কৈখালির হাটে

কৈখালির হাটে

নামখানা জম্পেশ। বজ্রবাহু মণ্ডল। এই নাম শুনে প্রাইমারির মাস্টারমশাই হরিপদ গড়াই বলেছিল, তোর নামখানাই তো ভূমিকম্প রে! কিন্তু নাম ধুয়ে তো জল খাবি না বাবা, একটু লেখাপড়ায় মন দে।

তা দিয়েছিল বেজা। বজ্রবাহু বলে আর কে ডাকছে তাকে। বেজা নামই সকলের মুখে। তা বেজা লেখাপড়ায় তেমন বোবাকালাও ছিল না। প্রাইমারি ডিঙিয়ে হাই, তারপর হাইও ডিঙিয়ে গিয়েছিল। সেকেন্ড ডিভিশন। তা তা—ই বা কম কী? কিন্তু এইখানে তার লেখাপড়ার গাড়ি সেই যে থেমে গেল, আর নড়ল না। বাপ অজাগর মণ্ডল সাপকাটিতে মারা যাওয়ার পর বজ্রবাহুর মাথায় বজ্রাঘাত। সংসারের হাল না ধরলে শুকিয়ে মরতে হবে। বিধবা মা, আরও তিনটে ভাইবোন, বাপের ধারদেনা— সব মিলিয়ে বিশ বছরের বেজা হিমসিম। অজা মণ্ডলের তিন বিঘে জমি ছিল পার্টির দয়ায়। তার পাট্টা ছিল না বটে। অজা মণ্ডল মরার পর জমি নিয়ে বখেরা লেগে গেল। জয়েশ পুততুণ্ড লিডার মানুষ। সে বলল, ও জমি তো আমার, অজা ভাগে চাষ করত। জয়েশের ওপর কথা কইবে কে? সুতরাং জমি একরকম ভোগে চলে গেল।

বেজার যখন পাগল হওয়ার জোগাড় সেই সময়ে স্বর্গ থেকে দেবদূতের মতো নেমে এল নব হালদার। সেও লিডার মানুষ। জমিজমা, গোরুবাছুর, পাকা বাড়ি নিয়ে ফলাও অবস্থা। তাকে ডেকে বলল, শোনো বাপু, তুমি লেখাপড়া জানা ছেলে, বুদ্ধি—বিবেচনাও আছে মনে হয়। যদি আমার প্রস্তাব মেনে নাও তাহলে ব্যবস্থা হয়ে যাবে।

বেজা তখন সবাইকেই খুশি করতে মুখিয়ে রয়েছে, এতগুলি উপোসি মানুষকে রক্ষা না করলেই নয়। বলল, যে আজ্ঞে?

আমার মেয়ে মালতীকে তো দেখেছ বাপু। তাকে যদি বিয়ে কর তাহলে তোমার পাশে আমি আছি।

বেজা পক করে খানিক হাওয়া গিলে ফেলল। হাওয়ার ডেলাটা পেটে নামল না, গলাতেই বেলুনের মতো আটকে রইল। যাকে ঘাঁটাপড়া মেয়েছেলে বলে, মালতী হল তাই। বয়সে না হোক বেজার চেয়ে তিন চার বছরের বড়ো। একবার বিয়েও হয়েছিল বিষ্টুপুরের নগেনের সঙ্গে। বছর না ঘুরতেই ফেরত এসেছে। তারপর থেকে মালতী আর বিয়েতে বসেনি বটে, কিন্তু পুরুষ—সঙ্গে তার খামতি নেই। সারা গাঁয়ে তাকে নিয়ে ঢিঢি। নব হালদার মেয়েকে সামাল দেওয়ার মতো ক্ষমতা রাখে না। মালতী তার বাপকে কুকুর বেড়াল বলে মনে করে।

সেই মালতী হালদারকে বেজা বিয়ে করবে কি? সে গলার বাতাসের বেলুনটা গিলে ফেলার চেষ্টা করল অনেকবার। হল না।

নব হালদার বলল, জমি ফেরত পাবে। তিন বিঘের জায়গায় পাঁচ বিঘে। আর একখানা তিন চাকার ম্যাটাডোরও দেব। ভালো করে ভেবে দেখ।

পেটের দায় বড়ো দায়। তবু রাজি হতে সময় নিচ্ছিল বেজা। কারণ ইদানীং শোনা যাচ্ছে মালতী নরেশ লস্করের সঙ্গে নটখট করে বেড়াচ্ছে। আর নরেশ হল হলদিঘাটের খুনে গুন্ডা। ডাকাতির মামলাতেও তার নাম আছে।

নব হালদারের মুখের দিকে চেয়ে বেজার মনে হল, লোকটা বড়ো নাচার। মালতীকে কারও ঘাড়ে না গছালে তার চলছে না।

বেজা বলল, যে আজ্ঞে।

নব একটু হাসল। বলল, তবে বাপু, বুঝতেই পারছ, মালতী আদরে মানুষ, তোমাদের ওই ভাঙা ঘরে তো আর থাকতে পারবে না। তুমিই দিব্যি এসে থাকবে আমার বাড়িতে। আলাদা ঘরটর আছে। খরচাপাতিও ধর আমারই।

বেজা মাথা নীচু করে রইল। ঘর—জামাই হতে তার আর আপত্তি কীসের?

এই ঘটনার দু—দিন বাদে কৈখালির হাটে যাচ্ছিল বেজা। কুমোরপাড়ার মোড়ে মালতীর মুখোমুখি পড়ে গেল।

খুব রসের হাসি হেসে মালতী বিষবিছুটি মাখা গলায় বলল, এই যে নাগর, শুনলুম নাকি আমার সঙ্গে মালাবদল করার জন্য হাঁ করে আছ!

বেজা তটস্থ হয়ে বলল, ইয়ে—মানে আপনার আপত্তি থাকলে—

আহা, আমার আবার আপত্তি কী গো! আমি তো বরণডালা সাজিয়ে বসেই আছি। বলি ভালোমানুষের পো, মধু আর হুল দুটোই সইবে তো!

তারপর সে কী গা—জ্বালানো হাসি!

ভাবী বউয়ের রকমসকম দেখে বড্ড দমে গিয়েছিল বজ্রবাহু। তার নামটাই যা শক্তসমর্থ, সে অতি দুর্বল মানুষ।

তা মালতী যে চোখেই দেখুক তাকে, বিয়েটা কিন্তু হয়ে গেল। ঘটাপটা তেমন কিছু নয়, তবে হ্যাজাক জ্বেলে, মন্ত্রপাঠ করে, দু—পাঁচজনকে ভোজ খাইয়ে একরকম হল ব্যাপারটা। কিন্তু যখন একা ঘরে মালতীর মুখোমুখি হতে হল তাকে তখন যে বুকের ধুকপুকুনিটা শুরু হল তার সেটা অদ্যাবধি থামেনি।

বিয়ের রাতে মালাটালা পরে ঘরে ঢুকতেই প্রেতিনীর মতো সে কী খলখল করে হাসি মালতীর! যেন সং দেখছে। বলল, বাঃ, বর তো দিব্যি সেজেছে দেখছি! তা এবার কী হবে গো! রসের খেলা নাকি। এস এস নাগর, দেখি তুমি কেমন পুরুষ!

নিজেকে এমন নপুংসক কখনো মনে হয়নি বেজার। তখন তার ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি অবস্থা। মালতী সম্বন্ধে শোনা ছিল তার। লোকে তাকে খারাপই বলে। কিন্তু বিয়ের রাতে যে অবস্থা করে তাকে ছাড়ল মালতী তাতে বেজার চোখ ভরে জল এসেছিল। মালতী শরীর ছাড়া কিছু বোঝে না। আর শরীর দিয়ে তাকে খুশি করার মতো মনের অবস্থাও ছিল না তার সেদিন। অপমানে, লজ্জায়, নিজেকে হীন ভেবে ভেবে ছোটো হয়ে গিয়ে সেদিন সে একটা জরদগব। মালতী শেষমেষ একখানা লাথিও মেরেছিল তাকে। সঙ্গে অশ্রাব্য গালাগাল।

সেই রাতে গলায় দড়ি দিতে ইচ্ছে হয়েছিল তার।

কেন যে তার সঙ্গে নিজের মেয়ের বিয়ে দিল নব হালদার তা সে খুব ভেবে দেখেছে। বেশি ভাবতে হয়নি অবশ্য। পরদিনই মালতীর বউদি মঙ্গলা তাকে আড়ালে ডেকে বলেছে, মেয়ের বদনাম ঘোচাতে তোমার সঙ্গে বিয়ে দিয়েছে আমার শ্বশুর। তুমি হলে শিখণ্ডী। সেইরকমই থাক। নইলে কপালে কষ্ট আছে।

মালতীর সঙ্গে এক ঘরে ওই একটা রাতই কেটেছে বজ্রবাহুর। পরদিন থেকেই সে পাশের খুপরিতে চালান হয়ে গেল।

বিয়ে যা—ই হোক, নব হালদার তাকে কথামতো জমি আর তিন চাকার ম্যাটাডোরখানা দিয়েছিল বটে। সেই ম্যাটাডোরখানা চালিয়েই আজ কৈখালির হাটে এসেছে বেজা। গঙ্গারামের মাল বয়ে এনেছে গঞ্জ থেকে। হাট ভাঙলে ফের ফেরত নিয়ে যাবে। এই করে তার রোজগার কিছু কম হয় না। ছোটো ভাই বিশালবাহু চাষবাষ দেখে। পরিবারটা বেঁচে গেছে।

আশ্চর্যের বিষয় মালতী এখনো তার বউ। ঠিক বটে মালতীর সঙ্গে আজকাল তার একরকম দেখাই হয় না। তবু বিয়েটা টিকে আছে। মালতী বিয়ের দু—বছর বাদে এখন নতুন পুরুষ ধরেছে। খয়রাপোতার মহাজন বীরেশ মহান্তকে। বীরেশ ফূর্তিবাজ লোক, টাকা ওড়াতে ভালোবাসে। মালতীকে তার পছন্দও খুব। বেজা এসব দেখেও দেখে না। পাশের ঘরে যা হওয়ার হয়। বেজা তার খুপরিতে শুয়ে ঘুমোয়।

বেজা জানে, তাকে আজকাল কেউ মানুষ বলে মনে করে না। পুরুষ হয়েও বউকে সামলাতে পারেনি বলে তার বিস্তর বদনাম। কিন্তু বেজা ভাবে, লোকে যাই বলুক তার কর্তব্য সে করেছে। পরিবারটাকে বাঁচিয়ে দিয়েছে।

কৈখালির হাট মানে এক বিচিত্র জায়গা। দোকান—পসার, বিকিকিনির এমন রমরমা হাট এ তল্লাটে নেই। অনন্ত দশ—বারোখানা গাঁয়ের লোক এসে হাটে ভিড় করে।

বজ্রবাহু ম্যাটাডোর এক চেনা দোকানির হেপাজতে রেখে হাট দেখতে বেরল। কেনাকাটাও কিছু আছে। ছোটো বোন সিতির জন্য একটা হাত—আয়না, মায়ের জন্য মালিশের ওষুধ, একখানা ভালো কাটারি এইসব টুকিটাকি।

দুই

জিপগাড়িটা থামিয়ে পেচ্ছাব করতে নেমেছিল বীরেশ মহান্ত। বাঁশবনের ধারে নির্জন জায়গায় দাঁড়িয়ে প্রাকৃতিক মর্মটা সারতে সারতে তার মনে হচ্ছিল, পেচ্ছাবের সেই তেজটা যেন আর নেই। আগে যেমন মাটি খুঁড়ে ফেলত, সেরকমটা আর হয় না আজকাল। শরীরের সেই তেজবীর্য ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে হয়তো। কমারই কথা।

প্যান্টের জিপারটা টেনে জিপগাড়ির দিকে ফিরে আসছিল সে। জিপে মালতী বসা। ছেনাল মেয়েছেলেটা এই দুপরে কেমন সেজেছে দেখ। জরির কাজ করা ঝলমলে লাল টকটকে শাড়ি, হাতায় কাজ করা ব্লাউজ, মুখে গুচ্ছের স্নো—পাউডার, কপালে মস্ত টিপ, ঠোঁটে রাঙা লিপস্টিক। একেবারে সং। তার ওপর মুখে একখানা ন্যাকা ন্যাকা খুকি—খুকি ভাব। আজকাল আর কেন যেন মেয়েছেলেটাকে পছন্দ হচ্ছে না তার।

জিপগাড়িটার দিকে যেতে যেতেও ধমকে দাঁড়ায় বীরেশ, পকেট থেকে সিগারেট বের করে ধরায়, একটু ভাবে।

কী গো! তোমার হল?

বীরেশ জবাব দিল না।

দেরি হচ্ছে কেন? হাটে যেতে সন্ধে হয়ে যাবে যে!

বীরেশ সিগারেট খেতে খেতে ধীরে ধীরে একটা সিদ্ধান্তে আসতে লাগল। নাঃ, এবার এই মেয়েছেলেটাকে ঝেড়ে ফেলতে হবে। অনেক হয়েছে, আর নয়। এর একটা নামকোবাস্তে স্বামী আছে। মেনিমুখোটা পাশের ঘরে শুয়ে ঘুমোয়।

মেনিমুখো হলেও লোকটাকে কখনো খারাপ লাগেনি বীরেশের। সরল,সোজা ছেলে। নাটকে একটা পার্ট করতে হবে বলে করে যাচ্ছে। পেটের দায় বলেও তো কথা আছে।

কই গো! জবাব দিচ্ছ না কেন?

মালতী জিপগাড়ি থেকে মুখ বাড়িয়ে উঁকি দিল।

বীরেশ হাসল, বলল আসছি।

দেরি করছ কেন বল তো!

এই একটু হাত—পায়ের আড় ভাঙছি।

একা সিগারেট খাচ্ছো? আমাকেও একটা দাও। বড্ড ঘুম—ঘুম পাচ্ছে।

এগিয়ে গিয়ে বীরেশ ওকে সিগারেট দিল। মেয়েছেলের সিগারেট খাওয়া কেন যেন পছন্দ হয় না বীরেশের।

গাড়িতে উঠে স্টার্ট দিল বীরেশ।

তোমার আজ কী হয়েছে বলো তো! কেমন যেন আলগা আলগাভাব! কী হয়েছে বলবে তো!

কিছ নয়, রোজ কী আর একরকম থাকা যায়?

বলি, আমি পুরোনো হয়ে যাইনি তো!

তা একা তুমি কেন? আমিও তো পুরোনো হচ্ছি।

জিপের পিছনে কয়েক পেটি মাল আছে। বীরেশের দিশি মদের ব্যাবসা।

কৈখালির হাটে মদের ব্যাপারিরা তীর্থের কাকের মতো চেয়ে বসে আছে। গিয়ে পড়লে পেটি নামাতেও হবে না, লহমায় বিক্রি হয়ে যাবে জিপগাড়ি থেকেই।

বীরেশ গাড়িতে হঠাৎ ব্রেক কষল।

মালতী বলল, কী হল থামলে কেন?

মদের গন্ধ পাচ্ছি যেন! বোতল ভাঙল নাকি?

মালতী হাসল, না গো, তোমার ফ্লাস্ক থেকে আমি একটু হুইস্কি ঢেলে খেয়েছি।

কখন?

যখন তুমি নেমে গিয়েছিলে তখন।

কেমন যেন এ ব্যাপারটাও পছন্দ হল না বীরেশের। যখন মানুষটার প্রতি অপছন্দের ভাব হয় তখন সেটা ধীরে ধীরে বাড়ে। তখন তার সবকিছুই অপছন্দ হতে থাকে। বীরেশের সিটের ধারের খাঁজে বেঁটে মোটা বড়োসড়ো স্টিলের ফ্লাস্কটা রাখা। তাতে বরফ মেশানো দামি হুইস্কি। বীরেশ দিনের বেলা খায় না। সূর্য ডুবলে তবে ওইসব।

গম্ভীর হয়ে আছো কেন বলো তো!

না, গম্ভীর হব কেন? ঠিকই আছি।

না, তুমি ঠিক নেই। বলো না গো কী হয়েছে?

এই শুরু হল ন্যাকামি। এটাই সবচেয়ে অসহ্য।

হঠাৎ বীরেশ বলল, আচ্ছা, গায়ে অমন বিটকেল গন্ধ মাখো কেন বলো তো!

মাথা ধরে যায়।

ও মাগো, বিটকেল গন্ধ কী? এই সেন্ট যে নিউ মার্কেট থেকে কিনে এনেছিলে তুমি।

আমি?

ও মা, মনে নেই?

তা হবে। গন্ধটা ভালো লাগছে না তো!

ঠিক আছে এটা না হয় মাখব না।

কৈখালির রাস্তা জঘন্য। মাঝে—মাঝেই রাস্তার ছাল—চামড়া উঠে গিয়ে কোপানো খেতের মতো অবস্থা, বড়ো বড়ো গর্ত, তার উপর ধুলো তো আছেই। ঝপাং ঝপাং করে জিপ লাফাচ্ছে। তিন—চারখানা গো—গাড়ি সামনে রাস্তা আটকে চলেছে অনেকক্ষণ ধরে। জিপ এগোতে পারছে না। ভারি বিরক্তিকর অবস্থা। ঘনঘন হর্ন দিচ্ছে বটে, কিন্তু সরু রাস্তায় গো—গাড়িই বা সাইড দেবে কী করে?

দুটো হাঁচি দিল মালতী। তারপর রুমালে নাক—মুখ চাপা দিয়ে বলল, এই রে! আমার আবার নাকে ধুলো গেলেই সর্দি হয়।

বীরেশ গো—গাড়িগুলিকে পাশ কাটানোর ফিকির খুঁজছে, সুবিধেমতো জায়গা পেলে রাস্তা থেকে ওভারটেক করে ফের রাস্তায় উঠবে। কিন্তু সেরকম সুবিধে পাচ্ছে না। ডানধারে ঝোপঝাড়, বাঁশ বন, গভীর নাবাল কিংবা পুকুর বা খেত। ক্রমশ ধৈর্য হারাচ্ছে বীরেশ।

ওঃ, অত হর্ন দিয়ো না তো! মাথা ধরে গেল।

হর্ন না দিলে হবে কেন? দেখছো না সাইড দিচ্ছে না।

তবু হর্ন বন্ধ করো।

বীরেশ অবশ্য কথাটাকে পাত্তা দিল না। হর্ন বাজাতে লাগল।

মালতী ফ্লাস্কটা তুলে নিয়ে বলল, একটু খাচ্ছি।

বীরেশ বিরক্ত হল, কিছু বলল না।

মালতী ফ্লাস্কের ঢাকনায় হুইস্কি ঢেলে খেতে লাগল।

জিপটার বাঁহাতি স্টিয়ারিং বলে রাস্তাটা ভালো দেখতে পাচ্ছে না বীরেশ। সামনে একটা তুমুল ধুলোর পাহাড় উঠেছে দেখে বুঝে নিল, উলটো দিক থেকে গাড়ি আসছে। গো—গাড়িগুলি জড়োসড়ো হয়ে থেমে পড়েছে। সুতরাং তাকেও থামতে হল।

নেচে নেচে, কেতরে, বহু কসরত করে খানিক রাস্তায় চাকা নামিয়ে একটা ট্রেকার উলটো দিক থেকে এসে পার হয়ে গেল তাদের। ঝান্ডা লাগানো পার্টির গাড়ি।

ওই তো, ওই তো সাইড পেয়ে গেল।

উলটো দিকের গাড়ি যে সুবিধেটা পায় সেটা যে সে পাবে না তা আর মালতীকে বোঝাবার চেষ্টা করল না বীরেশ। তবে সে একটা হিসেব—নিকেশ করে নিয়ে জিপটা ছাড়ল। ডানদিকে চাকা রাস্তার বাইরে খানিকটা নামানো যাবে। ছোটো ছোটো ঝোপ আছে বটে, তাতে আটকাবে না।

অ্যাকসেলেটর চেপে হর্ন দিতে দিতে জিপটার গতি বাড়িয়ে দিয়ে স্টিয়ারিং শক্ত হাতেই ধরে ডান বাঁয়ে মোচড় দিচ্ছিল বীরেশ।

কিন্তু কপাল খারাপ। বাঁয়ের সামনের চাকাটা বোধহয় একটা পাথরে লেগে গাড়িটা টাল খেয়ে ডান ধাবে একটা লাফ মেরে উঠে ডান কাতে পড়ে গেল।

প্রথম ধাক্কাতেই গাড়ি থেকে ছিটকে গিয়েছিল বীরেশ। পড়ে চোখে অন্ধকার দেখল। আর কিছু মনে নেই।

গো—গাড়ির গাড়োয়ানরাই নেমে এসে ধরে ঘাসের উপর শুইয়ে দিল তাকে। বাকিরা গিয়ে জিপের তলায় চাপা পড়া মালতীকে যখন বের করে আনল তখন তার শরীর নিথর হয়ে গেছে। হয়তো বেঁচেও যেত মালতী, যদি না মদের বোতলের ভারী পেটিগুলি তার বুক আর মুখের উপর আছড়ে পড়ত।

তিন

রাহুটা যে বড্ড প্রবল হে তোমার মেয়ের!

তাতে কী হয়!

ওঃ সে অনেক ফেরে পড়তে হয়।

বেঁচেবর্তে থাকবে তো!

তা থাকবে, শনিটাও যেন কামড়ে আছে।

তাতেই বা কী হয়; ভেঙে বলবে তো!

দাঁড়াও, ভালো করে দেখি। এ মেয়ে তো ভালো করে দেখতেই দিচ্ছে না হাত, বারবার টেনে নিচ্ছে।

শক্তিপদ একটা ধমক দিল মেয়েকে, অমন করছিস কেন?

বকুল খিলখিল করে হেসে বলে, সুড়সুড়ি লাগছে যে!

শক্তিপদ বিরক্ত হয়ে বলে, এ মেয়েকে নিয়েই হয়েছে আমার মুশকিল, বড্ড অশৈরণ। ক্ষণে ক্ষণে হাসি পায়। ক্ষণে ক্ষণে ব্যথা লাগে, সুড়সুড়ি লাগে, ভয় লাগে।

জ্যোতিষী হরুঠাকুর গম্ভীরভাবে শক্তিপদর দিকে চেয়ে বলে, একটাই নাকি!

মেয়ে এই একটা। ছেলে আছে তিনটে, তা তাদের নিয়ে ভাবি না। এইটে হয়ে অবধি আমিও যেন বাঁধা পড়ে গেছি। মেয়ের বড্ড মায়া তো!

বয়স কত হল মেয়ের!

এই তো ষোলো পোরে আর কি। বিয়ের যোগটা একটু দেখ তো হরুঠাকুর।

দেখছি বাপু, দেখছি। দেখি মা হাতটা বেশ চ্যাটালো করে মেলে ধরো তো।

বকুল হেসেই অস্থির।

তা লেগে যাবেখন বিয়ে।

কবে লাগবে?

শিগগিরই।

তোমাদের জ্যোতিষীদের মুশকিল কী জানো। সব আন্দাজে ঢিল। লেগে যাবে সে তো আমিও জানি। কিন্তু কবে লাগবে, পাত্তর কেমন হবে, সুখে ঘরসংসার করবে কিনা সব বিস্তারিত না বললে হয়?

কেতুটা একটু ভেতরে যাচ্ছে বটে, তবে—

বকুল হাতটা এবার সুট করে টেনে নিয়ে বলে, ও বাবা, আমার হাত ব্যথা করে না বুঝি!

শক্তিপদ গলে গেল। মেয়ে হল তার প্রাণ। পাঁচসিকে পয়সা ফেলে বলল, ওতেই হবে। কপালে যা আছে খণ্ডাবে কে?

হরুঠাকুর বলে, আরে বাপু, গ্রহবৈগুণ্য যাই থাক মা মঙ্গলচণ্ডীর কবচটা নিয়ে গিয়ে ধারণ করাও। দামও বেশি নয়। কাজ হয়ে যাবে।

আচ্ছা, সে হবেখন। মেয়ে এখন নেপাল ঘোষের চপ খাওয়ার জন্য অস্থির।

আসি হে ঠাকুর।

কৈখালির হাটে এসে যে নেপাল ঘোষের চপ না খেয়েছে সে আহাম্মক। তিন রকমের চপ করে নেপাল। আলুর চপ, মোচারচপ, আর ভেজিটেবল চপ।

তিনটেই ঝুড়ি ঝুড়ি উড়ে যায়। দোকানের সামনে লম্বা লাইন।

জ্যোতিষীর কাছ থেকে উঠে এসে বকুল বলল, উঃ হাতটা একেবারে ব্যথা হয়ে গেছে। তুমি যেন কী বাবা!

শক্তিপদ কাচুমাচু হয়ে বলে, তোর নাকি শনির দৃষ্টি আছে। সেইজন্যই আসা।

তবে হরুঠাকুর শনির কথাটা কিছু বলল না তো!

আমি তো ভালোই আছি। তুমি অত ভাবো কেন?

মেয়ের বড়ো মায়া। শক্তিপদ ঘরবাঁধা লোক ছিল না তেমন। কাজ—কারবার নিয়ে ব্যস্ত মানুষ। চৌপর দিন তার মাথায় নানা বিকিকিনির চিন্তা। তিনটে ছেলে হয়েও তার স্বভাব ঘরমুখো হয়নি কখনো। কিন্তু তিন ছেলের পর মেয়েটা হতেই সে কাত। মেয়ের মুখের দিকে চেয়ে তার বুকখানা যেন জলে ভরে উঠল। মা লক্ষ্মীরই কেউ হবে। মেয়ে হয়ে ইস্তক তার কাজ কারবারও ফেঁপে ফুলে উঠল। তিনটের জায়গায় সাতখানা ট্রাক হল, দু—খানা বাস, তিনটে ট্রেকার, টাকায় টাকায় ভাসাভাসি কাণ্ড।

চুড়ি কিনি বাবা? ওই তো পিন্টুর দোকান।

একগাল হেসে শক্তিপদ বলে, কিনবি? তা কেন।

কাচের চুড়ি কম্মের জিনিস নয়। কয়েকদিন বেশ ঝলমল করে তারপর পটপট করে ভাঙে। আগে কাচের চুড়ি দু—চোখে দেখতে পারত না শক্তিপদ। কিন্তু মেয়ে চাইলে ব্রহ্মাণ্ড দিতেও রাজি।

দু—হাত ভরে চুড়ি পরে বাপকে দেখায় বকুল, কেমন দেখাচ্ছে বাপ?

খুব ভালো মা। তবে তুই তো দস্যি মেয়ে, চুড়ি ভেঙে যেন হাত রক্তারক্তি করিস না।

পাঁচটা টাকা পিন্টুর কোলে ফেলে মেয়ে আগলে এগোয় শক্তিপদ। তা এগোয় সাধ্যি কী!

দু—পা এগিয়েই মেয়ের বায়না, পুঁতির মালাগুলি কী সুন্দর না বাবা?

হ্যাঁ, তা ভালোই।

না তেমন দামি জিনিস—টিনিস নয়, এইসব ছোটোখাটো জিনিসেরই বায়না বটে মেয়ের।

ও বাবা, ওই দেখ নেপালের দোকানে লাইন।

লাইন দেখে শক্তিপদর চোখ কপালে।

ও বাবা, এ যে ঘণ্টাখানেক লেগে যাবে!

আমার যে খিদে পেয়েছে বাবা!

তাহলে চল বিশ্বনাথের দোকানে একটু মিষ্টি খেয়ে নে।

এ বাবা, মিষ্টি আমি খাই নাকি? চপই খাব।

দাঁড়া দেখি, লাইনে চেনা মানুষ পাই কি না।

কৈখালির হাটে চেনা মানুষের অভাব নেই তার। সে তালেবর লোক। সবাই চেনে।

লাইনের পাশ দিয়ে এগোতেই একেবারে সামনের দিকে বজ্রবাহুর সঙ্গে দেখা।

বেজা নাকি রে?

শক্তিদা যে! কী খবর?

তা চপ নিচ্ছিস বুঝি?

হ্যাঁ।

আমার জন্যও নিস তো কয়েকখানা। তিন রকমেরই নিবি, এই পয়সা।

দুর। পয়সার রাখো। ক পয়সাই বা দাম!

বাঁচালি বাপ। মেয়েটা তখন থেকে খিদেয় কাতর।

পাঁচ মিনিটের মধ্যে বেজা গরম গরম চপ নিয়ে এল শালপাতার ঠোঙায়।

এনেছেও মেলা।

মেয়েটা হাঁ করে তাকিয়ে বজ্রবাহুকে দেখছিল।

এই তোমার মেয়ে বুঝি?

হ্যাঁ।

তোমার তো মেয়েঅন্ত প্রাণ!

শক্তিপদ একটু লজ্জার হাসি হাসল। সবাই তাই বলে বটে। মেয়ে নাকি শক্তিপদকে একেবারে বশ করে রেখেছে। তাতে একটু অহংকারই হয় তার। মেয়ে তো নয়, সাক্ষাৎ লক্ষ্মী।

ঘাসের উপর তিনজন বসেছে ত্রিভুজ হয়ে। চপ খেতে খেতে শক্তিপদ বলে,তা সেই ডাইনির খপ্পরেই এখনো পড়ে আছিস।

সবই কপাল শক্তি দাদা। পেটের দায়ে মেনে নিতে হয়েছে।

সবই জানি। তোর জন্য দুঃখও হয়। গেছো মেয়েছেলেটার তো গুণের শেষ নেই। তা এখন তোর সঙ্গে কেমন করে?

মাথা নেড়ে বেজা বলে, না দাদা, সম্পর্ক নেই। আমি হলুম গিয়ে শিখণ্ডী। নব হালদারের প্রেস্টিজ রাখতে আমাকে দরকার ছিল।

মেয়েটা চপ তেমন খাচ্ছে না। খুব হাঁ করে তাকে দেখছে। বজ্রবাহুর চেহারাটা খারাপ নয়। বহু মেয়েই তাকায়। কিন্তু সে নিজে আর মনের দুঃখে মেয়েদের দিকে তাকায় না। তার জীবনটাই অন্ধকার হয়ে গেছে।

তুমি তো খাচ্ছ না খুকি!

মেয়েটা হঠাৎ লজ্জা পেয়ে মুখ নামায়। ভারি লক্ষ্মীশ্রী আছে মুখখানায়।

বজ্রবাহু বলল, চপে বড্ড ঝাল দেয় নেপাল। তুমি বোধহয় ঝাল খেতে পারছ না! জিলিপি খাবে? শ্রীধরের জিলিপি ভারি ভালো। সাড়ে আট প্যাঁচের জিলিপি।

খাবে?

মেয়েটা চুপ করে আছে। মাথা নীচু। হাসছে।

দাঁড়াও, নিয়ে আসি।

বজ্রবাহু গিয়ে গরম জিলিপি নিয়ে এল। মেয়েটা লজ্জায় হাত বাড়িয়ে নিল ঠোঙাটা। বাপকে দিল, বজ্রবাহুকে দিল। নিজে একখানা একটু একটু কামড়ে খেতে লাগল! কিন্তু যেন খাওয়ায় মন নেই।

শক্তিপদ জিজ্ঞেস করে, তা হ্যাঁ রে বেজা, তোর ভ্যান চলছে কেমন?

ভালোই। নব হালদার ও ব্যাপারে ঠকায়নি।

কেমন হচ্ছে—টচ্ছে?

খারাপ নয় দাদা। একখানা ছোটো ট্রাক বায়না করেছি। সামনের মাসেই পাব। তখন আমি চালাব। ছোটো ভাইটাকে একটা দেব।

ভালো খুব ভালো। ধীরে ধীরে রয়ে—সয়ে হোক। আমারও তো ওইরকম ভাবেই হয়েছে কিনা।

জানি। তুমি একটা দৃষ্টান্তই তো চোখের সামনে।

শক্তিপদ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, তোর মতো একটা ছেলে যদি পেতাম—

কথাটা শেষ করল না শক্তিপদ। শেষ করার দরকারও ছিল না। সবাই বোঝে।

আমার কথা ভেবো না দাদা। খারাপ ভাগ্য নিয়ে জন্মেছিলাম। এভাবেই জীবন যাবে।

চার

শেফালীর চোখ টকটকে লাল। বিস্তর কেঁদেছে। দিদি মরায় তুমি তো খুশিই হয়েছে জামাইদা, তাই না?

মাথা নেড়ে বেজা বলে, না শেফালী, খুশি হব কেন? মালতী যেমনই হোক, একটা মানুষ তো। একজন মানুষ মরলে কি খুশি হওয়ার কথা!

আমরা জানি, দিদি কী রকম ছিল। তোমার ওপর অনেক অন্যায়—অত্যাচারও হল। তুমি ভালো লোক। এ বাড়ির সবাই কিন্তু তোমার সুখ্যাতি করে।

উদাস মুখে বেজা বলে, তা হবে হয়তো।

তোমাকে আমার একটা কথা বলার ছিল।

কী কথা শেফালী?

সে তোমাকে বাবা বলবে। যা বলবে ভেবে দেখো। দিদি খারাপ ছিল বলে ভেবো না যে আমরা সবাই খারাপ।

তা ভাবব কেন?

মালতী মারা গেছে এই দিনসাতেক হল। ধীরেশ সামন্ত বেঁচে গেছে। ঘটনাটা নিয়ে সারা গাঁয়ে ফিসফাস গুজগুজ চলছে তো চলছেই।

বজ্রবাহু একটা মুক্তির স্বাদ টের পায় বটে, কিন্তু তার আনন্দ হয় না। বরং একটু দুঃখই হয় মালতীর জন্য। জীবনটা ছড়িয়ে ছিটিয়ে মিসমার করে দিয়ে গেল। নিজে মরল, খানিক মেরে রেখেছিল বজ্রবাহুকেও। মেয়েমানুষকে আজকাল একটু একটু ভয় পায় বজ্রবাহু।

নব হালদার সকালে তাকে ডেকে বলল, সব তো শেষ হয়ে গেল, দেখলে তো! মেয়েটাকে নিয়ে শান্তি ছিল না। এখন ভাবি, তোমাকেও কষ্টের মধ্যে ফেলেছিলাম হে।

না না, কষ্ট কীসের?

কষ্ট নয়? খুব কষ্ট। সবই টের পেতাম। কিন্তু একটা কথা বলি।

কী কথা?

সম্পর্কটা ছাড়ান—কাটান হোক আমি তা চাই না।

বজ্রবাহু চুপ করে থাকে।

তোমার দিকটা আমি যেমন দেখছিলাম তেমনই দেখব।

বজ্রবাহু চুপ।

একটা প্রায়শ্চিত্তিরও হবে। বলছিলাম যদি শেফালীকে বিয়ে করো তবে সবদিক বজায় থাকে। সে ভারি ভালো মেয়ে। মালতীর একটা রক্তের দোষ ছিল হয়তো। কিন্তু শেফালী তেমন নয়।

শেফালী ভালো মেয়ে, আমি জানি। কিন্তু প্রস্তাবটা ভেবে দেখতে হবে।

শোকাতাপা নব হালদার দুর্বল গলায় বলে, তুমি ঠকবে না বাবা, কথা দিচ্ছি।

বজ্রবাহু বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে বলে জিনিসপত্র গুছিয়ে ফেলেছিল। শাশুড়ি আর শেফালী আড় হয়ে পড়েছিল।

শাশুড়ি বলেছিল, যাবে কেন বাবা? আমরা কি পর?

শেফালীর মালতীর মতো চটক নেই। কিন্তু সে ভালো মেয়ে, এটা বুঝতে পারা শক্ত নয়। কিন্তু ভালো মেয়ে বলেই যে ঘাড় পাততে হবে এমন কোনো কথা নেই। চার বছর বাদে একটা সম্পর্কের গারদ থেকে মুক্তি পেয়েছে বজ্রবাহু। ফের আবার একটা সম্পর্কে জড়িয়ে পড়তে তার মন চায় না। তা ছাড়া এই বাড়ির অনুষঙ্গও তো আছে। শেফালীকে বিয়ে করলে এখানেই বাস করতে হবে। সেটা কী পারবে সে?

তবে নব হালদারকে চটাতেও চাইছে না বেজা, সবে তার ব্যাবসা জমে উঠছে।

নব চটলে কোন কলকাঠি নেড়ে তাকে পথে বসায় কে জানে। নবর পিছনে পার্টিও আছে।

সুধাপুর থেকে নবগঞ্জ পর্যন্ত টানা একটা ট্রিপ মারল বেজা, নবগঞ্জেই রাতের ঠেক। চেনা জায়গা। হরিরামের দোকানে মাল খালাস করে সে পয়সা বুঝে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। জোর শীত পড়েছে এবার। সুফল মিত্রের পাইস হোটেলে খেয়ে সে তার ম্যাটাডোরে রাত কাটাবে বলে ফিরছিল। দূর থেকে দেখতে পেল, অন্ধকারে কে একজন তার ম্যাটাডোরের পাশে দাঁড়িয়ে।

বেজা নাকি রে?

শক্তিদাদা যে! এখানে?

একটা ট্রাক ফেঁসেছে। তাই আসা। কে যেন বলল, তুইও এখানে। তাই ভাবলুম দেখাটা হয়ে যাক।

ভালো করেছো।

আজ ফিরবি না?

খামোখা তেল পুড়িয়ে লাভ কী। রাত কাটালে সকালে হয়তো একটা ট্রিপ হয়ে যাবে। মুকুন্দ হালদারের মাল যাবে বলে মনে হচ্ছে।

তা ইয়ে বলছিলাম কী, খুব বরাতজোর তোর।

মালতীর কথা বলছো তো!

খুব বেঁচে গেলি।

বাঁচলুম তো, কিন্তু মনটা ভালো নেই।

কেন বল তো!

নব হালদার ফের বেঁধে ফেলতে চাইছে।

সে কী?

তার ছোটো মেয়ে শেফালীকে বিয়ে করার জন্য ধরে পড়েছে খুব। চটাতে ভরসা হয় না। ম্যাটাডোরখানাই তো ভরসা, যদি কেড়েকুড়ে নেয়। তার লোকবলও তো আছে।

একটু চেয়ে থেকে শক্তিপদ একটু হাসল, তা বটে। তবে অত ভয় খাস না। শক্তিপদ এখনো মরে যায়নি।

তুমি আর কী করবে দাদা! সবই আমার কপাল।

শোন রে বাপু, অত কপালের ওপর বরাত দিয়ে বসে থাকিসনি। এবার একটু পুরুষ হ। লেখাপড়া জানিস, বুদ্ধি আছে, শুধু সাহসটারই যা অভাব।

ঠিকই বলেছ। সাহসেরই অভাব। নইলে কী আর— যাকগে।

কথা দিয়ে ফেলিসনি তো?

না। সময় নিয়েছি।

ভালো করেছিস। কাল ফিরে একবার আমার বাড়ি যাস। কথা আছে।

ঠিক আছে দাদা। ব্যাপারটা কী!

বড়ো অশান্তি যাচ্ছে আমার। চিকিচ্ছের দরকার।

কার চিকিচ্ছে?

বলবখন।

পাঁচ

শক্তিপদর বউ পদ্ম রাগে ঝনঝন করছিল, আসকারা দিয়ে দিয়ে মেয়েটাকে মাথায় তুলেছে, এখন যা মনে চায় তাই করে। তিনদিন মেয়ে কুটোটি দাঁতে কাটছে না। বলি এরকম কতদিন চলবে রে হতভাগী?

বিছানায় দক্ষিণের জানালার দিকে মুখ করে শুয়ে আছে বকুল। মুখখানা শুকনো। বলি রাগটা কার ওপর? কী চাস কী তুই?

বকুল কিছু বলছে না।

পদ্ম বলল, এরপর কী আমি গলায় দড়ি দেব? তাই চাস?

বকুল চুপ করে চেয়ে আছে। জানালার বাইরে আতাগাছের ডালে ফিঙে পাখি নেচে বেড়াচ্ছে। দুটো প্রজাপতি ঢুকল ঘরে। ফের বেরিয়ে গেল।

মা!

পদ্ম ফিরে চাইল, কী?

আমার শীত করছে। লেপটা টেনে দাও তো গায়ে।

লেপ টেনে পদ্ম তার কপালে হাত রাখল। গলা নেমে এল খাদে, না জ্বর তো নেই। এক গেলাস গরম দুধ দিই মা, খা।

তুমি কেন বললে আমি তিন দিন খাইনি! আমি তো রোজ খাই।

সে তো এতটুকু করে। মুখরক্ষা করার জন্য। ও কি খাওয়া? বলি, উপোস দিচ্ছিস কেন রে মুখপুড়ি?

মনটা ভালো নেই মা।

কেন, সেটা বলবি তো!

পরে বলব। সময় হয়নি। বাবা কোথায় বলো তো!

তার কি আর সময়—অসময় আছে! এ সময়ে লোকজন আসে, ব্যাবসাপত্তরের কথাই হচ্ছে হয়তো। ঘরসংসারে কি তার মন আছে? ওই তো আসছে বুঝি!

খুব হন্তদন্ত দেখছি যেন!

শক্তিপদই। ঘরে ঢুকেই বলল, ওগো, মেয়ের চিকিচ্ছের ব্যবস্থা হয়েছে।

চিকিচ্ছে! কীসের চিকিচ্ছে?

সে আছে, তুমি বুঝবে না। তবে বজ্রবাহু এক কথাতেই রাজি।

কীসের রাজি গো! এ তো বড়ো সাঁটের কথা কইছো দেখি।

তা সাঁটই ধরে নাও। মেয়ে পেটে ধরেছ, এখনো ওর মনের কথা বুঝতে পার না, কেমন মা তুমি? আমি চলি, মেলা লোক বসে আছে।

শশব্যস্তে চলে গেল শক্তিপদ।

ওমা! তুই মুখচাপা দিয়ে হাসছিস যে বড়ো! কী হল বল তো! এসব কী? আমি যে বুঝতেই পারলুম না।

দুধ দেবে বলেছিলে যে!

সে তো বলেছিলুম?

শিগগির নিয়ে এসো। আমার বড্ড খিদে পেয়েছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *