কে?
১
উড়িষ্যায় বেড়াতে বেরিয়েছিলুম। আমি তার রূপলাল। এদেশ-সেদেশ ঘুরে ভুবনেশ্বরে গিয়ে হাজির হলুম।
এক দুপুর বেলায় খণ্ডগিরি আর উদয়গিরি দেখতে গেলুম। যাওয়ার সময় পাণ্ডা সাবধান করে দিলে, আমরা যেন সন্ধ্যা হওয়ার আগেই ফিরে আসি; কারণ খণ্ডগিরিতে নাকি নরখাদক বাঘের বিষম উপদ্রব হয়েছে। বাঘের কবলে পড়ে এক মাসের মধ্যে পাঁচজনের প্রাণ গিয়েছে!
এ-কথা শুনে ভয় পেলুম না, কারণ আমাদের সঙ্গে বন্দুক ছিল।
খণ্ডগিরি আর উদয়গিরি দেখতে দেখতে বেলা পড়ে এল এবং বেলা পড়ে আসার সঙ্গে-সঙ্গেই সারা আকাশ কালো করে শুরু হল ঝড় ও বৃষ্টি।
তাড়াতাড়ি ছুটে এসে ডাকবাংলোর ভিতরে আশ্রয় নিলুম।
বিকাল গেল, সন্ধ্যাও উতরে গেল। কিন্তু সে ঝড়-বৃষ্টি তবু থামল না।
বাংলোর বেয়ারা এসে বললে, ‘বাবু, আজ আপনারা এখান থেকে যাবেন কেমন করে?’
রূপলাল বললে, ‘কেন, যেমন করে এসেছি তেমনি করেই ফিরে যাব। অর্থাৎ দু-পায়ে ভর দিয়ে।’
বেয়ারা ঘাড় নেড়ে বললে, ‘আজ আর তা পারবেন না। একে এই ঝড়-জল, তার ওপরে— শুনেছেন তো?’
আমি বললুম, ‘হ্যাঁ, বাঘের উপদ্রবের কথা বলছ তো? শুনেছি।’
বেয়ারা বললে, ‘খালি বাঘ নয়, পেতনির ভয়ও আছে!’
রূপলাল বললে, ‘তা হলে আজ আমরা এই বাংলোতেই রাত কাটাব। জীবনে কখনো পেতনি দেখিনি। আজ তাকে দেখব। আর, যদি পছন্দ হয়, তাহলে সেই পেতনিটিকে বিয়ে করে দেশে ফিরব।’
বেয়ারা বললে, ‘বাবু, আপনি জানেন না তাই ঠাট্টা করছেন। বেশ, আপনারা তাহলে আজ এখানে থাকবেন তো?’
আমরা বললুম, ‘হ্যাঁ।’
বেয়ারা বললে, ‘তা হলে আপনাদের জন্যে রান্নাবান্নার আয়োজন করি-গে।’ এই বলে সে চলে গেল।
রাত হল। বৃষ্টি এখনও ঝরছে, ঝড় এখনও গর্জন করছে।
২
রাত্রে খেতে বসেছি, এমন সময়ে বাংলোর দরজায় ঘন ঘন করাঘাত হতে লাগল। আশ্চর্য হয়ে ভাবতে লাগলুম, এমন স্থানে এই দুর্যোগে দরজা ঠেলে কে?
বেয়ারা চেঁচিয়ে জিজ্ঞাসা করলে, ‘কে?’
বাহির থেকে ভীত, কাতর নারী-কণ্ঠে সাড়া এল, ‘শিগগির দরজা খুলে দাও! নইলে প্রাণে মারা গেলুম!’
উড়ে বেয়ারাটা সেইখানে দাঁড়িয়ে ভয়ে ঠকঠক করে কাঁপতে লাগল।
আমি বললুম, ‘অমন করছ কেন? যাও, দরজা খুলে দাও।’
বেয়ারা এক পা-ও নড়ল না, সেইখানে দাঁড়িয়ে তেমনি করেই কাঁপতে লাগল।
রূপলাল তার ভয় দেখে হাসতে হাসতে দরজার দিকে এগিয়ে গেল।
বেয়ারা ছুটে গিয়ে দরজায় পিঠ দিয়ে দাঁড়িয়ে মিনতি করে বললে, ‘পায়ে পড়ি বাবু, দরজা খুলবেন না! ও মানুষ নয়!’
রূপলাল বললে, ‘বলেছি তো পেতনি বিয়ে করতে চাই। ও মানুষ না-হলেই আমি খুশি হব!’
বাহির থেকে আবার আর্তস্বরে শোনা গেল, ‘বাঘ! বাঘ! রক্ষা করো! রক্ষা করো!’
রূপলাল আর বাধা মানলে না, বেয়ারাকে এক ধাক্কায় সরিয়ে দিয়ে একটানে সে দরজার খিলটা খুলে দিলে।
একটা ঝোড়ো হাওয়ার সঙ্গে দরজা ঠেলে তাড়াতাড়ি ভিতরে প্রবেশ করলে একটি স্ত্রী-মূর্তি। তাকে ভালো করে দেখবার আগেই বাতাসের ঝাপটে ঘরের আলোটা গেল নিবে।
বেয়ারাটা হাঁউমাউ করে চেঁচিয়ে কেঁদে উঠল।
সেই অন্ধকার রাত্রি, সেই ঝড়-বৃষ্টির হুলুস্থুল, সেই পার্বত্য অরণ্যের ঘন ঘন দীর্ঘশ্বাস, সেই অভাবিত ও অজানা নারী-মূর্তির আকস্মিক আবির্ভাব এবং আলোকহীন ঘরের ভিতরে বেয়ারার সেই ক্রন্দন স্বর— এই সমস্ত মিলে চারিদিকে কেমন একটা ছমছমে আস্বাভাবিক ভাব সৃষ্টি করলে!
আমি ব্যস্ত হয়ে বললুম, ‘রূপলাল, শিগগির দরজাটা বন্ধ করো, আমি আবার আলোটা জ্বেলে নিই।’
রূপলাল দরজায় খিল তুলে দিলে। আমি আলোটা জ্বাললুম।
কৌতূহলী চোখে ফিরে দেখলুম, ঘরের কোণে দাঁড়িয়ে একটি অসীম রূপসি মেয়ে ভয়ে ঠকঠক করে কাঁপছে! তার এলোমেলো চুলগুলো এলিয়ে মুখ, কাঁধ ও বুকের ওপর এসে পড়েছে এবং তার সর্বাঙ্গ বৃষ্টির জলে ভিজে গেছে। মেয়েটির বয়স হবে আঠেরো কী উনিশ।
ঘরের আর একদিকে মেঝের ওপরে উবু হয়ে বসে, দুই হাতে মুখ ঢেকে উড়ে বেয়ারাটা তখনও ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিল।
মেয়েটি প্রথমেই আশ্চর্যভাবে জিজ্ঞাসা করলে, ‘ও লোকটি অমন করে কাঁদছে কেন?’
রূপলাল হাসতে হাসতে বললে, ‘ওর ধারণা আপনি একটি নিখুঁত পেতনি!’
মেয়েটি চমকে উঠল। তারপর মুখের ওপর থেকে চুলের গোছা সরিয়ে দিয়ে বললে, ‘আমাকে কি পেতনির মতো দেখতে? কিন্তু সে কথা থাক, বড়ো বিপদ থেকেই আপনারা আমায় উদ্ধার করলেন!’
তার বিপদের ইতিহাস হচ্ছে এই। সে খণ্ডগিরি দেখতে এসেছে। কিন্তু হঠাৎ ঝড়-বৃষ্টি আসাতে এতক্ষণ সে একটা গুহার ভিতর ঢুকে আত্মরক্ষা করছিল। হয়তো সেই গুহার ভিতরেই সে রাতটা কাটিয়ে দিত, কিন্তু গুহার খুব কাছেই বাঘের ভীষণ গর্জন শুনে প্রাণের ভয়ে সে এখানে পালিয়ে এসেছে।
রূপলাল নিজের সিল্কের চাদরখানা খুলে মেয়েটির হাতে দিয়ে বললে, ‘আপনার কাপড়চোপড় সব ভিজে গেছে। পাশের ঘরে গিয়ে ভিজে কাপড় ছেড়ে আপাতত এই চাদরখানা ব্যবহার করতে পারেন।… কিন্তু আজ রাতে খাবেন কী? আমাদের তো খাওয়াদাওয়া হয়ে গেছে।’
৩
আমি ও রূপলাল আলোর শিখাটা খুব কমিয়ে দিয়ে শুয়ে পড়লুম। বন্দুকটাকেও শুইয়ে রাখলুম ঠিক আমাদের মাঝে।
শুয়ে শুয়ে শুনতে লাগলুম বনজঙ্গলের ওপরে, পাহাড়ের ওপরে বৃষ্টি-বালার অশ্রান্ত নৃত্য নূপুরধ্বনি।
রূপলাল আমার কানের কাছে মুখ এনে বললে, ‘আচ্ছা ভাই, ওই মেয়েটির ইতিহাস কি তোমার কাছে একটু উদ্ভট বলে মনে হল না?’
আমি বললুম, ‘কেন?’
রূপলাল বললে, ‘ও মেয়েটি কে? ওর কি কোনো অভিভাবক নেই? অত বড়ো মেয়েকে কেউ কি একলা এই বিদেশে ছেড়ে দেয়? ওর মাথায় সিঁদুর নেই, গায়েও একখানা গয়না নেই, ওর সবই যেন কেমন রহস্যময়!’
আমি পাশ ফিরে শুয়ে বললুম, ‘ওইসব বাজে কথা ভেবে তুমি মাথা গরম করতে থাকো, ততক্ষণে আমি এক ঘুম ঘুমিয়ে নিই।’
আমার যখন বেশ তন্দ্রা আসছে তখন শুনলুম, রূপলাল আপন মনে বলছে, ‘অমন সুন্দরী মেয়ে, কিন্তু তার চোখ দুটো কী তীক্ষ্ন! ওর চোখ দুটো যেন ওর নিজের চোখ নয়, যেন কোনো হিংস্র জন্তুর চোখ!’
কতক্ষণ ঘুমিয়ে ছিলুম জানি না। হঠাৎ কী-একটা অস্বস্তির ভাব নিয়ে আমি ধড়মড় করে জেগে উঠলুম। তারপর চোখ খুলেই যে দৃশ্য দেখলুম সারা জীবনে কোনোদিন তা ভুলতে পারব না।
এ-ঘর থেকে পাশের ঘরে যাওয়ার দরজার দিকে পিছন করে মাটির ওপরে স্থিরভাবে বসে আছে প্রকাণ্ড একটা বাঘ!
আমার বুকের গতি হঠাৎ যেন থেমে গেল। অত্যন্ত আড়ষ্টভাবে স্তম্ভিত নেত্রে বাঘটার দিকে তাকিয়ে রইলুম, সেও তাকিয়ে রইল আমার দিকে। এইভাবে কিছুক্ষণ কেটে গেল।
ইতিমধ্যে অল্প-অল্প হাত সরিয়ে পাশের বন্দুকটা আমি চেপে ধরলুম।
বাঘটা আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়াল। তারপর হঠাৎ হেঁট হয়ে পড়ল লাফ মারবার জন্যে।
চোখের নিমেষে আমিও বন্দুকটা নিয়ে উঠে বসলুম এবং তাকে লক্ষ করে গুলি ছুড়লুম।
একটা উলটো ডিগবাজি খেয়ে বাঘটা পাশের ঘরে গিয়ে পড়ে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। সঙ্গে-সঙ্গে স্ত্রী-কণ্ঠে বার বার ভীষণ আর্তনাদ! দড়াম করে একটা দরজা খোলার শব্দ! দ্রুত পদধ্বনি। তারপরে সব আবার স্তব্ধ!
বন্দুক হাতে করে অভিভূতের মতো বিছানার ওপরে বসে রইলুম। রূপলাল জেগে বিছানার ওপর থেকে নীচে লাফিয়ে পড়ে উদভ্রান্তের মতো বলে উঠল, ‘কে চেঁচালে অমন করে? বন্দুক ছুড়লে কেন?’
আমি বললুম, ‘বাঘ, বাঘ! এখন ও-ঘরে গিয়ে ঢুকেছে! সেই মেয়েটি চিৎকার করছে!’
‘সর্বনাশ! বাঘ বোধ হয় তাকেই ধরেছে!’— বলতে বলতে বেগে রূপলাল পাশের ঘরে গিয়ে ঢুকল। আমিও বন্দুক আর লণ্ঠনটা নিয়ে তার সঙ্গে ছুটলুম।
পাশের ঘরে কেউ নেই। খালি একটা খোলা দরজা দিয়ে হু-হু করে জোলো হাওয়া আসছে।
রূপলাল বেদনা-বিদীর্ণ স্বরে বললে, ‘আর কোনো আশা নেই। অভাগি শেষটা সেই বাঘের কবলেই গিয়ে পড়ল! কিন্তু বাঘ এখানে এল কেমন করে?’
রূপলালের কথার কোনো জবাব দিলুম না। আমি তখন আর একটা ব্যাপার সবিস্ময়ে লক্ষ করছিলুম। ঘরের ভিতর থেকে একটা একটানা রক্তের রেখা বাহিরের দিকে সোজা চলে গিয়েছে। পরে পরে একখানা করে রক্তাক্ত পায়ের ছাপ! মানুষের পা!
সবিস্ময়ে বললুম, ‘দেখ রূপলাল, দেখ! কী আশ্চর্য ব্যাপার!’
রূপলাল অনেকক্ষণ সেই দিকে তাকিয়ে আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। তারপর থেমে থেমে ধীরে ধীরে বললে, ‘এত রক্ত, কিন্তু একটাও বাঘের পায়ের দাগ নেই কেন? এ পায়ের দাগগুলো দেখলে মনে হয়, যেন কোনো মানুষের একখানা পা আহত হয়েছে আর সেই আহত পায়ের রক্ত ছড়াতে ছড়াতে সে এ-ঘর থেকে হেঁটে বাইরে বেরিয়ে গিয়েছে। বাঘ যদি সেই মেয়েটিকে ধরে নিয়ে যেত তাহলে তাকে মুখে করে টেনে-হিঁচড়েই নিয়ে যেত, আর তাহলে এখানে কখনোই এমন পায়ের ছাপ পড়ত না।’
সেই রক্তের দাগ ধরে আমরা বেরিয়ে গেলুম।
এবারে দেখলুম কাদার ওপর দিয়ে একজোড়া মানুষের পায়ের ছাপ বরাবর বনের দিকে চলে গিয়েছে!
রূপলাল মাথা নেড়ে বললে, ‘তুমি ঘুমের ঘোরে স্বপ্ন দেখেছ নিশ্চয়। সেই মেয়েটি আবার পালিয়েছে, বাঘ-টাঘ কিছুই এখানে আসেনি।’
আমি দৃঢ়স্বরে বললুম, ‘আমি নিজের চোখে বাঘ দেখেছি, নিজের হাতে গুলি করেছি, আর সে নিশ্চয় আহত হয়েছে!’
রূপলাল বললে, ‘তোমার গুলি খেয়ে বাঘ কি পাখি হয়ে ডানা মেলে আকাশে উড়ে গেল? দরজার সামনে এই কাদামাটি, কিন্তু এখানে বাঘের পায়ের দাগ কোথায়? ঘরের ভিতরে মেয়েটি ছিল, কেবল সেই-ই যে বেরিয়ে গেছে তার স্পষ্ট চিহ্ন কাদার ওপরে রয়েছে। কোনো বাঘ ঘর থেকে বেরোয়নি! আমার বোধ হয় তোমার গুলিতে সেই মেয়েটিই আহত হয়ে পালিয়ে গেছে!’
হঠাৎ একটা বিচিত্র সম্ভাবনা আমার মাথার ভিতরে জেগে উঠল। তাড়াতাড়ি রূপলালকে টানতে টানতে আবার ঘরের ভিতরে এনে সজোরে দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে সভয়ে আমি বললুম, ‘রূপলাল, রূপলাল! পৃথিবীর সব দেশের লোকেরই একটা বিশ্বাস আছে, কোনো কোনো বাঘ নাকি আসলে বাঘ নয়! রূপলাল, আজ রাত্রে যে স্ত্রীলোকটা এখানে এসেছিল, সে কে? গুলি করলুম বাঘকে, চিৎকার করলে একটা স্ত্রীলোক! এর মানে কী?— সে কে? সে কে?’
রূপলাল অবাক হয়ে আমার মুখের পানে তাকিয়ে রইল। অনেকক্ষণ পরে সে বললে, ‘তুমি কি বলতে চাও তাহলে ওই উড়ে বেয়ারাটার কথাই সত্যি!’