কেমব্রিজে

কেমব্রিজে*

আমি ভারতবর্ষ ত্যাগ করার আগেই অমৃতসরে জালিয়ানওয়ালাবাগের বিরাট হত্যাকাণ্ড ঘটে গেছে। কিন্তু পাঞ্জাবের বাইরে তার কোনও সংবাদই প্রায় পৌঁছয়নি। পাঞ্জাবে সামরিক আইন জারি হইয়াছিল এবং ওই প্রদেশ থেকে পাঠানো সব সংবাদের উপর সেন্‌সরের কড়া ব্যবস্থা ছিল। কাজেই লাহোরে ও অমৃতসরে ভয়ানক কিছু ঘটেছে এরকম ভাসা ভাসা গুজবই কেবল আমরা শুনেছিলাম। আমার একজন ভাই তখন সিমলায় কাজ করছিলেন; তিনি পাঞ্জাবের ঘটনাবলী এবং ইংরাজ-আফগানের যুদ্ধে যে আফগানরা ব্রিটিশদের পরাস্ত করেছিল ওই সম্বন্ধেও কিছু খবর—বরং গুজবই বলা যায়—নিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু জনসাধারণ উত্তর-পশ্চিমে কি ঘটছিল সে বিষয়ে কোনও খবরই জানত না, এবং আমি একটা আত্মতুষ্টির ভাব নিয়েই ইউরোপের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলাম।

জাহাজে বেশ কিছু সংখ্যক ভারতীয় যাত্রী ছিল—অধিকাংশই ছাত্র। সেজন্য আমরা পৃথক একটি খাবার টেবিল নেওয়া সঙ্গত মনে করলাম যেখানে আমরা অনেক স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করব। আমাদের টেবিল পরিচালনা করতেন একজন বয়স্কা ও শ্রদ্ধেয়া মহিলা, এক ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভেন্টের বিধবা পত্নী। যাত্রীদের অধিকাংশই ছিল ব্রিটিশ—রোদে পোড়া তামাটে রঙ ও উন্নাসিক প্রকৃতির। তাদের সঙ্গে মেলামেশা প্রায় অসম্ভব ছিল—সেজন্য আমরা ভারতীয়রা বেশির ভাগ নিজেদের নিয়েই থাকতাম। মধ্যে মধ্যে কোন না কোন ব্যাপারে ভারতীয় যাত্রীর সঙ্গে কোনও ব্রিটিশের সংঘর্ষ ঘটত; এবং যদিও আমাদের ইংলন্ড পৌঁছানো পর্যন্ত খুব গুরুতর কিছু ঘটেনি তবু ভারতীয়দের প্রতি ব্রিটিশের গর্বোদ্ধত মনোভাবে আমরা সকলে ক্ষুব্ধ হয়েছিলাম। এই সমুদ্রযাত্রাকালে কৌতূহলোদ্দীপক একটা আবিষ্কার আমি করেছিলাম—ভারতের বাইরে গেলেই অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের ভারত ও ভারতবাসীদের প্রতি ভালবাসা বেড়ে ওঠে। জাহাজে কয়েকজন অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান যাত্রী ছিল। যতই আমরা ইউরোপের নিকটবর্তী হচ্ছিলাম, ততই তাদের বাড়ির জন্য—অর্থাৎ ভারতের জন্য—‘মন কেমন’ করছিল। ইংলন্ডে অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানরা নিজেদের ইংরাজ বলে চালাতে পারে না। তা ছাড়া—সেখানে তাদের কোনও আশ্রয়, সমাজ বা আত্মীয়-বন্ধু নেই। অতএব এটা অবশ্যম্ভাবী যে ভারতবর্ষ থেকে তারা যতই দূরে যাবে, ততই তারা নিবিড়তরভাবে তার প্রতি আকৃষ্ট হবে।

‘সিটি অব ক্যালকাটা’ অপেক্ষা মন্থরতর জাহাজ হতে পারে বলে আমার মনে হয় না। ৩০ দিনে তার Tilbury পৌঁছবার কথা ছিল, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এক সপ্তাহ বেশী লেগে গেল। কারণ, ইংলন্ডে কয়লা-শ্রমিকদের ধর্মঘটের দরুন কয়লা না পাওয়ায় জাহাজ সুয়েজে আটকে পড়েছিল। আমাদের একমাত্র সান্ত্বনা ছিল এই যে পথে আমরা অনেক বন্দরে ভিড়েছিলাম। জাহাজে পাঁচ সপ্তাহের মেয়াদটিকে কিছুটা সহনীয় করবার জন্য আমাদের জীবনে বৈচিত্রের স্বাদস্বরূপ ঠাট্টা পরিহাসের আশ্রয় নিতে হয়েছিল। এক সহযাত্রী স্ত্রীর নির্দেশে গো-মাংস স্পর্শ করত না। আর একজন যাত্রী তাকে ঠকিয়ে গো-মাংসের ‘কোপ্তা কারী’ খাইয়েছিল—ভেড়ার মাংসের ‘কোপ্তা কারী’ মনে করে সেটি সে খুব উপভোগ করেছিল। বারো ঘণ্টা বাদে ভুল বুঝতে পেরে তার কি অনুশোচনা! আর একজন যাত্রীকে তার বাগ্‌দত্তা প্রতিদিন একটি করে চিঠি লিখতে বলে দিয়েছিল। সারাক্ষণ প্রেমের কবিতা আবৃত্তি করে ও তার সম্বন্ধে গল্প করে সে কাটাত। ভাল লাগুক আর না লাগুক, আমাদের শুনতেই হত। বারবার পীড়াপীড়ি করার ফলে একদিন যখন আমি মন্তব্য করলাম যে তার বাগ্‌দত্তার মুখাবয়বে গ্রিক বৈশিষ্ট্য আছে তখন সে আনন্দে আত্মহারা হয়ে গিয়েছিল।

দীর্ঘতম প্রতীক্ষার অবসান আছে; তাই শেষ পর্যন্ত আমরা Tilbury পৌঁছলাম। সেদিনটা ছিল স্যাঁতস্যাঁতে ও মেঘাচ্ছন্ন—লন্ডনের আবহাওয়ার যা বৈশিষ্ট্য। তবে প্রকৃতির কথা মন থেকে মুছে দেবার মতো যথেষ্ট উত্তেজনা আমাদের মধ্যে ছিল। প্রথম যখন ভূগর্ভ রেলস্টেশনে নেমে গেলাম তখন তার নূতনত্ব আমি বিশেষ উপভোগ করেছিলাম।

পরদিন সকালে খোঁজখবর করতে বেরিয়ে পড়লাম। ক্রমওয়েল রোডে ভারতীয় ছাত্রদের উপদেষ্টার অফিসে গেলাম। তিনি আমার সঙ্গে খুব সুন্দর ব্যবহার করলেন, অনেক উপদেশ দিলেন, কিন্তু শেষে বললেন যে কেমব্রিজে ভর্তির ব্যাপারে কিছু করার নেই। ভাগ্যক্রমে, সেখানে আমার সঙ্গে কেমব্রিজের কয়েকজন ভারতীয় ছাত্রের দেখা হয়ে গেল। তাদের একজন আমাকে দৃঢ়ভাবে পরামর্শ দিল, ক্রমওয়েল রোডে সময় নষ্ট না করে সোজা কেমব্রিজে গিয়ে সেখানে আমার ভাগ্য পরীক্ষা করে দেখতে। আমি রাজি হলাম, এবং পরদিন কেমব্রিজে উপস্থিত হলাম। উড়িষ্যা থেকে আগত কয়েকজন ছাত্র, যাদের আগে আমি সামান্য চিনতাম, আমাকে সাহায্য করল। তাদের একজন ছিল Fitzwilliam Hall-এর; সে আমাকে সেন্সর মিঃ রেডাওয়ের কাছে নিয়ে গিয়ে তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিল। মিঃ রেড়াওয়ে অতিশয় সদয় ও সহানুভূতিপূর্ণ ব্যবহার করলেন, ধৈর্য ধরে আমার কথা শুনলেন, এবং এই বলে তাঁর বক্তব্য শেষ করলেন যে অবিলম্বে তিনি আমাকে ভর্তি করে নেবেন। ভর্তির সমস্যা মিটল, কিন্তু তারপর প্রশ্ন দেখা দিল চলতি টার্ম নিয়ে যা দুই সপ্তাহ আগেই শুরু হয়ে গেছে। যদি আমার ওই টার্মটি নষ্ট হয় তাহলে সম্ভবত আমার ডিগ্রি লাভের যোগ্যতা অর্জনের জন্য আরও প্রায় এক বছর সময় লেগে যাবে; তা না হলে ১৯২১ সালের জুনের মধ্যে আমি ডিগ্রি লাভ করব। এই প্রশ্নেও মিঃ রেডাওয়ে আমার আশার অতিরিক্ত সুযোগের ব্যবস্থা করে দিলেন। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যাতে আমার অনুকূলে রায় দেন সেজন্য তিনি কয়লা-শ্রমিকদের ধর্মঘট ও সৈন্যবাহিনীতে আমার অংশগ্রহণের কথা উল্লেখ করলেন। তিনি কৃতকার্য হলেন, ফলে ওই টার্মটি আমার নষ্ট হল না। মিঃ রেডাওয়ে না থাকলে ইংলন্ডে আমার কি হত জানি না।

২৫শে অক্টোবর নাগাদ আমি লন্ডনে পৌঁছেছিলাম এবং কেমব্রিজে গুছিয়ে বসে কাজকর্ম শুরু করতে নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহ হয়ে গেল। আমাকে অস্বাভাবিক রকম বেশী লেকচারে উপস্থিত থাকতে হত—ওইগুলির কিছু ছিল Mental ও Moral Sciences Tripos-এর জন্য আর বাকি সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার জন্য। লেকচারের সময় ছাড়া আমাকে যতদূর সম্ভব পরিশ্রম করে পড়াশুনা করতে হত। এই কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে যা পেতাম তা ছাড়া আর কোনও আমোদর প্রশ্ন আমার কাছে ছিল না। সিভিল সার্ভিসের পুরাতন নিয়মাবলী অনুসারে আমাকে পরীক্ষা দিতে হয়েছিল বলে আমাকে আট-নয়টি বিভিন্ন বিষয় নিতে হয়েছিল; এর মধ্যে কয়েকটি ছিল আমার কাছে নতুন। আমার বিষয়গুলি ছিল—ইংরাজি রচনা, সংস্কৃত, দর্শন, ইংরাজি আইন, রাজনীতি-বিজ্ঞান, আধুনিক ইউরোপীয় ইতিহাস, ইংলন্ডের ইতিহাস, অর্থনীতি, ভূগোল। এই বিষয়গুলির অধ্যয়ন ছাড়াও, ভূগোলপত্রের জন্য আমাকে সমীক্ষা ও মানচিত্র-অঙ্কন করতে হয়েছিল (ইংরাজিতে যাকে Cartography বলে) এবং আধুনিক ইতিহাসের পত্রের জন্য কিছু কিছু ফরাসি শিখতে হয়েছিল।

Mental ও Moral Sciences Tripos-এর কাজ বেশী আকর্ষণীয় ছিল কিন্তু লেকচারগুলিতে উপস্থিত থাকা ছাড়া বেশী সময় তার জন্য দিতে পারতাম না। আমার লেকচারারদের মধ্যে ছিলেন অধ্যাপক সোরলি (নীতিশাস্ত্র), অধ্যাপক মায়ার্স (মনস্তত্ত্ব) ও অধ্যাপক ম্যাক্‌টেগার্ট (অধিবিদ্যা)। প্রথম তিনটি টার্মে কার্যত সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্যই আমার সমস্ত সময় ব্যয় করেছিলাম। অবসর-বিনোদনের জন্য ভারতীয় মজলিশ ও ইউনিয়ন সোসাইটির সভাগুলিতে যোগদান করতাম।

যুদ্ধের পর কেমব্রিজ রক্ষণশীল হয়ে উঠেছিল। অক্সফোর্ড অনেকটা সেরকমই ছিল, তবে উদারপন্থী হতে শুরু করেছিল। একটি বিষয় থেকেই প্রচলিত আবহাওয়া সম্বন্ধে ধারণা করা যেতে পারে: শান্তিবাদী, সমাজবাদী, নীতিগতভাবে যুদ্ধবিরোধী, ও ওই ধরনের মতাবলম্বীরা কেমব্রিজে প্রকাশ্য জনসভায় সহজে বক্তৃতা করতে পারতেন না। অ-স্নাতক ছাত্রেরা সাধারণত এসে ওই সব সভা ভেঙে দিত এবং বক্তার প্রতি ময়দার ঠোঙা নিক্ষেপ করে বা তাকে নদীতে চুবিয়ে অতিষ্ঠ করে তুলত। এই ‘র‍্যাগিং’ অবশ্য সেখানকার অ-স্নাতকদের একটা বৈধ আমোদ ছিল এবং আন্তরিকতার সঙ্গে আমি তা অনুমোদন করতাম। কিন্তু বক্তা ভিন্ন-মতাবলম্বী শুধু সেই কারণেই সভা ভেঙে দেওয়া আমার ভাল লাগত না।

আমার মতো একজন বহিরাগতের মনে যা বিশেষভাবে দাগ কেটেছিল তা হল ছাত্রদের যে পরিমাণ স্বাধীনতা দেওয়া হত, এবং সাধারণভাবে যে শ্রদ্ধার চোখে সকলে তাদের দেখত। তাদের চরিত্রের উপর নিঃসন্দেহে এর খুব ভাল প্রভাব পড়েছিল। আমার মনে হত, কলকাতার মতো পুলিশে ভরা শহর, যেখানে প্রত্যেকটি ছাত্রকে এক একজন সম্ভাব্য বিপ্লবী ও সন্দেহভাজন ব্যক্তিরূপে গণ্য করা হত, তার সঙ্গে এখানকার কত পার্থক্য! আর কেমব্রিজের আবহাওয়ায় বাস করে কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজের ঘটনাবলী—ছাত্রদের প্রতি অধ্যাপকদের দুর্ব্যবহার—কল্পনা করাও কঠিন ছিল; কারণ এখানে অধ্যাপকদের প্রতিই ছাত্রদের দুর্ব্যবহার করার সম্ভাবনা ছিল। বাস্তবিক পক্ষে, যে সমস্ত অধ্যাপককে অপছন্দ করা হত, অ-স্নাতকরা কখনও কখনও তাঁদের ঘরে চড়াও হয়ে তাঁদের ‘র‍্যাগ’ করত; অবশ্য বন্ধুত্বপূর্ণভাবে এরকম করা কত; কারণ কোনও ক্ষতি হলে পরে তাঁদের ক্ষতিপূরণ করা হত। এমন কি কেমব্রিজের রাস্তায় রাস্তায় যখন এই ধরনের গণ্ডগোল চলত এবং সরকারি সম্পত্তির ক্ষতি হত, পুলিশ তখনও আশ্চর্য সংযমের সঙ্গে ব্যবহার করত, ভারতবর্ষে যা একেবারে অসম্ভব।

ব্রিটিশ ছাত্ররা স্বাধীন আবহাওয়ায় জন্মেছে ও গড়ে উঠেছে, তাই স্বভাবতই ছাত্রদের এই স্বাধীনতাবোধ তাদের চেয়ে আমাকেই বেশী আকর্ষণ করত; এ কথা ছেড়ে দিলেও, যে খাতির ও শ্রদ্ধার সঙ্গে সর্বত্র তাদের প্রতি আচরণ করা হত তা দেখে খুবই আশ্চর্য হতে হত। সম্পূর্ণ নবাগতেরও তৎক্ষণাৎ এই ধারণা হত যে উচ্চমানের চরিত্র ও আচরণ তার কাছে আশা করা হবে; এবং এর প্রতিক্রিয়া অবশ্যই অনুকূল হত। কেবল কেমব্রিজেই যে অ-স্নাতকদের এরকম খাতির করা হত তা নয়, সারা দেশ জুড়েই কম-বেশী এর প্রচলন ছিল। রেলগাড়িতে কারও প্রশ্নের উত্তরে যদি কেউ বলত যে সে কেমব্রিজের বা (অক্সফোর্ড) ছাত্র, তাহলে সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্নকর্তার মনোভাবের পরিবর্তন ঘটত। সে বন্ধুভাবাপন্ন—কিংবা হয়তো বলতে পারি, আরও শ্রদ্ধাশীল হয়ে উঠত। এটা আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা। কেমব্রিজ বা অক্সফোর্ডে যারা যায় তাদের মধ্যে যদি উন্নাসিকতার কোনও লক্ষণ দেখা যায় তা নিশ্চয়ই আমি সমর্থন করি না। তবে পুলিশী নির্যাতনের একটা আবহাওয়ায় মানুষ হওয়ার দরুন আমার দৃঢ় ধারণা জন্মেছে যে ছাত্র ও তরুণদের দায়িত্বসম্পন্ন নাগরিক হিসেবে মেনে নিয়ে তাদের অধিকতর স্বাধীনতা দান এবং সমীহ করে চলার পক্ষে অনেক কথা বলার আছে।

কলকাতায় যখন কলেজের ছাত্র ছিলাম তখনকার একটি ঘটনা আমার স্মরণ আছে। নতুন নতুন বই কেনার তখন আমার ভীষণ শখ ছিল। দোকানের শো-কেসে কোনও বইয়ের উপর যদি আমার ঝোঁক পড়ত তাহলে সেটি না পাওয়া পর্যন্ত স্থির থাকতে পারতাম না। বইটি যতক্ষণ না পাচ্ছি ততক্ষণ এত অস্বস্তি বোধ করতাম যে বাড়ি ফিরবার আগেই সেটি আমায় কিনতে হত। একদিন কলেজ স্ট্রিটের বড় বড় দোকানগুলির একটিতে গিয়ে দর্শনের একটি বই চাইলাম যেটি পড়ার জন্য তখন আমি খুবই ব্যগ্র হয়ে উঠেছিলাম। দাম বলা হলে দেখলাম যে কয়েক টাকা আমার কম পড়ছে। আমি ম্যানেজারকে বইটি আমাকে দেবার জন্য অনুরোধ করলাম এবং পরদিন বাকি টাকাটা এনে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলাম। তিনি উত্তর দিলেন যে তা সম্ভব নয়, আমাকে পুরো দামটাই তৎক্ষণাৎ দিয়ে দিতে হবে। বইটি না পেয়ে কেবল যে নিরাশ হয়েছিলাম তাই নয়, আমাকে এরকম অবিশ্বাস করা হয়েছিল বলে অত্যন্ত আঘাত পেয়েছিলাম। সুতরাং যখন দেখলাম কেমব্রিজে যে কোনও দোকানে ঢুকে পছন্দমতো যে কোনও জিনিসের অর্ডার দেওয়া যায় ও সঙ্গে সঙ্গে দাম দেবার জন্য বিব্রত হতে হয় না তখন সত্যিই স্বস্তিবোধ করেছিলাম।

আর একটি ব্যাপার আমাকে মুগ্ধ করেছিল—তা হল ইউনিয়ন সোসাইটির বিতর্কসভাগুলি। সমস্ত পরিবেশই ছিল অতীব আনন্দদায়ক। যা খুশি বলবার বা যাকে ইচ্ছা আক্রমণ করার পূর্ণ স্বাধীনতা ছিল। পার্লামেন্টের বিশিষ্ট সদস্যগণ ও কখনও কখনও মন্ত্রিসভার সদস্যগণ পূর্ণ সমতার ভিত্তিতে এই সব বিতর্কে অংশগ্রহণ করতেন এবং অবশ্যই কঠোর সমালোচনার ও কখনও কখনও কটাক্ষের সম্মুখীন হতেন। পার্লামেন্ট সদস্য হোরেশিও বটমলী (Horatio Bottomley) একবার একটি বিতর্কে অংশগ্রহন করেছিলেন। বিরোধী পক্ষীয় একজন বক্তা তাঁকে সাবধান করে বলেছিলেন—“There are more things in heaven and earth Horatio than your John Bull dreams of.”

ছোটখাটো চমকপ্রদ রসিকতা সভার কার্যধারাকে প্রাণবন্ত করে তুলত। আয়ারল্যান্ড সম্বন্ধে এক বিতর্ক চলার সময়ে একজন আইরিশপন্থী বক্তা গভর্নমেন্টের স্বরূপ উদঘাটিত করতে গিয়ে বলেছিলেন—“the forces of law and order on one side and Bonar Law and disorder on the other”.

এই সব বিতর্কসভায় অতিথিদের মধ্যে পার্লামেন্টের বিতর্কে দক্ষ ও সুপরিচিত ব্যক্তিগণ ছাড়াও এমন আরও অনেকে ছিলেন যাঁদের তখন সবেমাত্র রাজনৈতিক জীবন শুরু হয়েছে। দৃষ্টান্তস্বরূপ, স্মরণ আছে যে ডাঃ হিউ ডালটন প্রায়ই এই সব বিতর্কে উপস্থিত থাকতেন। তিনি ছিলেন পার্লামেন্টের ভাবী সদস্য; সেই সময়ে কোনও এক নির্বাচন কেন্দ্রে কাজ করছিলেন। ভারতবর্ষ সম্বন্ধে একটি বিতর্কে অংশগ্রহণ করেছিলেন স্যার অসওয়াল্ড মোসলে; তিনি তখন বামপন্থী, উদারনৈতিক (বা শ্রমিক দলের সদস্য) ছিলেন। ডায়ার এবং ও’ডায়ারের নীতিকে তিনি তীব্রভাবে নিন্দা করেছিলেন, এবং ১৯১৯ সালে অমৃতসরের ঘটনাবলী জাতিবিদ্বেষেরই প্রকাশ, এই মন্তব্য করে ব্রিটিশ মহলে ঝড় তুলেছিলেন। স্যার জন সাইমন ও মিঃ ক্লাইনস একবার গিল্ডহলে কেমব্রিজবাসীদের কাছে খনি-শ্রমিকদের পক্ষ থেকে বলতে এসেছিলেন। তাঁদের বাধা দেবার জন্য অ-স্নাতকেরা এসে উপস্থিত হল। স্যার জন সাইমনকে চারদিক থেকে আক্রমণ করা হয়েছিল, কিন্তু মিঃ ক্লাইনস (তিনি নিজেও বোধহয় একজন খনি-শ্রমিক ছিলেন) উঠে দাঁড়িয়ে এমন আন্তরিকতা ও আবেগের সঙ্গে বললেন যে যারা বিদ্রূপ করতে এসেছিল তারা প্রশংসায় মুখর হয়ে উঠল।

কেমব্রিজে যে ছয়টি টার্ম কাটিয়েছিলাম ওই সময়ের মধ্যে ব্রিটিশ ও ভারতীয় ছাত্রদের সম্পর্ক মোটের ওপর সৌহার্দ্যপূর্ণ ছিল, কিন্তু খুব কম ক্ষেত্রেই তা প্রকৃত বন্ধুত্বে পরিণত হয়েছিল। শুধু আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে নয়, সাধারণভাবে যা দেখেছি তা থেকেই একথা বলছি। অনেকগুলি কারণ এর জন্য দায়ী। যুদ্ধের প্রতিক্রিয়া ত ছিলই এতে সন্দেহ নেই; সাধারণ ব্রিটিশদের মধ্যে অমায়িকতার বাহ্যিক আবরণের আড়ালে একটা শ্রেষ্ঠতবোধ লক্ষ্য করা যেত যা অন্যান্যদের পছন্দ হত না। আমাদের দিক থেকে, যুদ্ধোত্তর ভারতবর্ষে যে সব ঘটনা ঘটেছিল এবং বিশেষত অমৃতসরের শোচনীয় ঘটনার পর আমাদের আত্মসম্মান ও জাতির মর্যাদার ব্যাপারে আমরা স্পর্শকাতর (বোধহয় অতিমাত্রায়) না হয়ে পারিনি। আমাদের দেখে দুঃখ হত যে মধ্যবিত্ত ইংরেজদের মধ্যে জেনারেল ডায়ারের প্রতি যথেষ্ট সহানুভূতি ছিল। সাধারণভাবে বলা যায় যে ব্রিটিশ ও ভারতীয়দের মধ্যে বন্ধুত্বের কোনও ভিত্তি বোধহয় ছিল না। রাজনীতির দিকে থেকে আগের চেয়ে আমরা আরও সচেতন ও অধিকতর স্পর্শকাতর হয়ে উঠেছিলাম। কাজেই, কোনও ভারতীয়ের সঙ্গে বন্ধুত্বের মূল্য ছিল তার রাজনৈতিক মতামতের প্রতি সহানুভূতি, কিংবা অন্তত সহনশীলতা, যা সব সময়ে পাওয়া যেত না। রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে কেবল শ্রমিক দলই ভারতীয় আশা-আকাঙক্ষার প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন করত। সেজন্য শ্রমিক-দলের সদস্যগণ বা সেই সব ব্যক্তি যাদের মত ও ভাবধারা শ্রমিক-দলপন্থী ছিল, তাদের সঙ্গে সৌহার্দ্যের অধিকতর সম্ভাবনা ছিল।

উপরের মন্তব্যগুলি সাধারণভাবে প্রযোজ্য, তার ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে। আমার নিজের, ছাত্র এবং অন্যান্য বহু লোকের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়েছিল, ব্রিটিশ রাজনীতি সম্বন্ধে যাদের মতামত ছিল রক্ষণশীল এবং আমার জীবনের ভিন্ন গতি সত্ত্বেও আজ পর্যন্ত তা অক্ষুন্ন আছে। আমার মতামতের প্রতি তাঁরা যথেষ্ট সহনশীল ছিলেন বলেই এটি সম্ভব হয়েছিল। গত দশকে এবং বিশেষত গত পাঁচ বছর ধরে গ্রেট ব্রিটেনের বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় জ্ঞানের ক্ষেত্রে একপ্রকার বৈপ্লবিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে চলেছে; এবং আমার ধারণা কেমব্রিজ, অক্সফোর্ড, লন্ডন ও অন্যান্য স্থানগুলিতে এর প্রভাব পড়েছে। সুতরাং ১৯১৯ ও ১৯২০ সালের অভিজ্ঞতার সঙ্গে আজকের অভিজ্ঞতা নাও মিলতে পারে।

যুদ্ধের অব্যবহিত পরে যেরকম দেখেছি তাতে ব্রিটিশ মনোবৃত্তি সম্পর্কে আমার ধারণা যে ভুল হয়নি, দুই একটি ঘটনা থেকে তা দেখানো যেতে পারে। সাধারণত দাবি করা হয় যে সাধারণ ইংরাজের মধ্যে একটা ন্যায়বিচারবোধ, খেলোয়াড়সুলভ একটা মনোভাব আছে। আমি যখন কেমব্রিজে তখন আমরা ভারতীয়রা এর আরও প্রমাণ পেয়েছিলাম। সে বছর টেনিস চ্যাম্পিয়ান হয়েছিল সুন্দর দাস নামে এক ভারতীয় ছাত্র—সুতরাং সে ব্লু পেয়েছিল। আমরা আশা করেছিলাম আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় প্রতিযোগিতায় টিমের অধিনায়কত্ব করার জন্য তাকেই বলা হবে। কিন্তু ওই আশাকে ব্যর্থ করার জন্য একজন পুরানো ব্লু-কে, যাকে ইতিপূর্বেই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিদায় দেওয়া হয়েছিল, ডেকে পাঠানো হল এবং আর এক বছরের জন্য তাকে থেকে যেতে বলা হল। কাগজপত্রে সব কিছু ঠিক ছিল। টিমের অধিনায়কত্ব করার ব্যাপারে সিনিয়র ব্লু-র দাবিই প্রথমে গ্রাহ্য, কিন্তু পর্দার অন্তরালে কি ঘটে গেছে তা প্রত্যেকেই জানত এবং ভারতীয় ছাত্রমহলে নীরব ক্ষোভ জমে উঠেছিল।

আর একটি দৃষ্টান্ত। একদিন আমরা নোটিশে দেখলাম যে ইউনিভার্সিটি অফিসার্স ট্রেনিং কোর-এ ভর্তির জন্য অ-স্নাতকদের কাছে দরখাস্ত আহ্বান করা হয়েছে। আমাদের মধ্যে কেউ কেউ অগ্রণী হয়ে দরখাস্ত করল। আমাদের বলা হল যে প্রশ্নটি উচ্চতর কর্তৃপক্ষের কাছে বিবেচনার জন্য পাঠাতে হবে। কিছুকাল পরে উত্তর এল যে, ও টি সি-তে আমাদের ভর্তির ব্যাপারে ইন্ডিয়া অফিস আপত্তি জানিয়েছে। বিষয়টি ভারতীয় মজলিশের সামনে আনা হল এবং স্থির হল এ বিষয়ে ভারত-সচিবের সঙ্গে আলোচনা করা হবে, আর প্রয়োজন হলে Mr. K. L. Gauba ও আমাকে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাত করার অধিকার দেওয়া হল। তদানীন্তন সচিব, মিঃ ই এস মন্টেগু আমাদের বিষয়টি সহকারী সচিব আর্ল অব লিটনের কাছে পাঠিয়ে দিলেন; তিনি আমাদের আন্তরিকতার সঙ্গে অভ্যর্থনা করলেন এবং ধৈর্য ধরে আমাদের কথা শুনলেন। তিনি আমাদের জোর দিয়ে বললেন যে ইন্ডিয়া অফিসের আদৌ কোনও আপত্তি নেই এবং বাধাটা আসছে ওয়ার অফিস (War Office) থেকে। ওয়ার অফিসকে জানানো হয়েছিল যে, ও টি সি-তে ভারতীয়দের ভর্তি করা হলে ব্রিটিশ ছাত্ররা ক্ষুব্ধ হবে। তা ছাড়া, ওয়ার অফিসের ভয় এই যে পূর্ণ যোগ্যতা অর্জন করলে যেহেতু ও টি সি-র সদস্যদের ব্রিটিশ সৈন্যবাহিনীতে কর্মভার প্রাপ্ত হওয়ার অধিকার জন্মায়, সেহেতু ভারতীয় ছাত্ররা যদি ও টি সি-তে শিক্ষালাভ করার পর ব্রিটিশ সৈন্যবাহিনীতে চাকুরি দাবি করে তাহলে এক সঙ্কটজনক পরিস্থিতির উদ্ভব হবে। লর্ড লিটন আরও বলেছিলেন, ভবিষ্যতে যে ভারতীয় অফিসার সম্মিলিত বাহিনীর ভারপ্রাপ্ত হবে ব্যক্তিগতভাবে তিনি তা অবশ্যম্ভাবী মনে করেন; কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত কোনও কোনও মহলে ভারতীয়দের প্রতি বিদ্বেষ আছে যা উপেক্ষা করা যায় না। আমরা উত্তর দিয়েছিলাম যে, ওই অসুবিধা দূর করার জন্য আমরা আশ্বাস দিতে প্রস্তুত যে ব্রিটিশ সৈন্যবাহিনীতে আমরা চাকরি চাইব না। আমরা আরও বলেছিলাম যে পেশাগত ভাবে সৈন্যবাহিনীতে যোগদান করা অপেক্ষা শিক্ষালাভের দিকেই আমাদের আগ্রহটা বেশি। কেমব্রিজে ফিরে আবার আমরা ও টি সি স্টাফদের ধরাধরি করলাম এবং আবার আমাদের বলা হল যে ওই প্রস্তাবে ওয়ার অফিস আপত্তি করছে না, বরং ইন্ডিয়া অফিসই করছে। সত্য যাই হোক না কেন, কোনও কোনও ব্রিটিশ মহলে যে ভারতীয়দের প্রতি একটা বিদ্বেষ ছিল এতে সন্দেহ নেই। যতদিন আমি সেখানে ছিলাম, কর্তৃপক্ষ ততদিন আমাদের দাবিগুলি পূরণ করেননি এবং আমার মনে হয়, সতেরো বছর আগে অবস্থা যা ছিল এখনও তাই আছে।

সেই সময়ে কেমব্রিজে ভারতীয় ছাত্রদের রেকর্ড মোটের উপর সন্তোষজনক ছিল, বিশেষত পড়াশুনার ব্যাপারে। খেলাধুলায়ও তারা মোটেই খারাপ ছিল না। আমরা শুধু নৌকাবাইচে তাদের আরও উন্নতি দেখলে সুখী হতাম। এখন ভারতবর্ষে নৌকাবাইচ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে, সুতরাং আশা করা যায় যে ভবিষ্যতে নৌকাবাইচেও তারা বিশিষ্ট স্থান অধিকার করবে।

ভারতীয় ছাত্রদের বিদেশে পাঠানো বাঞ্ছনীয় কিনা এবং বাঞ্ছনীয় হলে কোন বয়সে পাঠানো উচিত এই বিষয়ে প্রায়ই প্রশ্ন উঠে থাকে। ১৯২০ সালে গ্রেট ব্রিটেনে বসবাসকারী ভারতীয় ছাত্রদের বিষয়ে বিবেচনা করে দেখার জন্য লর্ড লিটনের সভাপতিত্বে এক সরকারি কমিটি গঠিত হয়েছিল, এবং ওই প্রসঙ্গে এই প্রশ্নটিও আলোচিত হয়েছিল। আমার সুচিন্তিত অভিমত যা ছিল এবং এখনও আছে তা এই যে ভারতীয় ছাত্রদের খানিকটা সাবালকত্ব অর্জনের পরই বিদেশে যাওয়া উচিত। অথাৎ, সাধারণত বি এ পাস করার পর তাদের যাওয়া কর্তব্য। সেক্ষেত্রে তারা তাদের প্রবাসজীবনকে সর্বাপেক্ষা বেশি কাজে লাগাতে পারে। কেমব্রিজে ভারতীয় মজলিশের প্রতিনিধিরূপে ভারতীয় ছাত্রদের জন্য গঠিত উপরোক্ত কমিটির সামনে এই মতই আমি পেশ করেছিলাম। ব্রিটেনে পাবলিক স্কুলের শিক্ষা সম্বন্ধে অনেক বড় বড় কথা বলা হয়ে থাকে। ব্রিটেনের অধিবাসী ও ব্রিটিশ ছাত্রদের উপর এর ফল কিরকম হয়ে থাকে সে বিষয়ে কোনও মত প্রকাশ করার ইচ্ছা আমার নেই। কিন্তু ভারতীয় ছাত্রদের সম্বন্ধে যতদূর বলা যায়, এর স্বপক্ষে আমি কিছুই খুঁজে পাইনি। ইংলন্ডের পাবলিক স্কুলগুলি থেকে পাশ করেছে এরকম কিছু ভারতীয়ের সঙ্গে কেমব্রিজে আমার দেখা হয়েছিল এবং তাদের সম্বন্ধে আমার উচ্চ ধারণা হয়নি। যাদের বাবা-মা তাদের সঙ্গে ইংলন্ডে বাস করেছেন এবং স্কুলের শিক্ষার অতিরিক্ত বাড়ির প্রভাবও যাদের উপর পড়েছে তারা সম্পূর্ণ একাকী ছাত্রদের থেকে ভাল ফল দেখিয়েছে। নিম্নতর ধাপগুলিতে শিক্ষা অবশ্যই ‘জাতীয়’ হওয়া চাই, দেশের মাটির সঙ্গে তার নাড়ির যোগ থাকা চাই। স্বদেশের সংস্কৃতি থেকে মনের খোরাক আমাদের অবশ্যই গ্রহণ করতে হবে। অল্প বয়সেই কাউকে অন্য স্থানে পাঠিয়ে দিলে তা কি করে সম্ভব হবে? না, ছেলেমেয়েদের অপরিণত বয়সে একেবারে একাকী বিদেশের স্কুলগুলিতে পাঠাবার চিন্তাকে আমাদের সচরাচর প্রশ্রয় দেওয়া উচিত নয়। শিক্ষা আন্তর্জাতিক হয়ে ওঠে উচ্চতর ধাপগুলিতে। তখনই শুধু ছাত্রেরা বিদেশে গিয়ে উপকৃত হতে পারে এবং তখনই পারস্পরিক কল্যাণের জন্য প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মিলন ঘটতে পারে।

ভারতবর্ষে সিভিল সার্ভিসের সদস্যদের আগে বলা হত ‘সবজান্তা’, যার অজানা কিছুই নেই। এই কথার মধ্যে কিছু যৌক্তিকতা ছিল কারণ সকল প্রকার কাজে তাদের নিযুক্ত করা হত। যে শিক্ষা তারা লাভ করত তা তাদের খানিকটা স্থিতিস্থাপকতা এবং সেই সঙ্গে বহু বিষয়ে মোটামুটি জ্ঞান দিত, যা প্রকৃত শাসনকার্যে তাদের সহায়ক হত। আমি একথা উপলব্ধি করেছিলাম যখন নয়টি বিষয় ঘাড়ে নিয়ে আমি সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় বসি। পরবর্তী জীবনে ওইগুলির সমস্তই যে আমার কাজে লেগেছে এমন নয়, তবে আমি অবশ্যই বলব যে রাজনীতি-বিজ্ঞান, অর্থনীতি, ইংরাজি, ইতিহাস ও আধুনিক ইউরোপীয় ইতিহাস পড়ে উপকার হয়েছিল—বিশেষ করে আধুনিক ইউরোপীয় ইতিহাসের ক্ষেত্রে। এই বিষয়টি পড়বার আগে ইউরোপ মহাদেশের রাজনীতি সম্বন্ধে কোনও স্পষ্ট ধারণা আমার ছিল না। আমরা ভারতীয়রা ইউরোপকে গ্রেট ব্রিটেনের একটা বৃহৎ সংস্করণ হিসাবে গণ্য করতে শিখেছি। কাজেই ইংলন্ডের চোখ দিয়ে ওই মহাদেশকে দেখার একটা অভ্যাস আমাদের আছে। এটা অবশ্য একেবারেই ভুল, কিন্তু ইউরোপে যাইনি বলে, আধুনিক ইউরোপীয় ইতিহাস ও তার কিছু কিছু মূল সূত্রগুলি যথা বিসমার্কের আত্মজীবনী, মেটারনিকের স্মৃতিকথা, কাভুরের পত্রাবলী না পড়া পর্যন্ত এই ভুল আমি উপলব্ধি করিনি। কেমব্রিজে পড়া এই মূল সূত্রগুলি আমার রাজনৈতিক চেতনা জাগ্রত করতে ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির আভ্যন্তরীণ ধারাগুলি সম্বন্ধে আমার ধারণা গড়ে তুলতে সর্বাধিক সাহায্য করেছিল।

১৯২০-র জুলাই-এর গোড়ার দিকে সিভিল সার্ভিসের প্রকাশ্য প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা লন্ডনে শুরু হল। এটি একমাস যাবৎ চলেছিল এবং মানসিক যন্ত্রণাও বহুদিন ভোগ করেছিলাম। মোটের উপর আমি খেটেছিলাম খুব; কিন্তু আমার আশানুরূপ একেবারেই তৈরি হয়নি। সেজন্য আশান্বিত বোধ করতে পারিনি। কত মেধাবী ছাত্র বছরের পর বছর প্রস্তুতি সত্ত্বেও কৃতকার্য হয়নি, সেজন্য আত্মবিশ্বাস রাখতে হলে আত্মম্ভরিতার আশ্রয় নিতে হত। সংস্কৃত পত্রে প্রায় ১৫০-এর মতো নিশ্চিত নম্বর বোকার মতো ছেড়ে দেওয়ার পর নিজের উপর আস্থা আরও হারালাম। সেটি ছিল ইংরাজি থেকে সংস্কৃত অনুবাদের পত্র, এবং আমি ভালই করেছিলাম। প্রথমে অনুবাদটির মোটামুটি একটা খসড়া তৈরি করেছিলাম এই মনে করে যে উত্তরপত্রে সেটি ভাল করে লিখে দেব; কিন্তু সময়ের কথা এমনই ভুলে গিয়েছিলাম যে যখন ঘন্টা বেজে গেল তখন যে মূল খসড়াটি করেছিলাম তার অংশমাত্র ঠিকমতো লেখা হয়েছে। কিন্তু কি আর করা—উত্তরপত্র জমা দিতে হল, আঙুল কামড়ানো ব্যতীত আমার আর কিছু করার ছিল না।

আমি আমার আত্মীয়স্বজনদের জানিয়ে দিয়েছিলাম যে আমি ভাল করিনি এবং নির্বাচিত প্রার্থীদের মধ্যে স্থান পাবার আশা করতে পারি না। আমি এখন Tripos-এর জন্য আমার প্রস্তুতি চালিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করলাম। এই অবস্থায় লন্ডনে থাকাকালীন যখন এক রাত্রে আমার এক বন্ধুর কাছ থেকে তার পেলাম—‘অভিনন্দন জানাচ্ছি, মর্নিং পোস্ট দেখ’—তখন আমার বিস্ময়টা কল্পনা করুন! এর অর্থ কি হতে পারে আমি আশ্চর্য হয়ে ভাবছিলাম। পরদিন সকালে যখন মর্নিং পোস্টের একটা সংখ্যা পেলাম তখন দেখলাম যে আমি চতুর্থ স্থান অধিকার করেছি। আমি আনন্দিত হলাম। তৎক্ষণাৎ দেশে একটা তার পাঠিয়ে দিলাম।

এবার আমার সামনে আর এক সমস্যা দেখা দিল। এই চাকরি নিয়ে আমি কি করব? আমার সমস্ত স্বপ্ন এবং আকাঙক্ষা বিসর্জন দিয়ে নিশ্চিন্ত একটা জীবনে কি প্রতিষ্ঠিত হতে যাব? এতে নূতনত্ব কিছুই নেই। পূর্বে কতজনই তো এই পথে গিয়েছে—কতজন তাদের অল্প বয়সে বড় বড় কথা বলে বড় হয়ে অন্য রকম আচরণ করেছে। কলকাতার এক যুবকের কথা জানতাম, কলেজে পড়ার সময়ে যার জিহ্বাগ্রে রামকৃষ্ণ ও বিবেকানন্দ ছিল; কিন্তু পরে সে এক ধনী পরিবারে বিবাহ করে এবং এখন ভারতীয় সিভিল সার্ভিসে আশ্রয় নিয়েছে। তা ছাড়া, বোম্বাইয়ের এক বন্ধুর দৃষ্টান্ত আছে যে স্বৰ্গত লোকমান্য তিলকের সামনে প্রতিজ্ঞা করেছিল যে যদি সে আই সি এস পরীক্ষায় কোনও রকমে উত্তীর্ণ হয় তাহলে সে পদত্যাগ করে দেশের কাজে আত্মনিয়োগ করবে। কিন্তু আমার অল্পবয়সেই আমি স্থির করেছিলাম যে গতানুগতিক পথে চলব না এবং তা ছাড়া, আমার কতগুলি আদর্শ ছিল যেগুলি অবলম্বন করে আমি বাঁচতে চেয়েছিলাম। অতএব যে পর্যন্ত না আমি আমার অতীত জীবনকে মুছে ফেলতে পারছি ততক্ষণ চাকরি গ্রহণ করা ছিল আমার পক্ষে একেবারে অসম্ভব।

পদত্যাগের কথা ভাবার পূর্বে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় দুটি চিন্তাকে আমার গুরুত্ব দিতে হয়েছিল। প্রথমত, আমার আত্মীয়স্বজনেরা কি ভাববেন? দ্বিতীয়ত, উত্তেজনার ঝোঁকে যদি এখন আমি পদত্যাগ করি তাহলে ভবিষ্যতে আমার কাজের জন্য দুঃখ করবার কোনও কারণ ঘটবে কি? আমি যে ঠিক কাজ করছি এ সম্বন্ধে আমি কি একেবারে সুনিশ্চিত?

মনস্থির করতে আমার দীর্ঘ সাত মাস সময় লেগেছিল। ইতিমধ্যে, আমি আমার মেজদাদা শরৎ-এর সঙ্গে পত্র লেখালেখি শুরু করলাম। সৌভাগ্যবশত, আমার লেখা পত্রগুলি তিনি রেখে দিয়েছিলেন। আমি যেগুলি পেয়েছিলাম সেগুলি সমস্তই প্রচণ্ড রাজনৈতিক জীবনের ঝড়-ঝাপটায় হারিয়ে গিয়েছে। আমার পত্রগুলি প্রণিধানযোগ্য, কারণ ওইগুলি থেকে ১৯২০ সালে আমার মানসিক অবস্থা সম্বন্ধে জানা যায়।

১৯২০ সালের সেপ্টেম্বরের প্রায় মাঝামাঝি, আই সি এস পরীক্ষার ফল ঘোষিত হয়েছিল। এর কয়েকদিন পরে আমি যখন এথেন্সে লে-অন-সিতে ছুটি কাটাচ্ছি, তখন ২৫ সেপ্টেম্বর তাঁকে এই রকম একটি চিঠি লিখি:

‘আপনার অভিনন্দনসূচক চিঠি পেয়ে যারপরনাই আনন্দিত হয়েছি। জানি না আই সি এস পরীক্ষায় কৃতকার্য হয়ে আমার তেমন কি লাভ হয়েছে, কিন্তু এই খবরে যে সকলে খুশি হয়েছেন এবং বিশেষত বাবা ও মায়ের মন এই দুর্দিনে যে একটু হালকা হয়েছে এতেই আমার আনন্দ।

‘আমি এখানে কেট্‌স্‌ পরিবারে অতিথি হিসাবে বাস করছি। শ্রীমতী কেট্‌সে্‌র মধ্যে ইংরেজ চরিত্রের শ্রেষ্ঠ পরিচয় পাই। ভদ্রলোক মার্জিত, উদার মতাবলম্বী এবং ভাবে সর্বদেশিক। …রুশ, পোল্যান্ডবাসী, লিথুয়ানীয়, আয়ারল্যান্ডীয় ও অন্যান্য বিদেশীর সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব। রাশিয়ান, আইরিশ, ও ভারতীয় সাহিত্যে তাঁর প্রচুর উৎসাহ, রমেশ দত্ত ও রবীন্দ্রনাথের রচনায় তাঁর গভীর অনুরাগ। …পরীক্ষায় চতুর্থ স্থান অধিকার করায় আমি রাশিকৃত অভিনন্দন পাচ্ছি। তবে আই সি এস গোষ্ঠীতে প্রবেশ করার চিন্তায় যে কিছুমাত্র আনন্দ পাচ্ছি একথা বলা চলে না। যদি এই চাকরিতে যোগ দিতে হয় তবে এই পরীক্ষার জন্য পড়াশুনা করতে যেরকম অনিচ্ছা নিয়ে এসেছিলাম সেইরকম অনিচ্ছার সঙ্গেই তা করতে হবে। চাকরি-জীবনে মোটা মাইনে এবং তারপর মোটা পেন্‌স্‌ন আমার বরাদ্দ থাকবে তা জানি। দাসত্বে যদি যথেষ্ট কুশলতা অর্জন করি তাহলে একদিন কমিশনার পদে অধিষ্ঠিত হবার আশা আছে। যোগ্যতা থাকলে, গোলামিতে সুপ্রতিষ্ঠিত হলে, হয়তো একদিন কোনও প্রদেশ-সরকারের মুখ্য সচিব হওয়াও অসম্ভব নয়। কিন্তু চাকরিকেই কি আমার জীবনের শেষ লক্ষ্য বলে মেনে নিতে হবে? চাকরিতে সাংসারিক সুখ পাওয়া যাবে, কিন্তু সেটা কি আত্মার মূল্যের বিনিময়ে? আমার মনে হয় আই সি এস গোষ্ঠীর কোনও লোককে চাকরির আইন-কানুন যে ভাবে মাথা নীচু করে মেনে নিতে হয়, তার সঙ্গে জীবনের উচ্চ আদর্শকে মেনে নেবার চেষ্টা ভণ্ডামি ভিন্ন কিছুই নয়।

‘সাধারণ লোকের কথায় যাকে বলে জীবনে উন্নতি করা তার প্রবেশপথে দাঁড়িয়ে, আমার মানসিক অবস্থাটা ঠিক কি রকম, তা আপনি নিশ্চয়ই বোঝেন। এ চাকরির পক্ষে বলবার অনেক কিছু আছে। প্রত্যহ অগণিত মানুষ যে অন্নের চিন্তায় হাবুডুবু খাচ্ছে, সেই অন্নচিন্তা এ চাকরিতে চিরদিনের জন্য মিটে যাবে। জীবনের সামনে দাঁড়িয়ে সাফল্য অসাফল্য সম্বন্ধে কোনও সংশয় নেই, সন্দেহ নেই। কিন্তু আমার মতো মানসিকতার মানুষ যে চিরদিন “উদ্ভট” চিন্তা-ভাবনায় ডুবে থেকেছে তার পক্ষে স্রোতে গা ভাসিয়ে নিশ্চিন্ত হওয়াটাই শ্রেষ্ঠ পথ নয়। সংগ্রাম ছাড়া, বিপদ ছাড়া, জীবনের স্বাদই অনেকখানি অন্তর্হিত হয়ে যায়। যার অন্তরে সাংসারিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা নেই তার কাছে জীবনের সংশয়, বিপদ ততটা ভয়াবহ নয়। উপরন্তু একথা ঠিক যে সিভিল সার্ভিসের শৃঙ্খলের মধ্যে আবদ্ধ থেকে দেশের সত্যিকারের কাজ করা চলে না। এক কথায় সিভিল সার্ভিসের আইন কানুনের প্রতি আনুগত্যের সঙ্গে জাতীয় ও আধ্যাত্মিক আকাঙ্ক্ষাকে মেলানো চলে না!

‘আমি বুঝতে পারছি, এসব কথা বলে কোনও ফল হবে না, কারণ আমার ইচ্ছায় কিছু হওয়ার নয়। সিভিল সার্ভিস সম্পর্কে আপনার কোনও মোহ নেই, আমি জানি। কিন্তু আমার চাকরি ছাড়ার কথাতে বাবা যে খড়্গহস্ত হয়ে উঠবেন সে বিষয়েও কোনও সন্দেহ নেই। তিনি আমাকে জীবনে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সুপ্রতিষ্ঠিত দেখবার জন্য উদগ্রীব। …সুতরাং দেখছি যে, অর্থনৈতিক কারণে ও স্নেহের বন্ধনের ফলে আমার ইচ্ছাকে আদৌ আমার বলে দাবি করতে পারি না। কিন্তু একথা আমি নির্দ্বিধায় বলতে পারি যে আমার ইচ্ছাই যদি চূড়ান্ত হত, তাহলে সিভিল সার্ভিসে আমি কখনই যোগ দিতাম না।

‘আপনি হয়তো বলবেন যে এ চাকরি এড়াবার চেষ্টা না করে এর ভিতরে প্রবেশ করে এর পাপকে দূর করাই উচিত, এবং সে কথা বললে অবশ্যই অন্যায় বলা হবে না। কিন্তু যদি তাই-ই করি, তাহলেও যে কোনদিন অবস্থা এমন হয়ে দাঁড়াতে পারে যে, ইস্তফা দেওয়া ছাড়া আমার গত্যন্তর থাকবে না। এখন থেকে পাঁচ দশ বছর পরে যদি এমন পরিস্থিতির উদ্ভব হয়, তাহলে জীবনে নতুন করে পথ করে নেবার উপায় থাকবে না। সেক্ষেত্রে আমার সামনে অন্য পথ উন্মুক্ত রয়েছে।

‘সন্দেহবাদী লোকে বলবে যে চাকরির প্রশস্ত কোলে একবার স্থান করে নেবার পর আমার সমস্ত তেজ উবে যাবে। কিন্তু এই ক্ষয়কারী প্রভাব আমার উপর কিছুতেই পড়তে দেব না, এ বিষয়ে আমি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। আমি বিবাহ করব না, অতএব যা আমি সত্য বুঝব তা পালন করার পথে সাংসারিক বিবেচনার অধীন হয়ে থাকতে হবে না।

‘আমার মনের গঠন যে রকম তাতে আমার সত্যই সন্দেহ হয় যে সিভিল সার্ভিসের যোগ্যতা আমার আছে কি না। বরঞ্চ আমার ধারণা, যেটুকু ক্ষমতা আমার আছে, তা অন্যভাবে আমার নিজের ও দেশের কাজে লাগাতে পারব।

‘এ বিষয়ে আপনার মতামত জানতে পারলে আনন্দিত হব। বাবাকে এ বিষয়ে কিছু লিখিনি—কেন তা ভেবে পাচ্ছি না। তাঁর মত-ও জানতে পারলে সুবিধে হত।’

উপরের চিঠিটিতে দেখা যায় যে, আমার মনের দ্বন্দ্ব শুরু হয়েছে, কিন্তু সিদ্ধান্তে পৌঁছবার মতো কোনও সম্ভাবনাই দেখা যাচ্ছে না। ১৯২১ সালের ২৬ জানুয়ারি তারিখে ওই বিষয়ের পুনরুল্লেখ করে আমি লিখেছিলাম:

‘……আপনি বলতে পারেন যে এই কুৎসিত ব্যবস্থাকে পরিহার না করে এর ভিতরে প্রবেশ করে, এর সঙ্গে সংগ্রাম করাই আমার কর্তব্য। কিন্তু সে সংগ্রাম করতে হবে একাকী, কর্তৃপক্ষের হুমকি ও অস্বাস্থ্যকর স্থানে বদলি সহ্য করে, উন্নতির পথ বন্ধ করে। চাকরিতে থেকে এইভাবে যেটুকু উপকার করা যায় সেটুকু বাইরে থেকে যা করা যায়, তার তুলনায় যৎসামান্য। শ্রীযুক্ত রমেশচন্দ্র দত্ত অবশ্যই সার্ভিসের আওতায় অনেক কাজ করেছিলেন, তবু আমার মনে হয় আমলাতন্ত্রের বাইরে থাকলে তাঁর কাজ দেশের পক্ষে অনেক বেশি মঙ্গলজনক হত। তা ছাড়া এক্ষেত্রে প্রকৃত প্রশ্নটি নীতিগত। নীতি অনুসারেই, আমি এই শাসনযন্ত্রের অংশ হওয়ার কথা চিন্তা করতে পারি না। গোঁড়ামিতে, স্বার্থান্ধ শক্তিতে, হৃদয়হীনতায়, সরকারি মার-প্যাঁচের জটিলতায় এই শাসনযন্ত্র বিকল। এর প্রয়োজনের দিন বিগত।

‘আমি এখন এই দুই পথের সংযোগস্থলে উপস্থিত, এবং কোন মধ্যপথ আশ্রয় করবার কোনও উপায় নেই। হয় আমাকে এই জঘন্য চাকরির মায়া ত্যাগ করে সর্বান্তঃকরণে দেশের জন্য জীবন উৎসর্গ করতে হবে, নতুবা সমস্ত আদর্শ আকাঙক্ষায় জলাঞ্জলি দিয়ে সিভিল সার্ভিসে প্রবেশ করতে হবে। …আমি জানি আমার এই বিপজ্জনক হঠকারিতায় আত্মীয়স্বজনের মধ্যে অনেকেই তুমুল সোরগোল তুলবেন। …কিন্তু তাঁদের মতামতে, নিন্দায় বা প্রশংসায় আমার কিছু যায় আসে না। কিন্তু আপনার আদর্শবাদে আমার আস্থা আছে তাই আপনার কাছে আবেদন করছি। পাঁচ বছর আগে এই সময়ে আমার পক্ষে বিপর্যয়কারী একটি ঘটনায় আপনার নৈতিক সমর্থন পেয়েছিলাম। এক বছরের জন্য সেই সময় আমার ভবিষ্যৎ অন্ধকার বোধ হয়েছিল, তবু আমি তার সমস্ত পরিণাম নির্ভয়ে মাথা পেতে নিয়েছিলাম। কখনও নিজের কাছে অভিযোগ করিনি এবং সে ত্যাগ স্বীকার করতে পেরেছিলাম বলে আজও গর্ব অনুভব করি। সেই ঘটনার কথা স্মরণ করে মনে বল পাচ্ছি, আমার এই বিশ্বাস আরও দৃঢ় হচ্ছে যে ভবিষ্যতে আত্মত্যাগের যে কোনও আহ্বানকে আমি দৃঢ়তা, সাহস এবং ধৈর্যের সঙ্গে গ্রহণ করব। পাঁচ বছর আগে আপনি স্বেচ্ছায় এবং মহৎভাবে আমাকে যে নৈতিক সমর্থন জানিয়েছিলেন, আজও তার ব্যতিক্রম হবে না, এমন আশা কি সত্যিই দুরাশা?…

‘এবার বাবাকে তাঁর সম্মতি ভিক্ষা করে আলাদাভাবে লিখলাম। আশা করি আপনি যদি আমার সঙ্গে একমত হন তাহলে বাবাকেও তাতে সম্মত করাবার চেষ্টা চালাবেন। আমার স্থির বিশ্বাস, এ বিষয়ে আপনার মতের বিশেষ গুরুত্ব আছে।’

১৯২১ সালের ২৬ জানুয়ারির এই চিঠিতে দেখা যাচ্ছে যে একটা সিদ্ধান্তে প্রায় উপনীত হয়েছি, তবে বাড়ির অনুমোদনের জন্য তখনও অপেক্ষা করে আছি।

পরের যে চিঠিতে আমি ওই একই বিষয়ের উল্লেখ করেছিলাম তার তারিখ, ১৯২১ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি। তাতে আমি লিখেছিলাম:

‘……আমার “বিস্ফোরক” চিঠি এতদিনে আপনি বোধকরি পেয়ে থাকবেন। এই চিঠিতে আমার যে কার্যক্রমের কথা উল্লেখ করেছি, পরবর্তী চিন্তার দ্বারা তাই-ই দৃঢ়তর হয়েছে…যদি চিত্তরঞ্জন দাশ এই বয়সে সংসারের সব কিছু ছেড়ে জীবনে অনিশ্চয়তার সম্মুখীন হতে পারেন; তবে আমার সাংসারিক সমস্যাবিহীন তরুণ-জীবনে এ ক্ষমতা আরও অনেক বেশি। চাকরি ছাড়লেও আমার কাজের বিন্দুমাত্র অভাব ঘটবে না। শিক্ষকতা, সমাজ-সেবা, সমবায় প্রতিষ্ঠানাদি, গ্রাম-সংগঠন ইত্যাদি বহু কাজ আছে—যা হাজার হাজার কর্মঠ তরুণকে ব্যাপৃত রাখতে পারে। ব্যক্তিগতভাবে আমি বর্তমানে শিক্ষকতা ও সাংবাদিকতার দিকেই আকৃষ্ট হচ্ছি। ন্যাশনাল কলেজ এবং নতুন সংবাদপত্র “স্বরাজ”-এ যথেষ্ট কাজের সুযোগ পাব। …আত্মত্যাগের আদর্শ নিয়েই জীবন আরম্ভ করতে চাই, আমার কল্পনায় ও প্রবণতায় অনাড়ম্বর জীবন ও উচ্চ-চিন্তা এবং দেশের কাজে উৎসর্গীকৃত জীবনের আকর্ষণ প্রবল। তা ছাড়া বিদেশী শাসকের অধীনে কাজ করা অতি ঘৃণিত বলে মনে করি। অরবিন্দ ঘোষের পথই আমার কাছে মহৎ, নিঃস্বার্থ ও অনুপ্রেরণার পথ, যদিও সে পথ রমেশ দত্তের পথের চাইতে অনেক বেশি কণ্টকাকীর্ণ।

‘দারিদ্র্য ও সেবার ব্রত গ্রহণ করার অধিকার ভিক্ষা করে বাবা মা’র কাছে চিঠি লিখেছি। এই পথে, ভবিষ্যতে লাঞ্ছনার ভয় আছে এই চিন্তায় তাঁরা হয়তো আকুল হবেন। আমি নিজে দুঃখ-ক্লেশের ভয় করি না, সেদিন যদি আসেই দুঃখ থেকে সরে আসবার চেষ্টা না করে অগ্রসর হয়ে তাকে গ্রহণ করব।’

১৯২১-এর ২৬ ফেব্রুয়ারির চিঠিটাও কৌতূহলোদ্দীপক। তাতে আমি বলেছি:

‘যেদিন আই সি এস পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয়েছে, সেইদিন থেকেই আমার মনে এই প্রশ্ন আন্দোলিত; যদি চাকরিতে থাকি তাতে দেশের বেশি উপকারে আসব, না চাকরি ছাড়াটাই দেশের পক্ষে মঙ্গলজনক হবে। এই প্রশ্নের উত্তর মিলেছে। এ বিষয়ে আমি স্থির নিশ্চয় হয়েছি যে জনসাধারণের মধ্যে থেকেই আমি দেশের বেশি মঙ্গল করতে পারব, আমলাতন্ত্রের মধ্যে প্রবেশ করে নয়। চাকরিতে থেকে দেশের কোনই উপকার করা যায় না, আমার বক্তব্য তা নয়। আমি বলতে চাই যে তাতে যেটুকু মঙ্গল হতে পারে আমলাতন্ত্রের শৃঙ্খলমুক্ত দেশসেবার তুলনায় তা অতি নগণ্য। নীতির দিকটাও এখানে দেখতে হবে সে কথা আগেই বলেছি। বিদেশী আমলাতন্ত্রের অধীনতা মেনে নেওয়া আমার পক্ষে অসম্ভব। জনসেবার প্রথম প্রয়োজন সমস্ত সাংসারিক আকাক্ষা ত্যাগ। সাংসারিক উন্নতির পথ একবার ত্যাগ করলে তবেই জাতীয় কর্মে সম্পূর্ণভাবে আত্মোৎসর্গ করা সম্ভব। …আমার মনশ্চক্ষুতে অরবিন্দ ঘোষের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত সর্বদা জাগ্রত। আমার বিশ্বাস—এই আত্মত্যাগের দ্বারা সেই দৃষ্টান্তের দাবি মেটাতে পারব। আমার পারিপার্শ্বিক অবস্থাও তার অনুকূল।’

উপরের চিঠিটি থেকে একথা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে আমার মধ্যে তখনও অরবিন্দ ঘোষের প্রভাব ছিল। বাস্তবিক পক্ষে, এই সময়ে সকলেই বিশ্বাস করত যে, তিনি শীঘ্রই সক্রিয় রাজনীতিতে প্রত্যাবর্তন করবেন।

পরবর্তী চিঠিটি অক্সফোর্ড থেকে লেখা হয়েছিল ৬ এপ্রিল তারিখে, যেখানে আমি ছুটি কাটাচ্ছিলাম। ইতিমধ্যে বাবার চিঠি পেয়েছি, তিনি আমার পরিকল্পনা অনুমোদন করেননি। অথচ পদত্যাগ করবার জন্য আমি সুনির্দিষ্টভাবে মনস্থির করে ফেলেছিলাম। নিম্নের উদ্ধৃতাংশ কৌতূহলজনক:

‘বাবার ধারণা আত্মসম্মানবোধসম্পন্ন সিভিল সার্ভিস চাকুরিয়ার পক্ষে নতুন শাসনব্যবস্থায় জীবন মোটেই দুর্বিষহ হবে না। দশ বছরের মধ্যে এদেশে স্বায়ত্তশাসন অনিবার্য। কিন্তু আমার জীবন নতুন শাসনব্যবস্থায় সহনীয় হবে কি না, তা আমার প্রশ্ন নয়। পরন্তু আমার ধারণা যে চাকরিতে বহাল থেকেও আমি দেশের কিছু মঙ্গল করতে পারব। আমার প্রধান প্রশ্ন নীতিগত। বর্তমান অবস্থায় কি আমাদের এক বিদেশী আমলাতন্ত্রের বশ্যতা স্বীকার করে এক কাঁড়ি টাকার জন্য আত্মবিক্রয় করা সমীচীন? যারা ইতিমধ্যেই চাকরিতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, বা চাকরি গ্রহণ করা ছাড়া যাদের গত্যন্তর নেই তাদের কথা স্বতন্ত্র। কিন্তু আমার অবস্থা অনেক দিক দিয়ে যখন সুবিধেজনক তখন আমার কি এত তাড়াতাড়ি বশ্যতা স্বীকার করা উচিত? যেদিন আমি চাকরির প্রতিজ্ঞাপত্রে সই করব, সেদিন থেকে আমি আর স্বাধীন মানুষ থাকব না এই আমার বিশ্বাস।

‘যদি আমরা উপযুক্ত মূল্য দিতে প্রস্তুত থাকি, তবে দশ বছরে কেন তার আগেই স্বায়ত্তশাসন আমরা অর্জন করতে পারব। সেই মূল্য আত্মত্যাগ ও ক্লেশ-স্বীকার। কেবল এই আত্মত্যাগ ও দুঃখ বরণের ভিত্তিতেই জাতীয় সৌধ প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। যদি আমরা সকলে নিজের নিজের চাকরির খুঁটি আঁকড়িয়ে বসে থাকি, তবে পঞ্চাশ বছরেও আমাদের স্বায়ত্তশাসন মিলবে না। প্রত্যেক ব্যক্তির পক্ষে যদি সম্ভব না হয়, অন্তত প্রত্যেক পরিবারকে আজ দেশমাতার চরণে অর্ঘ্য এনে দিতে হবে। বাবা আমাকে এই আত্মত্যাগ থেকে রক্ষা করতে চান। আমাকে, আমার স্বার্থেই এই দুঃখ কষ্ট থেকে বাঁচাবার জন্য তাঁর ইচ্ছার মধ্যে যে স্নেহ উদ্বেল হয়ে উঠেছে, তার মূল্য বুঝব না, এমন হৃদয়হীন আমি নই। তাঁর স্বভাবতই আশঙ্কা হয় বুঝি বা আমি তরুণ-সুলভ উত্তেজনার ঝোঁকে কিছু একটা করে বসব। কিন্তু আমার স্থির বিশ্বাস, এই ত্যাগ কাউকে না কাউকে করতেই হবে।

‘যদি অন্য কেউ অগ্রসর হত, তবে আমার পিছ-পা হবার, অন্তত আরও খানিকটা ভেবে দেখবার কারণ বুঝতাম। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে সে লক্ষণ মোটেই দেখা যাচ্ছে না। অথচ অমূল্য সময় বয়ে যাচ্ছে। সমস্ত আলোড়ন সত্ত্বেও এটুকু ঠিক যে এখন পর্যন্ত একজন সিভিলিয়ানও চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে আন্দোলনে নামতে সাহস করেনি। ভারতবর্ষের সামনে এই চ্যালেঞ্জ এসেছে—অথচ কেউ তাতে সমুচিত সাড়া দেয়নি। আরও অগ্রসর হয়ে বলতে পারি যে, সমগ্র ব্রিটিশ ভারতের ইতিহাসে একজন ভারতীয় স্বেচ্ছায় দেশসেবার জন্য সিভিল সার্ভিস ত্যাগ করেনি। দেশের সর্বোচ্চ কর্মচারীদের নিম্নতর শ্রেণীর লোকদের কাছে দৃষ্টান্ত স্থাপন করার সময় এসেছে। সরকারি উচ্চ-চাকুরিয়ারা যদি বশ্যতার প্রতিজ্ঞা পরিহার করেন, এমন কি তার ইচ্ছাটুকুও প্রকাশ করেন তাহলেই আমলাতন্ত্রের যন্ত্র ধসে পড়ে।

‘সুতরাং এই ত্যাগ থেকে নিজেকে রক্ষা করবার কোনও পথ দেখতে পাচ্ছি না। এই ত্যাগের অর্থ আমি সম্যক জানি। দারিদ্র্য, দুঃখ, ক্লেশ, কঠিন পরিশ্রম তো আছেই, আরও নানা ভোগ আছে যার কথা স্পষ্টভাবে বলার প্রয়োজন নেই, কিন্তু আপনার পক্ষে বুঝে নেওয়া সহজ। কিন্তু এ ত্যাগ করতেই হবে, জেনে শুনে, বুঝে করতে হবে। দেশে ফিরে পদত্যাগ করার যে পরামর্শ আপনি দিয়েছেন তা অতি যুক্তিসঙ্গত হলেও, এর বিরুদ্ধে দু-একটি কথা বলার আছে। প্রথমত গোলামির প্রতীকস্বরূপ প্রতিজ্ঞাপত্রে সই করা আমার পক্ষে অত্যন্ত কঠিন কাজ হবে। দ্বিতীয়ত বর্তমানের জন্য যদি চাকরিতে প্রবেশ করি তাহলে প্রথা অনুযায়ী আমি ডিসেম্বর অথবা জানুয়ারির আগে দেশে ফিরতে পারব না। যদি এখন পদত্যাগ করি তাহলে জুলাই মাসেই ফিরতে পারব। ছয় মাসের মধ্যেই বহু পরিবর্তন ঘটবে। ঠিক মুহূর্তে যথেষ্ট সাড়া না পাওয়ার ফলে আন্দোলন দমে যেতে পারে, দেরিতে সাড়া মিললে তা হয়তো ফলপ্রসূ হবে না। আমার বিশ্বাস আরেকটি এ জাতীয় আন্দোলন আরম্ভ করতে বহু বছর লেগে যাবে। সুতরাং বর্তমান আন্দোলনের ঢেউকে যতদূর সম্ভব কাজে লাগাবার চেষ্টা করাই সমীচীন। যদি আমাকে পদত্যাগ করতে হয় তবে তা দুদিন পরে অথবা একবছর পরে করলেও আমার বা অন্য কারও ক্ষতিবৃদ্ধি নেই, কিন্তু দেরি করলে আন্দোলনের পক্ষে হয়তো ক্ষতি হতে পারে। আমি জানি যে আন্দোলনকে সাহায্য করার ক্ষমতা আমার হাতে অল্পই, তবু যদি নিজের কত পালনের সন্তোষ লাভ করতে পারি তা-ও এক বিরাট লাভ বলতে হবে। …যদি কোনও কারণে পদত্যাগ সম্বন্ধে মত পরিবর্তন করি তবে বাবার কাছে তৎক্ষণাৎ তার পাঠাব, তাতে তাঁর আশঙ্কা ঘুচবে।’

কেমব্রিজ থেকে ২০ এপ্রিল তারিখে লেখা চিঠিতে বলেছিলাম যে ২২ এপ্রিল আমার পদত্যাগপত্র পাঠাব।

কেমব্রিজ থেকে আমার ২৮ এপ্রিল তারিখের চিঠিতে এইরকম লিখেছিলাম:

‘আমার পদত্যাগ সম্বন্ধে ফিট্‌জ্‌উইলিয়াম হলের সেন্সার রেডাওয়ে সাহেবের সঙ্গে কথাবার্তা হল। তাঁর কাছে আমার যা প্রত্যাশা ছিল, ঠিক তার বিপরীত হল। তিনি আমার চিন্তাধারার প্রতি সোৎসাহে সমর্থন জানালেন। আমি মত পরিবর্তন করেছি শুনে তিনি নাকি আশ্চর্য এমন কি হতবুদ্ধি হয়ে গিয়েছিলেন, কারণ এ পর্যন্ত তিনি কোনও ভারতীয়কে এমন করতে দেখেননি। আমি তাঁকে বলি যে পরে আমি সাংবাদিকতাকেই গ্রহণ করব। তার মতে সাংবাদিক-জীবন একঘেয়ে সিভিল সার্ভিস অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ।

‘এখানে আবার আগে আমি তিন সপ্তাহ অক্সফোর্ডে ছিলাম এবং সেখানেই আমি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি। শেষ কয় মাস যে চিন্তা আমাকে অহরহ পীড়া দিয়েছে তা শুধু এই যে বহু ব্যক্তির বিশেষ করে বাবা মার দুঃখ ও ক্লেশ হয় এই রকম কাজ নীতিগতভাবে আমার করা উচিত কি না। …সুতরাং নূতন জীবনের কিনারায় দাঁড়িয়ে আজ আমাকে বাবা-মার সুস্পষ্ট ইচ্ছা ও আপনার উপদেশের বিরোধিতা করতে হচ্ছে—অবশ্য আপনি “যে কোনও পথে আমি চলি না কেন” আপনার “সাদর অভিনন্দন” জানিয়ে রেখেছেন। সার্ভিসে যোগ দেওয়ার বিরুদ্ধে আমার প্রধানতম যুক্তির ভিত্তি এই ছিল যে প্রতিজ্ঞাপত্রে সই করে আমাকে এমন এক বৈদেশিক আমলাতন্ত্রের বশ্যতা স্বীকার করতে হবে যার এদেশে থাকার নৈতিক অধিকার আমি বিন্দুমাত্র স্বীকার করি না। একবার প্রতিজ্ঞাপত্রে সই করলে, আমি তিন বছর অথবা তিন দিন কাজ করি তাতে কিছু যায় আসে না। আমি বুঝেছি যে আপসের মনোবৃত্তি হীন বস্তু—এতে মানুষের অধঃপতন এবং আদর্শের হানি হয়। …সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় যে জীবনান্তে সরকারি উপাধির মুকুট পরে মন্ত্রিত্বের গদিতে আসীন হয়েছেন তার কারণ তিনি এডমন্ড বার্কের সুবিধাবাদের দর্শনে বিশ্বাসী। সুবিধাবাদীর নীতি গ্রহণ করার অবস্থা আমাদের এখনও আসেনি। আমাদের এক নীতি গঠন করতে হবে এবং হ্যাম্পডেন ও ক্রমওয়েলের আপসহীন আদর্শবাদ ভিন্ন তা সম্ভব নয়। …আমার এই বিশ্বাস জন্মেছে যে ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে সব সম্পর্ক ছিন্ন করার সময় আজ উপস্থিত। প্রতি সরকারি কর্মচারী, সে তুচ্ছ চাপরাশি অথবা প্রাদেশিক গভর্নরই হোক, নিজের কাজের দ্বারা ভারতবর্ষে কেবল ব্রিটিশ সরকারের বুনিয়াদ পাকা করছে। সরকারের অবসান ঘটানোর শ্রেষ্ঠ উপায় তার কাছ থেকে সরে আসা। আমি টলস্টয়ের নীতির কথা শুনে অথবা গান্ধীর প্রচারে মুগ্ধ হয়ে একথা বলছি না, আত্মোপলব্ধি থেকে বলছি। …কয়েকদিন হল আমার পদত্যাগপত্র দাখিল করেছি। গৃহীত হবার সংবাদ এখনও পাইনি।

‘আমার চিঠির উত্তরে চিত্তরঞ্জন দাশ মহাশয় সম্প্রতি দেশে যে কাজ চলছে, তার বিষয়ে লিখেছেন। বর্তমানে আন্তরিকতাসম্পন্ন কর্মীর অভাব সম্বন্ধে তিনি অভিযোগ করেছেন। সুতরাং দেশে ফিরবার পর অনেক প্রীতিপ্রদ কাজ আমি পাব। …আর কিছু আমার বলবার নেই। ফিরবার সব পথ রুদ্ধ করে আমি ঝাপ দিলাম। —আশা করি এর ফল শুভই হবে।’

১৮ মে তারিখে কেমব্রিজ থেকে এই চিঠিটি লিখেছিলাম:

‘স্যার উইলিয়াম ডিউক আমাকে পদত্যাগপত্র প্রত্যাহার করতে রাজি করাতে চেষ্টা করছেন। তিনি এ বিষয়ে বড়দাদার সঙ্গে পত্রালাপও করেছেন। কেমব্রিজের সিভিল সার্ভিস বোর্ডের সেক্রেটারি রবার্টস সাহেবও আমাকে সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করতে পরামর্শ দিয়েছেন, এবং আমাকে জানিয়েছেন যে ইন্ডিয়া অফিসের নির্দেশানুসারেই তাঁর এই হস্তক্ষেপ। আমি স্যার উইলিয়ামকে জানিয়ে দিয়েছি যে পূর্ণ বিবেচনার পরই আমি আমার পথ বেছে নিয়েছি।’

এই চিঠিটির একটু টীকা প্রয়োজন। আমার পদত্যাগ পাঠিয়ে দেবার সঙ্গে সঙ্গে ইন্ডিয়া অফিসের লোকদের মধ্যে সাড়া পড়ে গিয়েছিল। স্বৰ্গত স্যার উইলিয়াম ডিউক ছিলেন তখন স্থায়ী সহকারী ভারত-সচিব; উড়িষ্যার কমিশনার থাকাকালীন তিনি আমার বাবাকে চিনতেন। তিনি আমার বড়দাদা শ্রীযুক্ত সতীশচন্দ্র বসুর সঙ্গে যোগাযোগ করলেন, তিনি তখন লন্ডনে ব্যারিস্টারি পড়ছিলেন। চাকরি থেকে পদত্যাগ না করার জন্য স্যার উইলিয়াম আমার দাদার মারফৎ আমাকে উপদেশ দিলেন। কেমব্রিজের লেকচারাররাও আমাকে অনুরোধ করলেন এবং আমার সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার জন্যও আমাকে বললেন। তারপর অনুরোধ এল কেমব্রিজে সিভিল সার্ভিস বোর্ডের সেক্রেটারি স্বর্গত মিঃ রবার্টসের কাছ থেকে। বিভিন্ন দিক থেকে এই সব প্রচেষ্টা আমার কৌতূহল উদ্রেক করল। —কিন্তু সবচাইতে মজার ছিল শেষ চেষ্টাটি।

কয়েকমাস আগে সিভিল সার্ভিসে শিক্ষানবীশদের কাছে ইন্ডিয়া অফিস প্রেরিত কতকগুলি মুদ্রিত নির্দেশাবলী নিয়ে মিঃ রবার্টসের সঙ্গে আমার ঝগড়া হয়েছিল। এই সব নির্দেশের শিরোনাম ছিল ‘ভারতে অশ্বের পরিচর্যা’ এবং এতে এই মর্মে মন্তব্য করা হয়েছিল যে, ভারতীয় সহিস (groom) তার অশ্ব যা খায় সেই একই খাদ্য খেয়ে থাকে। —ভারতীয় বেনেরা (Traders) যে অসাধু তা একরকম প্রবাদবাক্যে দাঁড়িয়ে গেছে, ইত্যাদি। এগুলি পেয়ে স্বভাবতই আমার ভয়ানক রাগ হয়েছিল এবং অন্যান্য সতীর্থ শিক্ষানবীশদের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করেছিলাম, তারাও এগুলি পেয়েছিল। আমরা সকলে একমত হয়েছিলাম যে, নির্দেশগুলি ভুল এবং অপমানকর এবং আমাদের মিলিতভাবে একটা প্রতিবাদ জানানো উচিত। লেখার সময় প্রত্যেকেই সরে পড়ার চেষ্টা করল। শেষপর্যন্ত হতাশ হয়ে নিজের ইচ্ছামতই কাজ করব স্থির করলাম।

আমি সোজা মিঃ রবার্টসের কাছে গেলাম এবং মুদ্রিত নির্দেশাবলীতে যে সব ভুলের কথা ছিল সেগুলির প্রতি তাঁর মনোযোগ আকর্ষণ করলাম। তিনি জ্বলে উঠে বললেন, ‘দেখ, মিঃ বোস, যদি তুমি সরকারি দৃষ্টিভঙ্গি স্বীকার না কর, তাহলে আশঙ্কা হয় তোমাকে বিদায় নিতে হবে।’ এত সহজে ভ্রূকুটিতে ভয় পাবার পাত্র আমি নই এবং লড়াই-এর জন্য আমি প্রস্তুত হয়ে গিয়েছিলাম। তাই শান্তভাবে জবাব দিলাম, ‘হ্যাঁ, কিন্তু সরকারি দৃষ্টিভঙ্গি বলতে আপনি কি বোঝাতে চান? মিঃ রবার্টস তৎক্ষণাৎ বুঝলেন যে ভ্রূকুটিতে কাজ হবে না, তাই তাঁর সুর বদলিয়ে ধীরে ধীরে বললেন, ‘আমি যা বলতে চাইছি তা হল এই যে, দোষ খুঁজে বেড়ানো তোমার উচিত নয়।’ আমি জবাব দিলাম যে, দোষ আমি খুঁজে বেড়াইনি, কিন্তু নির্দেশগুলি তো আমার সামনেই রয়েছে। সবশেষে তিনি পথে আসলেন এবং বললেন যে, আমি তাঁকে যা বলেছি সে সম্বন্ধে তিনি ইন্ডিয়া অফিসের মনোযোগ আকর্ষণ করবেন। তাঁকে ধন্যবাদ জানিয়ে চলে এলাম।

একপক্ষকাল পরে মিঃ রবার্টস আমাকে ডেকে পাঠালেন। এবার তিনি অত্যন্ত সহৃদয়তার সঙ্গে ব্যবহার করলেন। তিনি ইন্ডিয়া অফিস প্রেরিত একটি চিঠি পড়ে শোনালেন, যাতে তাঁরা মুদ্রিত নির্দেশগুলির প্রতি তাঁদের মনোযোগ আকর্ষণ করার জন্য আমাকে ধন্যবাদ জানিয়েছিলেন এবং আশ্বাস দিয়েছিলেন যে, যখন ওইসব নির্দেশ পুনর্মুদ্রিত হবে তখন প্রয়োজনীয় সংশোধনগুলি করে দেওয়া হবে।

আমার পদত্যাগের পর যখন তাঁর সঙ্গে দেখা করলাম, তখন তিনি সম্পূর্ণ ভিন্ন এক মিঃ রবার্টস। এত মধুর লেগেছিল তাঁর ব্যবহার। তিনি অনেকক্ষণ আমাকে যুক্তি দিয়ে বোঝাতে চেষ্টা করলেন যে নতুন শাসনতন্ত্রে আমার দু-বছর চাকরি করা উচিত। নতুন আইনে চাকরি করেও দেশের সেবা করা সম্ভব এবং দুবছর পরে যদি আমি দেখি যে পোষাচ্ছে না, তখন পদত্যাগ করা আমার পক্ষে মোটেই অসঙ্গত হবে না। তাঁকে ধন্যবাদ জানালাম কিন্তু বললাম যে, আমি মনস্থির করে ফেলেছি কারণ আমার বিশ্বাস যে, দু-জন মনিবের সেবা করা আমার পক্ষে অসম্ভব।

* আত্মজীবনী “ভারত পথিক”-এর নবম পরিচ্ছেদ। আই. সি. এস. থেকে পদত্যাগ করার সময় মেজদাদা শরৎচন্দ্র বসুকে লেখা চিঠিগুলির বিস্তৃত উদ্ধতি এই পরিচ্ছেদে আছে।

এস. এম. ডি.

অবস্থার যে এখন পরিবর্তন হয়েছে তা আমার অজ্ঞাত নয়।

এখন তার কত পরিবর্তন হয়েছে।

প্রত্যেক নিয়মেরই অবশ্য ব্যতিক্রম আছে।

লোকমান্য বি. জি, তিলক যখন ১৯১৯ সালে কেমব্রিজে আসেন তখন তিনি ভারতীয় ছাত্রদের কাছে সরকারি চাকুরির পিছনে না ছুটে জাতির সেবায় আত্মনিয়োগ করার জন্য আবেদন জানান। তিনি দুঃখ করে বলেছিলেন যে কত মেধাবী ও সম্ভাবনাপূর্ণ ছাত্র সরকারি চাকুরির জন্য লালায়িত। এই বন্ধুটি হঠাৎ প্রেরণার বশবর্তী হয়ে দাঁড়িয়ে উঠে বলেছিল যে যদিও সে ভারতীয় সিভিল সার্ভিসের যোগ্যতা অর্জনের জন্য চেষ্টা করছে, তবু যদি সে কোনরকমে পরীক্ষা পাস করে তাহলে সে পদত্যাগ করবে এবং তারপর জাতীয় স্বার্থে কাজ করবে। প্রথমবার সে পাস করেনি কিন্তু পরের বছর সে কৃতকার্য হয়েছিল এবং এখনও ঐ চাকুরি করছে।

লোকমান্য তিলকের কেমব্রিজে আসার কথা শুনে ইন্ডিয়া অফিস ও পররাষ্ট্র দপ্তর ঘাবড়ে গিয়েছিল। সম্ভব হলে তাঁর আসা বন্ধ করার জন্য অনুরোধ জানিয়ে তদানীন্তর পররাষ্ট্র-সচিব, লর্ড কার্জন, ভাইস-চ্যান্সেলরকে লিখেছিলেন। এ প্রসঙ্গে ভাইস-চ্যান্সেলর ভারতীয় ছাত্রদের ডেকে পাঠিয়েছিলেন; কিন্তু তারা জানিয়ে দিয়েছিল যে যেহেতু লোকমান্য তিলককে ইতিমধ্যেই আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে, তাঁর আসা বন্ধ করা একেবারেই অসম্ভব। এর পর, লর্ড কার্জনের পত্র সত্ত্বেও, বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে আর কোনও হস্তক্ষেপ করা হয়নি।

কেমব্রিজে লোকমান্য তিলকের বক্তৃতার মূল কথা ছিল এই যে ‘পনেরো বছরের মধ্যে স্বায়ত্তশাসন’ তাঁর দাবি। কিছু কিছু ইংরাজ অ-স্নাতক যারা শুনেছিল যে লোকমান্য তিলক একজন তেজস্বী পুরুষ, তারা তাঁর বক্তৃতায় কিছু গরম গরম কথা শোনার আশায় এসেছিল। বক্তৃতার পর তারা মন্তব্য করেছিল: ‘এরাই যদি তোমাদের চরমপন্থী হয়, তাহলে আমরা তোমাদের নরমপন্থীদের কথা শুনতে চাই না।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *