কেমন হয় একটা বিশ্ববিদ্যালয়?

কেমন হয় একটা বিশ্ববিদ্যালয়?

একটা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে তখনই আমরা ইউনিভার্সিটি বা বিশ্ববিদ্যালয় বলি, যখন সে প্রতিষ্ঠানটির কিছু বৈশিষ্ট্য থাকে। একটা প্রাথমিক বিদ্যালয় বা মাধ্যমিক বিদ্যালয়কে আমরা ইউনিভার্সিটি বলি না। একটি কলেজকে আমরা ইউনিভার্সিটি বলি না। এর কারণ শুধু এই নয় যে ইউনিভার্সিটির পাঠ্যসূচি আলাদা। একটা প্রতিষ্ঠান ইউনিভার্সিটি হতে হলে পাঠ্যসূচি ছাড়াও অন্যান্য বহু বৈশিষ্ট্য থাকতে হয়।

আমাদের তরুণেরা যখন পৃথিবীর পথে বের হন, তখন সারা দুনিয়ার ইউনিভার্সিটিগুলো দেখে একটা হোঁচট খান। তারা উপলব্ধি করেন, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে আমরা কী করে জেনেশুনে খুন করছি। তাদের খুব কষ্ট হয় তখন। সারা দুনিয়া থেকে আমরা খাবার সংস্কৃতি ধার করি। পোশাক সংস্কৃতি নেই। কিন্তু সারা দুনিয়ার শিক্ষা ও গবেষণার সংস্কৃতিটা কেন যে আমরা ধার করি না, অনুসরণ করি না, সেটা আজও বুঝি না। আমরা কি সেটা ধার করতে পারতাম না?

বছর বছর যখন দুনিয়ার ইউনিভার্সিটিগুলোর র‍্যাঙ্কিং হয়, তখন আমাদের কোনো ইউনিভার্সিটির নাম সে তালিকায় খুঁজে পাওয়া যায় না। এই বিষয়টা কি আমাদের দেশের শিক্ষক, শিক্ষাবিদদের একটুও নাড়া দেয় না? এশিয়াভিত্তিক যে তালিকা হয়, সে তালিকাতেও আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলোর নাম থাকে না। একটা প্রতিষ্ঠানের শুধু নাম, ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক, আর কতগুলো। ভবন থাকলেই সেটা একটা ইউনিভার্সিটি হয়ে যায় না। কিংবা একটা প্রতিষ্ঠান বয়সে পুরোনো হলেই সেটা ইউনিভার্সিটি হয়ে ওঠে না। একটা প্রতিষ্ঠান যদি বিশ্ববিদ্যালয় হতে হয়, তাহলে—

১. পিএইচডি ও গবেষণার অভিজ্ঞতা ছাড়া কেউ সেখানে অধ্যাপক হতে পারেন না।

২. পিএইচডি/পোস্টডক ছাড়া শিক্ষকতাই শুরু করতে পারতেন না। (চীন-ভারতের যে প্রতিষ্ঠানটি পৃথিবীর ৫০০টি ইউনিভার্সিটির তালিকাতে নেই, সেখানেও কেউ পারে না)

৩. ২৮-২৯-এর মেধাবীরা পৃথিবীর বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গবেষণার অভিজ্ঞতা নিয়ে এসে শিক্ষকতা ও গবেষণা শুরু করতেন।

৪. প্রতিটি ফ্যাকাল্টি, ডিপার্টমেন্টে নিয়মিত সেমিনার/সিম্পোজিয়াম হতো। দেশ-বিদেশের শিক্ষক ও গবেষকেরা। সেখানে লেকচার দিতেন।

৫. ইউরোপ-আমেরিকা, চীন-জাপানের বাঘা বাঘা প্রফেসররা নিয়মিত ভিজিট করতেন। প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিদেশ থেকে খণ্ডকালীন শিক্ষক/গবেষক নিয়োগ দেওয়া হতো।

৬. শিক্ষকদের প্রমোশন, বেতন এসব নির্ভর করত শুধু এবং শুধু গবেষণা ও শিক্ষকতার দক্ষতার ওপর (দুনিয়ার খুব কম দেশেই, দেশজুড়ে সব শিক্ষকের বেতন অভিন্ন )।

৭. বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা প্রকাশ হতো দুনিয়ার সেরা সেরা জার্নালে (ইউনিভার্সিটি র‍্যাঙ্কিংয়ে এগিয়ে থাকার এটা প্রধানতম শর্ত)।

৮. বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙিনায় নেতারা মাস্তানি করতেন না।

 ৯. বিশ্ববিদ্যালয়ের দেয়ালে দেয়ালে, কক্ষে ও বারান্দায় নেতা নেত্রীর পোস্টার, স্লোগান আর ছবিতে ভরপুর থাকত না।

১০. বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি সরকারের পুতুল হতেন না। তিনি হতেন প্রশাসনিকভাবে দক্ষ, অভিজ্ঞ, জ্ঞান-গবেষণায় জাহাজ। ভিসি সিলেক্ট করত বিশ্ববিদ্যালয়েরই কোনো বডি। (আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিরা প্রেসিডেন্টের কথাই শোনেন না। বহু ভিসি প্রেসিডেন্টের কথার উল্টো কথা বলে। বসে থাকেন)।

১১. শিক্ষকেরা রাজনীতি করে বেড়াতেন না। (বাংলাদেশের মতো দুনিয়ার আর কোনো দেশে এমনটি হয় না)।

১২. ছাত্রদের মধ্যে এমন দলীয় ও দলান্ধ নোংরা রাজনীতি থাকত না। (সিট দখল, হল দখল, মাঠ দখল, পদ দখল এই নিয়ে আছে আমাদের ছাত্র রাজনীতি)।

 ১৩. সেশনজট বলে কোনো শব্দ থাকত না। (পৃথিবীর কোথাও নেই)।

১৪. বিশ্ববিদ্যালয়জুড়ে থাকত নানান গবেষণা কেন্দ্রবিজ্ঞানের, সাহিত্যের, শিল্পকলার।

১৫. পৃথিবীর নানান দেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা দেশের মেধাবী ও দক্ষদের ফিরিয়ে এনে নিয়োগ দেওয়ার ধারাবাহিক চেষ্টা করা হতো।

 ১৬. প্রতিবছর সেখান থেকে মানসম্পন্ন ডক্টরেট করা বহু ছেলেমেয়ে (২৬-২৭ বছরের) বের হতো।

 ১৭. বিশ্ববিদ্যালয়টির সাথে দেশ ও বিদেশের বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠান, আন্তর্জাতিক সংগঠন ও অন্যান্য গবেষণাপ্রতিষ্ঠানের যোগাযোগ থাকত। গবেষণার যৌথ কার্যক্রম (Collaboration) চালু থাকত।

১৮. বিশ্ববিদ্যালয়টির কার্যক্রম, ডিপার্টমেন্টের পরিচিতি, শিক্ষকদের পরিচয়, যোগ্যতা, গবেষণা ইত্যাদির সুস্পষ্ট তথ্যের উল্লেখ থাকত ওয়েবসাইটে।

১৯. বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি কর্মকর্তা, কর্মচারী, গবেষণা শিক্ষার্থী প্রত্যেকের নাম দিয়ে থাকত বিশ্ববিদ্যালয়ের ই-মেইল আইডি। (কোনো জিমেইল, ইয়াহু আইডি না)।

উল্লিখিত বিষয়গুলো হলো বহু বৈশিষ্ট্যের সামান্য কিছু। আমাদের। দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে কি আমরা এগুলো প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছি? এগুলো প্রতিষ্ঠা না করে আমরা কী করে বিশ্বতালিকায়। আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলোর অবস্থান আশা করব?