কে শত্রু কে বন্ধু
দোতলা বাসের জানলার ধারে বসবার জায়গা পাওয়া একটা সৌভাগ্যের ব্যাপার। অনেকটা দূরে যেতে হবে। বাসের অল্প আলোয় একটা বই খুলে পড়ছিলাম। কতটা সময় কেটে গেছে খেয়াল করিনি, হঠাৎ চোখ তুলে বাইরে তাকিয়ে দেখি আমার গন্তব্য পেরিয়ে গেছে। রাত প্রায় সাড়ে ন-টা। ব্যস্ত হয়ে বই মুড়ে দাঁড়ালাম। বাসে তখন বেশ ভিড়। আমার সিট ছেড়ে সবেমাত্র বাইরে এসেছি, হঠাৎ আমার চোখে জগৎসংসার অন্ধকার হয়ে গেল, আমি পা দুমড়ে বসে পড়লাম।
উঃ করে একটা আওয়াজ করেছিলাম শুধু। হাত দিয়ে ঢেকে ফেলেছিলাম মুখ, তারপর কয়েকটা মুহূর্ত কিছুই শুনতে পাইনি। চোখেও দেখতে পাচ্ছিলাম না। একটু পরে আচ্ছন্ন ভাবটা কেটে গেল। শুনতে পেলাম, দু-তিনজন লোক জিজ্ঞেস করছে, কী হল মশাই? ও ভাই কী হল? আমি হাত দুটো চোখের সামনে আনলাম। দুহাত ভরা রক্ত।
বছর সাতেক আগের কথা। তখন কলকাতার পথেঘাটে মানুষ খুন করার উৎসবের রেওয়াজ ছিল না। আহত ও নিহত মানুষ দেখলে লোকে ফেলে পালাত না। চলন্ত বাসে অনেক লোক আমাকে ঘিরে ব্যাকুল হয়ে রইল।
আমার যে ঠিক কী হয়েছে, তা আমি নিজেই বুঝতে পারছিলাম না। আমার দুহাত ভরা শুধু রক্ত, আমার মুখ দিয়ে গলগল করে রক্ত পড়ছে—কোনো ব্যথাও তখন টের পাচ্ছি না। লোকজন ধরাধরি করে আমাকে দাঁড় করাল। রক্ত তখনও পড়ছে অনর্গল। অনেকে চিৎকার করে বাস থামাল।
আমাকে কি কেউ জোরে মেরেছে? কিন্তু বাসের কোনো লোক আততায়ীকে দেখেনি। কেউ দুদ্দাড় করে নেমে চলে যায়নি। ব্যাপারটা এমন হঠাৎ হয়েছে যে, আমি ভিড়ের মধ্যে হঠাৎ বসে না পড়লে কেউ লক্ষই করত না।
কোনো কিছুর সঙ্গে ধাক্কা লাগার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। সেখানে সেরকম কিছু নেই।
একজন লোক আমার দিকে মুখ নীচু করে জিজ্ঞেস করল, আপনার নাকে কে এরকম ঘুষি মারল?
আমি রক্তাক্ত মুখ তুলে লোকটিকে দেখতে চাইলাম। রক্তস্রোতে আমার বিস্ময় চাপা পড়েছিল। চোখেও যেন ঘোর লেগেছিল একটু।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, কে?
অনেকগুলি কণ্ঠ প্রশ্ন করলো, কে? কে? কে? কে?
উত্তর নেই।
কে মেরেছে, কেউ ঠিক বলতে পারছে না। একজনের হাত আমার মুখের সামনে বিদ্যুৎগতিতে এগিয়ে আসতে দেখেছে। হয়তো সেই হাতে কঠিন কোনো জিনিস ছিল। খালি হাতে এতটা আঘাত লাগার কথা নয়। যে মেরেছে সে হয়তো এখনও বাসের দোতলাতেই রয়েছে।
দুর্ঘটনা নয়। কেউ আমাকে মেরেছে, এটা শুনেই আমার ব্যথা বোধ হতে শুরু করল। অসম্ভব তীব্র ব্যথা।
আপনি কোথায় যাবেন?
আমি এখানেই নামব।
নিজে নামতে পারবেন?
আমি এবার সোজা হয়ে চারদিক তাকালাম। অনেকেই আমার দিকে তাকিয়ে আছে, সবারই মুখ বন্ধুর মতন। যন্ত্রণা অনেকটা কমে গেল।
আমি নামবার জন্য সিঁড়ির দিকে পা বাড়িয়েছি, একজন লোক বললেন, দাঁড়ান আমি ধরছি আপনাকে।
কারুর সাহায্য নিতে আমার লজ্জা করে। অথচ উপকারী মানুষের প্রতি রূঢ় ব্যবহার করাও যায় না। কোনো রকমে বললাম, ঠিক আছে—
তবু তিনি আমার হাত ধরলেন। তার সঙ্গে নামতে লাগলাম। তখন একটি রিনরিনে কণ্ঠস্বর বলে উঠল, আপনার বইটা? বইটা যে রয়ে গেল।
ময়ূরকণ্ঠী শাড়ি পরা একটি তেইশ-চবিবশ বছরের মেয়ে, মোটামুটি সুশ্রী এবং সপ্রতিভ। বইটা বাড়িয়ে ধরেছে আমার দিকে।
আমি মুখে ধন্যবাদ না জানিয়ে শুধু কৃতজ্ঞতার ভাব দেখিয়ে বইটা নিলাম। বইটা হারালে খুব মুশকিল হত, লাইব্রেরি থেকে আনা।
মেয়েটি জিজ্ঞেস করল, আপনাকে কে মারল?
এমনিতে এরকম একটি অচেনা যুবতী মেয়ে আমার সঙ্গে যেচে কথা বলত না। আমার রক্তমাখা মুখ দেখে ওর মনে বুঝি দয়া হয়েছে।
আমি বললাম, পৃথিবীতে আমার কোনো শত্রু নেই।
মেয়েটি বোধহয় এরকম কোনো উত্তর আশা করেনি। তাই আমার কথা শুনে সে একটু হেসে ফেলল হঠাৎ। রক্তাক্ত চেহারার মানুষকে দেখে কেউ হাসে না।
বাস এর আগেই চলতে শুরু করেছে। আমাকে নামতে হবে পরের স্টপে। মেয়েটির প্রশ্ন ও চিন্তা আমার মধ্যে নতুন করে সাড়া জাগায়। কে আমাকে মারল? কী দোষ আমি করেছি? হঠাৎ লেগে যাবার ব্যাপারও নয়, এত জোরে লেগেছে। কেউ যদি সামনাসামনি কোনো অভিযোগ জানাত, ঝগড়া করত, আচমকা মেরে বসত, তাহলেও না হয় মানে বুঝতাম। কাপুরুষের মতোই আত্মগোপন করে কেন মারল আমাকে? কোনো কাপুরুষের সঙ্গে আমার শত্রুতা থাকার প্রশ্নই ওঠে না।
বাসটি ততক্ষণ চলতে শুরু করেছে। যে ভদ্রলোক আমার হাত ধরে নামাচ্ছিলেন তিনি বললেন রোককে। রোককে।
বাস তবু থামল না। তিনি আরও জোর গলায় বললেন, রোককে। দেখছেন না অ্যাকসিডেন্ট।
ভদ্রলোক ব্যাপারটাকে নাটকীয় করতে চান। যন্ত্রণার মধ্যেও আমার লজ্জা হয়। আমাকে কেন্দ্র করে কোনো নাটকীয় ব্যাপার আমি পছন্দ করি না। অনেক লোক একসঙ্গে আমার দিকে তাকালে আমার শরীর কুঁকড়ে যায়।
একতলার কিছু লোক ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল। কেউই খুব একটা কৌতূহল দেখাল না। কন্ডাক্টর দুজনই নীচতলায় গল্প করছিল, তারা এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে? আমি তাদের কোনো উত্তর দিলাম না। বাস থামতেই নেমে পড়লাম।
যন্ত্রণায় তখনও আমার মাথা ঝিমঝিম করছে। শরীরের কোনো জায়গার বদলে নাকে লেগেছে বলেই ব্যথাটা এত বেশি। রক্ত বন্ধ হয়নি তখনও। আমার প্রথমেই চিন্তা হল, রক্তটা বন্ধ করা দরকার।
অধিকাংশ দোকানপাটই বন্ধ হয়ে গেছে। কাছাকাছি কোনো ডাক্তারখানা নেই।
আমার সঙ্গী ভদ্রলোক বললেন, একটু হাঁটতে পারবেন? আমহার্স্ট স্ট্রিটের কাছে একটা ডাক্তারখানা আছে।
আমি কাছেই একটা টিউবওয়েল দেখতে পেলাম। বললাম, আগে রক্তটা ধুয়ে নিই। আমার জামায় রক্ত, রুমালটা জবজবে ভিজে , প্যান্টে, এমনকি জুতোতেও রক্তের ফোঁটা পড়েছে। এই অবস্থায় রাস্তা দিয়ে হাঁটা যায় না।
ভদ্রলোক পাম্প করতে লাগলেন, আমি জল দিয়ে ধুতে লাগলাম। ঠান্ডা জলের স্পর্শে খানিকটা ভালোই লাগল। যেন অজানা কারুর স্নেহের মতন। নাকের মধ্যে জলের ঝাপটা দিলেও রক্ত বন্ধ হতে চায় না।
সেই অবস্থায় হঠাৎ আমার মনে পড়ল, একটু আগে বাসে দেখা মযূরকণ্ঠী শাড়ি পরা সেই মেয়েটির কথা, যে আসলে বইটা ফেরত দিয়েছিল। মেয়েটির মুখখানা খুব চেনা মনে হয়, যদিও একথাও ঠিক, ওকে আমি আগে কখনও দেখিনি। কারুর কারুর ক্ষেত্রে হয় এরকম—একবার দেখলেই মনে হয় অনেকদিনের চেনা। কিন্তু মেয়েটি হাসল কেন? আমার দুরবস্থা দেখে ওর কি হাসা উচিত? আমি এতই অপমানিত বোধ করলাম যে, আমার কান্না এসে গেল। তখন আমি চোখেমুখে জলের ছিটে দিচ্ছি, কেউ আমার কান্না বুঝবে না।
ভদ্রলোক বললেন, কমেছে?
আমি বললাম, অনেকটা। কিন্তু আপনি আমার জন্য কষ্ট করে নামলেন এখানে—
না, আমারও এখানেই নামবার কথা। কাছেই বাড়ি। আপনি কোথায় যাবেন?
আমি এখান থেকে থ্রি-বি বাস ধরব।
এক্ষুনি বাসে উঠতে পারবেন? শরীর দুর্বল লাগবে না?
না, চলে যাবো ঠিক।
আপনার যদি খুব তাড়া না থাকে, তাহলে আমাদের বাড়িতে একবার আসবেন? একটু বসে, তারপর চলে যেতেন। খুব কাছেই আমার বাড়ি।
না, না, শুধু শুধু আপনাকে বিব্রত করতে চাই না। আপনি এমনিতে আমায় যা সাহায্য করলেন—।
আরে মশাই, চলুন, অত ভদ্রতা করছেন কেন! আসুন, একটু কফি খেয়ে যাবেন।
বড়ো রাস্তার অদূরে গলির মধ্যে ভদ্রলোকের বাড়ি। ইতিমধ্যে নাম জেনে নিয়েছি। ওঁর নাম অনুপম সরকার, এক সরকারি অফিসের লাইব্রেরিয়ান।
সদর দরজা খোলাই ছিল। অন্ধকার, সরু সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে অনুপমবাবু বললেন, একটু সাবধানে উঠবেন, আবার যেন ধাক্কাটাক্কা না লাগে।
আমি নাকের ওপর হাত চাপা দিয়ে রেখেছিলাম। অন্য যে জায়গায় লাগে লাগুক, আবার নাকে লাগলে আমি এবার ঠিক অজ্ঞান হয়ে যাব।
নিস্তব্ধ বাড়ি। সিঁড়ি দিয়ে একতলা, দোতলা, তিনতলা পার হয়ে গিয়েও অনুপমবাবু থামলেন না। আমার একটু একটু অস্বস্তি হতে লাগল। কোথায় চলেছি? এত রাত্রে একজন সম্পূর্ণ অচেনা লোকের সঙ্গে এখানে না আসাই উচিত ছিল।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, ক-তলায়?
অনুপমবাবু আমার হাত চেপে ধরে বললেন, আসুন না!
হঠাৎ আমি অন্য একটা কথা ভাবলাম। এই লোকটার মতলব কী? আসলে কোথায় নিয়ে যাবে? এই লোকটাই আসলে মারেনি তো? এখন আমাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে আবার নিয়ে যাচ্ছে আরও কঠিন শাস্তি দেবার জন্য?
যদিও লোকটিকে আমি জীবনে কখনও দেখিনি, এর সঙ্গে আমার শত্রুতা থাকার কোনো কারণ নেই। তবু পৃথিবীতে অনেক অসম্ভব ব্যাপার ঘটে।
আমি থমকে দাঁড়ালাম। ভদ্রলোক সবলে আমার হাত চেপে ধরে বললেন, আরে মশাই, লজ্জা পাচ্ছেন কেন! আসুন।
গলার আওয়াজ পেয়েই বোধহয় দরজা খুলে গেল। একজন মহিলা সেখানে দাঁড়িয়ে, কুচকুচে কালো রং, স্নিগ্ধ মুখখানা, এক মাথা চুল। অন্ধকারের মধ্যে ভদ্রমহিলা প্রথমে আমাকে দেখতে পাননি, হঠাৎ দেখতে পেয়ে মুখ দিয়ে একটা আর্ত শব্দ করলেন—তারপরই ছুটে ঘরের মধ্যে কোথায় চলে গেলেন।
অনুপমবাবু হেসে আমাকে বললেন, আসুন।
আমার পক্ষে অত্যন্ত অস্বস্তিকর পরিস্থিতি। কিন্তু এখন আর ঘরের মধ্যে না গিয়ে উপায় নেই।
বিরাট খাটের ওপর দুটি বাচ্চা ঘুমুচ্ছে। ভদ্রমহিলা সেখানে নেই। ঘরে একটিমাত্র চেয়ার। অনুপমবাবু আমাকে বললেন, এই চেয়ারটায় বসুন। দাঁড়িয়ে রইলেন কেন?
বসলাম। দূরে একটা ড্রেসিং ট্রেবিলের আয়নায় দেখতে পেলাম আমার চেহারা। এমন বিসদৃশ এবং বোকা ভঙ্গিতে কোনো মানুষকে বসে থাকতে আমি এর আগে দেখিনি।
একটু বাদেই মহিলা ফিরে এলেন এ ঘরে। নিজের স্বামীর সঙ্গে কোনো কথা বলার আগেই জিজ্ঞেস করলেন, কী হয়েছে?
আমার বদলে ওঁর স্বামীই বললেন, ভদ্রলোক বাসে আসছিলেন, হঠাৎ কী যে হল, অদ্ভুত ব্যাপার—
আমি বাধা দিয়ে বললাম, হঠাৎ লেগে গেছে।
উনি বললেন, না। কে যেন মেরেছে।
কে মেরেছে?
তা তো জানি না।
ভদ্রমহিলা আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বললেন, ছিঃ, মারামারি করতে নেই। মানুষের সঙ্গে মারামারি করে কী লাভ!
এতক্ষণ বাদে আমার হাসি পেল। উনি ধরেই নিয়েছেন, আমি মারামারি করেছি। এই রকমই হয় বোধহয়। এক পক্ষের আঘাতে কি রক্তপাত হয় এতটা?
আমি বললাম, না, মারামারির ব্যাপারই নয়। আমার বোধহয় ধাক্কা-টাক্কা লেগেছে কোথাও। এত রাত্রে আপনাদের খুব বিব্রত করলাম। আমি এবার চলি?
অনুপমবাবু বললেন, কি ওঁকে এই অবস্থায় যেতে দেওয়া যায়?
মহিলা বললেন, না, আজ আর যাবার দরকার নেই। আপনি আজ এখানেই থেকে যান না। কোনো রকমে জায়গা হয়ে যাবে।
আমি তৎক্ষণাৎ উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, না, না, তার কোনো দরকার নেই। আমাকে বাড়ি ফিরতে হবে।
মহিলা বললেন, ঠিক আছে, একটু পরে যাবেন। এক্ষুনি ওঠবার দরকার নেই।
অনুপমবাবু আবার হাসতে হাসতে বললেন, করবী তুমি প্রথমে ওঁকে দেখেই পালিয়ে গেলে কেন? ভয় পেয়েছিলে?
অনুপমের স্ত্রীর নাম করবী। এই কথাটায় খুবই লজ্জা পেয়ে গেলেন কেন প্রথমে বুঝতে পারিনি। খুব নীচু করে বললেন, না, ভয় পাইনি।
এখন বুঝতে পারলাম। ভদ্রমহিলা গায়ে ব্লাউজ পরে ছিলেন না তখন। শোওয়ার জন্য তৈরি হয়েছিলেন। অচেনা পুরুষ দেখে তাই তাড়াতাড়ি পোশাক ঠিক করতে গিয়েছিলেন।
করবীর বয়স তিরিশের কাছাকাছি। আর একবার ওঁর দিকে তাকিয়ে মনে হল, এরকম সুন্দরী নারী আমি খুব কম দেখেছি। মুখের মধ্যে একটা কমনীয় ভাব, শান্ত দৃষ্টি, এই নারী বোধহয় পৃথিবীতে কোনো পাপের কথা জানে না।
পুরো ব্যাপারটাই আমার কাছে বেশ রহস্যময় লাগছিল গোড়া থেকে। ভদ্রলোক আমাকে ডেকে আনলেনই বা কেন, আজ তিনি আমাকে আর থাকবার জন্য পেড়াপীড়ি করলেনই বা কেন। ঘরদোরের চেহারা দেখলেই বোঝা যায়, এদের অবস্থা সচ্ছল নয়।
করবী আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, নাকের ওপর দুটো নখের দাগ বসে গেছে। কেউ খুব জোরে মেরেছে। ভীষণ লেগেছিল তাই না? উঃ! খুব লেগেছিল?
আমি দেখলাম, করবীর চোখে জল। আমার বিস্ময় বুকের মধ্যে আরও লাফিয়ে উঠল। উনি কাঁদছেন আমার কষ্টের কথা ভেবে! এরকম কখনও হয়?
আমি বললাম, না। ততটা লাগেনি।
করবী চোখ মুছলেন। আবার লজ্জিত মুখে বললেন, আপনি একটু বসুন। আমি এক্ষুনি আসছি।
আমি অসহায়ভাবে অনুপমবাবুকে বললাম, আমাকে এবার সত্যি চলে যেতে হবে। আপনার নিশ্চয়ই এখনও খাওয়াদাওয়া হয়নি।
অনুপমবাবু বললেন, দাঁড়ান করবীকে না বলে তো যেতে পারবেন না। ওকে এখনও চেনেননি আপনি।
প্রতি মুহূর্তেই আমার সন্দেহ হচ্ছিল, এদের বুঝি কিছু একটা মতলব আছে আমাকে নিয়ে। যদিও তার সঙ্গে করবীর চোখের জল ফেলাটা মেলাতে পারছি না। করবী ফিরে এল এককাপ দুধ আর একবাটি গরমজল নিয়ে। দুধটা আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, এটা খেয়ে নিন! অনেকখানি রক্ত বেরিয়েছে তো।
আমি লাফিয়ে উঠলাম। অসম্ভব। এদের আর্থিক অবস্থা ভালো নয়। দুটো বাচ্চা রয়েছে—এদের দুধ আমি খাব কেন? কলকাতায় এইসব পরিবারে যে অঢেল দুধ থাকে না, তা আমি জানি।
আমি কিছুতেই খাব না। ওরাও দুজন মিলে আমাকে দারুণ পেড়াপীড়ি করতে লাগলেন। করবীর গলায় হুকুমের সুর। এই দুধের মধ্যে বিষ মেশানো নেই তো? কিংবা ঘুমের ওষুধ?
শেষ পর্যন্ত ওদের জোরাজুরিতে অতিষ্ঠ হয়ে রীতিমতন বিরক্ত মুখে এক চুমুকে খেয়ে ফেললাম সবটা দুধ। কোনো প্রতিক্রিয়া হল না।
করবী বললেন, এবার চুপটি করে বসুন। আমি ওই জায়গাটা মুছে দিচ্ছি গরমজল দিয়ে।
আমার আর প্রতিবাদ করবারও ক্ষমতা নেই। যা হয় হোক। হাত-পা ছড়িয়ে বসে রইলাম চুপ করে। উনি গরমজলে তুলো ভিজিয়ে খুব যত্ন করে মুছে দিতে লাগলেন আমার ক্ষত। সস্নেহে বার বার জিজ্ঞেস করতে লাগলেন, লাগছে না তো! ব্যথা লাগছে না? এবার একটু ডেটল লাগিয়ে দিই? তাহলে আর ভয় নেই।
আমার মুখের খুব কাছেই করবীর মুখ। কী বড়ো দুটি চোখ, আঙুলগুলো যেন করুণা মাখা। আমার চোখ বুজে আসছিল বার বার। আমি কি স্বপ্ন দেখছি? এ সব হচ্ছে কী? যাদের বিন্দুমাত্র চিনি না—তারা আমাকে এ রকম যত্ন করছে কেন?
করবীর অনুরোধে আমাকে জামাটাও খুলে ফেলতে হল। মেয়েদের সামনে আমি কোনোদিন জামা খুলি না—কিন্তু আমার কোনো ওজরই টিকল না। করবী সেই জামাটা বাথরুমে নিয়ে ভিজিয়ে দিয়ে, আমাকে ওঁর স্বামীর একটা শার্ট পরতে দিলেন। বলতে লাগলেন, বাড়িতে ওরকম রক্তমাখা জামা পরে গেলে বাড়ির লোক ভয় পেয়ে যাবে।
প্রায় এক ঘন্টা ধরে করবীর সেবা নেবার পর আমি সত্যিই একসময় বিদায় নিলাম। করবী তাঁর স্বামীকে হুকুম করলেন, আমাকে সঙ্গে নিয়ে বাসে তুলে দিয়ে আসবার জন্য। অনুপমবাবু আমার শেষ আপত্তি সত্ত্বেও বেরিয়ে এলেন রাস্তায়।
গোড়া থেকে আমি কত রকম সন্দেহ করছিলাম, কিন্তু খারাপ কিছুই ঘটল না তো। শুধু সেবা আর যত্ন। রাস্তায় বেরিয়ে কিছুটা আসবার পর আমার মনে পড়ল, করবীকে সে রকম কোনো কৃতজ্ঞতা জানানো হল না তো।
অনুপমবাবুকে বললাম, আপনার স্ত্রী যা করলেন।
অনুপমবাবু বললেন, করবী বড্ড ভালো, জানেন। ওর মতন মেয়ে হয় না। নিজের স্ত্রী বলেই বলছি না।
সে তো নিশ্চয়ই।
আর একটু মিশলে দেখবেন, পৃথিবীতে এ যুগে এ রকম মেয়ে হয় না। যে-কোনো মানুষ দুঃখকষ্ট পেলে ও এত দুঃখ পায়—
সত্যি এ যুগে এরকম মেয়ে—
আমার মতন একজন গরিবের সঙ্গে বিয়ে হয়েছে, সারাদিন খাটাখাটনি করে, বাইরে বেরুতে পারে না—তবু আমার ইচ্ছে হয় কী জানেন, বাইরের লোককে ডেকে ডেকে দেখাই। সবাইকে বলি, দেখো, এ যুগেও এরকম মেয়ে আছে। তাই আপনাকে আজ নিয়ে এলাম।
আজ রাত্তিরের সমস্ত ঘটনাটাই রহস্যময়। কেন বাসে একজন মারল? তারপর কীরকমভাবে এরকম একটি পরিবারের সঙ্গে পরিচয় হল। যাদের কাজ হচ্ছে, বিনা কারণে উপকার করা। সম্পূর্ণ বিপরীত এই অভিজ্ঞতা।
পরক্ষণে আবার মনে পড়ল আমার আততায়ী তো আমার কোনো ক্ষতি করতে পারেনি। তার জন্যই অনুপম আর করবীর সঙ্গে আমার পরিচয় হল। আমার লাভের পরিমাণটা অনেক বেশি। আততায়ীকে এ কথাটা জানানো দরকার।