ন স্থানে মোতায়েন সেনাবাহিনীকে সতর্ক করে দেওয়া হয়েছিল, পলায়মান মারাঠা রাজার সম্বন্ধে তারা যেন সজাগ থাকে। তাঁকে বন্দি করতে পারলে প্রচুর পুরস্কার দেওয়া হবে— এ কথাও ঘোষণা করেছিলেন ঔরঙ্গজেব।
তুঙ্গভদ্রা নদীর একটি ছোট্ট দ্বীপে রাজারাম আর তাঁর দলবল এক টহলদারি মুঘল সেনাদলের মুখোমুখি হলেন। রাজারাম কোনো মতে পালিয়ে বাঁচলেন, তাঁর দলের অর্ধেক লোক এবং সমস্ত ঘোড়া হারাতে হল তাঁকে। সেখান থেকে সাধুর ছদ্মবেশে পদব্রজে তাঁরা যাত্রা করলেন। বাঙ্গালোরে খুব অল্পের জন্য আবার তিনি বেঁচে গেলেন। এক মন্দিরের চত্বরে যখন তাঁদের রান্না হচ্ছিল, তখন কেউ একজন লক্ষ করল এক সাধু কাউকে দিয়ে রাজারামের পা ধোয়াচ্ছে। এই ঘটনা কানে কানে রটে গেল। সৌভাগ্যক্রমে রাজারামের একজন অনুচরের কানে গেল কথাটা। সঙ্গে সঙ্গে রাজারামের রক্ষীরা তাঁকে নিয়ে সরে পড়ল, বাকি যারা ছিল তারা যেন কিছু হয়নি এমন ভান করে রান্না করতে লাগল। কিছুক্ষণের মধ্যেই মুঘল সেনারা ওখানে এসে তাদের ঘিরে ফেলল। বন্দি করে প্রচণ্ড প্রহার দেওয়া হল তাদের। কিন্তু তারা দৃঢ়কণ্ঠে বলল তারা ধর্মসম্প্রদায়ের লোক, ভিক্ষা করে জীবিকা নির্বাহ করে। রাজারামের সম্বন্ধে তারা কিছুই জানে না। কয়েক দিন কারাবাসের পর তারা মুক্তি পেল।
তিন-শো ঘোড়সওয়ার নিয়ে রাজারাম জিঞ্জি যাত্রা করেছিলেন, কিন্তু তিনি যখন জিঞ্জি পৌঁছুলেন তখন তাঁর সঙ্গী মাত্র পাঁচজন ব্রাহ্মণ অনুচর। তাঁদের পোশাক ছিন্নভিন্ন, ক্লান্তির শেষ পর্যায়ে তাঁরা পৌঁচেছেন। এক মাসের কিছু বেশি সময়ে পদব্রজে তাঁরা প্রায় হাজার মাইল পথ অতিক্রম করেছেন।
জিঞ্জি দুর্গের অধ্যক্ষ অনায়াসে ওই দলকে ফিরিয়ে দিতে পারতেন, রাজারাম আর তাঁর অনুচরদের দুর্গে স্থান না দিয়ে মুঘলদের রোষবহ্নির হাত থেকে নিষ্কৃতি পেতে পারতেন, কিন্তু আনুগত্যের চরম পরাকাষ্ঠা দেখালেন তিনি। শিবাজির প্রভাব তখনও জাদুমন্ত্রের মতো উজ্জীবিত করত দেশের মানুষকে। দুর্গাধ্যক্ষ ক্ষুদ্র ওই দলকে শুধু অভ্যর্থনাই জানালেন না, দুর্গের সঞ্চিত বিপুল সম্পদ তুলে দিলেন রাজারামের হাতে। রাজারাম ওই ধনরত্নের যথেচ্ছ ব্যবহারে কার্পণ্য করলেন না।
ঔরঙ্গজেব তাঁর বিশ্বস্ত সেনাপতি জুলফিকারকে আদেশ করলেন জিঞ্জি দখল করার জন্য। জুলফিকার রায়গড় দুর্গ অধিকার করে ঔরঙ্গজেবের প্রিয়পাত্র হয়েছিলেন। তখন তাঁর নাম ছিল ইত্তিকাদ খাঁ। ঔরঙ্গজেব তাঁকে জুলফিকার উপাধিতে ভূষিত করেছেন।
জুলফিকার জিঞ্জির দুর্গের গোড়ায় এসে শিবির গেড়ে বসলেন, কিন্তু দুর্গ আক্রমণের কোনো চেষ্টাই করলেন না। আট বছর কেটে গেল। আসলে জুলফিকারের জিঞ্জি দখল করার তেমন কোনো অভিপ্রায় ছিল না। তাঁর মতলব ছিল অন্য। ঔরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর তিনি দাক্ষিণাত্যে নিজেকে স্বাধীন সুলতান বলে ঘোষণা করবেন— এই ছিল তাঁর পরিকল্পনা। এ ব্যাপারে রাজারামের সাহায্য তিনি কামনা করেছিলেন। কিন্তু আশি বছর বয়সেও ঔরঙ্গজেব সক্ষম, সবল মানুষের মতো বেঁচে রইলেন। জুলফিকারের নিষ্ক্রিয়তায় ধৈর্যচ্যুতি ঘটল তাঁর। তিনি খবর পাঠালেন দুর্গ দখলের জন্য আক্রমণ না করলে জুলফিকারকে তিনি নেতৃত্ব থেকে সরিয়ে দেবেন।
১৬৯৮ সালে জুলফিকার জিঞ্জি দুর্গ আক্রমণ করে দখল করলেন। তার আগে কিন্তু রাজারামকে আশু আক্রমণের খবর জানয়ে তিনি তাঁকে পলায়নের সুযোগ দিয়েছিলেন। দুর্গ দখলের পরেও রাজারামের দুই পত্নীকে তিনি দুর্গ থেকে চলে যাবার অনুমতি দিয়েছিলেন। তারপর ঔরঙ্গজেবের মনে বিশ্বাস সৃষ্টির জন্য দুর্গের নেতৃস্থানীয় সকলকে নির্বিচারে হত্যা এবং দুর্গ লুণ্ঠন করা হল।
আনুগত্যের চরম মূল্য দিলেন জিঞ্জির দুর্গাধ্যক্ষ।
ঔরঙ্গজেব এবার ঠিক করলেন তিনি নিজেই মারাঠা দুর্গগুলি জয় করবেন। আক্রমণ শুরু করার আগে তিনি বাছা বাছা মারাঠা সর্দারের কাছে পত্র পাঠালেন
হতভাগ্য রাজারামের অধীন দুর্গগুলি দখল করে তাকে বিতাড়িত করার জন্য আমার সৈন্যবাহিনী অগ্রসর হচ্ছে… ওই হীন ব্যক্তির দখলে যত জায়গা আর দুর্গ আছে তা সবই আমার সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করা হবে। অপদার্থ রাজারামের ভাই (শাম্ভাজি) জাহান্নামে পচছে, রাজারামকেও বন্দি করে হত্যা করা হবে।
তোমরা যদি সুবুদ্ধি প্রণোদিত হয়ে আমার অনুচরদের হাতে দুর্গ তুলে দাও তবে তোমাদের অনেক ইনাম মিলবে, উপযুক্ত মর্যাদাও দেওয়া হবে… অন্যথায় তোমাদের বন্দি করে সপরিবারে নিধন করা হবে… তোমাদের পরিবারের শিশু, নারী, বৃদ্ধ কেউ পরিত্রাণ পাবে না।
ঔরঙ্গজেব ভেবেছিলেন হুমকি দিয়েই তিনি মারাঠাদের বশ্যতা স্বীকার করাবেন। কিন্তু তাঁর সে আশায় বাদ সাধলেন বীর মারাঠা সর্দাররা। তাঁরা তাঁদের রাজার প্রতি আনুগত্যের সিদ্ধান্তে অটল রইলেন।
এদিকে রাজারামের অনুপস্থিতিতে দাক্ষিণাত্যে আশ্চর্য এক পরিবর্তন সূচিত হয়েছিল। ঝটিকা আক্রমণে পোক্ত হয়ে উঠেছিল মারাঠারা। বিভিন্ন মারাঠা সর্দারের অধীনে স্বাধীনভাবে গড়ে উঠেছিল শক্তিশালী ঝটিকা বাহিনী। অগ্রগামী মুঘল সেনাদের শিবিরে অতর্কিতে হানা দিয়ে তাদের ব্যতিব্যস্ত করে তুলছিল তারা। এদের মধ্যে দুজন সর্দারের নাম তখন খুব শোনা যাচ্ছিল; তাঁদের দুঃসাহস আর রণকৌশল মুখে মুখে ফিরছিল দাক্ষিণাত্যে। তাঁরা হলেন সান্তাজি ঘোড়পাড়ে আর ধানাজি যাদব।
জিঞ্জি থেকে বিতাড়িত হয়ে রাজারাম আবার দাক্ষিণাত্যে নিজের রাজ্যে ফিরে এলেন। তিনি যখন রাজ্য ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন তখন মারাঠা বাহিনীর চরম দুর্দশা, কিন্তু ফিরে এসে তিনি নিজেকে শক্তিশালী এক সেনাবাহিনীর প্রভুরূপে দেখতে পেলেন। সেই বাহিনী সরাসরি মুঘলদের আক্রমণ প্রতিহত করার ক্ষমতা রাখে। মুঘলদের বিরুদ্ধে অভিযানে রাজারাম এবার স্বয়ং উদ্যোগী হলেন। এতকাল তিনি রাজপ্রতিনিধি হিসেবে স্বীকৃত ছিলেন, এবার তিনি নিজেকে ছত্রপতি বলে ঘোষণা করলেন।
বারো
রাজারামের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের কয়েক মাস আগে তাঁর নৌসেনাপতি সিদ্দিজি গুজ্জার প্রাণত্যাগ করেছিলেন। কানোজি আংরেই যে তাঁর স্থলাভিষিক্ত হবেন— এ বিষয়ে কারু মনে বিন্দুমাত্র সন্দেহ ছিল না।
আগেই বলা হয়েছে, কোঙ্কণের উত্তর উপকূল কানোজির ভাগে পড়েছিল। এই ন-বছরে তিনি শক্তিশালী এক নৌবহর গড়ে তুলেছেন, বিচক্ষণ সেনাপতির মতো প্রবল প্রতিপক্ষের সঙ্গে সংঘর্ষ সযত্নে পরিহার করে চলেছেন। এতকাল মারাঠা নৌবাহিনীতে রণকৌশলের বড়োই অভাব ছিল। অশ্বারোহী সৈন্যের মতো তারা শত্রুপক্ষের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ার চেষ্টা করার ফলে তাদের নৌবহর শত্রুর সহজ লক্ষ্যবস্তু হয়ে দাঁড়াত। কানোজি উপলব্ধি করলেন শুধু সাহস আর বীরত্ব দিয়ে যুদ্ধ জয় করা যায় না, বুদ্ধিমানের মতো অনর্থক ঝুঁকি পরিহার করাও সমরনীতির একটি প্রধান অঙ্গ।
নিজের ক্ষমতা সম্বন্ধে পূর্ণ সচেতন কানোজি ইংরেজদের সঙ্গে সংঘর্ষ এড়িয়ে চলছিলেন। তাঁর নৌবহর যখন তাদের মোকাবিলা করার মতো শক্তিশালী হয়ে উঠবে তখন তিনি তাদের সঙ্গে বোঝাপড়া করবেন।
সিদ্দিদের সঙ্গেও মুখোমুখি সংঘর্ষ তিনি এড়িয়ে চলছিলেন। একক নৌশক্তি হিসেবে সিদ্দিদের তখনও প্রবল প্রতাপ। তাদের সঙ্গে কানোজি একটি অলিখিত চুক্তিতে নিরপেক্ষ নীতি অবলম্বন করেছিলেন। উত্তর কোঙ্কণের সুরাট এবং জাঞ্জিরার মধ্যে সিদ্দির নৌবহরের ছিল গতিবিধি। কানোজি আরও দক্ষিণে তাঁর কর্তৃত্ব নিয়ে সন্তুষ্ট ছিলেন। এদিকে কিন্তু দক্ষিণ কোঙ্কণের উপকূল রক্ষার দায়িত্ব পড়েছিল ভগবানজি মোহিতের উপর। কানোজির সৌভাগ্য, ভগবানজি মোহিতে এ বিষয়ে উচ্চবাচ্য করেননি। তিনি তাঁর দুর্ভেদ্য সিন্ধু দুর্গে আয়েশ করে দিন কাটাচ্ছিলেন। তাঁর হয়ে কেউ যদি উপকূল পাহারা দেয় সেজন্য প্রতিবাদ করা প্রয়োজন মনে করেননি তিনি।
দক্ষিণ কোঙ্কণের শান্ত পরিবেশ কানোজির নৌবহরের প্রশিক্ষণের পক্ষে আদর্শ হয়ে উঠেছিল। সিদ্দি আর ইংরেজরা উত্তর কোঙ্কণে তাদের কার্যকলাপ চালাচ্ছিল, পোর্তুগিজরা চাওল আর গোয়ায় সীমাবদ্ধ রেখেছিল তাদের গতিবিধি। দক্ষিণ কোঙ্কণের উন্মুক্ত সমুদ্রে নৌপ্রশিক্ষণের মস্ত সুযোগ, কানোজি তা পুরোমাত্রায় গ্রহণ করেছিলেন।
সতর্কভাবে তিনি এগুচ্ছিলেন। যেসব জাহাজ মারাঠা অনুমতিপত্র না নিয়ে কোঙ্কণ উপকূল দিয়ে চলাচল করত তাদের তিনি বন্দি করে মুক্তিপণ আদায় করছিলেন। তখনকার দিনে মিত্রপক্ষের জাহাজ ছাড়া অন্য যেকোনো জাহাজ দখল করা বৈধ বলে স্বীকৃত হত। আত্মরক্ষায় অসমর্থ বাণিজ্য তরীগুলিই এ ধরনের আক্রমণের শিকার হত বেশি।
কানোজি স্থলেও শক্তি বৃদ্ধি করে চলেছিলেন। কোঙ্কণের কয়েকটি দুর্গ তিনি নিজের কর্তৃত্বে এনেছিলেন। এমনকী ভগবানজি মোহিতের অধীনস্থ কয়েকটি দুর্গেও তিনি নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
১৬৯৫ সালে, ছাব্বিশ বছর বয়সে, কানোজি নিজের শক্তি সম্বন্ধে এতই সচেতন ছিলেন যে, ওই সময় তিনি তাঁর স্ত্রী মথুরাকে নিয়ে তীর্থভ্রমণের উদ্দেশ্যে নাসিক গিয়েছিলেন। কয়েক মাস পরে তিনি সাগরগড় আক্রমণ করলেন। শাম্ভাজির মৃত্যুর আগের বছর মুঘলরা ওটা দখল করেছিল।
সাগরগড় দখল করতে তাঁর বেশি বেগ পেতে হয়নি। ওই বছরই তিনি সুবর্ণ দুর্গ থেকে কোলাবার তাঁর সদরদপ্তর স্থানান্তরিত করলেন। এর ফলে পশ্চিম উপকূলে দুটি প্রধান শক্তি, জাঞ্জিরার সিদ্দি এবং ইংরেজদের মাঝখানে তিনি শক্ত ঘাঁটি গেড়ে বসলেন। সিদ্দি এই ব্যাপারটা সুনজরে দেখল না। তার নৌবহর কানোজির নৌবহরকে ধ্বংস করার জন্য উদ্যোগী হল, কিন্তু সামান্য সংঘর্ষ ছাড়া আর কিছুই ঘটল না। ওই বছর পোর্তুগিজদের সঙ্গেও তাঁর ছোটোখাটো যুদ্ধ হয়ে গেল।
মারাঠা নৌবাহিনী ক্রমে ক্রমে ‘আংরিয়ার নৌবাহিনী’ নামে পরিচিত হচ্ছে। তাঁর অনুচররা তাঁর নামে খাজনা আদায় করছিল। কোঙ্কণে মারাঠা নৃপতির তেমন বিশেষ পরিচয় ছিল না, কানোজি আংরেই ছিলেন ওখানকার পরিচিত মানুষ। শক্তিশালী নৌবহর গড়ে তোলা, কোঙ্কণের বৃহৎ অংশ পুনরুদ্ধার— এ সবই সম্ভব হয়েছে তাঁর একক প্রচেষ্টায়। কোনো বাইরের সাহায্য তিনি পাননি, রাজারামের কাছ থেকে কিংবা মারাঠা সর্দারদের কাছ থেকেও কোনোরকম সাহায্য নয়।
কোঙ্কণের সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে গণ্যমান্য সবাই কানোজি আংরেকেই তাদের প্রভু বলে স্বীকার করে নিয়েছিল।
কানোজি আংরে নিজে কিন্তু মারাঠা নৃপতিকে তাঁর প্রভু বলে স্বীকার করতেন। তিনি তখন রাজারামের প্রত্যাবর্তনের অপেক্ষায় দিন গুনছেন। রাজার নির্বাসনকালে কোঙ্কণের বিস্তৃত যে অংশ তিনি পুনরুদ্ধার করেছেন তা অনুগত সেনাপতির মতো রাজার হাতে তুলে দেবেন— এই তাঁর বাসনা। হয়তো আরও একটি কামনা তাঁর ছিল। সেটি ছিল রাজারাম তাঁকে প্রধান নৌসেনাপতি সারখেলের পদে নিযুক্ত করার কথা ঘোষণা করবেন।
শিবাজির বংশধরের প্রতি এই আনুগত্য কানোজির চারিত্রিক গুণেরই পরিচয় দেয়। তিনি ইচ্ছে করলেই কোঙ্কণের স্বাধীন অধিপতিরূপে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারতেন। কোঙ্কণে তাঁর তখন যথেষ্ট প্রভাব ও প্রতিপত্তি, তাঁর নৌশক্তি শৈশব কাটিয়ে তারুণ্যের রক্তে টগবগ করছে, কিন্তু ও চিন্তা তিনি কখনো প্রশ্রয় দেননি। রাজার প্রতিভূরূপেই তিনি কোঙ্কণ শাসন করছেন, তাঁর নৌবাহিনী রাজার সম্পত্তি— এই ছিল তাঁর মনোভাব।
মারাঠা বীরদের এই অন্ধ আনুগত্যই বিধ্বস্ত মারাঠা সাম্রাজ্যকে আবার শক্ত ভিতের উপর দাঁড় করিয়েছিল। পরবর্তী এক-শো বছর মারাঠাদের ইতিহাস জয়ের ইতিহাস, দিল্লি পর্যন্ত ধেয়ে গিয়েছিল বিজয়ী মারাঠা বাহিনী।
তেরো
কানোজির সদরদপ্তর স্থানান্তরে সিদ্দির সঙ্গে তাঁর দীর্ঘ ঠাণ্ডা লড়াই আর ঠাণ্ডা রইল না, ইংরেজরাও সুনজরে দেখল না ব্যাপারটা।
বর্ষা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে সিদ্দি কোলাবার উপকূল অঞ্চল আক্রমণের উদ্দেশ্যে অভিযান করল। এ ব্যাপারে ইংরেজদেরও নিশ্চয়ই প্ররোচনা ছিল। কিন্তু কানোজি সিদ্দির ফাঁদে পা দিলেন না। তিনি জানতেন উন্মুক্ত সমুদ্রে সিদ্দির নৌবাহিনী তখনও দুর্ধর্ষ, সেই নৌবহরের বিরুদ্ধে সম্মুখ সমরে অবতীর্ণ হলে তাঁর অযথা শক্তি ক্ষয় হবে— পরাজয়ও অসম্ভব নয়। ছয় মাস সিদ্দি অপেক্ষা করল, তারপর উপকূল ঘেঁষা অঞ্চল লুটপাটের পর ফিরে গেল নিজের রাজ্যে। শোনা যায় কোলাবার উপকূলে আট হাজার নারকেল গাছ কেটে নষ্ট করেছিল সিদ্দি। সিদ্দির প্রস্থানের সঙ্গে সঙ্গে প্রতিশোধ নিলেন কানোজি। সিদ্দির রাজ্যের অন্তর্গত ‘থালের’ গভীরে আক্রমণ চালিয়ে নির্বিচারে লুণ্ঠন করলেন।
সিদ্দির সঙ্গে খোলাখুলি লড়াইয়ে নামার আগে কানোজি উপকূলের অন্যান্য শক্তিদের সঙ্গে একটা সমঝোতা করতে চাইলেন। ইংরেজরা যে সিদ্দিকে মদত দিচ্ছিল এ কথা তখন কারু অজানা নয়। তাদের বন্দরে সিদ্দির জাহাজের রসদ ও জল নেবার অনুমতি ছিল। বর্ষাকালে সিদ্দির নৌবহর ইংরেজদের বন্দরে অনেক সময় আশ্রয় গ্রহণ করত। কানোজি তবু ইংরেজদের সঙ্গে শান্তি বজায় রাখার পক্ষপাতী ছিলেন, একইসঙ্গে একাধিক শত্রু কখনো চাইতেন না তিনি।
পোর্তুগিজরাও শত্রুতাপূর্ণ অচরণ করছিল। কোঙ্কণের উপকূলে মারাঠাদের আধিপত্য তারা স্বীকার করতে অপারগ হবে— এ কথা বলা বাহুল্য।
* * *
এদিকে বৃদ্ধ সম্রাট ঔরঙ্গজেব তাঁর বিশাল বাহিনী নিয়ে শেষবারের মতো একটা হেস্তনেস্ত করতে বদ্ধপরিকর হলেন। মারাঠাদের ধ্বংস করার জন্য তিনি মুঘল বাহিনীকে দু-ভাগে ভাগ করলেন। এক ভাগের সেনাপতি নিযুক্ত হলেন জুলফিকার। তার প্রতি আদেশ হল রাজারামের স্থলবাহিনী ধ্বংস করা। সম্রাট স্বয়ং ভার নিলেন দুর্গগুলি দখলের। তাঁর বয়স তখন তিরাশি।
বড়ো বড়ো শহরে গত বারো বছর ধরে মুঘল শিবির পাকাপাকি গেড়ে বসেছিল। এবার শিবির ভাঙার পালা। মুঘল সেনাপতিরা বিলাসী ও আয়েশি হয়ে উঠেছিল, ইট পাথরের বড়ো বড়ো দালান কোঠা বানিয়ে ফুর্তিতে দিন কাটাচ্ছিল। সম্রাটের আদেশে অনিচ্ছা সত্ত্বেও আবার যাত্রা শুরু করতে হল তাদের।
ঔরঙ্গজেবের প্রথম লক্ষ্য সাঁতারা। রাজারাম জিঞ্জি থেকে ফেরার পর ওখানে দিন কয়েক কাটিয়েছিলেন বলেই বোধ হয় সাঁতারার ওপর তাঁর এই আক্রোশ। দুর্গাধ্যক্ষের কাছে আত্মসমর্পণের জন্য ভীতিপ্রদ পত্র আগেই পাঠানো হয়েছিল। গুপ্তচররা ভেতরে ভেতরে কাজ করে চলেছে। নতুন চকচকে কামান আর পিপে ভরতি বিস্ফোরক এনেছেন ঔরঙ্গজেব এই অভিযানে। পোর্তুগিজরা দিয়েছে বিস্ফোরক।
দুর্গপ্রাচীর ঘিরে চার মাস দিবারাত্র খনন কার্য চলছে। তারপর একদিন সেই পরিখায় স্থাপন করা হল বিস্ফোরক। আগুন লাগাবার আগে মুঘলবাহিনী জাঁকজমকপূর্ণ শোভাযাত্রার মতো সার বেঁধে দাঁড়াল। দুর্গরক্ষীরা উঁচু প্রাচীরের মাথায় জড়ো হয়ে দেখছে ব্যাপারটা কী ঘটতে চলেছে। প্রথম বিস্ফোরণে দুর্গ প্রাচীরের যথেষ্ট ক্ষতি হল, দুর্গরক্ষীরা বেশ কিছু হতাহত হল। দ্বিতীয় বিস্ফোরণটা ঘটল বাইরের দিকে, অর্থাৎ মুঘল সেনারা যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল সেখানে। প্রায় দু-হাজার মুঘল সৈন্য এই দুর্ঘটনায় প্রাণ হারাল।
মুঘলদের শিবিরে নামল বিষাদের ছায়া। কিন্তু এই বিষাদ অচিরেই রূপান্তরিত হল আনন্দ উৎসবে। খবর এল সিংহগড়ে রাজারাম মৃত্যুপথের যাত্রী। মার্চ মাসের মাঝামাঝি তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। সেটা হল ১৭০০ সাল।
রাজারামের মৃত্যু মুঘলদের শিবিরে উৎসবের বন্যা বইয়ে দিলেও ঔরঙ্গজেব নিজে হয়তো ভাবেননি যে, এবার মারাঠা শক্তি ভেঙে পড়বে। তাঁর চাইতে বয়সে ছোটো তিন তিনজন মারাঠা নৃপতিকে তিনি মৃত্যুমুখে পতিত হতে দেখলেন (শিবাজি, শাম্ভাজি ও রাজারাম)। তিনি তাঁদের বহু দুর্গ দখল করেছেন, হাজার হাজার মারাঠা সেনাকে হত্যা করেছেন, গ্রামের পর গ্রাম, জনপদ মাটিতে লুটিয়ে দিয়েছেন, মাইলের পর মাইল চাষের জমি নষ্ট করেছেন, ফসল পুড়িয়ে দিয়েছেন, কিন্তু এত করেও তাঁর অভীষ্ট সিদ্ধ হয়নি। দেয়ালের লিখন এতদিনেও কি তাঁর কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠেনি? মারাঠা শক্তিকে ধ্বংস করা তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়।
বর্ষার আগে সাঁতারায় প্রচণ্ড গরম। ঔরঙ্গজেব তাঁর অনাড়ম্বর শ্বেতরঙা তাঁবুর ভিতর তপ্ত শয্যায় বিনিদ্র রজনী যাপন করতে করতে নিশ্চয়ই হিসাবনিকেশ করতে চেয়েছিলেন নিজের সঙ্গে। তাঁর তিন বেগম দাক্ষিণাত্যে চোখ বুজেছে, তিনি নিজেও কি এই কাফেরদের দেশে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করবেন! দাক্ষিণাত্যে সুদীর্ঘ আঠারো বছর ধরে তিনি অবিরাম সংগ্রাম করেছেন, একবারও রাজধানীতে ফিরে যাবার ফুরসত পাননি। এই আঠারো বছরে তিনি প্রায় পাঁচ লক্ষ সৈন্য হারিয়েছেন, কিন্তু এত ক্ষতি স্বীকার করে কী ফল তিনি পেলেন! দাক্ষিণাত্যের যে বিশাল অঞ্চল তিনি অধিকার করেছিলেন, তার অনেকটাই মারাঠারা আবার ছিনিয়ে নিয়েছে।
কোঙ্কণের অবস্থাও ভালো নয়। সিদ্দির ক্ষুদ্র রাজ্য ছাড়া কোঙ্কণের আর কোনো অঞ্চল তাঁর বশ্যতা স্বীকার করেনি। দিকচক্রবালে যে নতুন এক তারকার উদয় হয়েছে, জলে-স্থলে যে সমান কুশলী সেনাপতি, দুঃসাহসী আর দুর্ধর্ষ, সেই কানোজি আংরের নাম ঔরঙ্গজেবের কানেও নিশ্চয়ই পৌঁচেছিল। ‘পর্বত মুষিক’ শিবাজির মতো সেই মানুষটিও ক্ষিপ্র, চতুর, নাজেহাল করে তুলছে শত্রুকে।
একমাস পরে সাঁতারা দুর্গের পতনের পরেও ঔরঙ্গজেব খুব সান্তনা পেয়েছিলেন বলে মনে হয় না। কারণ পরের অভিযানেই সামান্য একটা দুর্গ অবরোধের সময় তাঁর বিশাল বাহিনী বর্ষার মুখে পড়ল। এক মাসের মধ্যে মুঘলদের এত লোক ক্ষয় আর রসদ নষ্ট হল যা গত এক বছরের অভিযানেও হয়নি। ক্রুদ্ধ বরুণ দেবতা যখন নির্দয় হয়ে ওঠেন তখন তাঁর রোষের হাত থেকে কারও পরিত্রাণ নেই— দিল্লির বাদশা কোন ছার!
চোদ্দো
রাজারাম মৃত্যুর সময় দুই পুত্র রেখে গিয়েছিলেন, দুই পত্নীর গর্ভজাত দুই সন্তান। জ্যেষ্টের নাম শিবাজি, বয়স দশ বছর আর কনিষ্ঠের নাম শাম্ভাজি, মাত্র তিন বছর বয়স (একই নামের পুনরাবৃত্তি ঘটেছে মারাঠা রাজবংশে)। শিবাজি ছিলেন হাবাগোবা।
রাজারামের প্রধান মহিষী, শিবাজির জননী তারাবাই অসাধারণ রমণী ছিলেন। উচ্চাভিলাষ, মানসিক দৃঢ়তা আর তীক্ষ্ন বুদ্ধির সমন্বয় ঘটেছিল তাঁর জীবনে। তিনি তাড়াতাড়ি কয়েক জন বিশিষ্ট মারাঠা সর্দারকে আমন্ত্রণ করে শিবাজিকে মারাঠা সিংহাসনের ভবিষ্যৎ উত্তরাধিকারী বলে স্বীকৃতি আদায় করলেন। শিবাজি সাবালক না হওয়া পর্যন্ত তিনি বালক রাজার প্রতিভূ হয়ে রাজকার্য পরিচালনা করবেন। রাজপ্রতিনিধি হবার পর প্রথম যে কাজটি তিনি করলেন তা হল রাজারামের দ্বিতীয় সন্তান এবং তার জননীকে কারারুদ্ধ করা। কোনোরকম ঝুঁকি নিতে প্রস্তুত ছিলেন না তারাবাই।
রায়গড় পতনের সময় শাম্ভাজির বালক পুত্রকে ঔরঙ্গজেব বন্দি করে নিয়ে গিয়েছিলেন সে কথা আগেই বলা হয়েছে। সিংহাসনে তাঁর দাবিই কিন্তু সবচেয়ে প্রবল; কারণ তিনি ছত্রপতি শিবাজির সরাসরি বংশধর। সেই বালক এবং তার মা দশ বছরের উপর ঔরঙ্গজেবের শিবিরে বন্দিদশা যাপন করছেন। বালক যুবরাজ সম্বন্ধে নানা গুজব মারাঠাদের কানে আসছিল। তিনি নাকি মুসলমান ধর্ম গ্রহণ করেছেন, ঔরঙ্গজেব তাঁকে আফিম থেকে তৈরি একরকম বিষ অল্প অল্প করে খাইয়ে তাঁর ইচ্ছাশক্তি নষ্ট করে ফেলেছেন ইত্যাদি। তবে মুঘলদের হাত থেকে তাঁর পরিত্রাণের কোনো সম্ভাবনাই সে সময় ছিল না।
মারাঠা সিংহাসনের উত্তরাধিকারী ঘোষণার ব্যাপারে সিংহগড়ে যে সভা তারাবাই আহ্বান করেছিলেন, কানোজি আংরে তাতে যোগ দেননি। মারাঠা গদিতে কে বসবে সেটা তাঁর বিবেচনার বিষয় নয়, কিন্তু যেই বসুক না কেন, তাঁকে তিনি প্রভু বলে স্বীকার করে নেবেন।
মারাঠা সাম্রাজ্যের এই নতুন পরিস্থিতিতে তখনকার রাজনৈতিক মানচিত্রে আমরা একবার দৃষ্টি বুলিয়ে নিই।
মাথার ওপর সুরাট, মুঘল প্রদেশের সদরদপ্তর। ইংরেজদের বড়ো একটা কারখানা ছিল সেখানে, ফরাসি এবং ওলন্দাজদের ব্যাবসা ছিল।
সুরাট থেকে বেসিন এই উপকূল রেখায় মুঘলদের আধিপত্য। কিন্তু বেসিন এবং সমুদ্রের খাঁড়ি পর্যন্ত প্রসারিত বিশাল দুর্গ, বেসিনের পারিপার্শ্বিক অঞ্চল এবং ‘থানা’ পোর্তুগিজদের দখলে ছিল।
বেসিনের পাশেই বোম্বাই দ্বীপ, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সদরদপ্তর। বোম্বাই বেশ বড়ো শহর হয়ে দাঁড়িয়েছে, লোকসংখ্যা প্রায় সত্তর হাজার।
আরও দশ মাইল নীচে, বোম্বাই পোতাশ্রয়ে জাহাজ ঢুকবার প্রণালীর মুখে একজোড়া দ্বীপ; খান্দেরি আর আন্ধেরি। ১৬৭৯ সালে শিবাজি খান্দেরি দখল করে সুরক্ষিত করেছিলেন। দ্বীপটা তখনও মারাঠাদের অধীনে তবে শক্তিশালী কোনো রক্ষীদল সেখানে ছিল না।
আন্ধেরি সিদ্দির রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত।
উপকূলের আরও কুড়ি মাইল নীচে কোলাবা, দু-বছর আগে কানোজি এখানেই তাঁর সদরদপ্তর সরিয়ে এনেছেন। কোলাবার চারপাশের অঞ্চল কানোজির শাসনে থাকার কথা, কিন্তু অরক্ষিত সেই অঞ্চলে সিদ্দি ইচ্ছামতো লুঠতরাজ চালাচ্ছিল।
কোলাবা থেকে আরও নীচে, একদিনের জলপথে প্রাচীন বাণিজ্য বন্দর চাওল; ভাস্কো দা গামা, এমনকী মার্কো পোলোরও আগের সময়ের স্মৃতি বিজড়িত বন্দর। চাওল পোর্তুগিজদের দখলে।
চাওলের কয়েক মাইল নীচে জাঞ্জিরার দুর্ভেদ্য দুর্গ, সিদ্দি কাশেম ইয়াকুত খাঁর শক্ত ঘাঁটি। জাঞ্জিরার আশেপাশে কুড়ি মাইল সিদ্দির রাজ্য বলে গণ্য হলেও মূল ভূখণ্ডে শক্তিশালী স্থলবাহিনী না থাকায় ওই অঞ্চল প্রায় সবার কাছেই উন্মুক্ত ছিল।
জাঞ্জিরা থেকে গোয়া পর্যন্ত সমুদ্র উপকূল মারাঠাদের নিয়ন্ত্রণে এবং শাসনে ছিল। তারা ওখানকার অধিবাসীদের কাছ থেকে চৌথ বা খাজনা আদায় করত।
সমুদ্র উপকূলের যাত্রা শেষ গোয়ায়। সুরক্ষিত দুর্গ এবং শক্তিশালী রক্ষী বেষ্টিত পোর্তুগিজ বন্দর।
সুরাট থেকে কারওয়ার— এই পাঁচ-শো মাইল (বেসিন থেকে কারওয়ার চার-শো মাইল) বিস্তৃত উপকূলে দেখা যাচ্ছে কর্তৃত্ব করত মুঘল, পোর্তুগিজ, ইংরেজ আর মারাঠারা। এ পর্যন্ত ইংরেজরাই ব্যাবসাবাণিজ্যকে মূলধন করে টিকে থাকার চেষ্টা করছিল। স্থানীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যতদূর সম্ভব তারা খোলাখলি সংঘর্ষ এড়িয়ে চলছিল। শুধু যখন নিজেদের স্বার্থে বিবদমান দু-পক্ষের এক পক্ষকে মদত দেওয়া তাদের পক্ষে অপরিহার্য হয়ে পড়ত, তখন তারা সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসত। ক্ষমতার ভারসাম্য বজায় রাখাই ছিল তাদের লক্ষ্য। ইংরেজদের চিরকালের নীতিই তাই— কাউকে বেশি শক্তিশালী হতে দেওয়া হবে না। সমান শক্তির অধিকারী বিভিন্ন পক্ষকে জিইয়ে রেখে নিজেরা সাধু সেজে নিরপেক্ষতার ভান করত, আর যেই দেখত কোনো এক পক্ষ শক্তিশালী হয়ে উঠছে অমনি অন্য পক্ষকে উসকে দিত তাদের বিরুদ্ধে, সেইসঙ্গে সামরিক সাহায্য দিতেও ভুল হত না।
পোর্তুগিজরা শাসন ব্যবস্থার দিকে তেমন যত্নশীল হয়নি। তারা ভাবত ভারত মহাসাগর তাদের ব্যক্তিগত সম্পত্তি, তাদের অনুমতি ছাড়া কারু ওই সমুদ্রপথে চলাচলের অধিকার নেই। পোর্তুগিজদের ছাড়পত্র ‘কার্তাজ’ ছাড়া কোনো জাহাজকে সমুদ্রপথে যেতে হলে নিজের ঝুঁকিতে যেতে হত। ওই ছাড়পত্র উপযুক্ত মূল্যে ক্রয় করা যেত, কিন্তু অনেক বাধানিষেধ আরোপিত ছিল ওই ছাড়পত্রে। যেমন, ক্রিশ্চান দাস বহন করতে পারবে না জাহাজ বা সওদাগরি নৌকা, পোর্তুগিজদের শত্রু বন্দরে ভিড়তে পারবে না জাহাজ। তা ছাড়া, পোর্তুগিজরা যেসব পণ্যদ্রব্যের একচেটিয়া ব্যাবসা করত সেসব সামগ্রীর ব্যাবসা নিষিদ্ধ ছিল।
পোর্তুগিজদের অনুমতিপত্র ছাড়া দেশীয় জাহাজের সমুদ্রপথে চলাচলের উপায় ছিল না। পোর্তুগিজরা জাহাজ আটক করে মোটা ক্ষতিপূরণ আদায় করত, অনেক সময় ডুবিয়েও দিত। এমনকী মুঘল সম্রাটের জাহাজকেও কার্তাজ বহন করতে হত। স্থলপথে ঔরঙ্গজেব প্রবল পরাক্রান্ত হলেও পোর্তুগিজ নৌবাহিনী সমুদ্রপথে নিঃসন্দেহে অনেক বেশি শক্তিশালী ছিল। তবে মুঘল এবং অন্যান্য ভারতীয় শাসকদের যত খুশি অনুমতিপত্র বিলি করায় কোনো বাধানিষেধ ছিল না, কিন্তু কার্তাজের ধারাগুলি এতটুকু শিথিল করা হত না।
একমাত্র ইংরেজ জাহাজ পোর্তুগিজদের আধিপত্য স্বীকার করেনি। ইংরেজ জাহাজ আগ্নেয়াস্ত্র না নিয়ে চলাফেরা করত না। তাদের কামানগুলি ছিল পোর্তুগিজদের মতোই আধুনিক, আর তাদের গোলন্দাজরা পোর্তুগিজদের তুলনায় কোনো অংশে নিকৃষ্ট তো ছিলই না, বরং অনেক ক্ষেত্রে তাদের দক্ষতা পোর্তুগিজদেরও ছাপিয়ে যেত।
জাঞ্জিরার সিদ্দি নামেই মুঘল সম্রাটের নৌসেনাপতি, আসলে সিদ্দিরা স্বাধীনভাবেই চলছিল। আয়ত্তের মধ্যে কোনো জাহাজ পেলে তারা ছেড়ে কথা বলত না। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এসব ছিল দেশীয় বাণিজ্যপোত, লড়াই করার ক্ষমতা ছিল না বললেই চলে। সিদ্দিদের কার্যকলাপ অবশ্য নিজেদের এলাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে হত। উন্মুক্ত সমুদ্রে তাদের জাহাজ পোর্তুগিজদের অনুমতিপত্র নিয়েই চলাচল করত। নিজেদের এলাকাতেও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জাহাজগুলির তুলনায় তাদের শক্তি ছিল অনেকটা সীমিত। তাই মারাঠা বাণিজ্যতরী এবং মারাঠা এলাকাই ছিল তাদের প্রধান লক্ষ্যবস্তু।
এবার মারাঠাদের কথায় আসা যাক। এতদিনে তারা ভাবতে শুরু করেছে যে, কোঙ্কণ এবং তার উপকূল সংলগ্ন জলপথ তাদের জন্মগত অধিকার। সমুদ্র অবাধ, উন্মুক্ত। তাদের জাহাজ আটক করবার অধিকার কারু নেই। মজার কথা, ইংরেজদের কাছ থেকেই এ শিক্ষা তারা পেয়েছিল। ইংরেজ জাহাজ পোর্তুগিজদের ছাড়পত্রের দাবি স্বীকার করত না। তবে ভাবা আর কাজ এক নয়। সৌভাগ্যের কথা, এতদিনে মারাঠারা এমন একজন নেতার সন্ধান পেয়েছে, যিনি সমুদ্রে মারাঠা অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
কানোজি আংরে কোঙ্কণ উপকূল দিয়ে চলাচলকারী কিংবা সমুদ্রগামী বাণিজ্যপোতগুলিকে তাঁর নিজের অনুমতিপত্র, ‘দস্তক’ বিলি করতে শুরু করলেন। পোর্তুগিজরা যে হার বা মূল্যের বিনিময়ে কার্তাজ বিলি করত, তাঁর দাবিও ছিল মোটামুটি তাই। পোর্তুগিজদের মতো তিনিও বাণিজ্যতরীগুলিকে জলদস্যু এবং অন্যান্য উপকূল শক্তির হাত থেকে রক্ষার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছিলেন। যেসব জাহাজ বা বাণিজ্যপোত তাঁর ‘দস্তক’ ব্যবহার করত না, তাদের আটক করে মুক্তিপণ আদায় করা হচ্ছিল।
বুদ্ধিমান বণিকরা ‘কার্তাজ’ আর ‘দস্তক’ দুটোই সঙ্গে রাখত, আর ভগবানের কাছে প্রার্থনা করত যেন জলদস্যুরা তাদের ওপর চড়াও না হয়। এর কারণ, জলদস্যুদের আক্রমণের বিরুদ্ধে তাদের রক্ষার যে প্রতিশ্রুতি পোর্তুগিজ এবং মারাঠারা দিত তা অনেকটা নিয়মমাফিক। উপকূল থেকে বোম্বেটে জাহাজ দেখা গেলে তবেই ব্যবস্থা নেওয়া হত।
ইংরেজরা অবশ্য পোর্তুগিজ কিংবা মারাঠা কারও অনুমতিপত্রের ধার ধারত না। তারা এতদিন সমুদ্রে অবাধ বাণিজ্য করেছে, এখন কোনোরকম অনুশাসনের আওতায় আসতে তারা রাজি নয়। নিজেদের কামান আর বারুদের উপর পূর্ণ আস্থা আছে তাদের।
পনেরো
১৭০২ সালে কানোজি কালিকটের কাছে একটা বাণিজ্যতরী আটক করলেন। ওটাতে ছ-জন ইংরেজ যাত্রী ছিল। ওটা ছিল এক ভারতীয় বণিকের সম্পত্তি, ইংরেজরা যাত্রী মাত্র। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কিন্তু এ ব্যাপারে বেজায় চটল। তাদের মনোভাব হল, জাহাজ যারই হোক না কেন, সেই জাহাজে যদি ইংরেজ যাত্রী থাকে কিংবা তাদের নিয়ন্ত্রিত কোনো বন্দর যদি সেই জাহাজের গন্তব্যস্থল হয়, তবে কোম্পানির জাহাজের সব সুবিধে সেই জাহাজের পাওয়া উচিত।
বোম্বাইয়ে কোম্পানির পক্ষ থেকে জাহাজটা ছেড়ে দেবার দাবি জানিয়ে কড়া এক চিঠি লেখা হল কানোজিকে। তিনিও এক কড়া জবাব পাঠালেন।
১৭০৩ সালে কানোজি ওলন্দাজদের একটা যুদ্ধজাহাজ দখল করলেন। ‘মারাঠারা বড়োই উদ্ধত হয়ে উঠেছে’— ইংরেজ গভর্নর তাঁর রিপোর্টে লিখলেন।
এরপর কিছুকাল কানোজি চুপচাপ নিজের শক্তি বৃদ্ধির চেষ্টায় ব্যস্ত রইলেন। কোম্পানির সঙ্গে তাঁর সংঘর্ষ যে অনিবার্য তা তিনি বুঝেছিলেন। তিনি এটাও উপলব্ধি করেছিলেন যে, তাঁর ‘ঘুরাব’, ‘গালিভাত’ ইত্যাদি ইংরেজ এবং পোর্তুগিজদের রণতরীর তুলনায় অনেক নিকৃষ্ট। ইউরোপীয় জাহাজ কাবু করার একমাত্র উপায় তাদের জাহাজে চড়াও হয়ে হাতাহাতি যুদ্ধে লিপ্ত হওয়া। অসিযুদ্ধে মারাঠাদের দক্ষতার কথা আগেই বলা হয়েছে। ইউরোপীয় জাহাজগুলি আবার সবসময় মারাঠা নৌবহর থেকে যথেষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে চলত, সুতরাং সেই সুযোগ সদ্ব্যবহারের সম্ভাবনা খুব বেশি ছিল না।
অষ্টাদশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে কানোজি তাঁর নৌশক্তি বৃদ্ধির জন্য সচেষ্ট হলেন, সেইসঙ্গে উন্নত রণতরী নির্মাণের দিকেও বিশেষ দৃষ্টি দিলেন। পোর্তুগিজদের সঙ্গে তিনি একটা মৈত্রী চুক্তিতে আবদ্ধ হতে চাইছিলেন। তাদের কাছ থেকে কামান আর গোলাবারুদ সংগ্রহ করার উদ্দেশ্যেই এ পথ বেছে নিয়েছিলেন তিনি। পোর্তুগিজদের সঙ্গে যোগাযোগে তাঁর প্রধান সহায় ছিল ম্যানুয়েল মোরেস দা কার্ভেলো নামে এক পোর্তুগিজ। জাহাজ তৈরির ব্যাপারে ক্যানোজি তাঁকে উপদেষ্টা নিযুক্ত করেছিলেন। ম্যানুয়েল দা কাস্ত্রো নামে একজন দক্ষ গোলন্দাজকেও তিনি তাঁর নৌবাহিনীতে গ্রহণ করেছিলেন।
উন্মুক্ত সমুদ্রে ইউরোপীয় নৌবহর আক্রমণ করার মতো মূর্খ ছিলেন না তিনি। নৌবহর থেকে বিচ্ছিন্ন কোনো জাহাজকেই তিনি শিকারের জন্য বেছে নিতেন। তাঁর উপদেশে মারাঠা নৌসেনাপতিরা বিদেশি জাহাজের পার্শ্বদেশ লক্ষ্য করে আক্রমণ চালাত। ফলে আক্রান্ত জাহাজ আক্রমণকারীর দিকে ঘুরে দাঁড়াবার চেষ্টা করলেই তারা পাশ থেকে পিছিয়ে এসে অগভীর জলে আশ্রয় নিত। দুটো উদ্দেশ্য সিদ্ধ হত এই কৌশলে— ইউরোপীয় বড়ো জাহাজ অগভীর জলে তাদের তাড়া করে আসতে পারত না আর উপকূলরক্ষীর কামানের সাহায্য পাওয়া যেত। শত্রুপক্ষের জাহাজ আর উপকূলের মাঝ বরাবর থাকবার চেষ্টাই করত কানোজির নৌবহর।
বছর খানেক পর সাতটা গালিভাত নিয়ে বোম্বাইয়ের কাছে পানে নদীর মুখ আটকে বসলেন কানোজি। আর কিছু করলেন না, কোনো গোলাগুলি বিনিময় হল না। কিন্তু তাঁর উপস্থিতিতে মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে বোম্বাইয়ের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল, জাহাজ চলাচল সম্পূর্ণ বন্ধ। সাতদিন ওইভাবে অবরোধের পর কানোজি নৌবহর নিয়ে চলে গেলেন।
দক্ষ দাবাড়ুর মতো ঘুঁটির একটা দারুণ চাল দিলেন কানোজি। বোম্বাইয়ের ইংরেজদের তিনি সমঝে দিলেন যে, ইচ্ছে করলে বোম্বাই অবরোধ করে বিপর্যয় ডেকে আনতে পারেন তিনি।
বোম্বাইয়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্তৃপক্ষ কানোজির সঙ্গে মিত্রতার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করলেন। তাঁরা উইলিয়াম রেনল্ডসকে কানোজির সন্দর্শনে প্রেরণ করলেন। তাকে বলা হল ‘যেখানেই হোক তার সঙ্গে দেখা করো… সেই দস্যু সর্দারের সঙ্গে পরিচয়ের পর সৌজন্যের সঙ্গে তাকে জানাবে রাজা শিবাজির আমল থেকে মারাঠাদের সঙ্গে কোম্পানি যে প্রীতির সম্পর্ক বজায় রেখে চলেছে, কোম্পানির জাহাজের ওপর হামলা করে কানোজি তা ভঙ্গ করছে। এমন অবস্থা চলতে দেওয়া যেতে পারে না।’
রেনল্ডসকে অবশ্য সতর্ক করে দেওয়া হয়েছিল, অভদ্র বা শত্রুতামূলক ভাষা ব্যবহার না করার জন্য।
কানোজি রেনল্ডসের মুখের উপর জবাব দিলেন, ‘ইংরেজরা কখনো তাদের কথা রাখে না।’
তিনি স্পষ্টই বুঝিয়ে দিলেন যে, এখন থেকে সংঘর্ষ অনিবার্য। যেসব জাহাজ তাঁর ‘দস্তক’ বহন করবে না, তাদের তিনি আটক করবেন। ইংরেজরা যা খুশি করতে পারে।
ষোলো
এদিকে রাজারামের মৃত্যুর পর ছ-বছর কেটে গেছে। দীর্ঘ অবরোধের পর বহু অর্থ ও লোকক্ষয়ের বিনিময়ে একটার পর একটা দুর্গ ঔরঙ্গজেবের কাছে আত্মসমর্পণ করছিল বটে, কিন্তু এ সত্যটা তাঁর কাছে আর গোপন ছিল না যে, দাক্ষিণাত্যে মারাঠা শক্তি নিশ্চিহ্ন করার প্রয়াসে তিনি সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছেন। মনে মনে বোধ হয় তিনি বুঝতে পেরেছিলেন তিনি পরাজিত।
ঔরঙ্গজেব অন্য পথ ধরলেন। ১৬৮৯ সালে রায়গড় পতনের সময় তিনি শাম্ভাজির ছ-বছরের বালক পুত্র এবং মাতাকে বন্দি করেছিলেন। সম্রাটের প্রিয় কন্যা জেবউন্নিসার উপর ভার পড়েছিল ওই বালকের লালনপালনের। শোনা যায় ঔরঙ্গজেব নিজেও ক্রমে ক্রমে বালকের উপর প্রসন্ন হয়ে উঠেছিলেন। তিনি নাকি মন্তব্য করেছিলেন, দস্যু তস্করের বংশধর হলেও বালকটির চেহারা ‘সাও’য়ের মতো— ‘সাও’ অর্থ হল তস্করের মতো নয়। ‘সাও’ থেকে পরে বালকের নাম হয়ে গেল শাহু। ঔরঙ্গজেব স্থির করলেন শাহুকে তিনি মারাঠা রাজা বলে ঘোষণা করবেন। এর ফলে মারাঠা শক্তি দ্বিধাবিভক্ত হয়ে গৃহযুদ্ধের সূচনা করবে আর শাহু ঔরঙ্গজেবের সামন্তরূপে মারাঠা সিংহাসনে স্বীকৃতি পাবেন।
শাহুর তখন যুবা বয়স। বিগত জীবনের স্মৃতি তিনি বিস্মৃত হয়েছেন। মুঘলদের শিবিরে প্রবীণা রাজকুমারীর আদরযত্নে তিনি তখন মুঘল আদবকায়দায় অভ্যস্ত। তা ছাড়া মগজ ধোলাই থেকে শুরু করে অল্প অল্প আফিম খাইয়ে তাঁর ইচ্ছাশক্তি নষ্ট করে ফেলা হয়েছে। বন্দিশালায় বেড়ে ওঠা পশুর মতোই তাঁর জীবন। মুঘল শিবিরের বাইরের জীবন সম্বন্ধে তাঁর জ্ঞানের পরিধি অত্যন্ত সীমিত। বিলাসী, অলস, স্বাধীন চিন্তার ক্ষমতাটুকু পর্যন্ত হারিয়ে ফেলেছেন। মারাঠাদের মধ্যে শাহুর সম্বন্ধে এ ধারণাই বদ্ধমূল হয়ে গিয়েছিল।
কিন্তু মনস্থির করতে করতে ঔরঙ্গজেবের এক বছর লেগে গেল। শাহুকে যদি মারাঠারা গ্রহণ না করে? তারপর দূতের মাধ্যমে মারাঠা সর্দারদের সঙ্গে এ বিষয়ে তিনি আলোচনা শুরু করলেন। বেশ কিছুকাল আলোচনা চলল, কিন্তু শেষপর্যন্ত তাঁর এই উদ্যম ব্যর্থ হল। এদিকে ঔরঙ্গজেবের জীবন-প্রদীপ নিভু নিভু। নব্বুই বছর অতিক্রম করেছেন তিনি। মৃত্যু ভয় তাঁকে বিহ্বল করে তুলেছে। শাহুকে শয্যার পাশে আহ্বান করলেন ঔরঙ্গজেব। তাঁকে দিয়ে শপথ করিয়ে নিলেন যে, তিনি কখনো মুঘলদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করবেন না। কয়েক দিন পরে, ১৭০৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের এক হিমেল রাতে চিরনিদ্রার কোলে ঢলে পড়লেন ঔরঙ্গজেব।
সারা জীবন অনাড়ম্বর জীবনযাপন করেছিলেন তিনি। মৃত্যুর পরেও যেন তাঁর শেষকৃত্য জাঁকজমকহীন হয়— এই ছিল তাঁর নির্দেশ। তাঁর শেষ কথা হল ‘ধূলির এই দেহকে দেরি না করে প্রথম যে কবরখানা চোখে পড়বে সেখানেই গোর দিতে হবে, শবাধারের কোনো প্রয়োজন নেই।’
* * *
ঔরঙ্গজেবের মৃত্যু দাক্ষিণাত্যে বিরাট এক শূন্যতা এনে দিল। তাঁর নশ্বর দেহ যখন সমাহিত করা হচ্ছিল তখনই তাঁর তিন পুত্রের মধ্যে সিংহাসন নিয়ে বিবাদ শুরু হয়ে গেছে। তিন পুত্রের প্রত্যেকেই শক্তিশালী স্থলবাহিনীর তিনটি শাখার প্রধান। তাদের প্রত্যেকেই তাড়াতাড়ি দিল্লি ফিরে নিজেকে সম্রাট বলে ঘোষণা করার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ল। প্রায় এক বছর এবং দুটি তুমুল লড়াইয়ের পর এই জটিল অবস্থার অবসান ঘটল। মুঘল সিংহাসনে উত্তরাধিকারীর প্রশ্নটা ঔরঙ্গজেবের পুত্ররা পিতার অনুসৃত পথেই সমাধান করল। তাঁর এক পুত্র, প্রতিদ্বন্দ্বী দুই বাহিনীকে পরাভূত ও ভ্রাতাদের হত্যা করে আরোহণ করল দিল্লির মসনদে।
মুঘল সেনা তাদের দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছে এটা উপলব্ধি করে মারাঠারা কেমন যেন বিহ্বল হয়ে পড়ল। অবশিষ্ট মুঘল বাহিনীকে নিশ্চিহ্ন করার প্রয়াসে ঐক্যবদ্ধ হবার জন্য তাদের কাছে বার বার আবেদন জানালেন তারাবাই। কিন্তু ঘটনার আকস্মিকতায় তারা তখন দিশাহারা হয়ে পড়েছে।
মুঘলদের দিক থেকে বিপদ কেটে গেল বটে, কিন্তু ঔরঙ্গজেবের মৃত্যুর কয়েক সপ্তাহ পরেই নতুন এক সমস্যা দেখা দিল মারাঠাদের জীবনে। সুদীর্ঘ কাল ধরে তারা মুঘলদেরই একমাত্র শত্রু বলে জেনেছিল, সেই শত্রুর বিরুদ্ধেই তাদের মধ্যে গড়ে উঠেছিল শিবাজির বংশধরদের প্রতি নিঃস্বার্থ এক আনুগত্য। এমনকী যখন বিভিন্ন সর্দারের অধীনে তাদের সামরিক শক্তি বিভক্ত হয়ে পড়েছিল, তখনও মারাঠা জাতিরূপে একই পতাকার তলায় মুঘলদের বিরুদ্ধে তারা অস্ত্রধারণ করেছিল। কিন্তু এখন তারা বিভ্রান্ত।
এই বিভ্রান্তির কারণ আর কিছুই নয়— সিংহাসনের দাবি নিয়ে রঙ্গমঞ্চে শাহুর প্রবেশ।
সতেরো
বিশাল মুঘল বাহিনী যখন দিল্লির পথে ফিরে চলেছে, ঠিক সেই সময় শাহু তাঁর বিশ্বস্ত কয়েক জন অনুচর নিয়ে মুক্তির পথে পা বাড়ালেন।
কিছুকাল ধরেই দাক্ষিণাত্যের ঘটনাবলির ওপর লক্ষ রাখছিলেন তিনি। ঔরঙ্গজেবের জ্ঞাতসারেই ধূসর চোখ, তীক্ষ্ন দৃষ্টি এক যুবকের সঙ্গে তিনি যোগাযোগ করেছিলেন। এই যুবকের নাম বালাজি বিশ্বনাথ, যাঁর কথা আমরা আগেই জেনেছি। বালাজি বিশ্বনাথ ওই সময়ে তারাবাইয়ের দুই প্রধান সেনাপতির অন্যতম ধানাজি যাদবের সচিব, বলতে গেলে তাঁর ডান হাত। মুঘল বাহিনীর আমলাদের অনেকের সঙ্গেই বালাজির হৃদ্যতা ছিল। ঔরঙ্গজেবের সেনাপতি জুলফিকারকে ব্যক্তিগতভাবে তিনি জানতেন। শেষ জীবনে সম্রাট তাঁর কন্যা জেবউন্নিসার উপর ক্রমেই নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিলেন। শোনা যায় জেবউন্নিসার উপরেও নাকি বালাজি প্রভাব বিস্তার করেছিলেন।
কিছুকাল আগে ঔরঙ্গজেব যখন কিছু মারাঠা নেতার সঙ্গে শাহুর মুক্তির ব্যাপার নিয়ে আলোচনা চালাচ্ছিলেন, সেইসময় বালাজি বিশ্বনাথ শাহুর সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করেন। মারাঠা সিংহাসনে শাহুর দাবি সম্বন্ধে তাঁকে তিনি উৎসাহিত করেছিলেন।
শাহুর কাছে ব্যাপারটা অবশ্য খুব সহজ ছিল না। বিলাস আর নিরাপত্তার নিশ্চিন্ত জীবন ছেড়ে বিপদ আর অনিশ্চিতের মুখে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে তাঁকে। তাঁর মা, আর দুই বালিকা বধূকেও মুঘলদের দয়ার উপর নির্ভর করে ছেড়ে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই। শাহু বুঝেছিলেন শুধু এই কারণেই চিরকাল তাঁকে মুঘলদের বশ্যতা স্বীকার করে চলতে হবে। মা, দুই কিশোরী বধূ আর তাঁর কিছু অনুচরকে মুঘলরা জামিন হিসেবে আটকে রাখবে যাতে তিনি তাদের বিরুদ্ধাচরণ না করেন। তা ছাড়া, ঔরঙ্গজেবের মৃত্যুশয্যায় তিনি অঙ্গীকারবদ্ধ, মুঘলদের বিরুদ্ধে কখনো অস্ত্রধারণ করবেন না। মারাঠারা কি তাঁকে গ্রহণ করবে?
শাহুর বয়স এখন পঁচিশ, পূর্ণ যুবক তিনি, প্রাণশক্তিতে ভরপুর। এতকাল মুঘল শিবিরে যেভাবে তাঁকে গড়েপিঠে তোলা হয়েছিল, মগজধোলাই থেকে শুরু করে আফিমের নেশা ধরানো হয়েছিল, সবকিছু ঝেড়ে ফেলে শক্ত মানুষের মতো তিনি উঠে দাঁড়ালেন। ঈশ্বর নির্দিষ্ট পথে এগিয়ে যেতে হবে তাঁকে।
তাঁর না ছিল অর্থবল, না ছিল লোকবল। তাঁর একমাত্র মূলধন তিনি শিবাজির সরাসরি উত্তরাধিকারী। দাক্ষিণাত্যের অল্প মানুষই তাঁর কথা মনে রেখেছে। ছ-বছর বয়সে যাকে বন্দি করে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল আজ তার কথা লোকের মনে থাকবে— এটা ভাবাও উচিত নয়। তা ছাড়া পোশাকে, আচারে-ব্যবহারে শাহু শুধু মুঘল ঘেঁষাই ছিলেন না, মারাঠি ভাষা পর্যন্ত ভালো বলতে পারতেন না তিনি।
দাক্ষিণাত্যে সে সময় বাছা বাছা মারাঠা সর্দারের নাম মুঘল শিবিরে উচ্চারিত হত না এমন দিন ছিল না। শাহু তাঁদের কাছে দূত পাঠালেন। নিজের প্রত্যাবর্তনের সংবাদ জানিয়ে তাঁদের সাহায্য প্রার্থনা করলেন।
মারাঠা সিংহাসনের দাবিদার তখন দুজন— একজন শাহু, অন্যজন রাজারামের জড়বুদ্ধিসম্পন্ন পুত্র; মারাঠা রাজবংশের অবিচ্ছিন্নতা বজায় রাখার জন্য যাঁকে সিংহাসনে বসানো হয়েছে।
শাহুর প্রধান ভরসা বালাজি বিশ্বনাথ। ধানাজি যাদবের যিনি ডান হাত। কানোজি আংরের সঙ্গেও বালাজির একসময় যথেষ্ট হৃদ্যতা ছিল। বালাজি বিশ্বনাথের মাধ্যমে এই দুই সেনাপতিকে স্বদলে আনতে পারলে শাহুর আর কোনো চিন্তার কারণ নেই। দুই সেনাপতির কাছেই তিনি দূত পাঠালেন।
তারাবাইও বসে নেই। তিনি বিশিষ্ট মারাঠা সর্দারদের আমন্ত্রণ করে বললেন শাহু আসলে এক ভণ্ড। মুঘলদের হাতের পুতুল এক প্রতারক মারাঠা সিংহাসনে নিজেকে দাবিদার বলে ঘোষণা করছে। আসল রাজা হল তাঁরই পুত্র, আনুষ্ঠানিকভাবে সিংহাসনে যাঁর অভিষেক হয়েছে। তিনি সমবেত মারাঠা সর্দারদের সম্মানে এক ভোজ দিলেন। সেই ভোজসভায় তিনি তাঁদের দিয়ে শপথ করিয়ে নিলেন যে, তাঁরা কখনো তাঁর পক্ষ ত্যাগ করবেন না।
তারাবাই অসাধারণ ব্যক্তিত্বসম্পন্না মহিলা ছিলেন। মারাঠা সর্দারদের তিনি দুধ-ভাত হাতে নিয়ে অঙ্গীকার করালেন। মারাঠাদের কাছে ওই অঙ্গীকারের অর্থ, প্রাণ যায় তবু কথার খেলাপ হবে না। শিবাজির পরবর্তীকালে যাঁরা রাজকার্য পরিচালনা করেছিলেন, বুদ্ধি, মানসিক দৃঢ়তা এবং বিচক্ষণতায় তারাবাইয়ের স্থান বোধ হয় সবার উপরে।
যাঁরা ওই ভোজসভায় উপস্থিত হয়ে তারাবাই এবং তাঁর পুত্রের প্রতি আমৃত্যু আনুগত্যের শপথ নিয়েছিলেন, ধানাজি যাদব তাঁদের একজন। তারাবাই তাঁকে স্থলবাহিনীর প্রধান সেনাপতির পদে উন্নীত করলেন।
পরে যখন প্রমাণিত হয়েছিল, শাহু ভণ্ড নয়, তখন যাঁরা ওই ভোজসভায় তারাবাইয়ের কাছে অঙ্গীকারবদ্ধ হয়েছিলেন, তাঁরা নিজেদের প্রতিশ্রুতি আর রাজার প্রতি আনুগত্যের প্রশ্নে এমন মানসিক দ্বন্দ্বের সম্মুখীন হয়েছিলেন যে, তাঁদের একজন আত্মহত্যা করে যন্ত্রণামুক্ত হয়েছিলেন। কেউ কেউ প্রায়শ্চিত্ত করে দল বদল করেছিলেন আবার অনেকে কোনো পক্ষই অবলম্বন করেননি।
কানোজি আংরে ওই ভোজসভায় যোগ দেননি, কোনো প্রতিশ্রুতিও দেননি, কিন্তু তারাবাইয়ের প্রতি তাঁর আনুগত্যের প্রশ্নে কোনো সন্দেহ থাকতে পারে না। একবার যাঁর প্রতি আনুগত্য তিনি স্বীকার করেছেন, তা বদল করার মতো দুর্বল চরিত্রের মানুষ তিনি নন।
তারাবাই কিন্তু কানোজির কথা ভোলেননি। তিনি ওই ভোজসভায় ঘোষণা করলেন কানোজিকে মারাঠা নৌবাহিনীর প্রধান (সরখেল) এবং কোঙ্কণের শাসনকর্তা নিযুক্ত করা হল।
কানোজির অনেক দিনের স্বপ্ন সফল হয়েছে। যে পদ আর সম্মান তাঁর আকাঙ্ক্ষার বস্তু ছিল, তা তিনি অবশেষে পেয়েছেন।
আঠারো
মারাঠা রাজনীতিতে ব্রহ্মেন্দ্র স্বামীর প্রভাব অসামান্য। বালাজি বিশ্বনাথই বলতে গেলে তাঁকে আবিষ্কার করেন। দরিদ্রের ঘরে জন্ম ব্রহ্মেন্দ্র স্বামীর। তাঁর আসল নাম বিষ্ণু। মাত্র বারো বছর বয়সে তিনি মা-বাবাকে হারান। এর কিছুকাল পরেই নির্জনে দীর্ঘকালের জন্য তিনি ধ্যানমগ্ন হন। পনেরো বছর বয়সে কাশী গিয়ে পার্থিব সবকিছু পরিত্যাগ করে তিনি সন্ন্যাস ধর্ম গ্রহণ করলেন, নাম হল ব্রহ্মেন্দ্র স্বামী। এবার তীর্থযাত্রায় বেরুলেন তিনি। হিমালয় থেকে দক্ষিণ ভারতের শেষপ্রান্ত পর্যন্ত তিন হাজার মাইল পদব্রজে তিনি ভ্রমণ করেছিলেন। তীর্থযাত্রা শেষে তিনি চিপলুনের অদূরে এক বনে কুটিরবাসী হন।
এই বনেই বালাজি বিশ্বনাথ ধ্যানমগ্ন অবস্থায় তাঁর দেখা পান। বিশ্বনাথ তখন সিদ্দির লবণের কারখানারা একজন কেরানি। তিনিই ব্রহ্মেন্দ্র স্বামীর প্রথম শিষ্যত্ব গ্রহণ করলেন।
‘তুমি মারাঠা রাজ্যের সর্বোচ্চ পদ অলংকৃত করবে,’ ব্রহ্মেন্দ্র স্বামী বলেছিলেন বালাজিকে। ভাবীকালে গুরু-শিষ্য দুজনেই ইতিহাসে স্বাক্ষর রেখেছিলেন। দাক্ষিণাত্যের রাজনীতি তাঁদের যৌথ প্রচেষ্টায় ভিন্ন গতি নিয়েছিল। তবে তাঁরা দুজনেই অনেক ব্যাপারে নিজেদের স্বার্থে ঘটনার মোড় ঘুরিয়েছিলেন— এ কথা অস্বীকার করা যায় না। ১৬৮৮ সালে বালাজি চিপলুন থেকে সরে পড়ার পরেও দুজনের মধ্যে যোগাযোগ অবিচ্ছিন্ন ছিল।
বালাজি চিপলুন ত্যাগ করার পর দশ বছর পর্যন্ত ব্রহ্মেন্দ্র স্বামী নির্জন কুটিরে ধ্যানমগ্ন ছিলেন। ১৬৯৮ সালে তিনি আত্মপ্রকাশ করলেন। তখন তাঁর বয়স পঞ্চাশ বছর। কানোজি আংরেও ইতিমধ্যে স্বামীজির শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছেন। শোনা যায় সুবর্ণ-দুর্গে রাতারাতি বিদ্রোহ করে অচলজি মোহিতের হাত থেকে দুর্গের দখল নেবার আগে কানোজি বালাজি বিশ্বনাথের মাধ্যমে স্বামীজির আশীর্বাদ ভিক্ষা করেছিলেন।
আত্মপ্রকাশের পর থেকেই ব্রহ্মেন্দ্র স্বামী শিষ্য সংখ্যা বৃদ্ধির জন্য প্রচারে মন দিলেন। দীর্ঘকালের তপস্যায় যে আধ্যাত্ম শক্তি তিনি অর্জন করেছিলেন, তার অবাধ প্রয়োগে তিনি কুণ্ঠিত ছিলেন না। তাঁর সম্বন্ধে নানা অলৌকিক গুজব লোকমুখে ছড়িয়ে পড়তে দেরি হল না। যারা তাঁর বিরুদ্ধাচরণ করছিল তাদের তিনি ভয়ানক শাস্তির ভয় দেখাতেন, আর যারা তাঁর অনুগত ছিল, প্রয়োজনে অর্থ ও সম্পদ জোগাচ্ছিল, তাদের তিনি অবাধে আশীর্বাদ করতেন। আশ্চর্যের কথা, যারা তাঁর আশীর্বাদ লাভ করেছিল, তারা সবাই উন্নতি করেছিল জীবনে।
কয়েকটি বিরাট মন্দির নির্মাণ এবং তাদের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য তিনি প্রচুর অর্থ ব্যয় করেছিলেন। বলা বাহুল্য, এই অর্থ জোগাতে হত তাঁর শিষ্য বা অনুগ্রহপ্রার্থীদের। মন্দির ছাড়াও বড়ো বড়ো পুকুর এবং গভীর কূপ খনন করার মূলে ছিলেন তিনি, বানিয়েছিলেন সেতু আর সড়ক। মুসলমানদের মধ্যেও তাঁর শিষ্যের সংখ্যা কম ছিল না। জাঞ্জিরার সিদ্দি, কাশেম ইয়াকুত খাঁর উত্তরাধিকারী, চিপলুনের কাছে স্বামীজির সম্পত্তি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বার্ষিক অনুদানের ব্যবস্থা করেছিলেন। ব্যক্তিগত অপমান ব্রহ্মেন্দ্র স্বামী কখনো ক্ষমা করেননি, আবার নগদ টাকাপয়সা ছাড়া পারতপক্ষে কারু উপকার তিনি করতেন না। পার্থিব ভোগবিলাস তিনি বর্জন করেছিলেন, অথচ তাঁর নির্মিত প্রতিষ্ঠানগুলির জন্য যে দ্রব্যসামগ্রী তাঁর ধনী শিষ্যরা প্রেরণ করতেন তা বহন করবার জন্য এক মাইল দীর্ঘ বলদবাহী শকটের প্রয়োজন হত। তাঁর সুখসুবিধা দেখার ভার ছিল চোদ্দোজন দাসীর উপর। লোভী, স্বার্থপর, উচ্চাভিলাষী, প্রতিহিংসাপরায়ণ, বিবেকবর্জিত এই মানুষটি কিন্তু কখনো কোনো ক্ষুধার্তকে অভুক্ত অবস্থায় তাঁর দরজা থেকে ফিরিয়ে দেননি। অনেক অভাবীকেও নাকি তিনি সাহায্য করতেন। পরস্পরবিরোধী চরিত্রের এক বিচিত্র মানুষ ছিলেন তিনি।
সবচেয়ে মজার কথা, ব্রহ্মেন্দ্র স্বামী কখনো ভুল মানুষকে সমর্থন করেননি। যাঁর উপরেই তাঁর আশীর্বাদ বর্ষিত হত তিনিই জীবনে সাফল্য অর্জন করেছিলেন। অদ্ভুত এই যোগাযোগ! তিনি যা স্পর্শ করতেন তাই যেন সোনা হয়ে যেত।
১৭০৭ সালে ব্রহ্মেন্দ্র স্বামী বিশেষ দূত মারফত শাহুকে আশীর্বাদ করলেন, মারাঠা সিংহাসনে তাঁকে স্বাগত জানালেন। দান হিসেবে তিনি তাঁকে পাঠিয়েছিলেন উপবীত আর কটিবস্ত্র। ‘সমস্ত বাধা অতিক্রম করে তুমি শান্তিতে রাজত্ব করবে’— স্বামীজি বলে পাঠিয়েছিলেন শাহুকে।
ব্রহ্মেন্দ্র স্বামীর এই উক্তি শাহুর কাছে দৈববাণীর মতোই মনে হয়েছিল। নিজের দেশে নিজেকে আর নির্বান্ধব, অপরিচিত, বিদেশি মনে হয়নি। ব্রহ্মেন্দ্র স্বামীর মতো একজন প্রভাবশালীর মানুষের সমর্থন পেয়ে কৃতজ্ঞতায় ভরে গিয়েছিল তাঁর মন।
যে সময় বেশিরভাগ মারাঠা সর্দার আর সমর নায়করা তারাবাইয়ের সমর্থনে বলিষ্ঠ হাত বাড়িয়েছিলেন, সেইসময় স্বামীজির এই ভবিষ্যদবাণী বিস্ময়কর সন্দেহ নেই। তিনি দিব্যদৃষ্টির অধিকারী ছিলেন কিনা সে বিষয়ে মতভেদ থাকতে পারে, কিন্তু তিনি যে মস্ত বড়ো ঝুঁকি নিয়েছিলেন সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। এই ভবিষ্যদবাণী উচ্চারিত হয়েছে ব্রহ্মেন্দ্র স্বামীর মুখ থেকে— এটা জানার পর যাঁরা তারাবাইকে সমর্থন করবেন বলে অঙ্গীকার করেছিলেন তাঁদের মনের অবস্থা নিশ্চয়ই সুখের হয়নি।
ব্রহ্মেন্দ্র স্বামীর এই উক্তি কানোজি আংরের বুকেও নিশ্চয়ই চরম আঘাতের মতো এসে বেজেছিল। তারাবাই এবং তাঁর পুত্রকে মনপ্রাণ দিয়ে তিনি সমর্থন করেছেন। এ বিষয়ে তাঁর অভিমত সুস্পষ্ট, কোনো দ্বিমতের সুযোগ নেই। কিন্তু এখন তাঁর ধর্মগুরু, যাঁর আশীর্বাদ ছাড়া কোনো গুরত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত তিনি গ্রহণ করেন না, সেই স্বামীজি প্রকাশ্যেই শাহুকে সমর্থন করছেন।
কানোজির মনে নিশ্চয়ই ঝড় উঠেছিল। মারাঠা নৃপতির প্রতি তাঁর আনুগত্যের ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই, কিন্তু কে সেই নৃপতি? রাজারামের পুত্র না শাহু? এই সন্দেহ দোলায় রাজবংশের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে কোঙ্কণে স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠার বাসনা তাঁর মনে কি একবারও জাগেনি?
কিন্তু শেষপর্যন্ত তিনি তারাবাইয়ের অনুগত থাকাই স্থির করলেন। তারাবাইয়ের প্রতি তাঁর অশেষ শ্রদ্ধা। তাঁকে ত্যাগ করে মুঘলদের শিবিরে মানুষ হয়েছে এমন একজনকে সমর্থন করার কথা তিনি চিন্তাও করতে পারলেন না। তা ছাড়া তারাবাই তাঁকে সরখেলের পদমর্যাদা দিয়েছেন, কোঙ্কনের শাসনকর্তা নিযুক্ত করেছেন। তিনি অকৃতজ্ঞ নন, তারাবাইয়ের নুন খেয়েছেন, তাঁকে তিনি ত্যাগ করতে পারবেন না।
কানোজি আংরে তাঁর বিবেকের নির্দেশেই চললেন। দৃঢ়চেতা মানুষটি প্রচণ্ড প্রভাবশালী গুরুজির সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ হতে পারে জেনেও নিজের সিদ্ধান্তে অটল রইলেন।
উনিশ
শাহু ফিরে আসছেন। তাঁর অনুচরদের কেউ দক্ষ সেনাপতি নয়, কিন্তু দুজন শক্তিশালী মানুষের সমর্থন তিনি পেয়েছেন। তিনি জানতেন প্রধান মারাঠা সেনাপতি ধানাজি যাদবের সচিব বালাজি বিশ্বনাথ আর তাঁর গুরু ব্রহ্মেন্দ্র স্বামী তাঁর পিছনে আছেন।
তিনি তারাবাই এবং সমস্ত মারাঠা সর্দারের কাছে খত পাঠালেন। তারাবাই তাঁকে সমস্ত শক্তি দিয়ে বাধা দেবার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলেন। জনা কয়েক মারাঠা সর্দার অবশ্য শাহুর পক্ষ অবলম্বন করলেন। কিন্তু তবু যখন তিনি দাক্ষিণাত্যের সীমান্তে পৌঁছুলেন তখন তাঁর অনুচরের সংখ্যা নগণ্য।
শাহুর দাবি কিন্তু অনেক প্রবল। তিনি শাম্ভাজির পুত্র। তারাবাই তাঁর জড়বুদ্ধিসম্পন্ন পুত্রের প্রতিভূরূপে রাজকার্য পরিচালনা করছিলেন। মারাঠা সিংহাসনের প্রকৃত উত্তরাধিকারী মুঘলদের হাতে বন্দি এবং তাঁর ফিরে আসার কোনো সম্ভাবনা নেই ভেবেই রাজারাম ও তারাবাইয়ের পুত্রকে মারাঠা সিংহাসনের ভাবী উত্তরাধিকারী নির্বাচিত করা হয়েছিল। এখন শাহু ফিরে আসছেন তাই দেখা দিয়েছে সমস্যা। যাঁরা এতদিন তারাবাইয়ের ব্যক্তিত্ব এবং সাহসিকতায় তাঁর প্রতি আনুগত্য স্বীকার করেছিলেন, তাঁরা মুঘল শিবিরে লালিত পালিত যুবকটিকে মনে প্রাণে চাননি।
মৃত্যুর পরেও ঔরঙ্গজেবের কূট কৌশল ব্যর্থ হয়নি, দাক্ষিণাত্যের আকাশে ঘনীভূত হয়েছে গৃহযুদ্ধের কালো মেঘ।
আরও একটা প্রশ্ন জেগেছিল অনেকের মনে— শাহু কি সত্যিই শাহু! তারাবাই তাঁকে একজন জাল, প্রতারক বলে ঘোষণা করেছেন। উনিশ-কুড়ি বছর আগে যে রুগ্ন বালকটিকে মুঘলরা বন্দি করে নিয়ে গিয়েছিল, তার সঙ্গে আজ যে নিজেকে শাহু বলে দাবি করছে তার কোনো মিল খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।
মারাঠা সর্দারদের যাঁরা তারাবাইয়ের ভোজসভায় অঙ্গীকারবদ্ধ হননি, তাঁরাও শাহুর সত্যিকার পরিচয় না জানা পর্যন্ত কোনো পক্ষ অবলম্বন না করে দূরে সরে রইলেন। মনে মনে তাঁরা হয়তো আশা করেছিলেন শেষপর্যন্ত শাহু একজন প্রতারক বলেই প্রমাণিত হবেন।
তারাবাইয়ের নিজের মনে বোধ হয় সন্দেহ ছিল না যে, শাহু একজন ভণ্ড। তিনি তাঁর বিশ্বস্ত সেনাপতি পারসোজি ভোঁসলেকে শাহুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে এ ব্যাপারে মতামত জানাবার জন্য পাঠালেন।
পারসোজি ভোঁসলে তাঁর ভাইকে সঙ্গে নিয়ে শাহুর শিবিরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন। পারসোজি আর শাহুর মধ্যে ছিল একই বংশের রক্তধারা (শাহুর উপাধিও ছিল ভোঁসলে)। পারসোজি ছত্রপতি শিবাজির খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন এবং শাহুকে বালক অবস্থায় যাঁরা দেখেছিলেন, তিনি ছিলেন তাঁদের একজন।
সম্ভ্রান্ত মারাঠাদের মধ্যে এক পংক্তিতে বসে খাবার ব্যাপারে একটা নিয়ম আছে। ভিন্ন বর্ণের মানুষ একই পংক্তিতে খেতে বসতে পারে না, তা ছাড়া শুধুমাত্র এক পরিবারের লোক একই থালি থেকে খাদ্য গ্রহণ করে।
গোদাবরী নদীর তীরে পারসোজির সঙ্গে শাহুর সাক্ষাৎ হল। শাহুকে দেখামাত্র ভোঁসলের স্থির বিশ্বাস হল শাহু ভণ্ড নয়। পরের দিন শাহু প্রকাশ্যে একটা উৎসবের আয়োজন করলেন। সেখানে পারসোজি ভোঁসলে আর তাঁর ভাই শাহুর সঙ্গে এক থালিতে আহারে বসলেন। অর্থাৎ শাহুকে তাঁরা পরমাত্মীয় বলে স্বীকার করে নিলেন। বলা বাহুল্য, পারসোজি এই ঘটনার পর শাহুর দলে যোগদানের কথা ঘোষণা করলেন। তাঁর এই সিদ্ধান্তে প্রভাবান্বিত হয়ে সন্দেহের দোলায় দুলছিলেন এমন কয়েক জন মারাঠা সেনাপতি চটপট শাহুর পক্ষ অবলম্বন করলেন। এখন আর তাঁদের মনে সন্দেহ নেই যে, শাহু শাহুই।
তারাবাই পারসোজি ভোঁসলেকে বিশ্বাসঘাতক বলে ঘোষণা করলেন। শাহুকে তিনি চিঠি লিখে জানালেন তাঁকে তিনি কখনোই ভণ্ড এবং মুঘলদের একজন চর ছাড়া অন্য কিছু ভাববেন না। সমস্ত শক্তি দিয়ে তিনি তাঁর প্রত্যাবর্তন রুখবেন।
তারাবাইয়ের চিঠি পেয়ে শাহু দমে গেলেন। তিনি জানতেন খুড়িমার কাছ থেকে তিনি বাধা পাবেন, কিন্তু তাঁকে বাধা দেবার জন্য তারাবাই যুদ্ধের পথ বেছে নিতেও দ্বিধা করবেন না— এ চিন্তা তিনি করেননি। এই সময় বর্ষা নামায় তাঁকে থামতে হল, একদিক দিয়ে সুবিধেই হল তাঁর পক্ষে। চার মাস অনিশ্চয়তার মধ্যে কাটল তাঁর। তাঁর অর্থ প্রায় নিঃশেষ, অনুচররা অস্থির হয়ে উঠেছে, একটা হেস্তনেস্ত করতে চায় তারা। যাই হোক, বর্ষার শেষে শাহু আবার যাত্রা শুরু করলেন। তখনও তিনি আশা করছেন তারাবাইয়ের সঙ্গে একটা বোঝাপড়ায় আসা হয়তো সম্ভব হবে, যুদ্ধের প্রয়োজন হবে না।
কিন্তু তারাবাই শাহুকে বাধা দেবার জন্য বদ্ধপরিকর। তিনি তাঁর প্রধান সেনাপতি ধানাজি যাদবকে শাহুর বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করতে আদেশ করলেন। আরও একজন সেনাপতি ওই অভিযানে ধানাজির সঙ্গে যোগ দিলেন, তাঁর নাম পরশুরাম পন্থ। শাহুর কাছে সংবাদ গেল শক্তিশালী এক মারাঠা বাহিনী এগিয়ে আসছে।
ভীম নদীর দুই তীরে শাহু আর তারাবাইয়ের বাহিনী পরস্পরের মুখোমুখি হল। নদীর উত্তর দিকে কোনোমতে খাড়া করা শাহুর বাহিনী আর তাদের বিপক্ষে দুজন সুদক্ষ সেনাপতির অধীনে দুটি শক্তিশালী মারাঠা বাহিনী। ধানাজি যাদব আর পরশুরাম পন্থ দুজনেই দুধ-ভাত হাতে নিয়ে তারাবাইয়ের কাছে অঙ্গীকারাবদ্ধ ছিলেন।
ধানাজি হয়তো দুর্ধর্ষ যোদ্ধা এবং শত যুদ্ধের নায়ক ছিলেন, কিন্তু তীক্ষ্ন বুদ্ধি বালাজি বিশ্বনাথ ছিলেন তখনকার শ্রেষ্ঠ কূটনীতিবিদ। তিনি যেমন করেই হোক ধানাজি যাদবকে মধ্যরাত্রে শাহুর সঙ্গে নির্দিষ্ট একস্থানে আলোচনায় বসতে সম্মত করালেন। আলোচনা শেষ হলে দেখা গেল ধানাজি যাদব পক্ষ বদল করেছেন। দুধ-ভাতের অঙ্গীকার বালাজির কূটবুদ্ধির কাছে খান খান হয়ে গেছে।
ধানাজির এই সিদ্ধান্তে পরশুরাম পন্থ বেকায়দায় পড়লেন। দুর্ধর্ষ ধানাজির বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না বিবেচনা করে তিনি সাঁতারায় ফিরে গেলেন।
যুদ্ধ শেষ। বিজয়মাল্য শাহুর কণ্ঠে। রণাঙ্গনেই শাহু ধানাজি যাদবকে তাঁর স্থলবাহিনীর প্রধান সেনাপতি বলে ঘোষণা করেছিলেন।
ধানাজিকে পাশে নিয়ে শাহু বিজয়গর্বে শোভাযাত্রা করে সাঁতারায় পৌঁছোলেন। অনতিবিলম্বে মারাঠা নৃপতিরূপে সিংহাসনে আরোহণ করলেন তিনি। তারাবাই তাঁর অনুচরদের নিয়ে কোলাপুরের কাছে পানহালা দুর্গে আশ্রয় নিলেন। ধানাজির এই দল পরিবর্তনে নিশ্চয়ই তিনি প্রচণ্ড আঘাত পেয়েছিলেন, কিন্তু সহজে দমবার পাত্রী ছিলেন না তিনি।
কুড়ি
জাঞ্জিরার অধিপতি সিদ্দি কাশেম ইয়াকুৎ খাঁ-ও ১৭০৭ সালে প্রাণত্যাগ করলেন। নতুন সিদ্দি, রসুল ইয়াকুৎ খাঁর মনোভাবে স্পষ্ট হয়ে উঠল যে, তিনি কানোজির সঙ্গে সদ্ভাব বজায় রেখে চলতে চান। একটা বোঝাপড়া হল তাঁদের মধ্যে। ফলে যে সাগর-গড় নিয়ে কানোজি আর সিদ্দির মধ্যে প্রায়ই বিবাদ লেগে ছিল সেটা যৌথ সম্পত্তিরূপে গণ্য হল। সিদ্দি এবং মারাঠা, দু-পক্ষের পতাকাই উড়ল দুর্গ শিখরে।
কানোজি এখন তাঁর উপকূল দুর্গগুলি আরও সুরক্ষিত করার এবং নৌশক্তি ব্যাপক বৃদ্ধির দিকে সচেষ্ট হতে পারবেন। সিদ্দির সঙ্গে বিরোধ মিটে যাওয়ায় উপকূল ভাগে অন্য দুই বিদেশি শক্তি, ইংরেজ এবং পোর্তুগিজদের অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধেও উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করার সুযোগ পাবেন তিনি।
কিন্তু নতুন এক শত্রুর আবির্ভাব হয়েছে তাঁর জীবনে, প্রবল পরাক্রান্ত শত্রু— নতুন মারাঠা নৃপতি। সাঁতারায় পূর্ণ বৈদিক অনুষ্ঠানে ব্রাহ্মণদের দ্বারা অভিষেক সমাপ্ত হয়েছে। ব্রহ্মেন্দ্র স্বামী নতুন রাজাকে আশীর্বাদ জানিয়েছেন।
শাহু ভণ্ড নয়— এটা প্রমাণিত হবার পরেও এবং বেশিরভাগ বিশিষ্ট মারাঠা সর্দার তাঁকে রাজা বলে স্বীকার করে নেওয়া সত্ত্বেও, কানোজি কিন্তু তাঁর সিদ্ধান্তে অটল আছেন। তা ছাড়া, শাহুকে ঠিক বিশ্বাস করতে পারছেন না তিনি। মুঘলদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন শাহু। মুঘলরাও খোলাখুলি তারাবাইয়ের বিরুদ্ধে শাহুকে সমর্থন জানাচ্ছে।
একসময় যিনি শাম্ভাজির বিশ্বস্ত ও অনুগত ছিলেন সেই কানোজি এখন শাম্ভাজিরই পুত্রের বিরুদ্ধাচরণে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। অসমসাহসী এই বীর পুরুষটির নাম এখন দাক্ষিণাত্যে রূপকথার নায়কের মতো মানুষের মুখে মুখে। সুবিধেমতো দল বদলাবার মানুষ তিনি নন, বাতাসের গতির সঙ্গে পাগড়ি বদলান না তিনি।
* * *
১৭১১। চার বছর কেটে গেছে।
কানোজিকে স্বপক্ষে রাখার জন্য তারাবাই ঘোষণা করলেন রাজমাচি দুর্গ তিনি কানোজির হাতে তুলে দিলেন।
রাজমাচি হল কাণ্ডালা বন্দরের কাছে। কোঙ্কণের প্রাকৃতিক সীমানার বাইরে। কিন্তু কোঙ্কণের পক্ষে ওটার গুরুত্ব অসাধারণ। যে গিরিমালা কোঙ্কণকে দাক্ষিণাত্যের অবশিষ্ট অংশ থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে, সেই সীমান্ত অঞ্চলেই তখন চলছে গৃহযুদ্ধ— তারাবাই আর শাহুর সেনাবাহিনীর মধ্যে। পার্বত্য অঞ্চল দিয়ে উত্তর কোঙ্কণ আক্রান্ত হলে দুটো গুরুত্বপূর্ণ দুর্গ থেকে সেই আক্রমণ প্রতিহত করা সম্ভব। একটা হল রাজমাচি আর অন্যটা লৌহগড়। গিরিমালা আর উত্তর কোঙ্কণের মাঝখানে প্রধান গিরিপথ (বোরঘাট) নিয়ন্ত্রণ করছে ওই দুটো কেল্লা। রাজমাচি যার দখলে তার পক্ষে ওই গিরিপথ অনুশাসনে রেখে সাঁতারা আর উত্তর কোঙ্কণের মধ্যে চলাচল একেবারে স্তব্ধ করে দেওয়া সম্ভব।
রাজমাচি হল বোরঘাটে, এখন যেটা বোম্বাই-পুণা সড়ক, সেই সড়কের উপর। প্রায় তিন মাইল জুড়ে দুর্গের প্রাচীরে। ষাট ফুট উঁচু পাথরের কেল্লা। কেল্লার দেয়াল এমন খাড়া যে বলা হত গিরগিটির পর্যন্ত পা রাখার জায়গা নেই।
রাজমাচি দখলে আসার অর্থ কানোজির প্রচুর শক্তি বৃদ্ধি। মুশকিল হল ওই দুর্গের অধ্যক্ষ পুরোপুরি শাহুর পক্ষে। তারাবাই চাইছিলেন গুরুত্বপূর্ণ কেল্লাটি কানোজি দখল করুক। তারাবাইয়ের এই উদ্দেশ্যের পিছনে গূঢ় অর্থ ছিল। শাহু বোম্বাইয়ের গভর্নর স্যার নিকোলাস ওয়েটের কাছে কামান আর গোলাবারুদের জন্য আবেদন করেছিলেন। রাজমাচি কানোজির নিয়ন্ত্রণে এলে ইংরেজদের সঙ্গে শাহুর যোগাযোগে মস্ত বাধা সৃষ্টি হবে। কিন্তু যে দুর্গের দেয়াল বেয়ে ওঠা গিরগিটির পক্ষেও কষ্টকর তা দখল করা সহজ নয়।
এদিকে ইংরেজ আর পোর্তুগিজদের সঙ্গেও কানোজির সম্পর্ক দিন দিন অবনতি ঘটছে। দীর্ঘকাল রাজমাচি অবরোধ করা তাঁর পক্ষে বুদ্ধিমানের কাজ হবে না, বিশেষ করে ওই কেল্লা তাঁর সদর ঘাঁটি থেকে বেশ দূরে।
তিনি ঘেরিয়া আর কোলাবার দুর্গ ইতিমধ্যে সুদৃঢ় করেছেন, আর কোঙ্কণে চালু করেছেন নিজের নামাঙ্কিত মুদ্রা।
শাহু আর তারাবাইয়ের মধ্যে মুখোমুখি সংঘর্ষ তখনও কিন্তু হয়নি। তারাবাইয়ের অনুচরের সংখ্যা কম না হলেও, স্থলবাহিনীর নেতৃত্ব দেবার মতো সুদক্ষ সেনাপতির তখন তাঁর বড়োই অভাব। অপরদিকে শাহু কোমল স্বভাবের মানুষ ছিলেন। নিজের আত্মীয়স্বজনের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরার বড়ো-একটা ইচ্ছে তাঁর ছিল না। তাই তারাবাইয়ের সঙ্গে চূড়ান্ত ফয়সালা আজ না কাল করে তিনি ফেলে রেখেছিলেন।
ওই বছরেই অর্থাৎ ১৭১১ সালে শাহুর প্রধান সেনাপতি ধানাজি যাদব প্রাণত্যাগ করলেন। ধানাজির পুত্র চন্দ্র সেন যাদব পিতার পদে উন্নীত হলেন। শুধু ধানাজির পুত্র বলেই তিনি ওই পদ পেয়েছিলেন— একথা বলার অপেক্ষা রাখে না। চন্দ্র সেন ছিলেন দাম্ভিক, বদমেজাজী এবং সঙ্কীর্ণমনা এক যুবক। শাহুর নিজেরও চন্দ্র সেনের উপর বিশেষ আস্থা ছিল না, তাঁর সামরিক দক্ষতা সম্বন্ধেও তিনি সন্দিহান ছিলেন। তিনি চন্দ্র সেনকে বেশি গুরুত্ব না দেবার উদ্দেশ্যে বালাজি বিশ্বনাথকে সামরিক ব্যাপারে চন্দ্র সেনের সমান মর্যাদা দিলেন। এই অবস্থায় তাঁদের দুজনের উপর দ্বৈত দায়িত্ব বর্তাল। চন্দ্র সেন এটা খুশি মনে মেনে নিতে পারলেন না, ফলে একটা বিরোধের সূত্রপাত হল। মাস কয়েকের মধ্যেই চন্দ্র সেন আর বালাজি বিশ্বনাথের মধ্যে খোলাখুলি সংঘর্ষ হয়ে গেল।
সাঁতারার পঞ্চাশ মাইল দক্ষিণে কারাদ। ওর কাছাকাছি চন্দ্র সেনের বাহিনী ছাউনি ফেলেছিল। একদিন বালাজির কয়েক জন ভৃত্য একটি মৃগকে তাড়া করে ওখানে এসে পড়ে। হরিণটা প্রাণভয়ে আশ্রয় নিল চন্দ্র সেনের একজন কর্মচারীর তাঁবুর ভিতর। ওই কর্মচারী হরিণটিকে হত্যা করতে বাধা দিলে বচসার সৃষ্টি হয়। ব্যাপারটা দু-পক্ষেরই প্রভুর কান পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছোল। তাঁরাও এ ব্যাপারে পক্ষ নিলেন ফলে একটা ছোটোখাটো সংঘর্ষই বেধে গেল। বালাজির পক্ষ ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল সেই সংঘর্ষে। বালাজি স্বয়ং তাঁর নয় বছরের পুত্র বাজীরাওকে নিয়ে আত্মগোপন করতে বাধ্য হলেন। শাহু আর চুপ থাকতে পারলেন না, হস্তক্ষেপ করলেন এ ব্যাপারে। বালাজিকে তিনি আশ্রয় দিলেন। চন্দ্র সেন শাসালেন, বালাজিকে তাঁর হাতে তুলে না দিলে তিনি তারাবাইয়ের পক্ষে চলে যাবেন। শাহু তাঁর এই উদ্ধত দাবি মেনে নিতে পারলেন না। চন্দ্র সেন তখন সদলবলে তারাবাইয়ের সঙ্গে হাত মেলালেন।
শাহুর পক্ষে এটা মস্ত একটা দুর্ঘটনা। এদিকে ইংরেজরা তাঁর আবেদনে সাড়া দিয়ে গোলাবারুদ সরবরাহের ব্যাপারে মোটেই উৎসাহ দেখাচ্ছে না। মুঘলরা এতদিনে স্পষ্টই তাঁকে জানিয়ে দিল তারাবাইকে যুদ্ধে পরাস্ত না করা পর্যন্ত শাহুকে তারা মারাঠা নৃপতি বলে স্বীকার করবে না। শাহু বুঝতে পারলেন মুঘলরা পরোক্ষভাবে তাঁকে সাহায্য করবে না বলেই জানিয়ে দিল। মুঘলদের সাহায্য ছাড়াই যদি তিনি তারাবাইকে পরাস্ত করতে পারেন তবে মুঘলদের সাহায্যের কীসের দরকার তাঁর।
শাহুর এই দুঃসময়ে একমাত্র বালাজি বিশ্বনাথই অনড় পাথরের মতো তাঁর পাশে ছিলেন। তিনি পুণায় তাঁর অসংখ্য বন্ধুবান্ধব এবং আধ্যাত্মিক গুরু ব্রহ্মেন্দ্র স্বামীর কাছ থেকে প্রচুর অর্থ ধার করে সুশৃঙ্খল এক সৈন্যবাহিনী গড়ে তোলার দিকে মন দিলেন।
এদিকে তারাবাইয়ের সংকট কিন্তু শাহুর চাইতে অনেক গুরুতর। স্মরণ থাকতে পারে মৃত্যুকালে রাজারাম দুই পত্নী এবং দুই পত্নীর গর্ভে দুই সন্তান রেখে গিয়েছিলেন। তারাবাই ছিলেন জ্যেষ্ঠা পত্নী। তিনি তাঁর পুত্রকে সিংহাসনে বসিয়ে রাজপ্রতিনিধিরূপে রাজকার্য পরিচালনা করছিলেন। সতীন এবং সতীন পুত্রকে প্রথম সুযোগেই বন্দি করেছিলেন তিনি। এই ক-বছরে তারাবাই কিছুটা অসাবধান হয়ে পড়েছিলেন। এই সুযোগে রাজারামের দ্বিতীয় পত্নী আঘাত হানলেন। কয়েক জন বিশ্বস্ত অনুচরের সাহায্যে রাতারাতি তিনি তারাবাই আর তাঁর পুত্রকে বন্দি করে কারাগারে নিক্ষেপ করে পুত্র শাম্ভাজিকে রাজা বলে ঘোষণা করতে দ্বিরুক্তি করলেন না। মারাঠা সিংহাসনে উদয় হল নতুন এক প্রতিদ্বন্দ্বীর। শাম্ভাজির (২য়) বংশধররা এখনও কোলাপুরে বাস করেন। ভারতবর্ষ স্বাধীন হবার আগে এবং দেশীয় রাজ্যগুলির ভারতের সঙ্গে অন্তর্ভুক্তির পূর্বে তাঁরা কোলাপুরের শাসক বলে পরিচিত ছিলেন।
মারাঠা ইতিহাস থেকে তারাবাই মুছে গেলেন। বাকি জীবন কারাগারেই অতিবাহিত করতে হয়েছিল তাঁকে। এই ঘটনার কয়েক মাস পরে যে ছেলের প্রতিনিধিরূপে তারাবাই রাজকার্য পরিচালনা করছিলেন সেই হাবাগোবা ছেলেটিরও মৃত্যু হল।
শাহুকে আর তারাবাইয়ের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হতে হল না। তাঁর নতুন প্রতিদ্বন্দ্বী তখন সতেরো বছর বয়সের এক কিশোর। কিন্তু তাঁর প্রবল প্রতিপক্ষ সেই কিশোর নয়, তিনি হলেন কানোজি আংরে।
একুশ
শাহু ছিলেন বিলাসী এবং আয়েশি, কিন্তু পিতার মতো নিষ্ঠুর ছিলেন না তিনি। যারা তাঁর বিরুদ্ধাচারণ করেছিল তাদের প্রতি তিনি নির্দয় হয়ে ওঠেননি। এমনকী তাদের কয়েক জনকে দায়িত্বপূর্ণ পদে নিযুক্ত করতেও তিনি ইতস্তত করেননি।
কানোজি আংরে এই কয় বছর কোঙ্কণে শান্ত অবস্থার পূর্ণ সুযোগে নিয়েছেন। উপকূলবর্তী গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র এবং সেখানকার ‘গড়’ বা দুর্গ সুরক্ষিত করে তুলেছেন তিনি। বোম্বাই থেকে গোয়া প্রায় সম্পূর্ণ উপকূল এখন তাঁর নিয়ন্ত্রণে। প্রায় প্রত্যেকটি খাঁড়ি, পোতাশ্রয় এবং নদীর মুখে তিনি নৌ-ঘাঁটি বসিয়েছেন।
ইউরোপীয় নৌবহরের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তাঁর নৌবহর তিনি সংস্কার করেছেন। পাঁচটি জাহাজ নির্মাণ কারখানা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন কানোজি। বিদেশি কুশলীদের নির্দেশে শত শত শ্রমিক সেসব কারখানায় কাজ করত। তাঁর নৌবাহিনীর সবাইকে তিনি নিয়মিত বেতন দিতেন, তাদের চাকরির শর্তাবলি ইংরেজ কিংবা পোর্তুগিজদের চাইতেও অনেক বেশি লোভনীয় ছিল। ক্রিশ্চান, ওলন্দাজ, পোর্তুগিজ, আরব, মুসলমান এবং নিগ্রোরা তাঁর চাকরির শর্তে প্রলুব্ধ হয়ে মারাঠা নৌবাহিনীতে যোগ দিয়েছিল। এরা সবাই দুঃসাহসী, নির্ভীক। তাই গড়ে উঠল এক শক্তিশালী মারাঠা নৌবাহিনী— কানোজির নিজের হাতে গড়া।
এখন তাঁর অধীনে দশটি ঘুরাব, প্রত্যেকটিতে ষোলো থেকে ত্রিশটি কামান। তা ছাড়া পঞ্চাশটি গালিভাত, প্রত্যেকটিতে চার থেকে দশটি কামান।
সাংঘাতিক একটা নৌবহর না হলেও প্রত্যেকটি রণতরীর মাঝি মাল্লা পর্যন্ত যুদ্ধকুশলী। পোর্তুগিজদের সঙ্গে কানোজির বিরোধ বেধেছে। চাওলের পোর্তুগিজ গভর্নর তাঁর আজীবনের সঞ্চিত ধনরত্ন নিয়ে স্বদেশে ফিরছিলেন। কানোজি সেই জাহাজ (একটা ‘পাল’) দখল করলেন, সেইসঙ্গে বন্দি করলেন গভর্নরকেও। অল্প কিছুদিন পরে পোর্তুগিজদের দুটো রণতরীর (গান বোট) সঙ্গে তাঁর সংঘর্ষ হল। একটাকে তিনি ডুবিয়ে দিলেন অন্যটা দখল করলেন।
প্রত্যেক বছর পোর্তুগিজ বাণিজ্য জাহাজের এক বহর প্রচুর দ্রব্য সম্ভার এবং ধনদৌলত নিয়ে পোর্তুগালে যাত্রা করত। ওদের বলা হত ‘আর্মাডো’। বাণিজ্যপোতগুলিকে পাহারা দিয়ে নিয়ে যেত শক্তিশালী যুদ্ধ জাহাজ। ১৭১২ সালে কানোজি ‘আর্মাডো’ আক্রমণ করলেন। ওদের সঙ্গে ছিল দুটি রণতরী। একটায় চৌত্রিশটি কামান। সেটাকে অচল করে দেওয়া হল, অন্যটা পালিয়ে বাঁচল। অধিকাংশ বাণিজ্যপোতই কানোজির হাতে এল।
পোর্তুগিজদের পক্ষে এই বাণিজ্য নৌবহর হাতছাড়া হওয়ার অর্থ চরম ক্ষতি, কারণ এই ‘আর্মাডো’ গোয়ার বণিকদের সারা বছরের বাণিজ্যদ্রব্য এবং সঞ্চয় বহন করত।
ইতিমধ্যে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিও ধীরে ধীরে শক্তিশালী নৌবহর গড়ে তুলেছিল। তাদের সঙ্গে সংঘর্ষ এড়াবার জন্য কানোজি আর উৎকণ্ঠিত নন। অধিকতর শক্তিশালী নৌযানের বিরুদ্ধে কানোজির রণকৌশল ছিল অন্যরকম। বৃহদাকার ইউরোপীয় জাহাজ কূলের নিকটবর্তী হলেই তাদের গতি কমিয়ে দিতে হত। ঠিক তখনই লুকোনো জায়গা থেকে কানোজির রণতরীগুলি বেরিয়ে এসে তাদের ওপর চড়াও হত। দাঁড়-টানা নৌকাগুলি যোদ্ধা বোঝাই হয়ে ক্ষিপ্র গতিতে তাড়া করত তাদের। এ ধরনের আক্রমণে মারাত্মক অস্ত্রবাহী জাহাজও আক্রমণকারীদের সংখ্যাধিক্যের কাছে নতিস্বীকার করতে বাধ্য হত। কানোজির নৌবহর সবসময় আক্রান্ত জাহাজের দু-পাশে থাকার চেষ্টা করত, মুখোমুখি হয়ে সহজ নিশানার বলি হত না, আর সেইসঙ্গে পাল-মাস্তুল লক্ষ করে গোলাবর্ষণ করত। ফলে আক্রান্ত জাহাজ সহজেই কাবু হয়ে পড়ত। যদি অনুসরণকারী কোনো গালিভাত, ওই সংঘর্ষে ডুবে যেত তবে সঙ্গেসঙ্গে আরেকটা স্থান নিত তার।
গালিভাতের পিছন পিছন আসত ঘুরাব। তারাও আক্রান্ত জাহাজের পাশ থেকে তাদের বড়ো বড়ো কামান দিয়ে পাল-মাস্তুল লক্ষ করে গোলাবর্ষণ করত। আসলে গালিভাতই ওদের টেনে নিয়ে সুবিধে মতো জায়গায় দাঁড় করাত। প্রত্যেকটি ঘুরাব থেকে একসঙ্গে গোলা বর্ষিত হবার পরই ওটা সরে গিয়ে অন্য আরেকটিকে স্থান করে দিত।
কঠোর পরিশ্রমে কানোজি সুদক্ষ গোলন্দাজ বাহিনী গড়ে তুলেছিলেন। তবু উৎকৃষ্ট আগ্নেয়াস্ত্রের বিরুদ্ধে তিনি সবসময় চেষ্টা করতেন উপকূল রক্ষীর কামানের আওতার মধ্যে থাকার। তাদের সাহায্যের ওপর যথেষ্ট নির্ভরশীল ছিলেন তিনি।
অসি যুদ্ধে মারাঠাদের নৈপুণ্যের কথা আগেই বলা হয়েছে। ফলে আক্রান্ত জাহাজে কোনোক্রমে একবার তারা উঠতে পারলে আর তার রক্ষা ছিল না।
প্রসঙ্গক্রমে একটা কথা বলা দরকার। ইংরেজরা কানোজিকে জলদস্যু বলে অভিহিত করেছিল, অথচ তাদের নিজেদের দেশে যেসব নৌসেনাপতি বিদেশের বাণিজ্য জাহাজ লুণ্ঠন করে দস্যুতা করত তাদের বীরের মর্যাদা দেওয়া হত। হকিন্স, গ্রেণ ভিল, ড্রেক এঁরা সবাই জাতীয় বীরের সম্মান পেয়েছেন, কিন্তু কোনো না কোনোসময় তাঁরা সবাই বিদেশি জাহাজ লুণ্ঠন করতে দ্বিধা করেননি।
নতুন নৌবহর এবং সুদক্ষ নৌবাহিনী নিয়ে কানোজি নির্ভয়ে ইংরেজ আর পোর্তুগিজ জাহাজ আক্রমণ শুরু করলেন। ১৭১২ সালে কোম্পানির দুটো জাহাজ দখল করলেন তিনি। তার মধ্যে একটা গভর্নরের নিজস্ব সশস্ত্র প্রমোদ তরী, অন্যটা দু-মাস্তুলের ছোটো একটা বাণিজ্য জাহাজ ‘অ্যানি’।
বাণিজ্য জাহাজ অ্যানিতে গোলমরিচ, মোম আর কাঠ বোঝাই ছিল। কারওয়ার থেকে ওটা যাত্রা করেছিল, গন্তব্যস্থল বোম্বাই। গভর্নরের সশস্ত্র প্রমোদ তরী ছাড়াও একটা বড়ো যুদ্ধ জাহাজ ‘ডিফায়েন্স’ চলেছিল অ্যানিকে পাহারা দিয়ে। ওটাতে চোদ্দোটা কামান ছিল।
কারওয়ার ত্যাগ করার একদিন পরেই ভেঙ্গুরলার কাছে কানোজির চারটি রণতরীর মুখোমুখি হল ‘অ্যানি’ আর তার রক্ষক জাহাজ দুটি। লড়াই শুরু হবার সঙ্গে সঙ্গেই যুদ্ধ জাহাজ ডিফায়েন্স চোদ্দোটি কামান থাকা সত্ত্বেও নিজের নামে অপবাদ দিয়ে রণে ভঙ্গ দিল। তিনটে পাল তুলে দ্রুত ওটা পালিয়ে গেল বোম্বাই। গভর্নরের প্রমোদ তরী দুটো মাস্তুল ভেঙে না পড়া পর্যন্ত সাহসে ভর করে যুদ্ধ চালাল। অ্যানিও সেই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল, কিন্তু শেষপর্যন্ত তার গোলাবারুদ নিঃশেষ হয়ে যায়। অবস্থা গুরুতর উপলব্ধি করে ওটা কারওয়ারে ফিরে যাবার চেষ্টা করল, কিন্তু দুটো ঘুরাব তাড়া করে ধরে ফেলল তাকে। জাহাজ দুটিকে ঘেরিয়ায় নিয়ে যাওয়া হল, আর বন্দিদের নিয়ে যাওয়া হল কোলাবায়।
কয়েক দিনের মধ্যেই কানোজি জাহাজ দুটির ক্যাপ্টেন, প্রধান সহকারী এবং একজন ইংরেজ মহিলাকে মুক্তিপণ হিসেবে রেখে বাকি সবাইকে ছেড়ে দিলেন। মুক্তিপণ হিসেবে তিনি দাবি করলেন ত্রিশ হাজার টাকা। বোম্বাইয়ে কোম্পানির কর্তৃপক্ষ মুক্তিপণ দিতে দ্বিরুক্তি করলেন না।
অ্যানি এবং গভর্নরের প্রমোদতরীকেও ফিরিয়ে দেওয়া হল, কিন্তু প্রমোদতরীটার এমন ক্ষতি হয়েছিল যে ওটা আর ব্যবহারের উপযোগী ছিল না।
এই ঘটনায় বোম্বাইয়ে দারুণ হইচই পড়ে গেল। ডিফায়েন্সের ক্যাপ্টেনকে সঙ্গে সঙ্গে বরখাস্ত করা হল।
পরের মাসেই ইংল্যান্ড থেকে কোম্পানির দুটি জাহাজ আসছিল বোম্বাইয়ের পথে। কানোজির একটা ঘুরাব আর একটা গালিভাত আক্রমণ করল তাদের। জাহাজ দুটি পালিয়ে বাঁচল, কিন্তু সশস্ত্র এবং বৃহদাকার জাহাজের বিরুদ্ধে কানোজির ক্ষুদে রণতরীর ঔদ্ধত্যে স্তম্ভিত হয়ে গেল ইংরেজরা।
গোয়ায় পোর্তুগিজরাও উদবিগ্ন হয়ে উঠেছিল। আগের বছর ‘আর্মাডো’র ভাগ্যে যা জুটেছিল তার যাতে পুনরাবৃত্তি না ঘটে তার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল তারা। গোয়ার ভাইসরয় বোম্বাইয়ে কোম্পানির গভর্নরের কাছে কানোজির বিরুদ্ধে যৌথ আক্রমণের প্রস্তাব দিয়ে চিঠি লিখলেন।
একমাস আগে হলে ইংরেজ গভর্নর এ প্রস্তাবে লাফিয়ে উঠতেন। এখন কিন্তু এ ব্যাপারে তাঁর তেমন উৎসাহ ছিল না, কারণ মাত্র দিন কয়েক আগেই কানোজি কোম্পানির সঙ্গে সন্ধির প্রস্তাব দিয়েছিলেন।
বোম্বাইয়ের গর্ভনর সন্ধির শর্ত হিসেবে নিজেদের সুবিধেমতো কয়েকটা অনুচ্ছেদ জুড়ে দিয়েছিলেন। কানোজির অবশ্য তখন তা না মেনে উপায় ছিল না। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন শাহুর সঙ্গে চূড়ান্ত ফয়সালার সময় হয়ে এসেছে। একইসঙ্গে স্থলে ও জলে একাধিক শত্রুর বিরুদ্ধে সংগ্রামে অবতীর্ণ হওয়া বুদ্ধিমানের কাজ হবে না মনে করেই ইংরেজদের দিক থেকে নিজেকে তিনি বিপন্মুক্ত রাখতে চেয়েছিলেন।
১৭১৩ সালের এপ্রিল মাসে কানোজি আংরে আর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মধ্যে সন্ধি চুক্তি স্বাক্ষরিত হল।
বাইশ
রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম এবং মুঘল সিংহাসনে দাবিদারের প্রশ্নের মীমাংসার পর দাক্ষিণাত্যে আবার নজর দেবার সময় পেল মুঘল বাহিনী। তবে ঔরঙ্গজেবের মতো সমগ্র দাক্ষিণাত্য জয়ের দুরাশা আর তাদের নেই। মারাঠারা তাদের প্রভুত্ব স্বীকার করে নিলেই তারা খুশি।
আশ্চর্যের কথা, মারাঠাদের দু-ভাগই তখন মুঘলদের কর্তৃত্ব মেনে নিজে রাজি। গৃহযুদ্ধে জর্জরিত মারাঠারা বুঝতে পেরেছে মুঘলদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হবার দিন চলে গেছে। সমগ্র দাক্ষিণাত্যে স্বাধীন অখণ্ড এক মারাঠা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রশ্নও তখন সুদূরপরাহত। দু-পক্ষই চাইছে মুঘলরা তাদের স্বীকার করুক। শাহু এবং রাজারামের দ্বিতীয় পত্নীর গর্ভজাত সন্তান শাম্ভাজি দুজনেই ভাবছেন মুঘলদের সহায়তায় অপরপক্ষকে পরাজিত করা যায় কিনা।
মারাঠাদের চির শত্রুকে তখন ঘরোয়া বিবাদে সালিশ মানা হচ্ছে। অদৃষ্টের কী নিষ্ঠুর পরিহাস!
গোড়ার দিকে মুঘলরা শাহুর দাবিকেই সমর্থন জানিয়েছিল। কিন্তু তারা যখন বুঝতে পারল শাহু তাদের সাহায্যপ্রার্থী হলেও তাদের ক্রীড়াপুত্তলি হতে মোটেই ইচ্ছুক নয় তখন তারা ইতস্তত করতে লাগল। শাহুকে তারা বলেছিল তারাবাইকে যুদ্ধে পরাস্ত করতে পারলে তবেই তারা তাঁকে মারাঠা নৃপতি বলে স্বীকার করবে।
১৭১৩ সালে দাক্ষিণাত্যের মুঘল শাসনকর্তা শাম্ভাজিকেই সমর্থন জানাল। শাম্ভাজি তখন কোলাপুরে তাঁর রাজধানী প্রতিষ্ঠা করেছেন। চন্দ্র সেন যাদব যোগ দিয়েছেন তাঁর সঙ্গে। তিনি মুঘলদের সহযোগিতায় সদলবলে শাহুর রাজধানী সাঁতারা অভিমুখে যাত্রা করলেন।
শাহুর সেনাবাহিনীতে ধানাজি যাদবের পর দক্ষ সেনাপতি তেমন কেউ ছিল না, কিন্তু বালাজি বিশ্বনাথের সাংগঠনিক প্রতিভার ফল ফলতে শুরু করেছিল। তিনি সে সময় শাহুর প্রধান সামরিক উপদেষ্টা। মুঘল আর শাম্ভাজির সেনাবাহিনীর সম্মিলিত আক্রমণের মুখে তিনি মোটেই ভীত হলেন না। সুকৌশলে পিছিয়ে এসে কালক্ষেপ করতে লাগলেন। তিনি জানতেন বর্ষা শুরু হবার আগে পর্যন্ত তিনি যদি শত্রুপক্ষকে কোনোমতে ঠেকিয়ে রাখতে পারেন তবে সাঁতারার বিপদ কেটে যাবে। তাঁর সৌভাগ্যই বলতে হবে, সেবার বর্ষা একটু আগেই নামল। বর্ষাকে ভীষণ ভয় মুঘলদের। তারা জানে বর্ষায় তারা যখন আটকা পড়বে তখন মারাঠা সেনারা তাদের ওপর চোরা আক্রমণ চালাবে, অতিষ্ট করে তুলবে তাদের জীবন। তারা তাড়াতাড়ি ঔরঙ্গাবাদে তাদের ছাউনিতে গিয়ে আশ্রয় নিল। সাঁতারার বিপদ কেটে গেল তখনকার মতো।
বালাজির এই বিচক্ষণতায় শাহু তাঁর ওপর আরও নির্ভরশীল হয়ে পড়লেন। তিনি তাঁকে স্থলবাহিনীর সেনাপতির পদে উন্নীত করলেন। শাহুর দরবারে তিনজন প্রধানের বালাজি হলেন অন্যতম। প্রথম জন হলেন পেশোয়া বা প্রধানমন্ত্রী, তাঁর নাম বহিরোপন্থ পিংলে। দ্বিতীয় জন প্রধান সেনাপতি এবং তৃতীয় হলেন বালাজি বিশ্বনাথ।
মুঘলদের বিরুদ্ধে সুপরিকল্পিতভাবে পিছিয়ে আসা ছাড়া বালাজি বিশ্বনাথ কিন্তু এ পর্যন্ত রণকৌশলের কোনো স্বাক্ষর রাখতে পারেননি। বরং চন্দ্র সেনের সঙ্গে বিবাদের ফলে তাঁকে শাহুর আশ্রয় ভিক্ষা করতে হয়েছিল। সম্প্রতি দামাজি থোরাট নামে একজন বিদ্রোহী সর্দারকে দমন করতে গিয়ে তিনি বন্দি হন। তাঁকে মুক্ত করার জন্য শাহুকে প্রচুর মুক্তিপণ দিতে হয়েছিল।
পরের বছর শাহু তাঁর দরবারের তিন প্রধানের উপর তিনটি বিশেষ দাযিত্ব অর্পণ করলেন। প্রধান সেনাপতি পন্থ সচিবকে পাঠানেল দামাজি থোরাটকে দমন করার জন্য। বালাজি বিশ্বনাথকে তিনি প্রেরণ করলেন কট্টাওকর নামে আর একজন বিদ্রোহী সর্দারের বিরুদ্ধে, আর তাঁর প্রধানমন্ত্রীর উপর ভার পড়ল এক বিদ্রোহী সেনাপতিকে দমন করার— সেই সেনাপতি হলেন কানোজি আংরে। শাহুর উদ্দেশ্য ছিল কানোজিকে দমন করে সমগ্র কোঙ্কণ তাঁর শাসনে আনা।
দামাজি থোরাটের বিরুদ্ধে পন্থ সচিব শোচনীয়ভাবে পরাস্ত হলেন। থোরাট আগের বছরের ঘটনার পুনরাবৃত্তি করে পন্থ সচিবকে বন্দি করল।
বালাজি বিশ্বনাথ কিন্তু এবার বিজয়ী হয়ে ফিরলেন।
এবার পেশোয়ার অভিযানের কথায় আসা যাক। কানোজি অনেক আগেই এমন আক্রমণের সম্ভাবনায় নিজেকে প্রস্তুত করছিলেন। ইংরেজদের সঙ্গে সন্ধি করার ফলে তখন তিনি শাহুর সৈন্যবাহিনীর বিরুদ্ধে পূর্ণ শক্তি নিয়োগ করতে সক্ষম। তিনি বুঝেছিলেন আক্রমণ আসবে বোরঘাট গিরিপথ দিয়ে। আগেই বলা হয়েছে রাজমাচি কেল্লা যার দখলে, ওই গিরিপথ নিয়ন্ত্রণ করা তার পক্ষে সহজসাধ্য।
তিনি চমৎকার একটা ফাঁদ পাতলেন আর বহিরোপন্থ পিংলে সোজা হেঁটে সেই ফাঁদে পা দিলেন।
কানোজি মারাঠা বাহিনীকে বিনা বাধায় ওই গিরিপথ দিয়ে আসতে দিলেন। তারা কোঙ্কণের অনেক ভেতরে প্রবেশ করার পর তিনি আঘাত হানলেন। পেশোয়ার বাহিনীর সঙ্গে মুখোমুখি লড়াই না করে তিনি তাদের পিছনে গিয়ে গিরিপথ দখল করে বসলেন। ইঁদুরকে জাঁতাকলে পুরে তিনি ঢাকনার মুখ বন্ধ করে দিলেন।
মারাঠা বাহিনী বিভ্রান্ত হয়ে পড়ল। তারা ভাবতেও পারেনি বাইরের জগতের সঙ্গে তাদের যোগাযোগের সব পথ কানোজি এমনভাবে বিচ্ছিন্ন করে দেবেন। নিজেদের শক্তির উপর তাদের এতই আস্থা ছিল যে, রাজমাচি কেল্লা প্রায় অরক্ষিত রেখে তারা গিরিপথ ধরে এগিয়ে গিয়েছিল। প্রায় বিনা বাধায় কেল্লা দখল করলেন কানোজি। এখানেই কিন্তু তিনি নিরস্ত হলেন না। বিচক্ষণ সেনাপতির মতো সুযোগের পূর্ণ সদব্যবহার তিনি করতে জানতেন। পুণার ত্রিশ মাইলের মধ্যে লৌহগড়ের দিকে তিনি এগিয়ে গেলেন, দখল করলেন সেই দুর্গ।
এবার কোঙ্কণে অবরুদ্ধ পেশোয়ার অসহায় বাহিনীর দিকে তিনি দৃষ্টি ফেরালেন। তাদের সম্পূর্ণ পরাভূত করে পেশোয়াকে বন্দি করলেন তিনি।
দাবার ছক উলটে গেল। শাহুর প্রধানমন্ত্রী কানোজির হাতে বন্দি। রাজমাচি আর লৌহগড় এখন তাঁর দখলে।
কানোজিকে যাঁরা নৌসেনাপতি বলেই জানতেন তাঁরা নিশ্চয়ই স্থল যুদ্ধে তাঁর এই সাফল্যে বিস্মিত না হয়ে পারেননি। শাহু আর পেশোয়া দুজনেই হয়তো ভেবেছিলেন স্থলযুদ্ধে কানোজি মোটেই সুবিধে করতে পারবেন না। তাঁরা কানোজির প্রথম জীবনের কথা হয় জানতেন না, নয় বিস্মৃত হয়েছিলেন। প্রথম জীবনে স্থলযুদ্ধেই বেশি অংশগ্রহণ করেছিলেন তিনি।
লৌহগড় থেকে কানোজি শাহুর কাছে খবর পাঠালেন— ‘আমি সসৈন্যে আসছি সাঁতারায়।’
তেইশ
আতঙ্কের সৃষ্টি হল সাঁতারায়। আংরের সেনাবাহিনীর পক্ষে রাজধানী দখল করা এমন কিছু কষ্টকর ব্যাপার নয়। শাহুর ব্যক্তিগত প্রহরী বাহিনীই একমাত্র ভরসা, কিন্তু তারা সংখ্যায় নগণ্য। আর বালাজি বিশ্বনাথের পাঁচমিশালি সেনাদল, যাদের নিয়ে সম্প্রতি তিনি বিদ্রোহ দমন করতে গিয়েছিলেন। কিন্তু কানোজির শক্তির কাছে তারা তুচ্ছ।
অসহায় অবস্থা। বালাজি বিশ্বনাথকে শাহু আদেশ করলেন আরও কিছু সৈন্য সংগ্রহ করে লৌহগড়ের দিকে এগিয়ে তিনি যেন কানোজিকে বাধা দেন। বিশ্বনাথকে তিনি প্রতিশ্রুতি দিলেন, কানোজির সঙ্গে একটা মীমাংসায় আসতে পারলে তাঁকে তিনি পেশোয়ার পদে নিযুক্ত করবেন।
বালাজি বিশ্বনাথ বুঝতে পারলেন এই হচ্ছে উপযুক্ত সময়। এখনও যদি তিনি মনস্থির না করেন, তবে যে সুবর্ণ সুযোগ তাঁর দরজায় এসে আঘাত হানছে তা দ্বিতীয় বার হয়তো তাঁর জীবনে আর আসবে না। যদি কানোজিকে একটা সম্মানজনক মীমাংসার শর্তে তিনি সম্মত করাতে পারেন তবে রাজ্যের শ্রেষ্ঠ পদ তাঁর হাতের মুঠোয় ধরা দেবে। যদি…
তিনি শাহুকে বোঝালেন আংরের বিরুদ্ধে অভিযানের আগেই তাঁকে পেশোয়ার পদে নিযুক্ত করা একান্ত প্রয়োজন। তিনি যুক্তি দেখালেন, বালাজি বিশ্বনাথ পেশোয়ারূপে এই অভিযানের নেতৃত্ব করছে কিংবা একজন সেনাপতিরূপে, তার উপর নির্ভর করছে অভিযানের সাফল্য। কানোজি আংরের জানা উচিত যে, তিনি রাজার পেশোয়াকে বন্দি করলেও অন্য একজন তাঁর স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন— অর্থাৎ, রাজার প্রধানমন্ত্রীর পদ কখনো খালি পড়ে থাকবে না।
শাহু রাজি হলেন। বালাজি বিশ্বনাথ বাল্যকাল থেকে তখনও পর্যন্ত তিনি অশ্বারোহণ শিক্ষা করতে পারেননি, তিনিই মারাঠা নৃপতির প্রধানমন্ত্রীরূপে চললেন প্রবল পরাক্রান্ত কানোজি আংরের মোকাবিলা করতে। তাঁর সঙ্গে চলল জোড়াতালি দেওয়া অনভিজ্ঞ সেনাবাহিনী।
চতুর বালাজি বিশ্বনাথ প্রবল প্রতিপক্ষ কানোজির সঙ্গে সম্মুখ সমরের কথা নিশ্চয়ই কল্পনা করেননি, তিনি মূলধন করেছিলেন তাঁদের সখ্যতার উপর। আরও একটা কথা, কানোজির প্রধম সামরিক সাফল্য, সুবর্ণদুর্গের বিদ্রোহে তিনি তাঁকে সাহায্য করেছিলেন। তা ছাড়া তাঁরা দুজনেই ব্রহ্মেন্দ্র স্বামীর শিষ্য। তবে সবচেয়ে বেশি তিনি নির্ভরশীল ছিলেন তাঁর নিজের যুক্তি এবং কূটবুদ্ধির উপর। তিনি হয়তো দুর্ধর্ষ সেনাপতি ছিলেন না কিন্তু দাক্ষিণাত্যে সেইসময় তাঁর মতো তীক্ষ্ন বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ দ্বিতীয়টি ছিল না।
তিনি কানোজিকে তাঁর কর্তব্য এবং দায়িত্ব স্মরণ করিয়ে এক চিঠি লিখলেন।
মারাঠা নৃপতির প্রধান দুটি সেনাপতির তুমি একজন। তোমার পিতা তুকোজি মহারাজা শিবাজির অধীনে আনুগত্যের চরম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করেছিলেন। তুমি নিশ্চয়ই অবগত আছ, মহারাজা শাহু মহারাজা শিবাজির প্রথম পুত্রের বংশধর এবং মারাঠা সিংহাসনের ন্যায্য অধিকারী। তিনি এখন নিজের রাজ্যে রাজত্ব করতে ফিরে এসেছেন, তুমি তাঁর সঙ্গে শত্রুতাচারণ করে কনিষ্ঠ বংশের সঙ্গে হাত মিলিয়েছ।
‘এমন করেই কি,’ বালাজি বিশ্বনাথ অভিযোগ করে লিখলেন, ‘তুমি তোমার আনুগত্যের দায়িত্ব পালন করছ?’
চিঠির তলায় তিনি নাম স্বাক্ষর করে লিখলেন, রাজার পেশোয়া।
কানোজি জবাবে লিখলেন, ‘তুমি তোমার সৈন্যবাহিনী রেখে শুধু পার্শ্বচরদের নিয়ে লৌহগড়ে এসো, সাক্ষাতে আলোচনা করব।’
বালাজি বিশ্বনাথ সেই আমন্ত্রণ গ্রহণ করলেন।
ঐতিহাসিক সেই সাক্ষাৎ ঘটল লোনাওয়ালার কাছে। বাল্যে যে দুজনের মধ্যে বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল, উত্তরকালে তাঁরাই স্ব-স্ব কর্মক্ষেত্রে সর্বোচ্চ পদে উন্নীত হয়ে শক্তিমান পুরুষরূপে গণ্য হয়েছেন। বন্ধুত্বের পরিবেশে সেই দুজন আলিঙ্গনাবদ্ধ হলেন পরস্পরের। সে দৃশ্য ভোলার নয়।
তারাবাইয়ের পুত্রের মৃত্যুর পর কানোজির মনে দ্বন্দ্ব আর দ্বিধা এসেছিল, কার পক্ষ এখন তিনি সমর্থন করবেন। হয়তো সুযোগের অভাবেই শাহুর সঙ্গে একটা বোঝাপড়া তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠেনি।
বালাজি বিশ্বনাথ তাঁর তূণে যত চোখা চোখা বাণ ছিল, সব প্রয়োগ করলেন। শিবাজি মহারাজের গুণকীর্তন করে বললেন, প্রত্যেক মারাঠা তাঁর কাছে ঋণী। শাম্ভাজি এখন মুঘলদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন সে কথা কানোজিকে স্মরণ করিয়ে দিতে ভুললেন না। কোঙ্কণে কানোজির শত্রুর অভাব নেই— এ কথা বলে তিনি বোঝালেন, স্থলপথে কানোজি যদি মারাঠা নৃপতির কাছ থেকে নিরাপত্তার আশ্বাস পান তবে সেটা তাঁর পক্ষে মস্ত একটা বল ও ভরসার কারণ হবে। যৌথ প্রতিরক্ষার সুবিধার কথা স্মরণ করিয়ে তিনি বললেন কোঙ্কণে যখনই যুদ্ধ লাগবে, কানোজির আহ্বানে সাড়া দিয়ে তখনই তিনি মারাঠা বাহিনী নিয়ে তাঁর পাশে এসে দাঁড়াবেন। ব্রহ্মেন্দ্র স্বামী সর্বান্তকরণে শাহুকে আশীর্বাদ করেছেন এ কথাও মনে করিয়ে দিলেন বালাজি বিশ্বনাথ। কানোজিকে উদ্দেশ করে লেখা ব্রহ্মেন্দ্র স্বামীর একটা চিঠিও তিনি সঙ্গে এনেছিলেন। ওই চিঠিতে স্বামীজি কানোজিকে আদেশ করেছিলেন শাহুর সঙ্গে তিনি যেন সন্ধি করেন।
বালাজির অকাট্য যুক্তির কাছে হার মানলেন কানোজি। কিন্তু বালাজি যেসব প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন শাহু কি তা মেনে নেবেন। বালাজি তাঁর বন্ধুকে নিশ্চিন্ত করে বললেন, রাজার পেশোয়া হিসেবেই তিনি কানোজির সঙ্গে কথা বলছেন— বন্ধু হিসেবে নয়। শাহু তাঁকে কানোজির সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হবার পূর্ণ ক্ষমতা অর্পণ করেছেন।
কানোজি শাহুর সার্বভৌম কর্তৃত্ব মেনে নিতে সম্মত হলেন। বালাজি বিশ্বনাথ যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন শাহু তার সমস্তই অনুমোদন করলেন। দুই বন্ধু যাত্রা করলেন কোলাবা, কানোজির সদর ঘাঁটি যেখানে। ১৭১৪ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি চুক্তি স্বাক্ষরিত হল দুজনের মধ্যে। প্রাক্তন পেশোয়া পিংলে মুক্তি পেলেন তাঁর উত্তরাধিকারী বালাজি বিশ্বনাথের হস্তক্ষেপে।
তিনটি জেলা নিয়ে কোঙ্কণ। শাহু চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত হিসেবে কোঙ্কণের ভার দিলেন কানোজিকে। উপকূল রক্ষার দায়িত্ব ন্যস্ত হল তাঁর উপর। দশেরা থেকে শুরু করে গ্রীষ্মের উৎসব পর্যন্ত তিনি উপকূল বরাবর টহল দেবেন, উৎসবের সময় ফিরিঙ্গি আর হাবশিরা যাতে উপদ্রব করতে না পারে। শাহুর সঙ্গে সংঘর্ষের সূত্রপাত থেকে কানোজি মোট ন-টি কেল্লা দখল করেছিলেন। লৌহগড় সমেত পাঁচটি দুর্গ শাহুকে তিনি ফিরিয়ে দেবেন আর রাজমাচি সমেত চারটি রাখতে পারবেন নিজের দখলে। তা ছাড়া ওইসব কেল্লার চারপাশের অঞ্চলও কানোজির অধিকারে থাকবে। সন্ধির বাকি শর্তগুলি হল— যারা শাহুর পক্ষ ছেড়ে গেছে তাদের কাউকে কানোজি দলভক্ত করবেন না। কানোজি যদি উত্তর কোঙ্কণের ‘থাল’ অঞ্চলের কোনো দুর্গ দখল করেন তবে তা তিনি শাহুকে অর্পণ করবেন, পরিবর্তে কানোজির প্রয়োজনে শাহু তাঁকে সামরিক সাহায্য দেবেন।
কোলাবার এই চুক্তির ফলে কানোজি আংরে উপকূলবর্তী দশটি এবং স্থলবর্তী ষোলোটি কেল্লার নিয়ন্ত্রণ অধিকার পেলেন। যেসব অঞ্চল তাঁর অধীনে এল তা থেকে তাঁর বার্ষিক আয় দাঁড়াবে প্রায় ছত্রিশ লক্ষ টাকা। ‘সরখেলের’ পদে শাহু তাঁকে স্থায়ী মর্যাদা দিলেন।
বোম্বাই পোতাশ্রয়ে প্রবেশ করার প্রণালীর মুখে খান্দেরি। এই দ্বীপটি নিয়ন্ত্রণের অধিকারও কানোজি চেয়ে নিলেন শাহুর কাছ থেকে। অনেক ভেবেচিন্তেই এ কাজটা করেছিলেন তিনি।
চব্বিশ
কোঙ্কণের চুক্তি বালাজি বিশ্বনাথের কূটনীতির জয়, তাঁর ব্যক্তিগত সাফল্য। দুর্বল এক সৈন্যবাহিনী নিয়ে দুর্ধর্ষ এক সেনাপতির অধীনে শক্তিশালী এক বাহিনীর বিরুদ্ধে তিনি যুদ্ধযাত্রা করেছিলেন। সেই যুদ্ধের ফলাফল সম্বন্ধে তাঁর নিজের মনেও কোনো সন্দেহ ছিল না। কিন্তু দুর্জেয় সেই শত্রুকে তিনি মিত্রতার বন্ধনে বেঁধে নিজের এবং শাহুর হাত শক্ত করেছেন।
শাহু অকৃতজ্ঞ ছিলেন না। বালাজির সম্মানে তিনি উৎসবের আয়োজন করলেন। লোনাওয়ালা থেকে সাঁতারা পর্যন্ত প্রত্যেক গ্রামে বিজয় তোরণ নির্মিত হল, আম্রপত্রে সুসজ্জিত হল তোরণ, রোপন করা হল শিশু কদলি বৃক্ষ। প্রতিটি তোরণে সুবেশা, সুন্দরী রমণীরা তাঁর ললাটে রক্তচন্দনের তিলক এঁকে কণ্ঠে পরিয়ে দিল সুগন্ধী মাল্য। হাতির পিঠে চড়িয়ে পরিক্রমা করানো হল তাঁকে, তাঁর পিছনে হাতি ও অশ্বের পিঠে মানুষের শোভাযাত্রা। আনুষ্ঠানিকভাবে শাহু তাঁকে পেশোয়া বলে ঘোষণা করলেন, উপহার দিলেন প্রচুর।
দোল উৎসবে কানোজিকে সাঁতারায় আমন্ত্রণ জানালেন শাহু। এই শক্ত মানুষটিকে স্বপক্ষে পেয়ে তাঁর আনন্দের সীমা নেই, এখন আর তিনি ভয় করেন না কাউকেই।
কানোজির কিন্তু সেসময় সাঁতারায় যাবার উপায় ছিল না। কোলাবার চুক্তি শাহুর সঙ্গে তাঁর বিরোধের অবসান ঘটালেও অন্যদিক থেকে এল আঘাত। জাঞ্জিরার সিদ্দি, রসুল ইয়াকুত খাঁ দেখলেন ওই চুক্তির ফলে তাঁর রাজ্যের কিছু অঞ্চল কানোজিকে দেওয়া হয়েছে। শুধু তাই নয়, তাঁর অধিকৃত বলে এতদিন স্বীকৃতি কিছু অঞ্চল মারাঠা রাজা আর কানোজির মধ্যে ভাগাভাগি হয়েছে। তিনি ওইসব অঞ্চল পুনর্দখলের উদ্দেশ্যে কানোজির বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করলেন।
কোলাবার চুক্তি অনুযায়ী মারাঠা বাহিনী কানোজির সাহায্যে এগিয়ে এল। বালাজি বিশ্বনাথ স্বয়ং এক অশ্বারোহী বাহিনীর সঙ্গে এসে বিতর্কিত অঞ্চল অধিকার করলেন। (তিনি নিজে অশ্বারোহণে পটু ছিলেন না, দু-পাশ থেকে দুজন তাঁর ঘোড়া টেনে নিয়ে যেত)। তারপর যে অঞ্চল নিয়ে কলহের সুত্রপাত, তার চাইতে বেশি অঞ্চল দখল করে সন্ধির শর্ত নিয়ে আলোচনার জন্য সিদ্দিকে তিনি আহ্বান জানালেন।
সিদ্দির আর কিছু করার উপায় ছিল না। তিনি বালাজির সঙ্গে আলোচনার জন্য এলেন। বালাজি তাঁকে সসম্মানে অভ্যর্থনা জানিয়ে যেটুকু অঞ্চল তখনও সিদ্দির দখলে আছে শুধু সেটুকু নিয়েই তাঁকে সন্তুষ্ট থাকার শর্ত দিলেন। কোলাবার চুক্তি অনুযায়ী যেসব অঞ্চল সিদ্দির হাতছাড়া হয়েছিল তা ছাড়াও বেশ কিছু অঞ্চল হারাতে হল তাঁকে।
কানোজি অবশ্য সিদ্দির সঙ্গে কোনো আপোশ ব্যবস্থায় তেমন আগ্রহী ছিলেন না। সিদ্দিকে তিনি তাঁর ঝোলায় জ্বলন্ত অঙ্গারের মতোই সর্বক্ষণ একটা অস্বস্তির কারণ বলে মনে করতেন। তাঁর সঙ্গে চূড়ান্ত হেস্তনেস্ত করতে চাইছিলেন তিনি। বালাজি বিশ্বনাথ সূক্ষ্ম কূটনৈতিক কৌশলে তাঁদের বিবাদ মিটিয়ে দিলেন।
বালাজি বিশ্বনাথের উদ্যোগে কানোজি আংরে আর সিদ্দি রসুল ইরাকুত খাঁর মধ্যে ১৭১৫ সালের ৩০ জানুয়ারি শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হল।
কানোজি কালক্ষেপ না করে খান্দেরি দ্বীপ আর দুর্গ সুরক্ষিত করার ব্যাপারে সচেষ্ট হলেন। দুর্গরক্ষীর সংখ্যা বৃদ্ধি করে নতুন কামান বসানো হল। খান্দেরির গুরুত্ব কম নয়। বোম্বাই থেকে জাহাজ চলাচলের উপর নজর রাখার পক্ষে খান্দেরি ছিল আদর্শ।
রাজমাচি আর খান্দেরি কানোজির দখলে আসায় জলে-স্থলে গুরুত্বপূর্ণ দুটো ঘাঁটি নিয়ন্ত্রণের সুযোগ পেলেন তিনি।
খান্দেরি সুরক্ষিত করার পর শাহুর আমন্ত্রণ গ্রহণ করলেন তিনি। জাঁকজমকপূর্ণ শোভাযাত্রা করে তিনি যাত্রা করলেন রাজ সন্দর্শনে।
ইতিমধ্যে এক বছর কেটে গেছে। হাতি, ঘোড়া আর ষাঁড়ের পিঠে চড়ে চলল তাঁর অনুচর— এক মাইল দীর্ঘ শোভাযাত্রা। রাজ আদেশে বিশেষভাবে নির্মিত শিবিরে বিশ্রামের ব্যবস্থা হয়েছিল তাঁদের। ভোগবিলাসের আয়োজনের ত্রুটি ছিল না। নর্তকীর দল পাঁচরঙা আবির বর্ষণ করে অভ্যর্থনা জানাচ্ছিল তাঁদের। দোল পূর্ণিমার পাঁচ দিন আগে কানোজি সাঁতারায় পৌঁছুলেন। রাজার জন্য তিনি নিয়ে এসেছেন প্রচুর উপঢৌকন। যে অভ্যর্থনা তাঁকে দেওয়া হল তা সাঁতরার মানুষ আগে কখনো চোখে দেখেনি।
সুসজ্জিত মণ্ডপে শাহু অভ্যর্থনা জানালেন তাঁর নৌসেনাপতিকে। হাতি, ঘোড়া, অলংকার উপহার দিলেন আর প্রধান নৌসেনাপতির পোশাকে ভূষিত করলেন তাঁকে। সন্ধ্যায় এক ভোজসভায় আপ্যায়িত করা হল তাঁকে। সেই ভোজসভায় মন্ত্রিপরিষদের সবাই, উচ্চ পদাধিকারী কর্মচারীবৃন্দ এবং বিশিষ্ট সর্দাররা উপস্থিত ছিলেন।
প্রথম দর্শনেই শাহু এবং কানোজি পরস্পরের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে গড়ে উঠেছিল একটা অকৃত্রিম প্রীতির সম্পর্ক। কোঙ্কণে প্রত্যাবর্তনের পর কানোজি তাঁর রাজাকে বিদেশি বন্দুক, তরবারি, ঘড়ি, মখমল, মূল্যবান কাচের বাসনপত্র নিয়মিত পাঠাতে শুরু করলেন। তা ছাড়া, সুগন্ধী চাউল, কাজুবাদাম, কোঙ্কনের বিখ্যাত আম্রফল এবং অন্যান্য সুখাদ্যে ভরে উঠল শাহুর রন্ধনশালা।
গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে শাহু এখন কানোজির উপদেশ কামনা করেন। কোঙ্কণের ব্যাপারে তিনি হস্তক্ষেপ তো করেনই না, বরং ইংরেজ এবং পোর্তুগিজদের সম্বন্ধে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হলে কানোজির পরামর্শ ছাড়া তাঁর চলে না।
পঁচিশ
১৭১৫ সালে বোম্বাইয়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নতুন গভর্নর হয়ে এলেন চার্লস বুন। যেদিন তিনি বন্দরে পদার্পণ করলেন সেদিন সাধারণ ছুটি বলে ঘোষণা করা হল। আলোর মালায় সাজানো হল গোটা শহরকে। বোম্বাই শহরের সব গণ্যমান্য পুরুষকে সার বেঁধে দাঁড় করানো হল নতুন গভর্নরের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবার জন্যে। কামানের গোলা অভিবাদন জানাল গভর্নরকে।
বুন অসাধারণ উৎসাহী এবং কঠোর পরিশ্রমী ছিলেন। বোম্বাই শহরকে প্রাচীর বেষ্টিত করতে হবে— এই হল তাঁর প্রথম হুকুম। এই ব্যয়বহুল কাজের জন্য দেশীয় বণিকদের কাছ থেকে অনুদান হিসেবে মোটা টাকা আদায় করা হল। দু-বছরের মধ্যে ‘যুদ্ধ কর’ (ওয়ার ট্যাক্স) নাম দিয়ে বোম্বাইয়ের অধিবাসীদের উপর তিনি শতকরা দু-টাকা হিসাবে কর চাপিয়ে দিলেন।
এই প্রাচীর নির্মাণের উদ্দেশ্য ছিল কানোজি আংরের হাত থেকে বোম্বাই শহর রক্ষা করা। সেইসঙ্গে আরও যুদ্ধ জাহাজ, তৈরির দিকেও দৃষ্টি দিলেন বুন। যেখানে যেখানে কোম্পানির জাহাজ নির্মাণ কারখানা ছিল, সেখানেই হুকুম গেল চটপট যুদ্ধ জাহাজ বানাতে হবে। ছ-মাসের মধ্যে তিনটি যুদ্ধ জাহাজ কোম্পানির নৌশক্তি বৃদ্ধি করল। ওগুলো হল আঠারো কামানের ‘ব্রিটানিয়া’, ষোলো কামানের ‘ফ্রেম’ এবং ষোলো কামানের ‘রিভেঞ্জ’। প্রত্যেকটি ১২০ থেকে ১৬০ জন মানুষ বহন করতে সক্ষম। খুব তাড়াতাড়ি আরও কয়েকটি জাহাজ তৈরি হল। চব্বিশ কামানের যুদ্ধ জাহাজ ‘ভিকটরি’ আর দুটি আগুনে জাহাজ (ফায়ার শিপ) তাদের অন্যতম। আগুনে জাহাজ হল দাহ্য পদার্থ পূর্ণ নৌযান। শত্রুপক্ষের জাহাজের মধ্যে ওটাকে ভিড়িয়ে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হত। দাউ দাউ করে আগুন ছড়িয়ে পড়ত শত্রুপক্ষের জাহাজে। বোম্বাইয়ে পদার্পণ করার দু-বছরের মধ্যে বুন শক্তিশালী এক নৌবহর নির্মাণ করলেন।
এর আগেই কোম্পানির সঙ্গে কানোজির সম্পর্কের চিড় ধরতে শুরু করেছিল। তার প্রধান কারণ কানোজির ‘দস্তক’ এবং শুল্ক কর ফাঁকি দেবার জন্য ইংরেজরা দেশীয় সব জাহাজকে কোম্পানির পতাকা বহন করবার ঢালাও অনুমতি দিচ্ছিল। তাদের সঙ্গে চুক্তির শর্ত অনুযায়ী যেসব জাহাজ কোম্পানির মালপত্র কিংবা পতাকা বহন করে তারা ‘দস্তকের’ হাত থেকে রেহাই পাবে। কোম্পানি শর্তের ওই ধারা খেয়ালখুশিমতো ব্যবহার করেছিল।
কানোজি ক্রুদ্ধ হলেন। ১৭১৬ সালে বোম্বাই পোতাশ্রয়ের চোখের সামনেই কোম্পানির পতাকাবাহী একটা দেশীয় জাহাজ তিনি আটক করলেন। ১৭১৭ সালের গোড়ার দিকে আরও তিনটি ভারতীয় জাহাজ দখল করলেন তিনি, ওগুলির কোনোটিতেই তাঁর দস্তক ছিল না। ইংরেজদের পতাকা উড়িয়ে পাশ কাটিয়ে যাবার চেষ্টা করছিল।
গভর্নর বুন তীব্র প্রতিবাদ করে কানোজির কাছে পত্র পাঠালেন। তিনিও কড়া ভাষায় জবাবে লিখলেন— ‘শুধুমাত্র কোম্পানির নিজস্ব বাণিজ্যপোতগুলিই দস্তকের হাত থেকে রেহাই পাবে অন্য কোনো জাহাজ নয়।’
ইতিমধ্যে কানোজি গুজরাটি বণিক গোবর্ধন দাসের জাহাজ ‘সাকসেস’ আটক করলেন। গোর্ধন দাস সুরাটে কোম্পানির নিযুক্ত একজন দালাল। গভর্নর বুন ক্যাপ্টেন হেনরি কর্নওয়াল নামে একজনকে কোলাবায় পাঠালেন প্রতিবাদের জন্য। কর্নওয়াল যখন কোলাবায় কানোজির কাছে এ বিষয়ে তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছেন ঠিক তখনই বোম্বাইয়ে খবর পৌঁছাল যে, ‘রবার্ট’ নামে একটা জাহাজ কানোজির অনুচরেরা দখল করেছে। ওই জাহাজে কয়েক জন ইংরেজ যাত্রী ছিল। কয়েক দিন পর কোম্পানির একটা বাণিজ্যতরী আটক করে কোলাবায় নিয়ে যাওয়া হল। প্রচুর কড়িকাঠ ছিল ওই জাহাজে। কড়িকাঠের তখন দারুণ চাহিদা, বিশেষ করে জাহাজ তৈরির ব্যাপারে ওই কাঠের খুব দরকার। কানোজির আদেশে বেশ কিছু কড়িকাঠ নামিয়ে জাহাজটা ছেড়ে দেওয়া হল।
১৭১৮ সালের ৫ এপ্রিল বোম্বাইয়ে কোম্পানির উপদেষ্টাদের এক জরুরি বৈঠক বসল। আলোচনার ফল হিসেবে গভর্নর বুন কোম্পানির সমস্ত যুদ্ধ জাহাজে গোপন নির্দেশ পাঠালেন। কানোজি আংরের জাহাজ দেখলেই দখল করবে কিংবা ডুবিয়ে দেবে।
বুন আরও একটা ফন্দি আঁটলেন। ঘেরিয়া বা বিজয় দুর্গ হল কানোজির প্রধান নৌগুদাম। বর্ষাকালে তাঁর নৌবহরের একটা বিশেষ অংশ ডাঙায় তুলে ওখানে গুদামজাত করা হয়। আগে এ বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। বুন স্থির করলেন ঘেরিয়া আক্রমণ করে কানোজির গুদামে মজুত নৌবহরকে ধ্বংস করবেন। এক আঘাতে আংরের শক্তিশালী নৌবহরকে পঙ্গু করে দেওয়া হবে।
বর্ষার ঠিক আগে প্রত্যেকটি নৌযান ঘেরিয়ায় গুদামজাত করার অপেক্ষায় রইলেন তিনি। আরও একটা ব্যাপারে কোম্পানির উৎফুল্ল হবার কারণ ছিল। গত বছর পর্যন্ত ম্যানুয়েল দা কাস্ত্রো কানোজির প্রধান নৌ-উপদেষ্টা ছিল। সে এসে কোম্পানির সঙ্গে হাত মিলিয়েছে। উদ্ধত এবং অন্যায় আচরণের জন্য কানোজি তাকে পদচ্যুত করেছিলেন; সুতরাং কাস্ত্রোর ব্যক্তিগত আক্রোশ ছিল কানোজির উপর।
ঘেরিয়াকে সহজ লক্ষ্য বস্তু বলা যায়। সেখানে কানোজির নৌবহরের একটা বড়ো সংখ্যা ঘন সন্নিবিষ্ট অবস্থায় গুদামজাত করা রয়েছে। কোলাবা কিংবা সাঁতারা থেকে অনেক দূরে হওয়ায় সময়মতো সাহায্য পাবার কোনো সম্ভাবনা নেই। সবচেয়ে বড়ো কথা, ঘেরিয়া প্রায় অরক্ষিত থাকে বর্ষাকালে। বেশিরভাগ নাবিকই দীর্ঘ চার মাসের অবকাশ যাপন করতে যে যার বাড়ি যায়। ওই সময় আবার কোলাবায় কানোজির মেয়ে লাদুবাইয়ের বিবাহ উৎসবে যোগ দিতে গিয়েছে অধিকাংশ নৌসেনাপতি।
ফন্দিটা যে দারুণ সে বিষয়ে কারু মনে সন্দেহ ছিল না। বুনের মতলব ছিল ঘেরিয়া দখল করে তিনি আগুনে জাহাজের সাহায্যে একসঙ্গে জড়ো করা ‘ঘুরাব’, ‘গালিভাত’, ‘শিবার’ এবং ‘পাল’ ধ্বংস করবেন। ২৫০০ সুশিক্ষিত সৈনিক নিয়ে কোম্পানির নৌবহর চুপিসারে বোম্বাই থেকে যাত্রা করল ঘুমন্ত শত্রুকে আক্রমণের উদ্দেশ্যে। তারিখটা ছিল ৯ জুন, ১৭১৮।
পরদিন ইংরেজ নৌবহর ঘেরিয়ায় উপস্থিত হল। পর পর সার বেঁধে দাঁড়িয়ে জাহাজগুলি দুর্গের পূর্বদিক থেকে পোতাশ্রয়ের বেরুবার মুখ অবরোধ করে ফেলেছে। বড়ো বড়ো জাহাজের পিছনে আছে ক্ষুদ্র রণতরী। এবার ঘেরিয়া দুর্গ লক্ষ করে গোলাবর্ষণ শুরু করল নৌবহর। যা আশা করা গিয়েছিল তাই ঘটল। ঘন ঘন নিক্ষিপ্ত গোলার প্রত্যুত্তরে দুর্গ থেকে ঘণ্টায় একটা গোলা যেন ক্ষীণ প্রতিবাদ জানাচ্ছে।
কিন্তু তীরে অবতরণ করে ক্ষিপ্রগতিতে দুর্গ দখল করার আশা ত্যাগ করতে হল। তীরভূমি এত কঙ্করময় যে উপযুক্ত স্থান নিয়ে দাঁড়াবার সুবিধে নেই। দুর্গ প্রাচীরের উচ্চতাও আক্রমণকারীদের পক্ষে মস্ত একটা বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে, প্রকাণ্ড মইগুলি পর্যন্ত দুর্গের মাথায় পৌঁছুচ্ছে না।
আগুনে জাহাজটা মারাঠা নৌবহরের মাঝখানে নিয়ে যাবার চেষ্টা করা হল। ওগুলো তালাপাতার ছাউনিতে ঢাকা, তাড়াতাড়ি আগুন জ্বলে ওঠার পক্ষে আদর্শ। দেখা গেল মারাঠারা তাদের রণতরীগুলিকে অনেকটা টেনে বড়ো বড়ো গুহার বেশ ভেতরে রেখে দিয়েছে। একটা নালার সঙ্গে ওই গুহাগুলির যোগাযোগ। নালার মুখে বড়ো বড়ো ভাসমান কাঠ ফেলে অবরোধ সৃষ্টি করা হয়েছে। ফলে ওই সংকল্পও ত্যাগ করতে হল।
দু-দিন পরিশ্রান্ত গোলাবর্ষণ চলল। সকলের ধারণা যেকোনো মুহূর্তে প্রতিরোধকারীরা শান্তির পতাকা হাতে বেরিয়ে এসে আত্মসমর্পণ করবে। কিন্তু দু-দিন গোলাবর্ষণে দুর্গের দেয়ালের একাংশ ক্ষত বিক্ষত হলেও দেখা গেল বেশিরভাগ গোলাই বড়ো বড়ো পাথরে প্রতিহত হয়ে নষ্ট হচ্ছে।
অন্য পথ ধরা হল। কিছু সৈন্য স্থলে অবতরণ করে মারাঠা জাহাজগুলিতে আগুন ধরিয়ে দেবে। সেই উদ্দেশ্যে সৈন্য নামানো হল। অবাক কাণ্ড, দুর্গ থেকে কোনোরকম বাধাই এল না। যারা ডাঙায় নেমেছিল তাদের দুর্গ প্রাচীর ঘেঁষে যেতে হচ্ছিল। এত করেও দেখা গেল মারাঠা জাহাজগুলির কাছে যেতে হলে একটা জলাভূমি পার হতে হবে। অগত্যা জাহাজে আগুন লাগাবার সংকল্প একেবারে বাতিল করতে হল। অবতরণকারীরা দুর্গ থেকে কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে নিঃশঙ্ক চিত্তে দেয়ালের পাশ দিয়ে নিজেদের জাহাজে ফিরছিল। হঠাৎ তাদের অবাক করে দুর্গ থেকে ঘন ঘন গুলিবর্ষণ শুরু করল। অবতরণকারীরা দৌড়ে কোনোমতে নৌকায় চেপে জাহাজ ফিরে গেল।
১৭১৮ সালের ১৮ জুন ঘেরিয়া আক্রমণকারীরা ফিরে এল বোম্বাইয়ে।
মজার কথা, ঘেরিয়ায় ওই সময় শতখানেক রক্ষীও ছিল কিনা সন্দেহ। কানোজি যে ওখানে ছিলেন না সেটা নিশ্চিত ঘটনা। তবে কোম্পানি যেভাবে আক্রমণ পরিচালনা করেছে এবং শেষপর্যন্ত ব্যর্থ হয়ে ফিরে গেছে, তা জানবার পর তিনি নিজেও নিশ্চয়ই কম বিস্মিত হননি। অল্পের জন্য বেঁচে গেছে ঘেরিয়া। ভবিষ্যতে তিনি সাবধান হবেন, এমন সুযোগ আর দ্বিতীয় বার দেবেন না শত্রুকে।
* * *
গভর্নর বুন কিন্তু নিরুৎসাহ হলেন না। তিনি এবার খান্দেরি আক্রমণের মতলব আঁটলেন। বর্ষার চার মাস সেই উদ্দেশ্যে চলল প্রস্তুতি। সেপ্টেম্বরের শেষে ইংল্যান্ড থেকে তিন-শো সৈন্য এবং প্রচুর গোলাবারুদ এল। বুন স্বয়ং এই আক্রমণ পরিচালনা করার সংকল্প করলেন। ১৭১৮ সালের ১ নভেম্বর তিনি তাঁর নিজস্ব জাহাজ অ্যাডিসনে পতাকা ওড়ালেন। বিকেল দুটোয় শুরু হল অভিযান।
শিলা এবং গুল্মজাতীয় ঝোপে সমাকীর্ণ খান্দেরি, উপকূল থেকে প্রায় তিন মাইল। বোম্বাই থেকে খান্দেরির দূরত্ব দশ মাইল। দ্বীপটি উত্তর থেকে দক্ষিণে এক মাইলের একটু বেশি, চওড়ায় আধ মাইল। শাহুর অনুমতি নিয়ে ওই দ্বীপ নিজের দখলে এনেছিলেন কানোজি; সুরক্ষিত করেছিলেন দুর্গ, একথা আগেই বলা হয়েছে।
মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ইংরেজ নৌবহর খান্দেরি পৌঁছে গেল। দুর্গের দক্ষিণ দিক আক্রমণের জন্য বেছে নেওয়া হল। ওই দিকটাই কিন্তু সুরক্ষিত ছিল সবচেয়ে বেশি। দু-দিন ধরে দ্বীপের চারপাশে টহল দিয়ে তেসরা নভেম্বর আলো ফোটার আগেই শুরু হল গোলাবর্ষণ।
তিনটে কামান মাঝে মাঝে ইংরেজদের গোলাবর্ষণের প্রত্যুত্তর দিচ্ছিল। আক্রমণকারী একটা জাহাজের সামান্য ক্ষতি হল দুর্গ থেকে নিক্ষিপ্ত গোলায়। পাঁচ তারিখে বুন স্থির করলেন দ্বীপের পূর্ব এবং পশ্চিমদিকে সৈন্য অবতরণ করিয়ে সাঁড়াশি আক্রমণ চালাবেন। পূর্বদিক থেকে আক্রমণ করবে তিন-শো ইংরেজ সৈন্য আর পশ্চিমদিক থেকে কোম্পানির দেশীয় সেপাইরা। তাদের সাহায্য করার জন্য বড়ো যুদ্ধ জাহাজ আর গালিভাত জায়গা নিয়ে দাঁড়াল। পিছন থেকে গোলাবর্ষণ করে অবতরণকারীদের পথ বিপন্মুক্ত রাখবে তারা।
শেষ মুহূর্তে সেপাইরা ডাঙায় নামতে অস্বীকার করে বসল। ইংরেজ নৌসেনারা অবশ্য পূর্বদিকে অবতরণ করল। প্রচণ্ড বাধা এল দুর্গ থেকে। ঝাঁকে ঝাঁকে বন্দুকের গুলি এসে পড়ছে। তা সত্ত্বেও যারা দুর্গের কাছে পৌঁছাল তাদের উপর এমন প্রচণ্ড প্রস্তর বর্ষণ শুরু হল যে, আঠারোজন সঙ্গে সঙ্গে প্রাণ হারাল, আহত হল পঞ্চাশজন।
অবতরণকারীদের মদত দেবার জন্য যে জাহাজগুলি এগিয়ে এসেছিল হঠাৎ পূর্বদিক থেকে তাদের লক্ষ করে গোটা বারো কামান গর্জে উঠল। যথেষ্ট ক্ষতি হল ইংরেজ নৌবহরের।
সাত তারিখে স্থলপথে আবার একটা আক্রমণের চেষ্টা হল। সে প্রচেষ্টাও ব্যর্থ করে দিল দুর্গরক্ষীরা। ম্যানুয়েল দা কাস্ত্রো দুটো গালিভাতকে তীরের খুব কাছে নিয়ে এসেছিল। দুর্গ থেকে কামানের গোলায় গালিভাত দুটোর পঞ্চাশ-ষাট জন নাবিক হতাহত হল।
এবারও ব্যর্থ হল ইংরেজ অভিযান। খান্দেরির প্রবীণ এবং অভিজ্ঞ দুর্গাধ্যক্ষ কানোজির অত্যন্ত বিশ্বাসভাজন ছিলেন। খুব ঠান্ডা মাথায়, দৃঢ়তার সঙ্গে দুর্গ রক্ষা করেছিলেন তিনি। দুর্গে সেসময় তিন থেকে চার-শোর মতো মানুষ ছিল, তাদের একাংশ আবার ছিল নারী। আক্রমণের মুখে তারাও পুরুষদের পাশে দাঁড়িয়ে লড়াই করেছিল। প্রায় পঞ্চাশটি রণতরী ঘিরে ফেলেছিল খান্দেরি, দুর্গ থেকে তাদের সবরকম প্রস্তুতিই লক্ষ করা যাচ্ছিল। এই প্রবল প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে দুর্গের অধ্যক্ষ যে বীরত্ব এবং সাহসের পরিচয় দিয়েছিলেন, দুর্গের সকলের মনোবল যেভাবে উজ্জীবিত রেখেছিলেন, তা নিশ্চয়ই প্রশংসার দাবি রাখে।
অনর্থক সুরক্ষিত করেননি কানোজি তাঁর দুর্গগুলি।
ছাব্বিশ
১৭২০ সালের দোসরা এপ্রিল পরলোকগমন করলেন বালাজি বিশ্বনাথ। তাঁর মৃত্যুতে অপরিমেয় ক্ষতি হল শাহুর। একজন বিশ্বস্ত বন্ধু এবং বিচক্ষণ কূটনীতিবিদ হারালেন তিনি। বালাজি বিশ্বনাথের জ্যেষ্ঠ পুত্র বাজীরাওয়ের বয়স তখন মাত্র উনিশ। শাহু তাঁকেই পেশাদার পদে নিযুক্ত করলেন। শাহুর অন্যান্য মন্ত্রীদের মধ্যে এ নিয়ে তীব্র বিক্ষোভ দেখা দিল। মারাঠা সাম্রাজ্য পুনর্গঠনে বালাজি বিশ্বনাথের অশেষ অবদানের কথা শাহু তাঁদের স্মরণ করিয়ে দিলেন। তাঁর পুত্রকে ওই পদে নিযুক্ত করে অসাধারণ এক মানুষের স্মৃতির প্রতিই সম্মান দেখানো হয়েছে— একথা বললেন।
বালাজির মৃত্যুতে গভীর শোক পেলেন কানোজি। কোলাবার চুক্তির পর বালাজি সবসময় তাঁর পক্ষ নিয়েছেন, যখনই প্রয়োজন হয়েছে সৈন্য দিয়ে সাহায্য করেছেন। তাঁদের বন্ধুত্ব শক্ত ইমারতের মতোই গড়ে উঠেছিল। ইংরেজরা তাঁর বিরুদ্ধে আক্রমণের জন্য নিরলস প্রস্তুতি চালিয়ে যাচ্ছে। মুঘল, জাঞ্জিবারের সিদ্দি, এমনকী পোর্তুগিজদের সঙ্গেও এ ব্যাপারে তারা কথাবার্তা চালাচ্ছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে আগের মতো মারাঠা স্থলবাহিনীর সাহায্যে তিনি পাবেন কিনা সে বিষয়েও তাঁর যথেষ্ট দুশ্চিন্তা।
ওই বছরই কানোজি কোলাবার কাছে হিরাকোট দুর্গ সুরক্ষিত করলেন। দুর্গের ভিতর মন্দির নির্মাণ করে তাঁর গৃহ বিগ্রহ, দেবী কালিম্বিকাকে প্রতিষ্ঠিত করলেন সেখানে। ভাগ্যান্বেষণে আংরেরা যখন দেশের বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়িয়েছেন, দেবীকেও তখন তাঁদের সঙ্গেও টানাপোড়েনে পড়তে হয়েছে। এতদিনে তাঁর একটা স্থায়ী আস্তানা হল। আংরেরা কোলাবায় এসেছেন চিরকাল বসবাসের জন্য, তাঁদের গৃহবিগ্রহের সেই একই ব্যবস্থাই হবে। বর্ষার শেষে মহা ধুমধামে দেবীকে হিরাকোট মন্দির প্রতিষ্ঠা করা হল। এখনও সেই দেবী মূর্তি ওই মন্দিরে অধিষ্ঠা।
* * *
বিলেতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মকর্তারা বোম্বাইয়ের ঘটনাবলির উপর দৃষ্টি রেখেছিলেন। কোম্পানির নৌবহর কানোজি আংরেকে দমন করতে ব্যর্থ হয়েছে এটা তাঁদের নজর এড়ায়নি। তাঁরা অনুমান করলেন কানোজির নৌবহরের ক্ষিপ্রতা এবং অনায়াস দিক পরিবর্তন করার ক্ষমতাই তাঁকে অজেয় করে তুলেছে। তাঁরা ১৬০ টন ওজনের তিনটি দ্রুতগামী অথচ হালকা জাহাজ নির্মাণের হুকুম দিলেন।
এদিকে গভর্নর চার্লস বুনও বসে নেই। তিনি আংরের বিরুদ্ধে সম্মিলিত আক্রমণের জন্য পোর্তুগিজদের সঙ্গে কথাবার্তা শুরু করলেন, যেমন করেই হোক তাদের সঙ্গে এ ব্যাপারে একটা চুক্তি করতে তিনি বদ্ধপরিকর। বেশ টালবাহানার পর ১৭২১ সালের বিশে আগস্ট দু-দেশের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হল। এদিকে ২৭ তারিখে এক রাজকীয় ইংরেজ নৌবহর (রয়্যাল নেভি) বোম্বাই এসে পৌঁছাল।
রাজকীয় ওই নৌবহরে মোট চারটে যুদ্ধ জাহাজ ছিল। দুটোয় পঞ্চাশটা করে কামান, তৃতীয়টায় চল্লিশটি আর চতুর্থ জাহাজে কুড়িটি কামান। ওদের সঙ্গে যুক্ত হল একটা সরবরাহ জাহাজ (সাপ্লাই শিপ)। নৌবাহিনীর অধ্যক্ষ হয়ে এলেন কমোডোর টমাস ম্যাথুস।
ইংরেজদের এই সাজ সাজ ভাব কানোজির অগোচর ছিল না। তিনিও তাঁর নৌবাহিনীর শক্তিবৃদ্ধির দিকে নজর দিলেন, সেইসঙ্গে শাহুকে কোঙ্কণের ঘটনাবলি জানিয়ে সাহায্যের জন্য আবেদন জানালেন। ব্রহ্মেন্দ্র স্বামীর কাছেও তিনি আশীর্বাদ চেয়ে পাঠালেন। সামরিক সাহায্যের ব্যাপারে শাহু এবং নতুন পেশোয়ার উপর প্রভাব বিস্তারের জন্য গুরুকে অনুরোধ করতে ভুললেন না তিনি।
ওই সময় শাহুর অধিকাংশ বাহিনী বাজীরাওয়ের নেতৃত্বে নিজামের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ব্যস্ত। কানোজির মনে ঘোরতর সন্দেহ ছিল বাজীরাওয়ের ইচ্ছে থাকলেও তাঁকে সাহায্য করতে তিনি সক্ষম হবেন কিনা।
আক্রমণ কোন দিক দিয়ে শুরু হবে তা জানা দরকার। কানোজি গুপ্তচর ছড়িয়ে দিলেন বোম্বাই এবং চাওলে। সামরিক প্রস্তুতি সম্বন্ধে যা-কিছু খবর তারা সংগ্রহ করবে চটপট তাঁকে জানিয়ে দেবে। গুপ্তচরদের খবর থেকে এটা তাঁর কাছ স্পষ্ট হয়ে উঠল যে, সম্মিলিত ইঙ্গ-পোর্তুগিজ বাহিনীর লক্ষ্য কোলাবা— স্থল থেকে আক্রমণের পরিকল্পনা করছে তারা।
তিনি কোলাবাকে সুদৃঢ় করে তোলার দিকে মন দিলেন। এদিকে একটা শুভ সংবাদ এল শাহুর কাছ থেকে। পঁচিশ হাজার সৈন্য তিনি পাঠাচ্ছেন কানোজির সাহায্যে। কানোজি নিজেও এতটা আশা করেননি। কয়েক দিনের মধ্যেই মারাঠা বাহিনীর এক অগ্রগামী দল কোলাবায় এসে পৌঁছাল।
পেশোয়া বাজীরাও খবর পাঠালেন তিনি স্বয়ং কানোজিকে সাহায্য করার জন্য আসছেন, রাজার স্থলবাহিনী তিনিই পরিচালনা করবেন। তাঁর সহ-অধিনায়ক পিলাজি যাদব ইতিমধ্যেই অগ্রগামী দলের সঙ্গে কোলাবায় এসে ঘাঁটি গেড়েছেন। সুদক্ষ সেনাপতি এবং কুশলী কূটনীতিবিদ বাজীরাওয়ের নাম তখন আস্তে আস্তে ছড়িয়ে পড়ছে সমগ্র দাক্ষিণাত্যে। তাঁর পিতার অকৃত্রিম সুহৃদ, রূপকথার মানুষ, কানোজি আংরের কাছে নিজের প্রতিভার স্বাক্ষর রাখবার জন্য তিনিও হয়তো উন্মুক্ত হয়ে উঠেছিলেন।
* * *
কানোজ সঠিক সংবাদই পেয়েছিলেন। ইঙ্গ-পোর্তুগিজ বাহিনী স্থল দিয়েই আক্রমণের পরিকল্পনা করেছে, তাদের সাহায্য করবে যৌথ নৌবহর। সমগ্র স্থলবাহিনী চাওল থেকে যাত্রা করবে কোলাবায়। এই আক্রমণের পরিকল্পনায় কোম্পানির স্থলবাহিনীর সংখ্যা ছিল আড়াই হাজারের কাছাকাছি, যেমন
ইউরোপীয় এবং কাফ্রী সেনা… ৬৫৫
ইউরোপীয় অশ্বারোহী … ৪০
দুটি দেশীয় সিপাহী বাহিনী,
প্রত্যেকটির সংখ্যা ৭৫০ হিসাবে… ১৫০০
নৌ-বাহিনী থেকে স্বেচ্ছাদল… ২০০
আগ্নেয়াস্ত্র
কামান : দুটি ২৪ পাউন্ডার, দুটি ১৮ পাউন্ডার, চারটি ৯ পাউন্ডার, ছটি হালকা কামান (ফিল্ড গান), দুটি মর্টার, আটটি গ্রেনেড ক্ষেপণকারী।
স্থলবাহিনীর সেনাপতি— রবার্ট কোয়ান।
পোর্তুগিজদের স্থলবাহিনীর সংখ্যা ছিল প্রায় চার হাজার, যথা—
ইউরোপীয় সেনা ১০০০
স্বেচ্ছাবাহিনী ৩৫০
ইউরোপীয় অশ্বারোহী ১৬০
দেশীয় সিপাহী ২৪০০
আগ্নেয়াস্ত্র
কামান ৬টি ২৪ পাউন্ডা র, ৬টি ১৮ পাউন্ডার, ১০টি হালকা কামান এবং আটটি মর্টার।
পোর্তুগিজ বাহিনী পরিচালনা করছিলেন ডন আন্তনিও দা কাস্ত্রো-ই-মেলো, কিন্তু পোর্তুগিজ ভাইসরয় স্বয়ং এই লড়াই দেখতে উপস্থিত হলেন।
ইঙ্গ-পোর্তুগিজ সম্মিলিত শক্তি দাঁড়াল ছ-হাজারের উপর পদাতিক এবং দু-শো অশ্বারোহী সৈন্য, আটটি ২৪ পাউন্ডার, আটটি ১৮ পাউন্ডার, ষোলোটি হালকা কামান বা ফিল্ড গান, তা ছাড়া ৯ পাউন্ডারের কামান, মর্টার ইত্যাদি। দু-দেশের মোট দশটি যুদ্ধ জাহাজে (পাঁচটি ইংরেজদের এবং পাঁচটি পোর্তুগিজদের)। প্রায় তিন-শো দূরপাল্লার কামান ছিল। পদাতিক বাহিনীর আক্রমণের সঙ্গে সঙ্গে তারাও গোলাবর্ষণ করবে।
কোঙ্কণ উপকূলে কানোজি আংরের সব দুর্গ এবং নৌবহর ধ্বংস করার পক্ষে এই শক্তি যথেষ্ট।
সাতাশ
বোম্বাইয়ের ত্রিশ মাইল দক্ষিণে চাওল। দু-শো বছর ধরে ওটা পোর্তুগিজদের দখলে। এই চাওল থেকে শুরু হবে ঐতিহাসিক ইঙ্গ-পোর্তুগিজ অভিযান। পোর্তুগিজ সেনাপতি আন্তেনিও দা কাস্ত্রো-ই-মেলো তাঁর বাহিনী নিয়ে এসে পড়েছেন, গোয়া থেকে এসেছেন পোর্তুগিজ ভাইসরয়।
কোলাবা হল চাওলের উত্তরে। ইঙ্গ-পোর্তুগিজ পদাতিক ও অশ্বারোহী বাহিনী ১০ ডিসেম্বর চাওল থেকে যাত্রা করল। দু-দিন পর তারা পার হল একটা নদী, যা নাম রগোসিম (Ragocim)। ভারী কামান এবং যন্ত্রপাতি কিন্তু নদীর ওপারে নিয়ে যাওয়া গেল না কারণ দু-পক্ষই দাবি করল সেতু নির্মাণের দায়িত্ব অপরের। শেষপর্যন্ত কোনো মতে একটা সেতু খাড়া করা গেল। নদীর ওপারে রণাঙ্গনের কাছাকাছি রসদ সরবাহের জন্য একটা শিবির তৈরি হল। ইতিমধ্যে সম্মিলিত নৌবহর কোলাবায় এসে পৌঁচেছে। আগেই যে রাজকীয় নৌবহরের কথা বলা হয়েছে তারাও এই অভিযানে অংশগ্রহণ করেছে এ কথা উল্লেখ করা নিষ্প্রয়োজন। কমোডোর টমাস ম্যাথুজ এমন ভান করছেন যেন তিনিই এই অভিযানের সর্বাধিনায়ক।
চাওল থেকে ইঙ্গ-পোর্তুগিজ বাহিনীর গতিবিধির উপর সতর্ক লক্ষ রাখছিল কানোজির গুপ্তচর বাহিনীর। একবার পোর্তুগিজ ভাইসরয়, পোর্তুগিজ সেনাপতি কাস্ত্রো, ইংরেজ সেনাপতি কোয়ান এবং কমোডোর ম্যাথুজ স্থলে মিলিত হয়ে অভিযান পরিচালনার ব্যাপারে শলাপরামর্শ করছিলেন। কানোজির একজন ঘোড়সওয়ার নিঃশব্দে ফণীমনসার একটা ঝোপের পিছন থেকে ম্যাথুজকে লক্ষ করে বল্লম ছুড়ে মারে। বল্লমটা ম্যাথুজের ঊরু ছুঁয়ে গেল, সামান্য আহত হলেন তিনি। ম্যাথুজ ছিলেন ভীষণ বদমেজাজী। প্রচণ্ড ক্রোধে অশ্রাব্য গালিগালাজ করতে করতে তিনি পিস্তল থেকে গুলি ছুড়লেন। আক্রমণকারীকে তাড়া করার চেষ্টা ব্যর্থ হল কারণ তাকে দেখতেই পাওয়া গেল না।
শত্রুপক্ষের শক্তি, বিশেষ করে নৌশক্তিতে কানোজি আশঙ্কিত হয়েছিলেন নিশ্চয়ই। তাঁর চোখের সামনেই দশটি বড়ো বড়ো যুদ্ধ জাহাজ নোঙর করে আছে। শাহুর প্রতিশ্রুতি মতো পদাতিক বাহিনী তখনও এসে পৌঁছয়নি, শুধু পিলাজি যাদবের নেতত্বে আড়াই হাজার সেনা এসেছে। ওই আড়াই হাজারের মধ্যে এক হাজার পদাতিক আর দেড় হাজার অশ্বারোহী সৈনিক।
কোলাবা শত্রুপক্ষের লক্ষ্য বোঝার পর থেকেই কানোজি দুর্গ সুরক্ষিত করার এবং সরবরাহ বৃদ্ধির দিকে যত্নবান হয়েছিলেন। গোলাবারুদ, খাদ্য এবং পানীয় যথেষ্ট পরিমাণে মজুত করেছিলেন।
দুর্গের মধ্যে এক হাজার পদাতিক সেনা আর সাত-শো ঘোড়সওয়ার ছিল। এই বাহিনী এবং দুর্গের কামানের সাহায্যে দীর্ঘকাল তিনি দুর্গ রক্ষা করতে পারবেন বলেই দৃঢ় বিশ্বাস ছিল তাঁর। আরও একটা ব্যাপার উপলব্ধি করেছিলেন অভিজ্ঞ সেনাপতি কানোজি। তাঁর প্রতিরক্ষা সার্থক করতে হলে তাঁকে প্রতি আক্রমণ করতে হবে। পিলাজি যাদবের নেতৃত্বে মারাঠা বাহিনীকে তিনি এ কাজে লাগাবেন ঠিক করলেন। ইঙ্গ-পোর্তুগিজ বাহিনী যখন এগিয়ে আসতে থাকবে ঠিক তখনই কিংবা দুর্গ আক্রমণের পরেই পাশ থেকে তাদের আক্রমণ করার মতলব তিনি মনে মনে আঁটছিলেন।
পরের দশদিন ইঙ্গ-পোর্তুগিজ বাহিনী রগোসিম নদীর উত্তরে তাদের সরবরাহ শিবির শক্তিশালী করার ব্যাপারে ব্যস্ত রইল। কামান, গোলা, খাদ্য এবং যাবতীয় সরবরাহ এনে আক্রমণের শেষ পর্বের প্রস্তুতি চলছে। কানোজির নির্দেশে পিলাজি যাদবের বাহিনী বিশে ডিসেম্বর তারিখে ওই শিবির আক্রমণ করল। প্রতিপক্ষের ব্যুহের কিছুটা ক্ষতি করলেও পোর্তুগিজদের কামানের একেবারে মুখে পড়ে গেল তারা। ফলে বেশ ক্ষতি স্বীকার করে পিছু হঠতে বাধ্য হল মারাঠা বাহিনী।
একুশ তারিখে মিত্রপক্ষ স্থির করল তারা আলাদাভাবে আক্রমণ চালাবে। উত্তরে নদী মূল ভূখণ্ড থেকে কোলাবাকে বিচ্ছিন্ন করেছে। তার কাছাকাছি, কোলাবার উত্তর-পূর্ব কোণে পোর্তুগিজরা নতুন একটা শিবির স্থাপন করল। এখানেও কানোজির ঘোড়সওয়ারের একাংশ তাদের আক্রমণ করল, কিন্তু পোর্তুগিজরা সহজেই সেই আক্রমণ ব্যর্থ করে দিল। এই শিবির থেকে পোর্তুগিজরা দেড় হাজার সেনার একটা দলকে আক্রমণ শুরু করার জন্য আরও এগিয়ে নিয়ে গেল। তেইশ তারিখ সন্ধ্যাবেলা এই অগ্রগামী দলটি উন্মুক্ত বেলাভূমিতে তাঁবু ফেলল। আদেশ পেলেই তারা দুর্গ আক্রমণ করবে।
ইংরেজ বাহিনী দুর্গের দক্ষিণ-পূর্ব দিকে শিবির ফেলেছে। পূর্বে একটা অগভীর প্রণালী মূল ভূখণ্ড থেকে কোলাবাকে বিচ্ছিন্ন করেছে, তার ঠিক পিছনেই পড়ল এই শিবির। চব্বিশ তারিখে ওই শিবির থেকে কর্নেল ব্রেথওয়েটের নেতৃত্বে এক হাজার সৈন্যের একটি দল দুর্গ আক্রমণের জন্য এগিয়ে গেল।
কোলাবার দুর্গ হল দ্বীপের উপর। তখনকার দিনে ভাঁটার সময় পূর্বদিক থেকে হেঁটেই ওই দ্বীপে যাওয়া সম্ভব ছিল। জোয়ারের সময় গলার মতো সরু ওই জায়গাটা জলে ডুবে যেত। সেই অবস্থার সুযোগ নিয়ে শত্রুপক্ষকে আক্রমণ করে বিপদে ফেলার সুযোগ পেয়েছিলেন কানোজি, কিন্তু ওই ফালি জমিটুকু অতিক্রম করার সময় ইঙ্গ-পোর্তুগিজ বাহিনীকে তিনি বাধা দিলেন না।
হয়তো শত্রুবাহিনীর সংখ্যাধিক্য এবং দু-দুবার সংঘর্ষে নিজের পক্ষের ক্ষতি হওয়ায় যুদ্ধের পরিণাম সম্বন্ধে আশঙ্কিত হয়েছিলেন তিনি। শত্রুপক্ষ দ্বিধাবিভক্ত হওয়ায় তিনি নিশ্চয়ই স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছিলেন। তাদের সম্মিলিত অগ্রগামী বাহিনীকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছেন তিনি।
ইঙ্গ-পোর্তুগিজদের পরিকল্পনা ছিল— ইংরেজ পদাতিক বাহিনী দুর্গ আক্রমণ করবে, আর পোর্তুগিজ বাহিনী দ্বীপের উত্তর প্রান্তে অপেক্ষমান পিলাজি যাদবের বাহিনী যেন পাশ থেকে ইংরেজদের আঘাত হানতে না পারে তার জন্য প্রস্তুত থাকবে।
ইঙ্গ-পোর্তুগিজদের নৌবহর কিন্তু পদাতিক বাহিনীর সাহায্যে তেমন সুবিধা করতে পারছিল না। দুর্গ লক্ষ করে স্থির নিশানায় গোলাবর্ষণ করা প্রায় অসাধ্য হয়ে দাঁড়িয়েছিল, কারণ ঠিকমতো জায়গা নিয়ে জাহাজ ভিড়বার পক্ষে অনেক অসুবিধা দেখা গেল। তবে মারাঠা নৌবহরকে কানোজির সাহায্যে এগিয়ে আসার পথ তারা বন্ধ করে রেখেছিল। এমনকী চাওল থেকে অত পরিশ্রম করে আঠারো পাউন্ডার আর চব্বিশ পাউন্ডারের যে কামানগুলি বয়ে আনা হয়েছিল, সেগুলিও কাজে লাগল না। প্রতিকূল অবস্থার জন্য মূল শিবিরে ফেলে আসতে হল। দুর্গ আক্রমণের সময় ইংরেজ বাহিনীকে নির্ভর করতে হল তাদের জাহাজ থেকে ইতস্তত গোলাবর্ষণের উপর। আক্রমণের নির্দিষ্ট দিন সকালে জাহাজ থেকে গোলাবর্ষণ শুরু হয়েছিল, কিন্তু ইংরেজ বাহিনী যখন দুর্গের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য এগুচ্ছে তখন আর তাদের সাড়া পাওয়া গেল না। যুদ্ধক্ষেত্রে পদাতিক বাহিনীর হালকা কামান থেকে বর্ষিত গোলাই একমাত্র আড়ালের কাজ করল আক্রমণকারীদের পক্ষে।
চব্বিশে ডিসেম্বর বিকেল চারটেয় আক্রমণ শুরু হল। হয়তো জোয়ারের জন্যই ওই বেখাপ্পা সময়টা বেছে নিতে হয়েছিল। পদাতিক ও নৌবাহিনী মিলিয়ে মোট এক হাজার সৈন্য কর্নেল ব্রেথওয়েটের নেতৃত্বে সিংহ দরজার কাছে এবং দুর্গ প্রাচীরের দু-পাশে সমবেত হল। দুর্গের ভিতর থেকে মুহুর্মুহু গুলি বর্ষণ সত্ত্বেও আক্রমণকারীরা বাধা মানল না, লম্বা লম্বা মই দুর্গপ্রাচীরের গায়ে লাগিয়ে ঠেলাঠেলি করে ওঠবার চেষ্টা করতে লাগল।
যারা সিংহ দরজা ভাঙবার চেষ্টা করছিল তাদের উপর হঠাৎ বৃষ্টিধারার মতো এমন প্রচণ্ড গুলিবর্ষণ শুরু হল যে, তাদের পক্ষে ওখান থেকে সরে যাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় রইল না। মই বেয়ে কিছু ইংরেজ সৈন্য ওপরে উঠে এল বটে, কিন্তু হাতাহাতি যুদ্ধে তারা সবাই মারা পড়ল। যারা তাদের পিছন পিছন আসছিল তাদের উপর সরাসরি লক্ষে বর্ষিত হতে লাগল গুলি, সঙ্গে সঙ্গে চলেছে প্রস্তর বৃষ্টি। ঘণ্টা খানেক লড়াইয়ের পর ইংরেজ বাহিনী বেলাভূমিতে পিছু হটতে বাধ্য হল। তারা ফেলে গেল হালকা কামান, অন্যান্য সমরোপকরণ আর শ-খানেক হত অথবা আহত সৈনিক।
প্রথম আক্রমণ প্রতিহত করার পর দ্বিতীয় আক্রমণের জন্য প্রস্তুত হতে লাগলেন কানোজি। পোর্তুগিজ বাহিনীর অগ্রগামী দলটাকে তিনি দেখতে পাচ্ছেন, বেলাভূমিতে তারা প্রস্তুত হয়ে রয়েছে। কিন্তু শীতের সূর্য পিছনে ঢলে পড়া সত্ত্বেও পোর্তুগিজদের দিক থেকে দুর্গ আক্রমণের কোনো ইঙ্গিত দেখতে পেলেন না তিনি। কানোজি বুঝতে পারলেন পোর্তুগিজদের যুদ্ধে জড়াতে হলে তাঁকেই এ ব্যাপারে উদ্যোগী হতে হবে। এ সুযোগ তিনি হাতছাড়া করতে চাইলেন না। দিনের আলো আর ঘণ্টা খানেকও আছে কিনা সন্দেহ। কানোজি দ্রুত সিদ্ধান্ত নিলেন। পিলাজি যাদবকে নির্দেশ দিলেন, ‘পোর্তুগিজদের আক্রমণ করো।’
মারাঠা অশ্বারোহী বাহিনী এক জায়গায় স্থির শত্রুর উপর আঘাত হানতে সিদ্ধহস্ত। পনেরোশো ঘোড়সওয়ার বিদ্যুৎগতিতে ধেয়ে গেল পোর্তুগিজদের লক্ষ করে। দুর্গ প্রাচীর থেকে ইংরেজদের বিতাড়িত হতে দেখে পোর্তুগিজরা আগেই মনোবল হারিয়ে বসে আছে। ‘হর হর মহাদেও’ প্রচণ্ড চিৎকারে মারাঠা বাহিনী উদ্যত বল্লম হস্তে ঝাঁপিয়ে পড়ল পোর্তুগিজদের উপর।
ইংরেজরা দুর্গে প্রবেশ করলে পোর্তুগিজরা আক্রমণ করবে— এই ছিল পরিকল্পনা। কিন্তু ঘটনা সম্পূর্ণ উলটে গেল। উন্মুক্ত সৈকতে এভাবে আক্রান্ত হয়ে পোর্তুগিজরা বিমূঢ় হয়ে গেল। তাদের ভারী কামানগুলো প্রণালীর ওপারে মূল বাহিনীর সঙ্গে রয়ে গেছে সুতরাং গোলাবর্ষণের সাহায্য থেকেও বঞ্চিত হল তারা। মারাঠা বাহিনীয় তাদের ওপর এসে পড়ার আগেই তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে যে যার প্রাণ নিয়ে পালাবার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ল। রণোন্মাদ মারাঠা বাহিনী বল্লম আর তাদের অতি প্রিয় বাঁকা তরবারি নিয়ে ঘোর নিনাদে ঝাঁপিয়ে পড়ল তাদের উপর।
সন্ধ্যা হয়ে আসছে। দুর্গ প্রাচীর থেকে বিতাড়িত ইংরেজ সেনারা আক্রমণ করার আগে যেখানে সংঘবদ্ধ হয়েছিল আবার সেখানে নতুন করে দলবদ্ধ হতে শুরু করেছে। আঘাত হানার এটাই অপূর্ব সুযোগ। দিনের আলো প্রায় নিভে এসেছে। কানোজির আদেশে দুর্গরক্ষীদের একদল আক্রমণ করল তাদের। ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল কর্নেল ব্রেথওয়েট পরিচালিত ইংরেজ বাহিনী, দারুণ মার খেল তারা, হতাহত হল প্রচুর। দুটি অগ্রগামী বাহিনীই সম্পূর্ণ পর্যুদস্ত। অন্ধকার নেমে আসায় মারাঠারা তাদের অনুসরণ করে নিশ্চিহ্ন করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হল।
কানোজি ভেবেছিলেন রাতের অন্ধকারে শত্রুপক্ষ আবার আক্রমণে চেষ্টা করবে, কিন্তু পরদিন (সেটা ছিল পঁচিশে ডিসেম্বর, ক্রিশ্চানদের বড়োদিনের পরব) প্রত্যুষে তাঁকে অবাক করল এক দৃশ্য। কোলাবার সৈকত খাঁ খাঁ করছে, শত্রুপক্ষের কোনো চিহ্নই নেই। অন্ধকারের সুযোগে ইংরেজ সেনারা তাদের জাহাজে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে, আর পোতর্গিজরা কোনোমতে ফিরে গেছে তাদের মূল ঘাঁটিতে।
কমোডোর ম্যাথুজ তাঁর জাহাজ থেকে যুদ্ধের ঘটনাবলি লক্ষ করছিলেন। ঘটনার পরিণতিতে তিনি ক্ষেপে গেলেন, পোর্তুগিজরা বিশ্বাসঘাতকতা করেছে— একথা বলে তাদের উপর দোষারোপ করতে ছাড়লেন না। অগ্নিশর্মা হয়ে তিনি ছুটে গেলেন পোতুর্গিজদের মূল ঘাঁটিতে। হাতের ছড়িটা পোর্তুগিজ সেনাপতির নাকের উপর নাচিয়ে তাঁকে তিনি যাচ্ছেতাই গালিগালাজ করলেন, ভাইসরয়কেও ছেড়ে কথা কইলেন না।
চিরশত্রু ইংরেজ আর পোর্তুগিজদের মধ্যে এই সংঘবদ্ধ আক্রমণের ব্যাপারে মৈত্রী বন্ধনের যে সূচনা হয়েছিল, তা ছিন্ন হয়ে গেল। পোর্তুগিজ ভাইসরয় বিরক্ত ও অপমানিত বোধ করে নিজের জাহাজ আশ্রয় নিলেন, ঘোষণা করলেন তিনি অসুস্থ।
ম্যাথুজ তাতেও সন্তুষ্ট হলেন না। তিনি তাঁর জাহাজের চিকিৎসককে পোর্তুগিজ জাহাজে গিয়ে ভাইসরয়কে পরীক্ষা করার নির্দেশ দিলেন। চিকিৎসক ফিরে এসে জানালেন ভাইসরয়ের কিছু হয়নি।
ইংরেজ আর পোর্তুগিজদের মধ্যে সম্পর্কের চিড় ধরেছে— এটা আর গোপন থাকল না। কানোজি সেই সুযোগের পূর্ণ সদব্যবহার করতে চাইলেন। পোর্তুগিজ ভাইসরয়ের কাছে সন্ধির উদার শর্ত দিয়ে দূত পাঠালেন তিনি। কানোজির প্রস্তাব পেয়েই ভাইসরয় ইংরেজদের কাছে খবর পাঠালেন, আপাতত লড়াই বন্ধ রাখা হোক। ইংরেজদেরও নতুন করে আক্রমণ চালাবার মতো মনোবল আর ছিল না, তারা সহজেই এই প্রস্তাবে সম্মতি দিল।
ভাইসরয় যখন কানোজির সঙ্গে সন্ধির ব্যাপারে কথাবার্তা বলছেন ঠিক সেইসময় বাজিরাও পঁচিশ হাজার সেনা নিয়ে উপস্থিত হলেন রণাঙ্গনে। ভাইসরয়ের মনে যেটুকু দ্বিধা ছিল, ওই বিশাল বাহিনী দেখে তা কেটে যেতে দেরি হল না।
কোলাবা আক্রমণের কয়েক দিনের মধ্যেই আলিবাগে (Alibag) পোর্তুগিজ শিবিরে দু-পক্ষের মধ্যে সন্ধির শর্তের ব্যাপারে ঐক্যমত হল। তবে সরকারিভাবে সেই সন্ধির কথা ঘোষণা করা হল ১৭২২ সালের ৯ জানুয়ারি। কানোজি আংরে আর পোর্তুগিজ ভাইসরয় শত্রুর বিরুদ্ধে পরস্পর পরস্পরকে সাহায্য করবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিলেন। তা ছাড়া দু-পক্ষই পরস্পরের বাণিজ্যতরীকে নিজ নিজ বন্দরে অবাধ বাণিজ্যের সুযোগ দিতে অঙ্গীকৃত হলেন। মারাঠাদের যারা শত্রু তাদের বাণিজ্য জাহাজ পাহারা দিয়ে নিয়ে যাবে না পোর্তুগিজ রণতরী। তা ছাড়া, সুলভ মূল্যে মারাঠাদের কামান ও গোলা সরবরাহ করতে রাজি হলেন পোর্তুগিজ ভাইসরয়।
এদিকে সন্ধির প্রস্তাব নিয়ে যখন সবে আলোচনা শুরু হয়েছে, সেই সময়, আটাশে ডিসেম্বর, ইংরেজরা তাদের নৌবহর নিয়ে ফিরে গেছে।
ইঙ্গ-পোর্তুগিজ সম্মিলিত আক্রমণ শেষপর্যন্ত একটা প্রহসনে পরিণত হল, আর কানোজি আংরের হল জয় জয়কার।
আঠাশ
সমুদ্রপথে আরও দুঃসাহসী হয়ে উঠলেন কানোজি। কোম্পানির বাণিজ্যতরী ছাড়াও যুদ্ধ জাহাজ পর্যন্ত বেছে বেছে আক্রমণ শুরু করলেন। চার্লস বুন হতোদ্যাম হয়ে ফিরে গেছেন স্বদেশে, তাঁর জায়গায় গভর্নর হয়ে এসেছেন উইলিয়াম ফিপস। তাঁর কর্মভার গ্রহণের প্রথম মাসেই কানোজির নৌবহর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দুটি যুদ্ধ জাহাজ আক্রমণ করল, জাহাজ দুটির নাম ‘হান্টার’ আর ‘ঈগল’। সারাদিন ধরে চলল যুদ্ধ, দু-পক্ষই বিপক্ষের জাহাজে উঠবার অক্লান্ত চেষ্টা করছে। শেষপর্যন্ত ‘হান্টার’ চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেল কামানের গোলায় আর ‘ঈগল’ কোনোমতে পালিয়ে বাঁচল।
১৭২২ সালের এপ্রিল মাসে কোম্পানির একটা বাণিজ্য জাহাজ দখল করলেন কানোজি। ওই জাহাজে প্রচুর পণ্যদ্রব্য আর সোনারূপার পিণ্ড মজুত ছিল। ওই বছরই অক্টোবর মাসে আন্ধেরির কাছে কোম্পানির নৌবহরের সঙ্গে কানোজির একটা আংশিক নৌবহরের তুমুল লড়াই হল। ইংরেজ নৌবহরে তিনটি যুদ্ধ জাহাজ ছিল, ‘ভিকটরি’, ‘স্যালিবারি’ আর ‘রিভেঞ্জ’, তাদের সম্মিলিত কামানের সংখ্যা আশি। কানোজির নৌবহরে ছিল মাত্র একটা ঘুরাব আর কয়েকটা গালিভাত। ওই যুদ্ধে কানোজির পক্ষের ওলন্দাজ নৌসেনাপতি প্রাণ হারালেন। প্রচণ্ড লড়াইয়ে বিধ্বস্ত ঘুরাবকে যুদ্ধ জয়ের পুরস্কার স্বরূপ বোম্বাই নিয়ে যাওয়া হল। এই সাফল্যে আনন্দের সাড়া পড়ে গেল বোম্বাইয়ে।
১৭২৩ সালের শেষের দিকে কানোজির নৌবাহিনী একটা ওলন্দাজ জাহাজ দখল করল। প্রতিশোধ নেবার জন্য ওলন্দাজদের শক্তিশালী একটা নৌবহর আক্রমণ করল ঘেরিয়া। সেটা ছিল ১৭২৪ সালের গোড়ার দিকে। ঘেরিয়া দুর্গ ইতিমধ্যে বিশেষভাবে সুরক্ষিত করা হয়েছে। ইংরেজদের অসফল আক্রমণের পরেই কানোজি এ বিষয়ে উদ্যোগী হয়েছিলেন। দুর্গের অধ্যক্ষ রুদ্রজি অনন্ত একজন বেপরোয়া লড়ুয়ে। তাঁর এবং দুর্গরক্ষীদের মনোবল অত্যন্ত উঁচু।
সাতটা যুদ্ধ জাহাজ নিয়ে ঘেরিয়া আক্রমণ করল ওলন্দাজ বাহিনী, প্রত্যেক জাহাজে ত্রিশ থেকে পঞ্চাশটি কামান। নাবিক আর নৌসেনার সংখ্যা তিন হাজারের কম নয়।
ওলন্দাজ সেনারা বেলাভূমিতে অবতরণ করল। তারা বেলাভূমিতে সবে নেমেছে এমন সময় রুদ্রজি তাঁর রক্ষীবাহিনি নিয়ে তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন। চরম দুঃসাহসের পরিচয় দিয়েছিলেন রুদ্রজি অনন্ত। আক্রমণ শুরু করার আগেই পরাস্ত হল আক্রমণকারী ওলন্দাজ বাহিনী।
এদিকে কানোজির দুটি জাহাজ আর কোম্পানির এক নৌবহরের মধ্যে সংঘর্ষে আংরের একটা ঘুরাব শত্রুর হাতে বন্দি হল। ওই ঘুরাবের অধিনায়ক ছিলেন কানোজির প্রাচীনতম সেনাপতি, শিবাজি নায়েক, কানোজির ঘনিষ্ঠ বন্ধুও ছিলেন তিনি। হয়তো এই ঘটনায় কানোজি খুব উদবিগ্ন হয়েছিলেন। বন্ধুর মুক্তির জন্য কিছুটা হীনতা স্বীকার করেও ইংরেজদের শর্তে সন্ধির প্রস্তাবে রাজি হলেন তিনি।
১৭০২ সালে যে মানুষটি ইংরেজ গভর্নরকে এই বলে শাসিয়েছিলেন যে, ইংরেজদের তিনি আতঙ্কের সঙ্গে তাঁর নাম স্মরণ করতে বাধ্য করবেন, সেই মানুষটিই ১৭২৪ সালে ইংরেজদের অসম্মানজনক শর্তাবলি মেনে সন্ধির প্রস্তাবে সম্মতি দিলেন।
শুধু বত্রিশ আর চুয়ান্ন বছরের পার্থক্য কিংবা বিশ্বস্ত সহযোগীর মুক্তির উৎকণ্ঠাই তাঁকে নমনীয় করেছিল। ওই সময় তিনি শক্তির তুঙ্গে, নিজের নৌবাহিনীর উপর তাঁর গভীর আস্থা। আসলে শুভ্রকেশ তাঁকে এনে দিয়েছে অভিজ্ঞতা, তিনি উপলব্ধি করতে শুরু করেছেন যুদ্ধ জয়ই একমাত্র কাম্য হতে পারে না, যুদ্ধ পরিহার করাও সফল নায়কত্বের একটা অঙ্গ। তিনি এখন শান্তি চাইছেন। যুদ্ধ জয়ের গৌরব অপেক্ষা যুদ্ধের পরিণামে সাধারণ মানুষের অশেষ দুর্দশার কথা উপলব্ধি করছেন তিনি এখন। দুর্ধর্ষ সেনাপতি হঠাৎ যেন বিচক্ষণ শাসকে রূপান্তরিত হয়েছেন।
কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির দিকে তিনি সচেষ্ট হলেন, সেইসঙ্গে কোঙ্কণ উপকূলে লবণ তৈরির কারখানা স্থাপন করলেন। কোঙ্কণে কাঠের অভাব দূর করার উদ্দেশ্যে তিনিই বোধ হয় প্রথম বন সৃষ্টির ব্যাপারে উদ্যোগী হয়েছিলেন। বিচারব্যবস্থার দিকেও সজাগ দৃষ্টি রেখেছিলেন তিনি। শিল্পকলার উন্নতিতেও তাঁর যথেষ্ট আগ্রহ ছিল। শিক্ষার উন্নতিকল্পে চার-পাঁচটা গ্রাম নিয়ে একটা করে পাঠশালা স্থাপিত হল। বড়ো বড়ো গ্রাম কিংবা শহরে নিজস্ব বিদ্যালয়ের ব্যবস্থা তিনি করেছিলেন। কোলাবা দুর্গে তিনি একটি আবাসিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, ওটার পরিচালনায় তাঁর ব্যক্তিগত আগ্রহ ছিল।
মন্দির এবং বিভিন্ন ধর্ম প্রতিষ্ঠানে প্রচুর দান করেছিলেন কানোজি। ব্রহ্মেন্দ্র স্বামীর প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা দিন দিন বেড়েই চলেছিল; প্রায়ই উপঢৌকন পাঠাতেন তিনি গুরুকে।
১৭২৪ সালে তাঁর পূর্বপুরুষদের গ্রাম অঙ্গারওয়াড়িতে জমি কেনার জন্য উৎসুক হয়ে উঠলেন কানোজি। পূর্বপুরুষদের ভিটায় জমিজমা ও বাড়ি করে অতীতের সঙ্গে বর্তমানের সেতুবন্ধন করলেন তিনি।
কানোজি আংরের শেষজীবন কিন্তু শান্তিপূর্ণ হয়নি। তিনি বুঝতে পারছিলেন তাঁর পুত্ররা একসঙ্গে মিলেমিশে বাস করতে পারবে না। ছয় পুত্রের মধ্যে জ্যেষ্ঠ শেখজিকে তিনি অন্যান্যদের চাইতে অধিক স্নেহ করতেন। মনেপ্রাণে তিনি চাইছিলেন তাঁর অবর্তমানে শেখজি তাঁর স্থান নেবে। যখনই কোলাবা থেকে বেশ কিছু দিনের জন্য তাঁকে বাইরে যেতে হত, তিনি জ্যেষ্ঠ পুত্রকে সবকিছুর ভার দিয়ে যেতেন। অন্যান্য সন্তানরা যাতে জ্যেষ্ঠের প্রাধান্য স্বীকার করে নেয় তাই এই ব্যবস্থা। তাঁর মৃত্যুর পর শেখজি রাজার ‘সরখেলের’ পদে নিযুক্ত হবে এবং অন্যান্য ভাইরা তার পাশে দাঁড়িয়ে তার হাত শক্ত করবে— এটাই ছিল কানোজির বাসনা, কিন্তু তাঁর সে আশা বোধ হয় সফল হবে না।
দ্বিতীয় পুত্র শাম্ভাজি প্রচণ্ড সাহসী, কিন্তু নিষ্ঠুর আর উচ্চাকাঙ্খী। শাম্ভাজি প্রকাশ্যেই বলে বেড়াচ্ছিল, সরখেলের পদের জন্য জ্যেষ্ঠ শেখজির চাইতে সে ঢের বেশি উপযুক্ত।
শেখজি ছিল শান্ত এবং গম্ভীর প্রকৃতির। সৎ এবং ভদ্র— কোঙ্কণের শাসক হিসেবে আদর্শ মানুষ। অপরদিকে কানোজি নিজে কৈশোর থেকে যৌবনে যেমন নির্ভীক এবং দুঃসাহসী ছিলেন, শাম্ভাজির চরিত্রেও ফুটে উঠেছিল সেই বৈশিষ্ট্য।
তৃতীয় পুত্র মানাজি নিষ্ঠুরতা আর উচ্চাকাঙ্খায় শাম্ভাজির চাইতে কোনো অংশে কম নয়। ‘সরখেলের’ পদের দিকে তারও লোভাতুর দৃষ্টি। শেখজির মতো শান্ত মানুষষের জীবন কণ্টকাকীর্ণ হয়ে উঠবে এই চিন্তাই শেষ বয়সে আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল কানোজিকে। পুত্রদের এই কলহের সুযোগে এগিয়ে আসবে শত্রুর দল, প্ররোচিত করবে একজনের বিরুদ্ধে আরেকজনকে— এটা যেন চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছেন তিনি। মারাঠা সিংহাসনে দুজন দবিদারের মতো তাঁর নিজের ঘরও ভাগ হয়ে যাবে।
১৭২৭ সালে ব্রহ্মেন্দ্র স্বামীর প্ররোচনায় শাহু সিদ্দির বিরুদ্ধে অভিযানের সংকল্প করলেন। সেই উদ্দেশ্যে আলোচনার জন্য কানোজির ডাক পড়ল সাঁতারায়। কানোজি অনর্থক যুদ্ধ চাইছিলেন না। শাহু এবং বাজীরাওকে তিনি বোঝালেন, মারাঠা বাহিনী নিজামের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যেভাবে লিপ্ত হয়ে পড়েছে, তাতে সিদ্দির সঙ্গে লড়াইয়ের জন্য ওখান থেকে সৈন্য সরিয়ে আনা উচিত হবে না। তা ছাড়া সিদ্দিকে আক্রমণ করলে ইংরেজরা তাঁর সাহায্য এগিয়ে আসবে, ফলে যুদ্ধ এক জায়গায় কেন্দ্রীভূত থাকবে না। ব্রহ্মেন্দ্র স্বামী সিদ্দির প্রধান সেনাপতির বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত প্রতিহিংসার কারণেই শাহু আর বাজিরাওকে উস্কানি দিচ্ছিলেন। তিনি বললেন, ইংরেজদের উপর তিনি তাঁর প্রভাব বিস্তার করবেন যাতে তারা সিদ্দির সাহায্যে এগিয়ে না আসে। শেষপর্যন্ত কানোজির যুক্তিই টিকল। সাঁতারায় তাঁদের এই আলোচনা হয়েছিল ১৭২৭ সালের অক্টোবরে। সেসময় মহারাষ্ট্রে দশেরা উৎসব চলছে।
১৭২৮ সালে কানোজি কোম্পানির বাণিজ্য জাহাজ ‘ডার্বি’ দখল করলেন। এযাবৎ যত জাহাজ তিনি আটক করেছেন ওটাই বোধ হয় তাদের মধ্যে সবচেয়ে দামি জাহাজ— প্রচুর ধনরত্ন এবং বাণিজ্যসম্ভারে বোঝাই ছিল ‘ডার্বি’।
সাঁতারার আলোচনায় শাহুকে তিনি সিদ্দির বিরুদ্ধে যুদ্ধে বিরত থাকার পরামর্শে রাজি করিয়েছিলেন, কিন্তু একথাও তিনি বুঝেছিলেন যে, তিনি সাঁতারা ত্যাগ করার সঙ্গে সঙ্গেই ব্রহ্মেন্দ্র স্বামী আবার উঠে পড়ে লাগবেন, শাহুর সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করিয়ে তবে ছাড়বেন। তিনি যেন দিব্যদৃষ্টিতে দেখেছিলেন ওই ঘটনা।
কোলাবায় প্রত্যাবর্তনের অল্প কিছুদিন পরেই শাহু তাঁকে ওই ব্যাপারে আলোচনার জন্য আবার ডেকে পাঠিয়েছিলেন। ১৭২৮ সালের পুরো বছর এবং ১৭২৯ সালের গোড়ার দিকে কয়েক বারই শাহু তাঁকে সাঁতরায় আহ্বান করলেন, শেষের দিকে খুবই চাপ দিতে লাগলেন। কানোজি একটা-না-একটা অজুহাতে যাত্রা স্থগিত রাখছিলেন। ১৭২৯ সালের বসন্তকালে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লেন, অজুহাতের আর প্রয়োজন হল না।
ওই বছরের চৌঠা জুলাই তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। শাহু এবং ব্রহ্মেন্দ্র স্বামীর ক্রমাগত দাবি তিনি ঠেকিয়ে রেখেছিলেন, কিন্তু মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তে তিনি বোধ হয় বুঝেছিলেন তিনি হেরে গেলেন, শেষ রক্ষা আর করতে পারলেন না। তাঁর মৃত্যুর পর শেখজিকেই প্রধান নৌসেনাপতি এবং কোঙ্কণের শাসনকর্তার পদে নিযুক্ত করবেন শাহু— এ কথা যেমন সত্য, তেমন সত্য শেখজিকে ওই পদে প্রতিষ্ঠিত করার আগে সিদ্দির বিরুদ্ধে অবিলম্বে অভিযানের প্রতিশ্রুতি চাইবেন শাহু। শেখজি ওই প্রতিশ্রুতি দেবে সে বিষয়ে কানোজির বিন্দুমাত্র সন্দেহ ছিল না।
শেখজি আংরে তার পিতা কানোজি আংরের মতোই শৌর্য, বীর্যের পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে পিতৃগৌরব অক্ষুণ্ণ রাখবে— একথা ভেবে শেষমুহূর্তে হয়তো-বা কানোজির বুক পুত্রগর্বে ভরে উঠেছিল!
কানোজি আংরের বিস্ময়কর কাহিনি শেষ করার আগে একটা কথা না বললে এ কাহিনি অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। তা হল, স্থলযুদ্ধে বড়ো বড়ো মহারথীর অভাব ভারতবর্ষের ইতিহাসে কোনোদিন হয়নি, কিন্তু নৌযুদ্ধে কানোজি ছিলেন দুর্দম এবং অদ্বিতীয়। নেলসনের চাইতে তাঁর সাহস এবং রণকৌশল কোনো অংশে খর্ব ছিল না, শুধুমাত্র ভারতবর্ষে জন্মগ্রহণ করেছিলেন এই অপরাধ এবং পরবর্তীকালে ইংরেজ ঐতিহাসিকদের ইচ্ছাকৃত অনাদরে এই অনন্যসাধারণ মানুষটি ভারতবাসীর কাছে প্রায় অপরিচিতই থেকে গেছেন। ভারতবর্ষের ইতিহাসে কানোজি আংরের তেমন উল্লেখ পর্যন্ত নেই। এ আমাদের জাতীয় কলঙ্ক!