কে?
নতুন মামলা
সবে ফুটিফুটি করছে ভোরের আলো৷ কলকাতার গড়ের মাঠ৷
গাছে গাছে বিহঙ্গদের ঐক্যতান৷ এখানে-ওখানে অশ্বচালনা করছে পাঞ্জাবি ঘোড়সওয়াররা৷ প্রাতর্ভ্রমণে বেরিয়েছে আরও অনেকে এবং তাদের মধ্যে দেখা যাচ্ছে আমাদের পরিচিত তিনটি মানুষকে-সখের গোয়েন্দা জয়ন্ত আর মানিক ও পুলিশ-কর্মচারী সুন্দরবাবু৷
শরৎ ঋতুর জন্যে আসর ছেড়ে দেবার আগে শেষ বর্ষা যথেষ্ট বিক্রম প্রকাশ করে গিয়েছে গতকল্য রাত্রে৷ সারা শহরটা ঘণ্টা কয়েক ধরে স্নান করেছে এমন ঘন বৃষ্টিধারায় যে, পথের আর মাঠের অনেক জায়গাতেই এখনও থইথই করছে ঘোলাটে জল৷ রাত দুটোর পরে বৃষ্টি থেমেছে বটে, কিন্তু গড়ের মাঠ এখনও প্রাতর্ভ্রমণের উপযোগী হয়ে ওঠেনি৷
তবু প্রভাতি ভ্রমণে যারা অভ্যস্থ এ সময়টায় তারা ঘরের চার দেওয়ালের মধ্যে বন্দি হয়ে থাকতে চায় না৷ জয়ন্ত আর মানিক হচ্ছে এই জাতীয় জীব৷ কেবল সূর্যোদয়ের আগে নয়, সূর্যাস্তের পরেও একবার করে মুক্ত আকাশ-বাতাসের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপন করতে না পারলে তারা যেন আত্মস্থ হতে পারে না৷
এ বাতিক কোনোদিনই ছিল না সুন্দরবাবুর৷ কিন্তু ইদানীং তাঁর উদরদেশের বিপুলতা এতটা বেড়ে উঠেছে যে, চিকিৎসকরা পরামর্শ দিয়েছেন, নিয়মিতভাবে প্রত্যহ কিঞ্চিৎ ব্যায়াম-অর্থাৎ অন্তত মাইল দুয়েক পদব্রজে ভ্রমণ করতে৷ তাই ইচ্ছার বিরুদ্ধেও আজকাল তাঁকে হতে হয়েছে জয়ন্তদের ভ্রমণের সঙ্গী৷
ভুঁড়ির দ্বারা ভারাক্রান্ত সুন্দরবাবু কিছুক্ষণ পদচালনা করবার পর শ্রান্ত স্বরে বললেন, ‘মানিক, পথের আর মাঠের অবস্থা দেখছ তো?’
-‘দেখছি৷’
-‘আজ আমি কিছুতেই বেড়াতে আসতুম না৷’
-‘তবে এলেন কেন?’
-‘তোমাদের উৎপাতের দায়ে পড়ে৷ ভোর হতে-না-হতেই, কাক-চিল না ডাকতেই, বাসায় ঢুকে তুমি গাধার মতো যা ডাকাডাকি শুরু করলে৷ বাড়িতে ডাকাত পড়েছে ভেবে ছেলে-মেয়েরা পর্যন্ত চমকে জেগে উঠল৷ তোমার গর্ধভ কন্ঠকে রুদ্ধ করবার জন্যই আজ আমাকে তাড়াতাড়ি বাইরে বেরিয়ে আসতে হয়েছে৷’
মানিক মুখ টিপে হাসতে হাসতে বললে, ‘আমাকে গাধা বলে আপনি যদি খুশি হন, আমি আপত্তি করব না৷ কিন্তু বাইরে এসে কি দেখছেন না, আজকের দিনটির বিশেষত্ব?
-‘হুম! বিশেষত্বের মধ্যে তো দেখছি কেবল জল, কাদা আর পিছল পথ৷’
-‘আর কিছু দেখছেন না?’
-‘উঁহু৷’
-‘তাহলে আপনার চোখের দোষ হয়েছে৷’
-‘চোখের কিছু দোষ হয়নি৷ তাহলে আমি চশমা পরতুম৷’
মানিক এদিক-ওদিক অঙ্গুলি নির্দেশ করে বললে, ‘দেখছেন?’
সুন্দরবাবু এদিকে-ওদিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে হতভম্বের মতো বললেন, ‘কিছুই দেখছি না তো!’
-‘ভালো করে চেয়ে দেখুন, মাঠের যেখানে যেখানে জল জমেছে, সেইখানে স্বর্গ নেমে এসেছে মাটির কোলে৷’
-‘মানে?’
-‘স্বর্গ বললে আমরা কোনদিকে তাকাই? আকাশের দিকে৷ দেখুন মাঠের যেখানে যেখানে জল জমেছে, সেইখানে নেমে এসেছে টুকরো আকাশের সুন্দর নিলীমা৷ একটু পরেই দেখতে পাবেন ওখানে সাঁতার কাটছে কচি রোদের কাঁচা সোনালি আভা৷ আবার সন্ধ্যার পরে হয়তো ওখানে ফুটে উঠবে নতুন চাঁদের রুপোলি জ্যোৎস্নাও৷’
সুন্দরবাবু দুই ভুরু তুলে বললেন, ‘উঃ ভয়ংকর কাব্যি!’
জয়ন্ত এতক্ষণ নির্বাক মুখে অগ্রসর হচ্ছিল৷ হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে বললে, ‘সুন্দরবাবু!’
তাঁর কন্ঠস্বর শুনে সুন্দরবাবু সচমকে বললেন, ‘কী জয়ন্ত?’
আঙুল দিয়ে একদিকে দেখিয়ে জয়ন্ত বললে, ‘ওই গাছতলায় কী পড়ে আছে দেখছেন?’
-‘একটা মানুষ শুয়ে আছে বলে মনে হচ্ছে! না, না, ওটা যে রক্তাক্ত দেহ!’
-‘হুঁ৷ খুব সম্ভব ওটা মৃতদেহ! গড়ের মাঠে এমনধারা দৃশ্য নতুন নয়৷ এগিয়ে চলুন, ব্যাপারটা কী দেখা যাক!’
সুন্দরবাবু একটা নিশ্বাস ফেলে বললেন, ‘ব্যাপার আর কী, ঢেঁকি স্বর্গে গিয়েও ধান ভাঙে৷ মানিক এতক্ষণ আমাকে গড়ের মাঠে মাটির উপরে স্বর্গ দেখাবার চেষ্টা করছিল৷ এখন সামলাও বাবা স্বর্গের ঠেলা, স্বর্গের বদলে ঘাড়ে হয়তো চাপল একটা নতুন খুনের মামলা!’
মানিক বললে, ‘সত্যি সুন্দরবাবু, আপনার সঙ্গে আমিও সহানুভূতি প্রকাশ করছি৷ এমন বৃষ্টিস্নাত প্রভাত, মনে মনে করছিলুম কাব্যালোচনা, চোখের সামনে দেখছিলুম মাটির ফ্রেমে-বাঁধানো জলের পটে নিলীমার ছবি, হঠাৎ কিনা রক্তাক্ত মৃত্যু এসে এক মুহূর্তে বিলুপ্ত করে দিলে সমস্ত সৌন্দর্য৷ নিয়তির পরিহাস আর কাকে বলে!’
সকলে তখন গাছতলায় এসে দাঁড়িয়েছে৷ সেখানে মাটির ওপরে হাত-পা ছড়িয়ে চিত হয়ে পড়ে রয়েছে একটা মানুষের নিশ্চেষ্ট দেহ৷ প্রথম দৃষ্টিতেই বোঝা যায়, সেটা মৃতদেহ ছাড়া আর কিছুই নয়৷ কারণ, তার মুখের অস্তিত্ব নেই বললেই হয়-কপালের তলা থেকে চিবুক পর্যন্ত মুখের সমস্ত অংশটা একেবারে লুপ্ত হয়ে গিয়েছে, দেখা যাচ্ছে কেবল চাপ-বাঁধা রক্তের মধ্যে খানিকটা ছিন্নভিন্ন মাংস! বীভৎস দৃশ্য!
সুন্দরবাবু বললেন, ‘হুম, আত্মহত্যার নয়, হত্যার মামলা৷
জয়ন্ত বললে, ‘কেউ ছররা ভরা শটগান ছুড়ে এই বেচারার মুখ উড়িয়ে দিয়েছে৷ আর বন্দুকটা ছোড়া হয়েছে কাছ থেকেই, নইলে মুখটা অমনভাবে উড়ে যেত না৷’ সে বসে পড়ে মৃতদেহের ওপর হাত রেখে আবার বললে, ‘দেহটা এখনও একেবারে ঠান্ডা হয়ে যায়নি৷ খুব সম্ভব এর মৃত্যু হয়েছে ঘণ্টা খানেক আগেই৷’
সুন্দরবাবু বললেন, ‘চারিদিকে কত রক্ত দেখেছ?’
-‘তার মানে একে হত্যা করা হয়েছে এইখানেই৷ ঘটনাটা ঘটেছে বৃষ্টি থামবার পরে কোনো একসময়ে৷ নইলে কালকের প্রবল বৃষ্টিপাতে মৃতদেহের সমস্ত রক্ত ধুয়ে-মুছে নিশ্চিহ্ন হয়ে যেত৷ রাত দুটোর আগে বৃষ্টি থামেনি৷ আমরা ঘটনাস্থলে এসেছি সকাল সাড়ে পাঁচটার পর৷ হত্যাকারী কাজ সেরেছে এরই মধ্যে৷’
সুন্দরবাবু বললে, ‘এটা হচ্ছে যুবকের লাশ৷ জুতা আর পরনের কাপড় দেখলেই বোঝা যায় ভদ্রবংশের যুবক৷ কিন্তু ওর গায়ে রয়েছে কেবল একটা গেঞ্জি৷ গভীর রাত্রে কেবল গেঞ্জি পরে ভদ্রবংশের কোনো যুবক কি গড়ের মাঠে বেড়াতে আসে?’
-‘হত ব্যক্তিকে বোধ হয় কোনো গাড়িতে করে এখানে আনা হয়েছিল? হত্যাকাণ্ডের পর হয়তো তার উপরকার জামাটা অপরাধী খুলে নিয়ে গিয়েছে৷’
-‘কেন?’
-‘সহজে যাতে শনাক্ত করা না যায়৷’
হেঁট হয়ে মাটির উপর থেকে একখানা খাম তুলে নিয়ে তার উপরে চোখ বুলিয়ে বলল, ‘কিন্তু খুব সম্ভব হত্যাকারী দেখতে পায়নি যে এই খামখানা মৃত ব্যক্তির জামার পকেট থেকে এখানে পড়ে গিয়েছে৷’
-‘খামের উপরে কারুর নাম আর ঠিকানা আছে?’
-‘হ্যাঁ৷ শ্রীযুক্ত মণিমোহন বসু৷ দশ নম্বর বলাই শীল স্ট্রিট৷ কলিকাতা৷’
জয়ন্ত বললে, ‘এটা একটা বড়ো সূত্র৷ ওটা হয় হত ব্যক্তির, নয় হত্যাকারীর নাম আর ঠিকানা! খামের ভিতর কোনো চিঠি আছে?’
-‘আছে৷ এই যে!’ চিঠিখানা পড়ে মানিক বললে, ‘বাজে চিঠি৷’ শালিখায় পঁচিশ নম্বর সুন্দর সেন রোড থেকে এক চন্দ্রনাথ রায় মণিমোহনকে তার সঙ্গে দেখা করবার জন্যে অনুরোধ করেছে৷’
-‘বাজে চিঠি নয়, ওটাও কাজে লাগবে৷ সুন্দরবাবু, আপনার পায়ের কাছে একটা মানিব্যাগ পড়ে আছে না?’
সুন্দরবাবু সেটা কুড়িয়ে নিয়ে বললেন, ‘হ্যাঁ৷ কিন্তু ব্যাগের ভিতর খালি, ঢুঁঢুঁ৷’
জয়ন্ত আশেপাশের জমি পরীক্ষা করতে করতে বললে, ‘দেখছি বৃষ্টিভেজা মাটির উপরে তিন জন লোকের আলাদা আলাদা পায়ের ছাপ আছে৷ ধরলুম তিন জনের এক জন হচ্ছে নিহত মণিমোহন! তাহলে আর দু-জন কে? নিশ্চয়ই হত্যাকারী৷ সুন্দরবাবু, পদচিহ্নগুলোর প্লাস্টারের ছাপ তোলবার ব্যবস্থা করতে হবে৷’
সুন্দরবাবু খুশি মুখে বললেন, ‘প্রথমেই যখন এতগুলো সূত্র পাওয়া গেল, তখন মামলাটার কিনারা করতে বেশি বেগ পেতে হবে না বোধ হয়!’
জয়ন্ত বললে, ‘আরও একটা কথা বোঝা যাচ্ছে৷ ঘটনাস্থলে কোনো ধস্তাধস্তির চিহ্ন নেই৷ হত ব্যক্তি নিশ্চয়ই তার সঙ্গীদের চিনত, তাদের বিশ্বাস করত, নইলে রাত দুটোর পর গড়ের মাঠে এমন নির্জন জায়গায় তাদের সঙ্গে বিনা বাধায় আসতে রাজি হত না! আপাতত এই পর্যন্ত৷ সূর্য উঠেছে, চারিদিকে লোকের ভিড়, চলো মানিক স্থানান্তরে প্রস্থান করি৷’
হেঁয়ালির মামলা
মণিমোহন বসু৷ দশ নম্বর বলাই শীল স্ট্রিট৷
সুন্দরবাবু যথাস্থানে গিয়ে হাজির হয়ে দরজার কড়া নাড়তে লাগলেন৷
বাড়ির ভিতর থেকে বেরিয়ে এলেন এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক৷ সুন্দরবাবুর ধরাচূড়া পরা চেহারা দেখেই চমকে উঠল তাঁর দুই চক্ষু৷
সুন্দরবাবু শুধোলেন, ‘এ বাড়িতে মণিমোহন বসু বলে কেউ থাকে?’
-‘থাকে৷ মণি আমার ছেলে৷’
-‘আপনার নাম কী?’
-‘মহেন্দ্রমোহন বসু৷’
-‘মণিবাবুর সঙ্গে আমি দেখা করতে চাই৷’
-‘মণি কাল থেকে বাড়িতে ফেরেনি৷ তার জন্যে আমরা বড়ো ভাবছি৷ সে তো না বলে বাইরে কখনো রাত কাটায় না!’
-‘বটে৷ আপনার ছেলের বয়স কত?’
-‘আঠাশ৷’
-‘গায়ের রং?’
-‘উজ্জ্বল শ্যাম৷’
-‘একহারা, কিন্তু বলিষ্ঠ দেহ?’
-‘আজ্ঞে হ্যাঁ৷’
-‘বাইরে যাবার সময়ে সে কীরকম পোশাক পরেছিল?’
-‘সিল্কের পাঞ্জাবি৷ সরু কালোপেড়ে মিলের ধুতি৷ পায়ে ব্রাউন রঙের জুতো৷’
-‘আপনি অনুগ্রহ করে আমার সঙ্গে একটু আসবেন৷’
-‘কোথায়?’
-‘মর্গে৷’
মহেন্দ্রের দুই চক্ষু বিস্ফারিত হয়ে উঠল৷ সবিস্ময়ে বললেন, ‘মর্গে?’
-‘আপনার জন্যে আমার দুঃখ হচ্ছে৷ কিন্তু না বলেও আর উপায় নেই৷ আজ আমরা একটা লাশ পেয়েছি৷ সেটা আপনার ছেলের দেহও হতে পারে!’
মহেন্দ্রবাবু টলে পড়ে যাচ্ছিল, সুন্দরবাবু তাড়াতাড়ি দু-হাতে তাকে ধরে ফেললেন তারপর বললেন, ‘স্থির হোন মহেন্দ্রবাবু৷ আসুন আমার সঙ্গে৷ আমাদের অনুমান হয়তো সত্য নয়!’
শবাগারে গিয়ে সন্দেহ কিন্তু সত্য বলেই প্রমাণিত হল৷ যদিও শবের মুখ চেনবার উপায় নেই, তবু দেহটা পরীক্ষা করেই মহেন্দ্র সক্রন্দনে বলে উঠল, ‘এ আমার মণিমোহন৷’
খানিক পরে শোকের প্রথম ধাক্কাটা সে যখন কতকটা সামলে নিলে, সুন্দরবাবু জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনার ছেলে কী কাজ করত?’
-‘মার্চেন্ট আপিসে চাকরি করত, কিন্তু আপাতত বেকার হয়ে বসেছিল৷’
-‘দেখুন মহেন্দ্রবাবু, আমাদের ধারণা, মণিমোহন যাদের হাতে মারা পড়েছে, সে তাদের চিনত৷ সে কীরকম লোকের সঙ্গে মেলামেশা করত, আপনি কি তা জানেন?’
-‘যতদূর জানি, আমার ছেলের অসৎ সংসর্গ ছিল না৷ সে নিজেও ছিল শান্তশিষ্ট, অতি ভদ্র, মেলামেশাও করত সেইরকম সব লোকের সঙ্গে৷’
-‘তার কোনো ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে আপনি চেনেন?’
-‘চিনি৷ তার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠতা ছিল একজনের সঙ্গে, তার নাম নন্দলাল মিত্র৷’
-‘ঠিকানা?’
-‘পাঁচ নম্বর রায় রোড৷’
-‘তার সম্বন্ধে আরও কিছু বলতে পারেন?’
-‘নন্দ বড়ো ভালো ছেলে৷ মণিরই সমবয়সি৷ কে. সরকারের বিখ্যাত জুয়েলারি ফার্মের ক্যাশিয়ার৷’
-‘হুম৷ মণিমোহনের আর কোনো বন্ধুর কথা বলতে পারেন?’
-‘বিশেষ কিছু খবর রাখি না৷ নন্দের মতো ঘনিষ্ঠ বন্ধু বলে আর কাউকে আমি জানি না৷ তবে হালে . . .’
-‘বলুন, থামলেন কেন?’
-‘হালে মণির সঙ্গে একটি লোকের আলাপ হয়েছে বটে৷ লোকটিকে আমার ভালো লাগত না৷’
-‘ভালো লাগত না কেন?’
-‘প্রকৃতির কথা জানি না, তবে আকৃতি ছিল তার বিরুদ্ধে৷ অত্যন্ত কাঠখোট্টা চেহারা৷’
-‘তার নাম?’
-‘চন্দ্রনাথ রায়৷’
নাম শুনেই সুন্দরবাবু জাগ্রত হয়ে উঠলেন অধিকতর৷ ঘটনাস্থলে যে পত্র পাওয়া গিয়াছে, তারও লেখকের নাম চন্দ্রনাথ রায়৷ তিনি বললেন, ‘চন্দ্রনাথ কি শালিখার পঁচিশ নম্বর সুন্দর সেন রোডে থাকে?’
-‘ঠিক ঠিকানা জানি না, তবে সে শালিখাতেই থাকে বটে৷’
-‘তার দেহের একটু বর্ণনা দিন৷’
-‘রং কালো৷ আর এক পোঁচ বেশি কালো হলেই সে আফ্রিকার কাফ্রিদের দলে গিয়ে ভিড়তে পারত৷ মাথায় ছয় ফুটের কাছাকাছি রীতিমতো বলবান দোহারা দেহ৷ খ্যাঁদা নাক, খুদে খুদে চোখ, দৃষ্টি তীক্ষ্ণ৷ গোঁফদাড়ি কামানো৷ সর্বদাই কোট-প্যান্ট পরে আর হাতে থাকে একগাছা মোটা বাঘমারা লাঠি৷ বাঁ-হাতের কড়ে আঙুলের আধখানা নেই৷’
-‘হুম! যে বর্ণনা পেলুম, ভিড়ের ভিতর থেকে চন্দ্রনাথকে চিনে নিতে দেরি লাগবে না৷ আচ্ছা মহেন্দ্রবাবু, কেবল চেহারার জন্যই কি আপনার চন্দ্রনাথকে ভালো লাগত না?’
-‘না৷ তার গলার আওয়াজ যেমন কর্কশ, কথাবার্তাও তেমনি রুক্ষ! তার সঙ্গে মেলামেশার পর থেকেই মণির প্রকৃতিও যেন একটু একটু বদলে গিয়েছিল৷’
-‘কীরকম?’
-‘তার হাবভাব ব্যবহার কিঞ্চিৎ রহস্যময় হয়ে উঠেছিল৷’
-‘তার মানে?’
-‘সে যেন সর্বদাই কী চিন্তা করত! বাড়ির কারুর সঙ্গে বেশি কথা কইত না, আমাকেও যেন এড়িয়ে এড়িয়ে চলবার চেষ্টা করত! আমরা ভাবতুম, বেকার বসে আছে বলেই সে এমন মনমরা হয়ে আছে৷’
-‘তাও অসম্ভব নয় তো৷’
-‘খুব সম্ভব তাই, কিন্তু মণির আরও একটা পরিবর্তন আমরা লক্ষ করেছিলুম৷’
-‘বলুন৷’
-‘মণি আগে সন্ধ্যার সঙ্গেসঙ্গেই ফিরে আসত৷ কিন্তু ইদানীং বাড়ি ফিরতে তার রাত দশ-এগারোটা হয়ে যেত৷’
-‘কতদিন থেকে এটা লক্ষ করছেন?’
-‘চন্দ্রনাথের সঙ্গে মণির আলাপ হওয়ার পর থেকে৷’
-‘চন্দ্রনাথের আবির্ভাব কত দিন?’
-‘সে প্রথমে আমার বাড়িতে আসে মাস পাঁচেক আগে৷’
-‘মহেন্দ্রবাবু মৃতদেহের মুখ নেই বললেই হয়৷ ও দেহ যে আপনারই পুত্রের, সেটা ঠিক চিনতে পেরেছেন তো?’
মহেন্দ্র ভগ্ন স্বরে বললে, ‘কোনো সন্দেহ নেই-কোনো সন্দেহ নেই৷ আমি বাপ, নিজের ছেলের দেহ চিনতে পারব না৷ সেই রং, সেই গড়ন, আঙুলে পলার আংটি, পায়ে সেই জুতো! পরনের কাপড়ের আমাদের ধোপার মার্কা৷ বেশ বুঝেছি মশাই, আমারই কপাল পুড়েছে৷’ বলতে বলতে কাঁদো-কাঁদো হয়ে এল তাঁর কন্ঠস্বর৷
সুন্দরবাবু মমতাভরা গলায় বললেন, ‘নিয়তি বড়ো নিষ্ঠুর, তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করে লাভ নেই মহেন্দ্রবাবু৷ আপাতত আমার আর কোনো জিজ্ঞাস্য নেই, আপনি বাড়ি যেতে পারেন৷’
মহেন্দ্রের প্রস্থান৷ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সুন্দরবাবুর চিন্তা: হুম! শালখের চন্দ্রনাথ৷ রঙে কাফ্রি, নামে চন্দ্র-কানা ছেলের নাম পদ্মলোচন৷ আকৃতি প্রকৃতি নাকি সন্দেহজনক! এইবার তোমার দিকেই আমি পদচালনা করব৷ . . .
কিন্তু সুন্দরবাবুকে বেশি দূর পদচালনা করতে হল না৷ শবাগারের বাইরে আসতেই তিনি দেখলেন, একখানা মোটর এসে দাঁড়াল এবং গাড়ির ভিতর থেকে নেমে পড়ল একটি যুবক৷ তার মুখের ভাব উদবিগ্ন৷
সে বললে, ‘আপনিই তো সুন্দরবাবু?’
-‘হুম!’
-‘আমি আপনার কাছেই এসেছি৷’
-‘কেন?’
-‘আমার ছোটো ভাই নন্দলাল কাল সন্ধ্যার সময়ে বাড়ি থেকে বেরিয়েছে, এখনও ফেরেনি৷ থানায় সেই খবর দিতে গিয়ে শুনলুম, আপনারা নাকি একটা মৃতদেহ পেয়েছেন৷ আমি দেহটা একবার দেখতে চাই৷’
সুন্দরবাবু শুষ্ক কন্ঠে বললেন, ‘সেটা দেখে কী হবে?’
-‘দেহটা যদি নন্দের হয়?’
-‘অসম্ভব! তা শনাক্ত হয়ে গিয়েছে৷’
-‘কে শনাক্ত করেছে?’
-‘যার লাশ, তার বাপ নিজে৷’
-‘ভগবান করুন, ও দেহ যেন অন্যেরই হয়৷ তবু দয়া করে আমাকে কি একটি বার দেখবার সুযোগ দেবেন না?’
-‘আরে বাবা, খুনের মামলা-যা আমার চোখের বালি৷ আমার মগজে এখন বোঁ বোঁ করে চরকি ঘুরছে, এসব বাজে ব্যাপার ভালো লাগছে না, আমি চললুম৷’ বিরক্ত মুখে সুন্দরবাবু প্রস্থানোদ্যত হলেন৷
যুবক হাত জোড় করে মিনতি করে বললে, ‘দয়া করুন, একটি বার দেখতে দিন৷’
সুন্দরবাবু নাচারভাবে বললেন, ‘আপনি তো ভারি ছিনেজোঁক দেখছি৷ বেশ চলুন, নয়ন সার্থক করুন৷’
মৃতদেহের উপরে অর্ধমিনিটকাল চক্ষু বুলিয়েই যুবক চিৎকার করে কেঁদে উঠল৷
সুন্দরবাবু বিস্মিত কন্ঠে বললেন, ‘আরে গেল, খামোকা কান্নাকাটি কেন?’
-‘এই তো আমার ভাই নন্দলালের দেহ! যা ভেবেছি তাই, আমাদের সর্বনাশ হয়েছে!’
-‘আরে, আপনি পাগল নাকি!’
-‘আমি পাগল নই মশাই, পাগল নই! বিশ্বাস না হয়, ওর কাপড় তুলে দেখুন, জানুর উপরে দুই ইঞ্চি লম্বা কালো জড়ুল-এর দাগ আছে৷’
অবিশ্বাস ভরে সুন্দরবাবু এগিয়ে গেলেন! কাপড় সরানো হল৷ জানুর উপরে সত্য সত্যই রয়েছে দুই ইঞ্চি লম্বা কালো জড়ুলচিহ্ন৷
ধাঁ করে তাঁর মাথায় জাগল একটা নতুন সন্দেহ৷ আগ্রহের সঙ্গে তিনি শুধোলেন, ‘আপনার ভাইয়ের নাম নন্দলাল?’
-‘আজ্ঞে হ্যাঁ৷’
-‘নন্দলাল মিত্র?’
-‘আজ্ঞে হ্যাঁ৷’
-‘বাড়ি পাঁচ নম্বর রায় রোডে?’
-‘হ্যাঁ৷’
-‘তার এক বিশেষ বন্ধুর নাম মণিমোহন বসু?’
-‘হ্যাঁ৷’
সুন্দরবাবুর টুপি খুলে নিজের টাক চুলকাতে চুলকাতে হতভম্বের মতো বললেন, ‘এ কী কাণ্ড রে বাবা! এটা খুনের মামলা, না হেঁয়ালির মামলা?’
চন্দ্রনাথ রায়
প্রভাতি চায়ের আসরের জন্যে দু-জনে প্রস্তুত হচ্ছে, এমন সময়ে হন্তদন্তের মতো সুন্দরবাবুর প্রবেশ-
জয়ন্ত শুধোলে, ‘এ কী সুন্দরবাবু, হাঁফাচ্ছেন কেন?’
-‘দৌড়ে দৌড়ে আসছি যে!’
-‘দৌড়ে দৌড়ে?’
-‘প্রায়! পাছে চা-পানের মাহেন্দ্রক্ষণটি উতরে না যায়, সেই ভয়ে সবেগে পদচালনা করেছিলুম! গেল তিন দিন তোমাদের সঙ্গে দেখা হয়নি, ভয় হল আসর থেকে বুঝি নাম কাটা যায়!’
-‘তাহলে গেল তিন দিন বাড়িতে বসে চা-পান করেছেন?’
-‘পাগল! আমার বাড়ির চা ছুঁই না৷ সে যেন নালতের মতো, আর দোকানের চা-ও খাই না, সে যেন ঘোলাটে গঙ্গাজল! আজ তিন দিন চা খাওয়াই হয়নি৷’
-‘ব্যাপার কী?’
-‘গড়ের মাঠের সেই হত্যাকাণ্ডের ঠেলা৷ হন্তদন্তের মতো খালি তদন্ত আর তদন্ত করতে হচ্ছে৷ সূত্রও পেয়েছি ঢের, কিন্তু সব সুত্র জোট পাকিয়ে গিয়েছে৷’
-‘আচ্ছা, আগে চেয়ারসীন হোন, উদরদেশের চায়ের দুর্ভিক্ষ নিদারণ করুন৷ তারপর সব কথা শুনব৷’
সুন্দরবাবু আসন গ্রহণ করে বললেন, ‘আজ চায়ের সঙ্গে নতুন কোনো বিশেষত্ব আছে না কি?’
-‘বিশেষ কিছুই নয়৷ আমেরিকান ব্রেকফাস্ট৷ বিস্কুট, টোম্যাটো ওমলেট আর কড়াইশুঁটির কচুরি৷’
-‘ব্যস, ব্যস৷ ওইতেই আমি খুশি হতে পারব৷ সত্যি বলতে কী ভায়া বাড়ির চা আর ভালো লাগে না কেন জানো? তোমাদের বউদিদিটি দ্রৌপদী নন, নতুন পুরাতন যেকোনো রন্ধনে তিনি একেবারে মূর্তিমতী নিরাশা৷ হুম, কথায় বলে চা-টা! চায়ের সঙ্গে কিছু কিছু ‘টা’ না থাকলে চা কখনো সুখের হয়?’
মানিক বললে, ‘সুন্দরবাবু, আমাদের বউদিদি দ্রৌপদী হলে আপনি কি তাকে সহ্য করতে পারতেন?’
-‘মানে?’
-‘দ্রৌপদীর ছিল পাঁচ জন স্বামী৷’
-‘ধেৎ, খালি কথার ছল ধরা! আচ্ছা জয়ন্ত, টোম্যাটো ওমলেট পদার্থটা কী?’
-‘ওমলেটের ভিতরে মাখনে ভাজা কুচি কুচি পেঁয়াজ আর টোম্যাটো পুর৷ খুব সহজ রান্না৷’
-‘কিন্তু খেতে মজা তো? নাম শুনেই জিভে জল আসছে৷ কোথায় হে শ্রীমধুসূদন, শীঘ্র দেখা দাও৷’
ট্রে হাতে মধু ভৃত্যের প্রবেশ৷ চা পর্ব শেষ হবার আগে সুন্দরবাবু আর বাক্যালাপ করবার চেষ্টা করলেন না৷
জয়ন্ত বললে, ‘অঃতপর৷’
সুন্দরবাবু বললেন, ‘তোমরা মর্গের ব্যাপারটা তো আগেই শুনেছ৷ বেশ তারপর থেকেই আরম্ভ করি৷ শালখার চন্দ্রনাথ রায়ের সন্ধানে গিয়েছিলাম৷ কিন্তু তার বাসা খালি, বাহির থেকে তালাবন্ধ৷ খবর নিয়ে জানলুম হত্যাকাণ্ডের দিন বৈকালে একখানা কালো রংয়ের বুইক সিডান গাড়িতে চড়ে সে চলে গিয়েছে৷’
-‘গাড়িখানা তার নিজের?’
-‘হ্যাঁ৷ গাড়ি চালাত নিজেই৷’
-‘বাসায় কি সে একলা থাকত?’
-‘হ্যাঁ, অর্থাৎ চাকর, বামুন, দারোয়ান নিয়ে একলা৷ কিন্তু তার সঙ্গে আর সকলেও অদৃশ্য হয়েছে৷ এইটেই সন্দেহজনক৷’
জয়ন্ত খানিকক্ষণ চুপ করে রইল৷ ধীরে ধীরে বললে, ‘অসাধারণ মামলা বটে! মহেন্দ্রবাবু লাশ দেখে বলছেন সেটা তাঁর পুত্র মণিমোহনের মৃতদেহ৷ আর একজন বলছে, সে দেহটা হচ্ছে তার দাদা নন্দলালের৷ দ্বিতীয় ব্যক্তির কথামতো লাশের জানুর কাপড় তুলে দেখা গিয়াছে দুই ইঞ্চি লম্বা কালো জড়ুলের দাগ৷ মনে হচ্ছে দ্বিতীয় ব্যক্তির কথাই ঠিক! কারণ লাশের মুখ নেই-মহেন্দ্রবাবুর ভ্রম হওয়া অসম্ভব নয়৷’
সুন্দরবাবু বললেন, ‘শুনলুম মণিমোহনের আর নন্দলালের দেহের রং উচ্চতা আর গড়ন-পিটন নাকি প্রায় একইরকম!’
-‘এখানে প্রশ্ন ওঠে অনেকগুলো৷ ধরলুম হত ব্যক্তি হচ্ছে নন্দলাল৷ তাহলে হত্যাকারী কে? মণিমোহন? কিন্তু মহেন্দ্রের মুখে প্রকাশ, নন্দ ছিল তার সবচেয়ে বড়ো বন্ধু৷ সে অমন বন্ধুকে হত্যা করবে কেন? ঘটনাস্থলে আর এক ব্যক্তির পদচিহ্ন পাওয়া গিয়েছে৷ সেই-ই বা কে? শালিখার চন্দ্রনাথ? সে এখানে কোন ভূমিকায় অভিনয় করছে? নিশ্চয়ই মহাত্মার ভূমিকায় নয়, কারণ সেও গা-ঢাকা দিয়েছে৷ হ্যাঁ, ভালো কথা, যে তিন জন লোকের পায়ের দাগ পাওয়া গিয়াছে, তার প্লাস্টারের ছাঁচ তোলা হয়েছে?’
-‘হয়েছে?’
-‘তারপর?’
-‘একজোড়া ছাপের সঙ্গে হত ব্যক্তির-অর্থাৎ নন্দের জুতো অবিকল খাপ খেয়ে গিয়েছে৷ মণিমোহনের বাসার থেকে জুতোও সংগ্রহ করেছি৷ তার জুতোও মিলে গিয়েছে আর এক জোড়া ছাপের সঙ্গে৷ কিন্তু তৃতীয় ব্যক্তিকে পাইনি, তাই ছাপের সঙ্গে তার জুতোও মেলানো হয়নি৷’
-‘কিন্তু আপনি আরও কিছুদূর অগ্রসর হতে পেরেছেন৷ পদচিহ্নের ছাপ বিশেষভাবে প্রমাণিত করেছে দুটো সত্য৷ প্রথমত ঘটনাস্থলে মণিমোহনের উপস্থিতি৷ দ্বিতীয়ত হত ব্যক্তি নন্দ ছাড়া আর কেউ নয়৷ মামলাটা অনেকখানি হালকা হয়ে এল না কি?’
সুন্দরবাবু বললেন, ‘কিন্তু মামলাটার আর একদিক আরও ভারী হয়ে উঠেছে৷’
-‘কীরকম?’
-‘বলেছি তো, নন্দ ছিল কে. সরকারের বিখ্যাত জুয়েলারি ফার্মের ক্যাশিয়ার৷ সেখানে এক নতুন কাণ্ড হয়ে গিয়েছে!’
-‘বুঝেছি৷ চুরি৷’
সুন্দরবাবু সবিস্ময়ে বললেন, ‘কেমন করে বুঝলে?’
জয়ন্ত রুপোর ডিবে বার করে এক টিপ নস্য গ্রহণ করলে৷ মানিক কৌতূহলী চোখে তার দিকে তাকাল৷ সে জানে, এই নস্য গ্রহণটা হচ্ছে তার বন্ধুর বিশেষ আনন্দের লক্ষণ৷
সুন্দরবাবু আবার বললেন, ‘কেমন করে বুঝলে তুমি?’
জয়ন্ত হাসতে হাসতে বললে, ‘এটা আমার আন্দাজ মাত্র৷’
-‘বা রে, এমন যুক্তিহীন আন্দাজের কোনো কারণ নেই!’
-‘কারণ আছে বই কী৷ আমার আন্দাজ মোটেই যুক্তিহীন নয়৷ লোকে অকারণে নরহত্যা করে না৷ কিন্তু গোড়া থেকেই এই হত্যাকাণ্ডের মধ্যে আমি কোনো উদ্দেশ্য খুঁজে পাচ্ছিলাম না৷ এখন বেশ বোঝা যাচ্ছে যে, নন্দ মারা পড়েছে ওই টাকার জন্যেই৷ যদিও হত ব্যক্তি বিখ্যাত এক জুয়েলারি ফার্মের ক্যাশিয়ার শুনে একটা সন্দেহ আমার মনে উঁকি মারছিল! এখন জানা গেল, আমার সন্দেহ অমূলক নয়৷ সুন্দরবাবু, আন্দাজে আমি আরও একটা কথা বলতে পারি৷’
-‘পারো নাকি? বলে ফেলো৷’
-‘কে. সরকারের ফার্ম থেমে মোটারকম চুরি হয়ে গিয়েছে, আর চুরির জন্যে দায়ী ওই হত নন্দলাল৷’
সুন্দরবাবু বিস্ফারিত চক্ষে তালে তালে তিন বার তালি দিয়ে বললেন, ‘ঠিক! ঠিক! বা রে আন্দাজ! বা রে জয়ন্ত!’
জয়ন্ত বললে, ‘এখন আসল ব্যাপারটা খুলে বলুন দেখি৷’
-‘কে. সরকার নিজে থানায় অভিযোগ করতে এসেছিল৷’
-‘কীসের অভিযোগ?’
-‘চুরি বলেই ধরে নাও৷ চুরিটা হয়েছে হত্যাকাণ্ডের দিনেই৷ কে. সরকারের বসতবাড়ি আর দোকান এক জায়গায় নয়৷ তাঁর দোকান বন্ধ হত সন্ধ্যার মুখে৷ সেদিন দোকান বন্ধ হবার আগেই জরুরি কাজের জন্য তাঁকে বাড়িতে ফিরতে হয়েছিল৷ কথা ছিল, দোকানের ক্যাশ নিয়ে দোকান বন্ধ করে নন্দ তাঁর বাড়িতে জমা দিয়ে আসবে৷ কিন্তু নন্দ সেদিন ক্যাশ নিয়ে দোকান থেকে বেরিয়েই একেবারে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছে৷’
-‘টাকার পরিমাণ কত?’
-‘তেরো হাজার পাঁচ-শো পঞ্চাশ৷’
-‘নন্দের সম্বন্ধে কে. সরকারের ধারণা কী?’
-‘অত্যন্ত উচ্চ৷ বললে, নন্দ অতিশয় বিশ্বাসী আর সৎচরিত্র৷ তার দ্বারা কোনরকমে অসৎ কাজ হওয়া অসম্ভব৷’
-‘ঠিক৷ আমারও ওই বিশ্বাস৷’
-‘জয়ন্ত, আরও একটা এমন ব্যাপার জানা গিয়েছে, যা তুমি কিছুতেই আন্দাজ করতে পারবে না৷’
-‘পদে পদে আন্দাজে ঢিল ছোড়ার অভ্যাস আমার নেই৷’
-‘লাশের পরনে যে গেঞ্জি আর কাপড় ছিল তা নন্দের নয়, মণিমোহনের৷’
-‘শুনে বিস্মিত হলুম না৷ নন্দের পরনে কোট বা অন্য কোনোরকম জামাও ছিল, অপরাধীরা তা খুলে নিয়ে গিয়েছে, প্রথম দিনেই আন্দাজে এ কথাটা আপনাকে বলেছিলাম৷ সুন্দরবাবু, দোকান থেকে নন্দ সেদিন বাসায় ফিরে এসেছিল?’
-‘হ্যাঁ, তার বাসা দোকান থেকে কে. সরকারের বাড়িতে যাবার পথেই পড়ে৷ বাসায় এসে হাত-মুখ ধুয়ে কিছু খাবার খেয়ে আবার সে বেরিয়ে যায়-‘
-‘হ্যাঁ, মালিকের বাড়িতে টাকাগুলো পৌঁছে দেবার জন্যে৷ তারপরের ঘটনাগুলোও আমি কিছু কিছু আন্দাজ করতে পারছি৷’
-‘হুম, আবার আন্দাজ!’
-‘নন্দ পথ দিয়ে যাচ্ছে, হঠাৎ মণিমোহনের সঙ্গে দেখা৷ আমার বিশ্বাস, সে ছিল শালিখার চন্দ্রনাথের কালো রঙের বুইক-সিডান গাড়িতে আর গাড়ি চালাচ্ছিল চন্দ্রনাথ নিজেই৷ মণিমোহনের আহ্বানে নন্দ গাড়িতে এসে ওঠে৷ নন্দের কাছে কত টাকা আছে প্রকাশ পায়৷ তারপরের ব্যাপারগুলো ঠিক আন্দাজ করতে পারছি না৷ নন্দ গাড়িতে ওঠে সন্ধ্যার সময়ে, কিন্তু মারা পড়ে অন্তত রাত দুটোর পরে! মাঝের কয়েক ঘণ্টার হিসাব হত্যাকারী ধরা না পড়লে জানা যাবে না৷ নন্দকে হত্যা করে চন্দ্রনাথ আর মণিমোহন৷ আমার বিশ্বাস আসল হত্যাকারী হচ্ছে চন্দ্রনাথই, মণিমোহন বোধ হয় স্বহস্তে বন্ধু হত্যা করেনি৷ তারপর মৃতদেহের জামাকাপড় খুলে পরিয়ে দেওয়া হল মণিমোহনের জামাকাপড়৷ লাশের মুখ নিশ্চিহ্ন, তার দৈর্ঘ্য, রং আর গড়ন-পিটন প্রায় মণিমোহনের মতোই, তার পরনেও রইল মণিমোহনের জামাকাপড়৷ সুতরাং সেটা মণিমোহনের দেহ বলেই শনাক্ত হওয়া স্বাভাবিক, সকলে বুঝবে, কোনো অজানা ব্যক্তি অজানা কারণে মণিমোহনকে হত্যা করেছে৷ ওদিকে পুলিশ ভাবত নন্দ জুয়েলারি ফার্মের টাকা চুরি করে পলাতক হয়েছে৷ অপরাধীরা খুব মাথা খেলিয়ে প্ল্যান তৈরি করেছিল বটে, কিন্তু সব ব্যর্থ করে দিলে তুচ্ছ একটা জড়ুল আর কতকগুলো পায়ের দাগ৷ সুন্দরবাবু, এইবারে আপনার মামলাটা পরিষ্কার হয়ে গেল তো?’
সুন্দরবাবু বললেন, ‘তা তো গেল দেখছি৷ কিন্তু-‘
জয়ন্ত বাধা দিয়ে বলল, ‘কিন্তু আমার আর একটা আন্দাজ-এই কাজ হাসিলের পর চন্দ্রনাথ হয়তো মণিমোহনকেও হত্যা করেছে৷’
-‘হুম, আন্দাজেই তুমি কেল্লা ফতে করবে দেখছি৷ এখন চন্দ্রনাথকে হস্তগত করবার উপায়টাও আন্দাজে বাতলে দিতে পারো?’
এমন সময় মধু ঘরে ঢুকে বললে, ‘শালখে থেকে একটি বাবু দেখা করতে এসেছেন৷’
জয়ন্ত সচমকে বললে, ‘শালখে থেকে? নাম বলেছে?’
-‘আজ্ঞে হ্যাঁ৷ চন্দ্রনাথ রায়৷’
সুন্দরবাবু বাঘের মতো লাফিয়ে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘হুম৷’
অভিনেতা চন্দ্রনাথ
সত্য সত্যই কল্পনাতীত৷ পলাতক আসামি চন্দ্রনাথ নিজেই দেখা করতে এসেছে তাদের সঙ্গে৷ মামলাটার গোড়াতেই কোনো গলদ নেই তো? অবাক হয়ে ভাবতে লাগল জয়ন্ত ও মানিক৷
সুন্দরবাবু খুশিভরা গলায় বললেন, ‘আমাদের ভাগ্য ভালো৷ শিকার নিজেই জালে পড়তে চায়৷’
জয়ন্ত বললে, ‘সুন্দরবাবু এখন চন্দ্রনাথকে নিয়ে কী করবেন?’
-‘আগে করব গোটা কয় প্রশ্ন৷ তারপর তাকে থানায় নিয়ে গিয়ে ঘটনাস্থলে পাওয়া তৃতীয় ব্যক্তির পদচিহ্নের সঙ্গে তার জুতো মিলিয়ে দেখব৷’
জয়ন্ত বললে, ‘মধু, বাবুকে এখানে নিয়ে এসো৷’
মধুর প্রস্থান৷ অনতিবিলম্বেই ঘরের ভিতরে চন্দ্রনাথের আবির্ভাব৷
সুন্দরবাবু লক্ষ করে দেখলেন মণিমোহনের পিতার বর্ণনার সঙ্গে তার চেহারা মিলে যায় অবিকল৷ প্রায় ছয় ফুট লম্বা বলিষ্ঠ ও ঘোর কৃষ্ণবর্ণ দেহ৷ নাক খ্যাঁদা, কুতকুতে চোখে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি৷ মুখে গোঁফ-দাড়ি নেই৷ পরনে প্যান্ট-কোট, হাতে বেজায় মোটা লাঠি৷ বাঁ-হাতে আধখানা কাটা কড়ে আঙুল৷
দিব্যি নিশ্চিতভাবে ও সপ্রতিভ মুখে ঘরে ঢুকেই চন্দ্রনাথ বললে, ‘আমি সুন্দরবাবুর সঙ্গে দেখা করতে এসেছি৷’
-‘আমার সঙ্গে? কিন্তু এখানে কেন? এটা কি আমার ডেরা?’
-‘মোটেই নয়, মোটেই নয়৷ কে না জানে বাঘ থাকে বনে, আর পুলিশ থাকে থানায়? আমি থানাতেও ধরনা দিয়েছিলুম৷ সেখান থেকেই পেয়েছি এখানকার ঠিকানা৷’
লোকটার প্রগলভতা দেখে সুন্দরবাবুর মনে হল ক্রোধের সঞ্চার৷ কিন্তু সে ভাব দমন করে তিনি শুধোলেন, ‘আপনার নাম চন্দ্রনাথ রায়?’
-‘তাই তো আমি জানি, লোকেও আমাকে ওই বলেই ডাকে বটে৷’
তার কথাবার্তার ধরনধারণ বাড়িয়ে তুললে সুন্দরবাবুর ক্রোধের মাত্রা৷ বেশ একটু ঝাঁঝালো গলায় তিনি বললেন, ‘মহাশয়ের পিতৃদেব কি অন্ধ ছিলেন?’
-‘উঁহু৷’
-‘তবে মশাইকে কি স্বচক্ষে দেখে তিনি আপনার নাম রাখেননি?’
চন্দ্রনাথ নীরসকন্ঠে হেসে উঠল-হা হা হা হা৷ বললে, ‘ঠিক কথা৷ আমার গায়ের রংটা চাঁদের মতো নয় বটে! হাঁ, বাবার যে ভ্রম হয়েছিল সেকথা অস্বীকার করা চলে না৷ কিন্তু কী করব বলুন, পিতা হচ্ছেন দেবতা স্থানীয়, পুত্র হয়ে তাঁর ভ্রম আর শোধরাবার চেষ্টা করিনি৷’
-‘বেশ, তাহলে বাপের সুপুত্রের মতো ওই চেয়ারখানার উপরে একটু বসুন দেখি, আমি গোটা কয় প্রশ্ন করতে চাই৷’
চেয়ারখানা হড়হড় করে সুন্দরবাবুর খুব কাছে টেনে নিয়ে গিয়ে চন্দ্রনাথ বসে পড়ল৷ তারপর মোটা লাঠিগাছা পদযুগলের মাঝখানে রেখে তার উপরে দুই হস্ত স্থাপন করে বললে, ‘আপনার প্রশ্নগুলো শ্রবণ করবার জন্যে আমার দুই কর্ণ অতিশয় ব্যগ্র হয়ে উঠেছে৷’
এ কীরকম ঢ্যাঁটা অপরাধী, পুলিশ দেখে দূরে সরে দাঁড়ানো দূরের কথা, পুলিশের গা ঘেঁষে বসতে ভয় পায় না! ভালো কথা নয় তো, যা দিনকাল পড়েছে, সাবধানের মার নেই৷ সুন্দরবাবু নিজেই তফাতে সরে গিয়ে দখল করলেন অন্য একখানা চেয়ার৷
চন্দ্রনাথ হাসতে লাগল মুখ টিপে টিপে৷
সুন্দরবাবু বললেন, ‘হঠাৎ আমার সঙ্গে আপনার দেখা করবার শখ হল কেন?’
-‘শুনলুম, সেদিন আমার বাড়িতে আপনি বেড়াতে গিয়েছিলেন?’
-‘বেড়াতে নয়, আপনাকে খুঁজতে৷’
-‘বেশ তাই! কিন্তু কেন?’
-‘নন্দলাল মিত্র খুন হয়েছে জানেন?’
-‘কে নন্দলাল?’
-‘একেবারে আকাশ থেকে পড়লেন যে! মণিমোহন বসুর বিশেষ বন্ধু নন্দলালকে চেনেন না নাকি?’
-‘না, আমি কেবল মণিমোহনকেই জানি৷’
-‘বটে৷ গেল পঁচিশ তারিখে মণিমোহনের সঙ্গে আপনার দেখা হয়নি?’
-‘না৷’
-‘ওই তারিখে আপনি কোথায় ছিলেন?’
-‘সন্ধ্যা পর্যন্ত বাসাতেই ছিলুম৷ তারপর হঠাৎ এক আত্মীয়ের মারাত্মক অসুখের খবর পেয়ে তাড়াতাড়ি দেশে চলে যেতে হয়৷’
-‘চাকর, বামুন, দারোয়ান সবাইকে নিয়ে?’
-‘নিশ্চয়ই৷ একলা মানুষ, আমাকে দেখবে কে?’
-‘আপনার দেশ কোথায়?’
-‘এখান থেকে চল্লিশ মাইল দূরে ভজনপুর গ্রামে৷’
-‘আপনার শটগান আছে?’
-‘আছে! অন্যরকম বন্দুকও আছে৷’
-‘মণিমোহন আপনার বন্ধু?’
-‘হ্যাঁ৷ নতুন বন্ধু৷’
-‘তাকে আপনি একখানা চিঠি লিখেছিলেন, পঁচিশ তারিখে আপনার সঙ্গে দেখা করবার জন্যে?’
-‘হ্যাঁ৷’
-‘সে আপনার সঙ্গে দেখা করেছিল?’
-‘না৷’
-‘ওই তারিখের পর তার সঙ্গে আপনার আর দেখা হয়েছে?’
-‘না৷’
-‘সে এখন কোথায় আছে?’
-‘জানি না৷’
-‘তার আর কোথায় আসা-যাওয়া আছে?’
-‘ভগবান জানেন৷’
-‘ঘটনাস্থলে তিন জন লোকের পদচিহ্ন পাওয়া গেছে৷ মণিমোহনের আর নন্দলালের! কিন্তু তৃতীয় পদচিহ্নের অধিকারী কে, তা আমরা আবিষ্কার করতে পারিনি৷’
-‘শুনে দুঃখিত হলুম৷’
-‘আপনার দুঃখ নিয়ে আপনি চুলোয় গেলেও আমি দুঃখিত হব না! হুম! আমি এখন ভাবছি, কে এই তৃতীয় ব্যক্তি?’
-‘বলতে পারব না, আমি গনতকার নই৷’
-‘আরে গেল, এ প্রশ্ন কি আপনাকে করছি? আমি কথা কইছি নিজের সঙ্গেই৷ নিজের মনের ভিতরেই আমি উত্তর খোঁজবার চেষ্টা করছি৷’
-‘চেষ্টা করুন৷ আপনার আর কোনো প্রশ্ন আছে?’
-‘আপাতত নাই৷’
-‘তাহলে আমি গাত্রোত্থান করতে পারি?’
-‘নিশ্চয়ই! এইবারে আপনাকে গাত্রোত্থান করতে হবেই৷’
-‘তবে এই গাত্রোত্থান করলুম৷’
সুন্দরবাবুও আসন ত্যাগ করে বললেন, ‘এইবারে আপনাকে আমার সঙ্গে যাত্রা করতে হবে৷’
-‘কোথায়?’
-‘থানায়৷’
চন্দ্রনাথ সভয়ে বলে উঠল, ‘থানায় কেন?’
-‘যথাসময়েই সেটা জানতে পারবেন৷’
-‘আপনার সব কথারই জবাব তো দিলুম৷ আবার আমাকে থানায় টেনে নিয়ে যাবার কারণ কী?’
-‘কারণ? জলখাবার খাবার জন্যে নয়! ধরুন অকারণেই৷’
এতক্ষণ পরে চন্দ্রনাথ যেন হারিয়ে ফেলল নিজের সমস্ত দৃঢ়তা ও নিশ্চিন্ততা৷ কাতর কন্ঠে বললে, ‘অকারণে আমাকে থানায় নিয়ে গিয়ে লাভ কী সুন্দরবাবু?’
সুন্দরবাবু নিজের বাহু বিস্তার করে সবলে ধারণ করলেন চন্দ্রনাথের দক্ষিণ বাহু৷ তারপরে বললেন, ‘হুম! এখন সুড়সুড় করে আমার সঙ্গে চলুন তো৷ পরে ভাবা যাবে লাভ-লোকসানের কথা৷ আসি জয়ন্ত, আসি মানিক৷ খানিক পরেই ফোনে তোমাদের সঙ্গে বাক্যালাপ করব৷ আসুন, অমাবস্যার দৃশ্যমান চন্দ্র!’
চন্দ্রনাথ কলের পুতুলের মতো চলে গেল সুন্দরবাবুর সঙ্গে৷
জয়ন্ত চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললে, ‘মানিক, এইবারে আমরা মতামত বিনিময় করি এসো৷ চন্দ্রনাথ লোকটাকে তোমার কেমন লাগল?’
-‘ভালো লাগল না৷’
-‘ঠিক৷ একেবারে পয়লা নম্বরের অপরাধীর চেহারা! আর একটা ব্যাপার লক্ষ করেছ?’
-‘কী?’
-‘চন্দ্রনাথ যতক্ষণ এখানে ছিল, একবারও সোজাসুজি তোমার আর আমার দিকে তাকায়নি! অথচ সে ছিল আমাদের সম্বন্ধে সম্পূর্ণ সচেতন৷কারণ মাঝে মাঝে ওই বড়ো আয়নাখানার দিকে আড়চোখে চেয়ে দেখে নিচ্ছিল আমাদের৷’
-‘কিন্তু সে এখানে এসেছিল কেন?’
-‘অভিনয় করতে৷’
-‘অভিনয় করতে?’
-‘হ্যাঁ৷ আর সেই সঙ্গে নিজেকে নিরপরাধ বলে প্রমাণিত করতে৷’
-‘কিন্তু এ ভয় তো তার থাকা স্বাভাবিক যে, ঘটনাস্থলে পাওয়া তৃতীয় ব্যক্তির পদচিহ্নের সঙ্গে তার নিজের পদচিহ্নও মিলে যেতে পারে?’
-‘তা পারে৷ এইখানেই আমার কেমন খটকা লাগছে৷ এমন সম্ভাবনার কথা যে তারও মাথায় জাগেনি, তাকে তো দেখে একটা নির্বোধ বলে মনে হল না৷ সুন্দরবাবু তো ওই জন্যেই তাকে থানায় ধরে নিয়ে গেলেন৷’
-‘আর থানায় যাবার নামেই সে ভয়ে কীরকম জড়োসড়ো হয়ে পড়ল, লক্ষ করেছ তো?’
-‘তা আবার করিনি? কিন্তু তা হচ্ছে অভিনয়, অভিনয়, অভিনয়৷ আসলে সে এতটুকুও ভয় পায়নি৷’
-‘কেমন করে জানলে?’
-‘এখানে আসবার আগে সে নিজেই সুন্দরবাবুর খোঁজে থানায় গিয়ে হাজির হয়েছিল৷ সুতরাং থানায় যাবার নামে তার ভয় পাবার কোনোই কারণ থাকতে পারে না৷ সে ভয় পায়নি, ভয়ের অভিনয় করেছিল৷’
-‘কেন?’
-‘বোধ হয়, সুন্দরবাবুকে সে একেবারে অপদস্থ করতে চায়! আমার মনে হয়, সে ভালো করেই জানে যে থানায় গিয়ে সুন্দরবাবু তার পদচিহ্ন পরীক্ষা করবেন৷’
-‘বল কী হে?’
-‘হ্যাঁ৷ শেষ পর্যন্ত কী দাঁড়াবে জানো? ঘটনাস্থলের পদচিহ্নের সঙ্গে মিলবে না তার পদচিহ্ন৷ পুলিশ বনবে বোকা৷ সে হবে সমস্ত সন্দেহ থেকে মুক্ত৷ নিশ্চয় এই উদ্দেশ্য নিয়েই সে আজ সুন্দরবাবুর সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল৷ নইলে তার এই অভাবিত আবির্ভাবের কোনো অর্থই হয় না৷ যাকগে ওসব কথা৷ সুন্দরবাবু তো এখনও ফোন করলেন না দেখছি৷ আপাতত আমরা কী করি বলো তো? দু-এক চাল দাবা বোড়ে খেলবে নাকি?’
-‘আপত্তি নেই৷’
চলল খেলা৷ চল্লিশ মিনিট পরে প্রথম চাল খেলা শেষ হল৷ আর এক চালের জন্যে তারা ঘুঁটি সাজাচ্ছে, এমন সময়ে বেজে উঠল টেলিফোন৷
রিসিভারটা তুলে নিয়ে জয়ন্ত বললে, ‘হ্যালো?’
-‘আমি সুন্দরবাবু৷’
-‘খবর কী?’
-‘হুম, সব গুলিয়ে গেল৷’
-‘তা তো যাবেই৷’
-‘মানে?’
-‘মানে চন্দ্রনাথের পদচিহ্ন পরীক্ষার ফল সন্তোষজনক হয়নি৷’
-‘কেমন করে জানলে?’
-‘খুব সহজে৷ দুইয়ে দুইয়ে যোগ দিয়ে দেখলুম, চার হল৷’
-‘ধেৎ, হেঁয়ালি ভালো লাগে না! দস্তুরমতো অপদস্থ হয়েছি৷’
-‘ব্যাপারখানা কী?’
-‘ঘটনাস্থলে তৃতীয় ব্যক্তির যে জুতোর ছাপ পাওয়া গিয়েছে, চন্দ্রনাথের জুতোর ছাপের চেয়ে তা বড়ো৷ চন্দুরে রাস্কেলটা আমার মুখের উপরে কলা দেখিয়ে হাড়-জ্বালানো হাসি হাসতে হাসতে চলে গেল৷’
-‘এটুকু তো তিন-চার মিনিটের ব্যাপার৷ আমাকে ফোন করতে আপনার এত দেরি হল কেন?’
-‘হঠাৎ আরও দুটো খবর পেলুম৷ দ্বিতীয় খবরটা বিশেষরূপে উল্লেখযোগ্য৷’
-‘যথা-‘
-‘আমার সহকারী সুনীলকে নন্দলালের পাড়ায় তদন্ত করতে পাঠিয়েছিলুম৷ সে জানালে, ও পাড়ার এক মনিহারি দোকানের মালিক হত্যাকাণ্ডের দিন সন্ধ্যা বেলায় দেখেছিল, নন্দ পথ দিয়ে যাচ্ছে, এমন সময়ে একখানা মোটরগাড়ি তার কাছে এসে থামে৷ গাড়ির ভিতর থেকে মণিমোহন মুখ বাড়িয়ে নন্দকে ডাকে৷ নন্দ গাড়িতে ওঠে, গাড়িখানা চলে যায়৷’
-‘সুন্দরবাবু, আমার আন্দাজের সঙ্গে অনেকটা মিলছে, না?’
-‘তা মিলছে৷’
-‘তারপর?’
-‘গাড়ির ভিতর দুই জন লোক ছিল, মণিমোহন আর চালক৷ দোকানি কিন্তু চালকের দিকে নজর দেয়নি, তাকে শনাক্ত করতে পারবে না৷’
-‘কালো রঙের বুইক সিডান-গাড়ি?’
-‘দোকানি বললে, কালো রঙের সিডান গাড়ি বটে, কিন্তু বুইক কি ফোর্ড কি অস্টিন তা বোঝবার মতো জ্ঞান তার নেই৷’
-‘গাড়ির নম্বর?’
-‘দোকানি দেখেনি৷’
-‘সুন্দরবাবু, এ খবরে এইটুকু জানা গেল, আমার অনুমান নিতান্ত মিথ্যা নয়৷ এর ওপর নির্ভর করে আমরা চন্দ্রনাথের কিছুই করতে পারব না, কিন্তু ধাবমান হতে পারব মণিমোহনের পিছনে৷’
-‘আরও একটা উপায় হয়েছে৷’
-‘কীরকম?’
-‘দ্বিতীয় খবরটা শুনলেই বুঝতে পারবে৷ আমাদের এক চর এসে খবর দিলে, খিদিরপুর ছাড়িয়ে গঙ্গার ধারে একখানা বাগানবাড়ির ভিতরে স্বচক্ষে সে মণিমোহনকে প্রবেশ করতে দেখেছে৷’
-‘কবে?’
-‘আজই ভোর বেলায়৷’
-‘এখন কী করতে চান?’
-‘বাড়িখানাকে চারদিক থেকে পাহারা দেবার জন্য জনকয় লোক পাঠিয়েছি৷ আমি সদলবলে যাত্রা করবার জন্যে প্রস্তুত হচ্ছি৷ তোমারও আসছ তো?’
-‘সেকথা আবার বলতে৷’
ভদ্রেশ্বর ভদ্র
খিদিরপুর৷ গঙ্গার ধার৷ বেলা প্রায় বারোটা, কিন্তু সূর্যকে ঢাকা দিয়ে রেখেছে মেঘলা আকাশ৷ মাঝে মাঝে পৃথিবীকে ধুয়ে দিয়ে যাচ্ছে দু-এক পশলা বৃষ্টি৷
সদলবলে সুন্দরবাবু একখানি বাগানবাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালেন৷ পিছনে পিছনে জয়ন্ত ও মানিক৷
পাঁচিলঘেরা প্রকাণ্ড এক বাগানের মাঝখানে সেকেলে বাড়ি৷ সেকেলে বাড়ি বটে, কিন্তু নিয়মিত সংস্কারের গুণে এখনও অব্যবহার্য হয়ে পড়েনি৷ বাগানের অংশটা নামেই বাগান, কোথাও ফুল গাছের কোনো চিহ্নও নেই৷ মধুলোভী মৌমাছি আর প্রজাপতিরা সেখানে উড়ে আসে বটে, কিন্তু হতাশ হয়ে আবার উড়ে পালায়৷ এখানে-ওখানে দাঁড়িয়ে আছে মোটা মোটা গুঁড়িওয়ালা বুড়ো বুড়ো গাছ-আম, কাঁঠাল, জাম, জামরুল, তাল, নারিকেল প্রভৃতি৷ আর আছে অগুনতি কলা গাছের ভিড়৷ আর শাকসবজির ছোটো-বড়ো খেত৷
মানিক বললে, ‘বাগানের মালিক যে শৌখিন নন, ফুল গাছের অভাবই তা প্রমাণিত করেছে৷ কিন্তু তিনি যে আমাদের সুন্দরবাবুর মতোই উদার পরায়ণ তাতে আর একটুও সন্দেহ নেই৷’
সুন্দরবাবু দুই চক্ষে ফুটল বিস্ফোরণের লক্ষণ৷ গম্ভীর কন্ঠে বললেন, ‘একটুও সন্দেহ না থাকার কারণ?’
-‘এখানে ফুল গাছ নেই, খালি ফল গাছ৷ এখানে শাকসবজির খেতে তেমন সুগন্ধ না থাকতে পারে, রন্ধনশালার মালমশলা আছে যথেষ্ট৷ আপনি কি রন্ধনশালাকে দুনিয়ার সবচেয়ে ভালো জায়গা বলে মনে করেন না?’
সুন্দরবাবু বললেন, ‘আমি তোমার প্রশ্নের উত্তর দিতে চাই না৷ ওই যে জগন্নাথ আসছে৷ আমি এখন ওর সঙ্গেই কথা কইতে চাই৷’
জয়ন্ত শুধোলে, ‘জগন্নাথ কে?’
-‘আমাদের চর৷ সেই-ই তো মণিমোহনকে এই বাড়িতে ঢুকতে দেখেছে৷’
জগন্নাথ কাছে এসে নমস্কার করে বললে, ‘বড়োবাবু মণিমোহন এখনও ওই বাড়ির ভিতরেই আছে৷’
সুন্দরবাবু বললে, ‘দেখো জগন্নাথ, আজ সকালেই এক বেটা চন্দুরে আমাকে যে ঠকানোটা ঠকিয়ে গিয়েছে তা আর বলবার নয়৷ একদিনে আমি দু-দু-বার ঠকতে চাই না৷ তুমি মণিমোহনকে ঠিক দেখেছ তো?’
-‘আজ্ঞে মণিমোহনকে আগে আমি অনেকবার দেখেছি, তার চেহারা কি ভুলতে পারি? তবে আগে তাকে কোনোদিন কোট পরতে দেখিনি, আজ সে কোট পরে আছে৷’
-‘হুম, পুলিশের চোখে ধোঁকা দেবার চেষ্টা আর কি! আরে বাবা, এত সহজে কি পুলিশকে ফাঁকি দেওয়া যায়?’
মানিক বললে, ‘বিশেষ করে আমাদের সুন্দরবাবুকে!’
সে কথা সুন্দরবাবু গায়ে মাখলেন না৷
হঠাৎ জগন্নাথ চমকে চাপা গলায় বলে উঠল, ‘বড়োবাবু, বড়োবাবু, ওই দেখুন মণিমোহনকে৷ আমাদের দিকেই আসছে!’
সুন্দরবাবু তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন, ‘সবাই গাছ কিংবা ঝোপের আড়ালে গা-ঢাকা দাও৷ এত সহজে কেল্লা ফতে! বরাত ভালো!’
মণিমোহন নতমুখে অসংকোচে এগিয়ে এল, কোনো সন্দেহ করতে পারলে না৷ উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ, একহারা কিন্তু বলিষ্ঠ দেহ৷ মুখশ্রীও মন্দ নয়৷
হঠাৎ চারদিক থেকে পুলিশের দল তাকে ঘিরে ফেলল৷ ভ্যাবাচাকা খেয়ে সে দাঁড়িয়ে পড়ল৷
সুন্দরবাবু বললেন, ‘বাবাজি এখন ভিজে বেড়ালের মতো আমাদের সঙ্গে সুড়সুড় করে আসবে কি?’
-‘কোথায়?’
-‘আমাদের পোশাক দেখে বুঝতে পারছ না, আমরা তোমাকে কোথায় নিয়ে যেতে চাই?’
-‘আপনারা তো পুলিশ৷’
-‘আর তুমি তো মণিমোহন বসু?’
-‘আজ্ঞে না, এ নাম আমি জীবনে শুনিনি৷’
জগন্নাথ এগিয়ে এসে বললে, ‘না তুমিই মণিমোহন৷ তোমাকে আমি খুব চিনি৷’
-‘আমার নাম ভদ্রেশ্বর ভদ্র৷’
-‘হুম! আবার নাম ভাঁড়ানো হয়েছে? কিন্তু ও প্যাঁচটা খুবই পুরোনো, ধোপে ট্যাঁকে না৷ ভদ্রেশ্বর ভদ্র৷ কোনো আধুনিক ভদ্রলোকই ওরকম নাম ধারণ করতে পারে না৷ যাক ওকথা৷ এখন আমার প্রশ্নের জবাব দাও দেখি৷ এ বাগানবাড়ির মালিক নিশ্চয়ই তুমি নও?’
-‘না৷ আমি ভাড়াটে৷ বাগানবাড়ির মালিক হচ্ছেন চন্দ্রনাথবাবু৷’
-‘কে?’
-‘বাবু চন্দ্রনাথ রায়৷ তিনি শালখেয় থাকেন৷’
সুন্দরবাবু একটি ছোটোখাটো লাফ মেরে বললেন, ‘শুনছ জয়ন্ত? এখানেও আবার সেই অলুক্ষণে চন্দুরে৷ বাবু ভদ্রেশ্বর, তাহলে তুমি মণিমোহন ছাড়া আর কেউ নও!’
-‘আমি ভদ্রেশ্বর ভদ্র৷’
-‘বেশ তোমার ভদ্রতার দৌড় কত বুঝতে দেরি লাগবে না৷ গাড়িখানা তুমি ভাড়া নিয়েছ কেন?’
-‘আমার মিছরির কারখানা আছে৷ আর আছে আমার এক বন্ধুর মোটরের গ্যারাজ৷ সেখানে মোটর মেরামত হয়৷ আমি তার অংশীদার৷’
-‘তাই নাকি মণিমোহন? তুমি এখন একজন বিজনেসম্যানের ভূমিকায় অভিনয় করতে চাও৷’
মণিমোহন হাসতে লাগল৷
সুন্দরবাবু খেপে গিয়ে বললেন, ‘কে তোমাকে অমন করে হাসতে শিখিয়ে দিলে? আজ সকালে চন্দুরেটাও ঠিক ওইরকম হাড়-জ্বালানো হাসি হেসে আমাকে ঠাট্টা করেছে৷ আর তুমি হাসলেই বা কেন? পুলিশ কি হাস্যকর জীব?’
মণিমোহন বললে, ‘ভদ্রেশ্বরের ঘাড়ে মণিমোহন নাম চাপিয়ে দিলে ভদ্রেশ্বরের হাসি পাবে না কেন?’
-‘তুমি যে মণিমোহন সেটা থানায় গিয়ে আমিই প্রমাণ করে দেব৷ এই বাড়িতে আরও কত লোক আছে?’
মণিমোহন বললে, ‘আজ রবিবার, কারখানা বন্ধ৷ বাড়ির ভিতর ঝি চাকর রাঁধুনি ছাড়া আর কেউ নেই৷’
সুন্দরবাবু তাঁর সহকারী ইন্সপেক্টরকে ডেকে বললেন, ‘তুমি লোকজন নিয়ে খানাতল্লাসি করো৷ বাড়ির ভিতর থেকে কাউকে বাইরে বেরুতে দিয়ো না৷ আর জগন্নাথ-‘
-‘আজ্ঞে!’
-‘তুমি দশ নম্বর বলাই শীল স্ট্রিটে মণিমোহনের বাড়িতে যাও৷ মণির বাবা মহেন্দ্রবাবুকে গিয়ে বলবে তাঁর ছেলেকে পাওয়া গিয়েছে৷ তাঁকে সঙ্গে করে থানায় ফিরে যাবে৷ চলো মণিমোহন, তুমি কত বড়ো ঘুঘু এইবার সেই পরীক্ষাই হবে৷ এসো জয়ন্ত, এসো মানিক!’
মণিমোহন বললে, ‘বেশ মজা তো! কোন অপরাধে আমাকে থানায় নিয়ে যাবেন, তাও আমি জানতে পারব না?’
-‘সব জেনেশুনে ন্যাকা সেজো না মণিমোহন৷ গেল পঁচিশ তারিখে রাত্রি বেলায় গড়ের মাঠে তুমি আর একজন লোকের সঙ্গে নন্দলাল মিত্রকে খুন করেছ৷ ঘটনাস্থলে তোমাদের পায়ের ছাপ পাওয়া গিয়েছে৷’
মণিমোহন আবার হাসতে লাগল৷
-‘ফের হাসছ?’
-‘পুলিশের মুখে রূপকথা শুনলে কার না হাসি পায়?’
-‘রূপকথা মানে?’
-‘কে এই নন্দলাল? ডি.এল. রায়ের হাসির কবিতার সেই বিখ্যাত নন্দলাল নয় তো? কিন্তু কে তাকে খুন করলে? তার কথা পড়ে আমরাই তো হেসে খুন হতুম!’
-‘আবার রসিকতার চেষ্টা হচ্ছে? সেপাই, এই রসিক ব্যক্তিকে আমার গাড়িতে টেনে নিয়ে যাও তো৷’
মণিমোহন বললে, ‘টেনে নিয়ে যেতে হবে না৷ আমি জড়পদার্থ নই, সচল পদযুগলের সাহায্যে নিজেই গাড়িতে গিয়ে উঠতে পারি৷’
-‘তাই চলো তবে৷ এসো জয়ন্ত, এসো মানিক৷’
জয়ন্ত বললে, ‘আমরা যাব না৷ আমরা এখানকার খানাতল্লাসে যোগ দিতে চাই৷’
সুন্দরবাবু বিস্মিত স্বরে বললেন, ‘এ আবার কী শখ?’
-‘শখ নয়, খেয়াল৷ মণিমোহনবাবু, আপনার এখানে ফোন আছে?’
-‘আছে৷ কিন্তু কেন?’
-‘হয়তো ব্যবহার করবার দরকার হবে!’
মণিমোহনের মুখের উপরে ফুটে উঠেই মিলিয়ে গেল একটা দুর্ভাবনার ভাব৷ সে সহজ স্বরেই বললে, ‘বেশ ব্যবহার করবেন৷ তবে কিনা, যথামূল্যে৷’
-‘যথামূল্যে কেন, দ্বিগুণ দিতে রাজি আছি৷ অগ্রিম৷’
-‘পরে পেলে চলবে৷ আপাতত আমি সুন্দরবাবুর দ্বারা পরীক্ষিত হবার জন্যে উৎকন্ঠিত হয়ে উঠেছি৷ আসুন সুন্দরবাবু, অকারণে বিলম্ব করছেন কেন?’
সুন্দরবাবুর মাথা কেমন গুলিয়ে যেতে আরম্ভ করল৷ জয়ন্ত কেন এখানে থাকতে চায়-কাকে সে ফোন করতে চায়? আর মণিমোহনটা কি পাঁড়ঘুঘু রে বাবা, খুনের আসামি হয়েও থানায় যাবার জন্যে পুলিশকেই তাড়া লাগাচ্ছে!
এইসব ভাবতে ভাবতে সুন্দরবাবু প্রস্থান করলেন৷
পরের দৃশ্য থানায়৷ চেয়ারাসীন সুন্দরবাবু৷ দুই জন পাহারাওয়ালার মাঝখানে দণ্ডায়মান মণিমোহন৷
মণিমোহন বললে, ‘পরীক্ষা শুরু করতে আজ্ঞা হোক৷’
-‘হুম, ভারি ব্যস্ত যে! তোমার বাবার জন্যেও একটু অপেক্ষা করতে পাচ্ছ না?’
-‘আমার বাবা?’
-‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, এখনি তোমার বাবা এখানে আসবেন৷’
-‘মশাই কি ভূত নামাতেও জানেন?’
-‘তার মানে?’
-‘আমার বাবা স্বর্গে৷ সেখান থেকে কেমন করে তাঁকে এখানে আনবেন?’
-‘একটু সবুর করলেই দেখতে পাবে৷ না, না, তার আগেও আর একটা পরীক্ষা করা যেতে পারে৷’
-‘করুন মশাই করুন৷ একটা থেকে এক-শোটা পর্যন্ত পরীক্ষা করতে পারেন৷ কিন্তু তার বেশি পরীক্ষা আমি দিতে পারব না৷’
মনে মনে উত্তপ্ত হয়েও সুন্দরবাবু মুখে কিছু বললেন না৷ একটা কাগজের মোড়ক খুলে একজোড়া জুতো বার করে শুধোলেন, ‘এই জুতোজোড়া চিনতে পারো?’
-‘উঁহু৷ আমার জুতো-চেনা ব্যবসা নয়৷ আমি মিছরির ব্যাপারী৷’
-‘ঘটনাস্থলে তোমার পায়ের ছাপ পাওয়া গিয়েছে৷ বাড়ি থেকেই এই জুতো এনেছি-এ জুতো তোমারই৷ একবার জুতো জোড়া পায়ে পরো দেখি!’
মণিমোহন জুতোর ভিতর পা গলাবার চেষ্টা করে বলল, ‘এ জুতো ছোটো৷ এর মধ্যে পা ঢোকানো অসম্ভব!’
সুন্দরবাবু ইঙ্গিতে পাহারাওয়ালা দু-জন মণিমোহনের পায়ে জোর করে জুতো পরাবার চেষ্টা করলে৷ তাদের চেষ্টাও সফল হল না৷
সুন্দরবাবু দুই ভ্রূ সংকুচিত৷ মণিমোহনের কৌতুক-হাস্য৷
ঠিক সেই সময়ে জগন্নাথের সঙ্গে ঘরের ভিতরে প্রবেশ করলেন মণিমোহনের পিতা মহেন্দ্রবাবু৷
অকূলে যেন কূল পেয়ে সুন্দরবাবু শুধোলেন, ‘মহেন্দ্রবাবু একে চেনেন?’
মণিমোহনের দিকে তাকিয়ে মহেন্দ্রবাবুর চোখ উঠল চমকে৷ আরও দুই পা এগিয়ে তার কাছে গিয়ে ভালো করে দেখে তিনি বললেন, ‘না, এঁকে আমি চিনি না!’
-‘এ কি মণিমোহন নয়?’
-‘এঁকে প্রায় মণিমোহনের মতো দেখতে বটে, কিন্তু ইনি আমার পুত্র নন৷’
সুন্দরবাবুর ভুঁড়ি যেন চুপসে গেল ছ্যাঁদা বেলুনের মতো৷ এবং ঠিক সেই সঙ্গেই বেজে উঠল টেলিফোন যন্ত্র৷ বিরক্তিভরে রিসিভারটা তুলে নিয়ে ক্ষীণ কন্ঠে সুন্দরবাবু বললেন, ‘হ্যালো৷’
রিসিভারের ভিতর দিয়ে জয়ন্তের কন্ঠ ভেসে এল-‘জাগ্রত হোন সুন্দরবাবু৷ আসল মণিমোহনকে দেখতে চান তো বায়ুবেগে আবার বাগানবাড়িতে ছুটে আসুন!’
সুন্দরবাবুর চুপসে যাওয়া ভুঁড়ি আবার ফুলে উঠল৷ একসঙ্গে রিসিভার ও চেয়ার ত্যাগ করে তিনি চেঁচিয়ে বলে উঠলেন, ‘সেপাই আসামিকে লক-আপে নিয়ে যাও! এ বেটাও এই ঝাঁকের আর একটা ঘুঘু৷ খুব হুঁশিয়ার!’
সালখের চন্দুরে
মানিক শুধোলে, ‘জয়ন্ত এক যাত্রায় পৃথক ফল হল কেন? আমরাও তো সুন্দরবাবুর সঙ্গেই যেতে পারতুম৷’
-‘যেতে তো পারতুমই, কিন্তু যাওয়া আর হল কই?’
-‘তুমি কি নতুন কোনো সূত্র আবিষ্কার করতে পেরেছ?’
-‘কিছুই আবিষ্কার করতে পারিনি৷’
-‘তবে?’
-‘মনে একটা সন্দেহ জাগছে!’
-‘কী সন্দেহ?’
-‘মণিমোহন স্বেচ্ছায় ধরা দিলে কেন?’
-‘স্বেচ্ছায়?’
-‘নিশ্চয়৷ সে খুনের মামলার পলাতক আসামি৷ এ বাড়িতে টেলিফোন আছে৷ তার বন্ধু চন্দ্রনাথ পুলিশের কার্যকলাপের কথা নিশ্চয় তাকে জানিয়েছে৷ এ সময়ে তার কতটা সাবধান হয়ে থাকবার কথা৷ তুমি কি বিশ্বাস কর, দিনের বেলায় বাগানের ভিতরে সদলবলে পুলিশের আবির্ভাব হল আর অতি জাগ্রত খুনের আসামি মণিমোহন তা জানতে পারেনি? অম্লান বদনে ভেড়ার মতো সুড়সুড় করে এসে সে আত্মসমর্পণ করলে! কেবলই কি আত্মসমর্পণ? তাড়াতাড়ি থানায় যাওয়ার জন্যে তার বিপুল আগ্রহও লক্ষ করলে তো?’
-‘হ্যাঁ৷ কিন্তু তুমি কী বলতে চাও?’
-‘এসব অস্বাভাবিক ব্যাপার৷ আমার দৃঢ় ধারণা, মণিমোহনের ইচ্ছা ছিল তাকে গ্রেপ্তার করেই আমরা এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাই৷’
-‘এমন অদ্ভুত ইচ্ছা তার হবে কেন?’
-‘সে জানে, পুলিশ গ্রেপ্তার করেও তাকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হবে৷’
-‘ধেৎ, তাও কি সম্ভব৷ চন্দ্রনাথের কাছ থেকে সে নিশ্চয়ই শুনেছে পুলিশের কাছে তার পায়ের ছাপ আছে৷’
-‘খুব সম্ভব তার জুতোর সঙ্গে সে ছাপ মিলবে না!’
-‘কী যে বলছ জয়ন্ত!’
-‘খুব সম্ভব সে মণিমোহন নয়, অন্য কেউ!’
-‘তুমি পাগল হয়ে গেলে নাকি? পুলিশের চর জগন্নাথ আগে থাকতেই মণিমোহনকে চেনে৷ সে নিজে তাকে শনাক্ত করেছে৷’
-‘সে মণিমোহন হলে কিছুতেই যেচে ধরা দিত না৷ যে খুনের আসামি পুলিশের ভয়ে লুকিয়ে থাকে, সে কখনো হাসতে হাসতে ধরা দেয়? অসম্ভব মানিক অসম্ভব!’
-‘কিন্তু জগন্নাথ তাকে শনাক্ত করেছে৷’
-‘সে মণিমোহন নয় বটে, কিন্তু হয়তো প্রায় মণিমোহনেরই মতো দেখতে!’
মানিক বিস্ময়ে হতবাক৷
জয়ন্ত বললে, ‘এ ছাড়া এমন ব্যাপারের আর কোনো অর্থই হয় না৷ এই বাড়ির ভিতর নিশ্চয় কোনো রহস্য আছে, তাই জাল মণিমোহন আমাদের বিপথে চালনা করে এই বাড়ি থেকে দূরে নিয়ে যেতে চায়৷’
-‘কিন্তু সুন্দরবাবু বিপথগামী হলেও এখনও আমরা যথাস্থানেই বর্তমান আছি৷’
-‘হ্যাঁ মানিক৷ রহস্যভেদের ভার গ্রহণ করব আমরাই৷’
-‘কেমন করে?’
-‘তা জানি না৷ ওই যে সাবইনস্পেকটর পরেশবাবু আমাদের দিকেই আসছেন৷ ওঁর মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে খানাতল্লাসির ফল সন্তোষজনক হয়নি৷ . . . কী পরেশবাবু কতখানি অগ্রসর হলেন?’
পরেশবাবু হতাশভাবে বললেন, ‘অগ্রসর কী মশাই! এখন আমাদের সুন্দরবাবুর পশ্চাদগামী হতে হবে৷’
-‘খানাতল্লাস করে সন্দেহজনক কিছুই পেলেন না বুঝি?’
-‘কিছু না, কিছু না৷’
-‘তাই থানায় ফিরে যেতে চান?’
-‘তা ছাড়া আর কী! এখানে বসে আর অশ্বডিম্বে তা দিয়ে কী হবে? এর চেয়ে বাড়িতে ফিরে ভ্যারেন্ডা ভাজা ভালো৷’
-‘বাড়ির লোকজনদের পরীক্ষা করেছেন?’
-‘করেছি৷ লোকজন তো ভারি! দুটো বেহারি চাকর, একটা উড়িয়া বামুন, একটা বুড়ি, আর একটা ছুঁড়ি ঝি৷ ছুঁড়িটা দেশ থেকে নতুন এসেছে৷ এত লজ্জা যে কথা কইবে কী, মুখের ঘোমটা খুলতেও নারাজ৷’
-‘আপনার লোকজন কোথায়?’
-‘তাদের গাড়িতে বসতে বলে আমি আপনাদের ডাকতে এসেছি৷’
জয়ন্ত হঠাৎ সক্রোধে গর্জন করে উঠল, ‘পরেশবাবু!’
মানিক চমকে উঠল৷ জয়ন্ত তো সহজে এমন বিচলিত হয় না৷ পরেশও হতভম্ব!
-‘পরেশবাবু, আপনি অত্যন্ত অন্যায় করেছেন-এসো মানিক, শিগগির৷ মানিকের হাত ধরে টেনে জয়ন্ত দ্রুতপদে অগ্রসর হল এবং যেতে যেতে মুখ ফিরিয়ে পরেশবাবুকে বলে গেল, ‘তাড়াতাড়ি বাড়ির চারদিকে আবার পাহারা বসান৷’
পরেশবাবু মাথা চুলকাতে চুলকাতে নিজের মনেই বললেন, ‘বড়োবাবু বলেন জয়ন্তবাবুর মাথায় ছিট আছে! কথাটা মিথ্যা নয়৷ শখের গোয়েন্দা হয়ে কিনা আসল পুলিশকে ধমক দেয়! কী আর করব, বড়োবাবুই ওকে মাথায় তুলেছেন৷’
জয়ন্ত ও মানিক বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করল৷ কয়েক পদ অগ্রসর হয়ে দেখল, দালান ও উঠান এবং দালানের কোণে দ্বিতলে ওঠবার সিঁড়ি৷
সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে তারা দোতলার দালানের উপরে গিয়ে দাঁড়াল৷ দালানের একপাশে দাঁড়িয়ে কয়েকজন স্ত্রী-পুরুষ জটলা করছিল৷ তাদের দেখেই তারা একেবারে চুপ মেরে গেল৷ একটি অল্পবয়স্ক স্ত্রীলোক তাড়াতাড়ি মুখে ঘোমটা টেনে দিয়ে জড়োসড়ো হয়ে রইল৷
প্রায় মিনিট খানেক স্তব্ধভাবে দাঁড়িয়ে থেকে জয়ন্ত বললে, ‘তোমাদের কেউ একবার এদিকে এগিয়ে এসো তো!’
একটা বুড়ি এগিয়ে এল পায়ে পায়ে৷
জয়ন্ত শুধাল, ‘তুমি কে?’
-‘আমি এ বাড়ির পুরানো ঝি৷’
-‘তোমার নাম কী?’
-‘ভালোর মা৷’
-‘আর ওই মেয়েটি?’
-‘ও আমাদের নতুন ঝি৷ দিন তিনেক হল দেশ থেকে এসেছে৷’
-‘হ্যাঁগো বাছা নতুন ঝি, তোমার নাম কী?’
সে ফিসফিস করে কী বললে শোনা গেল না৷
ভালোর মা বললে, ‘ওর নজ্জা বাবু৷ ওর নাম হরিদাসী৷’
-‘আচ্ছা ভালোর মা, তোমাদের টেলিফোন আছে কোন ঘরে?’
ভালোর মা দেখিয়ে দিলে অঙ্গুলি নির্দেশে সিঁড়ির ডান পাশে টেলিফোনের ঘর৷
-‘দেখো ভালোর মা, তোমরা সবাই এইখানে দাঁড়িয়ে থাকো৷ আমি টেলিফোনের কাজ সেরে তোমাদের সঙ্গে কথা কইব৷’
জয়ন্তের সঙ্গে মানিক টেলিফোনের ঘরে গেল৷ পাঠকদের নিশ্চয় মনে আছে, জয়ন্ত সুন্দরবাবুকে এই কথাই জানিয়ে দিলে যে-জাগ্রত হোন সুন্দরবাবু! আসল মণিমোহনকে দেখতে চান তো বায়ুবেগে আবার বাগানবাড়িতে ছুটে আসুন৷
মানিক বিস্মিত কন্ঠে বললে, ‘কোথায় আছে আসল মণিমোহন?’
-‘এই বাড়িতেই৷’
-‘তাকে তুমি দেখেছ?’
-‘হ্যাঁ, তুমিও দেখবে এসো৷’
দু-জনে আবার দালানে গিয়ে উপস্থিত৷ ভালোর মা প্রভৃতি তখনও দাঁড়িয়ে আছে৷
তাদের উপরে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে জয়ন্ত বললে, ‘ভালোর মা, তোমাদের সকলকেই আমি এইখানেই হাজির থাকতে বললুম না৷’
-‘আমরা তো হাজির আছি বাবু৷’
-‘কিন্তু হরিদাসী কোথায়?’
-‘সেও আছে৷’
-‘কোথায় আছে? আমি তাকে দেখতে পাচ্ছি না কেন?’
-‘সে বাসন মাজতে গিয়েছে৷’
-‘কোথায়? কলতলায়?’
-‘না, খিড়কির পুকুরে৷’
-‘তোমাদের আবার খিড়কির পুকুর আছে বুঝি? কিন্তু কোন দিক দিয়ে সে গেল? ফোন করতে করতে আমি সিঁড়ির উপরে চোখ রেখেছিলাম, ওখান দিয়ে কেউ যায়নি৷’
-‘আমাদের অন্দরমহলে আর একটা সিঁড়ি আছে৷’
জয়ন্তের মুখে ফুটে উঠল দারুণ হতাশা, কিন্তু সহজ স্বরেই সে বললে, ‘আমাকে খিড়কির পুকুরে নিয়ে চলো৷’
ছোটো একটা পুকুর৷ নোংরা জল৷ ভাঙা ঘাট৷ চারপাশেই আগাছার ভিড়৷ কিন্তু সেখানেও হরিদাসীর পাত্তা মিলল না৷
জয়ন্ত কঠিন স্বরে বললে, ‘এরপর তুমি কী বলতে চাও ভালোর মা?’
ভালোর মা ভয়ে ভয়ে বললে, ‘কী জানি বাবু, আমি কিছুই বুঝতে পারছি না!’
জয়ন্ত তিক্ত স্বরে বললে, ‘দেখছ মানিক, নিরেট পরেশটা বাড়ির চারিদিকে এখনও পাহারা বসায়নি? সে-ই হচ্ছে যত অনিষ্টের মূল৷ তার উপরে নির্ভর করেই আমি হরিদাসীকে ছেড়ে ফোন করতে গিয়েছিলাম৷’
-‘কিন্তু হরিদাসী কে?’
-‘সে কথার জবাব একটু পরে দেব৷ আপাতত ভালোর মাকে তোমার জিম্মায় রেখে আমি একটু উদ্যান-ভ্রমণ করে আসি৷’
জয়ন্ত চলে গেল দ্রুতপদে৷
অনতিবিলম্বে ব্যস্তভাবে এসেই সুন্দরবাবু বলে উঠলেন, ‘মানিক, তুমি একা কেন?’
-‘জয়ন্ত উদ্যান-ভ্রমণে গিয়েছে৷’
-‘এই কি উদ্যান-ভ্রমণের সময়? কোথায় তোমাদের আসল মণিমোহন?’
-‘ওই যে জয়ন্ত আসছে, ওকেই জিজ্ঞাসা করুন৷’
-‘জয়ন্ত, মণিমোহন কোথায়?’
একখানা শাড়ি আর একটা সেমিজ মাটির উপর নিক্ষেপ করে জয়ন্ত বললে, ‘জামাকাপড় আমাদের উপহার দিয়ে মণিমোহন এখান থেকে প্রস্থান করেছে৷’
-‘আরে হুম! এ তো দেখছি স্ত্রীলোকের জামাকাপড়!’
-‘হ্যাঁ সুন্দরবাবু, মণিমোহন স্ত্রীলোকের ছদ্মবেশেই বাড়ির ভিতরে লুকিয়েছিল৷ তারপর নারীর খোলস ত্যাগ করে বাগানের পাঁচিল ডিঙিয়ে লম্বা দিয়েছে৷ এর জন্য দায়ী হচ্ছেন আপনাদের পরেশবাবু৷ তিনি সেপাইদের সরিয়ে নিয়ে না গেলে এ বিপত্তি ঘটত না৷’
রাগে ফুলতে ফুলতে সুন্দরবাবু বললেন, ‘বটে, বটে! আচ্ছা, তার সঙ্গে পরে বোঝাপড়া করব৷ কিন্তু তুমি মণিমোহনকে চিনতে পারলে কেমন করে?’
জয়ন্ত বললে, ‘মণিমোহন এখানে দাসী হরিদাসী সেজেছিল৷ সে নাকি পাড়াগেঁয়ে মেয়ে, সবে কলকাতায় এসেছে, এখনও লজ্জা ভাঙেনি, বাইরের লোক দেখলেই ঘোমটা টেনে বোবা হয়ে থাকে৷ আমাদের দেখে ও চট করে ঘোমটা টেনে দিলে, আমিও কিন্তু তার আগেই চট করে হরিদাসীর মুখ দেখে নিলুম৷ সে মুখ হরিদাসীর মুখ নয় দেখতে প্রায় ভদ্রেশ্বর ভদ্রের মতো৷’
সুন্দরবাবু বললেন, ‘মহেন্দ্রবাবু বললেন, ভদ্রেশ্বরের মুখ নাকি প্রায় তাঁর ছেলে মণিমোহনেরই মতো দেখতে৷ এইজন্যেই জগন্নাথ তাকে মণিমোহন বলে ভ্রম করে আমাদের নাকানিচোবানি খাইয়ে মেরেছে৷’
-‘হ্যাঁ সুন্দরবাবু, জগন্নাথের ভ্রমের কথা আমি আগেই আন্দাজ করতে পেরেছিলাম৷ হরিদাসীর পুরুষের দ্বিতীয় প্রমাণ পেলুম তার পা লক্ষ করে৷ জানেন তো অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অনাবৃত পা দেখলেই খুব সহজেই ধরা যায় যে, কে নারী আর কে নয়? তার উপরে হরিদাসীর আঙুলে আর গোড়ালিতে ছিল বড়ো বড়ো কড়া৷ পাড়াগেঁয়ে গরিবের মেয়ে জুতো পরে না, পায়ে কড়া পড়বে কেন? সে কথা কয় ফিসফিস করে, এও সন্দেহজনক৷ লজ্জার ছুতো বাজে, সে নিজের পুরুষ কন্ঠ চাপা দিতে চায়৷ সুন্দরবাবু, আপনার সহকারী পরেশবাবু নিশ্চয় খুব হুঁশিয়ার ব্যক্তি নয়, নইলে এতগুলো প্রমাণ তাঁর নজর এড়িয়ে যায়?’
সুন্দরবাবু দুঃখিতভাবে মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন, ‘সবই আমার অদৃষ্ট ভাই! জাল ছিঁড়ে মাছ পালিয়ে যাবে বারবার! তার উপরে দেখো না, মন বলছে, শালখের ওই চন্দুরে বেটাই হচ্ছে এই দলের মোড়ল, অথচ তার বিরুদ্ধে একটা প্রমাণও জোগাড় করতে পারছি না৷’
জয়ন্ত মুখ টিপে একটু হেসে বললে, ‘বিলাতি প্রবাদে বলে, শয়তানের কথা ভাবলেই শয়তানের উদয় হয়! ওই দেখুন কে আসছে!’
সুন্দরবাবু ফিরে বিস্ফারিত চক্ষে দেখলেন হাতের মোটা লাঠিগাছা ঘোরাতে ঘোরাতে, হেলতে হেলতে, দুলতে দুলতে এবং হাসতে হাসতে এগিয়ে আসছে শালিখার চন্দ্রনাথ রায়৷
দু-জন বেপরোয়া লোক
আগতপ্রায় চন্দ্রনাথের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে মাথা চুলকোতে চুলকোতে সুন্দরবাবু বললেন, ‘হুম!’
চট করে কী ভেবে জয়ন্ত তাড়াতাড়ি বলে উঠল, ‘সুন্দরবাবু, হুম বলে থ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকবেন না৷ শিগগির বাড়ির ভিতর যান৷’
-‘কেন বলো দেখি? চন্দুরের ভয়ে?’
-‘ভয়ে নয়, আপনাকে থানায় একটা ফোন করতে হবে৷’
-‘কী জন্যে?’
-‘সেপাইদের জিম্মায় ভদ্রেশ্বরকে একবার এখানে নিয়ে আসুন, আমি তাকে গুটি কয় প্রশ্ন করব৷’
-‘উত্তম৷’
-‘দাঁড়ান৷ আর একটা কথা৷ সেই সঙ্গে মণিমোহনের জুতোর ছাঁচও পাঠিয়ে দিতে বলবেন৷’
-‘এখানে? কেন হে?’
-‘সেকথা বলবার সময় নেই৷ ওই চন্দ্রনাথ এসে পড়েছে৷’
সুন্দরবাবুর প্রস্থান৷ চন্দ্রনাথ বুক ফুলিয়ে কাছে এসে দাঁড়াল৷ মুখ টিপে হাসতে হাসতে শুধোলে, ‘সুন্দরবাবু সরে পড়লেন কেন? আমার চন্দ্রবদন দেখতে রাজি নন?’
মানিক হেসে বললে, ‘মশাই কি নিজের বদনকে চন্দ্রবদন বলে সন্দেহ করেন?’
চন্দ্রনাথ আরও জোরে হেসে উঠে বললে, ‘না মশাই, তা করি না৷ পিতার ভ্রমে নামেই আমি চন্দ্রনাথ৷ আর সত্য কথা বলতে কী, চন্দ্রবদনের মালিক হলে আমি সুখী হতুম না৷’
-‘দুঃখিত হতেন?’
-‘ঠিক তাই৷ পূর্ণচন্দ্রের বদন আকাশেই মানায়৷ ওরকম অখণ্ড-মণ্ডলাকার বদন কোনো মানুষকেই সুখী করতে পারে না৷ যাক সে কথা৷ এখন আপনারা কে বলুন দেখি, মানিকজোড়ের মতো সর্বদাই সুন্দরবাবুর আশেপাশে বিরাজ করেন?’
-‘ঠিক ধরেছেন৷ আমার নাম মানিকই বটে, আর জয়ন্তও আমার জোড়াই বটে৷’
-‘নাম তো শুনলুম, এখন পরিচয়টাও দিতে আজ্ঞা হয়৷’
-‘ওই সুন্দরবাবু আসছেন৷ আমাদের পরিচয় ওর মুখেই শুনতে পাবেন৷’
কিন্তু সুন্দরবাবুর কাছ থেকে জয়ন্ত ও মানিকের পরিচয় জানবার জন্য চন্দ্রনাথ কোনো আগ্রহই প্রকাশ করলে না৷ হাত জোড় করে নমস্কার করে যেন ব্যঙ্গর স্বরেই বললে, ‘আসুন সুন্দরবাবু৷’
অনিচ্ছাসত্ত্বেও প্রতিনমস্কার করে সুন্দরবাবু অপ্রসন্ন স্বরে বললেন, ‘হুম, এই আমি এসেছি৷ কিন্তু আপনি এখানে এসেছেন কেন?’
-‘কী আশ্চর্য প্রশ্ন!’
-‘আশ্চর্য প্রশ্ন?’
-‘কেবল আশ্চর্য নয়, যুক্তিহীন প্রশ্ন৷’
-‘মানে?’
-‘আমি এখানে আসব না তো, আসবে কে? আপনি বোধ হয় জানেন না, এ বাড়ির মালিক হচ্ছি আমি৷’
-‘খুব জানি বাবা, খুব জানি! আর জানি বলেই তো আজ আপনাকে আমি গ্রেপ্তার করব৷’
-‘গ্রেপ্তার করবেন? আমি এই বাড়ির মালিক বলে আমাকে আপনি গ্রেপ্তার করবেন?’
-‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, হ্যাঁ!’
-‘না, না, না৷ বাড়ির মালিক হওয়াও অপরাধ নাকি?’
-‘যে বাড়ির ভিতরে খুনি আসামি আশ্রয় পায়, তার মালিক হওয়া অপরাধ বই কী!’
-‘কে খুনি আসামি?’
-‘আপনার সাঙাত মণিমোহন৷’
-‘তার সঙ্গে এ বাড়ির সম্পর্ক কী?’
-‘সে এখানে ছদ্মবেশে লুকিয়েছিল৷’
-‘আমি একথা বিশ্বাস করি না৷ আর একথা সত্য হলেও আপনি আমাকে গ্রেপ্তার করতে পারেন না৷’
-‘পারি না নাকি!’
-‘না৷ আমি এই বাড়ির মালিক বটে, কিন্তু এখানা ভাড়া দিয়েছি ভদ্রেশ্বরবাবুকে৷ আজ তাঁর কাছে আমি ভাড়ার টাকা আদায় করতে এসেছি৷ ভদ্রেশ্বরবাবুর বাড়ির ভিতর কে থাকে, তার কোনো খবরই আমি রাখি না৷ কোন আইন অনুসারে আপনি আমাকে গ্রেপ্তার করবেন? চুপ করে রইলেন কেন, বলুন? কোন আইন আনুসারে আপনি আমাকে গ্রেপ্তার করবেন সুন্দরবাবু? এখনও বোবা হয়ে রইলেন? হা হা হা হা! গ্রেপ্তার করবেন! গ্রেপ্তার করলেই হল!’
সুন্দরবাবুর হতাশ ভাব৷ অসহায়ের মতো তিনি তাকালেন জয়ন্তের মুখের পানে৷
জয়ন্ত বললে, ‘না চন্দ্রবাবু, আপনাকে কেউ গ্রেপ্তার করতে পারে না, সুন্দরবাবু বলেছিলেন কথার কথা মাত্র৷ ওকথায় আপনি কান দেবেন না৷ ওই দেখুন আর একখানা জিপগাড়ি বাগানের ভিতরে এসে দাঁড়াল৷ গাড়ি থেকে কে নামছে? ভদ্রেশ্বরবাবু না?’
সুন্দরবাবুর মুখ কিঞ্চিৎ উজ্জ্বল হয়ে উঠল৷ কিন্তু ওদিকে তাকিয়ে অনুচ্চস্বরে তিনি বললেন, ‘ভদ্রেশ্বর বেটাও আসছে ঠিক চন্দুরের মতো বুক ফুলিয়ে বেপরোয়াভাবে৷ এমন দু-জন বেপরোয়া লোককে সচরাচর একসঙ্গে দেখা যায় না৷ এ আমি কোথায় এসে পড়েছি বাবা!’
কাছে এসে একগাল হেসে ভদ্রেশ্বর বললে, ‘আরে সুন্দরবাবু! মশাই, এত তাড়াতাড়ি আপনি যে আমাকে বাসায় ফিরতে দেবেন, আমি ভাবতেই পারিনি৷ তারপর? আপাতত এদিককার খবর সব ভালো তো?’
সুন্দরবাবু গুম হয়ে গিয়ে বললেন, ‘মোটেই ভালো নয়-অন্তত তোমার পক্ষে৷’
ভদ্রেশ্বর চক্ষু বিস্ফারিত করে যেন সভয়েই বললে, ‘অ্যাঁ, বলেন কী! খবর আমার বিপক্ষে?’
-‘হুম তাই৷ খবর তোমার বিপক্ষেই বটে৷’
-‘হায় হায়! কেন এমনটা হল?’
-‘তুমি খুনি আসামি মণিমোহনকে এই বাড়ির ভিতরে লুকিয়ে রেখেছিলে৷’
-‘বটে, বটে, বটে! মণিমোহন নামধেয় সেই কাল্পনিক ব্যক্তিটি এখনও আপনার ঘাড় ছেড়ে নামতে রাজি হয়নি? একটু আগেই আমি ছিলুম মণিমোহন৷ এখন স্থির করেছেন, মণিমোহন এই বাড়ির ভিতরে লুকিয়ে আছে৷’
-‘না, এখন সে বাড়ির ভিতর নেই৷ সে লম্বা দিয়েছে৷’
-‘আপনার চোখে ধুলো দিয়ে?’
-‘এ জন্যেও তুমি দায়ী! মণিমোহনের সঙ্গে তোমার চেহারার খানিকটা মিল আছে৷ সেই সুযোগ গ্রহণ করে তুমি যদি আমাকে ভুলিয়ে এখান থেকে সরিয়ে না নিয়ে যেতে, তাহলে মণিমোহন কখনোই পালাতে পারত না৷’
-‘যত দোষ নন্দ ঘোষ৷ মশাই, আমার আর রূপকথা শোনবার বয়েস নেই৷ পথ দেখুন কিংবা পথ ছাড়ুন৷ আমাকে বাড়ির ভিতরে যেতে দিন৷’
-‘বাড়ির ভিতরে যাবে মানে! মামার বাড়ির আবদার নাকি! তোমাকে আমাদের সঙ্গে আবার থানায় যেতে হবে৷’
-‘কেন?’
-‘কতবার বলব? খুনি আসামিকে তুমি লুকিয়ে রেখেছিলে৷’
-‘কোথায় সে? প্রমাণ দেখান৷’
-‘সে এখানে হরিদাসী নাম নিয়ে স্ত্রীলোকের ছদ্মবেশে লুকিয়ে ছিল৷’
ভদ্রেশ্বর আগে হা-হা করে খুব খানিকটা হেসে নিলে৷ তারপর বললে, ‘বাহবা! মণিমোহন আগে ছিল শ্রীমান ভদ্রেশ্বর, কিন্তু এখন সে হয়েছে শ্রীমতি হরিদাসী? চমৎকার! মশাই গাঁজা-টাজা খান না তো?’
-‘চোপরাও বদমাইশ!’
-‘মোটেই চুপ করব না৷ হরিদাসীকে আগে এখানে নিয়ে আসুন৷’
-‘পুলিশ দেখে সে পালিয়ে গিয়েছে কেন?’
-‘পালিয়ে গিয়েছে বলেই ধরে নিতে হবে সে স্ত্রীলোক নয় পুরুষ, হরিদাসী নয়, মণিমোহন? এটা কোন দেশের যুক্তি? হরিদাসী পাড়াগেঁয়ে ভীতু মেয়ে, নতুন শহরে এসেছে, পুলিশ দেখে সে তো ভয়ে পালিয়ে যাবেই৷’
সুন্দরবাবুর অবস্থা আবার অসহায় হয়ে পড়ল৷ জয়ন্তকে একটু তফাতে নিয়ে গিয়ে নিম্নস্বরে বললে, ‘ভায়া, যেমন ওই চন্দুরেটা, তেমনি এই ভদ্রেশ্বর-দু-বেটাই মাছের মতো পিছল, ধরলেও হাত ছাড়িয়ে পালিয়ে যায়৷ তোমার কথাতেই ওকে এখানে নিয়ে এসেছি, এখন তুমিই ওর মুখ বন্ধ করার ব্যবস্থা করো৷’
জয়ন্ত বললে, ‘বেশ তাই করছি৷ আমি আর একবার বাড়ির ভিতরে যাব৷ ততক্ষণে আপনি মণিমোহনের জুতোর ছাঁচ গাড়ি থেকে আনিয়ে রাখুন৷ এসো মানিক৷’
দোতলার দালানে দাস-দাসীরা তখনও দাঁড়িয়েছিল৷
জয়ন্ত বললে, ‘হ্যাঁ ভালোর মা, হরিদাসী কি রাতে তোমার সঙ্গেই শুত?’
ভালোর মা বললে, ‘না বাবু, সে শুত একলা অন্য ঘরে৷’
-‘বেশ, সে ঘরখানা একবার আমরা দেখতে চাই৷’
ভালোর মা তাদের ভিতরে মহলে নিয়ে গিয়ে একখানা ঘর দেখিয়ে দিল৷
ঘরের ভিতরে ঢুকে মানিক বললে, ‘জয়ন্ত, কী উদ্দেশ্যে তুমি এ ঘরখানা দেখতে চাও?’
জয়ন্ত বললে, ‘মানিক, কায়ার পিছনে ছায়ার মতো কেবল আমার সঙ্গে সঙ্গে থেকে কোনোই লাভ নেই৷ যা স্বচক্ষে দেখছ আর স্বকর্ণে শুনছ, তা নিয়ে তোমারও স্বাধীন চিন্তাশক্তি ব্যবহার করা উচিত৷ এ ঘরে যে একবার আমাদের আসতেই হবে, আমি তা আগে থাকতেই জানতুম৷ আর সেই জন্যেই থানা থেকে মণিমোহনের পদচিহ্নের ছাঁচ এখানে আনিয়ে রেখেছি৷’
মানিক বললে, ‘তুমি কি এই ঘরের মেঝেতে মণিমোহনের নতুন পদচিহ্ন আবিষ্কার করতে চাও?’
-‘সে চেষ্টা বোধ হয় সফল হবে না৷’
-‘তবে?’
-‘হরিদাসী যে পুরুষ, এটা আমার সন্দেহ মাত্র৷ কিন্তু আসল প্রশ্ন হচ্ছে, পুরুষ হলেও সে সত্য সত্যই মণিমোহন কি না? এই ঘরে এই প্রশ্নের উত্তর পাবার সম্ভাবনা আছে৷’
-‘যুক্তিটা মাথায় ঢুকছে না৷’
-‘নিরেটদের মাথায় পেরেকও ঢোকে না৷ সুন্দরবাবুর সঙ্গগুণে তুমি একটি নিরেট হয়ে উঠছ৷ নির্বোধ, হরিদাসী যদি ছদ্মবেশী পুরুষ হয় তাহলে এই ঘরে নিশ্চয়ই তার পুরুষ বেশ ধারণের উপকরণ খুঁজে পাওয়া যাবে৷ পুলিশের ভয়ে তাড়াতাড়ি পালাবার সময়ে সেগুলো যে সে নিয়ে যেতে পারেনি, তাতে আর কোনোই সন্দেহ নেই৷ হ্যাঁ, যা ভেবেছি তাই৷ টেবিলের উপরে রয়েছে রুপোর সিগারেট কেস আর দেশলাই৷ আলনায় দু-খানা শাড়ি, একটা সেমিজ আর একটা ব্লাউজ ঝুলছে বটে, কিন্তু সেই সঙ্গে রয়েছে দু-খানা ধুতি আর দুটো পাঞ্জাবিও৷ মানিক, হরিদাসী পুরুষই বটে!’
মানিক বললে, ‘কিন্তু সে মণিমোহন কি না?’
সিগারেট কেসটা টেবিলের উপর থেকে তুলে নিয়ে মানিকের সামনে ধরে জয়ন্ত বললে, ‘দেখো৷ এর উপরে ইংরাজিতে খোদা রয়েছে এম৷ ওটা মণিমোহনের নামের আদ্যঅক্ষর বলে গ্রহণ করা যেতে পারে কি না?’
মানিক সায় দিয়ে বললে, ‘হ্যাঁ, এটা একটা বড়ো প্রমাণ৷’
এদিক-ওদিক ঘোরাঘুরি করে ও এটা-ওটা-সেটা নিয়ে নাড়ানাড়ি করতে করতে জয়ন্ত বললে, ‘তবু আমি যা খুঁজছি তা পাচ্ছি না৷ তারপর হেঁট হয়ে পড়ে খাটের তলায় দৃষ্টিচালনা করে জয়ন্ত উৎফুল্ল কন্ঠে বলে উঠল ‘পেয়েছি মানিক, পেয়েছি৷’
-‘কী?’
-‘খাটের তলায় রয়েছে একজোড়া জুতা৷ ব্যাস, আপাতত আমাদের খোঁজাখুঁজি শেষ৷ মানিক, জুতো জোড়া খাটের তলা থেকে টেনে নিয়ে আমার সঙ্গে চলে এসো৷’
বাগানে নেমে এসে তারা দেখলে, ভদ্রেশ্বর তখনও সুন্দরবাবুর সঙ্গে কথা কাটাকাটি করছে এবং চন্দ্রনাথ আপনমনে পায়চারি করছে সম্পূর্ণ নির্লিপ্তভাবেই৷
সুন্দরবাবু অধীর স্বরে বললেন, ‘ভাই জয়ন্ত, এই ঠোঁটকাটা ভদ্রেশ্বরের লেকচার আর আমি সহ্য করতে পারছি না৷ এর মুখ বন্ধ করবার কোনো উপায় পেয়েছ কি?’
মৃদু হাস্য করে জয়ন্ত বললে, ‘বোধ হয় পেয়েছি! মণিমোহনের জুতোর ছাঁচ কোথায়?’
-‘এই যে ভাই, এই যে৷’
খিলখিল করে হেসে উঠে ভদ্রেশ্বর বললে, ‘আবার ওই ছাঁচের সঙ্গে আমার জুতো মেলানো হবে নাকি?’
জয়ন্ত বললে, ‘মোটেই নয়৷ মণিমোহনের জুতোর ছাঁচের সঙ্গে আমি এই জুতো জোড়া মিলিয়ে দেখব৷’
ভদ্রেশ্বর সন্দিগ্ধ কন্ঠে বললে, ‘ও কার জুতো?’
ছাঁচের সঙ্গে জুতো মেলাতে মেলাতে জয়ন্ত বললে, ‘বাঃ, অবিকল মিলে যাচ্ছে৷ হ্যাঁ, এ হচ্ছে মণিমোহনের জুতো, পাওয়া গিয়েছে হরিদাসীর ঘরে৷’
সুন্দরবাবু সহর্ষে এবং সদম্ভে বলে উঠলেন, ‘হুম! হুম! বার বার ঘুঘু তুমি খেয়ে যাও ধান-‘
চন্দ্রনাথ সহসা বললে, ‘ভদ্রেশ্বরবাবু এখন আমি চললুম৷ ভাড়ার টাকার জন্যে পরে আর একদিন দেখা করব৷ -সে হনহন করে ফটকের দিকে এগিয়ে চলল৷’
সুন্দরবাবু ব্যস্ত হয়ে বললেন, ‘আরে গেল, চন্দুরেটা পালায় যে!’
জয়ন্ত বললে, ‘ওকে যেতে দিন সুন্দরবাবু! চন্দ্রনাথকে গ্রেপ্তার করতে পারি এমন কোনো প্রমাণ আমাদের হাতে নেই৷’
ভদ্রেশ্বর বললে, ‘আপনারা আমাকেও গ্রেপ্তার করতে পারেন না৷’
জয়ন্ত হাসতে হাসতে বললে, ‘মণিমোহনের জুতো আবিষ্কারের পরেও!’
-‘ও জুতো নিশ্চয়ই হরিদাসীর ঘরে ছিল না৷ এসব হচ্ছে পুলিশের কারসাজি৷’
ভদ্রেশ্বরকে সজোরে একটা ধাক্কা মেরে সুন্দরবাবু বললেন, ‘পাজি, ছুঁচো! এখনও বকবকানি! চুপটি মেরে থানায় চল, তোর যা বলবার আদালতে গিয়ে বলবি!’
আচম্বিতে গুড়ুম করে একটা শব্দ হল এবং সঙ্গেসঙ্গে জয়ন্ত দুই হাতে নিজের বুক চেপে ধরে মাটির উপরে বসে পড়ল৷
পকেট বুকের মহিমা
সুন্দরবাবু প্রথমটা হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে রইলেন, তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে ব্যস্তভাবে জয়ন্তর দিকে ছুটে গেলেন৷ মানিক তার আগেই জয়ন্তের কাছে গিয়ে হাজির হয়েছে৷
সুন্দরবাবু বললেন, ‘জয়ন্ত, জয়ন্ত তোমার কোথায় লাগল?’
জয়ন্ত টপ করে উঠে পড়ে একটুখানি হেসে বললে, ‘বুকে৷’
-‘অ্যাঁ, বল কী? বুকে গুলি লেগেছে, আর তুমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাসছ!’
-‘কান্নার চেয়ে হাসিই আমি পছন্দ করি৷’
-‘না, ঠাট্টা রাখো৷ দেখি কোথায় লেগেছে?’
-‘এই যে বাঁ-দিকের বুকপকেটের উপরে৷’
সুন্দরবাবু দুই চক্ষু বিস্ফারিত করে সভয়ে বলে উঠলেন, ‘ও বাবা, এ যে একেবারে মোক্ষম আঘাত! গুলি পকেট ছ্যাঁদা করে ভিতরে চলে গিয়েছে৷’
মানিক উদ্বিগ্ন কন্ঠে বললে, ‘জয়ন্ত কী করে তুমি এখনও পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছ? চলো, আমরা হাসপাতালে নিয়ে যাই৷’
জয়ন্ত মাথা নেড়ে বললে, ‘না৷’
-‘না মানে?’
-‘না মানে, না৷ হাসপাতালে যাব না৷’
-‘সে কী হে?’
-‘বন্ধু শিকারির লক্ষ্য অব্যর্থ বটে, কিন্তু সে লক্ষ্যভেদ করতে পারেনি৷’
সুন্দরবাবু ভ্যাবাচাকা খেয়ে বললেন, ‘হুম, ও আবার কীরকম কথা?’
জয়ন্ত বুকপকেট থেকে একখানা হৃষ্টপুষ্ট পকেট বই বার করে বললে, ‘দেখুন৷’
-‘কী দেখব?’
-‘আততায়ীর বুলেট জামার পকেট ভেদ করে পকেট বইয়ের মলাট আর অনেকগুলো পাতা ফুঁড়ে আর বেশি এগুতে পারেনি৷ আমি অক্ষত, আপনি নিশ্চিন্ত হোন৷’
মানিক উৎফুল্ল কন্ঠে বললে, ‘জয়ন্ত, ভগবানই তোমাকে বাঁচিয়েছেন৷’
-‘হ্যাঁ ভাই৷ কিন্তু কেবল আমাকে নয়, গত মহাযুদ্ধের সময়ে ভগবান এই উপায়ে বহু সৈনিকেরই প্রাণরক্ষা করেছেন৷’
সুন্দরবাবু খানিকক্ষণ চমৎকৃতের মতো নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন৷ তারপর যেন নিজের মনেই বললেন, ‘আশ্চর্য ব্যাপার!’
মানিক চারিদিকে তাকাতে তাকাতে বললে, ‘কিন্তু বন্দুক ছুড়লে কে?’
দু-জন পাহারাওয়ালার মাঝখানে এতক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়েছিল ভদ্রেশ্বর৷ সে মুখ টিপে হেসে বললে, ‘বন্দুকটা যে আমি ছুড়িনি অন্তত এ সম্বন্ধে আপনাদের নিশ্চয়ই কোনো সন্দেহ নেই?’
সুন্দরবাবু ধমক দিয়ে বলে উঠলেন, ‘এই চোপ! বন্দুক তুই না ছুড়ে থাকিস তোর স্যাঙাত ছুড়েছে!’
-‘আমার স্যাঙাত?’
-‘হ্যাঁ হ্যাঁ, সেই পাজি ছুঁচো উল্লুক মণিমোহন বেটা!’
-‘সুন্দরবাবু আপনাদের মণিমোহন পাজি কি না জানি না, কিন্তু সে একসঙ্গেই ছুচো আর উল্লুক হতে পারে না৷ ওরা হচ্ছে দু-জাতের দু-রকম জীব৷’
-‘চোপরাও, চোপরাও! তাহলে ছুঁচো হচ্ছিস তুই আর উল্লুক হচ্ছে মণিমোহন৷’
-‘মহাশয়, আর একবার ভ্রম সংশোধন করবার আজ্ঞা হোক৷’
-‘ভ্রম সংশোধন?’
-‘আজ্ঞে হ্যাঁ৷ মণিমোহন উল্লুক কি না জানি না কিন্তু আমি যে ছুঁচো নই-এ বিষয়ে আপনারা সকলে একমত হতে বাধ্য৷ আমি মানুষ৷’
-‘হুম, হুম! তোর মতো বক্কেশ্বর জীবনে আমি আর দেখিনি৷ তুই যদি ফের বকবক করিস তাহলে তোর দুই গালে মারব দুই থাবড়া!’
অতি বিনীত ভাবে মাথা কাত করে ভদ্রেশ্বর বললে, ‘দয়াময় এই আমি গাল পেতে দিলাম৷ থাবড়া মারবেন তো অনুগ্রহ করে ঝটিতে এগিয়ে আসুন৷’
সুন্দরবাবু হার মেনে ভদ্রেশ্বরের দিকে পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে রুদ্ধ ক্রোধে ফুলতে লাগলেন৷
ভদ্রেশ্বর তবু নাছোড়বান্দা৷ টিটকারি দিয়ে বললে, ‘বেশি ফুলবেন না মশায়, আপনার দোদুল্যমান ভুঁড়ির অসুখ হতে পারে৷’
সুন্দরবাবু আর পারলেন না, গর্জন করে বলে উঠলেন, ‘সেপাই সেপাই! ভদ্দুরেটাকে টানতে টানতে বাগানের বাইরে নিয়ে যাও৷ একেবারে গাড়িতে নিয়ে গিয়ে তোলো গে৷’
ভদ্রেশ্বর বললে, ‘টানাটানি হানাহানির দরকার নেই বাবা! সেপাই অগ্রসর হও! আমি পোষ-মানা ভেড়ার মতো তোমাদের সঙ্গে কুইক মার্চ করব৷’
ভদ্রেশ্বর বিদায় হলে পর জয়ন্ত বললে, ‘সুন্দরবাবু, তাহলে আপনার বিশ্বাস, মণিমোহন আমার প্রতি গুলি নিক্ষেপ করেছে?’
-‘সে নয় তো আর কে এ কাজ করতে পারে? বেটা নিশ্চয়ই আড়ালে আড়ালে কোথায় লুকিয়ে আছে৷ আমার ভয় হচ্ছে, সে যদি আবার গুলি ছোড়ে?’
জয়ন্ত বললে, ‘আমি ফটকের দিকে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম৷ গুলিটা এসেছে ওই দিকের কোনো ঝোপঝাড় থেকেই৷’
-‘তাই নাকি, তাই নাকি? তাহলে তো এমনি এদিকটা ভালো করে খুঁজে দেখতে হয়৷’
-‘হ্যাঁ, তাই দেখুন৷ বাগানের বাইরে পুলিশের কড়া পাহারা আছে, আততায়ী নিশ্চয়ই এখনও বাগান থেকে বেরিয়ে যেতে পারেনি৷’
হঠাৎ সুন্দরবাবু একেবারে থ৷ দূরে দেখা গেল, মোটা লাঠিগাছা ঘোরাতে ঘোরাতে ফটকের দিকে হনহন করে এগিয়ে যাচ্ছে চন্দ্রনাথ৷
মানিক সবিস্ময়ে বললে, ‘চন্দ্রনাথ এখনও বাগানের ভিতরে কী করছে?’
সুন্দরবাবু চিৎকার করে নিজের সহকারীকে ডেকে বললেন, ‘পরেশ! লোকজন নিয়ে দৌড়ে যাও, চন্দুরেকে আমার কাছে টেনে নিয়ে এসো৷’
অনতিবিলম্বে পাহারাওয়ালাদের সঙ্গে চন্দ্রনাথের পুনরাগমন৷ তার চেহারায় ভয়-সংকোচের চিহ্নমাত্র নেই, ভাবভঙ্গি অতীব সপ্রতিভ৷
সুন্দরবাবু রুক্ষ স্বরে শুধোলেন, ‘আপনি এতক্ষণ ওখানে কী করছিলেন?’
-‘হাওয়া খাচ্ছিলুম না নিশ্চয়ই৷’
-‘স্পষ্টাস্পষ্টি জবাব দিন৷ আপনি এতক্ষণ ওখানে কী করছিলেন?’
-‘হঠাৎ শ্রবণ করলুম বন্দুকের শব্দ৷ পরমুহূর্তে দর্শন করলুম আপনার বন্ধুর পতন৷ তাই শুনে আর দেখে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ব্যাপারটা কী তলিয়ে বোঝবার চেষ্টা করছিলুম৷ সেটাও কি বে-আইনি?’
সুন্দরবাবু বুলেটবিদ্ধ পকেট বইখানা চন্দ্রনাথের সামনে ধরে বললেন, ‘দেখুন৷’
-‘দেখছি৷’
-‘এই পকেট বই আজ জয়ন্তকে বাঁচিয়েছে৷’
-‘বুঝছি৷’
-‘এইবার আমরা আপনার জামাকাপড় খুঁজে দেখব৷’
-‘কেন?’
-‘দেখব, জামাকাপড়ের মধ্যে আপনি কোনো আগ্নেয়াস্ত্র লুকিয়ে রেখেছেন কি না?’
-‘কীরকম আগ্নেয়াস্ত্র? রাইফেল?’
-‘জামাকাপড়ের ভিতরে রাইফেল লুকিয়ে রাখা চলে না৷’
-‘তবে কী খুঁজতে চান? রিভলবার?’
-‘ধরুন তাই৷’
-‘কিন্তু যে বুলেট দেখালেন, ওটা তো রাইফেলের বুলেট? কোনো ছোটো আকারের রাইফেলের বুলেট৷’
-‘তবু খুঁজে দেখব৷’
-‘দেখুন৷’
খোঁজাখুঁজি ব্যর্থ৷ বিপদজনক কিছুই পাওয়া গেল না৷
সুন্দরবাবু বললেন, ‘পরেশ, লোকজন নিয়ে ফটকের ওই দিকে যাও৷ ঝোপঝাড় খুঁজে রিভলবার-টিভলবার কিছু পাও কি না, দেখো৷’
সদলবলে পরেশের প্রস্থান৷
চন্দ্রনাথ হেসে বললে, ‘পাওয়া গেছে রাইফেলের বুলেট, আপনি খুঁজছেন রিভলবার৷’
-‘রাইফেলও পেতে পারি৷’
-‘আপনার অন্বেষণ সফল হলে খুশি হব৷’
-‘আপনার হাতে অমন মোটা লাঠি কেন?’
-‘আমার শখ৷’
-‘ওরকম শখ ভালো নয়৷ ভবিষ্যতে রোগা লাঠি নিয়ে আমার সামনে আসবেন৷’
-‘উপদেশের জন্যে ধন্যবাদ৷’
খানিক পরে পরেশ ফিরে এসে জানালে, কোথাও কোনোরকম আগ্নেয়াস্ত্রের সন্ধান মিলল না৷
চন্দ্রনাথ সকৌতুকে বললে, ‘তাহলে সুন্দরবাবু অঃতপর আমি সসম্মানে বিদায় গ্রহণ করতে পারি?’
-‘হুম!’
-‘নমস্কার!’
সুন্দরবাবু প্রতি নমস্কার করলেন না৷ চন্দ্রনাথ চলে গেল৷
সুন্দরবাবু বললেন, ‘ভাই জয়ন্ত, এই চন্দুরে আর ওই ভদ্দুরেটা দেখছি আমাকে সাত ঘাটের জল না খাইয়ে ছাড়বে না৷’
জয়ন্ত বললে, ‘খাওয়ায় যদি তো খেতে হবে৷ আপাতত কী করবেন?’
-‘আরও ভালো করে খানাতল্লাসি করে দেখি, মণিমোহন কোথাও ঘুপটি মেরে আছে কি না৷’
-‘আমি আর মানিক এইবার প্রস্থান করতে চাই৷’
পরদিন প্রভাতে বেজে উঠল জয়ন্তের টেলিফোন ঘণ্টা৷
রিসিভার নিয়ে জয়ন্ত বলল, ‘হ্যালো?’
-‘আমি সুন্দরবাবু৷’
-‘আপনার কন্ঠস্বর উত্তেজিত কেন?’
-‘আবার খুন! আবার চুরি-যে-সে চুরি নয়, নগদ পঞ্চাশ হাজার টাকা আর ত্রিশ হাজার টাকার জড়োয়া গয়না উধাও! আবার পদচিহ্ন!’
-‘পদচিহ্ন?’
-‘হ্যাঁ, মণিমোহন আর সেই অজ্ঞাত ব্যক্তির পদচিহ্ন-যাকে আমরা কোথাও খুঁজে পাচ্ছি না৷ তুমি শীঘ্র এসো৷’
-‘আপনি কোথায়?’
-‘ঘটনাস্থলে৷’
-‘ঠিকানা?’
-‘সাতাশ নম্বর সতীশ বসু স্ট্রিট৷’
অপরিচিতের সুপরিচিতের পদচিহ্ন
সাতাশ নম্বর সতীশ বসু স্ট্রিট৷ নতুন ঘটনাস্থল৷ একখানা রেলিং ঘেরা মাঝারি আকারের বাড়ি৷ ফটক পার হলেই পাওয়া যায় খানিকটা খোলা জমি৷ এইখানে কয়েকজন পুলিশ-কর্মচারী ও অন্যান্য লোকের সঙ্গে চেয়ার পেতে বসেছিলেন সুন্দরবাবু৷
জয়ন্ত ও মানিকের আবির্ভাব৷
সুন্দরবাবু বললেন, ‘এসো ভায়া এসো৷ আগে গোড়ার কথা শুনবে, না একেবারেই বাড়ির ভিতরে যাবে?’
জয়ন্ত বললে, ‘আগে গৌরচন্দ্রিকাটা হয়ে যাওয়াই ভালো৷’
-‘হুম, উত্তম৷ এই বাড়ির মালিকের নাম রামময় মন্ডল৷ লোহার ব্যাপারী, ধনী ব্যক্তি, স্ট্র্যান্ড রোডে গদি৷ সংসার খুব বড়ো নয়-স্ত্রী, দুই মেয়ে, এক ছেলে ও এক ভাই৷ বহুদিন রোগ-ভোগের পর স্ত্রীর দেহ ভেঙে যাওয়াতে ডাক্তাররা বায়ু পরিবর্তনের পরামর্শ দেন৷ কাজের চাপের জন্যে রামবাবু নিজে কলকাতা ছাড়তে পারেননি, ছোটো ভাইয়ের সঙ্গে পরিবারবর্গকে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন শিমুলতলায়৷ হঠাৎ পরশু রাত্রে তাঁর ভাইয়ের কাছ থেকে এক টেলিগ্রাম আসে: বউদি মৃত্যুশয্যায়৷ অবিলম্বে চলে এসো৷ কিন্তু টেলিগ্রাম পাবার পর ট্রেন ছিল না বলে রামবাবু পরশু রাত্রে শিমুলতলায় যেতে পারেননি৷ তিনি গতকল্য সকালের ট্রেনে কলকাতা ত্যাগ করেছেন বাড়ির অতি পুরাতন ও অতি বিশ্বস্ত কর্মচারী দ্বিজদাসের জিম্মায় রেখে৷’
বাধা দিয়ে জয়ন্ত শুধোলে, ‘দ্বিজদাস ছাড়া বাড়ির ভিতরে আর কেউ ছিল না?’
-‘ছিল৷ তিন জন বেয়ারা আর দুই জন দ্বারবান৷ বাড়িখানায় দুটো মহল-সদর আর অন্দর৷ বেয়ারা আর দারোয়ানের ঘর সদরের একতলায়৷ দ্বিজদাস ছিল অন্দরের দোতলার একখানা ঘরে-রামবাবুর শয়নগৃহের ঠিক পাশেই৷ আজ সকালে দেখা যায়, দোতলার বারান্দার উপরে পড়ে আছে দ্বিজদাসের মৃতদেহ, কে তার বুকের উপরে ছোরার আঘাত করেছে৷ রামবাবুর ঘরের দরজার কুলুপ ভাঙা, ঘরের ভিতরকার লোহার সিন্দুক থেকে অদৃশ্য হয়েছে নগদ পঞ্চাশ হাজার টাকা আর ত্রিশ হাজার টাকার জড়োয়া গয়না৷’
-‘অত টাকা ব্যাঙ্কে জমা না দিয়ে বাড়ির ভিতরে রাখা হয়েছিল কেন?’
-‘টাকাটা রামবাবুর হাতে এসেছিল পরশু বৈকালেই৷ রাত্রে টেলিগ্রাম পেয়ে রামবাবু দুশ্চিন্তায় পাগলের মতন হয়ে যান৷ কাল সকালে উঠেই তাঁকে তাড়াতাড়ি স্টেশনে ছুটতে হয়েছিল বলে তিনি টাকার কোনো ব্যবস্থা করে যেতে পারেননি৷’
-‘অপরাধীরা কি দলে ভারী ছিল?’
-‘জানি না৷ তবে পদচিহ্ন পেয়েছি দুই জনের৷ ফোনেই তো বলেছি, দুই পদচিহ্নই আমাদের পরিচিত৷ এক চিহ্নের মালিক মণিমোহন, অন্য চিহ্নের মালিক আজও অজ্ঞাতবাস করছে৷’
-‘তারা বাড়ির ভিতরে ঢুকল কেমন করে?’
-‘খিড়কির দরজা দিয়ে৷’
-‘ওখানকার দরজা কি বন্ধ ছিল না?’
-‘ছিল বলেই তো শুনেছি৷’
-‘তবে?’
জয়ন্তের কাছে এসে সুন্দরবাবু তার কানে কানে বললেন, ‘বাড়ির ভিতরে নিশ্চয়ই অপরাধীদের সহকারী আছে৷ হয়তো কোনো দারোয়ান বা বেয়ারা! সে খোঁজ পরে নেওয়া যাবে৷ আপাতত তাদের সবাইকে নজরবন্দি করে রাখা হয়েছে৷’
-‘আপনার গৌরচন্দ্রিকা শেষ হল?’
-‘আর একটু বাকি আছে৷ কিন্তু সে যে একটু নয়, দস্তুরমতো গুরুতর একটু৷’
-‘অর্থাৎ?’
-‘মিনিট পঁচিশ আগে আজ শিমুলতলা থেকে দ্বিজদাসের নামে রামবাবুর এই জরুরি টেলিগ্রাম এসেছে৷ পড়ে দেখো৷’
টেলিগ্রামখানা নিয়ে জয়ন্ত পাঠ করলে: স্ত্রীর পীড়ার সংবাদ মিথ্যে৷তাঁর স্বাস্থ্য যথেষ্ট উন্নত৷ অবিলম্বেই কলকাতায় ফিরে যাচ্ছি৷
জয়ন্ত মৌন মুখে ভাবছে, সুন্দরবাবু বললেন, ‘রামবাবুকে কলকাতা থেকে যথাসময়ে সরাবার জন্যে কেউ তাকে মিথ্যে ভয় দেখিয়ে টেলিগ্রাম করেছিল৷ কে সে! নিশ্চয়ই অপরাধীদের কেউ?’
জয়ন্ত বললে, ‘আপনার অনুমানই সত্য বলে মনে হচ্ছে৷ দেখছি অপরাধীরা রীতিমতো আটঘাট বেঁধে কার্যক্ষেত্রে অবতীর্ণ হয়েছে৷’
সুন্দরবাবু অগ্রসর হয়ে বললেন, ‘এইবারে বাড়ির ভিতরে চলো৷’
প্রথমেই তারা গিয়ে ঢুকল রামবাবুর শয়নগৃহে৷ যার ভিতর থেকে টাকা ও গহনা চুরি গিয়েছে সেটা লোহার সিন্দুক নয়, স্টিলের আলমারি৷
আলমারিটা পরীক্ষা করে জয়ন্ত বললে, ‘বেশ বোঝা যাচ্ছে, অপরাধীরা কাজ করে আধুনিক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে৷ তারা নিশ্চয়ই সঙ্গে করে এনেছিল একটা পোর্টেবেল অক্সিজেন ট্যাঙ্ক, আগুনের শিখায় ইস্পাত গলিয়ে আলমারির পাল্লা খুলে ফেলা হয়েছে৷’
সুন্দরবাবু বললেন, ‘একেবারে ঝানু অপরাধী৷ এত কাণ্ডকারখানার মধ্যে কোথাও আধখানা আঙুলের ছাপ পর্যন্ত রেখে যায়নি৷’
মানিক একটু বিস্মিত স্বরে বললে, ‘অথচ আপনি বলছেন, তারা তাদের পায়ের ছাপ রেখে গিয়েছে৷’
-‘ছাপ বলে ছাপ! স্পষ্ট ছাপ৷’
জয়ন্ত মাথা নাড়তে নাড়তে বললে, ‘বড়োই সন্দেহজনক, বড়োই সন্দেহজনক!’
-‘সন্দেহজনক? কেন?’
-‘কেন তা জানি না৷ এখন বাইরে চলুন৷’
বারান্দায় পড়েছিল রক্তাক্ত কাপড় দিয়ে ঢাকা একটা মূর্তি৷ হতভাগ্য দ্বিজদাসের মৃতদেহ৷ কাপড় সরিয়ে দেহটার উপরে দৃষ্টিপাত করে জয়ন্ত বললে, ‘বেশ বোঝা যাচ্ছে ছোরার এক আঘাতেই ভদ্রলোক মারা পড়েছেন৷’
সুন্দরবাবু বললে, ‘বিয়োগান্ত দৃশ্যের কতকটা আমি আন্দাজ করতে পারছি৷ খুব সম্ভব অপরাধীরা যখন রামবাবুর ঘরের দরজা খোলবার চেষ্টা করছিল, সেই সময়ে দ্বিজদাসের ঘুম ভেঙে যায়৷ তিনি ব্যাপার কী জানবার জন্যে তাড়াতাড়ি নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন আর সঙ্গেসঙ্গেই আক্রান্ত হন৷
জয়ন্ত দুই পা এগিয়ে বললে, ‘এই পদচিহ্নগুলোর কথাই বলছেন?’
-‘হ্যাঁ৷’
ছয় জোড়া পদচিহ্ন তার মধ্যে তিন জোড়া খুব স্পষ্ট৷ দুই জন লোকের কর্দমাক্ত জুতোর ছাপ৷ চিহ্নগুলো আরম্ভ হয়েছে বারান্দার একটা নর্দমার কাছ থেকে৷
হেঁট হয়ে দেখতে দেখতে জয়ন্ত বললে, ‘সুন্দরবাবু, গতকল্য রাত্রে এ অঞ্চলে কি বৃষ্টি পড়েছিল?’
-‘নিশ্চয়ই নয়৷’
-‘আজ সকালের কাগজে আমি আবহাওয়ার রিপোর্ট দেখেছি৷ কাল কলকাতার কোথাও একফোঁটা বৃষ্টিও হয়নি৷’
-‘হয়নি তো হয়নি৷ তা নিয়ে তোমার মাথা ব্যথা কেন?’
-‘মাথা থাকলেই মাথার ব্যথা হওয়া সম্ভব৷’
-‘তার মানে তুমি বলতে চাও, আমার মাথা থেকেও নেই?’
-‘আমি ওসব কিছুই বলতে চাই না৷ আমি খালি এই কথাই আপনাকে মনে করিয়ে দিতে চাই যে, আগুন না থাকলে যেমন ধোঁয়া দেখা যায় না, তেমনি জল না পড়লে মানুষের জুতোও কর্দমাক্ত হয় না৷’
চমৎকৃতভাবে সুন্দরবাবু কেবলমাত্র উচ্চারণ করলেন-‘হুম৷’
জয়ন্ত বললে, ‘বাড়ির কোনো বেয়ারাকে ডাকুন৷’
একজন বেয়ারা হাজির হল৷
জয়ন্ত শুধোলে, ‘নর্দমার কাছে দেখছি একটা মগ আর একটা খালি বালতি রয়েছে৷’
বেয়ারা বললে, ‘আজ্ঞে, ব্যবহার করবার জন্যে সবসময়েই জলভরা বালতি থাকে৷’
-‘কাল রাত্রেও ছিল?’
-‘আজ্ঞে হ্যাঁ হুজুর৷ কাল সন্ধ্যের সময়ে আমি নিজের হাতে জল-ভরা বালতি রেখে গিয়েছি৷’
-‘কিন্তু বালতিতে জল নেই৷’
-‘তাহলে কাল রাতে কারুর জলের দরকার হয়েছিল৷’
-‘আচ্ছা, তুমি যাও৷ সুন্দরবাবু৷’
-‘কী ভাই?’
-‘নর্দমার কাছটা পরীক্ষা করে দেখুন৷ এখানে রয়েছে পাতলা কাদার প্রলেপ৷’
-‘এ থেকে কী বুঝব?’
-‘এই পদচিহ্নগুলো হচ্ছে প্রদর্শনীর জন্যে৷’
-‘প্রদর্শনী?’
-‘হ্যাঁ৷ অপরাধীরা এই পদচিহ্নগুলো আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখাতে চায়৷’
-‘কারণ?’
-‘কারণ বোঝবার চেষ্টা করুন আপনি৷ এসো মানিক, এখানে আমাদের আর কোনো কাজ নেই৷’
জয়ন্ত ও মানিকের একসঙ্গে প্রস্থান৷ সুন্দরবাবু হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মাথার টাক চুলকাতে লাগলেন৷
পরের দিন সকাল বেলায় মানিক এসে দেখলে, কী যেন ভাবতে ভাবতে জয়ন্ত তার পুস্তকাগারের মেঝের উপরে পদচারণা করছে৷
মানিক বললে, ‘তোমার মুখ দেখে বোধ হচ্ছে তুমি যেন কিছু মনে করবার চেষ্টা করছ কিন্তু মনে করতে পারছ না!’
-‘ঠিক তাই৷ একখানা বইয়ের নাম কিছুতেই স্মরণে আসছে না৷’
-‘কীরকম বই?’
-‘সেইটেই তো প্রশ্ন৷ বইখানা কিনে পড়েছিলুম অনেক দিন আগে৷ আর একটা বিশেষ ঘটনার কথাও মনে আছে৷ কিন্তু বইখানার নাম মনে আনতে পারছি না বলে বুঝতে পারছি না, ঘটনাটা কাল্পনিক না সত্য কাহিনি৷’
-‘ঘটনাটা কাল্পনিক হলে কিছু ক্ষতি আছে?’
-‘আছে বই কী, খুব আছে৷ সেটা কাল্পনিক ঘটনা হলে আমার অনুমানও অমূলক বলে প্রমাণিত হবে৷’
-‘অনুমানটা কী শুনতে পাই না?’
-‘ভদ্রেশ্বরের বাগানে আমার প্রতি নিক্ষিপ্ত বুলেটটা এসেছিল কীরকম আগ্নেয়াস্ত্রের ভিতর থেকে, সেইটেই আমি বোঝবার চেষ্টা করছি৷’
মানিক অত্যন্ত বিস্মিত হল, কিন্তু মুখে কিছু বললে না৷ জয়ন্ত বইয়ের আলমারিগুলোর ভিতরে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিপাত করতে করতে বারংবার এদিক-ওদিক আনাগোনা করতে লাগল৷ মানিক একখানা চেয়ারের উপর বসে সেদিনের খবরের কাগজখানা টেনে নিলে৷ এইভাবে কেটে গেল প্রায় বিশ মিনিট৷ হঠাৎ জয়ন্ত সানন্দে চিৎকার করে বলে উঠল, ‘পেয়েছি!’
-‘কী পেয়েছ হে?’
-‘সেই বইখানা৷’
-‘কী বই?’
-‘জোসেফ গোলাম সাহেবের, মাস্টার ম্যানহান্টার্স-অর্থাৎ ওস্তাদ মনুষ্যশিকারি৷ বইখানা প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ১০২৬ খৃষ্টাব্দে৷’
-‘ওখানা কি উপন্যাস?’
-‘মোটেই নয়! ওর আগাগোড়াই আছে কেবল সত্য ঘটনার পর সত্য ঘটনা৷ দস্তুরমতো অপরাধ বিজ্ঞানের বই, কাল্পনিক কথা একটাও নেই৷’
-‘তাহলে তোমার অনুমান ভুল নয়?’
-‘খুব সম্ভব তাই৷’
-‘কীরকম আগ্নেয়াস্ত্র থেকে তোমাকে গুলি করা হয়েছিল?’
জয়ন্ত জবাব দেবার আগেই বেজে উঠল টেলিফোনের ঘণ্টা৷
-‘হ্যালো! . . . আরে, আজ সকালেও ফোনে সুন্দরবাবু! ব্যাপার কী? এখনি আমাকে আপনার কাছে ছুটতে হবে? কেন? কাল রাত্রেও আবার একটা নরহত্যা হয়েছে? অ্যাঁ-কে খুন হয়েছে বললেন? এবারে স্বয়ং মণিমোহন? এবারের ঘটনাস্থলেও সেই পরিচিত পদচিহ্ন পাওয়া গিয়েছে৷ আচ্ছা, আমরা এখনি যাচ্ছি৷’
সুপরিচিত অপরিচিত
তখন মর্গে স্থানান্তরিত হয়েছিল মণিমোহনের দেহ৷ জয়ন্ত ও মানিককে নিয়ে সুন্দরবাবু সেইখানে গিয়ে হাজির হলেন৷
জয়ন্ত চমৎকৃত হয়ে লক্ষ করলে, ভদ্রেশ্বরের সঙ্গে মণিমোহনের আকৃতিগত সাদৃশ্য৷ একরকম দীর্ঘতা, একরকম গঠন এবং প্রায় একরকম মুখ-চোখ-নাক৷ কেবল ভদ্রেশ্বরের জোড়া ভ্রূ, মণিমোহনের জোড়া নয়৷ ভদ্রেশ্বরের চেয়ে মণিমোহনের রং একটু বেশি ফরসা৷ এবং মণিমোহনের চেয়ে ভদ্রেশ্বরের কপাল বেশি প্রশস্ত, কিন্তু এই অল্পস্বল্প পার্থক্য চেষ্টা করলে খুব সহজেই ঢেকে ফেলা যায়৷
জয়ন্ত বললে, ‘দেখছি মণিমোহন মারা পড়েছে ছোরার আঘাতে৷’
সুন্দরবাবু বললেন, ‘হ্যাঁ, ঠিক বুকের উপরে মোক্ষম আঘাত৷ ডাক্তারের মতে, আঘাতের সঙ্গেসঙ্গেই মৃত্যু হয়েছে, মণিমোহন হয়তো ছটফট করবারও সময় পায়নি!’
-‘কোন সময়ে এর মৃত্যু হয়েছে, ডাক্তার সে সম্বন্ধে কোনো মত প্রকাশ করেছেন কি?’
-‘ডাক্তারি হিসাবে প্রকাশ, মণিমোহনের মৃত্যু হয়েছে অন্তত গতকাল সন্ধ্যার আগে৷’
-‘মৃতদেহ পাওয়া গিয়েছে কখন?’
-‘আজ ভোর বেলায়৷’
-‘আপনার মুখে শুনলাম, বালির কাছে গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোডের পাশে একটা সরু গলির ভিতরে মৃতদেহটা পাওয়া গিয়েছে৷ সে কীরকম গলি? সেখান দিয়ে কি লোক-চলাচল হয় না?’
-‘একথা জিজ্ঞাসা করছ কেন?’
-‘কাল সন্ধ্যার আগে খুন হয়েছে অথচ লাশ পাওয়া গেছে আজ সকালে৷ জায়গাটা নিশ্চয়ই অত্যন্ত নির্জন৷’
-‘না, জায়গাটা মোটেই নির্জন নয়৷ স্থানীয় লোকেরা বলে, কাল রাত দুপুরেও গলির ভিতরে লাশ-টাশ কিছুই ছিল না৷’
-‘তাহলে মণিমোহন মারা পড়েছে অন্য কোনো জায়গায়৷ হত্যার অনেক পরে, গভীর রাতে তার দেহটা ওই গলির ভিতরে ফেলে দিয়ে যাওয়া হয়েছে৷’
-‘জয়ন্ত, আগে আমিও ওই সন্দেহ করতে পারিনি৷ আমি ভেবেছিলাম খুনটা হয়েছে ওই গলিতেই৷ কিন্তু তারপর ডাক্তারের রিপোর্ট পেয়ে মত পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়েছি৷ কিন্তু-কিন্তু’, বলতে বলতে সুন্দরবাবু ভুরু কুঁচকে মাথা চুলকোতে লাগলেন৷
-‘থামলেন কেন? ভাবছেন কী?’
-‘হুম! আমি ভাই একেবারেই কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গিয়েছি৷’
-‘কেন?’
-‘সন্ধ্যার আগেই যদি মণিমোহনের মৃত্যু হয়ে থাকে, তবে রাত বারোটার পরেও তার মৃতদেহ থেকে কি রক্তের ধারা বইতে পারে?’
-‘আপনার কথার অর্থ কী?’
-‘মৃতদেহ যেখানে পাওয়া গিয়েছে সেখানকার মাটি ভিজে গিয়েছে রক্তের ধারায়৷’
মুখ টিপে হেসে জয়ন্ত বললে, ‘না, অতক্ষণ পরে মৃতদেহ থেকে রক্ত বেরুতে পারে না৷’
-‘তবে! ডাক্তার কি ভুল রিপোর্ট দিয়েছেন?’
-‘উঁহু, সম্ভবত ডাক্তার ভুল করেননি৷ সুন্দরবাবু, আমি আর একটা ব্যাপার আন্দাজ করতে পারছি৷’
-‘কী আন্দাজ?’
-‘ফোনে আমাকে বললেন না, ঘটনাস্থলে পাওয়া গিয়েছে সেই নিরুদ্দেশ অপরিচিত ব্যক্তির সুপরিচিত পদচিহ্ন৷’
-‘হ্যাঁ৷ সেই পদচিহ্নগুলো-‘
-‘পাওয়া গিয়েছে রক্তমাখা মাটির উপরে? কেমন এই তো?’
চরম বিস্ময়ে চক্ষু বিস্ফারিত করে সুন্দরবাবু বলে উঠলেন, ‘কী আশ্চর্য, কেমন করে জানলে তুমি?’
-‘বললুম তো আন্দাজে৷’
-‘এ কীরকম আন্দাজ বাবা? এ যে মন্ত্রশক্তিকে হার মানায়!’
-‘আমার আন্দাজ প্রায়ই সত্য হয়ে দাঁড়ায়! কারণ যুক্তি থেকেই তার উৎপত্তি৷’
-‘ধন্য ভায়া৷ দাদা হয়েও তোমার পায়ে গড় করতে ইচ্ছে হচ্ছে! আচ্ছা, এখন কী করবে? ঘটনাস্থলটা একবার দেখে আসবে নাকি?’
-‘না সুন্দরবাবু, প্রয়োজন নেই৷ আমি মনে মনে মামলাটা প্রায় সম্পূর্ণ করে ফেলেছি, কেবল একটু তদন্ত বাকি আছে৷ বিলম্বে কার্যহানির সম্ভাবনা, শুভস্য শীঘ্রম৷’
-‘আমাকে কী করতে বল?’
-‘জনকয়েক লোক নিয়ে এখনি আমার সঙ্গে চলুন৷’
-‘কোথায় হে?’
-‘এখনি দেখতে পাবেন৷’
জয়ন্তের নির্দেশে পুলিশের জিপগাড়ি এসে থামল শালিখার চন্দ্রনাথ রায়ের বাড়ির সামনে৷
সবিস্ময়ে সুন্দরবাবু শুধোলেন, ‘জয়ন্ত তুমি কি চন্দুরের কাছেই এসেছ?’
-‘হ্যাঁ৷’
-‘তুমি কি ওর বিরুদ্ধে নতুন কোনো প্রমাণ পেয়েছ?’
-‘কোনো প্রমাণই পাইনি৷’
-‘তবে?’
-‘আমি চন্দ্রনাথের সঙ্গে কিছুক্ষণ আলাপ-আলোচনা করতে চাই৷’
-‘আর আমরা কী করব?’
-‘দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমাদের কথোপকথন শ্রবণ করবেন৷’
এমন সময়ে বোধ হয় গাড়ি থামার শব্দ শুনেই চন্দ্রনাথ স্বয়ং বেরিয়ে এসে দাঁড়াল দোতলার বারান্দায়৷ তারপর উপর থেকে মুখ বাড়িয়ে দেখে বললে, ‘আরে! আবার আমার দ্বারে সুন্দরবাবুর দল!’
সুন্দরবাবু বললেন, ‘আজ্ঞে হ্যাঁ, আপনাকে একটা খবর দিতে এসেছি৷ আসুন৷’
মিনিট দুই পরে চন্দ্রনাথ নীচে নেমে রাস্তায় বেরিয়ে এল৷ হাতে তার সেই মোটা লাঠিগাছা৷
জয়ন্ত বললে, ‘মশাই কি বাড়িতেও ওই বাঘমারা লাঠিছাড়া হয়ে থাকেন না?’
চন্দ্রনাথ বললে, ‘কোমরে হঠাৎ লাম্বেগোর ব্যথা হয়েছে৷ লাঠি ছাড়া চলতে কষ্ট হয়৷ সুন্দরবাবু, কী একটা খবরের কথা বলছিলেন না?’
সুন্দরবাবু বললেন, ‘আমাদের রাস্তায় দাঁড়িয়েই কথাবার্তা কইতে হবে নাকি? আপনি কি আমাদের ধুলো পায়েই বিদায় করতে চান?’
চন্দ্রনাথ নাচারের মতো বললে, ‘বেশ, তবে বাড়ির ভিতরে আসুন৷’
সকলে বৈঠকখানায় গিয়ে আসন গ্রহণ করলে পর চন্দ্রনাথ বললে, ‘আপনারা এমন কী জরুরি খবর দেবার জন্যে এত দূর ছুটে এসেছেন?’
সুন্দরবাবু বললেন, ‘আপনার বন্ধু মণিমোহনকে মনে আছে তো?’
-‘কিন্তু আপনাদের সঙ্গে দেখা হবার পর থেকে তার সঙ্গে আর আমার দেখা হয়নি৷ জানি না সে কোথায় অজ্ঞাতবাস করছে৷’
-‘আমরা এতদিন পরে তাঁকে খুঁজে পেয়েছি, কিন্তু জীবন্ত অবস্থায় নয়৷’
-‘কী বলছেন!’
-‘হ্যাঁ, গতকাল কে যেন তাকে খুন করেছে৷’
-‘শুনে অত্যন্ত দুঃখিত হলাম৷ অপরাধীর কোনো সন্ধান পেয়েছেন?’
-‘না৷ মণিমোহনের সঙ্গে শত্রুতা ছিল, এমন কোনো লোককে আপনি জানেন?’
-‘তার কোনো শত্রু বা বন্ধুকেই আমি চিনি না, কারণ তার সঙ্গে বেশিদিন আমার আলাপ হয়নি৷’
জয়ন্ত এবার মুখ খুললে৷ বললে, ‘আপনার বাড়িতে কয়খানা ঘর আছে চন্দ্রনাথবাবু?’
-‘দশখানা৷’
-‘ঘরগুলো একবার দেখাবেন?’
-‘আপনার কৌতূহল একটু অদ্ভুত নয় কি?’
-‘কেন, দেখাতে কোনো আপত্তি আছে?’
-‘কিছু না৷ আসুন৷’
একে একে সব ঘর দেখিয়ে চন্দ্রনাথ সর্বশেষে দোতলায় একখানা ঘরে ঢুকে বললে, ‘এখানা আমার শোবার ঘর৷’
জয়ন্ত একবার চারদিকে চোখ বুলিয়ে নিলে৷ তারপর এক দিকে চেয়ে বললে, ‘ওখানে রয়েছে পর পর সাত জোড়া জুতো৷ সব জুতোই আপনার?’
শুকনো হাসি হেসে চন্দ্রনাথ বললে, ‘হ্যাঁ৷ আমার কিঞ্চিৎ পাদুকা বিলাস আছে৷’
জয়ন্ত জুতাগুলোর সামনে গিয়ে বসে পড়ল৷ একে একে সব জুতো হাতে করে তুলে নিয়ে উলটেপালটে পরীক্ষা করে বললে, ‘বাঃ, বেশ জুতোগুলো! চন্দ্রবাবুর পছন্দ আছে বটে!’
চন্দ্রনাথ ভাবহীন মুখে গম্ভীর স্বরে বললে, ‘মশায়ের আর কিছু জ্ঞাতব্য বা বক্তব্য আছে?’
জয়ন্ত উঠে দাঁড়িয়ে বললে, ‘নীচে ফিরে যাই চলুন৷’
সকলে আবার বৈঠকখানায় এল৷
সুন্দরবাবুর এক সহকারী কর্মচারী একটা লোককে নিয়ে দাঁড়িয়েছিল সেইখানে৷ বললে, ‘স্যার, এই লোকটা বাড়ির বাইরে যাচ্ছিল, আমরা যেতে দিইনি৷’
লোকটা বললে, ‘আমি এই বাড়ির চাকর৷ বাজারে যাচ্ছি৷’
সহকারী বললে, ‘কিন্তু ও বাজারে যাচ্ছে রেশন ব্যাগের ভিতরে এক জোড়া জুতো নিয়ে!’
জয়ন্ত সাগ্রহে বললে, ‘জুতো! দেখি, দেখি৷’
চন্দ্রনাথ বললে, ‘কোথাকার একটা উটকো লোক আজ ভোরে রেশন ব্যাগসুদ্ধ ওই জুতো জোড়া আমার বৈঠকখানায় ফেলে গিয়েছিল৷ তাই চাকরকে আমি বলেছিলুম সে যেন বাজারে যাবার সময়ে জুতো জোড়া রাস্তায় ফেলে দিয়ে যায়৷’
জয়ন্ত নিরুত্তর মুখে একখানা আতশিকাচের সাহায্যে জুতো জোড়া খানিকক্ষণ পরীক্ষা করে বললে, ‘সুন্দরবাবু, গাড়িতে ওঠবার সময় আপনাকে কী আনতে বলেছিলাম মনে আছে?’
-‘সেই অপরিচিত ব্যক্তির পদচিহ্নের ছাঁচ তো? এনেছি৷’
-‘তার সঙ্গে এই জুতো জোড়া মিলিয়ে দেখুন৷’
গাড়ি থেকে ছাঁচ আনানো এবং জুতোর সঙ্গে মেলানো হল৷ অবিকল মিলে গেল-একচুল এদিক-ওদিক হল না৷
সুন্দরবাবু উত্তেজিত কন্ঠে বলে উঠলেন, ‘হত্যাকারীর জুতো!’
জয়ন্ত বললে, ‘সে বিষয়ে কোনোই সন্দেহ নেই৷ জুতোর তলার দিকে তাকালেই দেখতে পাবেন জায়গায় জায়গায় শুকনো রক্তের দাগ৷ তার মানে হচ্ছে কাল মণিমোহনকে বধ করবার পরেও এই জুতো জোড়া ব্যবহার করা হয়েছিল৷ এই জুতো সংগ্রহ করবার জন্যেই আমার এখানে আগমন৷’
চন্দ্রনাথ চমকে উঠে বললেন, ‘কী বললেন? আপনি জানতেন যে, ওই জুতো আছে আমার এইখানেই?’
-‘ঠিক জানতুম বলতে পারি না, তবে এইরকম একটা সন্দেহ করেছিলুম বটে৷’
চন্দ্রনাথ খাপ্পা হয়ে বলে উঠল, ‘এতক্ষণ আমার ধারণা ছিল কোনো উটকো লোক জুতো জোড়া আমার বৈঠকখানায় ফেলে রেখে গিয়েছে৷ এখন বুঝতে পারছি, এ হচ্ছে পুলিশের কারসাজি৷ কিন্তু আপনাদের সমস্ত কূটকৌশলই ব্যর্থ হবে৷ দেখুন ওই জুতোর সঙ্গে আমার পা মিলিয়ে৷ আমি বলছি, এ জুতো আমার নয়৷’
জয়ন্ত সহাস্যে বললে, ‘আমি জানি ও জুতোর মাপ আপনার পায়ের চেয়ে বড়ো৷ কিন্তু আমি কেবল জুতোর আসল গুপ্তকথাই জানি না, বোধ হচ্ছে আপনার ওই লাঠির গুপ্তকথাও আমার কাছে অবিদিত নেই৷ সুন্দরবাবু, আপনি এখন অনায়াসেই চন্দ্রনাথকে থানায় ধরে নিয়ে যেতে পারেন৷’
আচম্বিতে চন্দ্রনাথের মুখ হয়ে উঠল বীভৎস এক দানবের মতো৷ সঙ্গেসঙ্গে ফস করে সে লাঠিগাছা দুই হাতে কোমর বরাবর উঁচু করে তুলে ধরলে-এবং তৎক্ষণাৎ একটা রিভলবার গর্জন করে উঠল ও পরমুহূর্তে লাঠিগাছা তার হাত থেকে খসে মেঝের উপরে পড়ে গেল সশব্দে৷ চন্দ্রনাথের ডান হাতের কব্জির উপরে ফুটে উঠল রক্তের রেখা৷
চারদিকে তাকাতে তাকাতে সুন্দরবাবু সবিস্ময়ে বলে উঠলেন, ‘রিভলবার ছুড়লে কে, রিভলবার ছুড়লে কে?’
জয়ন্ত প্রশান্ত কন্ঠে বললে, ‘সে কথা পরে শুনবেন সুন্দরবাবু৷ এখন চট করে লাঠিগাছা তুলে নিন দেখি৷ কিন্তু খুব সাবধান, বোধ হয় ওটা লাঠি নয়-কোনো সাংঘাতিক ভয়াবহ অস্ত্র৷’
পদচিহ্ন রহস্য
চন্দ্রনাথের পরিত্যক্ত লাঠিগাছাটা মাটির উপর থেকে তুলে নিয়ে সুন্দরবাবু আবার বললেন, ‘কিন্তু রিভলবার ছুড়লে কে?’
জয়ন্ত হাসতে হাসতে বললে, ‘রিভলবার ছুড়েছি আমি সুন্দরবাবু৷’
সুন্দরবাবু মাথা নেড়ে বললেন, ‘হতেই পারে না৷ যখন রিভলবারের আওয়াজ হয় তখন তোমার ডান হাত ছিল জামার পকেটের ভিতরেই৷’
-‘ঠিক দেখেছেন৷ এখনও আমার ডান হাত পকেটের ভিতরেই আছে৷’
-‘তবে?’
-‘পকেটের ভিতর থেকেই আমি রিভলবার ছুড়েছিলুম৷’
-সে কী হে!
-‘এই দেখুন, আমার পকেট ছ্যাঁদা করে রিভলবারের গুলিটা বাইরে বেরিয়ে এসেছে৷’
-‘হুম!’
-‘চন্দ্রনাথকে আমি বিশ্বাস করিনি, আর আমার সবচেয়ে বেশি সন্দেহ ছিল ওর ওই মোটা লাঠিগাছার উপরে৷ আমি জানতুম, সে যদি হঠাৎ কোনো চালাকি খেলে বসে, তাহলে পকেট থেকে আর রিভলবার বার করবার সময় পাব না৷ তাই পকেটের ভিতরেই রিভলবার ধরে আমি আগে থাকতে তৈরি হয়ে ছিলাম৷’
-‘ধন্যি ছেলে যাহোক৷’
-‘না সুন্দরবাবু ব্যাপারটায় নতুনত্ব নেই কিছু৷ চোখের পলক পড়বার আগেই কাজ সারবার জন্যে মার্কিন গুন্ডাদের মধ্যে এই নিয়মই প্রচলিত আছে৷ এখন ওকথা থাক৷ লাঠিগাছাটা আমার হাতে দিয়ে আগে চন্দ্রনাথকে গ্রেপ্তার করুন৷’
সুন্দরবাবুর হুকুমে তখনই পাহারাওয়ালা এসে চন্দ্রনাথকে ঘিরে দাঁড়াল৷
দাঁতে দাঁত ঘষতে ঘষতে চন্দ্রনাথ বললে, ‘বটে বটে! আমার বিরুদ্ধে কী প্রমাণ পেয়েছ তোমরা?’
জয়ন্ত জবাব না দিয়ে চন্দ্রনাথের লাঠিগাছা নিয়ে নাড়াচাড়া করতে লাগল৷ তারপর সকলের দিকে পিছন ফিরে জানলার ধারে গিয়ে দাঁড়িয়ে লাঠিগাছা আকাশের দিকে উঁচু করে তুলে ধরলে৷ তারপরেই ঘরের সবাইকে চমকে দিয়ে গুড়ুম করে একটা আওয়াজ হল৷
সুন্দরবাবু আঁতকে বলে উঠলেন, ‘বন্দুক ছুড়লে কে, বন্দুক ছুড়লে কে?’
জয়ন্ত ফিরে দাঁড়িয়ে বললে, ‘আমি৷’
সুন্দরবাবু সবিস্ময়ে বললেন, ‘মানে? বন্দুকটাও তোমার পকেটের ভিতরে লুকিয়ে রেখেছ নাকি?’
তখন ধূমায়মান লাঠিগাছা দেখিয়ে জয়ন্ত বললে, ‘না৷ আমি ছুড়েছি এই লাঠি-বন্দুকটা৷’
-‘লাঠি আবার বন্দুকে পরিণত হতে পারে নাকি! গুপ্তির কথা শুনেছি বটে, লাঠির ভিতরে লুকানো থাকে ছোটো তলোয়ার৷ কিন্তু লাঠি-বন্দুক আবার কী চিজ, বাবা!’
-‘হ্যাঁ সুন্দরবাবু, আমার হাতে যা দেখছেন তা লাঠির ছদ্মবেশে বন্দুক ছাড়া আর কিছুই নয়৷ এই দেখুন লাঠির রুপো-বাঁধানো মুন্ডি৷ তার তলায় এই যে দেখছেন সোনার ব্যান্ড বা বন্ধনী, আঙুল দিয়ে এটা একটু সরানো যায়৷ কিন্তু সরাবার সঙ্গেসঙ্গেই লাঠির ভিতরে যে ট্রিগার বা টিপকল আছে সেটা পড়ে যাবে আর ভিতর থেকে বেরিয়ে পড়বে বুলেটটা৷ কী হে চন্দ্রনাথ, তাই নয় কি?’
চন্দ্রনাথ ক্রুদ্ধ মুখে গুম হয়ে দাঁড়িয়ে রইল, কোনো উত্তর দিল না৷
সুন্দরবাবু চমৎকৃত হয়ে বললেন, ‘এমন আজব বন্দুকের কথা কখনো তো শুনিনি৷’
জয়ন্ত বললে, ‘না শোনবারই কথা! এ দেশে এরকম বন্দুক থাকতে পারে আমিও আগে তা জানতুম না৷’
-‘তবে তুমি লাঠির গুপ্তকথা আবিষ্কার করলে কেমন করে?’
-‘বলছি শুনুন৷ এই মোটা লাঠিগাছা দেখলেই অসাধারণ বলে মনে হয় নাকি? এরকম লাঠি নিয়ে কোনো শৌখিন বাবুই হাওয়া খেতে বেরোয় না৷ লাঠির ওই অসাধারণত্ব প্রথম দিনেই আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল৷ কিন্তু আমি তখন ওটাকে ভেবেছিলুম সাধারণ গুপ্তিজাতীয় কোনো যন্ত্র৷ তারপর আমার প্রথম সন্দেহ জাগ্রত হয় ভদ্রেশ্বরের বাগানে গিয়ে৷’
-‘কেন? সেখানে তো আমরাও ছিলুম, আমরা তো চন্দ্রনাথের লাঠিকে তখনও সন্দেহজনক বলে মনে করতে পারিনি৷’
-‘গুটি কয় কথা ভেবে দেখুন৷ ভদ্রেশ্বরের বাগানে আমাদের কোনোই বন্দুকধারী শত্রু ছিল না৷ মণিমোহন পলাতক, ভদ্রেশ্বর বন্দি, যেদিক থেকে আমাকে লক্ষ করে গুলি নিক্ষিপ্ত হয় সেদিকে দাঁড়িয়েছিল কেবল চন্দ্রনাথ৷ কিন্তু তার হাতে ছিল মাত্র এই লাঠিগাছা৷ বাগান তল্লাস করেও অন্য কোনো লোক বা বন্দুক খুঁজে পাওয়া যায়নি৷ তবে বন্দুক ছুড়লে কে? একমাত্র উত্তর হতে পারে, চন্দ্রনাথ! কিন্তু তার কাছেও ওই লাঠি ছাড়া আর কোনো অস্ত্রই ছিল না৷ গুলি তো আকাশ থেকে খসে পড়েনি, তাই সর্বপ্রথম আমার মনে সন্দেহ জাগে, তবে কি চন্দ্রনাথের ওই লাঠির ভিতরেই কোনো রহস্য নিহিত আছে? বাড়িতে ফিরে এসে এই নিয়ে ভাবতে ভাবতে হঠাৎ মনে পড়ে গেল, অনেক দিন আগে কী একখানা ইংরেজি কেতাবে অদ্ভুত একটা লাঠির কথা পাঠ করেছিলুম৷ কিন্তু বইখানার নামটা প্রথমে মনে পড়েনি৷ তারপর আমার লাইব্রেরির আলমারিগুলোর ভিতরে খুঁজতে খুঁজতে হঠাৎ যখন বইখানা চোখে পড়ে গেল, তখন মানিকও সেখানে হাজির হল৷ কী হে মানিক বইখানার নাম তুমি এর মধ্যে ভুলে যাওনি তো?’
মানিক বললে, ‘নিশ্চয়ই ভুলে যাইনি! বইখানা হচ্ছে জোসেফ গোলাম সাহেবের-মাস্টার ম্যানহান্টার্স৷’
-‘ঠিক৷ ওখানা উপন্যাস নয়, সত্য ঘটনার অপরাধ-বিজ্ঞানের বই৷ তারই পাতা ওলটাতে ওলটাতে দ্বাদশ পরিচ্ছেদে প্যারিসের অপরাধ জাদুঘরের বর্ণনার মধ্যে খুঁজে পেলুম চন্দ্রনাথের এই লাঠির জুড়ি৷’
সুন্দরবাবু আগ্রহ ভরে বললেন, ‘কীরকম, কীরকম!’
-‘সম্পূর্ণ ঘটনার কথা পরে আপনি বিস্তৃতভাবে বইখানা পাঠ করলেই জানতে পারবেন, আপাতত আমি সংক্ষেপেই তার কথা বলব৷ ফ্রান্সে একবার একটা গার্ডেন পার্টিতে জনৈক ব্যক্তি কোনো অজানা আততায়ীর দ্বারা নিক্ষিপ্ত গুলিতে নিহত হয়৷ তখনি ঘটনাস্থলে পুলিশ আসে আর সারা বাগান আর প্রত্যেক নিমন্ত্রিত ব্যক্তির জামাকাপড় তল্লাস করে, কিন্তু বন্দুক বা কোনোরকম আগ্নেয়াস্ত্রই খুঁজে পায় না৷ অন্য কোনো সূত্র না পেয়ে গোয়েন্দারা খোঁজ নিতে লাগল, নিহত ব্যক্তির সঙ্গে কারুর বিশেষ শত্রুতা আছে কি না! ফলে এক ব্যক্তির উপরে পুলিশের সন্দেহ হয়৷ তারপর তার বাড়ি খানাতল্লাস করে আবিষ্কৃত হয় এমন একগাছা লাঠি, যা অবিকল চন্দ্রনাথের এই লাঠিগাছারই মতো৷’
সুন্দরবাবু বললেন, ‘তুমি কি বলতে চাও, চন্দ্রনাথ ওইরকম সর্বনেশে লাঠি তৈরি করেছে?’
-‘সে নিজে হয়তো তৈরি করেনি, হয়তো ইউরোপ থেকেই অস্ত্রটা আমদানি করেছে!’
-‘তাহলে চন্দ্রনাথকে বড়োজোর তোমাকে খুন করবার চেষ্টা করেছে বলে আমরা চালান দিতে পারি৷ কিন্তু আমাদের আসল মামলা তো এখনও রয়ে গেল যে তিমিরে সেই তিমিরেই!’
রুপোর নস্যদানি বার করে নস্য নিতে নিতে জয়ন্ত বললে, ‘মোটেই নয়! চন্দ্রনাথের বাড়িতে আজ যে জুতো জোড়া খুঁজে পেয়েছি, আসল মামলার কিনারা হবে তার সাহায্যেই৷’
-‘সে কী হে, ও জুতোর মাপ যে চন্দ্রনাথের পায়ের মাপের চেয়ে বড়ো!’
-‘হ্যাঁ, কিন্তু কোনো ঘটনাস্থলে যাবার সময়ে চন্দ্রনাথ নিশ্চয়ই ওই জুতোর ভিতরে কাগজের নুটি বা প্যাড গুঁজে দিয়ে কিছুক্ষণের জন্যে কোনোরকমে জুতো জোড়া ব্যবহার করত৷’
-‘কেন?’
-‘পুলিশকে ভোলাবার জন্যে৷’
-‘কেমন করে এটা জানতে পেরেছ?’
-‘রামময়বাবুর বাড়িতে যে চুরি আর হত্যাকাণ্ড হয়, সেদিন বৃষ্টি হয়নি তবু ঘটনাস্থলে পাওয়া গিয়েছিল মণিমোহনের আর এই জুতো জোড়ার কাদামাখা ছাপ৷ তারপর দেখা গেল, নর্দমার কাছে গিয়ে বালতির জল ঢেলে ধুলোমাখা জুতো ভিজিয়ে কারা ইচ্ছে করেই সেই পদচিহ্নগুলো সৃষ্টি করেছে৷ মনে আছে সুন্দরবাবু, তখনি আপনাকে আমি বলেছিলুম, অপরাধীরা এই পদচিহ্নগুলো আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখাতে চায়!’
-‘হুম!’
-‘তারপর যেখানে মণিমোহন খুন হয় সেখানেও এই জুতো জোড়ার ছাপ পাওয়া যায় রক্তমাখা মাটির উপরে, অথচ সেখানে রক্ত থাকবার কথা নয়, কারণ লাশটাকে হত্যাকাণ্ডের অনেক পরে সেখানে স্থানান্তরিত করা হয়েছিল৷ আসলে সে রক্তও আমদানি করা৷ সেখানেও হত্যাকারী এই জুতো জোড়ার ছাপ দেখিয়ে আমাদের ভোলাতে চেয়েছিল৷ এখন ব্যাপারটা বুঝতে পারছেন?’
-‘খানিক খানিক, সবটা নয়৷’
-‘গোড়া থেকে ভেবে দেখুন৷ চন্দ্রনাথের কুকর্ম্মের সহকারী হল মণিমোহন৷ প্রথমেই কে. সরকারের জুয়েলারি ফার্মে চুরি৷ তারপর নন্দলালকে হত্যা করে তাকে মণিমোহন বলে চালাবার চেষ্টা৷ সেখানেও নন্দলালের, মণিমোহনের আর অজ্ঞাত ব্যক্তির জুতোজোড়ার ছাপ পাওয়া যায়৷ তারপর ধরা পড়ে মণিমোহন খুন হয়নি, মারা পড়েছে নন্দলালই৷ পুলিশের সন্দেহ যায় মণিমোহন আর এক অজ্ঞাত ব্যক্তির দিকে৷ চন্দ্রনাথের উদ্দেশ্যই ছিল তাই৷
‘তারপর রামময়বাবুর বাড়িতে খুন, পঞ্চাশ হাজার টাকা আর ত্রিশ হাজার টাকার জড়োয়া গয়না চুরি৷ সেখানেও পাওয়া গেল মণিমোহনের আর সেই অজ্ঞাত ব্যক্তির জুতোর ছাপ৷ তারপর ভিতরের ব্যাপারটা ঠিক ধরতে পারছি না বটে, কিন্তু খুব সম্ভব চোরাই টাকা-গহনার ভাগবাঁটোয়ারা নিয়ে মণিমোহনের সঙ্গে চন্দ্রনাথের ঝগড়া হয়, যার ফলে মণিমোহনের অকাল মৃত্যু৷ লাশ অন্যত্র পাঠিয়ে সেখানে আবার পুলিশের অজ্ঞাত সেই ব্যক্তির জুতোর ছাপ রেখে আসা হল৷ ফলে চন্দ্রনাথ ভেবেছিল সে নিজে থাকবে নিরাপদে, আর পুলিশ খুঁজে মরবে এমন কোনো ব্যক্তিকে পৃথিবীতে যার অস্তিত্ব নেই৷’
চন্দ্রনাথ ঝাঁঝালো গলায় বললে, ‘ও জুতো যে আমার, সেটা প্রমাণ করবে কে?’
জয়ন্ত বললে, ‘সে ভার পুলিশের হাতে দিয়ে তুমি নিশ্চিন্ত হয়ে থাকতে পারো৷ এই জুতো জোড়া পাওয়া গিয়েছে তোমার বাড়িতে৷ পুলিশ দেখেই জুতো জোড়া তুমি সরিয়ে ফেলতে গিয়েছিলে৷ তার উপরে এমন আরও অনেক সারকামস্ট্যানসিয়াল এভিডেন্স বা অবস্থা ঘটিত প্রমাণও আছে, তোমাকে ফাঁসিকাঠে ঝোলাবার পক্ষে যা হবে যথেষ্ট৷’
সুন্দরবাবু বললেন, ‘যেমন বুনো ওল, তেমনি বাঘা তেঁতুল৷ যেমন কুকুর তেমনি মুগুর! হুম, জয়ন্তের মতো ওঝা না হলে চন্দুরের মতো ভূতকে শায়েস্তা করতে পারে কে?’