কে? – হেমেন্দ্রকুমার রায়

কে? – হেমেন্দ্রকুমার রায়

উড়িষ্যায় বেড়াতে গিয়েছিলুম৷ আমি আর রূপলাল৷ এদেশে-সেদেশে ঘুরে ভুবনেশ্বরে গিয়ে হাজির হলুম৷

এক দুপুরবেলায় খণ্ডগিরি আর উদয়গিরি দেখতে গেলুম৷ যাওয়ার সময় পাণ্ডা সাবধান করে দিলে, আমরা যেন সন্ধ্যা হ’বার আগেই ফিরে আসি, কারণ খণ্ডগিরিতে নাকি নরখাদক বাঘের বিষম উপদ্রব হয়েছে৷ বাঘের কবলে প’ড়ে একমাসের মধ্যে পাঁচজনের প্রাণ গিয়েছে৷

একথা শুনে ভয় পেলুম না, কারণ আমাদের সঙ্গে বন্দুক ছিল৷

খণ্ডগিরি আর উদয়গিরি দেখতে দেখতে বেলা পড়ে গেল, এবং বেলা পড়ে আসার সঙ্গে সঙ্গেই সারা আকাশ কালো করে শুরু হল ঝড় ও বৃষ্টি৷

তাড়াতাড়ি ছুটে এসে ডাকবাংলোর ভিতরে আশ্রয় নিলুম৷

বিকাল গেল, সন্ধ্যাও উতরে গেল৷ কিন্তু সে ঝড়বৃষ্টি তবু থামল না৷

বাংলোর বেয়ারা এসে বললে, ‘‘বাবু, আজ আপনারা এখান থেকে যাবেন কেমন করে?’

রূপলাল বললে, ‘‘কেন, যেমন করে এসেছি তেমনি করেই ফিরে যাব, অর্থাৎ দু-পায়ে ভর দিয়ে!’’

বেয়ারা ঘাড় নেড়ে বললে, ‘‘আজ আর তা পারবেন না৷ একে এই ঝড়জল, তার ওপরে—শুনেছেন তো?’’

আমি বললুম, ‘‘হ্যাঁ, বাঘের উপদ্রবের কথা বলছ তো? শুনেছি৷’’

বেয়ারা বললে, ‘‘খালি বাঘ নয়, পেত্নীর ভয়ও আছে৷’’

রূপলাল বললে, ‘‘তাহলে আজ আমরা এই বাংলোতেই রাত কাটাব৷ জীবনে কখনো পেত্নী দেখি নি, আজ তাকে দেখব৷ আর যদি পছন্দ হয়, তাহলে পেত্নীটিকে বিয়ে করে দেশে ফিরব৷’’

বেয়ারা বললে, ‘‘বাবু, আপনি জানেন না তাই ঠাট্টা করছেন৷ বেশ, আপনারা তাহলে আজ এখানে থাকবেন তো?’’

আমরা বললুম, ‘‘হ্যাঁ৷’’

বেয়ারা বললে, ‘‘তাহলে আপনাদের জন্য রান্নাবান্নার আয়োজন করি গে৷’’—এই বলে সে চলে গেল৷

রাত হল৷ বৃষ্টি এখনো ঝরছে, ঝড় এখনো গর্জন করছে৷

রাত্রে খেতে বসেছি, এমন সময় বাংলোর দরজায় ঘন ঘন করাঘাত হতে লাগল৷ আশ্চর্য হয়ে ভাবতে লাগলুম, এমন স্থানে এই দুর্যোগে দরজা ঠেলে কে?

বেয়ারা চেঁচিয়ে জিজ্ঞাসা করলে, ‘‘কে?’’

বাহির থেকে ভীত-কাতর নারীকণ্ঠে সাড়া এল, ‘‘শীগগির দরজা খুলে দাও৷ নইলে প্রাণে মারা গেলুম৷’’

উড়ে বেয়ারাটা সেইখানে দাঁড়িয়ে ভয়ে ঠকঠক করে কাঁপতে লাগল৷

আমি বললুম, ‘‘অমন করছ কেন? যাও, দরজা খুলে দাও!’’

বেয়ারা এক পা-ও নড়লো না, সেইখানে দাঁড়িয়ে তেমনি করেই কাঁপতে লাগল৷

রূপলাল তার ভয় দেখে হাসতে হাসতে দরজার দিকে এগিয়ে গেল৷

বেয়ারা ছুটে গিয়ে দরজায় পিঠ দিয়ে দাঁড়িয়ে মিনতি করে বললে, ‘‘পায়ে পড়ি বাবু, দরজা খুলবেন না৷ ও মানুষ নয়৷’’

রূপলাল বললে, ‘‘বলেছি তো, আমি পেত্নী বিয়ে করতে চাই৷ ও মানুষ না হলেই আমি বেশি খুশি হব৷’’

বাহির থেকে আবার আর্তস্বর শোনা গেল, ‘‘বাঘ, বাঘ! রক্ষা কর—রক্ষা কর!’’

রূপলাল আর বাধা মানলে না, বেয়ারাকে একধাক্কায় সরিয়ে দিয়ে একটানে সে দরজার খিলটা খুলে দিলে৷

একটা ঝোড়ো হাওয়ার সঙ্গে দরজা ঠেলে তাড়াতাড়ি ভিতরে প্রবেশ করলে একটি স্ত্রীমূর্তি৷ তাকে ভালো করে দেখবার আগেই বাতাসের ঝাপটে ঘরের আলোটা নিভে গেল৷

বেয়ারা হাঁউমাউ করে চেঁচিয়ে কেঁদে উঠল৷

সেই অন্ধকার রাত্রি, সেই ঝড়বৃষ্টির হুলুস্থূল, সেই পার্বত্য অরণ্যের ঘন ঘন দীর্ঘশ্বাস, সেই অভাবিত ও অজানা নারীমূর্তির আকস্মিক আবির্ভাব এবং আলোকহীন ঘরের ভিতরে বেয়ারার সেই ক্রন্দনস্বর,—এই সমস্ত মিলে চারিদিকে কেমন একটা ছমছমে অস্বাভাবিক ভাব সৃষ্টি করলে৷

আমি ব্যস্ত হয়ে বললুম, ‘‘রূপলাল, শীগগির দরজাটা বন্ধ কর! আমি আবার আলোটা জ্বেলে নি!’’

রূপলাল দরজায় খিল তুলে দিলে৷ আমি আলোটা জ্বাললুম৷

কৌতূহলী চোখে ফিরে দেখলুম, ঘরের কোণে দাঁড়িয়ে একটি অসীম রূপসী মেয়ে ভয়ে ঠকঠক করে কাঁপছে৷ তার এলোমেলো চুলগুলো এলিয়ে মুখ কাঁধ ও বুকের উপর এসে পড়েছে এবং তার সর্বাঙ্গ বৃষ্টির জলে ভিজে গেছে৷ মেয়েটির বয়স হবে আঠারো কি উনিশ৷

ঘরের আর এক দিকে মেঝের উপরে উবু হয়ে বসে, হাতে মুখ ঢেকে উড়ে বেয়ারাটা তখনো ফুঁপিয়ে কাঁদছিল৷

মেয়েটি প্রথমেই আশ্চর্যভাবে জিজ্ঞাসা করলে, ‘‘ও লোকটি অমন করে কাঁদচে কেন?

রূপলাল হাসতে হাসতে বললে, ‘‘ওর ধারণা আপনি একটি নিখুঁত পেত্নী!’’

মেয়েটি চমকে উঠল৷ তারপর মুখের উপর থেকে চুলের গোছা সরিয়ে দিয়ে বললে, ‘‘আমায় কি পেত্নীর মতো দেখতে? কিন্তু সে কথা থাক, বড় বিপদ থেকেই আপনারা আমায় উদ্ধার করলেন৷’’

তার বিপদের ইতিহাস হচ্ছে এই৷ সে খণ্ডগিরি দেখতে এসেছে৷ কিন্তু হঠাৎ ঝড়বৃষ্টি আসাতে এতক্ষণ সে একটা গুহার ভিতরেই ঢুকে আত্মরক্ষা করছিল৷ হয়তো সে রাতটা কাটিয়ে দিত, কিন্তু গুহার কাছেই বাঘের ভীষণ গর্জন শুনে প্রাণের ভয়ে সে এখানে পালিয়ে এসেছে৷

রূপলাল নিজের সিল্কের চাদরখানা খুলে মেয়েটির হাতে দিয়ে বললে, ‘‘আপনার কাপড়-চোপড় সব ভিজে গেছে৷ পাশের ঘরে গিয়ে ভিজে কাপড় ছেড়ে আপাতত এই চাদরখানা ব্যবহার করতে পারেন৷—কিন্তু আজ রাতে খাবেন কি? আমাদের তো খাওয়া-দাওয়া হয়ে গেছে!’’

মেয়েটি পাশের ঘরে যেতে যেতে বললে, ‘‘এক রাত না খেলে কেউ মরে না৷’’

আমি ও রূপলাল আলোর শিখাটা খুব কমিয়ে দিয়ে শুয়ে পড়লুম৷ বন্দুকটাকেও শুইয়ে রাখলুম ঠিক আমাদের মাঝে৷

শুয়ে শুয়ে শুনতে লাগলুম বনজঙ্গলের উপরে পাহাড়ের বৃষ্টি-বালার অশ্রান্ত নৃত্য-নূপুরধ্বনি৷

রূপলাল আমার কানের কাছে মুখ এনে বললে, ‘‘আচ্ছা ভাই, ওই মেয়েটির ইতিহাস কি তোমার কাছে একটু উদ্ভট বলে মনে হল না?’’

আমি বললুম, ‘‘কেন?’’

রূপলাল বললে, ‘‘ও মেয়েটি কে? ওর কি কোনো অভিভাবক নেই? অত বড় মেয়েকে কেউ কি একলা এই বিদেশে ছেড়ে দেয়? ওর মাথায় সিঁদুর নেই, গায়েও একখানা গয়না নেই৷ ওর সবই যেন কেমন রহস্যময়!’’

আমি পাশ ফিরে শুয়ে বললুম, ‘‘ওই সব বাজে কথা ভেবে তুমি মাথা গরম করতে থাকো, ততক্ষণে আমি একঘুম ঘুমিয়ে নি!’’

আমার যখন বেশ তন্দ্রা আসছে তখন শুনলুম, রূপলাল আপন মনে বলছে, ‘‘অমন সুন্দরী মেয়ে, কিন্তু তার চোখ দুটো কী তীক্ষ্ন! ওর চোখ দুটো যেন ওর নিজের চোখ নয়, যেন কোনো হিংস্র জন্তুর চোখ!’’

কতক্ষণ ঘুমিয়েছিলুম জানি না, হঠাৎ কি একটা অস্বস্তির ভাব নিয়ে আমি ধড়মড় করে জেগে উঠলুম৷ তারপর চোখ খুলেই যে দৃশ্য দেখলুম, সারাজীবনে কোনো দিন তা ভুলতে পারব না৷

এ-ঘর থেকে পাশের ঘরে যাবার দরজার দিকে পিছন করে মাটির উপরে স্থিরভাবে বসে আছে প্রকাণ্ড একটা বাঘ৷

আমার বুকের গতি হঠাৎ যেন থেমে গেল৷ অত্যন্ত আড়ষ্টভাবে স্তম্ভিত-নেত্রে বাঘটার দিকে তাকিয়ে রইলুম, সেও তাকিয়ে রইল আমার দিকে৷ এইভাবে কিছুক্ষণ কেটে গেল৷

ইতিমধ্যে অল্পে অল্পে হাত সরিয়ে পাশের বন্দুকটা আমি চেপে ধরলুম৷

বাঘটা আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়াল৷ তারপর হঠাৎ হেঁট হয়ে পড়ল লাফ মারবার জন্য৷

চোখের নিমেষে আমিও বন্দুকটা নিয়ে উঠে বসলুম এবং তাকে লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়লুম৷

একটা উল্টো ডিগবাজি খেয়ে বাঘটা পাশের ঘরে গিয়ে পড়ে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল, সঙ্গে সঙ্গে স্ত্রীকণ্ঠে বার বার ভীষণ আর্তনাদ৷ দড়াম করে একটা দরজা খোলার শব্দ৷ দ্রুত পদধ্বনি৷ তারপরে সব আবার স্তব্ধ৷

বন্দুক হাতে করে অভিভূতের মতো বিছানার উপরে বসে রইলুম৷ রূপলাল জেগে বিছানার উপর থেকে নীচে লাফিয়ে পড়ে উদভ্রান্তের মতো বলে উঠল, ‘‘কে চেঁচালে অমন করে? কে বন্দুক ছুঁড়লে?’’

আমি বললুম, ‘‘বাঘ, বাঘ! এখন ও-ঘরে গিয়ে ঢুকেছে৷ সেই মেয়েটি চিৎকার করছে৷’’

‘‘সর্বনাশ! বাঘ বোধ হয় তাকেই ধরেছে৷’’—বলতে বলতে বেগে রূপলাল পাশের ঘরে গিয়ে ঢুকল৷ আমিও বন্দুক আর লণ্ঠনটা নিয়ে তার সঙ্গে ছুটলুম৷

পাশের ঘরে কেউ নেই৷ খালি একটা খোলা দরজা দিয়ে হু-হু করে জোলো হাওয়া আসছে৷

রূপলাল বেদনা-বিদীর্ণ স্বরে বললে, ‘‘আর কোনো আশা নেই৷ অভাগী শেষটায় সেই বাঘের কবলেই গিয়ে পড়ল৷ কিন্তু বাঘ এখানে এল কেমন করে?’’

রূপলালের কথার কোনো জবাব দিলুম না৷ আমি তখন আর একটা ব্যাপার সবিস্ময়ে লক্ষ করছিলুম৷ ঘরের ভিতর একটা একটানা রক্তের রেখা বাহিরের দিকে সোজা চলে গিয়েছে৷ পরে পরে একখানা করে রস্তাক্ত পায়ের ছাপ—মানুষের পা৷

সবিস্ময়ে বললুম, ‘‘দেখ রূপলাল, দেখ! কি আশ্চর্য ব্যাপার!’’

রূপলাল অনেকক্ষণ সেই দিকে তাকিয়ে আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে রইল৷ তারপর থেমে থেমে ধীরে ধীরে বললে, ‘‘এত রক্ত! কিন্তু একটাও বাঘের পায়ের দাগ নেই কেন? এ পায়ের দাগগুলো দেখে মনে হয়, যেন কোনো মানুষের একখানা পা আহত হয়েছে আর সেই আহত পায়ের রক্ত ছড়াতে ছড়াতে সে এ-ঘর থেকে হেঁটে বাইরে বেরিয়ে গিয়েছে৷ বাঘ যদি সেই মেয়েটিকে ধরে নিয়ে যেত, তাহলে তাকে মুখে টেনে-হিঁচড়েই নিয়ে যেত, আর তাহলে এখানে কখনই এমন পায়ের ছাপ পড়ত না!’’

সেই রক্তের দাগ ধরে আমরা বাইরে বেরিয়ে গেলুম৷

এবারে দেখলুম, কাদার উপর দিয়ে একজোড়া মানুষের পায়ের ছাপ বরাবর বনের দিকে চলে গিয়েছে৷

রূপলাল মাথা নেড়ে বললে, ‘‘তুমি ঘুমের ঘোরে স্বপ্ন দেখেছ নিশ্চয়ই৷ সেই মেয়েটি আবার পালিয়েছে৷ বাঘ-টাঘ কিছুই এখানে আসেনি৷’’

আমি দৃঢ়স্বরে বললুম, ‘‘আমি নিজের চোখে বাঘ দেখেছি, নিজের হাতে গুলি করেছি, আর সে নিশ্চয় আহত হয়েছে৷’’

রূপলাল বললে, ‘‘তোমার গুলি খেয়ে বাঘ কি পাখি হয়ে ডানা মেলে আকাশে উড়ে গেল? দরজার সামনে এই কাদামাটি, কিন্তু এখানে বাঘের পায়ের দাগ কোথায়? ঘরের ভিতরে মেয়েটি ছিল, কেবল সে-ই যে বেরিয়ে গেছে তার স্পষ্ট চিহ্ন কাদার উপরে রয়েছে৷ কোনো বাঘ ঘর থেকে বেরোয় নি৷ আমার বোধ হয়, তোমার গুলিতে সেই মেয়েটিই আহত হয়ে পালিয়ে গেছে৷’’

হঠাৎ একটি বিচিত্র সম্ভাবনা আমার মাথার ভিতরে জেগে উঠল৷ তাড়াতাড়ি রূপলালকে টানতে টানতে আবার ঘরের ভিতরে এনে সজোরে দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে সভয়ে আমি বললুম, ‘‘রূপলাল, পৃথিবীর সব দেশের লোকেরই একটা বিশ্বাস আছে, কোনো কোনো বাঘ নাকি আসলে বাঘ নয়! রূপলাল, আজ রাত্রে যে স্ত্রীলোকটা এখানে এসেছিল, সে কে? গুলি করলুম বাঘকে, চিৎকার করলে একটা স্ত্রীলোক—এর মানে কি? সে কে? সে কে?’’

রূপলাল অবাক হয়ে আমার মুখের পানে তাকিয়ে রইল৷ অনেকক্ষণ পরে সে বললে, ‘‘তুমি কি বলতে চাও, তাহলে ওই উড়ে বেয়ারাটার কথাই সত্যি?’’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *