কে মা তুমি?
উৎক্ষিপ্ত, বিভ্রান্ত, বিস্রস্ত, যখন মনে হয়—এইবার কাঠের বিছানায়, কাঠের বালিশ মাথায় দিয়ে লকলকে আগুনে বিশুদ্ধ হয়ে ঘুমিয়ে পড়ি, তখন ভারী মিষ্টি একটা কণ্ঠস্বর শুনতে পাই—’বাবা!’
কে মা তুমি? বৃক্ষতলে, শুভ্রবসনে?
‘তোমাদের ঠাকুর বলতেন—সারদা, সরস্বতী। তোমাদের কাছে আমার একমাত্র পরিচয়—আমি মা।
মা, তুমি আমার ভিতরে প্রবেশ কর মা। তোমার খুব কষ্ট হবে মা। দমবন্ধ হয়ে যাবে। কোন বাতাস নেই। বহুকালের না-মাজা চায়ের কেটলির মতো ভিতরটা। সেখানে কি তুমি আসবে মা?
‘বাবা! আমার তিনটে কাজ। সেবা, মাজা আর সেদ্ধ করা। এই তিনটি তিনি আমাকে শিখিয়ে গেছেন। আর আমাকে বসিয়ে দিয়ে গেছেন সহ্যশক্তির ওপর। বাবা! কত বাসন মেজেছি, কত ধান সেদ্ধ করেছি! আর সেবা! সেবা তো আমার স্বভাব! তিনি নরেনকে রাখলেন বড় সেবার জন্য—”শিবজ্ঞানে জীবসেবা”। সেই সেবার জন্যে মঠ, মিশন, সন্ন্যাসী সন্তানের দল। আমার জন্য রেখে গেলেন সংসার। ক্ষতবিক্ষত যত সংসারী। সারদা! তুমি তাদের যন্ত্রণার অংশীদার হও। তাদের পাশে দাঁড়িয়ে তাদের সঙ্গে তুমিও সহ্য কর। যন্ত্রণার একমাত্র দাওয়াই সহ্যশক্তি। সারদা! আমার শেষ এবং শ্রেষ্ঠ সাধন হলো— যন্ত্রণা। এবার আর পঞ্চবটী নয়। শ্যামপুকুর আর কাশীপুর। শিব-কৃষ্ণ, ক্যান্সারের ক্ষতে জ্বলছি রামকৃষ্ণ। পাশে কে? একেবারে পাশটিতে কপালে হাত রেখে? তুমি। তুমি সারদা। নরেন্দ্রের জ্যান্ত দুর্গা। আমার জীবন্ত কালী। রামকৃষ্ণ কে, বলো তো সারদা! শ্মশান। চিতা সাজিয়ে বসেছি। মহাশ্মশান, অনির্বাণ অগ্নি। ‘আমি’ এস। পুড়ে, দগ্ধ হয়ে ‘তুমি’ হয়ে ফিরে যাও। এরই নাম রামকৃষ্ণের দীক্ষা। আমি কসাই। সংসারের জোয়াল ঘাড়ে বলদগুলোকে ‘অকারণ’ চাষের মাঠ থেকে ‘কারণ’ কর্ষণক্ষেত্রে আকর্ষণ করে আনি। হাম্বা, হাম্বা—সে-রব আর থামে না। মার ব্যাটাকে। অন্ত্রকে টেনে বের করে শুকিয়ে ধুনুরির যন্ত্রে। প্রতিটি টঙ্কারে তখন তুঁহু, তুঁহু। অন্ত্রই তো অন্তর। অন্তরই মানুষের অহঙ্কারের পীঠস্থান। শিশ্নোদরপরায়ণ যত জীব অহঙ্কারের টঙ্কারে নিজের অস্তিত্ব ঘোষণা করে। সংসারের জোয়াল টানতে টানতে পালা ফুরিয়ে যায়। বেকার জীবনের শূন্যতায় বিস্ফারিত চোখে চিৎ হয়ে পড়ে থাকে। ঈশ্বরের হিসাবে এরা সব খুচরো পয়সা। কলাইয়ের ডালের কারবারী। চোগা- চাপকান যাই থাক। আসলে এরা ব্যর্থ ব্যবসায়ী। পৃথিবী বেচাকেনারই জায়গা। কেউ আলুপটল বেচে দুটো পয়সা রোজগার করে সেই কাঞ্চনের নেশাতেই বুঁদ হয়ে থাকে। বুদ্ধিমান ব্যবসায়ী অজ্ঞান বেচে জ্ঞানলাভ করে। অনিত্য ছেড়ে নিত্যের কারবারী হয়। মার খেতে খেতে, হারতে হারতে, হারাতে, হারাতে, টল থেকে অটলে এসে বুঝে যায় বেদান্তের সার—জগৎ মিথ্যা। তার বুদ্ধি জলের ওপর তৈলবিন্দুর মতো প্রসারলাভ করে—”তস্য বিস্তারিতা বুদ্ধিস্তৈলবিন্দুরিবাম্বসি”। প্রকৃত জ্ঞানী জানেন, শান্তিলাভের একটিই উপায়—
“চন্দনং শীতলং লোকে চন্দনাদপি চন্দ্ৰমাঃ।
তাভ্যাং চন্দনচন্দ্রাভ্যাং শীতলঃ সাধুসঙ্গম।।” (দ্রঃ পূর্ণচন্দ্র দে কাব্যরত্ন সঙ্কলিত ‘উদ্ভটশ্লোকসংগ্রহ’)
—পৃথিবীতে চন্দন অতি শীতল পদার্থ, চন্দনের চেয়েও শীতল হলো চন্দ্রালোক। আর সেই চন্দন আর চন্দ্রের চেয়েও শীতল হলো সাধুসঙ্গ।
‘শোন, সাধু হলো গেরুয়া রঙের আগুন। সেই আগুনে পুড়লে মন শীতল হয়। মন কিরকম? সদাসর্বদা চড়বড় করছে। বোলতার মতো, ভীমরুলের মতো দেহীকে অনবরত দংশন করছে। সাধুর আগুনে সব কীট পুড়ে যায়। সব ব্রণ শুকিয়ে যায়।
‘যারা আমার কাছে এসেছে, তাদের সকলকেই আমি বলেছি—মৃত্যুকে মনে রেখো, তাহলেই তোমার ‘হাম্বা রোগ’ কমে আসবে গো।
“অশনং মে বসনং মে জায়া মে বন্ধুবর্গো মে।
ইতি ‘মে-মে’ কুৰ্বাণং কালবৃকো হন্তি পুরুষাজম্।।” (দ্রঃ ঐ)
—এই আমার ভোগ্য, এই আমার বসন, এই তো আমার জায়া, এই যে আমার আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবর্গ। ‘পুরুষাজম্’–ব্যাটা ছাগল, ‘মে-মে’–আমার, আমার করছিস! পিছনে তাকা—’কালবৃকঃ’–কালরূপ ব্যাঘ্র জিভ চাটছে। ঘ্যাক করে তোকে ধরবে, তখন বলবি—অন্তিম ‘মে-মে’। সেটি হলো—’মা, মা’!
‘কিন্তু কাল অন্য কথা সোচ্চারে স্লোগানের মতো বলে যাচ্ছে—টাকা, টাকা, ভোগ, ভোগ! বলছে—
“ন নরস্য নরো দাসো দাসশ্চার্থস্য সর্বদা।
গৌরবং লাঘবং বাপি ধনাধননিবন্ধনম্।।” (দ্রঃ ঐ)
—মানুষ কি মানুষের দাস? সর্বকালে মানুষ অর্থেরই দাস। ধনই মানুষকে সম্মানীয় করে। ধনহীনের কোন সম্মান নেই। তাকে সবাই দূর দূর করে তাড়ায়। অর্থ থাকলেই যেকোন মানুষকে ক্রয় করা যায়। অর্থহীন মানুষ অন্যের দ্বারা ক্রীত হতে পারে। কোন গুণ নেই কিন্তু টাকার মালিক, তার কি খাতির, কি সম্মান! আবার বহু গুণের অধিকারী কিন্তু গরিব, তাঁকে কেউ সম্মান করবে না।
‘বাবা! তোমাদের ঠাকুর কি ছিল? লাখোপতি? তিনখানা বাড়ি! বিলিতি গাড়ি! অথচ দেখছ তো, সারা পৃথিবীর মানুষ তাঁকে জুতো খুলে প্রণাম করে! যারা করে না, তারা একটু ভড়কে যায়—রাজনীতির হাতল ঘোরাচ্ছি, মানুষের মাথা কাটছি, টাকার পাহাড় তৈরি করছি, হুঙ্কারে নিজেরাই চমকে যাচ্ছি; কিন্তু? কে ঐ মানুষটা? ছোট্ট একটা ছবি! ঠোঁটের কোণে অদ্ভুত এক হাসি। চোখ দুটো আধখোলা, তবু কী আকর্ষণ! কে ঐ মানুষ? যাঁর সামনে মহা মহা রথীরা নতজানু! বাবা! ঠাকুর যার মধ্যে একবার ঢুকেছেন, সে এই জগতের বাইরে চলে যায়। কিরকম জান? যেন বেড়ার ওধার থেকে এধার দেখা! কিরকম জান? যেন বেড়াতে এসেছে। কি গো, মেয়েটা কাঁদছে কেন? বুকে যে সর্দি বসেছে! দাঁড়াও, কি করা যায় দেখি! কি গো, তোমাদের কিসের ঝগড়া? ছোরা-ছুরি বেরিয়েছে? ও, সম্পত্তির বখরা! দাঁড়াও, এই ছবিটা দেখ। এঁর নাম শ্রীরামকৃষ্ণ। এই মহামানব বলেছিলেন, ভগবান দুবার হাসেন। একবার, যখন মানুষ এইরকম করে—জমি নিয়ে ছেঁড়াছেঁড়ি। পৃথিবীটা কারুর বাপের সম্পত্তি নয় হে! ভগবানের জমিদারি। যখন মরবে তখন কি এই দুকাঠা চার ছটাক জমি গোল করে গুটিয়ে মাদুরের মতো বগলে নিয়ে ওপরে যাবে?
‘ঠাকুর ভিতরে থাকলে, সে ঠাকুরকে নিয়ে বাইরে থাকতে বাধ্য। সে পারবে না, অন্য আর কিছু ভাবতেই পারবে না। এই যে দেখছ কপাল! নহবতের দরজাটা এত ছোট ছিল, ঢুকতে বেরতে কপাল ঠুকে যেত! মাঝেমধ্যে কেটেও যেত। শেষে অভ্যাস হয়ে গেল। এই একটি শব্দ পেলে— অভ্যাস। নহবত মানে সংসার। তোমাদের ঠাকুরের সংসার। সংসার মানুষেরই হোক আর ঠাকুরেরই হোক, সংসার খুব ছোট জায়গা, ঢোকার সময় খাটো হতে হয়। কুঁকড়ে থাকতে হয়।
‘ঠাকুর আমার জন্য দুপাশে দুটি রাখলেন, ব্যবধান মাত্র কুড়ি হাত। এদিকে অসীমের, অনন্তের লীলা-সেখানে ঠাকুর। ওদিকে সসীম, মায়ার সংসার। শোন বাবা, তোমাদের ঠাকুর খুব চালাক ছিলেন, ঐ যে বলতেন—
“এই সংসার মজার কুটি, আমি খাই দাই আর মজা লুটি
জনক রাজা মহাতেজা তার বা কিসে ছিল ত্রুটি।
সে যে এদিক-ওদিক দুদিক রেখে, খেয়েছিল দুধের বাটি।”
‘তোমাদের ঠাকুর ছিলেন সাক্ষাৎ জনকরাজা। নির্জনে, গোপনে সাধন- ভজন করে নিজেকে আগে জেনে নিলেন। ঐ যে বলতেন না ভূতকে জানলে ভূতের ভয় আর থাকে না। মায়াকে জানলে সংসারের পিছনে কে আছে জানা যায়। তিনি আছেন। সবই তাঁর খেলা। হাতে তেল মেখে কাঁঠাল ভাঙা। কর্মফলে এসে যখন পড়েছ মানুষ, আনন্দে বাঁচ। আনন্দের সুসমাচার আছে ঈশ্বরের কাছে। তাঁকে ধরলে সংসারের আর কোন কিছু তোমাকে ধরতে পারবে না। তোমাদের ঠাকুর আমার মধ্যে আনন্দের একটি পূর্ণয়ট বসিয়ে দিয়ে গেলেন। সদা উৎসবের মধ্যে রেখে গেলেন। এই নবতে তখন দিনরাত রান্নাই চলেছে। তখন সারদার ধর্ম হলো রন্ধনকর্ম। এই হয়তো রাম দত্ত এল, গাড়ি থেকে নেমেই বলছে : “আজ ছোলার ডাল আর রুটি খাব।” আমি শুনতে পেয়েই চাপিয়ে দিতুম। তিন-চার সের ময়দার রুটি হতো। রাখাল থাকত, তার জন্য প্রায়ই খিচুড়ি হতো। কলকাতা হতে সব মোটাসোটা মেয়েলোকেরা দেখতে যেত, আর দরজার দুদিকে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে বলত : “আহা, কি ঘরেই আমাদের সতীলক্ষ্মী আছেন গো—যেন বনবাস গো!”
‘আজ তুমি আমার ছবির সামনে বসে তোমার দুঃখের কথা শোনাচ্ছ। তোমার সব আছে। শোওয়ার ঘর, খাট-পালঙ্ক। জোড়া বাথরুম। গরমজলের কল। ঢুকু ঢুকু চা, চুটকি বিস্কুট। কানের কাছে গান। চোখের সামনে ছবির বাক্স। শোন বাবা, তোমার এই মা ছবির পাটরানী নয়—মাঠের সারদা, জলে ভেজা, রোদে পোড়া সারদা। রাত চারটায় নাইতুম। দিনের বেলায় বৈকালে সিঁড়িতে একটু রোদ পড়ত, তাইতে চুল শুকাতুম। তখন মাথায় অনেক চুল ছিল। নবতের নিচে একটুখানি ঘর, তা আবার জিনিসপত্রে ভরা। ওপরে সব শিকে ঝুলছে। রাত্রে শুয়েছি, মাথার ওপর মাছের হাঁড়ি কলকল করছে— ঠাকুরের জন্য শিঙ্গি মাছের ঝোল হতো কিনা। শৌচের আর নাওয়ার জন্যই যা কষ্ট হতো। বেগধারণ করে করে শেষে পেটের রোগ ধরে গিয়েছিল। দিনের বেলায় দরকার হলে রাত্রে যেতে পারতুম—গঙ্গার ধারে অন্ধকারে। কেবল বলতুম, ‘হরি হরি, একবার শৌচে যেতে পারতুম!’
‘এইবার আরো একটু শুনে যাও বাবা—ছবির মায়ের মুখে জ্যান্ত মায়ের কথা। ঠাকুর রামলালকে কাশীপুরে বললেন : “তুই ভবতারিণীর সেবা করবি, তাহলে তোর অভাব থাকবে না।” আর আমাকে বললেন : “তুমি কামারপুকুরে থেক, আর লক্ষ্মীর দিকে একটু নজর রেখ। ওকে খেতে দিতে হবে না। তবে সে যেন বাড়ি থেকে কোথাও না যায়। আমাকে ভক্তেরা যেমন ভক্তি করছে, তোমাকেও তেমনি ভক্তি করবে।” পরে আবার রামলালকে বললেন : “দ্যাখ, তোর খুড়ী যেন কামারপুকুরে থাকে।” তাতে রামলালের উত্তর : “ওঁর যেখানে ইচ্ছে হবে সেখানে থাকবেন।” তোমাদের ঠাকুর এই উত্তরের তাৎপর্য বুঝলেন।
‘এবার শোন, সংসারের চালচিত্রটা কেমন। রামলাল আমার গ্রাসাচ্ছাদনের কোন চেষ্টা করা দূরে থাক, ত্রৈলোক্যবাবুকে বোঝালেন, দলে দীনু খাজাঞ্চিও আছেন—উনি ভক্তদের কাছ থেকে যথেষ্ট টাকা পান, নিঃসন্তান বিধবার আর কি প্রয়োজন! এস্টেট থেকে যে-সাতটাকা দেওয়া হয়, বন্ধ করে দিন। বন্ধ হয়ে গেল টাকা। নরেনের শত অনুরোধেও কোন কাজ হলো না।
‘কিন্তু বাবা, আমি যে অমন সোনার মানুষকে দেখেছি! ঐ কয়েকটা টাকার কি মূল্য? লক্ষ-কোটি টাকারই বা কি মূল্য? দুঃখ? কিসের দুঃখ বাবা! শোন বাবা, ঠাকুরের পাঠশালায় যে পাঠ নিয়েছে তার আবার দুঃখ কিসের?’
দুঃখের রঙ পাকা, সুখের রঙ কাঁচা। তাই আমার মা আজো জ্বলজ্বল করছেন।