কে ডাকে তোমায় – ৭

সাত

আমজাদ চট্টগ্রাম আন্দরকিল্লা জেনারেল হাসপাতালে ঘুমন্ত শারমিনকে দেখে চলে আসার ঘন্টা খানেক পর জাব্বার সাহেব স্ত্রী ও ছেলেমেয়েসহ যখন এলেন তখনও শারমিনের ঘুম ভাঙ্গেনি।

তাদেরকে দেখে ডিউটিরত নার্স এসে আমজাদকে যা বলেছিল, তাদেরকেও তাই বলে বলল, কাল যিনি এই পেসেন্টকে নিয়ে এসেছিলেন, তিনি ঘন্টা খানেক আগে এসেছিলেন। তখনও পেসেন্ট ঘুমাচ্ছিলেন। যাওয়ার সময় বললেন, উনি যে এসেছিলেন, তা আপনাদের জানাতে। তারপর বলল, আপনারা অপেক্ষা করুন, কিছুক্ষণের মধ্যে পেসেন্টের ঘুম ভাঙ্গবে। কথা শেষ করে নার্স সেখান থেকে চলে গেল।

প্রায় মিনিট দশেক পর শারমিন চোখ মেলে তাকাল।

জাব্বার সাহেব বললেন, এখন কেমন লাগছে মা?

শারমিন সবাইয়ের দিকে একবার চোখ বুলিয়ে বাবার দিকে তাকিয়ে বলল, ভালো।

ফজিলা বেগম বললেন, এখন আর যন্ত্রনা হচ্ছে?

শারমিন না বলে আর একবার সকলের দিকে তাকিয়ে নিয়ে মাকে জিজ্ঞেস করল, যিনি আমাকে কাল এখানে এনেছিলেন, তিনি এসেছিলেন?

ফজিলা খাতুন বললেন, তুই ঘুমিয়ে পড়ার পর আমি নার্সকে তোর দিকে লক্ষ্য রাখতে বলে বাসায় গিয়েছিলাম। আমরা আসার পর নার্স বলল, আমি যাওয়ার ঘন্টা খানেক পরে এসেছিলেন। তখনও তুই ঘুমিয়ে ছিলি। মায়ের কথা শুনে নাজনীনের পান্ডুর মুখটা আরো পার হয়ে গেল।

.

জব্বার সওদাগর বাসা থেকে বেরোবার সময় বড় ছেলে রফিককে খবরটা জানাবার জন্য ভাইঝী জামায় জাভেদের বাসায় পাঠিয়েছিলেন।

খবর শুনে জাভেদ স্ত্রী আয়শাকে নিয়ে রফিকের সঙ্গে হাসপাতালে এল। ঘটনাটা রফিকের কাছে শুনেছে। সবাইকে দেখে সালাম দিয়ে চাচা শ্বশুর ও শাশুড়ীকে উদ্দেশ্য করে বলল, কাল এতবড় একটা দূর্ঘটনা ঘটল, অথচ আমরা জানতে পারলাম না। রাত্রে এখানে কে ছিল?

জব্বার সওদাগর সালামের উত্তর দিয়ে বললেন, তোমার চাচি আম্মা।

জাভেদ বলল, উনি প্রেসারের রুগী, রাত জেগে এখানে থাকা উচিত হয়নি। খবর দিলে আপনাদের মেয়ে থাকতে পারত।  

জব্বার সওদাগর বললেন, তুমি কিছু মনে করো না বাবা, শারমিনের অবস্থা দেখে আমার মাথার ঠিক ছিল না।

আয়শা শারমিনের বেডে বসে মাথায় হাত বুলোতে বুলোতে বলল, এখন কেমন আছিস?

কালকের থেকে ভালো।

মন খারাপ করিস না। আল্লাহ চাহে তো শিঘ্রী ভালো হয়ে যাবি।

স্ত্রী থেমে যেতে জাভেদ বলল, রফিকের কাছে শুনলাম, কে একজন যুবক ছেলে নাকি শারমিনকে এখানে নিয়ে এসেছেন? নিজের রক্তও দিয়েছেন?

জব্বার সওদাগর বললেন, হ্যাঁ বাবা ঠিকই শুনেছ। দুঃখের বিষয় হল, তার পরিচয় আমরা জানতে পারিনি। তোমার মামীকে শুধু বলেছে, কুমিল্লা থেকে কাল জরুরী কাজে এসেছে, আজ চলে যাবে। যাওয়ার আগে এখানে আসবে। নার্স বলল, আমরা আসার ঘন্টা খানেক আগে যখন এসেছিল তখন শারমিন ঘুমাচ্ছিল।

কাল কুমিল্লা থেকে জরুরী কাজে এসে আজ চলে গেছে শুনে জাভেদের সন্দেহ হল, আমজাদ নয় তো?

চাচি শাশুড়ীকে জিজ্ঞেস করল, ক’টার সময় বাসায় গিয়েছিল?

ফজিলা বেগম বললেন, তখন আমি আসরের নামায পড়ে তসবীহ গুণছিলাম। তা…পাঁচটা হবে।

জাভেদের সন্দেহটা বেড়ে গেল। আবার জিজ্ঞেস করল, নাম-টাম কিছু বলেনি?  

ফজিলা বেগম বললেন, আমার কাছে বলে নি, রফিকের কাছে বলেছে। তারপর তার দিকে তাকিয়ে বললেন, কী নাম যেন বললি?

রফিক বলল, আমজাদ।

নাম শুনে জাভেদের সন্দেহটা আরো বেড়ে গেল। আর কিছু জিজ্ঞেস না করে বলল, আমরা এখন আসি। আমার অফিসে কাল থেকে অডিট হচ্ছে, যেতেই হবে। আপনার মেয়েদের স্কুলে পরীক্ষা চলছে, ওকেও যেতেই হবে। বিকেলে আবার আসব । তারপর চাচা শ্বশুরের সঙ্গে সালাম বিনিময় করে স্ত্রীকে বলল এস।

হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে জাভেদ স্ত্রীকে বলল, কিছু বুঝতে পারলে?

আয়শা বলল, হ্যাঁ, ছেলেটা খুব সম্ভব আমজাদ ভাই।

আমারও তাই মনে হচ্ছে। তবে এ নামে অন্য কেউও হতে পারে। শারমিন সুস্থ হয়ে বাসায় ফেরার পর একদিন ওর কাছে পুরো ঘটনা শুনলে সীওর হওয়া যাবে।

ততক্ষণে ওরা রাস্তায় এসে গেল। জাভেদ আয়শাকে রিকশায় তুলে দিয়ে অন্য একটা রিকশায় উঠে ওয়াশা অফিসে যেতে বলল।

প্রায় পনের মোল দিন হাসপাতালে থেকে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে শারমিন বাসায় ফিরল।

আরো কিছুদিন পর একদিন সকালের দিকে জাভেদ স্ত্রীকে নিয়ে চাচা শ্বশুরের বাসায় বেড়াতে এল। দুপুরে খাওয়ার পর জাভেদ ও আয়শা শারমিনের সঙ্গে গল্প করছিল। এক সময় আয়শা শারমিনকে বলল, রফিকের কাছে দুর্ঘটনাটা শুনেছি, তবু তোর মুখে শুনতে চাই। বলতে শুনি।

শারমিন বলল, সেই ঘটনার কথা মনে পড়লে আমার খুব খারাপ লাগে। একবার যখন শুনেছ তখন আবার শুনতে চাচ্ছ কেন?

স্ত্রী কিছু বলার আগে জাভেদ বলল,লাগুক খারাপ, তবু আমরা শুনব।

শারমিন মৃদু হেসে বলল, আসামীদের ধরার জন্য গোয়েন্দাগিরী করবেন নাকি?

জাভেদ বলল, তা করতেও পারি।

জ্ঞান হারাবার আগে পর্যন্ত যা ঘটেছে সবকিছু বলে শারমিন বলল, জ্ঞান ফেরার পর জানতে পারলাম, যে ছেলেটা সন্ত্রাসীদের কবল থেকে আমাকে রক্ষা করেন, তিনিই হাসপাতালে এনেছিলেন এবং ব্লাড ব্যাংকে রক্ত নেই জেনে নিজের রক্ত দিয়ে আমাকে বাঁচিয়েছেন।  

আয়শা বলল, তা হলে তো তুই আমজাদ সাহেবের কাছে ঋণী রয়ে গেলি? আয়শা ও শারমিনের মধ্যে বয়সের তফাৎ এবং চাচাতো বোন হলেও দুজনের সম্পর্ক এত গভীর যে, বান্ধবীর মতো ব্যবহার করে।

শারমিন ম্লান মুখে বলল, হ্যাঁ আপা, ওঁর কাছে আমি চিরকাল ঋণী থেকে যাব। যদি পরিচয় জানতে পারতাম, যতটুকু পারতাম ঋণ পরিশোধ করার চেষ্টা করতাম।

আচ্ছা জ্ঞান ফেরার পর তোর কাছে থেকেই তো আমজাদ সাহেব ঠিকানা নিয়ে বাসায় খবর দিতে গিয়েছিলেন তাই না?

হ্যাঁ।

কেমন দেখতে বলতে পারবি?

গায়ের রং শ্যামলা, লম্বায় সাড়ে পাঁচ ফুটের মতো, স্বাস্থ্য ভালো, চওড়া কপাল, ভ্রু দু’টো জোড়া, আর কিছু মনে পড়ছে না।

পরণে কি ছিল বা হাতে কিছু ছিল কিনা মনে পড়ে?

শারমিন চোখ বন্ধু করে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে মনে করার চেষ্টা করল। তারপর চোখ খুলে বলল, মনে পড়েছে, সাদা পাজামা পাঞ্জাবী পরে ছিলেন। যখন ঠিকানা জানতে চাইলেন তখন পাজামা পাঞ্জাবীতে রক্তের দাগ দেখেছি। যা ছিল আমারই রক্ত। আর হাতে একটা প্লাস্টিকের সবুজ রং এর ফাইল ছিল। তারপর মৃদু হেসে শারমিন বলল, দুলাভাই আসামীদের ধরার জন্য গোয়েন্দাগিরী করবে বললেন, তাদের কথা জিজ্ঞেস না করে আমজাদ সাহেবের কথা জিজ্ঞেস করছ কেন?

স্ত্রী বলার আগে জাভেদও মৃদু হেসে বলল, আসামীদের কথা জিজ্ঞেস করবে পুলিশ। আমি তো আর পুলিশ না। আমি গোয়েন্দাগিরী করব, যিনি আমার অপূর্ব সুন্দর শালীকে সাক্ষাৎ মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করেছেন।

শারমিন হেসে উঠে বলল, তা বর্ণনা শুনে কী মনে হচ্ছে, তাকে আবিষ্কার করতে পারবেন?

সবকিছু শুনে জাভেদের সন্দেহ দৃঢ় হয়েছে। বলল, আমজাদ সাহেব যখন শ্বশুরের দেশের ছেলে তখন ইনশাআল্লাহ দু’দিন আগে হোক আর পরে তোক আবিস্কার করবই এবং তোমার কাছে হাজির করবই।

এতক্ষণ সবকিছু শুনে আয়শারও সন্দেহটা দৃঢ় হয়েছে, শারমিনের উদ্ধারকর্তা আমাদের আমজাদ ভাই। স্বামী থেমে যেতে বলল, তোর দুলাভাই যদি আবিস্কার করতে পারে, তা হলে তাকে কি পুরস্কার দিবি?

শারমিন বলল, সে কথা তুমি জিজ্ঞেস করছ কেন? করলে দুলাভাই করবেন। তা ছাড়া দুলাভাই পুরস্কারের কথা বলবেনই বা কী করে? ছোট শালীর উদ্ধারকর্তাকে আবিস্কার করা এবং তাকে খুশী করা বা কৃতজ্ঞতা জানান তো দুলাভাইয়ের দায়িত্ব।  

জাভেদ বলল, তুমি ঠিক বলেছ? এবার গিয়ে চাচা ও চাচি আম্মাকে বল আমরা বাসায় ফিরব।

শারমিন চলে যাওয়ার পর আয়শা বলল, ছেলেটার সম্পর্কে শারমিনও যা বলল। তা আমজাদ ভাইয়ের সঙ্গে সবকিছু মিলে যাচ্ছে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আমজাদ ভাই সেদিন আমাদেরকে মিথ্যে বলেছে।

জাভেদ বলল, আমারও দৃঢ় বিশ্বাস। তারপর বলল, সেদিন আমি কিন্তু আমজাদের কথা বিশ্বাস করি নি। কারণ ও যখন বলল, হাইজ্যাকারদের একজনের হাতে পিস্তল ছিল তাই ধরা দিয়েছি তখনই বুঝতে পারি নিশ্চয় কোনো কারণে মিথ্যে বলছে। ও খুব সাহসী, শক্তিশালী ও ধৈর্যশীল। কাউকে এতটুকু ভয় করে না একমাত্র আল্লাহকে ছাড়া। এমন কি মৃত্যুকেও না। বলে কী জান? বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে যেমন আল্লাহ সত্য, তেমনি সৃষ্টি জগতের মাঝে মৃত্যু সত্য। মৃত্যুর চেয়ে পৃথিবীতে সত্য আর কিছু নেই। মৃত্যুকে যে ভয় পায়, সে কাপুরুষ। সেই ছেলে হাইজ্যাকারের হাতে পিস্তল দেখে ভয় পাবে, তা কখনই সম্ভব নয়।

আয়শা বলল, তাই যদি হয়, তবে আমাদেরকে মিথ্যে বলল কেন?

জাভেদ বলল, সেটা আমিও ভেবেছি; কিন্তু কোনো কারণ খুঁজে পাইনি। তবে মেয়ে ঘটিত ব্যাপার বলে হয়তো সত্য ঘটনা বলে নি। ওতো আবার মেয়েদেরকে খুব এড়িয়ে চলে?

কেন?

জাভেদ হেসে উঠে বলল, এতকিছু জান, আর এটা জান না, ইসলামে গায়ের মহররম ছেলে মেয়েদের মেলামেশা নিষেধ? আর ও যে আমার চেয়ে ধার্মিক, তা তো আগেই বলেছি।

এমন সময় শারমিন ফিরে এসে বলল, তোমাদেরকে আব্বা-আম্মা চা খাওয়ার জন্য ডাকছে।

.

বাসায় ফিরে আয়শা বলল, তুমি আমজাদ ভাইকে চিঠি দিয়ে সত্য মিথ্যে যাচাই করবে না কী?

জাভেদ বলল, যদিও সিওর সেদিন আমজাদই শারমিনকে সন্ত্রাসীদের হাত থেকে রক্ষা করেছে, তবুও করব এবং কেন মিথ্যে বলল, জানতে চাইব। উত্তর পেতে অবশ্য দেরি হবে।

আয়শা বলল, দেরি হবে কেন?

ও বেশি দিন কোনো লজিং এ থাকতে পারে না। তাই বাড়িতে বা আমাকে চিঠি দিলেও ঠিকানা দেয় না। আমি ওর বাড়িতে যে সব চিঠি দিই। আমজাদ যখন বাড়িতে আসে তখন সে সব চিঠি পড়ে উত্তর দেয়।

আমজাদ ভাই কোনো লজিং-এ বেশি দিন থাকতে পারে না কেন?

ও মেয়েদেরকে এড়িয়ে চলে বলে।

লজিং-এ থাকার সঙ্গে মেয়েদের ব্যাপার আসবে কেন?

জাভেদ হেসে উঠে বলল, এত সহজ ব্যাপারটাও বুঝলে না? বেশির ভাগ লজিং বাড়িতে সেয়ানা মেয়ে লেখাপড়া করে। ইচ্ছা না থাকলেও তাকে পড়াতে হয়। আমজাদের আচার ব্যবহারে ও হ্যাঁণ্ডসাম চেহারা দেখে ঐ মেয়ে মাষ্টারের প্রেমে পড়ে যায়। অথবা মেয়ের মা-বাবা মাস্টারকে জামাই করতে চায়। তাই বেচারাকে ঘন ঘন লজিং বদলাতে হয়।

আয়শা মৃদু হেসে বলল; সত্যি, আমজাদ ভাইয়ের স্বাস্থ্য ও ব্যক্তিত্ব দারুন। যে মেয়ে একবার তার সংস্পর্শে আসবে, সেই প্রেমে পড়তে বাধ্য।

জাভেদ স্ত্রীর মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, সর্বনাশ! তুমি যেভাবে তার গুনাগুন বর্ণনা করছ, একদিনের সংস্পর্শে তার প্রেমে পড়ে যাও নি তো?  

আয়শা স্বামীর পিঠে কয়েকটা আদরের কীল দিয়ে বলল, অসভ্য কোথাকার, এমন কথা বলতে পারলে? জান না, স্ত্রীকে ইয়ার্কি করেও এরকম কথা বলতে নেই। আবার যদি কোনোদিন বল, বিষ খাব, তবু তোমাকে এ মুখ দেখাব না।

জাভেদ হাত জোড় করে বলল, ইয়ার্কি করতে গিয়ে ভুল করে না হয় কথাটা বলে ফেলেছি। সে জন্য পিঠে কীল মেরে শাস্তি দিয়েছ। তারপরে যা বললে, তা যে আমার ভুলের চেয়ে অনেক বেশি অন্যায়, তা জানো না বুঝি? কথাটা শুনে খুব দুঃখ পেলাম।

আয়শা ছলছল চোখে ভিজে গলায় বলল, তুমি যে ইয়ার্কি করে বলেছ তা বুঝে আমিও ইয়ার্কি করে বলেছি। এখন বুঝতে পারছি তোমার চেয়ে আমি বেশি অন্যায় করেছি। তারপর তাকে জড়িয়ে ধরে বলল, বল, মাফ করে দিয়েছ?

জাভেদ তাকে জোরে চেপে ধরে বলল, মাপ চাওয়ার কোনো প্রশ্নই উঠে না। দু’জনেই ইয়ার্কি করতে গিয়ে গোনাহর কাজ করে ফেলেছি। এস দু’জনেই তওবা পড়ে আল্লাহর কাছে মাফ চেয়ে নিই।

পরের দিন জাভেদ শারমিনের সঙ্গে তার সম্পর্কের কথা না জানিয়ে আমজাদকে চিঠি লিখে জানতে চাইল, ভার্সিটি থেকে ফেরার পথে কোনো মেয়েকে সন্ত্রাসীদের হাত থেকে উদ্ধার করে জেনালের হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল কিনা। যদি ঘটনা সত্য হয়, তা হলে তুই সেদিন মিথ্যা বলেছিলি কেন?  

প্রায় দু’আড়াই মাস পরে আমজাদ উত্তর দিয়ে জানাল, ঘটনা সত্য। মেয়ে ঘটিত ব্যাপার শুনে তোরা জালাতন করবি ভেবে সেদিন মিথ্যে করে হাইজ্যাকারদের পাল্লায় পড়েছিলাম বলেছি। কিন্তু খুব আশ্চর্য হচ্ছি, তুই ব্যাপারটা জানলি কী করে?

চিঠি জাভেদের অফিসের ঠিকানায় এসেছিল। বাসায় ফিরে স্ত্রীর হাতে দিয়ে বলল, আমজাদ কী লিখেছে পড়ে দেখ।

আয়শা পড়ে বলল, ওকে আবার চিঠি দিয়ে জানাবে না কী, যাকে সন্ত্রাসীদের হাত থেকে উদ্ধার করেছে, সে তোমার চাচাত শালী?

এখন জানাব না, চিঠি লিখে জরুরী আসতে বলব।

শারমিনকে জানাবে নাকী, তার উদ্ধারকর্তা তোমার বন্ধু?

না, তাকেও এখন জানাব না। আমজাদ আসার পর দু’জনকে সামনা-সামনি হাজির করে সারপ্রাইজ দিয়ে এমন বোকা বানাব যা ওরা কল্পনাও করতে পারবে না।

আমি একটা কথা বলি?

বল।

শারমিনের সঙ্গে আমজাদ ভাইকে খুব সুন্দর মানাবে। ওদেরকে এক সূতায় বাধার ব্যবস্থা করলে কেমন হয়?

তুমি তো দারুন কথা বলেছ। কিন্তু-বলে জাভেদ চুপ করে গেল।

আয়শা বলল, কী হল? কিন্তু বলে থেমে গেলে কেন?

কিন্তু চাচা ও চাচি আম্মা কী রাজি হবেন? আমজাদের বাবার অবস্থা তেমন ভালো নয়। তার উপর ও এখনও বেকার। তা ছাড়া শারমিনও রাজি হবে বলে মনে হয় না।

তুমি সব সময় এ্যাডভান্স চিন্তা কর। আরে বাবা, চাচা ও চাচি আম্মাকে প্রস্তাব দিয়েই দেখ না। রাজি হতেও তো পারেন। ওঁরা রাজি হলে আমি শারমিনের মত নেব। ওদের জোড়া আল্লাহ লিখে রাখলে সবাই রাজি হতে বাধ্য। আর আমজাদ ভাই তো চিরকাল বেকার থাকবে না। আল্লাহর মর্জি হলে যে কোনো সময়ে পেয়ে যাবে। চাকরি পাওয়ার পরে না হয় প্রস্তাব দিও।

জাভেদ স্ত্রীকে জড়িয়ে দরে মাথায় চুমো খেয়ে বলল, আল্লাহ এই মাথায় কত বুদ্ধি দিয়েছেন। তারপর বলল, আমজাদ চলে যাওয়ার পর আমিও কথাটা চিন্তা করেছিলাম, ওর চাকরি হলেই তোমার সঙ্গে পরামর্শ করে মামাকে প্রস্তাব দেব ভেবেছিলাম।

আয়শা অবাক হয়ে বলল, তা হলে তো আমার মাথার চেয়ে তোমার মাথায় বুদ্ধি বেশি। তবু আমার বুদ্ধির তারিফ করলে কেন?

করলাম এই জন্য, তুমি বুদ্ধি প্রকাশ করেছ, আর আমি প্রকাশ করতে পারি নি।

আয়শা আলিঙ্গনমুক্ত হয়ে বলল, এর মধ্যে যদি শারমিনের বিয়ের সম্বন্ধ আসে?

যখন আসবে তখন চিন্তা করব।

ধর না, এসেছে।

আসার আগে বা পরে চাচা নিশ্চয় আমাদের জানাবেন। আমি তখন বলব, আমার হাতে জানাশোনা একটা খুব ভালো ছেলে আছে, ওদেরকে না করে দেন।

চাচা যদি ছেলের পরিচয় জানতে চান?

বলব, শারমিনকে যে ছেলেটা সন্ত্রাসীদের হাত থেকে বাঁচিয়েছিল, সেই ছেলে।

চাচা তো ছেলের পরিবারের সবকিছু জানতে চাইবেন।

জানতে চাইলে যা সত্য তাই বলব।

জানার পর যদি না করে দেন?

সে সম্ভাবনার কথা তো তোমাকে আগেই বলেছি। তাই তোমার কথাটা পূনরাবৃত্তি করছি, “আল্লাহ ওদের জোড়া লিখে রাখলে সবাই রাজি হতে বাধ্য।”

এই কথায় দুজনেই হেসে উঠল।

.

নাজনীন ছুটির দিন সকালের দিকে প্রায়ই জাভেদের বাসায় এসে সারাদিন আয়শার সাথে গল্প করে বিকেলে বাসায় ফিরে। একদিন গল্প করার সময় আয়শাকে বলল, সেদিন তো দুলাভাই বলেছিল, আমার উদ্ধারকর্তাকে আবিস্কার করবে। এতদিন হয়ে গেল, কই কিছু তো করতে পারল না।

আয়শা সুযোগ পেয়ে তার মন বোঝার জন্য হেসে উঠে বলল, কেন রে? উদ্ধারকর্তাকে দেখার জন্য মন বুঝি খুব ছটফট করছে?

নাজনীন তার ইঙ্গিত বুঝতে পেরে কপট রাগ দেখিয়ে বলল, তুমি সব সময় কথার মানে উল্টো ধর। আমার জায়গায় তুমি হলে তোমারও তাই করতো বুঝি?

বারে, করত না মানে? নিশ্চয় করত। শুধু উদ্ধারকর্তা বলে নয়, অমন সুন্দর, স্বাস্থ্যবান ও ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন সুপুরুষের জন্য কার মন না ছটফট করে?

কথাটার সত্যতা উপলব্ধি করে শারমিন লজ্জারাঙা বয়ে বলল, বিয়ের পরে কিন্তু কোনো মেয়েরই পর পুরুষকে ওভাবে লক্ষ্য করা উচিত নয়।  

তুই অবশ্য ঠিক কথা বলেছিস, তবে এটাও ঠিক, বিয়ের পর প্রিয় কোনো মেয়ের জন্য পাত্রের সব কিছু লক্ষ্য করাতে দোষের কিছু নেই।

আয়শা যে তাকেই উদ্দেশ্য করে কথাটা বলল, তা বুঝতে পেরে শারমিন আরো লজ্জা পেল। প্রসঙ্গটা ঘোরাবার জন্য বলল, দুলাভাই কতদূর কী করল, বললে না যে?

তোর দুলাভাই একদিন বলল, ঐ ব্যাপারে সে অনেক দূর এগিয়েছে। শুধু প্রমানের অপেক্ষায় আছে।

শারমিন মনের আবেগে বলে ফেলল, জান আপা, আমজাদ সাহেবকে কয়েক মিনিটের জন্য একবার মাত্র দেখেছিলাম। তাতেই মনে হয়েছিল, তার মতো সুপুরুষ আর কাউকে কখনো দেখি নি। যখন তার কথা মনে পড়ে তখন মন ভীষণ খারাপ হয়ে যায়। সামান্য কৃতজ্ঞতা জানাবার সুযোগ পর্যন্ত পেলাম না। তারপর দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বলল, জানি না, আল্লাহ আমাকে সে সুযোগ দেবেন কিনা।

আয়শা বলল, আল্লাহ তাঁর নেক বান্দা-বান্দীর নেক মকসুদ পূরণ করে থাকেন। তিনি তোর মতো নেক বান্দীর মকসুদ নিশ্চয় পূরণ করবেন।

আমি তার নেক বান্দীদের পায়ের ধূলো হতে পারলে নিজেকে ধন্য মনে করতাম। দোয়া করো, আল্লাহ যেন আমার আশা পূরণ করেন।

তাতো করবই। তোমার জন্য করব না তো কার জন্য করব? তার যা জানার, তা জানতে পেরেও সীওর হওয়ার জন্য বলল, এবার একটা কথা বলছি কিছু মনে করবি না বল?

ওমা, তোমার কোনো কথায় কখনো কিছু মনে করেছি নাকি?

তা করিসনি; তবে এখন যা বলব, কিছু মনে করারই কথা। তাই বললাম আর কি।

কথাটা যাই হোক না কেন তুমি বল। আমি কিছু মনে করব না।

ধর, হঠাৎ একদিন আমজাদ সাহেবের সঙ্গে কোথাও তোর দেখা হয়ে গেল। তখন কী করবি?

কথাটা শুনে শারমিনের মুখটা কয়েক সেকেণ্ডের জন্য উজ্জ্বল হয়ে উঠেই ম্লান হয়ে গেল। দীর্ঘ নিশ্বাস চেপে রেখে বলল, এমন সৌভাগ্য কি আমার হবে?

হবে কি হবে না, তা ভাগ্য যিনি লিখেছেন তিনি জানেন। যা জিজ্ঞেস করলাম উত্তর দে।

শারমিন কি বলবে মাথা নিচু করে চিন্তা করতে লাগল।

অল্পক্ষণ অপেক্ষা করে আয়শা বলল, কিছু বলছিস না যে?

আরো কিছুক্ষণ ঐভাবে থেকে শারমিন মুখ তুলে তার দিকে অশ্রুভরা চোখে বলল, কৃতজ্ঞতা জানান ছাড়া আর কি করতে পারি?

শুধু চোখের পানি আর কৃতজ্ঞতা জানিয়ে ঋণ পরিশোধ করতে চাস বুঝি?

আর কি করতে পারি, তাহলে তুমিই বলে দাও।

যিনি নিজের জীবনের মায়া ত্যাগ করে তোমাকে নব জন্ম দিলেন, তাকে শুধু কৃতজ্ঞতা জানিয়ে আর কতটুকু ঋণ পরিশোধ করতে পারব? যদি তোর মনটা দিতে পারিস, তা হলে হয়তো কিছুটা পরিশোধ হতে পারে।

হাসপাতালে জ্ঞান ফেরার পর শারমিন সবকিছু জেনে তখন থেকে উদ্ধারকর্তার প্রতি অজানা একটা আকর্ষণ অনুভব করছে। তারপর যত দিন-মাস গড়িয়েছে, সেই আকর্ষণ তত বেড়েই চলেছে। তবে সেই আকর্ষণটা যে কি, তা বুঝতে পারে নি। আয়শা আপা যেন চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিল। তার হার্ট বিট বেড়ে গেল, মুখটা লজ্জায় লাল হয়ে উঠল। ভাবির কাছে ধরা পড়ার ভয়ে অনেক্ষণ মুখ নিচু করে রইল।

তার অবস্থা দেখে আয়শা যা বোঝার বুঝে গেল। তবু বলল, কী ব্যাপার? মুখ নিচু করে আছিস কেন? মাইণ্ড করলি না কী?  

শারমিন সামলে নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে বলল, আমি মন দিলে উনি যদি গ্রহণ না করেন?

গ্রহণ করা না করা, সেটা তার ব্যাপার? তবে আমার যতদূর মনে হয়, তিনি তোকে ফেরাবেন না।

কী করে বুঝলে?

এতো সহজেই বোঝা যায়। তাকে দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন, তাই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এত কিছু করেছেন।

যাদের মধ্যে সামান্যতম মানবতা বোধ আছে, তারা কাউকে বিপদে পড়তে দেখলে উদ্ধারের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েন।

তা না হয় স্বীকার করলাম; কিন্তু ব্লাডব্যাংকে রক্ত নেই জেনে নিজের রক্ত দিলেন, এটার ব্যাখ্যায় কী বলবি?

যাদের মানবতা বোধ বেশি, তারা শুধু রক্ত কেন, জীবন উৎস্বর্গ করেও বিপদগ্রস্থকে বাঁচাবার চেষ্টা করেন।

তুই অবশ্য ঠিক কথা বলেছিস; তবে তারা সাধারণ মানুষ নন। তারা যেমন অসাধারণ তেমনি খুব উঁচু মনের মানুষ।এরকম মানুষ আজকালের দুনিয়ায় লাখে একটা আছে কিনা সন্দেহ। মনিষিরা বলেছেন, “লক্ষ কোটি সম্পদের চেয়ে একটা উঁচু বা ভালো মন অনেক বেশি মূলব্যান।” তুমি নিজেই ব্যাখ্যা করলে আমজাদ। সাহেবের মন খুব উঁচু। আর উঁচু মনের মানুষ যে কখন কাউকে নিরাশ করে না, তা সবাই জানে। আগের যুগের অনেক উঁচু মনের মানুষের কথা শোনা যায়। তাদের একজনের কথা বলছি শোন, দাতা হাতেম তাঈয়ের নাম নিশ্চয় শুনেছিস?

শারমিন বলল, হ্যাঁ শুনেছি।

তার জীবনের একটা ঘটনা বলছি,

আমাদের নবী হযরত মুহাম্মদ (দঃ) জন্মাবার অনেক আগে ইয়ামন দেশের বাদশাহ ছিলেন হাতেম তাঈ। ছেলে বেলা থেকেই তিনি পরোপকারী ছিলেন। বাদশাহ হওয়ার পরও সারা জীবন মানুষের কল্যানের কাজ করে গেছেন। তাই দাতা ও উদার হৃদয়ের মানুষ হিসাবে সারা বিশ্বে তার সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। অন্য কোনো এক দেশের বাদশাহও খুব দাতা ছিলেন। তিনি প্রজাদের কল্যাণের জন্য অকাতরে দান করতেন। তবু প্রজারা তার গুণাগুণ না করে হাজার হাজার মাইল দূরে যার দেশ, সেই হাতেম তাঈয়ের দানের গুণাগুণ করত। এর কারণ জানার জন্য ঐ বাদশাহ সভাসদদের সঙ্গে পরামর্শ করে একটা বুদ্ধি আঁটলেন। বাদশাহ। শুনেছিলেন, হাতেম তাঈয়ের হাজার হাজার ঘোড়ার মধ্যে একটা খুব সুন্দর ও তেজস্বী ঘোড়া আছে। সেই ঘোড়াটা হাতেম তাঈয়ের অত্যন্ত প্রিয়। সেটা সব সময় তার সঙ্গে থাকে। সেই ঘোড়ায় চড়ে সবখানে যাতায়াত করেন।

ঐ ভিনদেশী বাদশাহ সাত আটজন লোক হাতেম তাঈয়ের কাছে পাঠাবার সময় বলেদিলেন, তোমরা গিয়ে বলবে, আমাদের বাদশাহ আপনার অতি প্রিয় ঘোড়াটা চেয়েছেন।  

বাদশাহর লোকেরা ইয়ামন দেশে গিয়ে হাতেম তাঈয়ের দরবারে হাজির হল। হাতেম তাঈ তাদেরকে বললেন, আপনারা নিশ্চয় ভিন দেশ থেকে কোনো প্রয়োজনে আমার কাছে এসেছেন। আপনারা পরিশ্রান্ত। বিশ্রাম নিয়ে খাওয়া দাওয়া করুন। তারপর আপনাদের কথা শুনব।

হাতেম তাঈ নিজে তদারকী করে খুব যত্ন সহকারে মেহমানদারী করলেন। তারপর বললেন, এবার বলুন, আপনারা কোন দেশে থেকে কী প্রয়োজনে এসেছেন?

তাদের দলপতি বলল, আমাদেরকে অমুক দেশের বাদশাহ নামদার আপনার উদার হৃদয় ও দানশীলতার কথা শুনে পাঠিয়েছেন।

হাতেম তাঈ বললেন, কেন পাঠিয়েছেন বলুন।

দলপতি বলল, আপনার নাকি খুব সুন্দর ও তেজস্বী একটা ঘোড়া আছে। যেটা আপনার অত্যন্ত প্রিয়। সেই ঘোড়াটা আমাদের বাদশাহ নামদার চেয়ে পাঠিয়েছেন।

দলপতির কথা শুনে হাতেম তাঈ চোখের পানি ফেলতে লাগলেন। তাই দেখে বাদশাহর লোকেরা মনে করল, উনি প্রিয় ঘোড়াটা দিতে চান না। উনি হয়তো জানেন আমাদের বাদশাহ খুব প্রতাপশালী। না দিলে বিপদ হবে ভেবে কাঁদছেন। দলপতি বললেন, এতে কাঁদবার কী আছে? আপনার ইচ্ছা হলে দেবেন, না হলে দেবেন না। আমাদের বাদশাহ নামদার খুব দীলদার। সামান্য একটা ঘোড়ার জন্য আপনাকে কিছুই বলবেন না। আপনার ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই।

হাতেম তাঈ চোখ মুছে বললেন, আপনারা যা ভাবছেন তা নয়। আমার সব পশু চরণ ভূমীতে চলে গেছে। আপনাদের মেহমানদারী করার জন্য অন্য কোনো উপায় না পেয়ে বাদশাহ নামদার যে ঘোড়াটি চেয়েছেন, সেটাই জবেহ করেছি।

বাদশাহর লোকেরা হাতেম তাঈয়ের কথা শুনে ভীষণ আশ্চার্য হয়ে বলল, আপনার দানশীলতা ও বদান্যতার কথা শুনে আমাদের বাদশাহ সত্য মিথ্যা যাচাই করার জন্য আপনার প্রিয় ঘোড়াটি চেয়ে পাঠিয়েছেন। সত্যি, আমরা আপনার সম্পর্কে যা শুনেছি, তার চেয়ে অনেক বেশি দেখলাম। তারপর বিদায় নিয়ে তারা ফিরে গেল।

গল্পটা শেষ করে আয়শা বলল, শুনলেতো একজন উঁচু মনের মানুষের কথা?

শারমিন বলল, আমাকে যে মন দেওয়ার কথা বললে, ওঁকে অন্য কোনো মেয়ে যদি আগেই মন দিয়ে থাকে। আর সেকথা আমাকে জানান, তা হলে আমি হয়তো লজ্জায় মরেই যাব।

মন দেওয়ার আগে আলাপের সময় বুদ্ধি করে তা জেনে নিবি। এত লেখাপড়া করেছিস, এটাও শিখিয়ে দিতে হবে না কী?

ঠিক আছে, তোমার কথা মনে রাখব। এবার আসি আপা। আরো দেরি করলে আম্মা চিন্তা করবে।’

তোর দুলাভাইয়ের সাথে দেখা করে যাবি না?

দুলাভাই কখন ফিরবে তার ঠিক আছে। তারপর সালাম বিনিময় করে শারমিন চলে গেল।

কিছুক্ষণ পরে জাভেদ বাসায় ফিরে স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করল, শারমিন চলে গেছে?

আয়শা বলল, এইতো কিছুক্ষণ আগে গেল।

আমজাদের ব্যাপারে আলাপ করলে না কী?

হ্যাঁ করেছি।

কী বুঝলে?

ওর মত আছে।

কী ভাবে বুঝলে? ডাইরেক্ট জিজ্ঞেস করেছিলে?

না। তারপর শারমিনের সঙ্গে যা আলাপ হয়েছিল সংক্ষেপে বলল।

আমজাদকে আমরা চিনি অথবা আমদের আত্মীয় সেকথা বলনি তো?

তুমি পাগল হয়েছ? ওসব বলতে যাব কেন?

যাক নিশ্চিন্ত হলাম। আচ্ছা, আমজাদের আর্থিক অবস্থা সম্বন্ধে কিছু বলেছ নাকী?

না বাবা না, তার সম্বন্ধে কিছুই বলিনি। যা বলেছি তাতে তোমাকে বললামই।

.

প্রায় সাত আট মাস পর জাভেদ অফিসে আমজাদের চিঠি পেল। চিঠি পড়ে তার চাকরি হয়েছে জেনে খুব খুশী হল। আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে ভাবল, এতদিনে আল্লাহ ওর উপর রহম করলেন। বাসায় ফিরে জাভেদ আমজাদের চাকরি পাওয়ার খবর স্ত্রীকে জানাল।

আয়শা আল হামদুলিল্লাহ বলে বলল, এবার তুমি বড় মামাকে প্রস্তাবটা দাও।

জাভেদ বলল, এত তাড়াহুড়ো করার কি আছে? ওকে চিঠি দিয়ে আসতে বলি। আসার পর ওর সাথে আলাপ করে যা করার করব। ও যদি শারমিকে পছন্দ না করে?

আমার মন বলছে, আমজাদ ভাই ওকে পছন্দ করবে।

আমারও মন তাই বলছে। তবু ওর সঙ্গে আলাপ না করে প্রস্তাব দেওয়া ঠিক হবে না।

তা হলে চিঠি দিয়ে আমজাদ ভাইকে আসতে লিখে দাও।

তা আমিও ভেবেছি।

চাকরি পাওয়ার খবর জাভেদকে জানাবার সময় আমজাদ লজিং-বাড়ীর ঠিকানা দিয়েছিল। জাভেদ পরের দিন চিঠি দিল।

আমজাদ উত্তরে লিখল, নূতন চাকরি, তার উপর অফিসে কাজের খুব চাপ। তবু আসার চেষ্টা করব।  

মাস দুয়েক অপেক্ষা করে জাভেদ আবার তাকে আসার কথা লিখে চিঠি দিল।

কয়েকদিন পর আমজাদের কাছ থেকে একই উত্তর এল।

আরো তিনটে চারটে চিঠি দিয়ে একই উত্তর পেয়ে জাভেদ স্ত্রীকে বলল, আমি তো. ওকে চিনি। নূতন চাকরি, বেশি কাজ করে বসকে খুশী করার চেস্টা করছে। অন্ততঃ ছয় সাত মাসের আগে আসবে না।

আয়শা বলল, সেদিন বললে না, দু’এক মাসের মধ্যে ভাবির সঙ্গে তার বাপের বাড়ি বেড়াতে যাবে? আমি বলি কি তুমি চাচা ও চাচি আম্মাকে প্রস্তাব দাও। ওঁরা কী বলেন জানা থাকলে আমজাদ ভাইকে না পেলেও তালই-মাই এর সঙ্গে আলাপ করতে সুবিধা হবে। তারপর না হয় তুমি একবার ঢাকা গিয়ে তার সঙ্গে দেখা করবে।

জাভেদ বলল, কথাটা মন্দ বলনি। ঠিক আছে, দু’একদিনের মধ্যে চাচা ও চাচি আম্মার সঙ্গে আলাপ করব।

একদিন অফিস ছুটির পর জাভেদ চাচাশ্বশুরের বাসায় গেল।

জাব্বার সওদাগর কিছুক্ষণ হল ফিরেছেন। ড্রইংরুমে ফজিলা বেগম স্বামীকে চা-নাস্তা দিয়ে সামনে বসে আছেন।

জাভেদ ঢুকে চাচি আম্মার দিকে তাকিয়ে সালাম দিল।

ফজিলা বেগম সালামের উত্তর দিয়ে বললেন, বস বাবা, তোমার চাচার সঙ্গে নাস্তা খাও। বসার পর নাস্তা পরিবেশন করে বললেন, আয়শাও তাবাসসুমকে নিয়ে এলে না কেন?

জাভেদ বলল, আমি অফিস থেকে আসছি। শারমিনকে দেখছিনা যে? ওর বান্ধবী সুমীর বাসায় গেছে। নাস্তা খেয়ে চা খাওয়ার সময় জাভেদ বলল, আপনারা কী শারমিনের জন্য কোনো ছেলে দেখেছেন?  

জাব্বার সওদাগর বললেন, কত সম্বন্ধ তো এল, কিন্তু ছেলে পছন্দ হয়নি। তোমার সন্ধানে ভালো ছেলে আছে না কী?

জ্বি আছে? তাই তো জানাতে এলাম।

ছেলেটার সবকিছু খোঁজ খবর নিয়েছ?

জ্বি নিয়েছি। আমার বিয়াই হয়। তারপর আমজাদের পরিচয় ও তার বাবার আর্থিক অবস্থার কথা বলল।

লিয়াকত আলীদের সবাইকে আমি চিনি। ওরা আমাদের দূর সম্পর্কের আত্মীয়। অনেক আগে আব্বার সঙ্গে একবার ওদের বাড়িতে গিয়েছিলাম। তখন লিয়াকত আলির দুই মেয়ে ও একছেলে দেখেছিলাম। ছেলেটা বেশ ছোট ছিল। ঐ ছেলেই তাহলে আমজাদ?

জাভেদ বলল, জ্বি।

জব্বার সওদাগর বললেন, আমজাদের সম্পর্কে যা বললে, ঐ রকম ছেলেই আমার পছন্দ।

জাভেদ বলল, আমি আমজাদকে যেমন জানি, তেমনি শারমিনকেও জানি। ওদের মন-মানষিকতা প্রায় একই রকম। তাই তো ওদের আর্থিক অবস্থা তেমন ভালো নয় জেনেও পছন্দ করেছি। একটা কথা শুনে আপনারা খুব অবাক হবেন, দুর্ঘটনার দিন আমজাদই শারমিনকে সন্ত্রাসীদের কবল থেকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল।

জব্বার সওদাগর অবাক কণ্ঠে বললেন, কী বলছ তুমি?

জাভেদ বলল, জ্বি। আমরা অবশ্য তখন জানতে পারি নি। আমজাদ ভার্সিটি থেকে বি.এস.সি. পাশের সনদপত্র উঠাবার জন্য আগের দিন এসে আমার বাসায় উঠে। পরের দিন সকালে নাস্তা খেয়ে ভার্সিটিতে যায়। দুপুরে না ফেরায় আমরা চিন্তিত হয়ে পড়ি। পাঁচটার সময় ফিরে এলে দেরি হওয়ার কারণ জিজ্ঞেস করি। বলল, “হাইজ্যাকারদের পাল্লায় পড়েছিলাম। তাই দেরি হয়ে গেল।” পরের দিন হাসপাতালে বড় মামীর কাছে ছেলেটার বাড়ি কুমিল্লা শুনে এবং রফিকের মুখে নাম শুনে আমার মনে সন্দেহ হয়। তারপর শারমিন সুস্থ হওয়ার পর ওর কাছে সবকিছু শুনে সন্দেহটা আরো বেড়ে যায়। একদিন আমজাদকে দূর্ঘটনার কথা উল্লেখ করে চিঠি দিয়ে জানতে চায় ঐ সেদিন শারমিনকে সে উদ্ধার করেছিল কিনা? আমজাদ স্বীকার করে চিঠির উত্তর দেয়।  

স্বামী কিছু বলার আগে ফজিলা বেগম বললেন, ছেলেটার গায়ের রং শ্যামলা হলেও দেখতে খুব সুন্দর। স্বাস্থ্যও খুব ভালো। কথা বার্তা খুব নম্র। পছন্দ করার মতো ছেলে। লিয়াকত আলির বাড়ি রফিকের নানাদের গ্রামের পাশের গ্রামে। আব্বার মুখে ওদের বংশের অনেক সুনাম শুনেছি। এবারে যখন আব্বার অসুখ শুনে দেখতে গেলাম তখন আমার বড় ভাই বলল, লিয়াকত আলির ছেলেটা খুব ভালো। ঢাকায় ভালো চাকরি করে নূতন বাড়ি-ঘর করেছে। জমি-জায়গাও কিনেছে। আরো বলল, লিয়াকত আলির ছেলের বিয়ে দেবেন বলে ভালো মেয়ের খোঁজ করছেন। আমার মেয়ে সুফিয়া যদি সেয়ানা হত, তার ছেলেকে জামাই। করতাম। তারপর আমাকে বলল, শারমিন তো বিয়ের উপযুক্ত হয়েছে, ওর বাবাকে খোঁজ খবর নিতে বলিস। কথাটা তোমাকে বলি বলি করেও বলা হয়নি। এখন জাভেদের কথা শুনে মনে পড়ল। আমার মনে হয়, জাভেদের প্রস্তাব মেনে নেওয়ায় ভালো।

জব্বার সওদাগর বললেন, ওদের সম্পর্কে আমি যে কিছু জানি না তা নয়। তারপর জাভেদকে বললেন, তুমি একদিন সময় করে তাদের বাড়িতে গিয়ে আমার কথা বলে শারমিনের ব্যাপারে আলাপ করো। তারা রাজি থাকলে আমাদের কোনো আপত্তি নেই।

জ্বি করব বলে জাভেদ বিদায় নিয়ে বাসায় ফিরল।

স্বামীকে এত দেরিতে ফিরতে দেখে আয়শা জিজ্ঞেস করল, এতক্ষণ অফিসেই ছিলে?

জাভেদ বলল, না। ছুটির পর চাচা শ্বশুরবাড়ি গিয়েছিলাম ঘটকালী করতে।

আয়শা বলল, নিশ্চয় আমজাদ ভাই ও শারমিনের…।

তাকে কথাটা শেষ করতে না দিয়ে জাভেদ বলল, হ্যাঁ ওদের ব্যাপার নিয়ে আলাপ করে এলাম।

আলাপের ফলাফল বল।

জাভেদ সবকিছু বলে বলল, আসলে আমজাদ একটা রত্ন। ওর মতো ছেলে এই যুগে খুবই বিরল। আমি মেয়ে হলে নির্ঘাৎ ওর প্রেমে পড়ে যেতাম।  

আয়শা মেকী দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বলল, আল্লাহ যখন তা করেন নি তখন আর হা-হুঁতাশ করে লাভ কী?

দরকার নেই বাবা মেয়ে হওয়ার। হলে এই চাঁদবদনীকে পেতাম না। কথা শেষ করে জাভেদ তাকে আলিঙ্গনাবদ্ধ করে সারা মুখে আদরে আদরে ভরিয়ে দিতে লাগল।

আয়শাও চুপ করে থাকল না। আদরের প্রতিদানে মেতে উঠল।

মাস চারেক হল ওদের একটা মেয়ে হয়েছে। জাভেদ ভালো নাম রেখেছে। উম্মে কুলসুম। আয়শা ডাক নাম রেখেছে তাবাসসুম।

তাবাসসুম শুয়ে থেকে হাত পা ছুঁড়ে খেলছিল। এবার মা-বাবার দিকে তাকিয়ে নিথর হয়ে গেল।  

আয়শার সেদিকে নজর পড়তে বলল, এই ছাড়, একজন দেখছে।

জাভেদ তাড়াতাড়ি স্ত্রীকে আলিঙ্গন মুক্ত করে বলল, কই? কে দেখছে?

আয়শা তাবাসসুমের দিকে হাত বাড়িয়ে বলল, ঐ দুষ্ট মেয়েটা।

জাভেদ হেসে উঠে আবার তাকে জড়িয়ে ধরে বলল, ঐ দুষ্টু মেয়েটা ভালো করে দেখুক, তার মা-বাবা কি করছে।

আয়েশা বলল, ও পেসাব করলে খেলতে খেলতে থেমে যায়। দেখছ না চুপ করে রয়েছে। এবার ছাড় ওর কাঁথাটা পাল্টে দিই।

জাভেদ ছেড়ে দিয়ে এগিয়ে এসে মেয়েকে কোলে নিয়ে আদর করতে লাগল।

আয়শা কাঁথা পাল্টে স্বামীর কাছ থেকে মেয়েকে নিয়ে বুকের দুধ ধরাল।

জাভেদ তার পাশে বসে বলল, সামনের মাসে তো আমরা ভাবির সঙ্গে তার বাপের বাড়িতে বেড়াতে যাচ্ছি। তালই মাওই মনে হয় অমত করবেন না। তবু যদি তোমার চাচা বড়লোক ভেবে অমত করেন, তুমি ম্যানেজ করবে। ভাবিও শারমিনকে দেখেছে। তাকেও বলব, সে যেন তার মা-বাবাকে রাজি করায়।

আয়শা বলল, তা না হয় হল; কিন্তু আমজাদ ভাই যদি বড়লোকের মেয়েকে বিয়ে করতে না চান?

তোমার কথা ঠিক। তালই মাওই বড়লোকের মেয়েকে বৌ করতে রাজি হলেও আমজাদ হবে না।

আয়শা অবাক হয়ে বলল, তাই যদি জান, তা হলে ওদের বিয়ে দেওয়ার জন্য এতকিছু করছ কেন?

আমজাদ বড়লোকের মেয়েকে বিয়ে করবে না আমাকে বলেছে ঠিক; কিন্তু সেই সাথে এটাও বলেছে, মা-বাবা যেখানে বিয়ে দেবে, সেখানেই করবে। ওর মতো মা-বাপ ভক্ত ছেলে আর কেউ আছে কিনা জানি না।

আয়শা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বলল, তাই বল। আমি তো আমজাদ ভাই বড়লোকের মেয়েকে বিয়ে করবে না শুনে ভাবলাম, শারমিনের কাছে অপদস্ত না হতে হয়।

পরের মাসে জাভেদ ভাবির সঙ্গে আয়শা ও মেয়েকে নিয়ে আমজাদদের বাড়িতে গেলে। আমজাদ তখন ঢাকায়। জাভেদ তালই মাওই-এর সঙ্গে আমজাদ ও শারমিনের বিয়ের ব্যাপারে বিস্তৃত আলোচনা করে রাজি করাল। ফিরে আসার সময় তাদের বলল, আমজাদকে মেয়ে দেখার জন্য অবশ্যই চট্টগ্রামে পাঠাবেন। আমজাদদের বাড়িতে ছুটি কাটিয়ে জাভেদ চট্টগ্রামে ফিরে এসে একদিন চাচা শ্বশুরের বাসায় গিয়ে তাদেরকে আমজাদের মা-বাবার মতামত জানিয়ে বলল, তালই মাওইকে বলে এসেছি, আমজাদ বাড়িতে এলে যেন চট্টগ্রামে পাঠিয়ে দেন।

জব্বার সওদাগর বললেন, আমজাদ এলে আমাদের বাসায় নিয়ে আসবে। শারমিনও তাকে দেখবে। তারও তত মতামত আছে।

জাভেদ বলল, তাতো নিশ্চয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *