কেয়ারগিভার

‘কেয়ারগিভার’ শব্দটির বাংলা—যে সেবা দান করে। স্লোয়ান-কেটারিংয়ে চিকিৎসা নিতে এসে কেয়ারগিভার শব্দের অর্থ নতুন করে জানলাম। হাসপাতালের কাছে রোগী যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তার কেয়ারগিভার সে রকমই গুরুত্বপূর্ণ। কেয়ারগিভারের নাম হাসপাতালে তালিকাভুক্ত করা হলো—মেহের আফরোজ শাওন। রোগীর স্ত্রী। চিকিৎসকেরা কেয়ারগিভার ছাড়া আর কারও সঙ্গেই রোগ নিয়ে বা চিকিৎসা নিয়ে কোনো কথা বলবেন না।
রোগীর রক্ত নেওয়া হচ্ছে বা কেমোথেরাপি দেওয়া হচ্ছে, তখনো শুধু কেয়ারগিভারের উপস্থিতি থাকবে। আর কেউ থাকবে না।
কেমো দেওয়ার পদ্ধতিটাও সুন্দর। প্রথম একজন নার্স প্যাকেট ভর্তি করে কয়েক ব্যাগ ওষুধ নিয়ে আসবে। কেয়ারগিভার ও রোগীকে প্রতিটি ওষুধের নাম বলবে। তারপর সে বিদায় নেবে। আসবে দ্বিতীয় নার্স। সেও একই কাজ করবে। প্রতিটি ওষুধের নাম বলবে। ডাবল চেকিং। যাতে কখনো কোনো ভুল না হয়। ঠিক রোগীকে ঠিক কেমো দেওয়া হচ্ছে কি না, নাকি ভুল অন্য কাউকে দেওয়া হচ্ছে, তার পরীক্ষাও আছে। দুজন নার্সই আলাদা আলাদাভাবে জিজ্ঞেস করবে—
তোমার নামের শেষ অংশ কী?
আহমেদ।
প্রথম অংশ কী?
হুমায়ূন।
জন্মতারিখ বলো।
জন্মতারিখ বলতে গিয়ে সমস্যা হয়ে যাচ্ছে। ১৩ নভেম্বর আমার জন্ম, পাসপোর্টে লেখা এপ্রিলের ১০ তারিখ। হাসপাতালে পাসপোর্টের জন্মতারিখ লেখা হয়ে আছে। কাজেই যতবার আসল জন্মদিন বলেছি, হইচই শুরু হয়েছে। এই রোগী কি সেই রোগী, নাকি অন্য কেউ? পাত্তা লাগাও, পাত্তা লাগাও। তাড়াতাড়ি করো।
রোগীর সেবা ছাড়াও কেয়ারগিভারকে আরও কিছু ঝামেলার ভেতর দিয়ে যেতে হয়। ক্যানসারে আক্রান্তদের অনেক ধরনের সমিতি আছে। তাদের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলতে হয়। তাদের সামলাতে হয়। বেশির ভাগ সমিতিই হলো রোগীর ডিপ্রেশন কাটানোবিষয়ক।
একটি সমিতি দেখলাম, বেঁচে থাকার অর্থ এবং আনন্দ বোঝানোর সমিতি। এক ঘণ্টা বাড়তি বেঁচে থাকাও বিশাল ব্যাপার, এ জাতীয় বিষয়। এর সঙ্গে আছে প্রেয়ার গ্রুপ অর্থাৎ দোয়া পার্টি বা স্পিরিচুয়াল কাউন্সেলিং। সব ধর্মের রোগীদের জন্যই দোয়ার ব্যবস্থা আছে।
আমার কেয়ারগিভার সব ঝামেলা হাসিমুখে সহ্য করে আমার সঙ্গেও সার্বক্ষণিক হাস্যমুখী থাকার চেষ্টা করে। মনে হয়, তাকে হাসপাতাল হাসি হাসি মুখে রোগীর সঙ্গে থাকতে বলে দেওয়া হয়েছে।
একদিন লক্ষ করলাম, সে ঝিম ধরে কম্পিউটারের ফেসবুকের পাতার দিকে তাকিয়ে আছে। তার চোখের পাতায় অশ্রুবিন্দু।
আমি বললাম, সমস্যা কী?
কেয়ারগিভার বলল, কোনো সমস্যা না। সামান্য মন খারাপ। কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছি।
আমি বললাম, আমাকে বলো, দেখি, মন খারাপ কাটানোর চেষ্টা করতে পারি কি না।
তোমাকে বলব না। তোমার মন খারাপ হবে।
আমি বললাম, সহজে মন খারাপ হবে, এমন মানুষ আমি না। বুঝতে পারছি, ফেসবুকে পাঠানো কারও কমেন্ট পড়ে তুমি আপসেট হয়েছ। কী লিখেছে?
শাওন পড়ে শোনাল। কেউ একজন লিখেছে, তোমার উচিত শিক্ষা হয়েছে। আমি খুশি যে তোমার স্বামীকে ক্যানসার দিয়ে আল্লাহ তোমাকে শিক্ষা দিলেন। এই শিক্ষা তোমার আরও আগেই হওয়া উচিত ছিল।
শাওনের মেয়ে লীলাবতী যখন মারা গেল, তখনো সে এ ধরনের চিঠিপত্র পেত। লেখা থাকত, তোমার কঠিন শাস্তি হওয়ায় আমরা খুশি। আরও শাস্তি হবে। এই ধরনের কথা।
আমি শাওনকে বললাম, পৃথিবীতে মানসিক অসুস্থ অনেক মানুষ। তাদের নিয়ে চিন্তার কিছু নেই। আমরা ভাবব সুস্থ মানুষদের কথা। তোমার ফেসবুকে শত শত মানুষ কত চমৎকার সব কথা লিখছে। লিখছে না?
হ্যাঁ।
এর মধ্যে একজনের কথা চিন্তা করো। সে চলে গেছে মক্কায়, কাবা শরিফে। সেখান থেকে তোমাকে জানিয়েছে, আমি স্যারের জন্য দোয়া করতে এসেছি। শাওন আপু, আপনি একটুও চিন্তা করবেন না। এর পরও কি মন খারাপ করা তোমার উচিত?
শাওন বলল, না, উচিত না।
তাহলে মিষ্টি করে একটু হাসো।
হাসতে পারব না।
বলেও সে হাসল।
আমাদের আশপাশে বিকৃত মানসিকতার মানুষের সংখ্যা কি বাড়ছে? মনে হয় বাড়ছে। একজনের কথা বলি, সে আমার সঙ্গে দেখা করার জন্য হাস্যকর কাণ্ডকারখানা শুরু করল। একটা পর্যায়ে গেটের সামনে স্ট্রাইক করার মতো অবস্থা। মহা বিরক্ত হয়ে তাকে আসতে বললাম। ২৩-২৪ বছরের যুবক। কঠিন চোখমুখ। আমি বললাম, এখন বলো, আমার সঙ্গে কথা বলার জন্য এত ব্যস্ত হয়েছ কেন? বিশেষ কিছু কি বলতে চাও?
চাই।
তাহলে বলে ফেলো।
আপনার লেখা আমার জঘন্য লাগে।
এই কথাটা বলার জন্য এত ঝামেলা করেছ?
হ্যাঁ! কারণ সরাসরি এই কথা আপনাকে বলার কারোর সাহস নাই। সবাই আপনার চামচা।
আমি বললাম, আরও কিছু কি বলবে?
হ্যাঁ।
বলে ফেলো।
সে ইংরেজিতে বলল, আই ওয়ান্ট ইউ টু ডাই সুন।
আমি কিছুক্ষণ অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে থেকে বললাম (ইংরেজিতে), আই হোপ অ্যান্ড প্রে ইউ হ্যাভ আ লং অ্যান্ড মিনিংফুল লাইফ।

হুমায়ূন আহমেদ, নিউইয়র্ক থেকে
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, নভেম্বর ০৫, ২০১১

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *