কেরির ‘কথোপকথন’

কেরির ‘কথোপকথন’

উইলিয়ম কেরির Colloquies বা ‘কথোপকথন’ [১৮০১] তাঁর ‘A Grammar of the Bengalee Language’ [১৮০১]-এর পরিপূরক গ্রন্থ। দুটি বইয়ের প্রকাশের নির্দিষ্ট তারিখ স্পষ্ট বলা কঠিন। তবে ব্যাকরণের ভূমিকাটি লেখা হয়েছে শ্রীরামপুরে ২২ এপ্রিল, ১৮০১ তারিখে। ওই বছর ১৫ জুন রাইল্যাণ্ডকে কেরি জানান, ‘I…set about compiling a grammar, which is now half printed’। ১৫ জুন ব্যাকরণটি অর্ধমুদ্রিত হয়ে থাকলে আশা করা যায় মুদ্রণ শেষ হতে আর বেশি দেরি হয়নি, বিশেষত ছাত্রদের জন্য বইয়ের অভাব যখন খুবই তীব্র। এর পরে পরেই প্রকাশিত হয় ‘কথোপকথন’। এর প্রথম সংস্করণের ভূমিকাটি লেখা হয়েছে ৪ আগস্ট ১৮০১। ব্যাকরণের ভূমিকাটি বই ছাপা শেষ হবার আগেই লেখা হয়েছে, অর্থাৎ ভূমিকা ছেপে তারপর একে একে অন্য অংশ ছাপা হয়েছে। কিন্তু ‘কথোপকথনে’-র ভূমিকাটি সম্ভবত বই ছাপা শেষ হবার আগে, অন্তত বই বেশ খানিকটা ছাপা হবার আগে লেখা হয়নি। কারণ ভূমিকায় বিভিন্ন ভাষারীতির বৈশিষ্ট্য নির্দেশ করতে গিয়ে কেরি বইয়ের ভিতরের মুদ্রিত পৃষ্ঠাসংখ্যার উল্লেখ করেছেন। ভূমিকা বইয়ের মূল অংশের আগেই ছাপা হলে এইসব পৃষ্ঠাসংখ্যার উল্লেখ করা তাঁর পক্ষে সম্ভব হত না। সুতরাং, ‘কথোপকথনের’ প্রথম সংস্করণের আনুমানিক প্রকাশ তারিখ ৪ আগস্ট ১৮০১ অথবা তার পরবর্তী কোনো কাছাকাছি তারিখ। কাজেই অনুমান করা যায় ব্যাকরণ ও ‘কথোপকথনে’ প্রকাশ-তারিখের মধ্যে ব্যবধান খুব অল্পসময়ের হয়ত ২/১ মাসের। দুই বইয়ের মধ্যে নৈকট্য শুধু প্রকাশকালের দিক থেকেই নয়, নৈকট্য প্রকাশের উদ্দেশ্যের দিক থেকেও। দুটি বইয়ের উদ্দেশ্য ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের বিদেশি ছাত্রদের বাংলা ভাষা শেখায় সহায়তা করা। ব্যাকরণের উদ্দেশ্য ভাষার সাধারণ বৈশিষ্ট্যগুলি সূত্রাকারে তুলে ধরা, আর ‘কথোপকথনের’ উদ্দেশ্য ভাষার বিভিন্ন রীতি [কেরির ভাষায় ‘stile’]-এর সঙ্গে ছাত্রদের পরিচয় করানো, যেসব রীতির পরিচয় ব্যাকরণের সাধারণীকৃত সূত্রাবলিতে ধরা পড়া সম্ভব নয়। এই কারণে এই সময়ে জুলাই মাসে রামরাম বসুর ‘প্রতাপাদিত্য চরিত্র’ [১৮০১] প্রকাশিত হলেও ‘কথোপকথনে’-র প্রকাশ ছিল অপরিহার্য। কারণ ‘প্রতাপাদিত্য চরিত্র’ বিবরণধর্মী টানা রচনা, তাতে বাংলা ভাষার নানা স্তর ও শ্রেণিসাপেক্ষ বিভিন্ন রীতি প্রতিফলিত হওয়ার সম্ভাবনা নেই। অথচ কলেজের পড়ুয়ারা তো কোম্পানির ভাবী প্রশাসক, প্রজাসাধারণের কাছাকাছি যাওয়ার জন্য তাদের পক্ষে বাংলা ভাষার সব স্তরের রীতি জানা আবশ্যিক। এজন্য ‘প্রতাপাদিত্য চরিত্র’ সত্ত্বেও ব্যাকরণের সঙ্গে ‘কথোপকথনে’-র পাঠ নেওয়া ছিল অপরিহার্য। দু-টি বই তাই একই উদ্দেশ্যে অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত। হয়ত এজন্যই পরবর্তীকালে ‘কথোপকথন’ ব্যাকরণের উত্তরখন্ড হিসেবে একই আধারে প্রকাশিত হয়েছে।

ব্যাকরণের সঙ্গে সঙ্গে ‘কথোপকথন’ প্রকাশ করার ব্যাপারে কেরি তখনকার দিনের একটি অভিন্ন ইউরোপীয় আদর্শ অনুসরণ করেছিলেন। রেনেসাঁসের পর ইউরোপের বিভিন্ন দেশের অভিযাত্রিকেরা যেসব নতুন উপনিবেশের সন্ধানে বেরিয়ে পড়েন তাঁদের কেউ কেউ উপনিবেশের ভাষা শেখার সহায়ক বই হিসেবে ব্যাকরণ, শব্দকোশ এবং প্রশ্নোত্তরমালা বা কথোপকথনমূলক সংলাপ-গ্রন্থ রচনা করেন। ইংরেজদের আগে যেসব পোর্তুগিজ ধর্মযাজক এদেশে এসেছেন তাঁদের কেউ কেউ এই ধরনের বই রচনা এবং সংকলন করেছেন। মানোএল দা আসসুম্পসাঁও-এর ‘কৃপার শাস্ত্রের অর্থভেদ’ [১৭৪৩] কিংবা দোম আন্তোনিয়োর [১৭২৬-এর আগে] ‘ব্রাহ্মণ-রোমান ক্যাথলিক সংবাদ’ [নামটি সম্পাদক সুরেন্দ্রনাথ সেনের দেওয়া, ১৯৩৭, সম্ভবত রবীন্দ্রনাথের ‘কর্ণকুন্তী সংবাদে’-র (১৯০০) অনুস্মৃতিতে] এই ধরনেরই কথোপকথনমূলক বই। তবে এগুলির উদ্দেশ্য ভাষাশিক্ষা নয়, ধর্মশিক্ষা। পোর্তুগিজদের পর ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকরাও বাংলা ভাষাশিক্ষার প্রয়োজনে একই রীতির উপকরণ অর্থাৎ ব্যাকরণ, শব্দকোশ ও সংলাপগ্রন্থ রচনা করেন। তবে এঁদের সংলাপগ্রন্থের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এতে ধর্মীয় বিষয় স্থান পায়নি, উপনিবেশের আচার-ব্যবহার, সামাজিক রীতিনীতি ও অর্থনৈতিক অবস্থাই এইসব বইয়ের উপজীব্য। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকদের এইসব ভাষা-উদ্যোগের আর একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এঁদের কেউ কেউ যেমন স্বজাতির জন্য স্বভাষায় বাংলা শেখার বই লিখেছেন, অন্যদিকে তেমনি কেউ কেউ বাঙালিদের জন্য ইংরেজি শোনার উপকরণও তৈরি করেছেন। এই ধরনের একটি বই জন মিলারের ‘The Tutor’ বা ‘সিক্ষ্যা গুরু’ [১৭৯৭]। এই বইয়ের তিনখন্ডের প্রথম খন্ডে আছে, ইংরেজি শব্দের উচ্চারণ শিক্ষা এবং ইংরেজি শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ, দ্বিতীয় খন্ডে আছে ‘ইংরাজি ব্যাকরণ’ এবং ‘ত্রিতিয়’ খন্ডে আছে ‘জবাব সওয়াল হরেক বিষয়ের’ অর্থাৎ প্রশ্নোত্তরমূলক সংলাপগ্রন্থ। বইটি ছাপা হয় ১৭৯৭ খ্রিস্টাব্দে শ্রীরামপুরে মিলারের নিজের ছাপাখানায়। মিলারের বইয়ের ‘ত্রিতিয় খন্ডে’-র সংলাপ অংশের সঙ্গে কেরির ‘কথোপকথনে’-র আঙ্গিকগত বাহ্য সাদৃশ্য আছে। মিলার এখানে মোট আটটি বিষয়ে কথোপকথন রচনা করেছেন। প্রথমে ইংরেজি বাক্য, তারপর তার বাংলা তর্জমা। মিলার ভূমিকায় ‘বাঙ্গালিদিগেরকে’ বলেছেন: ‘আমার মনস্ত ছিলো সপরোধ করিতে এই কেতাব সমস্কৃততে। কিন্তু আমি এক্ষেত্রে দেখিলাম জে অতি অল্পলোক আছে জে আমার এবিষয় বুঝে। অতয়েব আমি বিবচনা [sic] করিয়া এ তরজমা করিয়াছি চলতি কথার দ্বারায়।’ প্রথম খন্ডের শব্দকোশ ও তৃতীয় খন্ডের সংলাপে এই ‘চলতি কথার’ ছাপ আছে। এই বিবরণ থেকে মনে হওয়া স্বাভাবিক যে, কেরি হয়ত মিলারের এই বইয়ের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন এবং ‘কথোপকথনে’-র পরিকল্পনায় এই বইয়ের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। কিন্তু একটু গভীরভাবে অনুধাবন করলে এই অনুমান সংগত বলে মনে হয় না। কারণ, প্রথমত, কেরি ও তাঁর অনুগামীদের কারো লেখায় মিলারের এই বই ব্যবহারের কথা উল্লিখিত হয়নি, যদিও হ্যালহেড বা ফরস্টারের মতো পূর্বসূরির কাছে ঋণ স্বীকার করতে কেরি [বা তাঁর অনুগামীরা] কখনো কুন্ঠিত হননি। দ্বিতীয়ত, মিলার সংলাপের জন্য ৮টি বিষয় নির্বাচন করেছেন। তাঁর লক্ষ শুধু আটটি প্রসঙ্গে কী কী শব্দ ব্যবহৃত হয়, পক্ষান্তরে কেরির লক্ষ্য বহুবিস্তৃত। তিনি শুধু কয়েকটি নির্দিষ্ট প্রসঙ্গের মধ্যে সীমাবদ্ধ থেকে প্রসঙ্গ-নির্ভর শব্দাবলির বৈচিত্র্য দেখাতেই তৎপর ছিলেন না। তিনি একই প্রসঙ্গকে বিভিন্ন পরিস্থিতি ও বিভিন্ন শ্রেণিভুক্ত স্ত্রী-পুরুষের কথাবার্তার মাধ্যমে উপস্থিত করেছেন। ফলে শুধু প্রসঙ্গনির্ভর শব্দবৈচিত্র্যই নয়, স্থান-কাল-পাত্র-নির্ভর নানা বাক্যবন্ধের ব্যাপক বৈচিত্র্যই কেরির ‘কথোপকথনে’ উদাহৃত হয়েছে। এইজন্য কেরি একই প্রসঙ্গ একাধিক সংলাপ-খন্ডে উত্থাপন করেছেন। তৃতীয়ত, মিলারের বইতে সংলাপগুলি মনিব M[aster] ও চাকর S[ervant]-এর মধ্যে সীমাবদ্ধ। এই চাকরশ্রেণিতে পদমর্যাদার কোনো প্রকারভেদ নেই, সাধারণ ভৃত্য থেকে দায়িত্বশীল দেওয়ান সকলেই একই রীতির ভাষা ব্যবহার করে এবং সে-রীতি তখনকার দিনের ‘চলতি কথা’-র রীতি। কিন্তু কেরির বইতে সাহেবের চাকরিতে নিযুক্ত—এই অর্থে সকলেই ‘চাকর’ হলেও চাকরদের মধ্যে কর্মবিভাজন [‘হুন্দা’] আছে এবং সেই কর্মবিভাজন অনুসারে চাকরদের ভাষারীতিও পৃথক। তা ছাড়া, কেরির বইতে মেয়েদের ভাষার একটা আলাদা ভূমিকা আছে। কিন্তু মিলারের বই স্ত্রীচরিত্রবর্জিত। সুতরাং, বোঝা যাচ্ছে মিলারের থেকে কেরির গ্রন্থপরিকল্পনা ছিল আমূল পৃথক। কাজেই মিলারের দ্বারা কেরির প্রভাবিত হওয়ার প্রসঙ্গটি একেবারে অবান্তর। তবু যদি কেউ তর্কের খাতিরে প্রসঙ্গটি টেনে নিয়ে যেতে চান তবে তাঁকে স্বীকার করতেই হবে যে, কেরির পরিকল্পনায় ও প্রসঙ্গ-বিন্যাসে সচেষ্ট নাটকীয় সাহিত্যলক্ষণ আছে, যা সাহিত্য-সমালোচকদেরও দৃষ্টি আকর্ষণ করে। সুতরাং, ‘কথোপকথনে’ কেরি ঐতিহ্যকে অনুসরণ করেও স্বকীয় মহিমায় স্বতন্ত্র।

‘কথোপকথনে’-র আর এক সমস্যা এর গ্রন্থকর্তৃত্ব নিয়ে। ‘কথোপকথন’ ছাপা হয়েছে বাংলা ও ইংরেজি দুই ভাষায়। বাঁদিকের পাতায় বাংলা অংশ, ডানদিকের পাতায় ইংরেজিতে বাংলা অংশের ‘free translation’ [Carey]। ইংরেজি অনুবাদ অবশ্যই কেরি করেছেন। ভূমিকায় এ ব্যাপারে তাঁর নিজের স্বীকারোক্তি আছে। কিন্তু মূল বাংলা অংশটি কার বা কাদের লেখা? ভূমিকায় কেরি বলেছেন: ‘That the work might be as compleat as possible, I have employed some sensible natives to compose dialogues upon subjects of a domestic nature, and to give them precisely in the natural stile of the persons supposed to be speakers’। এই উক্তির উপর ভিত্তি করে এই বইয়ের গ্রন্থকতৃত্ব সম্পর্কে পন্ডিতেরা নানারকম মত প্রকাশ করেছেন। কারো মতে, ‘এই সংকলনে কেরি ইংরেজি অনুবাদক মাত্র। বাংলা মূল একাধিক অঞ্চলের ভাষার সহিত সুপরিচিত ব্যক্তির বা ব্যক্তিদের সংগ্রহ।’ কারো মতে, ‘পুস্তিকাটির যেখানে [যেমন ‘চাকর ভাড়াকরণ’] প্রসঙ্গ এবং সাহেব ও বাঙালিদের কথোপকথন আছে তা কেরির রচনা হতে পারে। কিন্তু যেখানে বাঙালি পরিবার ও সমাজের ঘনিষ্ঠ বর্ণনা আছে সেগুলি মৃত্যুঞ্জয় বা কলেজের অন্য কোনো পন্ডিতের লেখা।’ আবার কেউ কেউ মনে করেন, এর প্রায় সবটাই মৃত্যুঞ্জয়ের লেখা, কারণ ভাষার বৈচিত্র্যের ওপর এতখানি দখল তখন মৃত্যুঞ্জয় ছাড়া আর কারো ছিল না। বলা বাহুল্য, এ সমস্ত অভিমতই অনুমাননির্ভর। আমাদের দেখতে হবে এ ব্যাপারে কোনো যুক্তিনির্ভর ও বস্তুনিষ্ঠ ভিত্তি পাওয়া যায় কিনা, যার সাহায্যে এই গ্রন্থকতৃত্বের ব্যাপারে আর একটু স্পষ্ট করে কথা বলা যায়।

প্রথমে দেখতে হবে কেরি কবে ‘sensible native’-দের সংলাপ রচনার কাজে নিযুক্ত করেছিলেন এবং তখন কোন কোন ‘native’ তাঁর পক্ষে নির্ভরযোগ্য ছিলেন। বাংলা ভাষার যে আঞ্চলিক বৈচিত্র্য আছে তা কেরি সুন্দরবন, নদিয়া, মালদা, দিনাজপুর এবং ভুটান সীমান্তে ঘোরাঘুরি সূত্রে খুব ভালোভাবেই অবগত হয়েছিলেন। সমসাময়িক জার্নাল ও চিঠিপত্রে কেরি তার উল্লেখও করেছেন। তবে কলেজের কাজে যোগ দেবার আগে তিনি ‘কথোপকথন’ সংকলন করার প্রয়োজনবোধ করেছেন বলে মনে হয় না। কলেজে যোগ দেওয়ার আগে তিনি বাংলা ব্যাকরণ ও অভিধান তৈরি করার কথা ভেবেছেন, কারণ বাংলায় ধর্মপুস্তক তৈরি করতে গিয়ে তিনি ভাষাগত নানারকম অসুবিধায় পড়েন। অভিধান ও ব্যাকরণ এই অসুবিধা দূর করবে বলে তাঁর মনে হয়েছিল। তবে ‘কথোপকথন’ সংকলন সেদিক থেকে খুব জরুরি ছিল না। কিন্তু ১৮০১ খ্রিস্টাব্দের ৪মে [মার্শম্যানের মতে ১২মে] কলেজের কাজে যোগ দেওয়ার পর তিনি ভাষাশিক্ষার উপযোগী বইয়ের তীব্র অভাব অনুভব করেন। মার্শম্যানের বিবরণ থেকে জানা যায়, ওই বছর ৮ এপ্রিল তাঁর কাছে ওই কলেজের চাকরির প্রস্তাব আসে। সম্ভবত তার পরই ২২ এপ্রিল বাংলা ব্যাকরণটি ছাপা শুরু করেন এবং ব্যাকরণে যা ধরা পড়ে না সেই ‘flexity of expression, which could not be soon acquired by constant and rigid attention to grammatical rules alone’[ভূমিকা, কথোপকথন, ৪আগষ্ট ১৮০১] অভ্যাস করানোর জন্য ‘কথোপকথন’ সংকলনের পরিকল্পনা করেন। সুতরাং, অনুমান করা যায় ১৮০১ সালের এপ্রিল, মে বা জুন মাস নাগাদ ‘কথোপকথন’ লেখার কাজে ‘sensible native’-রা নিযুক্ত হয়েছিলেন। কিন্তু কারা এইসব ‘sensible native’? আগেই বলা হয়েছে, ‘কথোপকথন’ ছাপা শুরু হয়েছিল ৪ আগস্ট ১৮০১-এ ভূমিকা লেখার আগেই। সুতরাং, বইয়ের মূল ও অনুবাদ অংশ নিশ্চয়ই ৪ আগস্টের আগেই লেখা ও ছাপা হয়ে গিয়েছিল। কাজেই এপ্রিল বা মে থেকে জুলাই পর্যন্ত কয়েকটি মাসই হচ্ছে কথোপকথনের পান্ডুলিপি লেখা ও ছাপার সময়। এই অল্প সময়ের মধ্যে কেরি তৈরি করাচ্ছেন এমন একটি জরুরি বই যা ‘will not only assist the student, but furnish a considerable idea of the domestic economy of the country’ [ভূমিকা]। অর্থাৎ এ কাজের দুটি লক্ষ্য : একটি ভাষিক, অপরটি ‘domestic economy of the country’। দ্বিতীয়টিকে প্রথমটির মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলাই হবে কথোপকথনের কাজ। এ কাজে তিনি কার বা কার কার উপর নির্ভর করতে পারেন? বলা বাহুল্য তিনি প্রথমে নিজের উপরই নির্ভর করেছেন এবং তা শুধু অনুবাদ করার ব্যাপারেই নয়, বিষয়বস্তু অর্থাৎ পূর্বোক্ত দ্বিতীয় উপকরণটির ব্যাপারেও। কারণ যেসব মুনশি বা পন্ডিতের সঙ্গে তিনি তখন পর্যন্ত পরিচিত তাঁদের আরব্ধ কাজকর্ম থেকে বোঝা গিয়েছে যে, তাঁরা সবাই প্রাচীন উপাখ্যান বা পুরোনো ইতিহাসের বিবরণধর্মী আখ্যান রচনাতেই মানসিকভাবে প্রস্তুত, সমসাময়িক জীবনযাত্রা থেকে উপাখ্যান বা বৃত্তান্ত সংকলনে প্রস্তুত নন। অথচ ‘domestic economy of the country’ তুলে ধরতে হলে তো সমসাময়িক জীবনবৃত্তই অবলম্বন করতে হবে। কাজেই এ-কাজটির দায়িত্ব অর্থাৎ অর্থনৈতিক জীবনবৃত্ত নির্বাচনের দায়িত্ব কেরি নিজই গ্রহণ করেছিলেন। কারণ সমসাময়িক জীবন থেকে বাস্তব বৃত্তান্ত সংগ্রহ করতে গেলে যে নিরপেক্ষ বস্তুনিষ্ঠতা দরকার, একজন বিদেশি মানুষ হিসেবে কেরির পক্ষে তা সহজসাধ্য ছিল। তাই মনে হয় পরিস্থিতি ও তদনুযায়ী পাত্র-পাত্রী সব তাঁরই পরিকল্পনা, ‘sensible native’-দের তিনি হয়ত এইসব পরিস্থিতি অনুসারে সম্ভাব্য সংলাপ রচনার নির্দেশ দিয়েছিলেন। সুতরাং, কেরিকে শুধু ইংরেজি অনুবাদক বললে তাঁর ভূমিকাকে ছোট করে দেখা হয়।

শুধু এইমাত্র নয় ‘আগে কহ আর’। প্রথমত ‘কথোপকথনে’ এমন কয়েকটি সংলাপখন্ড আছে যা একান্তভাবে কেরির ব্যক্তিগত জীবনের সঙ্গে যুক্ত। যেমন, ‘পরিচয়’ [ইংরেজিতে ‘Enquiries about a voyage’] শীর্ষক সংলাপখন্ডটি। এখানে বক্তা ও প্রতিবক্তা উভয়েই প্রবাসী দুই ব্রিটিশ। বক্তার প্রশ্নের উত্তরে প্রতিবক্তা স্বদেশে তার পঠদ্দশায় ভাষাশিক্ষা এবং সমুদ্রযাত্রার ব্যাপারে প্রতিবক্তার সঙ্গে কেরির ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার অনেকখানি মিল আছে। প্রতিবক্তার বিবরণে জানা যায় সমুদ্রপথে আসার সময় বড় ঝড় হয়েছিল, তাতে ‘জাহাজ প্রায় মারা গিয়েছিল’। পরে কোনোমতে রক্ষা পাবার পর নদীতে প্রবেশ করে তাড়াতাড়ি কলকাতায় পৌঁছোবার ইচ্ছায় সে‘এক পানসি ভাড়া লইয়া শীঘ্র’ কলকাতায় চলে আসে। এই অভিজ্ঞতা কেরির নিজের সমুদ্রযাত্রার অভিজ্ঞতার অনুরূপ। কেরি ১৭৯৩-এর ১৩ জুন দিনেমার জাহাজ Kron Princessa Maria-তে চেপে কলকাতায় রওনা হন। পথে জাহাজটি এক প্রবল ঝড়ের মধ্যে পড়ে ডুবে যাবার উপক্রম হয়। এর বিবরণ দিয়ে কেরির জীবনীকার S. P. Carey লিখেছেন:‘Off Africa’s southernmost cape, a midnight storm almost sank the Kron Princessa, which was only of 130 feet keel and 600 tons’ burthen. From one plunge Carey never supposed she could rally. To his untrained sight the waves seemed ‘fifty or sixty yards high! It took eleven days to repair her damage’। পূর্বোক্ত প্রতিবক্তার মতো কেরিরও কলকাতায় পৌঁছোনোর তাড়া ছিল। কারণ কলকাতায় আসার মতো প্রয়োজনীয় ছাড়পত্র তাঁর বা তাঁর সঙ্গীদের ছিল না। তাই কোম্পানির পাহারাদারদের নজর এড়াবার জন্য জাহাজ হুগলি নদীতে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে কেরি ও তাঁর সঙ্গীরা ‘betook themselves to a native boat’ [S. P. Carey]। সুতরাং, ‘পরিচয়’ শীর্ষক সংলাপখন্ডে কেরি তাঁর নিজের অভিজ্ঞতাকেই সংক্ষেপে লিপিবদ্ধ করেছেন। এবং সম্ভবত এই সংলাপখন্ডটি তাঁর নিজেরই রচনা। কারণ প্রবাসী ইংরেজের মুখের বাংলা তো দেশীয় মুনশি বা পন্ডিতদের চেয়ে কেরির পক্ষেই বর্ণনা করা সহজ। তা ছাড়া, দেশীয় মুনশি বা পন্ডিতরা তো ব্রিটেন বা সমুদ্রযাত্রার সঙ্গে পরিচিত নন যে, পরিস্থিতি বলে দিলেই তাঁরা বিষয়ের যথাযথতা বজায় রেখে সংলাপ রচনা করতে পারবেন। তা ছাড়া, এই অংশের বাক্যবিন্যাসে এমন কিছু বিদেশি ছাপ আছে যা পরবর্তী সংস্করণগুলিতে সংশোধন করা হয়েছে। যেমন, ১ম সংস্করণে (১) ‘তিন মাস থাকিলাম কেপে’ পরবর্তী সংস্করণে ‘তিন মাস কেপে থাকিলাম’ (২) ‘এতদিন জলের উপর থাকিয়া ভূমি দেখিতে মনের বড় আনন্দ’, দ্বিতীয় সংস্করণে ‘এতদিন জলের উপর থাকিলে ভূমি দেখিতে মনের বড় আনন্দ ছিল’, তৃতীয় সংস্করণে ‘….ভূমির দেখাতে বড় আনন্দ ছিল।’ ‘পরামর্শ’ ও ‘ভোজনের কথা’ এই দুটি রচনাও দুই প্রবাসী সাহেবের কথোপকথন। বাক্যবন্ধেও সাহেবি আড়ষ্টতা আছে, যা পরবর্তী সংস্করণে সংশোধন করা হয়েছে। এ দুটিও কেরির রচনা হওয়া অসম্ভব নয়!

আর একটি সংলাপখন্ড ‘বাগান কবিরার হুকুম’—এটিও কেরির ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত। প্রসঙ্গক্রমে পূর্বোক্ত জন মিলারের ‘সিক্ষ্যাগুরু’-র কথা আবার উল্লেখ করি। মিলারের বইতেও ‘জমি খরিদের’ ‘জবাব সওয়ালে’ সাহেবের বাগান করার কথা আছে [p. 116-128]। সংলাপের খানিকটা অংশ উদ্ধার করা যাক [ইংরেজি অনুবাদ ব্যতিরেকে]

দেওয়ানজি একখানা জমি তল্বাস করো আমি চাহি বাগান করিতে [। ]

কতো বিঘার দরকার আছে তুমি চাহ খরিদ করিতে কিম্বা তোমার মনস্ত ভাড়া করিতে [?]

আমি চাহি কুড়ি বিঘা জমি [,] জমি খরিদ করিতে পাওয়া জায় বড়ো ভালো [,] আর তাহা না হয় ভাড়া করিতে হইবেক [। ]

কি আমি তল্বাস করিব এক জায়গা গঙ্গার ধারে [?] আর কত দূর এখান হইতে [?]

জদি গঙ্গার ধারে পাওয়া জায় আমি বড়ো খুষি হইব [,] কিন্তু পাঁচ ক্রোষ হইতে দূর না হয় [। ]

এর পর জমির সন্ধান, দরদস্তুর, জমির শরিকদারদের সঙ্গে বোঝাপড়া, জমি বিক্রিতে প্রতিবেশীদের আপত্তি, প্রতিবেশীদের সঙ্গে বোঝাপড়া ও শেষপর্যন্ত জমি বিক্রি ও দখলদারি। সমস্ত বিষয়টিতে জমি কেনাবেচাসংক্রান্ত আইনি কথাবার্তা, কিন্তু বাগান করার নান্দনিক বা উদ্ভিদপ্রেমী অভিলাষ [কেরির ভাষায় ‘botanical taste’] সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। তখনকার দিনে ঔপনিবেশিকরা এইভাবেই হয়ত বড়ো বড়ো তালুক গড়ে তুলত। কিন্তু কেরির কথোপকথনে যে সাহেবটি বাগান করার হুকুম দিচ্ছেন তাঁর মনে বিষয়প্রীতির চেয়ে পরিকল্পিত উদ্ভিদপ্রীতিই প্রধান। কেরির জীবনীপাঠকেরা সকলেই তাঁর উদ্ভিদপ্রীতির কথা জানেন। তিনি মালদহে মদনাবতীতে থাকার সময় একটি সুন্দর বাগান করেছিলেন, পরে শ্রীরামপুরে এসেও একটি বড়ো বাগান করেছিলেন। কথোপকথনের বাগান-চিন্তায় মদনাবতীর অভিজ্ঞতাই প্রতিফলিত। কারণ এখানে যেসব আনাজ ও কৃষি-উপকরণের উল্লেখ আছে বাংলা দেশের অন্যত্র সেগুলির ব্যবহার থাকলেও এই সংলাপে তাদের উত্তরবঙ্গীয় নামগুলিই ব্যবহৃত হয়েছে, যেমন : ১. আনাজ ও ফলের নাম—চুকা, হালিম, সলুপা, সফতালু [=পিচ ফল—এটি উত্তরবঙ্গের বিশিষ্ট ফল], নেয়া [দিনাজপুর, রাজসাহি, রংপুরের ফলনাম], ২. কৃষিসরঞ্জামের নাম—পাসান [=জমির আগাছা পরিষ্কার করার জন্য খুরপি জাতীয় অস্ত্র; রাজসাহি, পাবনা, দিনাজপুর, মালদহ, রংপুরে এই শব্দ বা এর ঈষৎ ধ্বন্যন্তরিত রূপ প্রচলিত], চাঙ্গি [=লতানে গাছ বেড়ে ওঠার জন্য উঁচু মাচা; দিনাজপুর-মালদহে প্রচলিত শব্দ]। বলা বাহুল্য, এই সংলাপের সাহেবটি কেরি স্বয়ং। এবং মনে হয়, এ সংলাপটিও কেরির নিজের রচনা। সংলাপের শেষ বাক্যটিতে বিদেশি-সুলভ আড়ষ্টতা আছে, পরবর্তী সংস্করণে তা সংশোধিত : [১ম সং] তুই সকল সাবধান কর, [২য় সং] তুই সকলেতে মনোযোগ কর। ‘ভূমির কথা’ সংলাপ-খন্ডেও কেরির মদনাবতীতে থাকাকালীন চাষাবাসের অভিজ্ঞতা ঘনিষ্ঠভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। ফুল-ফলের বাগান ছাড়াও চাষবাসের ব্যাপারে তাঁর অভিজ্ঞতা যে কত গভীর ও ব্যাপক ছিল তা ১৮১১ সালে ‘Asiatic Researches’ পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর ‘Remarks on the state of Agriculture in the District of Dinajpur’ প্রবন্ধে জানা যায়। এই প্রবন্ধের সঙ্গে এই সংলাপটি মিলিয়ে পড়লে স্পষ্টই বোঝা যায় সংলাপের রচয়িতা কেরি ছাড়া আর কেউ নন। কারণ দুটি ক্ষেত্রেই একই অভিজ্ঞতার প্রতিফলন।

কথোপকথনের অনেকগুলি সংলাপের বিষয়বস্তু জমিজমা বিষয়কর্মসংক্রান্ত [মহাজন আসামি, খাতক মহাজনি, সাধু খাতকি, ইজারার পরামর্শ, জমিদার রাইয়ত]। এইসব সংলাপে ঋণগ্রস্ত চাষি, ভাগচাষি, অত্যাচারী জমিদার, পেয়াদাদের উৎপীড়ন, বেগারপ্রথা, মহাজনি শোষণ, দাদন-নেওয়া নীলচাষির দুর্গতি এবং সেইসঙ্গে একজন প্রতিবাদী রায়তের কথাও আছে। এই অবস্থা কোম্পানি-প্রবর্তিত নতুন ভূমিব্যবস্থার পরিণতি। কেরি মদনাবতীতে জর্জ উডনির নীলকুঠিতে ম্যানেজারের কাজ করার সময় এই ভূমিব্যবস্থার অশুভ রূপটি প্রত্যক্ষ করেছিলেন। S. P. Carey লিখেছেন : ‘Carey’s frequent business-journeyings over his district though nine months of the year, to secure the due cultivation of the indigo, and to settle ever-recurring disputes, gave him an expert’s familiarity with rural North Bengal …He learned every process of local farmings, every secret of economy, and every trick of the people.’ এই সংলাপগুলিতে মদনাবতীতে অর্জিত বৈষয়িক অভিজ্ঞতাই প্রতিফলিত হয়েছে। কারণ শ্রীরামপুরে যাবার পর কেরি আর এই ধরনের ভূমিনির্ভর বিষয়কর্মের সঙ্গে যুক্ত থাকেননি। এইসব সংলাপ-রচনাতেও তাই কেরির প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপ থাকা অসম্ভব নয়।

কথোপকথনের অন্যান্য সংলাপগুলি কেরি-নিয়োজিত ‘sensible native’-দের লেখা। এই ‘native’-রা কারা? কথোপকথনের পান্ডুলিপি তৈরি করার সময় তাঁর সান্নিধ্যে ছিলেন তাঁর কয়েক বছরের পুরোনো সঙ্গী মুনশি রামরাম বসু এবং পন্ডিত গোলোকনাথ শর্মা। এঁরা দুজনেই কেরির উত্তরবঙ্গবাসের সঙ্গী। এ ছাড়া, মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার ১৮০১ সালের মে মাসে কেরির অধীনে ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের বাংলা বিভাগের প্রধান পন্ডিত হিসেবে নিযুক্ত হলেও, মনে হয় কলেজে নিযুক্ত হবার আগে থেকেই মৃত্যুঞ্জয়ের সঙ্গে কেরির পরিচয় ছিল। কলেজের কাজে যোগ দেবার আগে মৃত্যুঞ্জয় বাগবাজারে টোলে অধ্যাপনা করতেন। অধ্যাপনায় সাফল্যজনিত সুখ্যাতিই হয়ত মৃত্যুঞ্জয়কে কেরির কাছে পরিচিত করেছিল। তাই মনে হয়, কথোপকথনের পান্ডুলিপি সংকলনে কেরি ছাড়া আর যারা যোগ দিয়েছিলেন, তাঁরা হলেন রামরাম বসু, গোলোকনাথ শর্মা এবং মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে : এই তিনজনের মধ্যে কে, কোন অংশ লিখেছিলেন? এ-বিষয় নিশ্চিতভাবে বলা কঠিন। তবে ভাষাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে কিছু যুক্তিনির্ভর অনুমান করা যেতে পারে। যেমন, ‘চাকর ভাড়াকরণ’ এবং সাহেবমুনসির কথাবার্তা আরবি-পারসি-মিশ্রিত। কাজেই এ দুটির সঙ্গে মুনশি রামরাম বসুর যুক্ত থাকা অসম্ভব নয়, বিশেষত ‘আঞ্জাম’, ‘রেওরা’, ‘তাগাদা’, ‘তাগাইদ’, ‘খাতিরজমা’, ‘তকসির’, ‘নষ্টতা করা’, ‘ঠেকানো’, ‘প্রবর্ত হওয়া’, ক্রিয়াপদ ‘হবেক’ ‘থাকিবেক’ ‘যাবেক’ ওন/অনযুক্ত কৃদন্ত বিশেষ্যপদ ‘যাওন’ ‘হওন’ ‘মার্জন’ ‘চলন’ ‘শিক্ষণ’ ‘করণ’ ‘খাওন’ ‘পীয়ন’—এই পদগুলি বা এই কাঠামোর পদ তাঁর প্রতাপাদিত্য চরিত্রেও আছে, কিন্তু সমকালীন গোলোকনাথ বা মৃত্যুঞ্জয়ের রচনায় নেই বা তুলনামূলকভাবে বিরল। একই কারণে ‘ভদ্রলোক-২ প্রাচীন-২’[‘Discourse of the good old people’] শীর্ষক সংলাপটিকেও রামরামের রচনা বলে মনে হয়। এখানে আলোচ্য বিষয় জনৈক প্রাচীন ব্রাহ্মণ পন্ডিতের দীর্ঘ রোগভোগ ও তাঁর ‘কোম্পানির কার্য’-পাওয়া উঠতি বড়োলোক ভ্রাতুষ্পুত্রের বৃত্তান্ত। এখানে তৎসম শব্দের প্রাধান্য প্রত্যাশিত হলেও আকস্মিকভাবে ‘কাহিলী’, ‘কুদরৎ’, ‘চাসা হাট্টি’, ‘ভর্সা’, ‘লটখটানি’, ‘হরিমটুক’, ‘লওয়াজিমা’, ‘আমদ’ [প্রতাপাদিত্য চরিত্রে ব্যবহৃত] প্রভৃতি শব্দ অনুপ্রবিষ্ট। সংস্কৃত প্রবচন ‘নিয়তি: কেন বাধ্যতে’ এই সংলাপে হয়েছে ‘নিয়তঃ কেন বাধ্যতে’। সংলাপের এই প্রয়োগ প্রতাপাদিত্য চরিত্রেও আছে: ‘কি করে। চারা কি। নিয়তঃ কেন বাধ্যতে।’ এই সঙ্গে কথোপকথনের বিষয়কর্মসংক্রান্ত সংলাপগুলিতেও রামরামের কতৃত্ব থাকতে পারে। তবে সেকতৃত্বে কেরির সহযোগিতা বা সাক্ষাৎ নিয়ন্ত্রণের সম্ভাবনা খুবই প্রবল।

কথোপকথনের রচনায় গোলোকনাথ কতটা এবং কীভাবে অংশ নিয়েছিলেন অথবা আদৌ অংশ নিয়েছিলেন কিনা সে-বিষয়ে নিশ্চিতভাবে বলা কঠিন। কথোপকথনের পান্ডুলিপি রচনার সময় শ্রীরামপুর মিশন প্রেসে তাঁর ‘হিতোপদেশ’ ছাপার উদ্যোগ চলছে—শুধু এই তথ্যের সূত্রেই কথোপকথনের এক ধরনের ভাষারীতির উদাহরণ রচনায় কেরি তাঁকে নিযুক্ত করতে পারেন এমন সম্ভাবনা অনুমান করা যেতে পারে। বিশেষ করে যেখানে সংলাপের অন্যতম [যেমন, ‘ঘটকালি’, ‘যাজক যজমান’] বা উভয় চরিত্রই [যেমন ‘ভিক্ষুকের কথা’] জাতিতে ব্রাহ্মণ, সেখানে ব্রাহ্মণোচিত ভাষারীতির জন্য ব্রাহ্মণবংশীয় লেখককেই কেরি দায়িত্ব দেবেন এমন অনুমান করা অসংগত নয়। সেদিক থেকে মৃত্যুঞ্জয়ের নামও অবশ্য প্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে। কিন্তু মৃত্যুঞ্জয় এই সময় যে ‘বত্রিশ সিংহাসন’ [১৮০২] লেখেন তার ভাষারীতি পুরোপুরি সংস্কৃতঘেঁষা। ক্রিয়াপদ ও সর্বনাম সর্বত্র পূর্ণাঙ্গ। কিন্তু ‘ঘটকালি’ ‘যাজক ও যজমান’ এবং ‘ভিক্ষুকের কথা’-য় ক্রিয়াপদ ও সর্বনামের রূপ মাঝে মাঝে সঙ্কুচিত। এই বৈশিষ্ট্য তখন রামরাম ও গোলোকনাথ এই দুজনের মধ্যেই বিশেষভাবে দেখা যায়। কাজেই এই সংলাপগুলিতে মৃত্যুঞ্জয়ের হাত না থাকই সম্ভব। আরবী-পারসী-মিশ্রণ যদি রামরামের আরেকটি নিত্যলক্ষণ হয়, তবে এ তিনটি গোলোকনাথের রচনা হওয়া অসম্ভব নয়, কারণ, এই তিনটিতে আরবি-পারসি উপাদান খুব কম। তবে এই মত খুব ক্ষীণ অনুমান-সূত্রের উপর নির্ভরশীল। কাজেই রামরামের কৃতিত্বের কথাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। বিশেষত ‘যাজক ও যজমান’ এবং ‘ভিক্ষুকের কথা’য় যথাক্রমে ব্রাহ্মণ-পুরোহিতের জাত্যভিমানী শোষকরূপ ও সুযোগসন্ধানী উঞ্ছবৃত্তি সম্পর্কে যে প্রচ্ছন্ন শ্লেষের ভাব লক্ষ করা যায় তা তখনকার দিনে ব্রাহ্মণ অপেক্ষা ব্রাহ্মণেতর লেখকের কাছ থেকেই অধিক প্রত্যাশিত। বিশেষত দীর্ঘদিন টমাস ও কেরিকে খ্রিস্টধর্ম প্রচারের ব্যাপারে সাহায্য করতে গিয়ে রামরাম একটা ব্রাহ্মণবিরোধী মানসিকতা তখন আয়ত্ত করে ফেলেছিলেন। অন্যান্য ভাষাতাত্ত্বিক উপকরণের দিক দিয়েও [যেমন, অন/ওনযুক্ত কৃদন্ত বিশেষ্য; ব্যাকরণদুষ্ট সংস্কৃত প্রবচন ‘অমোঘ বিপ্র আশীষ’] এই লেখাগুলির রচয়িতা হিসেবে গোলোকনাথের বদলে রামরামকে মেনে নেওয়াই বেশি যুক্তিসংগত বলে মনে হয়। বইয়ের শেষ ‘কথোপকথন’টিও রামরামের লেখা বলে মনে হয়, কারণ শাব্দিক উপাদান রামরামেরই সাপেক্ষতা করে।

মৃত্যুঞ্জয়কে কেরি সম্ভবত ভিন্ন ভাষারীতির কথোপকথন রচনায় নিয়োগ করেছিলেন এবং তা কথোপকথনের বাংলা অংশ সংকলনের কাজ খানিকটা এগোবার পর। বইয়ের ভূমিকায় কেরি বলেছেন:‘When the following Dialogues were first begun, I did not intend to add a translation: but I soon perceived, that if they were so extended as to include the most common conversations of the country people, it would be necessary to translate them, and to add a few observations’ [বক্রীকরণ আমার]। এ উক্তি থেকে মনে হয় কেরি প্রথমে সাহেব ও সাহেব-সম্পৃক্ত দেশীয় মানুষজনের সংলাপ সংকলনের পরিকল্পনা করেছিলেন, পরে তাঁর পরিকল্পনা সম্প্রসারিত হয় এবং একেবারে নিম্নস্তরের [‘the lower order of people’—ভূমিকা] দেশীয় মানুষদের নানা পরিস্থিতি-নির্ভর সংলাপ সংকলন করার কথা ভাবেন। প্রকৃতপক্ষে ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের ছাত্রদের পক্ষে তো বাস্তব ও ব্যাবহারিক প্রয়োজনেই এই ‘the difference of idiom among the lower order of people in different situation’ [ভূমিকা] অবগত হওয়া বিশেষ জরুরি ছিল। এইসব ‘difference of idiom’ ব্যাকরণের সাধারণীকৃত সূত্রে ধরা পড়বে না বলেই তো তাদের পাঠ্যসূচিতে ব্যাকরণের সঙ্গে ‘কথোপকথনে’-র আবশ্যিক ও পরিপূরক সংযোজন। এই ‘the lower order of people’-এর ভাষাস্বাতন্ত্র্য ছাড়াও কেরি বাংলাভাষী সমাজের আর একটি অংশের ভাষারীতিতে উল্লেখযোগ্য স্বাতন্ত্র্য লক্ষ করেছিলেন, তা হল মেয়েদের ভাষা। এ বিষয়ে ভূমিকায় কেরির নিজের মন্তব্য : ‘Women speak a language considerably different from that of the men, especially in their quarrels’। এজন্য মেয়েলি ভাষা ‘in the friendly and contentious stile’ সংকলন করাও তিনি যুক্তিযুক্ত মনে করেছিলেন। আমাদের অনুমান কেরি মৃত্যুঞ্জয়কেই এই ধরনের [অর্থাৎ ‘the lower order of people’ এবং ‘Women’-এর ] ভাষা সংকলনের দায়িত্ব দিয়েছিলেন। আমাদের এই অনুমানের সূত্রটি এই রকম :—এই ধরনের সংলাপ একমাত্র তিনিই লিখতে পারেন যিনি এই দুটি শর্ত পূরণ করতে সমর্থ : [১] তিনি এই ধরনের ভাষার প্রকাশশক্তির অমোঘতা সম্পর্কে বিশেষভাবে অবহিত এবং এই ধরনের ভাষার তথাকথিত গ্রাম্যতা বা আভিজাত্যহীনতা সম্পর্কে সবরকম শুচিবায়ু বা গোঁড়ামি থেকে মুক্ত। [২] তিনি এই ধরনের মানুষদের [আধুনিক পরিভাষায় ‘target group’] জীবনযাত্রার সঙ্গে বিশেষভাবে পরিচিত।

এই শর্ত দুটির পরিপ্রেক্ষিতে মৃত্যুঞ্জয়কেই এই শর্ত পূরণে সক্ষম বলে মনে হয়। কারণ মৃত্যুঞ্জয়ের তৎকালীন বই ‘বত্রিশ সিংহাসন’ [১৮০২]-এর সংস্কৃতঘনিষ্ঠতা এবং ‘বেদান্তচন্দ্রিকা’ [১৮১৭]-র শেষ বাক্যে ‘সালঙ্কারা শাস্ত্রার্থবতী সাধুভাষা’ [অনুবাদে ‘Ornamented and beautiful language of the Shasters’]-র প্রতি পক্ষপাত দেখিয়ে ‘নগ্না উচ্ছৃঙ্খলা লৌকিক ভাষা’ [অনুবাদে ‘unembllished and immethodical style of vulgar language’] সম্পর্কে ‘সৎপুরুষদের পরাঙ্খুখ’ হবার অভ্যাসের কথা থাকলেও এই সংস্কৃতমুখীনতা খুবই উপলক্ষ্য-সাপেক্ষ ও আনুষ্ঠানিক বলে মনে হয়। কলেজের প্রধান পন্ডিত হিসেবে তিনি প্রথম বাংলা বই লিখছেন, সুতরাং পদমর্যাদার সঙ্গে সংগতি রেখে ‘বত্রিশ সিংহাসনে’ তাঁর সংস্কৃতিঘনিষ্ঠতা খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। অন্যদিকে ‘বেদান্তচন্দ্রিকা’-য় তাঁর সংস্কৃতঘনিষ্ঠতা খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। অন্যদিকে ‘বেদান্তচন্দ্রিকা’-য় সাধুভাষার প্রতি যে পক্ষপাত ও লৌকিক ভাষার যে অপহ্নব সেতো পন্ডিত ও চতুষ্পাঠীর অধ্যাপক হিসাবে একটা আনুষ্ঠানিক সামাজিক অঙ্গীকার, পন্ডিত সমাজের অংশীদার হিসেবে তিনি এই কথা সরবে ঘোষণা করতে বাধ্য। কিন্তু মনে মনে তিনি বাংলা ভাষার লৌকিক শব্দভান্ডার ও লোকোক্তির প্রকাশক্ষমতার জোর কতখানি তা ভালোভাবেই জানতেন। ওই বেদান্তচন্দ্রিকাতেই গুরুগম্ভীর প্রতিবেশে নিজের বক্তব্য বোঝাতে গিয়ে তিনি প্রচলিত লোকোক্তি ব্যবহার না করে পারেননি: (১) তত্বজ্ঞানীর ব্যাবহারিক ব্যাপার যদি করিতে হয় তবে কি যৎকিঞ্চিৎ কর্মযোগানুষ্ঠান করণে তত্বজ্ঞানভরালসেরদিরে ভার বোধ হয় মোটের উপরে কি শাকের আঁটি সহা যায় না;[অক্ষরের পীনায়ন আমার] (২) আপনার চক্ষুর ঢেঁকি দেখিতে পায় না পরের চক্ষুর ধূলি তুলিতে চায়। এই সঙ্গে ‘প্রবোধচন্দ্রিকা’ [আনুমানিক ১৮১৩]-র কথা অবশ্যই উল্লেখযোগ্য। ‘প্রবোধচন্দ্রিকা’-র শুধু বহুউদ্ধৃত বিশ্ববঞ্চক বৃত্তান্ত [২য় স্তবক ৪র্থ কুসুম] বা ব্যাঘ্রদম্পতী বৃত্তান্তে [৩য় স্তবক ৩য় কুসুম]-ই নয়, তত্ত্ব আলোচনাতেও সহজবোধ্যতার প্রয়োজনে তিনি লৌকিক শব্দ ও লোকোক্তি ব্যবহার করেছেন, তথাকথিত ভব্যরুচির পরোয়া করেননি। কারণ ব্যাখ্যা করে প্রবোধচন্দ্রিকার ভূমিকায় [১৮৩৩] মার্শম্যান বলেছিলেন, ‘The writer anxious to exhibit a variety of style, has in some cases indulged in the use of language current only among the lower orders; the vulgarity of which, however, he has abundantly redeemed by his vein of original humour’ [লক্ষণীয়, এখানেও সেই ‘lower order’-এর উল্লেখ]। আসলে, শুধু ‘প্রবোধচন্দ্রিকা’ লেখার সময়েই নয়, মৃত্যুঞ্জয়ের ভাষাবোধের মধ্যে আগাগোড়া একটা দ্বান্দ্বিক অবস্থান ছিল। সেজন্য পন্ডিত হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘সালঙ্কারা সাধুভাষা’-র সপক্ষে ওকালতি করলেও ব্যাবহারিক ক্ষেত্রে লৌকিক ভাষার শক্তিকে উপেক্ষা করতে পারেননি। বরং এই ভাষারূপ সম্পর্কে একটা সাপেক্ষতা বোধ করেছেন, কোন পন্ডিতি আভিজাত্যবোধ বা ব্রাহ্মণ্য শুচিবায়ু তাঁকে আচ্ছন্ন করতে পারেনি। ভাষাবোধের এই দ্বান্দ্বিকতা ‘বত্রিশসিংহাসন’ [১৮০২] লেখার সময়েও ছিল, তবে তখন তিনি উদীয়মান নবীন গ্রন্থকার, বিতর্কের ঊর্ধ্বে থেকে পন্ডিত সমাজ এবং কলেজীয় কতৃপক্ষের কাছে নিষ্কণ্টক প্রশংসা আদায়ই তাঁর লক্ষ্য। কিন্তু ১৮১৩-তে ‘প্রবোধচন্দ্রিকা’ লেখার সময় সমাজে ও ইংরেজমহলে তাঁর যশ ও প্রতিপত্তি সুপ্রতিষ্ঠিত। তখন স্বনামে প্রকাশিত বইতে ব্যাপকভাবে লৌকিক শব্দব্যবহার করলেও তাঁর ক্ষতির সম্ভাবনা নেই। কিন্তু ‘বত্রিশসিংহাসন’ [১৮০২] বা ‘কথোপকথন’ [১৮০১]-এর সময় স্বনামে প্রকাশিত বইতে লৌকিক শব্দ ব্যবহারে তাঁর অসুবিধা ছিল। তবে ‘কথোপকথন’ ছিল তাঁর পক্ষে বেনামী রচনা, এই বইতে বা রচনায় তাঁর নাম থাকছে না। তাই প্রবোধচন্দ্রিকার মতো এই বইতেও ‘language current only among the lower orders’ অবলম্বন করে কেরির ইচ্ছা অনুযায়ী সংলাপ-খন্ড রচনায় তাঁর কোনো অসুবিধা ছিল না। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, ‘কথোপকথনে’ অংশগ্রহণ করার ব্যাপারে মৃত্যুঞ্জয়ের অবস্থান আমাদের পূর্বোক্ত ১নং শর্তের সঙ্গে সংগতিশীল।

দ্বিতীয়ত, যে ক-টি সংলাপ মৃত্যুঞ্জয়ের রচনা বলে অনুমান করা যায় [মজুরের কথাবার্তা, হাটের বিষয়, স্ত্রীলোকের হাটকরা, স্ত্রীলোকের কথোপকথন, তিয়রিয়া কথা, কন্দল, স্ত্রীলোকের হাটকরণ, স্ত্রীলোক২ কথাবার্তা, মাইয়া কন্দল] সেগুলির চরিত্র ও প্রসঙ্গের ভৌগোলিক এলাকা বাগবাজার-আহিরিটোলা-সিমুলিয়া এককথায় এখনকার কলকাতার উত্তর অঞ্চল বা সুতানুটি এলাকা। বৃত্তি অনুযায়ী ভাষার উপরিতলে পার্থক্য থাকলেও তার নিহিত কাঠামোটি উত্তর কলকাতার রাঢ়ি উপভাষা। অর্থাৎ এই সংলাপগুলির সব চরিত্রই উত্তর কলকাতার বিভিন্ন পল্লির বাসিন্দা। বলা বাহুল্য, তখনকার দিনে এইসব পল্লির আর্থসামাজিক চিত্র ভিন্ন রকম ছিল, নগরায়ণের প্রক্রিয়াও তখন পুরোপুরি শুরু হয়নি। মৃত্যুঞ্জয় [১৭৬২—১৮১৯] তো তাঁর শিক্ষাজীবন শেষ করে উত্তর কলকাতার বাগবাজারে চতুষ্পাঠী খুলে বসবাস করছিলেন। সুতরাং, অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ দিকের প্রাক-নগরায়ণ পর্বের উত্তর কলকাতার জনজীবনের সঙ্গে তাঁর পরিচয় থাকা খুবই স্বাভাবিক। তাঁর জীবনবৃত্তান্ত আরও বিশদ অনুধাবনের অপেক্ষা রাখে। কিন্তু তাঁর স্বনামে প্রকাশিত বইগুলিতে লোকায়ত জীবনের যেসব প্রসঙ্গ ও অনুষঙ্গ নানা উপলক্ষ্যে উদাহৃত হয়েছে তাতে মনে হয় সেকালের উত্তর কলকাতার জনজীবনের সঙ্গে তাঁর পরিচয় বেশ ঘনিষ্ঠই ছিল। লোকজীবনের সঙ্গে পরিচয়ের অভিজ্ঞতাই প্রবোধচন্দ্রিকার বিভিন্ন উপাখ্যান ও লোকোক্তিতে প্রতিফলিত হয়েছে। এবং আমরা বলতে পারি স্বনামে প্রকাশের আগে তিনি বেনামে এইসব অভিজ্ঞতার কিছু অংশ ভিন্নভাবে ‘কথোপকথনে’-র পাতায় প্রকাশ করেছেন। ‘প্রবোধচন্দ্রিকা’-য় কাশ্মীররাজের বৃত্তান্তে [৩য় স্তবক ২য় কুসুম] কাশ্মীররাজের প্রতি দাসীদের কটূক্তি কিংবা ব্যাঘ্রদম্পতির বৃত্তান্তে [৩য় স্তবক ২য় কুসুম] শেয়ালের প্রতি বাঘিনীর দুর্বাক্য—এর সঙ্গে কথোপকথনের মেয়েলি ঝগড়ার সংলাপগুলির ঐক্য চক্ষুষ্মান পাঠকমাত্রেই স্বীকার করবেন। ব্যাঘ্রদম্পতি-বৃত্তান্তের অন্তর্গত চাষানীর সংলাপে গরিব গৃহস্থবধূর আর্থিক দুরবস্থার কথা প্রকাশ পেয়েছে, কথোপকথনের হাটে-যাওয়া সুতোকাটা পল্লিবধূর বৃত্তান্তের সঙ্গে তার মিল আছে। সুতানুটির সুতোকাটা গরিব মেয়েদের করুণ অবস্থা মৃত্যুঞ্জয় নিশ্চয়ই নিজের চোখে দেখেছিলেন। তাই এই ছবি। আর চাষানীর স্বামীকে মৃত্যুঞ্জয় প্রথমে আলঙ্কারিকভাবে ‘ক্ষেত্রপতি’ বলে উল্লেখ করলেও অচিরেই তার ধ্রুপদি আবরণ খসে গিয়েছে। সেরাজার রাজস্ব দেওয়া গরিব ভাগচাষি মাত্র। ফসল না হলেও রাজা খাজনা আদায় করতে ছাড়ে না। তার উপর মোড়ল, পাটোয়ারি, ইজারাদার, তালুকদার, জমিদারের পাইক পেয়াদার উৎপাত এবং মহাজনের শোষণও আছে। ‘যে বছর শুকা হাজাতে কিছু খন্দ না হয় সেবছর’ চাষিকে পাড়াপড়শিদের ঘরে ‘দুই চারি পোণ’ মজুরিতে ‘মুনিশ’ খাটতে হয়। এই মুনিশ খাটা গরিব চাষিই কি ‘কথোপকথনে’ ‘মজুরের কথাবার্তা’ সংলাপে ভিন্নভাবে উপস্থিত হয়নি? দুটি ক্ষেত্রে উপলক্ষ্য ভিন্ন হলেও পরিস্থিতি অভিন্ন এবং মজুরের প্রতি রচয়িতার সহানুভূতিও অভিন্ন। ‘হাটের বিষয়’ সংলাপখন্ডে তো এই ধরনের দুই গরিব ভাগচাষি বা মুনিশখাটা খেতমজুর হাটের পথে রওনা হয়েছে। আর ‘তিয়রিয়া কথা’য় যে জেলেপাড়ার প্রতিবেশ, সেজেলেপাড়া তো মৃত্যুঞ্জয়ের বাসস্থান বাগবাজার থেকে খুব বেশি দূরে নয় [স্মরণীয়: জেলেপাড়ার সঙ]। সুতরাং এই সংলাপখন্ড রচনায় মৃত্যুঞ্জয়ের হাত থাকার কথা অনুমান করা অসংগত নয় [উল্লেখ্য : প্রবোধচন্দ্রিকা ৪র্থ স্তবক ৬ষ্ঠ কুসুমে তিনি বলেছেন, ‘তীবরের প্রসিদ্ধ নাম তিয়র। বৃত্তি মৎস্যবিক্রয়াদি’]।

৩.

কথোপকথনের আখ্যাপত্রে [আগস্ট ১৮০১] বলা হয়েছিল : Dialogues intended to facilitate the acquiring of the Bengalee Language। এখন প্রশ্ন হচ্ছে: ‘Bengalee Language’-এর চেহারা তখন কেরির কাছে কেমন ছিল? এর উত্তর কেরির ব্যাকরণের ভূমিকা [২২ এপ্রিল ১৮০১]-তেই পাওয়া যায়:‘The Bengalee comprehends the dialects of Midnapore, Nuddea, Dinagepore, Cooch Behar, and that spoken about Dacca and Chittagung, which all differ from each other and yet preserve the same formation and genius’ [p. iv] অর্থাৎ কেরির কাছে ‘Bengalee Language’ হচ্ছে পূর্ব-পশ্চিম, উত্তর-দক্ষিণ এলাকার সমস্ত উপভাষার সন্নিপাত বা সমবায়। কিন্তু ব্যাকরণে তিনি বাংলা ভাষার এইসব উপভাষার পরিচয় দেননি, ঔপনিবেশিক বৈচিত্র্য সত্ত্বেও বাংলার ‘formation and genius’-এর যে একটি অভিন্ন কাঠামো আছে ব্যাকরণে তিনি সেই কাঠামোটিই তুলে ধরতে চেয়েছেন। আর ভাষার আঞ্চলিক রূপবৈচিত্র্য আয়ত্ত করার উপায় হিসেবে বলেছেন, ‘when the language itself is acquired, the difficulties of understanding the provincialisms will be obviated by a little attention to the conversation of the native’—অর্থাৎ এইজন্যই ‘কথোপকথনে’-র পরিকল্পনা। সুতরাং, কথোপকথন ব্যাকরণের সূত্রাবলির উদাহরণ-সম্প্রসারণ নয়, ব্যাকরণে যা দেননি বা দিতে পারেননি, তারই পরিপূরক। ‘কথোপকথন’ যে ব্যাকরণেরই পরিপূরক প্রকাশন, তা এই অর্থেই।

তবে কি ‘কথোপকথনে’ সারাবাংলার সমস্ত উপভাষাতেই সংলাপ সংকলিত হয়েছে? না, তা হয়নি। কেরি ব্যক্তিগতভাবে পশ্চিমবঙ্গ [পুরোনো অর্থে] ও উত্তরবঙ্গের উপভাষার সঙ্গে পরিচিত থাকলেও ‘কথোপকথনে’ শুধু পশ্চিমবঙ্গের অর্থাৎ রাঢ়ি উপভাষার নমুনাই গৃহীত হয়েছে। কারণ, এই বই ভাবী রাজকর্মচারীদের জন্য বৃহত্তর ঔপনিবেশিক স্বার্থের দিকে লক্ষ রেখে সংকলিত। তখন সারাবাংলা এবং পার্শ্ববর্তী এলাকা জুড়ে ব্রিটিশ উপনিবেশ দ্রুত সম্প্রসারিত হতে থাকলেও কলকাতা ও তার আশপাশের এলাকাকে নিয়েই এই উপনিবেশের স্নায়ুকেন্দ্র গড়ে উঠেছে। তাই সংকীর্ণ ও ঔপনিবেশিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই বাংলার অন্যান্য এলাকা উপেক্ষিত হয়েছে এবং বিকাশমূলক সব ধরনের কাজকর্মই [বৈষয়িক ও সারস্বত] কেন্দ্রীভূত হয়েছে উপনিবেশের স্নায়ুকেন্দ্রে। ঔপনিবেশিক ভাষাচর্চার ক্ষেত্রেও তাই কলকাতা ও তার আশপাশের এলাকার ভাষা ও ভাষাপ্রবণতাই বিশেষভাবে গুরুত্ব পেয়েছে। অবশ্য এর একটা অন্য ঐতিহাসিক কারণও ছিল। মধ্যযুগে গদ্য লেখার কোনো সর্বজনীন উপলক্ষ না-থাকলেও পদ্য লেখার সর্বজনীন প্রয়াস ছিল। সেই প্রয়াসের মধ্য দিয়ে পদ্যভাষার একটি মান্যীকৃত সর্বজনীন রূপ দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। পদ্যের এই মান্যীকৃত রূপের ভিত্তিটি ছিল রাঢ়বঙ্গের উপভাষা। তাই রাঢ়বঙ্গের পদ্যে [তা আখ্যানমূলক হোক বা গীতিমূলক হোক] যে ভাষারূপ প্রতিষ্ঠিত প্রান্তপূর্ববঙ্গের চট্টগ্রাম-আরাকান এলাকার কবিরাও পদ্য লেখায় অনেকদিন পর্যন্ত সেই ভাষারূপ অনুসরণ করে এসেছেন। অর্থাৎ সর্বজনীন লেখার ব্যাপারে রাঢ়ি উপভাষার প্রাধান্য অনেকদিন থেকে প্রতিষ্ঠিত। মধ্যযুগে বাংলা গদ্য সর্বজনীনভাবে লিখিত হয়নি, যা হয়েছে তা খুব সীমাবদ্ধ ক্ষেত্রে ও সীমাবদ্ধ উপলক্ষ্যে, কিন্তু আঠারো শতকের শেষে এবং উনিশ শতকের গোড়ায় যখন সর্বজনীনভাবে গদ্য লেখার দরকার হল তখন ঐতিহ্যগত ভাবে রাঢ়ি উপভাষার ভিত্তিটাই আপেক্ষিক গুরুত্ব লাভ করল। কেরির দেশীয় ভাষা-শিক্ষকরা, তিনি যে এলাকারই হোন না কেন, ভাষা শেখাতে গিয়ে এবং পরে গদ্য বই লিখতে গিয়ে এই ভিতটাই অবলম্বন করেছিলেন। কেরিও তাই ব্যাকরণের পরিপূরক করতে গিয়ে ‘কথোপকথনে’ শুধু রাঢ়ি উপভাষার বৃত্তেই আবদ্ধ থাকেন, অন্যান্য উপভাষা তাঁর সংকলনে অপ্রয়োজনীয় বিবেচিত হয়।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে: ওই সময়ে অর্থাৎ আঠারো শতকের শেষদিকে কলকাতা ও সন্নিহিত এলাকার উপভাষা অর্থাৎ কথ্য ভাষার চেহারা কেমন ছিল? কথ্যভাষা ছাড়াও কোন আলাদা লেখ্য ভাষা ছিল কি? যদি থেকে থাকে তার সঙ্গে কথ্যভাষার সম্পর্ক কেমন ছিল? এ ব্যাপারে কেরির ব্যাকরণের ভূমিকা [১৮০১] তেই কিছু উত্তরের আভাস পাওয়া যায়: ‘The Language in which the classical books of the Hindoos are written is principally derived from the Sansksrit. This is called pure Bengalee: but multitudes of words, originally Persian or Arabic, are constantly employed in common conversation, which perhaps ought to be considerd as enriching rather than corrupting the language’ [বক্রীকরণ আমার]। বাংলা গদ্যভাষায় হিন্দু শাস্ত্রগ্রন্থ রচনার দীর্ঘ ঐতিহ্য নেই, তবে অষ্টাদশ শতাব্দীতে এই ধরনের কিছু গদ্য বইয়ের পুথি ঐতিহাসিকেরা উদ্ধার করেছেন। পন্ডিতদের কাছে কেরি এসব পুথি দেখেও থাকবেন। এগুলির ভাষা অবশ্যই সংস্কৃতঘনিষ্ঠ এবং কেরির মতে তা ‘pure Bengalee’। ১৮১৭ সালে মৃত্যুঞ্জয়ও ‘বেদান্তচন্দ্রিকায়’ ‘শাস্ত্রার্থবতী’ ভাষাকে ‘সাধুভাষা’ বলে চিহ্নিত করেছিলেন, যা সালঙ্কারাও বটে। এর পাশাপাশি তিনি আর একটি ভাষারূপের কথা বলেছিলেন—‘লৌকিক ভাষা’ যা ‘নগ্না উচ্ছৃঙ্খলা’ [ইংরেজি অনুবাদে ‘unembellished and immethodical’] এবং যার প্রতি ‘সৎপুরুষেরা’ ‘পরাঙ্খুখ’। ১৮২৩-এ প্রকাশিত ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘কলিকাতা কমলালয়ে’ এ বিষয়ে আর একটু স্পষ্ট চিত্র পাওয়া যায়। সেখানে পল্লিগ্রাম-নিবাসী আগন্তুকটি কলকাতা-নগরনিবাসীকে বলেছে ‘শুনিয়াছি যে ভদ্রলোকের মধ্যে অনেক লোক স্বজাতীয় ভাষা মিশ্রিত করিয়া থাকেন যথা—কম, কবুল, কমবেশ, কয়লা, কর্জ, কষাকষি, কাজিয়া ইত্যাদি ককার অবধি ক্ষকার পর্যন্ত, ইহাতে বোধ হয় সংস্কৃতশাস্ত্র ইহারা পড়েন নাই এবং পন্ডিতের সহিত আলাপও করেন নাই তাহা হইলে এতাদৃশ বাক্য ব্যবহার করিতেন না স্বজাতীয় এক অভিপ্রায়ের অধিক ভাষা থাকিতে যাবনিক ভাষা ব্যবহার করেন না’। উত্তরে কলকাতাবাসী নাগরিক কলকাতার লোকেরা যে মিশ্র ভাষার ব্যবহার করে তার সমর্থনে বলে, ‘ইহার কতক কতক ব্যবহার করিয়া থাকেন কিন্তু ইহাতেও বড় দোষ স্পর্শ হয় না যেহেতু সন্ধ্যাপূজা ও দৈবকর্মে পিতৃকর্মে ওই সকল শব্দ ব্যবহার করিলেই দোষ হইতে পারে [। ] বিষয়কর্ম নির্বাহার্থে কিংবা হাস্যপরীহাসাদি সময়ে ব্যবহার করণে কি দোষ [,] আর অন্য জাতীয় ভাষা না কহিলে পরে সংস্কৃতানুযায়ী ভাষা ব্যবহার করিলে অনেকে বুঝিতে পারে না তবে কীরূপে বিষয়কর্ম নির্বাহ হয়, আরো বলি যখন যে জাতি রাজা হয়েন তখন তজ্জাতীয় অনেক বাক্য চলিত হইয়া থাকে বিশেষত রাজবিচার সম্পর্কীয় ব্যাপারের কথাসকল ব্যবহার না করিলে উপায় নাই’ [পীনায়ন আমার]। অর্থাৎ সংস্কৃতঘেঁষা একটি ‘শুদ্ধ’ লেখ্য বাংলার ব্যবহার তখন প্রচলিত ছিল, কিন্তু তার অনুশীলন ছিল শুধু শাস্ত্রচর্চার জন্য পন্ডিত ও পন্ডিতদের সঙ্গে ‘সহবাস’-সম্পন্ন ব্যক্তিদের মধ্যে সীমাবদ্ধ। ‘বেদান্তগ্রন্থে’ [১৮১৫] রামমোহন এই ভাষাকেই ‘সাধুভাষা’ বলে চিহ্নিত করেছেন। এই ভাষা সীমাবদ্ধ শুধু শাস্ত্রচর্চার ক্ষেত্রে মুষ্টিমেয় শাস্ত্রজ্ঞ ব্যক্তিদের মধ্যে। কিন্তু সমাজের কাজ তো শুধু শাস্ত্রচর্চা নয়, সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশও শাস্ত্রব্যবসায়ী নয়। বিশেষ করে তখনকার নতুন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পটভূমিকায় সামাজিক প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে শাস্ত্রচর্চার চেয়েও বিষয়কর্মের গুরুত্ব অনেক বেশি সম্প্রসারিত হচ্ছে। আর বিষয়কর্মের ভাষার ‘শোষণশক্তি’ অনেক বেশি, তার কারণও ভবানীচরণের রচনায় ব্যাখ্যাত। সমাজের বৃহত্তর কাজকর্মের জন্য এই শোষণশক্তি ছাড়াও নমনীয়তাও এত বেশি যে এই ভাষা কথ্যতা ও লেখ্যতার গন্ডি অনায়াসে ডিঙিয়ে যেতে পারে, ‘শাস্ত্রার্থবতী’ সাধুভাষায় যা সম্ভব নয়। এজন্য কিছুদিন পরেই সাধুভাষার সুদিন দেখা দিলেও দুই শতকের সন্ধিলগ্নে শাস্ত্রার্থবতী সাধুভাষা ছিল কোণঠাসা—তার পোশাকি বা আনুষ্ঠানিক সম্মান থাকলেও বৃহত্তর সমাজে তার আটপৌরে বা ব্যাবহারিক গ্রহণযোগ্যতা ছিল না। সমাজের সর্বস্তরে চালু ছিল আরবি-পারসি-ইংরেজি-পোর্তুগিজ শব্দ মেশানো লৌকিক ভাষা, যাকে কেরি বলেছেন ‘Constantly employed in common conversation’। একেই মিলার বলেছেন ‘চলতি কথা’ এবং রামরাম বসু বলেছেন ‘চলন ভাষা’ [লিপিমালা ১৮০২]। এই ‘চলনভাষা’-ই ছিল তখনকার সামাজিক কথ্যভাষা এবং ‘চলনভাষা অবগত নহিলে রাজক্রিয়াকর্ম হইতে পারে না’ [লিপিমালা—রামরাম বসু]। এজন্য বৈষয়িক লেখাপড়ার কাজে চলনভাষার লিখিত ব্যবহারও ছিল। অর্থাৎ শাস্ত্রনিষ্ঠ ক্ষীণ সাধুভাষার পাশে তখন আর একটি লেখ্যভাষার ধারা বিপুলভাবে জেগে উঠছিল যার সঙ্গে কথ্যভাষার সম্পর্ক ছিল অনায়াস-অন্তর্বিনিময়ের এবং যাকে বাংলা গদ্যের সংস্কৃতজ্ঞ লেখকেরা অচিরেই খুব সংগঠিতভাবে চাপা দিয়েছেন। ঔপনিবেশিক চতুর ইংরেজ রাজশক্তিও এক সাম্রাজ্যবাদী দূরদর্শিতায় বাংলা ভাষাগোষ্ঠীর মধ্যে সাম্প্রদায়িক ভাষাবিচ্ছেদের বীজ বপন করার জন্য মুসলিম-জনগোষ্ঠী-ঘনিষ্ঠ আরবি-পারসি-মিশ্রিত এই চলনভাষার বদলে ব্রাহ্মণ্য সাধুভাষারই ধারাবাহিক পৃষ্ঠপোষকতা করে এসেছে। পারিপার্শ্বিকের প্রভাবে কেরি পরে এই সংস্কৃতপন্থী প্রবণতার অংশীদার হয়ে পড়লেও ১৮০১-এ কেরির দৃষ্টিভঙ্গি এমন ছিল না। তখন ব্যাকরণের ভূমিকায় আরবি-পারসির মিশ্রণকে ‘enriching rather than corrupting the language’ বলে মনে করেছেন এবং কথোপকথনে আরবি-পারসি-মিশ্রিত সাহেব ও মুনশির সংলাপকে ‘grave stile’ বলে চিহ্নিত করেছেন। তাই ব্যাকরণে [১৮০১] তিনি যে বাংলার পরিচয় দিয়েছেন তা এই চলনবাংলা, আর ‘কথোপকথনে’ [১৮০১] সাহেব-সন্নিহিত লোকজন এবং বিষয়ী লোকদের সংলাপে এই চলনবাংলারই পরিস্থিতি অনুযায়ী ভিন্ন ভিন্ন বৈচিত্র্য দেখিয়েছেন। তবে আগেই বলা হয়েছে, ‘কথোপকথন’ বাংলা ব্যাকরণের সূত্রাবলির দৃষ্টান্তমালা নয়, এখানে আরো কিছু আছে যা ‘could not be acquired by constant and rigid attention to grammatical rules alone’ [ভূমিকা-কথোপকথন]।

কী সেই বাড়তি উপাদান যা ব্যাকরণ বইতে নেই? তা হল ভাষার এমন সব নিদর্শন যা ব্যাকরণ-অভিধানের মতো ভাষাশিক্ষার মামুলি উপকরণে পাওয়া যাবে না, এবং ব্যাকরণ-অভিধানের বাঁধাধরা বিচারে যা আপাতত ‘irregular’। কেরি এগুলিকে বলেছেন, ‘allusive expressions and idiomatic forms of speech’। এই ‘allusion’ কীসের ঐতিহ্য-উল্লেখ? এই ‘idiom’ কোন যূথজীবনের কোন অতীত একক ঘটনার সাধারণীকৃত বাঙ্খয় বিবৃতি? এখানেই আসে সমাজের সাধারণ ব্যাপ্তির মধ্যে ছোটো ছোটো গোষ্ঠীবন্ধনীর কথা, সমাজ এগিয়ে গেলেও যার রেশ থেকে যায় সমাজের কথাবার্তার সচল ধারার মধ্যে। এই গোষ্ঠীবন্ধনী যে ভাষার সাধারণ রূপের মধ্যে বৈচিত্র্য সৃষ্টি করে কেরি সেকথা ব্যাকরণের ভূমিকাতে বলেছেন: ‘There are also certain variations of Dialect among people, of different caste, though living in the same town’। অর্থাৎ সমাজের জাতিভেদ একটি গোষ্ঠীবন্ধনী যা একই ভাষার মধ্যে নানা ঔপভাষিক বৈচিত্র্য সৃষ্টি করে। ব্যাকরণে পুরুষবাচক সর্বনামের আলোচনায় ‘superior’ [যথা ‘আমি’] এবং ‘inferior’ [যথা ‘মুই’]—এই রকম শ্রেণিবিভাগের বেশি আর কিছু করেননি [ব্যাকরণ, p.42]। কিন্তু ‘কথোপকথনে’ বিষয়টি আর একটু বিশদভাবে উপস্থিত করেছেন, যদিও গোষ্ঠীবন্ধনীর গ্রন্থিগুলিকে খুব স্পষ্ট করে চিহ্নিত করেননি। যেটুকু করেছেন তা হল ১. ‘lower order of people’ ২. ‘Women’ অর্থাৎ বক্তার লৈঙ্গ-সামাজিক [sexo-societal] অবস্থান—এই দুটি বন্ধনীগ্রন্থির কথা কেরি ভূমিকায় খুব স্পষ্ট করে উল্লেখ করেছেন, আর উল্লেখ না-করেও আর একটির দৃষ্টান্ত দিয়েছেন, তা হল বয়স তথা প্রজন্ম [age, i.e. generation]।

‘Lower order of people’ বলতে গিয়ে জনসংখ্যার বিভিন্ন ‘order’ বা বিন্যাসের ভিত্তি কী কেরি তা নির্দিষ্ট করে না-বললেও, বোঝা যায় যে এই ‘order’-এর ভিত্তি অর্থনৈতিক অবস্থা নয়, জাতি বা বর্ণগত অবস্থান। ‘কথোপকথনে’-র পরিমন্ডলে ভাষার অবস্থানও এই অবস্থানের সঙ্গে সংগতিশীল। এই জন্য কেরির ব্রাহ্মণ ভিক্ষুক আর সম্পন্ন ‘ভদ্রলোকে’-র ভাষারূপে কোনো তফাত নেই, কারণ তাদের আর্থিক অবস্থায় উচ্চাবচতা থাকলেও সামাজিক বা জাতিগত অবস্থায় কোনো তারতম্য নেই। শ্রেণিগতভাবে এরা এক ও অভিন্ন—এরা পরশ্রমজীবী, স্বয়ং শ্রমজীবী নয়। পক্ষান্তরে মজুর, ভাগচাষি বা তিয়র ‘ভিক্ষুকের কথা’-র ব্রাহ্মণের মতো অনুগ্রহজীবী বা সম্পূর্ণ পরনির্ভর ভিক্ষুক নয়, শ্রমের বিনিময়ে তাদের রোজগারের সংস্থান আছে, কিন্তু তা সত্ত্বেও সামাজিক সঁিড়ির নীচের ধাপে অবস্থান হেতু তাদের ভাষারূপের মধ্যে ধ্বনিতাত্ত্বিক ও রূপতাত্ত্বিক অপভ্রংশের লক্ষণ অনেক বেশি। স্থানাভাবে উদ্ধৃতি দিতে বিরত থাকলাম, পাঠকরা উল্লিখিত সংলাপগুলি পরস্পর তুলনা করলেই বিষয়টি বুঝতে পারবেন। এখানে সমাজ ভাষাবিজ্ঞানের দিক দিয়ে আর একটি গুরুত্বপূর্ণ ইঙ্গিত আছে। সেটি ‘তিয়রিয়া কথা’-র বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ প্রসঙ্গে। কেরি এই সংলাপকে বলেছেন ‘the greatest instance of irregularity’। এই ‘irregularity’-র কারণ হচ্ছে এর বিশেষ ধরনের গোষ্ঠীগত উচ্চারণভঙ্গি, শব্দভান্ডার ও বাগবিধি যা ভাষায় সাধারণভাবে প্রচলিত নয়। অর্থাৎ এর দ্বারা কেরি এই ইঙ্গিত দিতে চেয়েছেন যে, যে-গোষ্ঠী জাতিগতভাবে যত আত্মসংবৃত [self-contained] সেই গোষ্ঠীর ভাষারূপে তার জাতিগত স্বকীয়তা বা বিচ্ছিন্নতার লক্ষণ তত বেশি।

এই আত্মসংবৃতির তত্ত্ব মেয়েদের সংলাপগুলির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। এই মেয়েরা সামন্ততান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার অধীন। ওই সমাজব্যবস্থায় মেয়েদের সামাজিক অবস্থান অনেক বেশি আত্মসংবৃত। বৃত্তিগত কারণে কোনো কোনো সম্প্রদায়ের মেয়েরা হাটবাজারের মতো উন্মুক্ত মেলামেশার জায়গায় যেত, কিন্তু তাদের সামাজিক আত্মসংবৃতি তাদের মানসিক জগতে এত বেশি প্রভাব ফেলত যে, এই সব আংশিক ও প্রান্তিক বহি:সংযোগ [external exposure] তাদের ভাষারূপে কোনো উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটাতে পারত না। তাদের মনোজগতের আত্মসংবৃতির জন্য নানা আদিম সংস্কার ও লোকবিশ্বাস তাদের মনে দৃঢ়মূল হত। এইজন্য তাদের সংলাপে নানা লোকায়ত সংস্কার, আচার ও বিশ্বাসের ‘allusive expression’। ‘কন্দল’ শীর্ষক সংলাপটিতে কোন্দলের উপলক্ষ্যই তো ‘ভরন্ত কলসি’ ‘ছেলের মাথার উপর তলানি’ দিয়ে নিয়ে যাওয়া এবং ‘সেই হইতে ষাইটের বাছা’-র ‘জ্বরে ঝাউরে’ পড়া—এই দুটি ঘটনার মধ্যে কার্যকরণগত সম্পর্ক স্থাপন। এই কার্যকরণ সম্পর্ক স্থাপনের মধ্যে বৈজ্ঞানিক বিচারবুদ্ধি নেই, আছে আবহমান কাকতালীয় লোকবিশ্বাস, যার অপর নাম হচ্ছে কুসংস্কার। ‘স্ত্রীলোক ২ কথাবার্তা’-য় সংসারের বড়ো বউ প্রতিবেশিনীকে বলে ‘মায়া দুটার বিবাহ দিতে পারলে আমি সাতটা সর্ষা দিয়া স্নান করি কুলাইছন্ডির ভানা গুয়া পান দেই সুবচনী পূজা করি মনস্কামনা সিদ্ধি করিলে।’ এখানেও অলৌকিক শক্তির উপর ঐতিহ্যগত বিশ্বাস ও নির্ভরশীলতা এবং অলৌকিক শক্তির প্রীতি উৎপাদনের জন্য লোকাচারসম্মত ব্যবস্থা অবলম্বনের সঙ্কল্প। ‘সুবচনী’ সম্পর্কে ইংরেজি অনুবাদে কেরি কিছু ‘observation’ দেননি, তবে তাঁর অভিধানে [১৮১৮] বলেছেন, ‘a goddess worshipped by women in company with Moosoolman women’। তাহলে এখানে দেখা যাচ্ছে ‘মনস্কামনা সিদ্ধি’-র দেবী হিসেবে ‘সুবচনী’ মেয়েমহলে এমন একটি অলৌকিক শক্তির অধিষ্ঠাত্রী যাঁর মহিমার প্রতি বিশ্বাস উচ্চতর সাম্প্রদায়িক সীমানাকেও অতিক্রম করে যায়। এই বিশ্বাস আধুনিককালের ধর্মনিরপেক্ষতা বা secularism নয়, ধর্মভিত্তিক অসাম্প্রদায়িকতা, যার বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সম্প্রদায়বিশেষের যাজকগোষ্ঠীর খবরদারিকে উপেক্ষা না-করেও মানুষ যেখানে অস্তিত্বের একেবারে গোড়ার জায়গায় নিজেকে সম্প্রদায়-নির্বিশেষে একই ধরনের দুরবস্থার অধীন বলে মনে করে এবং সেই দুরবস্থা থেকে উদ্ধারের উপায় হিসেবে সাম্প্রদায়িক শাস্ত্রগত ব্যবস্থাপনার সঙ্গে লোকাচারসম্মত এক ও অভিন্ন অলৌকিক শক্তির উপর আস্থা স্থাপনকেও বিকল্প বা পরিপূরক হিসেবে মেনে নেয়। বড়ো বউয়ের এই সংলাপে সেই সামন্ততান্ত্রিক যুগের বাঙালি মেয়েদের এই শাস্ত্রাচার-নিরপেক্ষ লোকবিশ্বাসেরই ‘allusive expression’ ঘটেছে।

কোন্দলের সময় মেয়েরা প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে যেসব বিশেষণ ও সম্বোধন ব্যবহার করেছে আধুনিক রুচিতে তা অশ্লীল বলে মনে হলেও তাতেও এই ‘allusive expression’। অশ্লীল শব্দগুলি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় প্রতিপক্ষকে আঘাত করার জন্য তাকে দু-ভাবে দেখবার চেষ্টা করা হয়েছে :[১] সেপরিবারের বিভিন্ন সদস্যদের পক্ষে অনিষ্টকারিণী [আক্ষরিক অর্থে ভক্ষণকারিণী—জামাইখাগি, পুতখাকি, ভালডাখাগি, ভাইখাকি ইত্যাদি]। পরিবারের বাস করার সময় সেসামাজিক নিয়মকানুন লঙ্ঘন করে না, শুধু তার স্বভাবের উগ্রতাই পরিবারের পক্ষে ক্ষতিকর। এখানে গালাগালির উপাদান হচ্ছে উদ্দিষ্ট মহিলার স্বভাবের উপর উগ্রতার অভিযোগ আরোপ। [২] সেপরিবারে বাস করলেও তার আচরণ পরিবারের সামাজিক সুনামের পক্ষে ক্ষতিকর। কারণ সামন্ততান্ত্রিক সমাজে বিবাহ নামক সামাজিক চুক্তির শর্তে আজীবন একটিমাত্র পুরুষের যৌন বশ্যতাই মেয়েদের শুচিতা তথা সামাজিক মর্যাদাপ্রাপ্তির একমাত্র মাপকাঠি। যেকোনো পরিস্থিতিতে এই অবস্থার ব্যতিক্রম মেয়েদের পক্ষে চরম অগৌরবের বিষয়। বলা বাহুল্য, ‘গস্তানী’ ‘পেটফেলানি’ ‘খানকি’ ইত্যাদি শব্দের মধ্য দিয়ে বোঝানো হয়েছে উদ্দিষ্ট মহিলা সেই বশ্যতা স্বীকার করে না। এখানে গালাগালির উপকরণ হচ্ছে উদ্দিষ্ট মহিলাকে সমাজবিরোধী বলে চিহ্নিত করা। দুটি উপকরণের মধ্যে দ্বিতীয় উপকরণটি চরিত্রহননের পক্ষে সবচেয়ে মারাত্মক। সেজন্য দুটি কোন্দলের মধ্যে দেখা যায় প্রথমটিতে আক্রমণের ক্ষেত্র প্রতিবেশী দুই পরিবার, স্বার্থের সংঘাত কিছুটা অস্পষ্ট, তা ছাড়া আক্রমণের বেগও তত তীব্র ও দীর্ঘস্থায়ী নয়, সেজন্য এক্ষেত্রে প্রথম উপকরণবাহী শব্দগুলি ব্যবহৃত হয়েছে, কিন্তু দ্বিতীয় কোন্দলে আক্রমণের ক্ষেত্র একই পরিবার, স্বার্থের সংঘাত সুনির্দিষ্ট, আক্রমণ দীর্ঘস্থায়ী এবং আক্রমণের বেগও তীব্র থেকে তীব্রতর। এই কোন্দলে দুই রকম উপকরণবাহী শব্দই একযোগে ব্যবহৃত হয়নি, সামন্ততন্ত্রের অধীনে একটি বহুকাললালিত পারিবারিক মূল্যবোধেরই ‘allusive expression’ হিসেবে তির্যকভাবে ব্যবহৃত হয়েছে। আবার, আত্মসংবৃতির জন্য মেয়েদের শব্দভান্ডার সীমাবদ্ধ বটে। নতুন শব্দ গ্রহণের বদলে পুরোনো অপ্রচলিত শব্দের প্রতি রক্ষণশীলতা [কানোড়া, হিজলদাগুড়া, আঁটকুড়ি ইত্যাদি] এবং ইডিয়ম, প্রবাদ ও প্রবাদমূলক বাক্যাংশের বাহুল্য [সুতার কপালে আগুন, দশ নুড়া তোর মুখে, অঙ্গ লাড়া, তলানি দেওয়া, ঘাটে বসে মঙ্গল গাওয়া, বুকে বাঁশ দেওয়া, বাঁশ থাকিয়া কঞ্চি শক্ত, রাবণের চিলুমাথা মুড়া খাওয়া, চক্ষের মাথা খাওয়া, পুতের মাথা খাওয়া, ভালো রাতি না পোহানো, শ্রাদ্ধের চালু চড়ান, রাড় চুয়াড় ইত্যাদি] মেয়েলি সংলাপগুলিতে প্রাধান্য পেয়েছে। এ-ও এক আত্মসংবৃতিজনিত স্বাতন্ত্র্য-লক্ষণ।

এই আত্মসংবৃতির কারণেই ‘ভদ্রলোক২ প্রাচীন২’ সংলাপে আরবি-পারসি শব্দের ব্যবহার কম। এই দুই ব্যক্তি বয়সে ‘প্রাচীন’ এবং সামাজিক মর্যাদায় ‘ভদ্রলোক’—অর্থাৎ প্রাচীনতর প্রজন্মের প্রতিভূ। এঁরা চাষি, মজুর, খাতক, মহাজন, ব্যবসায়ী ইত্যাদি কোনো শ্রেণিতেই পড়েন না। এঁরা তাই ‘ভদ্রলোক’। কোম্পানির আগমনে বানিয়া অর্থনীতি ও তাকে ভিত্তি করে যে নতুন উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির উদ্ভব শুরু হয়েছে, এঁরা তার সঙ্গে যুক্ত নন। এঁরা তারও আগেকার সামন্ততান্ত্রিক আত্মসংবৃত গ্রামীণ সংস্কৃতির অংশীদার। তাতে নবাবি আমলের ঐতিহ্যের ছাপ থাকলেও সেইসঙ্গে মধ্যযুগীয় ব্রাহ্মণ্য মূল্যবোধের অনুস্মরণও আছে। এজন্য এই সংলাপের শব্দভান্ডারে আরবি-পারসির ব্যবহার কম, তৎসম বা তদ্ভব শব্দেরই প্রাচুর্য। সেইসঙ্গে প্রাচীন লোকোক্তির ইতস্তত ব্যবহার [হরিমটুক, হস্তিমূর্খ, চাসাহাট্টি, মহারাজচক্রবর্তী, আঙ্গুল ফুলিয়া কলাগাছ ইত্যাদি] পক্ষান্তরে ‘কাজ চেষ্টার কথা’-য় কেরি চরিত্রদুটির বয়স ও সামাজিক অবস্থান সম্পর্কে নির্দিষ্ট কোনো ইঙ্গিত দেননি, তবে তাদের সংলাপ থেকে বোঝায় যে তারা তখনো জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। সেদিক থেকে এরা বয়সে নবীন প্রজন্মের অন্তর্গত এবং বনেদি গ্রামীণ ‘ভদ্রলোক’ হওয়ার চেয়ে শহরবাসী নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণি বা ‘বাবু’ শ্রেণিভুক্ত হতে উৎসাহী। এজন্য এদের সংলাপে বিষয়ী লোকের উপযুক্ত ‘চলনবাংলা’-র লক্ষণ সুপরিস্ফুট এবং আরবি-পারসি শব্দ শব্দভান্ডারের সম্পদ বলে গৃহীত। তবে এখানে একটা বিষয় লক্ষণীয়, এই নবীন প্রজন্মের অংশীদারেরা যখন বিবাহ, শ্রাদ্ধ ইত্যাদি ঐতিহ্যগত অনুষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত হয়, তখন তাদের শব্দমন্ডলে তৎসম শব্দের উল্লেখযোগ্য প্রাধান্য এবং আরবি-পারসি শব্দের উল্লেখযোগ্য বিরলতা দেখা দেয় [দ্রষ্টব্য: ঘটকালিতে বরের পিতা, যাজক ও যজমান, যজমান যাজকের কথা]। ১৮২৩ সালে ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় ঠিক এই কথাই বলেছিলেন : ‘সন্ধ্যাপূজা ও দৈবকর্মে পিতৃকর্মে ওই সকল শব্দ [আরবি-পারসি] ব্যবহার করিলেই দোষ হইতে পারে।’

‘কথোপকথনে’-র পরবর্তী সংস্করণগুলিতে কিছু কিছু পরিবর্তন করা হয়েছে। এই পরিবর্তন যেখানে পদসংক্রান্ত [যেমন, ‘শিক্ষা করাইবা আমাকে’>আমাকে শিক্ষা করাইবা; ‘দুই এক বিঘা করিয়া থাকে গুড়ের কারণ’>‘দুই এক বিঘা গুড়ের কারণ করিয়া থাকে] সেখানে তা বইটির ব্যাকরণগত ত্রুটিমোচনে সাহায্য করেছে; কিন্তু যেখানে কথ্য, বিদেশি শব্দ বা তদ্ভব শব্দ ও শব্দরূপের বদলে তৎসম শব্দ আনা হয়েছে [যেমন, নিষ্পি ভুই রুপিয়াছি—আরবি ‘নিষ্পি’-র স্থানে তৎসম ‘অর্ধ’, কোম্পানির কায পাইয়া—‘কায’-এর বদলে ‘কার্য্য’, ‘বাতাসের কারণ’-এর বদলে ‘বাতাসপ্রযুক্ত’, ‘মনিবে মেহেরবানি করিয়া জেয়াদাও দিতেছেন’—‘মেহেরবানি’-র বদলে ‘অনুগ্রহ’] সেখানে সাধুভাষার ক্রমবর্ধমান প্রভাবেরই ছায়াপাত ঘটেছে। তবে এই প্রভাব সর্বাত্মক নয়, আংশিক ও প্রক্ষিপ্ত, ফলে এই বইয়ের মৌল ভাষাতাত্ত্বিক চরিত্রের কোনো পরিবর্তন হয়নি। সেই ভাষাতাত্ত্বিক চরিত্রটি মৌল ভাষাতাত্ত্বিক চরিত্রের কোনো পরিবর্তন হয়নি। সেই ভাষাতাত্ত্বিক চরিত্রটি হচ্ছে : আঠারো শতকের শেষদিকে শাস্ত্রব্যবসায়ী সংস্কৃতজ্ঞ ব্যক্তিদের বাংলায় লেখাপড়া করার জন্য যে সীমিত ভাষারূপ প্রচলিত ছিল, তার বাইরে সমাজের বৃহত্তর অংশের লোকসাধারণ দৈনন্দিন ব্যাবহারিক কাজকর্মের জন্য যে ভাষা ব্যবহার করত সেই লোকায়ত বা লোকায়ত্ত [popular] ভাষারূপটি এখানে বিধৃত হয়ে আছে। সাধুভাষার সংগঠিত আক্রমণে/সংক্রমণে এই ভাষারূপ অনেকদিন কোণঠাসা হয়ে ছিল, উনিশ শতকের শেষার্ধের গোড়ার দিকে প্যারীচাঁদ মিত্রর [১৮১৪-১৮৮৩] রচনায় শেষবারের মতো এই ভাষারীতির পুনরুজ্জীবন হয়। কিন্তু ততদিনে বাংলা গদ্যভাষার বিকাশধারায় অন্য সামাজিক শক্তির আবির্ভাব ঘটে গিয়েছে। কাজেই এই গদ্যের আনুপূর্বিক পুনর্বাসন আর সম্ভব হয়নি। কিন্তু তাই বলে এই বই জাদুঘরের সংরক্ষিত প্রদর্শশালায় কাচে ঘেরা নিরাপত্তা-বেষ্টনীতে সন্তর্পণে সাজিয়ে রাখার জিনিস নয়। সংস্কৃতির লোকায়ত উপকরণকে যেমন সমাজের পরিবর্তমান আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ব্যবহার করলে পরিবর্তিত সমাজেও তার কার্যকারিতা দেখা যায়, তেমনি ‘কথোপকথনে’-র পরিকল্পনার মধ্যেও যেসব সূক্ষ্ম ভাষাতাত্ত্বিক প্রবর্তনার সূচক নিহিত আছে, আধুনিক কালের ভাষাপরিকল্পনাতেও সেগুলিকে সফলভাবে কাজে লাগানো যেতে পারে।

__________________________________________________

প্রাসঙ্গিক টীকা :

১. ‘বিশিষ্ট লোকের সহিত আলাপ; হুকুম দেওয়ান আর অন্য লোককে; ধান্যতন্ডুল ওগয়রহো বেবসার উপর; জমি খরিদের; এমারতির; ঘোড়া খরিদের; আদালত ঘরে যাওনের; পিড়িতের।’

২. Bengali Literature in the 19th Century : Sushilkumar De, 2nd ed., 1962, p. 133.

৩. বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস, ২য় খন্ড—সুকুমার সেন, ৫ম সংস্করণ ১৩৭০, পৃ. ১৪।

৪. পুরাতন বাংলা গদ্যগ্রন্থ সংকলন ১ম খন্ড—অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, ১৯৭৮, ভূমিকা, পৃ. ঘ-ঙ।

৫. দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থমালা ১৩নং—সজনীকান্ত দাস সম্পাদিত, ১৩৪৯; ভূমিকা।

৬. Society for the Propagation of the Gospel-কে লেখা কেরির ১৭ অক্টোবর ১৭৯৩ তারিখের চিঠিতে এই ঝড়ের বিশদ বিবরণ আছে। ঝড় উঠেছিল ২৫ আগস্ট ১৭৯৩ রাত্রি দেড়টা নাগাদ।

৭. মূলে ছেদচিহ্ন নেই, দ্রুত অর্থবোধের জন্য ইংরেজি রূপান্তর অনুসরণে [ ] বন্ধনীর মধ্যে ছেদচিহ্ন বসানো হল।

৮. William Carey – S. P. Carey, 2nd ed. November 1923. p. 163.

৯. ৪নং পাদটীকায় উল্লিখিত বই, ভূমিকা, পৃ. ছ-ঞ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *