আট
মীরহাজীবাগে আসার চার পাঁচ মাস পরে একদিন আমজাদ পেপার দেখে সচিবালয় তথ্যমন্ত্রনালয়ে ও বগুড়ায় টি.এন.টি’তে এ্যাপ্লাই করল। কয়েকদিন পরে সচিবালয় থেকে ইন্টারভিউ কার্ড পেয়ে ইন্টারভিউ দিল। তার পরের দিন বগুড়া তেকে বড় দুলাভাইয়ের চিঠি পেল। ওখানের এ্যাপ্লিকেসনে বড় দুলাভাইয়ের বাসার ঠিকানা দিয়েছিল। চিঠির সাথে ইন্টারভিউ কার্ড দেখে পড়ে দেখল, পরশুদিন ইন্টারভিউ। ভাবল ওখানেও ইন্টারভিউ দেওয়া যাক। আল্লাহ রাজি থাকলে যেখানে হোক চাকরি পাব।
রাত্রে ছাত্র-ছাত্রীদের পড়াবার সময় আমজাদ হক সাহেবকে বগুড়ায় ইন্টারভিউ দিতে যাওয়ার কথা জানাল।
হক সাহেব বললেন, এটা তো ভালো কথা। পরশুদিন ইন্টারভিউ, কালই আপনি চলে যান। সরকারী চাকরি ভালো। ভবিষ্যতে উন্নতি করতে পারবেন।
আমজাদ নির্দিষ্ট দিনে রিটেন ও ভাইভা দুটোতেই ভালোভাবে পরীক্ষা দিল।
ইন্টারভিউ দিয়ে ফিরে আসার দশ-বার দিন পর তার দুলাভাই মারফত বগুড়া থেকে এ্যাপয়েন্টমেন্ট রেটার পেল। আনন্দে আমজাদের চোখে পানি এসে গেল। আজ আড়াই বছর বিভিন্ন অফিসে হন্যি হয়ে ঘুরেছে, পে-অর্ডারসহ শতশত এ্যাপ্লীকেশন করেছে, অনেক জায়গায় ইন্টারভিউও দিয়েছে। চাচা-মামা ও অর্থবল না থাকায় কোথাও চাকরি পাইনি। চোখ মুছে তাড়াতাড়ি মসজিদে গিয়ে দু’রাকাত শোকরানার নামায পড়ল।
হক সাহেব রাতে বাসায় ফিরে মাষ্টারের চাকরি হয়েছে শুনে আনন্দিত হলেন। জিজ্ঞেস করলেন, জয়েনিং ডেট কবে?
আমজাদ বলল, সামনের মাসের এক তারিখে।
ওখানে থাকবেন কোথায়?
আমার বড় বোন ও দুলাভাই ওখানে থাকেন। তাদের কাছে থাকব।
তা হলেতো কোনো অসুবিধে হবে না। আপনি কবে যেতে চান?
এই মাসের ত্রিশ তারিখে।
হক সাহেব কিচুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, আপনাকে পেয়ে ছেলে মেয়েদের ব্যাপারে নিশ্চিন্ত ছিলাম। আপনার চাকরি হয়েছে শুনে আনন্দিত হয়েছি; তবে চলে যাবেন ভেবে খুব খারাপ লাগছে। কি আর করা যাবে? সবই আল্লাহর ইচ্ছা।
আল্লাহর কুদরত বোঝা মানুষের অসাধ্য। পরের দিন সচিবালয় তথ্যমন্ত্রনালয় থেকেও এ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার পেল।এখানেও জয়েনিং ডেট এক তারিখে। রাতে হক সাহেবকে সে কথাও জানাল।
মাষ্টার চলে গেলে ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার কথা চিন্তা করে কাল থেকে হক সাহেবের মন খারাপ হয়েছিল। এখন তার কথা শুনে আনন্দিত হলেন। ভাবলেন, মাষ্টার যদি ঢাকায় চাকরি নেন, তা হলে ভালই হবে। বললেন, টেলারিং মাষ্টারের কাছে আপনার সম্পর্কে কিছু কিছু শুনেছি। আপনি জীবনে অনেক দুঃখ কষ্ট ভোগ করেছেন। তবু সৎ পথ থেকে বিচ্যুৎ হননি। তাই এবার আল্লাহ তার রহমতের দৃস্টি আপনার দিকে দিয়েছেন। তা কোথায় জয়েন করবেন কিছু ভেবেছেন?
আমজাদ হক সাহেবকে যত দেখছে, তত তার চরিত্রের গুণাবলী দেখে অবাক হয়েছে। তার ধারণা, এ যুগে তার মতো সৎ ও আল্লাহওয়ালা মানুষ খুব কম। আছেন। তাই তাকে খুব ভক্তি-শ্রদ্ধা করে। আর খালুজী বলে ডাকে। এখন তার। কথা শুনে বলল, খালুজী, আপনাকে আমি মুরুব্বী হিসাবে মানি ও সম্মান করি। আপনি যেখানে জয়েন করতে বলবেন, সেখানেই করব।
হক সাহেবও আমজাদকে সৎ ও ধার্মিক জেনে ছেলের মতো স্নেহ করেন। অল্পক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, তাই যদি মনে করেন, তা হলে ঢাকাতেই জয়েন করা আপনার জন্য ভলো হবে। কারণ প্রতি সপ্তাহে বাড়ি গিয়ে মা-বাবার খোঁজ খবর নিতে পারবেন। দু’আড়াই ঘন্টার পথ। যাতায়াতেরও অনেক সুযোগ সুবিধা। আর বগুড়া হল এখান থেকে সড়ক পথে ২২৮ কিলোমিটার আর রেলপথে ৩৬৯ কিলোমিটার। এখানে থাকলে যে সুযোগ সুবিধে পাবেন, ওখানে সেসব পাবেন না। এখন আপনি চিন্তা ভাবনা করে দেখুন কোথায় জয়েন করবেন।
আমজাদ বলল, আপনার কথাই ঠিক। বগুড়ার চেয়ে ঢাকায় থাকলে সব দিকেই সুবিধে। আমি ঢাকাতেই জয়েন করব।
হক সাহেব মনে মনে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে বললেন, সেটাই ভালো হবে।
তথ্যমন্ত্রণালয়ে জয়েন করার পর আমজাদ মা-বাবাকে চিঠি দিয়ে জানাল।
চাকরিতে ঢুকে আমজাদ হক সাহেবের ছেলেমেয়েদের ঠিকমতো পড়াবার সময় পেল না। সকালে ছ’টা থেকে আটটা পর্যন্ত পড়ালেও রাত্রে বেশি সময় পড়াতে পারতো না। অফিসের কাজের চাপে বাসায় ফিরতে সন্ধ্যে সাতটা আটটা বেজে যায়। সারাদিন ডিউটি করে তখন আর পড়াবার মতো শারীরিক ও মানষিক অবস্থা থাকে না। তবুও এক দেড় ঘন্টা পড়ায়।
পাঁচ ছয় মাস পর একদিন আমজাদ হক সাহেবকে বলল, দেখুন খালুজী, অফিসের কাজের চাপে আমি ঠিক মতো পড়াতে পারছি না। ওদের পড়াশোনার ক্ষতি হচ্ছে। তাই বলছি, আপনি যদি একজন মাষ্টার রাখার ব্যবস্থা করতেন, তা হলে ভালো হত।
হক সাহেব বললেন, আমার ছেলেমেয়েদের এতদিন পড়াচ্ছেন, ওরা ভালো না খারাপ ছাত্র তা জানেন। ওদের পড়াশোনার ক্ষতি হলে আমাকে জানাত। আমি যতদূর জানি ওদের সেরকম কিছু হচ্ছে না। আপনি অবশ্য ভালো কথা বলেছেন। তবে আমার ইচ্ছা, আপনি যতটুকু সময় পান পড়াবেন। মাষ্টার কম সময় পড়ালে ছেলেমেয়েদের পড়ার ক্ষতি হয়, আর বেশিক্ষণ পড়ালে লাভ হয়, একথা আমি বিশ্বাস করি না। তবে হ্যাঁ, আপনি যদি পড়াতে না চান, সেটা অন্য কথা।
খালুজী, আপনি আমাকে ভুল বুঝবেন না। আমি ওদের পড়াশোনার ক্ষতি হচ্ছে মনে করে কথাটা বলেছি। তবু যদি কিছু মনে করে থাকেন, মাফ করে দিন।
না-না, এতে মাফ চাওয়ার কী আছে? মাষ্টার হিসাবে ছাত্রদের মঙ্গল কামনা করাইতো উচিত। যাক গে, যতদিন আপনার পক্ষে সম্ভব হয় এবং যতটুকু সময় পান পাড়বেন।
আমজাদের অফিসে যত কাজের চাপ বেড়ে চলল, ছাত্র-ছাত্রীদের পড়াবার সময়ও তত কমে যেতে লাগল। তা জেনেও হক সাহেব মাস্টারের তিন বেলা খাওয়ার দিকে লক্ষ্য রাখতেন।
আরো তিনচার মাস পড়াবার পর শীতকাল এসে যেতে আমজাদ মোটেই পড়াবার সুযোগ পেল না। অত শীতে ছেলেমেয়েরা সকাল সাতটা সাড়ে সাতটার আগে পড়তে বসতে পারত না। শীতকালে সন্ধ্যা হয় সাড়ে পাঁচটায়। আমজাদ অফিস থেকে ফিরে সাত-আটটায়। ঐ সময় তার যেমন পড়াতে যেতে ইচ্ছা করে না তেমন ছাত্র-ছাত্রীদেরও অসুবিধে হয়।
তাই একদিন হক সাহেবকে সেকথা জানিয়ে বলল, আমার জানাশোনা একজন মাস্টার আছে, তাকে রাখলে ভালো হবে। আমি অফিসের কাছাকাছি কোনো মেসে থাকার ইচ্ছা করেছি।
হক সাহেব বললেন, আপনার যাতায়াতের অসুবিধার কথা আমিও চিন্তা করেছি। ঠিক আছে, আপনি যা ভালো বোঝেন করেন।
আমজাদ কিছুদিনের মধ্যে এক কলিগের সহায়তায় অফিসের কাছাকাছি তারই মেসে চলে এল।
প্রায় বছর খানেক চাকরি করার পর একদিন যখন দেশে গেল তখন তার মা। জরীনা বেগম তাকে বললেন, তোর আব্বার ও আমার খুব ইচ্ছা, এবার একটা ভালো মেয়ে দেখে বৌ করে ঘরে আনব। আমি একা একা কতদিন আর সংসার টানব।
মায়ের কথা শুনে শারমিনের কথা আমজাদের মনে পড়ল। আজ থেকে প্রায় তিন বছর আগে দেখা শারমিনকে আজও ভুলতে পারে নি। এর মধ্যে বন্ধু জাভেদ ও তার বৌ আয়শা কতবার চিঠি দিয়ে যেতে বলেছে। যতবার চিঠি পেয়েছে, ততবারই শারমিনকে দেখার ইচ্ছা প্রবল হয়েছে। বন্ধু ও বন্ধুপত্নীর আমন্ত্রনের চেয়ে শারমিনকে দেখার জন্য মনে বেশি তাগিদ অনুভব করেছে। কিন্তু শত ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও চাকরি পাওয়ার আগে বেকারত্বের অভিশাপ মাথায় নিয়ে যেতে পারেনি। চাকরি পাওয়ার খবর জেনে জাভেদ কয়েকটা চিঠি দিয়ে যেতে বলেছে; কিন্তু নূতন চাকরিতে ছুটি পাওয়া সম্ভব হয়নি। আর দু’একদিনের ছুটিতে গেলে আয়শা ভাবি ছিঁড়ে খাবে ভেবে যায়নি।
ছেলেকে চুপ করে থাকতে দেখে জরীনা বেগম বললেন, কীরে, চুপ করে আছিস কেন? তুই আমাদের এক ছেলে, আমাদের বৌ দেখতে সখ হয়না বুঝি?
আমজাদ লজ্জা পেয়ে মুখ নিচু করে বলল, আমি কি কোনোদিন তোমাদের কথার অবাধ্য হয়েছি?
তা হসনি, তবে তোর আব্বা বলছিল, আজকালের ছেলেরা যতদিন গ্রামে থাকে, ততদিন বাপ-মার অবাধ্য হয় না। শহরে লেখাপড়া বা চাকরি বাকরি করতে গেলে পাল্টে যায়। তখন আর তারা মা-বাবার বাধ্য থাকে না। নিজেদের ইচ্ছামতো সবকিছু করে।
আব্বা ঠিক কথা বলেছেন। তবে তোমরা আমাকে দ্বীন শিক্ষা দিয়ে মানুষ করেছ। যার পেটে দ্বীনি এলেম আছে, সে যেখানেই যাক না কেন, আর যা কিছু করুক না কেন, কখনও মা-বাবার অবাধ্য হবে না। তোমরা কোনো মেয়ে দেখেছ। নাকি?
দেখি নি। তবে কিছুদিন আগে জেবুন্নেশার সঙ্গে জাভেদ তার বৌ ও মেয়েকে নিয়ে এসেছিল। সে বলছিল…।
আমজাদ মাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, জাভেদের মেয়ে হয়েছে?
হাঁ, চার পাঁচ মাসের বাচ্চা। টুকটুকে ফরসা কি সুন্দর দেখতে।
আমজাদ ভাবল, সে যাইনি বলে জাভেদ মেয়ের কথা জানাইনি। মাকে বলল, জাভেদ কী বলেছে বল।
বলল, তার নাকি এক চাচাত শালী আছে। দেখতে শুনতে ভালো। বি.এ. পাশ। নামায-কালাম ঠিক মতো পড়ে। জাভেদ ও তার বৌয়ের খুব ইচ্ছা, তোর সঙ্গে তার বিয়ে দেবে। তোর আব্বাও মেয়ের বাবা চাচাঁদের চেনে। জাভেদের কথা শুনে বলল, ওরা খুব বড়লোক। আমাদের মতো গরিবের বাড়িতে দেবে কী? জাবেদ বলল, দেবে কী না দেবে সে দায়িত্ব আমার। আপনারা রাজি কিনা বলুন। তোর আব্বা বলল, বড় লোকের মেয়ে এ বাড়িতে এসে, সে যেমন শান্তি পাবে না, তেমনি আমরাও পাব না। দশটা না পাঁচটা না আমজাদ আমাদের একমাত্র ছেলে। তার বৌকে নিয়ে যদি সংসারে অশান্তি আসে, তা হলে কী হবে? জাভেদ বলল, আমার মামাত বোন বলে বলছি না, ওর মতো ভালো মেয়ে আর দেখিনি। অত লেখাপড়া করেও ধর্মের সবকিছু মেনে চলে। আর গরিব বড়লোকের কথা যে বললেন, তাও ঠিক নয়। আমার মামা-মামী অন্য পাঁচটা বড়লোকের মতো নন। খুব ধার্মিক। ছেলে-মেয়েদেরকেও সেই ভাবে মানুষ করেছেন। আমি আমজাদ ও আপনাদের পারিবারিক সবকিছু তাদেরকে বলেছি। তা ছাড়া তারা তো আপনাদের দূর সম্পর্কের আত্মীয়। তারাও আপনার সবকিছু জানেন। তাই বলছি ওঁরা যখন জেনেশুনে আত্মীয়তা করতে চাচ্ছেন তখন আপনাদের আপত্তি করার কী আছে? তোর আব্বা বলল, ঠিক আছে, আমজাদ বাড়িতে এলে তোমাদের কথা বলব। সে রাজি থাকলে তোমাদের জানাব। জাভেদের বৌ ও মেয়েটার খুব প্রশংসা করে বলল, ঐ মেয়ে এ বাড়িতে বৌ হয়ে এলে আপনারা সবাই সুখী হবেন। জেবুন্নেশা বলল, সে মেয়েকে দেখেছে। তোর সঙ্গে মানাবে। ঐ মেয়ে এ বাড়িতে এলে সবাই সুখী হবে। ফিরে যাওয়ার সময় জেবুন্নেশা জাভেদ ও তার বৌ তোকে চট্টগ্রাম যাওয়ার জন্য অনেক করে বলে গেছে। আমি বলি কী, কাল জেবুন্নেশাদের বাড়িতে যা। তারপর না হয় ওখান থেকে চট্টগ্রামে জাভেদের কাছে গিয়ে মেয়েটাকেও দেখে আয়। তোর পছন্দ হলে আমরা বিয়ের কথা বার্তা বলতাম।
আমজাদ বলল, জাভেদ যখন সম্বন্ধ এনেছে তখন ঐ মেয়েকে বিয়ে করি আর করি, তখন একবার যাব। তবে এবারে যেতে পারব না। পরশুদিন আমাকে অফিস করতে হবে। ঢাকা থেকে কয়েক দিনের ছুটি নিয়ে না হয় যাব। তারপর বলল, আব্বা ওঁদের চেনেন, দূর সম্পর্কের আত্মীয়ও কিন্তু চট্টগ্রামে থাকে কেন জান?
ওদের বাড়ি গৌরীপুর। মেয়ের বাপ চট্টগ্রামে ব্যবসা করে। সেখানে বৌ ছেলে-মেয়ে নিয়ে থাকে।
ও তাই বল। ঠিক আছে, যাব বলে আমজাদ মায়ের কাছ থেকে চলে গেল।
দু’দিন বাড়িতে থেকে আমজাদ ঢাকা ফিরে এল। এবারে আসার পর শারমিনের কথা বারবার মনে পড়তে লাগল। একদিন ঘুমাবার সময় শারমিনের কথা মনে পড়তে ভাবল, এতদিনে হয়তো তার বিয়ে হয়ে গেছে। স্বামীর ঘরে সুখে দিন কাটাচ্ছে। যাই হোক না কেন, চট্টগ্রামে গেলে প্রথমে শারমিনদের বাসায় যাবে। তারপর জাভেদের বাসায়। ফেরার পথে ছোট আপার বাড়ি হয়ে ফিরবে। হঠাৎ তার মন বলে উঠল প্রথমে ওখানে গিয়ে কি হবে এতদিন পরে তোমাকে কী চিনতে পারবে? না তোমার কথা তাদের মনে আছে? যদি জিজ্ঞেস করে কে আপনি? কেন এসেছেন? তখন কী বলবে?
আমজাদ মনকে বলল, সবাই চিনতে না পারলেও, মনে না রাখলেও যাকে বাঁচালাম, সে নিশ্চয় মনে রেখেছে এবং চিনতেও পারবে।
মন বলল, ঠিক আছে, ধরলাম, তারা সবাই তোমাকে মনে রেখেছে, চিনতেও পারল এবং খাতির যত্নও করল; কিন্তু তাতে তোমার কী লাভ?
লাভ শারমিনকে দেখা। আর সেই সাথে বিয়ে হয়েছে কিনা আলাপ করে জানা।
যদি বিয়ে না হয়?
তাহলে জাভেদকে বলব, তোর মামাত বোন নাকচ। তারপর শারমিনের ঠিকানা দিয়ে বলব একে বিয়ে করতে চাই ব্যবস্থা কর।
নিজের মামাত বোনকে বাদ দিয়ে শারমিনের জন্য ব্যবস্থা করতে যদি রাজি না হয়?
জাভেদ আমার কথা না রেখে পারবেই না।
শারমিনের বাবা বড়লোক। তিনি যদি তোর মতো গরিবের ছেলের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিতে রাজি না হন? অথবা শারমিন যদি রাজি না হয়? অথবা তার যদি বিয়ে হয়ে গিয়ে থাকে?
তা হলে তক্বদীরে নেই ভেবে সবর করব।
তখন তা হলে জাভেদের মামাত বোনকে বিয়ে করবি তাই না?
তক্বদীরে থাকলে করব।
এইসব ভাবতে ভাবতে আমজাদ কখন ঘুমিয়ে পড়ল জানতে পারল না।
.
আমজাদ বাড়িতে এসে মায়ের কাছে সবকিছু শুনে চট্টগ্রামে মেয়ে দেখতে যেতে রাজি হয়ে ভেবেছিল, এবারে ও জাভেদকে খবর না দিয়ে যাবে এবং প্রথমে শারমিনদের বাসায় গিয়ে জানার চেষ্টা করবে তার বিয়ে হয়েছে কিনা। কিন্তু ঢাকায় এসে চিন্তা করল, সরাসরি তাদের বাসায় যাওয়া ঠিক হবে না। জাভেদ যখন ঘটনাটা জানে তখন নিশ্চয় শারমিনের পরিচয়ও জানে। ওর কাছ থেকেই বুদ্ধি করে তার বিয়ে হয়ে গেছে কিনা জেনে নিতে হবে। তাই চট্টগ্রামে রওয়ানা হওয়ার আগের দিন তার অফিসে ফোন করে সালাম ও কুশল বিনিময় করে বলল, কাল ইনশা আল্লাহ রওয়ানা দিচ্ছি। চারটের দিকে পৌঁছাব। বাসায় থাকবি তো?
জাভেদ শুনে হর্ষেফুল্ল কণ্ঠে বলল, এতদিনে আমাদের কথা মনে পড়ল তা হলে?
যা কিছু ভাবতে পারিস, এখন বল, বাসায় থাকবি, না অফিসে যাব?
তুই তো জানিস, ঐ সময়ে অফিসে থাকতেই হয়। তবে তোর চিন্তার কারণ নেই; তোর ভাবিকে টিফিনের সময় ছুটি নিয়ে আসতে বলব।
কাল তুই ছুটি নিতে পারবি না?
নারে, কাজের খুব চাপ।
তোর নাকি একটা মেয়ে হয়েছে?
আমার নয়, তোর ভাবির হয়েছে।
আমজাদ হেসে উঠে বলল, তুই একটা আস্ত খাজা।
খাজা আবার কী রে?
এটা আর বুঝলি না? যার মাথায় ঘীলু নেই তাকে খাজা বলে।
অফিসে একাউন্ট সেকশানে আছি, ঘীলু আছে কিনা ভেবে দেখ।
আছে, তবে অল্প। আচ্ছা বলতো, পরিচয় দেওয়ার সময় নিজের নামের পর মায়ের নাম বলিস, না বাবার নাম বলিস?
বাবার।
তা হলে তোর মেয়ে হওয়ার কথা জিজ্ঞেস করতে ভাবির কথা বললি কেন?
ভুল হয়ে গেছে।
বাসায় গিয়ে আমার আসার কথা ভাবিকে বলতে ভুলে যাবি না তো?
আরে না, তোর কথা কী ভুলতে পারি?
মেয়ে হওয়ার খবর জানাতে ভুলে গিয়েছিলি, না ইচ্ছা করে জানাসনি? না জানান প্রয়োজন মনে করিসনি?
কোনোটাই নয় তুই আসিসনি বলে রাগ করে জানাইনি।
রাগ পড়েছে? না কাল গেলে তাড়িয়ে দিবি?
ফোন পাওয়ার আগে পর্যন্ত ছিল। এখন আর নেই।
ভাবিকে আমার সালাম দিবি আর তোদের ছোট্ট খুকুমনিকে স্নেহাশীষ ও স্নেহ চুম্বন দিবি।
ঠিক আছে দেব।
মেয়ের কী নাম রেখেছিস?
ভালো নাম ও ডাক নাম দু’টো বলে জাভেদ বলল, তুই কী আরো দেরি করবি?
কেন বলতো?
বাথরুমে যাওয়ার সময় তোর ফোন পেলাম। এতক্ষণ সহ্য করতে পারলেও আর পারছি না। আরো দেরি করলে অপেক্ষা কর, বাথরুমের কাজ সেরে আসি।
আমজাদ হেসে উঠে বলল, না-না, আর কিছু বলব না, রাখছি তারপর সালাম বিনিময় করে লাইন কেটে দিল।
ছুটির পর বাসায় ফিরে জাভেদ স্ত্রীকে বলল, আমজাদ ফোন করেছিল, কাল আসছে।
আয়শা উৎফুল্ল হয়ে বলল, সত্যি বলছ? না ইয়ার্কি করছ?
সত্যি বলছি। আমাকে ছুটি নিতে বলেছিল। তা সম্ভব নয় জানিয়ে বললাম, তোর ভাবিকে টিফিনের সময় ছুটি নিয়ে বাসায় আসতে বলব। তারপর তার কাছে থেকে তাবাসসুমকে বুকে নিয়ে আদর দিতে দিতে বলল, জানিস মা, কাল তোর এক লড়াকু চাচা আসছে। এতদিন তোকে দেখতে আসেনি। তোকে যখন আদর করবে, কান কলে দিবি, কেমন?
ছয় মাসের বাচ্চা, বাবার কথা তো বুঝে না, আপন খেয়ালে শব্দ করে হেসে উঠল।
জাভেদ স্ত্রীকে বলল, দেখলে তো, কান মলে দেওয়ার কথা বলতে কেমন হেসে উঠে সম্মতি জানাল?
আয়শা বলল, তোমার যেমন কথা। ওকি আর এখনো কিছু বুজে না কি? এবার আমাকে দাও পেসাব করিয়ে আনি, অনেকক্ষণ করে নি। তারপর মেয়েকে নিয়ে যেতে যেতে বলল, তুমি কাপড় পাল্টে হাত মুখ ধুয়ে নাও। আমি নাস্তা নিয়ে আসছি।
আয়শা বাচ্চা প্রসব করার আগে বাপের বাড়ি গিয়েছিল। সেখানেই প্রসব করে। মাস খানেক পরে জাভেদ গিয়ে নিয়ে আসে। আসার সময় বাচ্চাকে দেখাশোনা করার জন্য নিঃসন্তান আধবয়সী মাজেদাকে সঙ্গে নিয়ে আসে। মাজেদাই সংসারের বেশিরভাগ কাজ করে আর আয়শা যতক্ষণ স্কুলে থাকে ততক্ষণ তাবাসসুমকে নিয়ে থাকে। তাকে আয়শা ও জাভেদ মাজেদা খালা বলে ডাকে। ওদের রান্নাঘরটা বেশ বড়। জাভেদ একজন শোবার মতো একটা চৌকি কিনেছে। রান্নাঘরের একপাশে সেই চৌকিতে মাজেদা থাকে।
আয়শা তাবাসসুমকে নিয়ে বাথরুমে যাওয়ার সময় মাজেদাকে ডেকে বলল, খালা চায়ের পানি চড়াও আমি আসছি।
বাথরুম থেকে এসে তাবাসসুমকে মাজেদার কোলে দিয়ে আয়শা চা করে দু’কাপ চা ও কয়েকটা বিস্কুট নিয়ে ড্রইংরুমে এল।
চা খাওয়ার সময় জাভেদ বলল, কালকেই ওদের দুজনকে সারপ্রাইজ দিয়ে বোকা বানাব ভাবছি।
আয়শা বলল, কি ভাবে?
কাল স্কুলে না গেলে কোনো অসুবিধে হবে?
না, পরশু দিন গিয়ে একটা দরখাস্থ দিলেই হবে।
তা হলে তুমি কাল বাসায় থাকবে। আমি অফিসে যাওয়ার পথে চাচার বাসায় গিয়ে শারমিনকে বলব, তোমার আপার আজ শরীর ভালো নেই। স্কুলে যাবে না বলল। বেরোবার সময় আমাকে বলল, তোমাকে যেতে বলে যেন অফিসে যাই। আরো বলল, নাস্তা না খেয়ে থাকলে এখানে এসে খাবে। তারপর জাভেদ হেসে উঠে বলল, শারমিন আসার পর তোমাকে কিন্তু শরীর খারাপের অভিনয় করতে হবে। আমি দেড়টার সময় ছুটি নিয়ে চলে আসব। দু’টোর মধ্যে আমরা খাওয়ার পাট চুকিয়ে ফেলব। তারপর মাজেদা খালাকে মেহমান আসার কথা বলে নাস্তা করতে বলে আমরা বেড রুমে তিনজনে গল্প করব।
আয়শা বলে উঠল, নাস্তা কেন? আমজাদ ভাইয়ের জন্য ভাত তরকারী রেডী রাখব।
ও চারটের পর ভাত খায় না। এটা ওর ছোটবেলা থেকে অভ্যাস। যা বলছিলাম শোন, আমজাদ চারটের সময় আসার কথা বললেও বাসের ব্যাপার তো, আধ ঘন্টা এক ঘন্টা দেরি হতে পারে। এসে যখন দরজায় নক করবে তখন আমি শারমিনকে খুলে দিতে বলব। তারপর হাসতে হাসতে বলল, দরজা খুলে দেওয়ার পর কী ঘটবে ভেবে দেখ।
আয়েশাও হাসতে হাসতে বলল, সীনটা দারুন জমবে। আমি কিন্তু আড়াল থেকে সীনটা না দেখে থাকতে পারব না।
জাভেদ বলল, আমিও কি পারব?
পরের দিন প্ল্যানমতো সবকিছু করে জাভেদ স্ত্রী ও শারমিনের সঙ্গে গল্প করছিল। সোয়া চারটের সময় দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ পেয়ে আয়শা সচকিত হয়ে স্বামীর দিকে তাকাল।
জাভেদ শারমিনকে বলল, দেখতে কে এল?
শারমিন গিয়ে দরজা খুলে উদ্ধারকর্তাকে দেখে তার বিস্ময়ের সীমা ছাড়িয়ে গেল। চমকে উঠে স্ট্যাচুর মতো দাঁড়িয়ে এক দৃষ্টিতে আমজাদের মুখের দিকে তাকিয়ে ভাবল, স্বপ্ন দেখছে না তো?
আমজাদেরও একই অবস্থা। সেও নির্বাক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রইল। তারও মনে হল স্বপ্ন দেখছে।
এভাবে বেশ কিছুক্ষণ কেটে গেল। এক সময় শারমিনের ডাগর ডাগর মায়াবি চোখ দুটো পানিতে ভরে উঠল।
তাই দেখে আমজাদ বাস্তবে ফিরে এল। সালাম দিয়ে বলল, আপনি? এখানে?
আমজাদের কথা শুনে শারমিনও বাস্তবে ফিরে এল। তাড়াতাড়ি ওড়নায় চোখ মুছে সালামের উত্তর দিয়ে বলল, এটা আমার চাচাতো বোনের বাসা। তা আপনি এখানে?
আমজাদের হঠাৎ মনে হল, জাভেদ কী বাসা পাল্টেছে? ভাবল, তা হলে তো কাল যখন ফোন করলাম তখন জানাত?
তাকে চুপ করে থাকতে দেখে শারমিন বলল, কিছু বলছেন না কেন?
আমজাদ বলল, দেখুন এখানে আমার এক বিয়াই জাভেদ ফ্যামিলী নিয়ে থাকতেন। তিনি কী আর থাকেন না?
তার কথা শুনে শারমিন আবার এত অবাক হল যে, নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারল না। বলল, কী বলছেন আপনি?
তাকে অবাক হতে দেখে আমজাদ বলল, বিশ্বাস করুন, প্রায় তিন বছর আগে যেদিন আপনি দূর্ঘটনার স্বীকার হয়েছিলেন, সেই সময় এই বাসাতেই উঠেছিলাম।
শারমিন বুঝতে পারল, আয়শা আপা ও দুলাভাই তার সঙ্গে এতদিন অভিনয় করেছে। সবকিছু জেনেও তাকে বলেনি। ভারল, আজকের ঘটনাটাও তা হলে ওদেরই পরিকল্পিত? মনে মনে তাদের উপর রেগে গেল।
কী হল? আপনি চুপ করে আছেন কেন?
শারমিন সামলে নিয়ে সংযুত কণ্ঠে বলল, ওঁরা এখানেই আছেন।
আমজাদও এবার অবাক হয়ে বলল, তা হলে আপনি যে বললেন, এটা আপনার চাচাতো বোনের বাসা?
নাজনীন হাসি চেপে রেখে বলল, যা সত্য তাই বলেছি। আপনার বিয়াই জাভেদই আমার চাচাতো বোনের স্বামী। তারপর আর হাসি চেপে রাখতে পারল না। অনুচ্চস্বরে হেসে উঠে বলল, দাঁড়িয়ে আছেন কেন? ভিতরে আসুন।
এতক্ষণ জাভেদ ও আয়শা আড়াল থেকে তাদের সবকিছু দেখছিল ও শুনছিল। এবার ভিতরে ঢুকে জাভেদ বলল, শারমিন, কার সঙ্গে এতক্ষণ কথা বলছ? তারপর আমজাদের দিকে তাকিয়ে সালাম দিয়ে বলল, আরে তুই? তা দাঁড়িয়ে রয়েছিস কেন? ভিতরে আয়।
আমজাদ জাভেদের ন্যাকামী কথা শুনে রেগে গেলেও সালামের উত্তর দিয়ে। তার দিকে বড় বড় চোখে তাকিয়ে ভাবল, সবকিছু জেনেও এতদিন গোপন রেখে আমাকে বোকা বানালে। ঠিক আছে, আমিও একদিন এর প্রতিশোধ নেব।
তাদের অবস্থা দেখে আয়শা হাসি চেপে রেখে শারমিনকে উদ্দেশ্য করে বলল, তোর কী জ্ঞান বলতো? যে নাকি নিজের জীবন তুচ্ছ করে একদিন তোকে বাঁচালেন, তাকে চিনতে পারলি না? এতক্ষণ বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখেছিস। শিক্ষিত মেয়ে হয়ে এমন কাজ করতে পারলি?
জাভেদ স্ত্রীকে মিষ্টি ধমকের স্বরে বলল, তুমি থামতো। আমার বিয়াইয়ের সামনে এসব কথা বলা তোমার উচিত হচ্ছে না। তারপর আমজাদকে বলল, কীরে? ভিতরে আসছিস না কেন?
আয়শা মেকী গলা চড়িয়ে শারমিনকে বলল কীরে, দরজা আগলে দাঁড়িয়ে রয়েছিস কেন? আমজাদ ভাই কী তোকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে আসবে?
তাদের ভনিতা দেখে শারমিন ক্রমশঃ রেগে যাচ্ছিল। আপার শেষের কথা শুনে লজ্জা পেয়ে ছুটে পালাতে গেল।
আয়শা খপ করে তার একটা হাত ধরে ফেলে বলল, পালাচ্ছিস যে? উদ্ধার কর্তাকে সামনে পেলে কী করার ওয়াদা করেছিলি মনে নেই বুঝি?
শারমিন আরো বেশি লজ্জা পেয়ে হাতটা ছাড়িয়ে ছুটে পালাবার সময় বলল, আপা, তোমাকে আমি ছেড়ে কথা বলব না। কি করি তখন বুঝবে।
আয়শা হাসতে হাসতে বলল, তার আগেই আমি কী করি তুই বুঝবি।