কেশবচন্দ্র সেন
কলুটোলার প্রখ্যাত এই সেন পরিবারের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে জগবিখ্যাত হয়েছেন কেশবচন্দ্র সেন। ১৮৩৮-এর ১৯ নভেম্বর তিনি কলুটোলাতে জন্মগ্রহণ করেন। পিয়ারীমোহনের তিনি মধ্যমপুত্র। বাল্যকাল থেকেই তিনি শান্ত ও দয়ালু, কিন্তু তাঁর স্বাধীনচিত্ততা ও অন্যান্য চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য দেখে সহজেই ভবিষ্যদ্বাণী করা যেত যে, এ ছেলে ভবিষ্যতে বহু মানুষের ওপর প্রভাব বিস্তার করবে। বস্তুত মানবচরিত্র সম্বন্ধে অভিজ্ঞ তাঁর পিতামহ রামকমল সেন বালক কেশবচন্দ্রকে দেখে নাকি বলেছিলেন, কালে এ ছেলে বিরাট ব্যক্তিরূপে পরিচিত হবে।
স্বগৃহে বাংলা শেখার পর তাঁকে হিন্দু কলেজে ভর্তি করা হয়; এখানে শিক্ষালাভ করে তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজের প্রথম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েন। এখানে তিনি সর্বাপেক্ষা মেধাবী ও বিশিষ্ট ছাত্রদের অন্যতম ছিলেন। স্বভাবতই গভীর প্রকৃতির হলেও, মাঝে মাঝে ছাত্রজীবনে তাঁর বাগ্মিতা প্রকাশ পেত। তাঁর উচ্চারণ ও বাচনভঙ্গীতে সকলে চমৎকৃত হতেন। কোন সামাজিক বা নৈতিক প্রশ্নে কোনরূপ প্রস্তুতি না নিয়েও তিনি যেরূপ উচ্চস্তরের বক্তৃতা দিতেন, তাতে বিশেষজ্ঞগণ পর্যন্ত বলতেন যে, ব্রাহ্ম ধর্মের প্রচার ও প্রসারে (বাগ্মিতাপূর্ণ বক্তৃতা দ্বারা) তিনি যে খ্যাতিলাভ করেছেন, ব্যবহারজীবী হলে জীবনে ততোধিক সার্থকতা লাভ করতে পারতেন। প্রায় শৈশবকাল থেকেই তিনি সব খেলায়, সকল কাজে সঙ্গী সাথীদের নেতা হতেন। যাত্রার দল গড়তেন আর তিনিই হতেন তার অধিকারী। শৈশবে তিনি যে-সব বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিতেন, এখানে তার একটির উল্লেখ করা যেতে পারে। সে-সময় গিলবার্ট নামক একজন ফরাসী যাদুকর খাস কলকাতাবাসীদের হাত সাফাইয়ের নানারকম ক্রিয়াকৌশল দেখিয়ে চমৎকৃত করেছিলেন; বালক কেশবচন্দ্র একবারমাত্র সেই সব দেখেই, তাঁর কৌশল ধরে ফেলে সকলকে সেইসব খেলা দেখাতে থাকেন। তাঁর উদ্ভাবনী শক্তি এখানেই কে যায় নি ৷ সমাজসংস্কারমূলক আন্দোলনকে, বিশেষত হিন্দু বিধবা বিবাহ আইন বিধিবদ্ধ হবার পর, এই আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য, তিনি পরিবারের অন্যান্য তরুণ সদস্যদের সহযোগিতায় হিন্দু মেট্রোপলিটন কলেজ হল্-এ পর পর বেশ কয়েক রাত্রি ‘হিন্দু বিধবা বিবাহ নাটক’ মঞ্চস্থ করেন। এই বাবদ তাঁর অভিভাবকগণকে কমপক্ষে ১০,০০০; টাকা ব্যয় করতে হয়েছিল। সে যাই হক, অভিনয় হয়েছিল সফর ও সার্থক। শহরের সে-যুগের প্রথম শ্রেণির সংবাদপত্রসমূহে এই প্রচেষ্টা ও অভিনয়ের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা প্রকাশিত হয়েছিল।
ইংরেজি শিক্ষার জন্য, এবং তাঁর নিজের স্বীকৃতি অনুযায়ী, ইংরেজি সাহিত্য ও বিজ্ঞানের প্রভাবে তিনি গভীরভাবে বাইবেল অধ্যয়নে ও ঈশ্বরের একত্বে বিশ্বাসী হয়ে ওঠেন। ফলে স্বাভাবিকভাবেই, আবাল্য অভ্যস্ত মূর্তিপূজা ও তার আচার আচরণ তিনি ঘৃণাভরে ত্যাগ করলেন, কিন্তু ‘মনের যে স্থান এতদিন হিন্দু কুসংস্কার অধিকার করেছিল, তার স্থান নেবার মতো কিছুই ছিল না; দু’তিন বছর যাবৎ তিনি ধর্মীয় ব্যাপারে উদাসীন ও সংস্রবশূন্য হয়ে রইলেন; ধর্মবিষয়ক আলাপ আলোচনা করবেন এমন একটি বন্ধুও তাঁর ছিল না। মূর্তি-উপাসনা থেকে তিনি দেহসর্বস্ব আরাম আয়েস বিলাসের জীবনে চলে যাচ্ছিলেন। তিনি নিজেই বলেছেন ‘অবশেষে ঈশ্বরের ইচ্ছায় এক রহস্যময় পন্থায় আমার কাছে সত্যের আলোক উদ্ভাসিত হল, এবং সেই থেকে শুরু হল সংগ্রাম, আশা আর চেষ্টা যার ফলে, বলতে আনন্দ হচ্ছে, আমি শান্তি পেয়েছি, হৃদয় আমার রূপান্তরিত হয়েছে। নিয়মিত প্রার্থনার অভ্যাস দ্বারা তাঁর ধর্মের প্রতি আগ্রহ প্রোৎসাহিত হতে থাকে। তাঁর এই অভ্যাস দেখে অনেকেই সন্দেহ করতে থাকেন যে, তিনি খ্রিস্ট ধর্মে ধর্মান্তরিত হতে চলেছেন, পরিণামে তাঁকে অনেক উপহাস সইতে হয় ও নানান বিরক্তিকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়। এসব সত্ত্বেও তিনি অভ্যাসমত প্রার্থনা করতে থাকেন; এজন্য তাঁর আত্মা আশা, সাহস ও দৃঢ়তা লাভ করে। অধ্যাত্মজ্ঞানের আশীর্বাদ যাতে তর বন্ধুগণও লাভ করতে পারেন, এই উদ্দেশ্যে তিনি ‘সান্ধ্য ধর্মীয় বিদ্যালয়’ স্থাপন করে স্বয়ং তার সম্পাদক বা পরিচালক হন। প্রখ্যাত জর্জ টম্সন্ দু’বার এই বিদ্যালয়ের বাৎসরিক পরীক্ষায় সভাপতিত্ব করেন। তিন বছরের মাথায় অর্থাভাবে বিদ্যালয়টি বিলুপ্ত হল। এর অল্প কিছুদিন পরে, ১৮৫৮তে কেশব স্বগৃহে নিকট বন্ধু ও সহপাঠীদের নিয়ে ‘গুডউইল ফ্র্যাটার্নিটি’ নামে ছোট একটি ক্লাব স্থাপন করেন। এর উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য ছিল ধর্মীয় আলোচনার বিকাশ ও প্রার্থনা। এখানে এবং ইতিপূর্বে স্বগৃহে প্রতিষ্ঠিত বিতর্ক সভায় কেশবচন্দ্র প্রস্তুতিহীন বক্তৃতা অভ্যাস ও আয়ত্ত করতে থাকেন এবং ধর্মীয় শক্তিতে অপরের উপর প্রভাব বিস্তারের ক্ষমতা অর্জন করতে থাকেন; এই ক্ষমতা পরবর্তী জীবনে তাঁর পক্ষে বিশেষ কার্যকর হয়েছিল। তাঁর যা কিছু অধ্যয়ন সবেরই লক্ষ্য ছিল ভবিষ্যতের পথনির্দেশের জন্য সত্যের সন্ধান। দর্শন ও তর্কশাস্ত্র ছিল তাঁর বিশেষ প্ৰিয়।
১৮৫৮তে একখানি ব্রাহ্ম পুস্তিকা তাঁর হাতে আসে; সেখানি পড়ে তিনি দেখেন যে, যে-একেশ্বরবাদের তিনি সন্ধান করছিলেন, তারই উপাসনার জন্যও সেই মতবাদের প্রতিষ্ঠান আগে থেকেই আছে। কুড়ি বছর বয়সে তিনি ব্রাহ্ম সমাজে যোগদান করেন; তাঁর এই সাহস পদক্ষেপের সঙ্গী হন তাঁর গুড় উইল ফ্র্যাটার্নিটির বন্ধুগণ। ব্রাহ্মসমাজের আচার্য বাবু দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরামর্শে এবং হিন্দু বিশ্বাস তিনি বর্জন করেছেন এটা প্রমাণ করবার জন্য তিনি কুলগুরুর কাছে ‘মন্ত্ৰ’ (দীক্ষা) নিতে অস্বীকার করলেন। পরিবারের গুরুজনেরা বহুপ্রকারে তাঁকে বোঝালেন যে, ধৰ্ম ধর্ম করে জীবন কাটালে জীবিকার সংস্থান হবে না, তখন তিনি কেরানীর চাকরি গ্রহণ করলেন; ধর্মচিন্তা আর সত্যানুসন্ধানে তাঁর অন্তর আপুত; কাজেই অল্পদিনের মধ্যে ওই চাকরি ছেড়ে দিয়ে তিনি ঈশ্বরের সেবায় নিজেকে নিয়োগ করলেন। পিতৃপিতামহের ধর্মবিশ্বাস ত্যাগ করায় এবং সাংসারিক জীবনে অনীহা দেখা দেওয়ায় তাঁকে তিরস্কার, ভীতিপ্রদর্শন ও বহু অপ্রীতিকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হল। কিন্তু সাহস আর বিশ্বাসের দৃঢ়তা নিয়ে এ সব কিছুর বিরুদ্ধে শক্তভাবে তিনি দাঁড়াতে সক্ষম হলেন। ১৮৫৯এ দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর স্বাস্থ্যোদ্ধারের জন্য সমুদ্রপথে সিংহল যাত্রা করলে; কেশব তাঁর সঙ্গী। প্রত্যাবর্তনের পর কেশব ব্যাঙ্ক অব বেঙ্গলে মাসিক ২৫ টাকা বেতনে কেরানীর পদে বহাল হলেন; সুন্দর ও পরিচ্ছন্ন হস্তাক্ষরের জন্য শ্রীঘ্রই তাঁর বেতন বাড়িয়ে ৫০ টাকা করা হল। এই ব্যাঙ্কে চাকরি করবার সময় তিনি ‘ইয়ং বেঙ্গল’ নামে একখানি পুস্তিকা প্রকাশ করেন।
১৮৬০এ ‘সঙ্গত সভা’ প্রতিষ্ঠায় কেশব গুরুত্বপূর্ণ অংশ গ্রহণ করেন। ‘সভার’ উদ্দেশ্য ছিল বাস্তব, অর্থাৎ যা-কিছু চরিত্র গঠনে ও সাধনে সাহায্য করে, তা-ই এর উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য। ১৯৬২তে তাঁকে সমাজের ‘আচার্য’ পদে বরণ করা হয়; ঐ বছরই তাঁকে সমাজের সম্পাদক করা হয়। এই সময় তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে জাতপাত কুলীন অকুলীন প্রভৃতির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে সস্ত্রীক দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাড়িতে নিমন্ত্রণ গ্রহণ করেন– দেবেন্দ্রনাথরা ব্রাহ্মণ হলেও, ছিলেন পিরালী ব্রাহ্মণ, পতিত। ফলে, আচারবিচারহীন দম্পতি বাড়ি থেকে বহিষ্কৃত হলেন। ছয়মাস পর কেশব অত্যন্ত অসুস্থ হয়ে পড়ায়, আত্মীয়স্বজনের মন নরম হল; তাঁর আইনসঙ্গত অধিকার স্বীকার করে নিয়ে বাড়িতে তাঁর স্বস্থানে তাঁকে ফিরিয়ে আনলেন; কেশব কিন্তু তাঁর বিশ্বাস ও আচরণের স্বাধীনতা ত্যাগ করলেন না; কয়েকমাস পরে তাঁর প্রথম সন্তানের জাতকর্ম করলেন সরল ব্রাহ্ম প্রথায়, পারিবারিক চাপ সত্ত্বেও পারিবারিক প্রথা মানলেন না। সমাজের মঙ্গল ও উন্নতির জন্য কেশবচন্দ্র এই সময় পর্যন্ত প্রায় পাঁচ বছর দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে সহযোগিতা করেন। এই সময় দুজনের মধ্যে মতভেদ এবং শেষ পর্যন্ত বিচ্ছেদ হয়; কেশবের নেতৃত্বে ‘ভারতের ব্রাহ্ম সমাজ প্রতিষ্ঠিত হয়। মতান্তরের কারণ আচার্যরূপে কেশব উপবীত ধারণের বিরোধিতা করেন, কিন্তু দেবেন্দ্রনাথ উপবীত বর্জনের নাকি বিরোধিতা ছিলেন। ১৮৬৩তে কেশব ভিন্ন ভিন্ন বর্ণের বর-কনের বিবাহ দিলে, সংস্কৃত ধর্মের এই দুই নেতার মতান্তর চরম পর্যায়ে পৌঁছায়।
আদি (ব্রাহ্ম) সমাজের সম্পাদকের পদ থেকে তাঁকে সরান হল এবং কেশব আদি (বাহ্ম) সমাজ ত্যাগ করলেন ১৮৬৫তে। এই ঘটনার এক বছর আগে ১৮৬৪তে, কেশব মাদ্রাজ ও বোম্বাই ঘুরে এসেছেন ব্রাহ্মধর্ম প্রচার করে; ১৮৬৮তে দ্বিতীয়বার বোম্বাই গেলেন; ১৮৬৯এ গেলেন পাঞ্জাব। ১৮৬৬র মে মাসে মেডিক্যাল কলেজের থিয়েটার তিনি ‘যীশুখ্রিস্ট, ইউরোপ ও এশিয়া’ শীর্ষক তাঁর বিখ্যাত ভাষণ দিলেন; এর ফলে, লোক সন্দেহ করতে লাগল যে, তিনি খ্রিস্ট ধর্মের দিকে ঝুঁকেছেন। ১৮৬৬র নভেম্বরের সমাজ আনুষ্ঠানিকভাবে দুভাগে বিভক্ত হয়ে গেল। আদি (ব্রাহ্ম) সমাজের নেতা রইলেন দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর; আর ভারতের ব্রাহ্মসমাজের নেতা হলেন কেশবচন্দ্র সেন। ১৮৬৮তে ভাইস্রয় স্যার জেন লরেন্সের আমন্ত্রণে কেশব সিমলা গেলেন; সেখানে, যে প্রাসাদটি ভারতীয় নৃপতিদের অবস্থানের জন্য সংরক্ষিত ছিল তাতেই তাঁকে থাকতে দেওয়া হল। তাঁরই কথামত সিমলাতে স্যার হেনরী মেইন ‘ব্রাহ্ম বিবাহ আইনের’ বিল আনেন। ১৮৭২এ লেজিসলেটিভ কাউন্সিলে এটি আইনরূপে গৃহীত হয়। ক্রমে সমাজ দৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত হল। দেবেন্দ্রনাথ ও কেশবচন্দ্রের সম্পর্কের অবশ্য বিশেষ উন্নতি হল না; এদিকে, কেশবের শিষ্যবৃন্দ দূরদূরান্তরে ব্রাহ্ম ধর্ম প্রচার করতে লাগলেন। ১৮৭০-এ কেশব ইংল্যান্ড গেলেন; যাওয়ার আংশিক উদ্দেশ্য ছিল ‘ইউরোপীয় সভ্যতা ও প্রগতি সম্পর্কে ভালভাবে জ্ঞানার্জন’ আর বিশেষ উদ্দেশ্য ছিল ইংল্যান্ডের জনগণকে ভারতের পুরুষ ও মহিলাদের রাজনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় মঙ্গলে উদ্বুদ্ধ করা। ১৮৭০-এর প্রথম দিকে তিনি ইংল্যান্ডে পৌঁছন; সেখানে তিনি সোৎসাহ সংবর্ধনা পেয়েছিলেন। তাঁর ইংল্যান্ড গমন যে সাফল্যমন্ডিত হয়েছিল, এবিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। এই ভ্রমণে তাঁর বাগ্মিতার খ্যাতি আরও ব্যাপ্তি লাভ করে।
১৮৭০-এর ১২ এপ্রিল হ্যাঁনোভার স্কোয়ার কক্ষে সমাজের মঙ্গলের উদ্দেশ্যে তাঁকে সংবর্ধনা জানানো হয়। এই সমাবেশে ইংল্যান্ডের বহু অভিজাত ও বিশিষ্ট ভদ্রলোক সমবেত হয়েছিলেন। এখানে তাঁকে সহর্ষ ও আন্তরিক অভ্যর্থনা জানানো হয় ৷ লর্ড লরেন্স তাঁর ভাষণে বলেন :
‘তিনিই কেশবচন্দ্র সেনকে সমুদ্র পার হয়ে ইংল্যান্ডে আসতে উৎসাহ দিয়েছিলেন– হিন্দু ভদ্রলোকদের পক্ষে সমুদ্রযাত্রা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, অত্যন্ত ভীষণ ব্যাপার হওয়া সত্ত্বেও তিনি কেশবকে প্রোৎসাহিত করেছিলেন। তাঁদের অতিথি বিখ্যাত বংশের সম্ভ্রান্ত ভদ্রলোক। তাঁর (কেশবের) পিতামহ ছিলেন সংস্কৃত ভাষার গভীর জ্ঞানসম্পন্ন এদেশীয় পন্ডিত পরলোকগত মিঃ উইলসনের সহযোগী ও সহকৰ্মী। হিন্দুদের চিকিৎসক জাতি থেকে ইনি উদ্ভূত। অল্প বয়সে ইনি পিতৃমাতৃহীন হন; এর খুল্লতাত এঁকে একটি ইংরেজি স্কুলে ভর্তি করে দেন; সেখানকার পাঠ শেষ হলে তিনি কলকাতার কলেজে পড়ে স্নাতক হন, এখানেই তিনি ইংরেজি ভাষা, সাহিত্য ও ইতিহাসে গভীর জ্ঞান অর্জন করেন; এই গভীর জ্ঞান নিয়ে তিনি পৌত্তলিক থাকবেন, এ অসম্ভব। প্রথম জীবনেই তিনি মূর্তি পূজাকে ঘৃণা করতে আরম্ভ করেন; ক্রমে ধ্যান ও প্রার্থনার মাধ্যমে তিনি একেশ্বরবাদে বিশ্বাসী হয়ে ওঠেন। এরপর তিনি একটি (ধর্ম) সম্প্রদায়ে যোগদান করেন, নিম্ন বঙ্গে এই সম্প্রদায়টিকে ব্রাহ্ম সমাজ নামে অভিহিত করা হয়। এঁরা ব্রহ্ম বা স্রষ্টার উপাসক। এই সংস্কারকদের মধ্যে থেকে অল্পকালের মধ্যে তিনি অধিকতর সংস্কারক একটি দলের নেতা হন। মহান সংস্কারক যে দলটি বঙ্গদেশে গড়ে উঠছিল তার মধ্যে সর্বাপেক্ষা প্রগতিশীল গোষ্ঠীর প্রতিনিধিরূপে গণ্য হন কেশবচন্দ্র সেন। এই আন্দোলন আজও তার শৈশব অতিক্রম করেনি; এমনকি কেশবচন্দ্র পর্যন্ত এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব সবিশেষ ব্যাখ্যা করে উঠতে পারেন নি। তিনি বিশ্বাস করেন যে, এই সংস্কারমূলক আন্দোলন ভারতীয় জনগণের ওপর ব্যাপক ও বিস্তৃত প্রভাব ফেলবে।
ইংল্যান্ডে তিনি যে সব কাজ করেছিলেন, নিচে তার একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেওয়া হল :
১৮৭০-এর ১০ এপ্রিল তিনি ডাঃ মার্টিনের চ্যাপেলে প্রথম ‘উপদেশ’ দেন। ‘ইউনাইটেড কিংডম অ্যালায়েন্স ফর দি সাপ্রেশন অব লিকার ট্র্যাফিক’ (যুক্তরাজ্যের মদ্যপান নিবারণী সংযুক্ত সমিতির) এক সমাবেশে তিনি মধ্যপান বিরোধী একটি বক্তৃতা দেন; এই সমাবেশে চার হাজার মানুষ সমবেত হয়েছিলেন। তিনি বলবার জন্য উঠে দাঁড়াতেই সমবেত সকলে দাঁড়িয়ে উঠে তাঁকে সহর্ষ অভিবন্দন জানান। এই বক্তৃতাটি তিনি দিয়েছিলেন ১৮৭০-এর ১৯ মে এর কয়েকদিন বাদে,২৪ মে তিনি ‘স্পার্জিয়ন্’স্ টেবার্নেকলে ‘ভারতের প্রতি ইংল্যান্ডের কর্তব্য’ বিষয়ে বক্তৃতা দেন, সেটি শোনার জন্যও চার হাজার ব্যক্তি হাজির হয়েছিলেন। এই সভায় সভাপতিত্ব করেন লর্ড লরেন্স। ব্রিস্টলে তিনি রামমোহন রায়ের সমাধি দর্শন ও সমাধিপার্শ্বে প্রার্থনা করেন। ম্যাঞ্চেষ্টারে তিনি অত্যন্ত অসুস্থ হয়ে পড়লে, এক ইংরেজ পরিবার অতি যত্নসহকারে তাঁর সেবা শুশ্রূষা করেন। মহারাণীর সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎকার হয়; মহামান্যা মহারাণীর ব্যক্তিগত সচিব জেনারেল পনসনবি বিশেষ আন্তরিকতার সঙ্গে তাঁকে অভ্যর্থনা জানান। প্রাসাদে তিনি প্রাতরাশ গ্রহণ করেন; সম্পূর্ণ নিরামিষ ভোজ্য পরিবেশিত হওয়ায় কেশব বিস্মিত হন। মহামান্যা মহারাণী রাজকুমারী লুইসি (বর্তমান মাসিওনেস অব লোর্ন)-কে সঙ্গে নিয়ে তাঁকে সাক্ষাৎদান করেন; তাঁদের মধ্যে আকর্ষণীয় বিষয়ে আলাপ আলোচনা হয়। বাবু কেশবচন্দ্র সেনের স্ত্রীর একখানি পত্র পান; সচিব জানান যে, কেশবের সঙ্গে আলাপ-আলোচনায় মহারাণী খুব খুশি হয়েছেন, পত্রের সঙ্গে কিছু উপহার আসে; উপহারের মধ্যে ছিল : ১. মহারাণীর একখানি আলোকচিত্র, ২. আর্লি ইয়ার্স অব প্রিন্স কসর্ট এবং ৩. তাঁর ‘হাইল্যান্ড জার্ণালস্’ নামক দুখানি পুস্তকেই মহারাণীর স্বাক্ষর ছিল, আর ছিল রাজকুমারী লুইসি ও রাজকুমার লিওপোল্ডের একখানি করে আলোকচিত্র। বাবু কেশবচন্দ্র সেন ইংল্যান্ডের লন্ডন, ব্রিস্টল, নটিংহ্যাম, বার্মিংহ্যাম, লীড্স্, ম্যাঞ্চেস্টার, লিভারপুল, এডিনবার্গ, গ্লাসগো প্রভৃতি স্থানে বক্তৃতা করেন।
‘সমাজ’ ভারতীয়দের আগের ব্যবহার ও ধর্মে যে পরিবর্তন সাধন করেছিল, তাতে ইংল্যান্ডের সকল পক্ষই বিস্মিত হয়েছিল। প্রতিতাধর ও চিন্তাশীল ব্যক্তিদের সংস্পর্শে এসে যে-সব সুযোগ-সুবিধার উৎপত্তি হয়, দেশে ফিরে কেশবচন্দ্র তার সুফল উপলব্ধি করেন। দেশে প্রত্যাবর্তনের পর তিনি হিন্দু-মুসলমান-পার্শী ও ইংরেজদের নিয়ে ‘ইন্ডিয়ান রিফর্ম অ্যাসোসিয়েশন’ প্রতিষ্ঠা করেন। অ্যাসোসিয়েশনটি পাঁচ ভাগে বিভক্ত, ১. স্ত্রীলোকদের উন্নয়ন, ২. শিক্ষা, ৩. স্বল্পমূল্যে সাহিত্য, ৪. মদ্যপান নিবারণ ও ৫. দান; প্রতিটি বিভাগই গত কয়েক বছর যাবৎ ভাল কাজ করে আসছে। কেশবচন্দ্রের জীবনের পরবর্তী বছরগুলি ভারতীয় ব্রাহ্মসমাজের ইতিহাস।
উল্লেখ করা বাহুল্য হবে যে, কুচবিহারের তরুণ মহারাজা কেশবচন্দ্রের জ্যেষ্ঠা কন্যাকে বিবাহ করেছেন।