কে তুমি বিবেকানন্দ
দক্ষিণেশ্বরে দেবালয়ের পাশেই যদু মল্লিকের বাগানবাড়ি। ঠাকুর দাঁড়িয়ে আছেন, পাশেই তাঁর অন্যতম ভক্ত শরৎচন্দ্র (পরবর্তী কালে স্বামী সারদানন্দ)। ঠাকুরের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন বাগানের ম্যানেজার রতনবাবু। ঠাকুর রতনকে বলছেন : “জান তো, এরা সব ছেলে মন্দ নয়—দেড়টা পাস করেছে—শিষ্ট, শান্ত; কিন্তু নরেন্দ্রের মতো একটি ছেলেও আর দেখতে পেলুম না। যেমন গাইতে বাজাতে, তেমনি লেখাপড়ায়, তেমনি বলতে-কইতে, আবার তেমনি ধর্মবিষয়ে। সে রাতভোর ধ্যান করে, ধ্যান করতে করতে সকাল হয়ে যায়, হুঁশ থাকে না। আমার নরেন্দ্রের ভিতর এতটুকু মেকি নেই; বাজিয়ে দেখ টংটং করছে। আর সব ছেলেদের দেখি, যেন চোখ কান টিপে কোনরকমে দু-তিনটে পাস করেছে—ব্যস, এই পর্যন্ত! এ করতেই যেন তাদের সমস্ত শক্তি বেরিয়ে গেছে! নরেন্দ্রের কিন্তু তা নয়, হেসে-খেলে সব কাজ করে, পাস করাটা যেন তার কিছুই নয়! সে ব্রাহ্মসমাজেও যায়, সেখানে ভজন গার্; কিন্তু অন্য ব্রাহ্মদের মতো নয়, সে যথার্থ ব্রহ্মজ্ঞানী। ধ্যান করতে বসে তার জ্যোতি দর্শন হয়। সাধে নরেন্দ্রকে এত ভালবাসি!”
ফুলে ফুলে ভরে আছে বাগান। ঠাকুর দাঁড়িয়ে আছেন সেই বাগানে। সবুজ ঘাসের ওপর। মৃদুমন্দ বইছে গঙ্গার বাতাস। চারপাশ বড় উৎফুল্ল। ঠাকুর যেখানে দাঁড়িয়ে আছেন, সামনেই যদু মল্লিকের বৈঠকখানা। বড়লোকের বসার ঘর যেমন হয়—সুসজ্জিত, অতি সুরম্য। নানা আকারের শ্বেতপাথরের টেবিল। সোফাসেট। দেওয়ালে আরো কয়েকটি ছবির সঙ্গে সেই বিখ্যাত ছবিটিও ঝুলছে—ম্যাডোনার কোলে শিশু যীশু। এই ছবিটি দর্শনে ঠাকুর সমাধিস্থ হয়েছিলেন। পাশেই আরেক মল্লিক—শম্ভু মল্লিকের বাগানবাড়ি। আলাপী মানুষ। ঠাকুর মাঝেমধ্যে শম্ভু মল্লিকের বাগানে গিয়ে বাইবেল শুনতেন। শুনতে শুনতে এমনই মোহিত হলেন, শুরু করলেন খ্রীস্টধর্ম সাধন। একদিন এই বৈঠকখানায় ঐ ছবিখানির দিকে তাকিয়ে ঠাকুর বসে আছেন, ভাবস্থ। শম্ভু মল্লিক বাইবেল থেকে ঈশার জীবনকথা তাঁকে শুনিয়েছেন। ঠাকুর ছবিখানির দিকে অনিমেষে তাকিয়ে আছেন আর সেই অদ্ভুত জীবনকথা ভাবছেন। হঠাৎ! হঠাৎ ছবিটি জীবন্ত, জ্যোতির্ময় হয়ে উঠল। দেবজননী ও দেবশিশু দুজনেই প্রাণবন্ত। দুজনের দেহ থেকে বিচ্ছুরিত জ্যোতিরশ্মি ঠাকুরের দেহে প্রবেশ করছে। তিনি অনুভব করতে পারছেন, চিন্তার জগতে ভীষণ এক প্রতিক্রিয়া শুরু হয়েছে। হিন্দু-ভাব, হিন্দু-সংস্কার বদলে যাচ্ছে। জগদম্বাকে কাতর কণ্ঠে বলছেন : “মা, আমাকে এ কি করছিস!” মা শুনলেন না সে-প্রার্থনা। পুরো তিনটে দিন ঠাকুর হয়ে রইলেন খ্রীস্টান। খ্রীস্টানের সংস্কার, খ্রীস্টানের ভাব। হিন্দু দেব-দেবীর ওপর কোন বিশ্বাস নেই। মানসভাবে গির্জাবাসী। অল্টারে সার সার মোমবাতি। প্রার্থনার গভীর, গম্ভীর সুর। পাদপীঠে নতজানু মানুষ চার্চবেল। অবশেষে পঞ্চবটীতলে যীশুর দর্শন। দেখছেন, অদৃষ্টপূর্ব এক দেবমানব, সুন্দর, গৌরবর্ণ, স্থিরদৃষ্টিতে ঠাকুরের দিকে তাকিয়ে এগিয়ে আসছেন। দর্শনমাত্রেই ঠাকুর বুঝেছেন, ইনি বিদেশী। কে ইনি? সঙ্গে সঙ্গে নিজের ভিতর থেকে কে বলে উঠলেন : “চিনলে না! ঈশামসি—দুঃখ-যাতনা থেকে জীবকুলকে উদ্ধারের জন্য হৃদয়ের রক্ত ঝরিয়েছিলেন। সেই মানুষেরই নির্যাতনে ক্রুশবিদ্ধ। সেই পরম যোগী, সেই পরম প্রেমী তোমার সামনে।” যীশু ঠাকুরকে আলিঙ্গন করে তাঁর শরীরে লীন হয়ে গেলেন। ঠাকুর বাহ্যজ্ঞান হারিয়ে মাটিতে পড়ে গেলেন।
এই সেই যদু মল্লিকের বাগানবাড়ি। প্রথম দর্শনে নরেন্দ্রনাথের ধারণা হয়েছিল—”এ কাকে দেখতে এসেছি! এ তো একেবারে উন্মাদ! তা না হলে আমি বিশ্বনাথ দত্তের ছেলে, আমার হাতদুটো ধরে কাঁদতে কাঁদতে কেউ বলেন—যেন কতদিনের পূর্বপরিচিত আমি—’এতদিন পরে আসতে হয়! আমি তোমার জন্য কত প্রতীক্ষা করে বসে আছি, সে-কথা একবার ভাবলে না! বিষয়ী লোকের যত বাজে কথা শুনতে শুনতে আমার কান ঝলসে যাবার উপক্রম। প্রাণের কথা কারোকে বলতে না পেরে আমার পেট ফুলে উঠেছে।’ কাঁদছেন আর বলছেন। এইতেই শেষ নয়, আমি যেন দেবতা! সামনে দাঁড়িয়ে বলছেন—’জানি আমি প্রভু, তুমি সেই প্রাচীন ঋষি, নররূপী নারায়ণ; জীবের দুর্গতি নিবারণ করতে আবার শরীর ধারণ করেছ।’
বায়ু! বায়ুর প্রভাব। অ্যাটর্নির ছেলে ‘নর-নারায়ণ’! লোকে শুনলে হাসবে। তবে একথা অস্বীকার করার উপায় নেই, দিব্য প্রভাব। অদ্ভুত, অপ্রাকৃত উল্লাসে মন ভরে গিয়েছিল। জ্যোতির্ময় মুখমণ্ডল, মধুমাখা কণ্ঠস্বর, প্রেম-ঢলঢল দুটি চোখ। থেকে থেকে সমাধি। ঘরভর্তি বিমুগ্ধ মানুষ। সকলেই বিদ্বান, বুদ্ধিমান! .. তাহলে! সিদ্ধান্তটা কি সমুচিত হলো? কোথায় একটা কি আছে! দিব্য আকর্ষণ! কেষ্ট, বিষ্ট, অলৌকিক—এসব তো আমি কিছুই মানি না। এমনকি ব্রহ্মও মানি না। ব্রাহ্মসমাজে যাই বটে, দুটো কারণে—কেউ কি ঈশ্বরকে জেনেছেন, পেয়েছেন তাঁর ঠিকানা! আমি যুক্তিবাদী। ভাল, মন্দ কোন সংস্কারই আমার নেই। আমি কংক্রিট প্রমাণ চাই। “No abstraction. দ্বিতীয় কারণ, সঙ্গীত। ওস্তাদের কাছে গান শিখেছি, গান গাইব।
তবু পারলেন না। মাসখানেক পর মনে হলো, কথা যখন দিয়েছি আরেকবার যাই। উন্মাদ হয়তো, কিন্তু বড় সৎ, বড় প্রেমিক! সৎসঙ্গে দোষ কি! সর্বোপরি কৌতূহল—কে ইনি? কেন ঐসব বললেন? আমি তো জানি, আমি বিশ্বনাথ দত্তের ছেলে। সিমুলিয়ায় থাকি। কলেজে পড়ি। বেণী ওস্তাদের কাছে গান শিখি। অম্বু গুহের আখড়ায় কুস্তি করি। তাহলে ওসব কি বললেন!
দক্ষিণেশ্বর এত দূর জানা তো ছিল না! যাচ্ছি তো যাচ্ছিই, পথ আর ফুরোয় না। অবশেষে সোজা ঠাকুরের ঘরে। কোথাও আর থামাথামি নেই! নিজের ছোট্ট খাটটিতে বসে আছেন, একেবারে একা। শান্ত, সৌম্য, সহজ, সরল আত্মভোলা একজন মানুষ। দেখা মাত্র মুখ উদ্ভাসিত। “এস, এস বস এখানে।” খাটের আরেক প্রান্তে নরেন্দ্রনাথ বসলেন। সঙ্গে সঙ্গে ঠাকুর অন্য একটা ভাবে চলে গেলেন। মুখে আহ্লাদের আর কোন প্রকাশ নেই। বিড়বিড় করে কি সব বলছেন! নরেন্দ্রনাথের দিকে তাকিয়ে আছেন স্থিরদৃষ্টিতে। ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছেন নরেন্দ্রনাথের দিকে। “এই রে! পাগল বুঝি আগের দিনের মতো আবার কোন পাগলামি করবে!”
ভাবতে না ভাবতেই ঠাকুর তাঁর দক্ষিণ চরণখানি দিয়ে নরেন্দ্রনাথকে স্পর্শ করলেন। মুহূর্তে প্রলয়! “দেওয়ালগুলির সহিত গৃহের সমস্ত বস্তু বেগে ঘুরিতে ঘুরিতে কোথায় লীন হইয়া যাইতেছে এবং সমস্ত বিশ্বের সহিত আমার আমিত্ব যেন এক সর্বগ্রাসী মহাশূন্যে একাকার হইতে ছুটিয়া চলিয়াছে।” দারুণ আতঙ্কে নরেন্দ্রনাথ চিৎকার করে উঠলেন—আমিত্বের নাশই তো মরণ, সেই মরণ সামনে, সন্নিকটে—”ওগো, তুমি আমার একি করলে? আমার যে বাপ-মা আছেন!”
খলখল করে হাসছেন অদ্ভুত সেই পাগল। সামনের দাঁত-দুটির মাঝে সামান্য ফাঁক। মুখে অলৌকিক প্রভা। অদৃশ্য কোন আলো এসে পড়েছে। নরেন্দ্রনাথের বুকে হাত রেখে বললেন : “তবে এখন থাক, একেবারে কাজ নেই, কালে হবে!” সঙ্গে সঙ্গে নরেন্দ্রনাথ অসীম থেকে সসীমে ফিরে এলেন। ‘কালে হবে!’ নরেন্দ্রনাথ তখনো জানেন না, কি হবে!
এই সেই যদু মল্লিকের বাগানবাড়ি। সাতদিন পরেই ঠাকুরকে নরেন্দ্রনাথের তৃতীয় দর্শন। ঠাকুর বললেন : “চল, পাশের বাগানে বেড়িয়ে আসি।” বাগানবাড়ির গঙ্গার ধারে দুজনে সমবয়স্ক বন্ধুর মতো অনেকক্ষণ বেড়ালেন। বাতাসের বিকেল। দুজনের চুল বাতাসে এলোমেলো। বসনপ্রান্ত উড়ছে। যদুবাবুর নির্দেশ ছিল, ঠাকুর আসা মাত্রই গঙ্গার ধারের বৈঠকখানাঘরটি যেন খুলে দেওয়া হয়। রতন নির্দেশ পালন করেছেন। কিছুক্ষণ বেড়াবার পর ঠাকুর বললেন : “চল বসি!” যদু মল্লিকের বৈঠকখানা। ঠাকুর ঘরে এসেই সমাধিস্থ। নরেন্দ্রনাথ অবাক হয়ে দেখছেন। তাঁর কলেজের অধ্যক্ষ হেস্টি সাহেব বলেছিলেন, ওয়ার্ডসওয়ার্থের সমাধি হতো। সমাধির পরিচয় যদি পেতে চাও, দক্ষিণেশ্বরে গিয়ে দেখে এস। সেখানে একজন আছেন যাঁর সমাধি হয়। এই সেই সমাধি!
ঠাকুর হঠাৎ নরেন্দ্রনাথকে স্পর্শ করলেন, সঙ্গে সঙ্গে নরেন্দ্রনাথের বাহ্যসংজ্ঞা লুপ্ত। কেউ কোথাও নেই। বাগানময় ফুলের শোভা। সামনে প্রবাহিত গঙ্গা। সন্ধ্যা নামবে। ঠাকুর নরেন্দ্রের কানে কানে প্রশ্ন করছেন : “তুমি কে?” নরেন্দ্রনাথ অন্তরের গভীরে প্রবেশ করে উত্তর খুঁজে আনলেন। “তুমি কোথা থেকে এসেছ?” “কেন এসেছ?” “কতদিন থাকবে এখানে?” সব মিলে গেল। একদিন সমাধি-পথে যা যা দেখেছিলেন। “আমি সপ্তঋষির এক ঋষি এসেছি অখণ্ডের ঘর থেকে। কেন এসেছি? তুমিই তো ডেকে এনেছ, তোমার কাজে, প্রেমের প্রচারে। আমাকে দিয়ে তুমিই বলাবে—আজই হোক, কালই হোক,শত শত যুগ পরেই হোক, সত্যের জয় হবেই। প্রেমের জয় হবেই। ঈশ্বরের খোঁজ কোথায় করছ? ‘বহুরূপে সম্মুখে তোমার…’। প্রত্যেকেই প্রত্যেকের ঈশ্বর। LOVE! That wonderful four-lettered word!”
“নরেন্দ্র যেদিন জানতে পারবে সে কে, সেদিন আর ইহলোকে থাকবে না, দৃঢ়সঙ্কল্প সহায়ে যোগমার্গে তৎক্ষণাৎ শরীর ত্যাগ করবে। নরেন্দ্র ধ্যানসিদ্ধ মহাপুরুষ।”