পটলা সমগ্র ১
পটলা সমগ্র ২

কেষ্টমামার কীর্তি

কেষ্টমামার কীর্তি

সারা কলকাতায় হৈচৈ পড়ে গেছে! পড়ারই কথা। মহাকাশে কোনো দেশের পাঠানো এক কৃত্রিম উপগ্রহ চুরমার হয়ে ভেঙে পড়ছে। কোথায় কখন কি ভাবে সেই বিরাট বস্তুগুলো টুকরো টুকরো হয়ে জ্বলন্ত অবস্থায় ছিটকে পড়বে আর কি প্রলয় কাণ্ড বাধাবে তা কে জানে।

গোপীবল্লভ তর্কতীর্থ সেদিন হরিসভায় ধর্মালোচনার সময় বেশ জমিয়ে একটিপ নস্যি নাকের ফোকরে সেঁদিয়ে মেজাজ এনে বলে—হবে না? ঈশ্বরের রাজ্যে মানুষ গেছেন ক্যারদানি দেখাতে। এখন বোঝো ঠ্যালা! নিজেদের পাঠানো উপগ্রহ এখন অগ্নিগর্ভ হয়ে এগিয়ে আসছে দ্বাদশ সূর্যের তেজ নিয়ে সৃষ্টি আর মানুষ জাতকে ধ্বংস করতে। নিশ্চিত ধ্বংস অনিবার্য। হরিসভায় উপস্থিত বুড়োবুড়ি। মানুষজনের মুখে নেমেছে আতঙ্কের ছোঁয়া।

পতিত ডাক্তার এই আড্ডায় একজন নিয়মিত ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি। এককালে ডাক্তারীতে নামও করেছিলেন এই এলাকায়। এখন অনেক ছোকরা ডাক্তার এসে পাড়ায় পতিতবাবুর বাজার একটু মন্দা ।

আমাদের পঞ্চপাণ্ডব ক্লাবের একনিষ্ঠ সদস্য হোঁৎকার চিন্তাশীল অভিমত—পতিত ডাক্তার ইদানীং কানে কম শোনত্যাছে, জ্বর হইলে দিছে প্যাটের অসুখের ওষুধ। প্যাটের অসুখে দেয় জ্বরের ওষুধ! রোগী হালায় যাইব ক্যান!

এহেন পতিতবাবু হরিসভায় ঘোষণা করেন,-পণ্ডিতমশাই এই উপগ্রহের বিস্ফোরণে যারা বিলীন হবে তারা তো মরে বেঁচে যাবে। কিন্তু বাকি যারা থাকবে তাদের প্রাণ যাবে বেঘোরে। শরীরের অন্ত্র যন্ত্র ক্ষয়ে যাবে। আর ক্যানসার -বিলকুল ক্যানসারে কাতরে-কেতরে মরবে, দেখবেন।

ভক্তজনে কাতর কণ্ঠে শুধোয়, তাহলে কিসের রক্ষা পাবো পণ্ডিতমশাই ?

পণ্ডিত গোপীবল্লভ অর্ধনিমীলিত নেত্রে বলেন, –নাম গান করো ঈশ্বরকে ডাকো। কে জানে কি হবে!

পঞ্চপাণ্ডব ক্লাবের সভ্যবৃন্দের মুখেও ভীতির ছায়া। আমরা তো কোনো ছার, সারা কলকাতা, মায় বাংলাদেশের মানুষই সেই সমাগত ধ্বংসের ভয়ে শিউরে উঠছে।

কাগজখানা পড়ে আছে। আমরা গড়াগড়ি দিচ্ছি ঘাসে। একেবারে সামনের পাতায় মহাকাশে ছিটকে আসা আগুনের পুঞ্জ! তারা পৃথিবীর উপর এসে পড়বে দু’একদিনের মধ্যে। গোবরা ম্লানমুখে বলে,–ভেবেছিলাম এবার গদাধর শিল্ডটা জিতবোই।

হোঁৎকার আলুকাবলিতেও অরুচি এসে গেছে। বলে,—না। পটলা খানদুই কুলপি ছাড় গিয়া। দু’দিন তো আর বাঁইচা আছি মাত্তর। গোবরা ওই শিল্ডের স্বপ্ন ছাইড়া দে।

ফটিকের খেয়াল-এর সুর থেমে গেছে। বলে সে—আর গান গেয়ে কি হবে রে? ডেথ্ কামিং।

সারা কলকাতা ক্রমশ ক্ষেপে উঠেছে। গোপীবল্লভ পণ্ডিতের ওই নাম-গানের কথাটা যেন সারা কলকাতার মানুষের কানে পৌঁছে গেছে।

শুরু হয়েছে নাম সংকীর্তন। গঙ্গার ধারে কোথাও বিরাট প্যাণ্ডেল করে মারোয়াড়ীর দল মণকে মণ ঘি পুড়িয়ে যজ্ঞ করছে। পার্ক, তেরাস্তার মোড় নাট মন্দিরের চত্বরে হাজার হাজার মানুষ বসে পড়েছে খোল করতাল নিয়ে।

আমাদের পাড়ার গিরিধারী লালাকে আসতে দেখে তাকালাম। সদ্য স্নান পুজো সেরেছে, কপালে সাদা লাল চন্দনের দাগ, লম্বা ছোলা বাঁশের মত লকলকে চেহারা, টিকিতে জবা ফুল।

লোকটার চাল-ডাল আটার বিরাট ব্যবসা, টাকার কুমির। কিন্তু ক্লাবের চাঁদার বেলায় তেমনি হাড়কঞ্জুস। পাঁচ টাকা বের করতে কালঘাম ছুটিয়ে দেয়। পারতপক্ষে আমাদের ছায়া মাড়ায় না। এহেন লালাজি আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে !

লালাজি মধুমাখানো স্বরে বলে,–বাবালোগ, দুনিয়া পাপে ভরে গেল, তাই রামজি ধ্বংস করবেন ইবার। পাপীলোগ কো খতম করে পুণ্যবান লোগকেই বাঁচাবেন। শোচলো বেটা, হামার গুদামসে চাউল আটা সব কোইকে দিবে। তুমলোগ বন্দোবস্ত করো। আউর নাম গানা ভি হোগা।

এ যেন ভূতের মুখে রামনাম! লোকটা কী ভুল বকছে?

ফটিক বলে, –কাল থেকে কেত্তন পার্টি আর নেই। সব বুকড। ডবল — তেডবল রেট নিচ্ছে। হরিদাস মড়া কেতুনে। সেও তিন শিফটে পাক্কা একশ টাকা রেটে নামগান করছে। লালাজি অভয় দেয়, যা লাগে দিব।

ক্লাবের মাঠেই বাজারের কয়েকজন কুচো সবজিওয়ালা, পাড়ার ঘুঁটেওয়ালীকে ধরে এনে ফটিক লাগিয়েছে নাম-গান করতে।

টবের তুলসী গাছ এনে মালা পরিয়ে বসানো হয়েছে।

ওদিকে হোঁৎকা, গোবরা লাইনবন্দী লোকদের চাল আটা দান করাচ্ছে লালাজিকে দিয়ে । লালাজির গুদামে এত চাল ! সরষের তেল আর হোয়াইট মিশিয়ে যে এত ব্যারেল তেল! স্বচক্ষে দেখলাম, গরুর চর্বির ব্যারেলগুলো থেকে চর্বির সঙ্গে দালদা আর ঘিয়ের সেন্ট মিশিয়ে কিভাবে আসল ভাদুয়া ঘৃত হত ।

অবাক গলায় বলি,–এই ঘি আর তেল তৈরি করতেন লালাজি !

লালাজি বলে—রাম কহো বেটা। উসব সিধা ফেক দিবে গঙ্গা জমে।

লালাজি আজ যেন দেবতা হয়ে গেছে। দরাজ হাতে গুদাম খালি করে দান করছে আর মাঝে মাঝে কীর্তন পার্টির ওখানে গিয়ে হুঙ্কার ছাড়ছে—বলো হরে কিষ্ট—হরে কিষ্ট। কিষ্ট কিষ্ট হরে হরে।

পঞ্চপাণ্ডব ক্লাবের মাঠেই ওই দানযজ্ঞ চলেছে, নামযজ্ঞ চলেছে।

ওদিকে হরিবাবুও এসে বলে,—মহৎ পুণ্য কাজ করছ হে তোমরা। পুরোনো কথা মনে রেখো না বাবা। আর কতক্ষণই বা বাঁচব?

হরিহর বাবুর সঙ্গে মাসাধিককাল আমাদের বাক্যালাপ বন্ধ।

আমাদের ক্লাবের একটু ওদিকে হরিহরবাবুর বাড়ি। রিটায়ার করে ভদ্রলোক ছাদের বেশ কিছুটা এলাকা দরমাজাল দিয়ে ঘিরে টালির ছাউনি চাপিয়ে পোলট্রি করেছেন। লেগহর্ন, রোড আইল্যান্ড মুরগি পুষে বেশ ব্যবসা করেছেন। ওঁর সঙ্গে তুচ্ছ কারণে একটা গোলমাল হওয়ার জন্য তিনিও শাসিয়েছেন, আমরাও কথা বলিনি।

আজ হরিহর বাবু নিজে এসে বলেন,—ওসব মনে রাখিস না বাবারা, এই অপবিত্র মুরগির ব্যবসা তুলে দিচ্ছি। তোদের জন্য গোটা পাঁচেক মুরগি রেখেছি। নিয়ে আসবি। জয় গুরু ! পাড়ার তাবড় অনেকেই এসে উদাত্তকণ্ঠে হরিনামে যোগ দিয়েছে।

গোপীবল্লভ পণ্ডিত বলে,—নাম গান করো বাবারা। কলৌ নাস্তেকলৌ নাস্তে। কলৌ নাস্তেব গতিরণ্যথাঃ ।

লোডশেডিংওয়ালারাও বোধহয় পাপের ভয়ে কদিন আর আলো নেভায়নি। সব আলো জ্বলছে, মাইকে মাইকে সারা কলকাতা ছেয়ে গেছে। আজই এই কলকাতার নাকি শেষ রাত্রি । হঠাৎ দেখি কুলপিওয়ালা রামভরোসও এসে জুটেছে। রোদে নামগান করে ভক্তদের তেষ্টা পাচ্ছে। সেও ভক্তদের কুলপি খাওয়াচ্ছে, দাম মাত্র আট আনা।

রামভরোস বলে-বাবুজি, এতনা জাদা নাফা করে আর পাপ নেহি করব। আমাদের হাতে শালপাতা ভর্তি দু-তিনটে করে কুলপি দিয়ে দেয়।

দামটা দে পটলা —বলি পটলাকে।

রামভরোস দুই কানে হাত দেয়, ছিঃ ছিঃ! – আর কিতনা টাইম বাঁচব বাবুজি !

ওদিকে আদি সত্যনারায়ণ মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের মালিক গদাই বাবু খালি গায়ে বসে আলটাকরা বের করে চিৎকার করছে,—জপো হরে কৃষ্ণ, হরে রাম।

বিশাল উদর। থলথলে দেহ। মিষ্টির দোকানে ওই ঘি-এর গন্ধে আর দুধ ছানা খেয়ে ফুলে ওঠা তেলালো দেহ নিয়ে এতদিন দোকানের থরে থরে সাজানো সন্দেশ আগলে বসে থাকত ।

আজ গদাই-এর আদি সত্যনারায়ণ মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের মিষ্টির অনেকটাই এসেছে ক্লাবের ওই তুলসীতলায়। পুণ্য, পুণ্য চাই।

সারা দেশটা বুঝি রাতারাতি বদলে গেছে। পাড়ার ওদিকের রেললাইনের ধারে পাতাল রেলের মালপত্র চুরি যেত, মাঝে মাঝে বোমাবৃষ্টি হত তেলিয়া মস্তান আর ন্যাপলা ঘোষের দলের মধ্যে। ছুরি বোম-মারামারি চলত।

আজ সেই তেলিয়া-ন্যাপলার দল দু’ঝুড়ি বোমা এনে ওদিকে পচা পুকুরের পাঁকে ফেলে দিয়েছে। ছুরিও ফেলেছে তারা। ওদিকের নাটমণ্ডপে দু’জনে চন্দনের ছাপ কপালে দিয়ে তারস্বরে নামগান করছে।

আর একটা দিন কেটে গেল! শেষ সময় নিকটবর্তী, রেডিওতে বাজছে করুণ সুর—সর্বত্র মাইকে মাইকে নামগানের মহড়া।

আমরা যথারীতি পৌঁছে গেছি তুলসীতলায়, মাঠে। আর একটু পরেই শুরু হবে দানযজ্ঞ, নামগান।

কেষ্টমামার কি হইছে জানস?—হঠাৎ হোঁৎকার মুখে ওই নামটি শুনে চমকে উঠি।

বড় তিক্ত অভিজ্ঞতা রয়েছে ওই কেষ্টমামাকে ঘিরে। ওই নিয়ে অভিন্ন হৃদয় হোঁৎকার সঙ্গেও চলেছিল একটা ঠান্ডা লড়াই কয়েক মাস ধরে। সেই ‘কেষ্টমামা’! আবার !

তখন এশিয়াড-এর প্রস্তুতি চলেছে। কোন কোন অ্যাথলেট, কোনো প্লেয়ার সেখানে যাবে প্রতিযোগিতায় তার তোড়জোড় চলছে, এহেন সময় হোঁৎকার সেই কেষ্টমামা এসে হাজির ।

বন পাহাড়ের ওদিকে কোনো নামি ইস্পাত কোম্পানির লোহার খনিতে কাজ করে হোঁৎকার কেষ্টমামা। গোল পেটা নিটোল কালো কুচকুচে চেহারা। মাথায় চকচকে একখান টাক। পরনে হাফপ্যান্ট কেডস—আর বুকে লেবেল সাঁটা টাইট গেঞ্জি ।

পঞ্চপাণ্ডব ক্লাবে ওকে এনে হোঁৎকা পরিচয় করিয়ে দেয়—আমার কিষ্ট মামা, বিরাট স্পোর্টসম্যান! ডিসকাস থ্রো কইরা স্টিল কোম্পানিতে চাকরি পাইছে। সারা বিহার চ্যাম্পিয়ন। এবার দিল্লীর এশিয়াড গেমসে ইন্দিরাজি ওরে কল করেছেন।

হোঁৎকা আবার বলে,—জানস, বুটা সিং মামার ‘বুজম্ ফ্রেন্ড’!

মামা তেলানে হাসে,—হেঁ-হেঁ ও আর এমনকী। দিল্লীতে এবার এশিয়ান চ্যাম্পিয়ন হই ল‍ই তয় অলিম্পিক যাবার লাগবো। হোঁৎকাও অবশ্যই যাইব, মেনেজার হইব।

হোঁৎকা একদিনেই মামাকে নিয়ে আমূল বদলে গেছে। ট্যাক্সিতে চেপে চলে গেল। বলে গেল, চিফ মিনিস্টারের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছে। ওখান থেকে কেষ্টমামার প্র্যাকটিসে যাবে। পটলা বলে–স-সব গুল। লোহার বল ছুঁড়ে দিগ্বিজয় করবে, হুঁ!

ফটিক বলে—না রে, তাই হয় আজকাল। দেখিসনি সামান্য তবলা বাঁয়া নিয়ে সারা পৃথিবী ঘুরছে লোকে। ওই পূর্ণদাস বাউল তো একতারা খমক বাজিয়ে গান গেয়ে পৃথিবী পাক দিচ্ছে। হোঁৎকার এখন একদম সময় নেই। প্যান্ট কোট টাই পরতে শুরু করেছে। ক্লাবে এসে বলে, ভারতগৌরব কিষ্ট মামারে একখান রিসেপশন দে—চাঁদার জন্য ভাবস না। মামারে ধইরা তিনশো ট্যাকা দিমু, অর্গানাইজ কইরা ফ্যাল।

পঞ্চপাণ্ডব ক্লাব কর্তৃক ভারত গৌরব ডিসকাস নিক্ষেপকারীকে সম্বৰ্ধনা জ্ঞাপন ।

খবরটা ছড়িয়ে পড়তে অনেকেই আসে। খেলাধুলার উৎসাহী ক্লাব হিসাবেও নাম ছড়ায়। আর পণ্ডিত ডাক্তারও ম্যানেজ করে এসেছে সভার অন্যতম প্রধান বক্তা হিসেবে।

পাড়ার সব অনুষ্ঠানের পতিতবাবু ঠিক লাইন করে সেট হয়ে যায়। ধর্মসভা, স্কুলের বিতরণী উৎসব, রবীন্দ্র জন্মোৎসব, ফুটবল প্রদর্শনী কোথাও বাদ নেই ৷

শোনা কথা, একবার গোহত্যা নিবারণী সভায় লেকচার দিয়ে নাকি ষাঁড়দের নিয়ে কি বলেছিল, ষাঁড়েরা গুঁতিয়ে একটা ঠ্যাংই ভেঙে দিয়েছে। সেই থেকে এখনও লেংচে লেংচে

চলে।

আমাদের সভাতেও পতিতবাবু এসে বক্তার চেয়ার দখল করে বসেছেন। মাঠে বহু কৌতূহলী মানুষও জমেছে। সবার চোখে বিস্ময়!

পতিতবাবু গলা কাঁপিয়ে নেচে নেচে বক্তৃতা শুরু করলেন

কিষ্টবাবু দেশের গৌরব, দেশের শক্তি। ওই গোলক ছুঁড়েই দেশের আক্রমণকারীদের আমরা বিনাশ করব। দেশছাড়া করব।

ভাইসব, ওই লৌহ গোলক নিক্ষেপকারী জাতীয় বীরকে আমরা বলব- তুমি দিনরাত লোহার গোলা ছুঁড়ে দেশের মধ্যে চোরাকারবারী, মুনাফাবাজ, মজুতদারদের দুর্গ গুঁড়িয়ে দাও ৷ দেশকে বহিঃশত্রু, ভিতরের শত্রুদের হাত থেকে বাঁচাও। হে বীর-

পতিতবাবু আরও কি সব বলতে যাচ্ছিল, হাততালি আর সিটির আওয়াজে শোনা গেল না। তাড়াতাড়ি বসানো হল তাকে।

মাইকে ঘোষণা করা হল এরপর লৌহগোলকের কৌশল দেখাবেন কেষ্টবাবু।

একটা ঘড়ির চক্র করা জায়গাতে কেষ্টবাবু সর্বাঙ্গে রেড়ির তেল মেখে কুচকুচে কালো দেহ নিয়ে লোহার গোলা হাতে দণ্ডায়মান। হোঁৎকা খুদু ইলেকট্রিসিয়ানকে বলে ওখানে একটা আলোর ফোকাস ফেলেছে।

তারপর বিশাল দেহটাকে লাটুর মত আড়াই পাক খাইয়ে একটা চাপা গর্জন করে ছুড়ে দিল সেই লৌহগোলক ।

সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার ওঠে খাগড়াই কাসাপেটার গলায়,—কোন ড্যাকরা—মুখপোড়ারে। সেই সঙ্গে হরিহরবাবুর গর্জন, বেশ কিছু মোরগের ঝটাপটি।

কেষ্টমামার উৎক্ষিপ্ত গোলক গিয়ে পড়েছে ওদিকে হরিবরবাবুর টালির তৈরি মুরগির ঘরের উপর। কয়েকটা টালি ভেঙে পড়েছে। গোটা তিনেক মুরগি চাপা পড়ে মরেছে, দুটোর ঠ্যাং ভেঙে তারস্বরে চিৎকার করছে!

হরিহরবাবু ওই লৌহগোলকের গুঁতোয় ধরাশায়ী-মোরগকুলকে হাতে ঝুলিয়ে ভাঙা টালি তুলে গর্জাতে গর্জাতে এগিয়ে আসে,—ইয়ার্কি পেয়েছ! লৌহগোলক ছোঁড়া ঘুচিয়ে দেব ! থানায় যাচ্ছি।

জনতাও মজা পেয়ে যায়। শেষ অবধি তিনটে মুরগির দাম তিন আটটে চব্বিশ টাকা দিয়ে আর টালির দাম বাবদ ষোল টাকা কুল্যে চল্লিশ টাকা দিয়ে পুলিশের হাত থেকে বাঁচলাম আমরা।

হোঁৎকা ততক্ষণে মামাকে নিয়ে হাওয়া।

তার দুদিন পরই শুনলাম হোঁৎকা দিল্লী গেছে মামার সঙ্গে। সেখান থেকে নাকি অলিম্পিকে

যাবে।

গোবরা বলে—একনম্বর বেইমান ব্যাটা হোঁৎকা ।

পঞ্চপাণ্ডব ক্লাব যেন মিইয়ে পড়েছে। হোঁৎকা নেই। এদিকে ফাইন্যাল খেলায় তিন গোলে হারলাম।

হঠাৎ একদিন ভুস্ করে উদয় হল হোঁৎকার। বিষণ্ণ চেহারা। ঝোড়োকাকের মত কোত্রাতে কোত্রাতে ক্লাবে এসে ঢোকে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,—আমার বরাত খুবই মন্দ রে! হক্কল প্ল্যান ভেইস্তা গেল গিয়া !

হোঁৎকা তাহলে ব্যাক টু প্যাভেলিয়ান! মনে মনে খুশিই হই।

পটলা মুখে সান্ত্বনা দেয়-আলুকাবলি খা।

হোঁৎকা আবার ফুল-ফর্মে শালপাতা চাটতে চাটতে বলে,—একটুর জন্য মিস কইরা গেল রে, মামায় ডিসকাস খান্ ছুঁড়েছে, ব্যস–ধাঁ কইরা উপরে উইঠা কোথায় ওদিকের ঝোপ জঙ্গল না খানায় পড়েছে তার আর পাত্তাই হইল না গিয়া।

আহা! হোঁৎকার দুঃখে আমরা দুঃখিত হই। ঠান্ডা যুদ্ধের শেষ হয় এইভাবেই।

তারপর কিছুদিন পরই এই ধ্বংসলীলার পূর্বাভাস শুরু হয়েছে।

এমন সময় হোঁৎকার ওই মামার কথা শুনে শুধোই,— পুলিশ তাকে খুঁজছে কেন? হোঁৎকা বলে,—কারোরে কস না কিন্তু। খুউব গোপনীয়।

–আরে বল না, কারণটা কি?

হোঁৎকা বলে,—সারা ভারতের এতবড় ডেঞ্জার ক্যান আইছে আজ তারই এনকোয়ারি কইরা সব, খবর পাইছে ওরা। রাশিয়াও কনফার্ম করছে। মামার লাক খানা ভেরি ব্যাড়রে। হেই যে দিল্লীতে কম্‌পিটিশনে যে লৌহ গোলক খান ছুঁড়ছিল——

—সেটাতো খুঁজেই পাওয়া যায় নি।

হোঁৎকা বলে—না। তার পাত্তা মিলছে। আর হেই লৌহগোলকখানই এইসব ডেঞ্জার করছে! মামার ছোঁড়া হেই লৌহগোলকখান সিধা হাত তনে ছুইটা আকাশে উইঠা আরও উপরের দিকে যাইয়া পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ ছাড়াইয়া সোজা মহাকাশে হাজির হইছে।

–এ্যাঁ! বলিস কিরে ?

হোঁৎকা বলে,—হঃ! সেই মহাকাশে গিয়া না একখান জবরদস্ত উপগ্রহের ঠক্কর লাগছে, ব্যস—সেখানে চুরমার হইয়া এখন নামতেছে। বাংলার দিকে।

সমস্বরে গর্জে উঠি,ধরে নিয়ে যাক তোর ওই কেষ্টমামাকে। উঃ সারা বাংলাদেশ ধ্বংস হচ্ছে ওর জন্য !

হোঁৎকা মিনতির সুরে বলে—মামারে বাঁচা সমী। মুখ বন্ধ কইরা থাক ।

সকাল হয়। নাহ্! কিছুই হয়নি।

আরে! আমরা সবাই বেঁচে গেছি। কাগজে বের হয়েছে সেই উপগ্রহ চূর্ণ কোথায় মহাকাশে জ্বলে ছাই হয়ে গেছে। দু’একটা টুকরো কোনো সমুদ্রে পড়েছে।

সকালেই কীর্তন ভেঙে গেছে।

লালাজি কপাল চাপড়াচ্ছে,–মেরা সব্বনাস হো গিয়া। ফকির হয়ে গেল বিলকুল। গুদাম সাফ হয়ে গেল। হায় রামজি।

সারা পাড়া কেঁপে ওঠে বোমার শব্দে। তেলিয়া মস্তান আর ন্যাপলা ঘোষের দলের মধ্যে বোমাবাজি শুরু হয়েছে আবার। লোকজন পালাচ্ছে প্রাণভয়ে ।

ক্লাবের মাঠে রামভরোসে কুলপি এনেছে। এইটুকু কুলপি। বলে-দেড় রুপেয়া লাগবো। রাতারাতি সব বদলে গেছে আবার। পটলা বলে—হোঁৎকা তোর কেষ্টমামাকে বল, যদি সত্যি পারে তো গোটা কয়েক লৌহগোলক ছুঁড়ে মহাকাশ থেকে যে কটা কৃত্রিম উপগ্রহ আছে পৃথিবীর বুকে পেড়ে ফেলুক, তবু জিনিসের দাম কমবে।

হোঁৎকা ওর কথায় এবার গর্জে ওঠে,–কি কইলি পটলা? আমি গুল দিছি তগো ?

মারমুখী হোঁৎকাকে থামাই,–শোন হোঁৎকা, পটলা তো তা বলেনি। কেষ্ট ঠাকুর বহুবার দেশকে বাঁচিয়েছে পাপীতাপীদের শাস্তি দিয়েছে সুদর্শন চক্র ঘুরিয়ে। তাই তোর মামা যদি আর গোটাকয়েক লৌহগোলক ছুঁড়ে আবার পৃথিবীর বুকে দু চারটে উপগ্রহকে চুরমার করে নামাতে পারে, সব বিলকুল বদলে যাবে। গেছল কিনা বল ?

হোঁৎকাও সায় দেয়—তা গেছল। হক্কলেই সাধু হইয়া গেছল।

তাই বলছি একবার তোর কেষ্ট মামারে রিকোয়েস্ট করে দ্যাখ না, যদি কিছু করা যায়।—আমি হোঁৎকাকে ঠাণ্ডা করি।

হোঁৎকা চিন্তিতভাবে বলে, – দেহি কথাটা কমু ওরে। হোঁৎকা এবার কথাটা সিরিয়াসলি ভাবছে বোধহয় ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *