কেমন এই দুনিয়া!
।। ১ ।।
একদিন সকালে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দেখলুম—সে পালিয়েছে। ফিরবে না কোনওদিন। একমাথা কোঁকড়া-কোঁকড়া চুল ছিল তার। দুটো বড় বড় নীল চোখ। টান টান মসৃণ ত্বক। দুসার ঝকঝকে দাঁত। হাসিমাখা মুখ। ভেতরের আনন্দ ফুটে বেরুচ্ছে। সে নেই, সে না বলেই চলে গেছে। জানি সে আর আসবে না। এ এক বিচিত্র অকৃতজ্ঞতা।
যে-শিশুটি সবুজ মাঠে শীতের রোদে দৌড়ত, সে গেল কোথায়। ভোরের কুয়াশা। হাঁ করে তাকিয়ে আছে ঝাপসা খেজুর গাছের দিকে। ঝাপসা একজন মানুষ সেই টঙে ঝুলে আছে। তার হাতের নাগালে গোটা কতক কলশি। শিশুটির রোমহর্ষক ভাবনা—রাতের ভূত ভোরের গাছে কোনওভাবে আটকে গেছে। এইবার কী হবে! একটু পরেই যে রোদ উঠবে!
‘ও খোকা! ও ভূত নয়। ও হল সিউলি, খেজুরের রস পাড়ছে। নলেন গুড় তৈরি হবে।’
নতুন শব্দ। সিউলি। পণ্ডিতমশাই ভোরবেলা টোলে যাচ্ছেন। যাওয়ার পথে শিশুটিকে শিখিয়ে যাচ্ছেন, ‘শোন, যখন ফুল, তখন বানান হবে শিউলি। আর যখন রস পাড়ার লোক, কোমরে দড়ি, হাতে কলশি, তখন বানান হবে সিউলি!’
জোড়া পুকুরের মাঝখানের সরু পথ ধরে পণ্ডিতমশাই হাইস্কুলের মাঠের দিকে চলে যাচ্ছেন। টকটকে ফরসা। দীর্ঘ দেহ। পায়ে খদ্দরের মোটা চাদর। পায়ে খড়ম। শিশির-ভেজা ঘাসের ওপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন। মাঠের ওপর কুয়াশা ভাসছে। ভোর কেটে সূর্য উঠেছে। চোখের সামনে ভারী মজা। রোদ ওপর দিক থেকে কুয়াশা খেয়ে ফেলছে। লম্বা, লম্বা, রোদের রেখা নেমে এসেছে মাটিতে। নীচের দিকটা ঝাপসা, ওপর দিকে যেন আগুন লেগে গেছে। সেই অদ্ভুত আলোর মধ্যে দিয়ে ধীরে ধীরে একটা সাইকেল আসছে। মধুদা। সাইকেলের পেছনে দুপাশে দুটো দুধের ক্যান ঝুলছে। মধুদার মাথায় একটা কাপড় পাগড়ির মতো করে বাঁধা। কুয়াশা রোদের তাড়া খেয়ে দূরে দূরে পালাচ্ছে। আরও দূরের মাঠে। বকের ভাসায়। বিরাট বটের অন্তরঙ্গ শাখায়। দূরের শ্রীনাথদার চালাটা এখনও স্পষ্ট হয়ে ফুটে ওঠেনি। চালের ওপরের লাউগুলো ধপ ধপ করছে। শ্রীনাথদাকে ঝাপসা ঝাপসা দেখা যাচ্ছে। ব্লটিং-পেপারে আঁকা ছবির মতো। কাঠ কাটার শব্দ শুনতে পাচ্ছি। শ্রীনাথদার কাঠের গোলা আছে। আম কাঠ, জাম কাঠ, জারুল কাঠ। আর একটু পরেই আসবে হাঁসের পাল। হেলেদুলে। একটাই ভাষা প্যাঁক প্যাঁক। গামলার মতো ভাসতে থাকবে। ফুরফুরে বাতাসে জলে ফুটবে শিরশিরানি। সেই আনন্দ পেটের তলায় রেখে হাঁসেদের টহলদারি।
আকাশ আছে, শিশির আছে। জোড়া পুকুর আছে, হাঁস আছে, স্কুল বাড়িটা আছে, মাঠটা আছে। সেই শিশুটি নেই। আর একটু বড় একটা শরীরের তলায় চাপা পড়ে গেছে। সে এখন কিশোর। তার দৃষ্টি পালটে গেছে। কথায় পাক ধরেছে। পরিবেশ পুরোনো হয়ে গেছে। বিস্ময় হারিয়ে গেছে। কল্পনা ঢুকে গেছে বাস্তবে। তার অবস্থা তখন ঠেলাগাড়ির মতো। পৃথিবীর প্রবেশপথ যাঁরা খুলে দিয়েছিলেন, তাঁরা এইবার সদলে ভয় দেখাতে শুরু করেছেন। দুটো শব্দ জীবনে ঢুকে পড়েছে, পদার্থ আর অপদার্থ। যার টাকা আছে, সে পদার্থ। যার টাকা নেই সে অপদার্থ। সেই বিদ্যাই বিদ্যা, যে-বিদ্যায় টাকা হয়, গাড়ি হয়, বাড়ি হয়। সে চুরি-বিদ্যা হলেও আপত্তি নেই।
কিশোরের মগজ-ধোলাই হয়ে গেল। বিদ্যার বিনিময়ে জ্ঞান চাই না, চাকতি চাকতি টাকা চাই। আকাশ, বাতাস, নদী, বৃষ্টি, মেঘ, বক, সমুদ্র ঢেউ, পূর্ণচন্দ্র, ফালি চাঁদ, ঝকঝকে তারা, পাহাড় চূড়া, বরফ উজ্জ্বল এক ঝাঁক পায়রা, ওসব কবিদের জন্যে। কবিরা আবার ওই মশলা দিয়ে টাকা বানাবেন। যশ খ্যাতি, সভা, সেমিনার, পুরস্কার। একালে একটা নতুন তকমা পাওয়া যাচ্ছে, ‘সেলিব্রিটি।’ গান শিখলেই গাইয়ে হওয়া যাবে না। এক ধরনের সুরে অঙ্গভঙ্গি করে নাচতে হবে। তৈরি হবে ‘মিউজিক ভিডিও’! যাঁরা প্রকৃত ওস্তাদ তাঁদের কদর নেই। কায়দা করে ‘টপে’ উঠতে হবে। সমালোচক, ‘মিডিয়া’কে তোয়াজ করতে হবে। ব্যাপারটা এইরকম হবে। তুলবে, তুলবে তারপর ধপাস করে ফেলবে। সুতরাং পয়লা উপদেশ-করিতকর্মা হও। শোনো খোকা, ভালো মানুষ হয়ে লাভ নেই, চালু মানুষ হও। ধর্মও করো দু-নম্বরিও করো।
খোকা কলেজে গেল। তখন গুড়গুড়ে যৌবন। কুয়াশাভাঙা সকালে গ্রামের মাঠে দাঁড়িয়ে থাকা বালকটি নেই আর। সে তলিয়ে গেছে। চারপাশে ঝাঁঝা শহর। সিনেমার হোর্ডিং-এ মোহিনীমায়া। শরীরের জাদু। সেক্স ঢুকছে ছুরির ফালার মতো। প্রেমের জাদুদণ্ড। মনস্তাত্বিক বলছেন, আরে ওইটাই তো সব। জগৎ কামময়। সৃষ্টির উৎস হল কাম। ওইটাই হল ইঞ্জিন। আমি চাই। নারী চাই, বাড়ি চাই, গাড়ি চাই, কাঁড়ি-কাঁড়ি টাকা চাই। ভোগ চাই। ফ্রয়েড একটি শব্দ সে দেশ থেকে এ দেশে চালান করে দিলেন, ‘ইউ’। পাওয়ার হাউস অফ এনার্জি। প্রতিটি জীবের মধ্যে ঘাপটি মেরে আছে। এইখান থেকেই উঠছে আমার ‘আমি’-র ঢেঁকুর। এইখান থেকেই তৈরি হচ্ছে ‘লিবিডো’। কাম। কামের পেছনে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ, মাৎসর্য। বললেন, মানুষের সমস্ত প্রচেষ্টাই হল ‘সেকসচ্যুয়াল ড্রাইভ।’
সেই ড্রাইভার ঢুকিয়ে দিলে সংসারে। মিটে গেল ঝামেলা। ধিনতাকের ব্যাটা তিনতাক। যৌবন জলতরঙ্গে হাবুডুবু। আদম! তুমি ইভের দাস। বৃথা হম্বিতম্বি করো না। ইভ তোমার দাসী নয়। তুমি বাঘ মারবে। সেই সুন্দর বাঘছালে শোবে তোমার ইভ। তোমার সমস্ত বীরত্বের কারণ একটাই, তুমি ইভের চোখে ‘হিরো’ হতে চাও যাতে সে তোমাকে আরও ভালোবাসে।
শুরু হয়ে —গেল ‘এজিং’। পাকা চুল, টাক, কুঁচকে গেল দেহত্বক। চোখে আর সে আলো নেই। আয়নার সামনে এটা কে, ধান্দাবাজ, ধড়িবাজ। একে আমি চিনি না।
‘আমার সে কোথায় গেল?’
‘সে মরে গেছে। তুমিই তার হত্যকারী।’
আয়না হেসে উঠল, ‘তোমরা প্রত্যেকেই নিজেকে হত্যা করছ। আয়নার আদালতে এসে আততায়ীর মুখ দেখে চমকে উঠছ কেন?’
।। ২ ।।
এক ডায়মন্ড মার্চেন্ট। তাঁর একদিন মনে হল, টাকা-পয়সা, বাড়ি-গাড়ি, সবই তো হল; কিন্তু আনন্দ কোথায়! বোদা জেগে শরীরটাই গেদো হল। সবই কেমন যেন একঘেয়ে। মশাই! বলতে পারেন, আনন্দ কীভাবে পেতে পারি?
এটা কোনও কথা হল? বসে বসে টাকা গুনুন। অত সুন্দর বাড়ি, ছাত বাগান, বাগান-ছাতার তলায় বসার ব্যবস্থা, এই সব ঘুরে ঘুরে দেখুন। দেখতে দেখতে বলুন—এসব আমার, আমার। ব্যাবসা বাড়ছে, জোয়ারের জলের মতো টাকা বাড়ছে, আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দেখুন। চেহারায় কী চেকনাই!
আমার দাদা ছিলেন আরও বড় মার্চেন্ট। তিনখানা বাড়ি। টাকার শেষ ছিল না, হঠাৎ ফট হয়ে গেল।
তা যাক না, মানুষ অমর নয়। সবাই মরবে।
তখন তো সবই ফেলে যেতে হবে!
যাবেন, ড্যাং ড্যাং করে যাবেন। শ্রাদ্ধ হবে ঘটা করে। কঠোপনিষদ পাঠ হবে। কীর্তন হবে। আমরা সব মালা নিয়ে আসব। গরম গরম কচুরি, আলুর দম, ধোঁকা খাব। আপনার ছবি মালায়-মালায় চাপা পড়ে যাবে। আপনার বিয়েটা যেমন ‘মিস’ করেছি। ‘মিসেস’কে দেখা হয়নি শ্রাদ্ধে সেটা পুষিয়ে নোব। আমিষে প্রবেশ নিরামিষে প্রস্থান।
একটু ‘এক্সপ্ল্যানেসান।’
বিয়ের ভোজে মাছ, মাংস। শ্রাদ্ধে কেবল ধোঁকা। জীবন যে ধোঁকাবাজি সেইটাই বোঝাবার চেষ্টা।
বড্ড বকেন! জানতে চেয়েছি আনন্দ লাভের উপায়।
আপনি একবার করে বিয়ে করুন একবার করে ডির্ভোস। বিলেতের বড়লোকরা তাই করে।
আমার অত পয়সা নেই। বিয়ের চেয়ে ডিভোর্সে খরচ অনেক বেশি। মেন্টিনেনস কস্ট। বাড়ি দিতে হবে টাকা দিতে হবে। দিতে দিতে ভিখিরি।
আপনাকে একটা বাঙালি-বুদ্ধি দি। একজনকেই বারেবারে ডিভোর্স করবেন, বারেবারে বিয়ে! শুনুন, ‘মিলন আর বিচ্ছেদ—বিচ্ছেদ আর মিলন’-এর মতো আনন্দের আর কিছু নেই। আর বউ হল ‘ প্রেসাস ডায়মন্ড।’ একবার করে হারাবেন একবার করে পাবেন। হৃদয় আনন্দে ধক ধক করে উঠবে, তারপর একদিন হৃদয়াঘাতে অকম্প স্থির। বল হরি!
বলিহারি যাই আপনাকে। কী পরামর্শই দিলেন।
তাহলে দেখুন—অন্য কোথাও কিছু পান কি না! শুনেছি, বাঁধের ধারে যে-জঙ্গল সেই জঙ্গলে এক সাধু এসেছেন। সংসারীরা কি আর সুখের সন্ধান দেবে! সাধুদের কাছেই সুখ থাকে। যেমন গাছের ডালে বাবুই পাখির বাসা দোলে।
সত্যি, সত্যি একজন সাধু, বসে আছেন গাছের তলায়। সেই সৌম্যসাধুর সামনে বণিক এসে দাঁড়ালেন।
‘কী চাও?’
‘বাবা! আমার জীবনে এতটুকু সুখ নেই। আপনার কাছে সুখের সন্ধানে এসেছি।’
সাধু বললেন, ‘তুমি হিরের ব্যাবসা করো। তোমার হিরের পুঁটলিটা আগে আমার সামনে এইখানে রাখো, তারপর তোমার সুখের কথা।’
বণিক তাঁর হিরের ঝোলাটি সাধুর সামনে রাখামাত্রই তিনি সেটি নিয়ে দৌড় দিলেন গভীর জঙ্গলের দিকে। ‘এ কি রে ভাই। এ তো সাধু নয়, এ যে তস্কর’! সাধু ছুটছেন, তাঁকে ধরার জন্যে পেছনে-পেছনে ছুটছেন বণিক। সেই জঙ্গলের গোলকধাঁধায় সাধু নিমেষে অদৃশ্য। বণিক হাপরের মতো হাঁপাচ্ছেন—যা:, হয়ে গেল। ন্যাকামির শাস্তি হাতেহাতে মিলল! কি এমন অসুখে ছিল, যে সুখের সন্ধানে পাগল পাগল হলে!
যথেষ্ট শিক্ষা হল। মনের দু:খে বণিক ফিরে এলেন সেই গাছের তলায়। এ কী! এ কী দেখছেন! বসে আছেন সেই সাধু! মুখে মিটিমিটি হাসি। সামনে পড়ে আছে হিরের সেই পুঁটলি। সাধুর চোখ মুদিত। ধ্যানস্থ। তিনি কিছুই দেখছেন না।
কীসের সাধু, কার সাধু, কীসের সুখ, কার সুখ! ওই তো আমার সম্পদ। খপ করে পোঁটলাটা হাতে তুলে নিয়ে বণিক ধেই ধেই নাচছেন। যেন হরিনাম সংকীর্তন।
এইবার সাধু চোখ খুললেন। অতি মিষ্টি গলায় বললেন, ‘বাবা! তোমার ধন ফিরে পেয়ে সুখী হলে তো!’
বণিক সাধুর পায়ে পড়লেন।
অরণ্যচারী, সর্বত্যাগী সাধু তখন বললেন :
‘শোনো বাবা, আগে দু:খ-কষ্ট জানতে হবে, তবেই বুঝতে পারবে সুখ কাকে বলে! You have to know suffering ; only then you know what happiness is.
আগে দু:খ চাও পরে পাবে সুখ
।। ৩ ।।
এখন সংসার চালানোটা কেমন হয়েছে জানেন? লগবগ করে সাইকেল চালানোর মতো। একটু এদিক-ওদিক হলেই ধপাস।
তা চালাচ্ছ কেমন করে?
নিজের থেকে চলছে। শামুকের মতো গুটি গুটি। আমরা দর্শক মাত্র।
অর্থাৎ ভূতুড়ে ব্যাপার।
না, ব্যালেনসের ব্যাপার। পুজোর তিন মাস আগে থেকে একবেলা আহার।
সম্পূর্ণ বৈষ্ণব। লম্বা একটা ডাল। একতাল আলু ভাতে। সপরিবারে অম্বলের উপাসনা। পেটটা ফুলিয়ে দাও ভগবান। কারও অসুখ করলে, প্রথমে হোমিওপ্যাথি।
পারিবারিক গৃহচিকিৎসা খুলে কসরত। কত রকমের জ্বর। পেট থেকে জ্বর। বুক থেকে জ্বর, দাঁত থেকে জ্বর।
দাঁত থেকে জ্বর মানে?
মাথা থেকে। অসহ্য মাথা ধরা। শুয়ে পড়ো। এই ভুরুর কাছটা টিপে ধরছি। আরাম লাগেছে? না। আচ্ছা, রগ দুটো টিপে ধরছি। কী বুঝছ? খুব আরাম লাগছে! ভেরি গুড! ভেরি গুড নয়। চাপ আলগা হলেই ফিরে আসছে। ছেলেকে বললুম, মায়ের রগ দুটো টিপে ধরে বসে থাক। সে বললে, আহা। কাল আমার পরীক্ষা। আমার ধান্দা, যাতে ডাক্তার না ডাকতে হয়! স্ত্রীকে বললুম, তুমি কাত হয়ে শোও, আমি রগে একটা পেপার ওয়েট চাপিয়ে দি।
দেখো, আমি নিজে গীতায় পড়েছি—যোগ কর্মসু কৌশলম। কর্মের কৌশলকে বলে যোগ। যোগের পথেই ঈশ্বরকে পাওয়া যায়। শুনেছি, তাঁর বিরাট একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোর আছে। তিনি সন্তুষ্ট হলে, গাড়ি চাইলে গাড়ি, বাড়ি চাইলে বাড়ি।
এই সংবাদটি তোমায় কে দিলে। স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ।
না, ব্যাবসাদাররা। কী সব পুজোর ধুম। নেচে নেচে তারকেশ্বরে। বাবা কৃপা করলে কি না হয়। পঙ্গু গিরি লঙ্ঘন করে। অন্ধ খবরের কাগজ পড়ে। সাত বিঘে জমির ওপর সাততলা বাড়ি হয়। বউয়ের গলায় হিরের নেকলেস। ফেলু ছেলে আই.এ.এস। বোঁচা মেয়ের রাজপুত্তুর। এই তো পঞ্চার বউ বারের ব্রত করছিল, পঞ্চা ভুটান লটারির ফার্স্ট প্রাইজ পেয়ে ওপর দিকে উঠে গেল।
উঠে গেল মানে?
স্বর্গে চলে গেল।
সে কী?
শকে মরে গেল।
তা হলে আর কী হল?
ওই তো, ভগবান গরিবদের পছন্দ করেন না। পঞ্চাকে বড়লোক করে কাছে টেনে নিলেন। এখানে চান করত পানা পুকুরে জলে। ওখানে গায়ে আতর মেখে মন্দাকিনীর জলে চান করে। রম্ভা তোয়ালে দিয়ে গা মুছিয়ে দেয়। উর্বশী ককটেল সার্ভ করে। মেনকা পা টিপে দেয়। রাত্তিরে ইন্দ্রের পার্টিতে গিয়ে কুবেরের পাশে বসে। মহাদেব মোয়া খাওয়ান। বিষ্ণু পশ্চিমবঙ্গের শাসন ব্যবস্থা সম্পর্কে পরামর্শ করেন।
পশ্চিমবঙ্গে তো একটি রাজনৈতিক জোট দীর্ঘদিন শাসন করছেন। ব্রহ্মা-বিষ্ণু কী করবেন!
একটা ব্যাপার ভুল করো না। এই পৃথিবীর আদি প্রাোমোটার বিষ্ণু। তিনি আবার সায়েবদের বেশি পছন্দ করেন। ইওরোপ, আমেরিকার দিকটা ফাটিয়ে দিয়েছেন। কী ডেভালপমেন্ট! স্বর্গের ছাঁচে তৈরি। মানুষগুলোকে কি তৈরি করেছেন! সাদা, সাদা। আর মেয়েরা। ছবি দেখলেই আত্মারাম খাঁচা ছাড়া। জ্যান্ত সামনে এসে দাঁড়ালে হার্ট-ফেল। আমাদের দিকটা লর্ড বিষ্ণু একেবারে ‘নেগলেক্ট’ করেছেন। আমার চেহারাটাই দেখ না। বেঁটে বক্কেশ্বর। তামাটে গায়ের রং। জিশুখ্রিস্টের মতো লম্বা, লম্বা চুল রাখার চেষ্টা করেছিলুম। চুলের ‘বিউটিতে’ যদি ‘অ্যাপিয়ারেনস’ টা একটু খোলে। পাতকোর জলে চানের চোটে সামনের দিকটায় অচিরেই টাক পড়ে গেল। যত চুল ঘাড়ের দিকে। এখন সকলের দিকে পেছন ফিরে দাঁড়াই। যেই বলে, সামনে ঘুরে দাঁড়াও। আমি বলি, যা বলার বলে যাও, আমার পেছনটাই সামনে।
মানুষের যেমন ছিরি, দেশটারও সেইরকম ছিরি। এক হাঁড়ি দই নিয়ে ট্যাক্সিতে চেপে টালা থেকে টালিগঞ্জ যাচ্ছিলুম। ট্যাক্সিতে বসে বসে নাচছি। ব্যাঙের নাচ—’ফ্রগ ড্যানস’, ‘ ব্রেক ড্যানস’। যখন পৌঁছলুম, দই আর দই নেই ঘোল হয়ে গেছে। বেয়ান সেটি আমার মাথায় ঢেলে দিয়ে বললেন, ‘বাড়ি যান।’
আমরা লগবগ আর টগবগ করে বেঁচে আছি। একসময় ঘোড়া ছিল তুর্কি আর মোঘল রাজপুরুষদের বাহন। প্রজাদের বাহন গরু। গাধার পিঠে চাপতেও আপত্তি ছিল না। মোল্লা নাসিরউদ্দিনের বাহন ছিল গাধা। আমাদের দেবী শীতলা গাধাকে বাহন করেও জাতে তুলতে পারেননি। মা শীতলার পুজোয় গাধা-পুজোর কোনও মন্ত্র আছে কি?
আচ্ছা গাধারা সব গেল কোথায়?
বোধ হয় মানুষ হয়ে গেছে।
।। ৪ ।।
‘কী যে করা যায়?’
‘প্রশ্নটা কাকে করলে?’
‘যে উত্তর দেবে তাকে।’
‘তোমার এই প্রশ্নের উত্তর কেউ দেবে না, কারণ, উত্তর জানা নেই। কোনও রকমে বেঁচে-বত্তে থাক, যতদিন পারো, তারপরে প্যাঁট করে মরে যাও।’
‘প্যাঁট বললে কেন?’
‘পায়ের চাপে আরশোলা প্যাঁট শব্দ করে মরে।’
‘মানুষ কি আরশোলা?’
‘মানুষ আর আরশোলা পৃথিবীর প্রাচীনতম প্রাণী। মেরে শেষ করা যায় না। ঝ্যাঁটা, জুতো, লাথি, ইনসেকটিসাইড, পেস্টিসাইড সব ফেল মেরেছে। খেয়ে না খেয়ে হুড়হুড় করে বংশবৃদ্ধি করে চলেছে। ভাগাড়ে থাকতে পারে, রাজপ্রাসাদেও থাকতে পারে। কোনও খাদ্যেই অরুচি নেই।’
‘আমি আরশোলা নই, অমৃতের পুত্র। আমার ভেতরে তিনি আছেন।’
‘তিনি কিনি?’
‘পরম শ্রদ্ধেয় ভগবান। মানুষকে অত ছোট কোরো না। দু-চারটে ছোটলোক থাকতে পারে। সে যেমন গোবিন্দভোগে দু-চারটে কাঁকর।’
‘যুগ যুগ ধরে মানুষ অবশ্য এই রকমই বলে আসছে। মন্দিরে মন্দিরে ভগবান বন্দি। সকাল সন্ধে মন্দিরা বাজিয়ে গান শোনানো হচ্ছে। প্রহরে-প্রহরে ভোগ। সেদিন দেখলুম মদনমোহন ভোরবেলা টুথব্রাশ আর টুথপেস্ট দিয়ে দাঁত মাজছেন।
সেবককে জিগ্যেস করলুম, ব্যাপারটা কী হল? তিনি জানালেন, মর্ডান মদনমোহন। দিনে দুবার গ্রিন টি খান। শ্রীমতীর সপ্তাহে একবার ফেসিয়াল করা হয়। সেই কবে দ্বাপরে কৃষ্ণের সঙ্গে বৃন্দাবনে নাচতেন, তারপর তো আর নাচেননি। নাচের ভঙ্গি করে দাঁড়িয়ে থাকেন। এখন রোজ ফিজিও থেরাপিস্ট এসে আসন করাচ্ছেন। মদনমোহনের অ্যালার্জি। ওষুধ চলছে। মাঝে-মাঝে অম্বল হয়। চুলে ড্যানড্রাফ। অ্যান্টি ড্যানড্রাফ শ্যাম্পু ব্যবহার করেন। সকাল সন্ধে দুজনে টিভি দেখেন নিয়মিত। শীতকালে পিকনিক করেন। এসবের মানে?
দেবতাকে আমরা মানুষ ভাবি। মানুষকে দেবতা ভাবি না। আধুনিক যুগে মানুষকে দেবতা ভাবা অন্যায়, কুসংস্কার। মানুষ হল উন্নত পশু। শিকারি। হয় মারো, না হয় মরো।
প্রথম এবং শেষ কথা টাকা। টাকার জন্যে দোকান, টাকার জন্যে দেশসেবা। টাকার জন্যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, নার্সিংহোম। ভগবানকেও বেচে দাও। এক রাজা মদনমোহনকে বাঁধা রেখেছিলেন। যুধিষ্ঠিরবাবু দ্রৌপদীদিদিকে পণ রেখে জুয়া খেলেছিলেন।
মূর্তিচোরেরা ভালো-ভালো প্রাচীন দেবমূর্তি বিদেশে পাচার করে দিচ্ছে। দেবীর চোখে দামি পাথর বসানো ছিল, খুবলে তুলে নিল। অসহায় অন্ধদেবতা দেউলে।
কিচ্ছু করার নেই, কিচ্ছু করা যায় না। মানুষ নিষ্ঠুরতম প্রাণী। মানুষের সমাজ নিষ্ঠুর সমাজ। কে কার ওপর কী করে বসবে বলা যায় না। প্রেমের ফাঁদে মেরে ধরে বেশ্যালয়ে বেচে দিতে পারে। অবাঞ্ছিত শিশুটিকে ট্রামের আসনের তলায় পরিত্যাগ করে মেতে উঠতে পারে আবার রমণে। পাপ করলেও কিছু হয় না, পুণ্য করলেও কিছু হয় না। তীর্থযাত্রীর বাসই খাদে পড়ে। অবতারের মৃত্যু ক্যানসারে। ভগবানের মৃত্যু ব্যাধের বাণে।
এই পৃথিবীটা কেমন? প্রশ্নটা নিয়ে বিভিন্ন জনের কাছে যাওয়া যাক। অরিন্দম গান-পাগল। ভালো গান গায়। ভালো গুরুর কাছে শেখে। ‘অরিন্দম! পৃথিবীটা কেমন?’
‘তানপুরার মতো।’
‘বোঝাও।’
‘সা, পা, সা, এই তিন সুরে সব সুর ভরা। এই তিনটে সুর গলায় সেঁটে গেলে আর বেসুর হওয়ার ভয় নেই।’
সা আর পা। যেন জল আর ডাঙ্গা। যেন জীবন আর মৃত্যু। ‘সা’ তে সেধে যাই সারারাত। পায়ে পায়ে এগিয়ে যাই ভোরের ভৈরবীর দিকে। ভৈরবী কেন? রিক্ত, উদাস কোনও এক সকাল। কেউ আছে কেউ নেই। জীবন হল সমুদ্রের তীরে দাঁড়িয়ে থাকা। এক একটা ঢেউ আসছে। নানা বর্ণের ঝিনুক ছড়িয়ে দিয়ে যাচ্ছে। পর মুহূর্তেই সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
দিন যেন ঢেউয়ের মতো। রাশি রাশি জীবন যেমন রাখছে, ফিরছে না খালি হাতে, মুঠো মুঠো তুলে নিয়ে যাচ্ছে। অনেকেরই ভোর আর দেখা হয় না! একদিন না একদিন শেষ হবেই। সকাল তাই উদাসী।
কাল ছিলে আজ নেই কেন? ওই ‘নেই’ টাই সকলের শেষ পাওনা! তাই ‘পা’। সা আর পা। বাজে জীবন-তানপুরা সব সুরে।
জিগ্যেস করলুম আর একজনকে, ‘তোমার পৃথিবীটা কেমন?’
‘সে নতুন একটি মটরবাইকের মালিক হয়েছে। বললে, ‘পৃথিবীটা মোটরবাইকের মতো। গতি। ট্রিমেন্ডাস স্পিড, আর শব্দ। হুহু করে ছুটে চলা। দৃশ্যের পর দৃশ্য! এই এল, এই গেল। তারপর?
বাইকও নেই আরোহী নেই। কবরের নিস্তব্ধতা। শ্বেতপাথরের ওপর এক গুচ্ছ সাদা গোলাপ। যে আছে আর যে নেই তার মাঝখানে পড়ে থাকে এই মনে রাখার নিবেদন। মাপা জীবনের পরেও খানিকটা জীবন থাকে, তার নাম স্মরণ। ভিজে পায়ের ছাপ। ‘ছিল’টা সহজে ‘নেই’ হতে চায় না।’
তানপুরার তারে আঙুল ঠেকালেই সেই পরিচিত সুর, সা আর পা। আঙুল বদলে যায়, সুর বদলায় না। ‘তোমার পৃথিবীটা কেমন?’
‘সুন্দর, ভারী সুন্দর! এই দ্যাখো, এই এক টুকরো জমি পেয়েছি, ফুল ফুটিয়েছি। কত ফুল! কত রকমের, কত রঙের। এইটুকু-টুকু বীজ। মাটির কাছে এসে তার ঘুম ভাঙল, স্বপ্ন যেন জেগে উঠল গঠনে, বর্ণে, গন্ধে। এতটুকু! তারই মধ্যে অত সব। অবাক পৃথিবী! যা পেয়েছি, যা জেনেছি, তার পরেও আরও কত কী আছে কে জানে?’
।। ৫ ।।
‘তোমার পৃথিবীটা কেমন?’
রাজমিস্ত্রী ইঁট গাঁথতে গাঁথতে বললে, ‘গঠন! ইটের পরে ইট! ওপরে উঠছে। তিনতলা, চারতলা, পাঁচতলা। কয়েকদিন আগেও ছিলুম মাটির কাছাকাছি। আজ কত ওপরে! শূন্য থেকে কেটে কেটে বের করে আনছি, ঘরের পাশে ঘর, ঘরের ওপর ঘর, বারান্দা, করিডর। জমিটা বাস্তব, বাকিটা স্বপ্ন, আশ্রয়ের আশা।
মাঝিকে জিগ্যেস করলুম। ‘পৃথিবীটা কেমন?’
‘পারাপার। এ-পার, ও-পার। এ-পার থেকে ও-পারে যাওয়া, ও-পার থেকে এ-পারে আসা। সময় সময় বুঝতে পারি না আমি কোন পারের!’
নদীকে জিগ্যেস করলুম, ‘পৃথিবী কেমন?’
‘বড় কঠিন! তিনের চার জল দিয়েও একের চার স্থলকে নরম করা গেল না।
ডুবিয়ে দিলেও আবার মাথা তোলে। স্থলের অহংকারে পর্বত হয়, জলের অহংকারে সামান্য কটা আগোছালো ঢেউ, নিমেষে ভেঙে যায়!’
নিজেকেই প্রশ্ন করি, ‘বলতে পারো—পৃথিবীটা কার অহংকার?’
।। ৬ ।।
বলো গণতন্ত্র কাকে বলে?’
‘যে-তন্ত্রে জনগণের কোনও অস্তিত্ব নেই।’
ভেরি গুড। দশে দশ। আচ্ছা, এই বার বল, নির্বাচন কাকে বলে?’
‘নির্বিচারে বচন ঝাড়াকে নির্বাচন বলে।’
‘আবার দশে দশ। বল, আইন কাকে বলে?’
‘আইনের অনেক ধারা, যা হবে নয়ন ধারা।’
‘শাবাশ, দশে দশ! বল জামিন কাকে বলে?’
‘নেতা, আর অভিনেতাদের জেলে যেতে হয় না। ওই জামিনের জোরে জমিতে ঘুরে বেড়ায় সারা জীবন।’
‘কেয়া বাত! এবার বলো, শাসন কাকে বলে?’
‘এমন ব্যবস্থা, যাতে বদমাইশরা বাইরে থাকে সাধুরা জেলে থাকে।’
‘সংস্কৃতি কাকে বলে?’
‘সব রকমের দুস্কৃতিকে সংস্কৃতি বলে।’
‘নির্বাচনী পথসভার বক্তৃতা কে শোনে?’
‘যিনি বলেন তিনিই শোনেন।’
‘নেতা চেনা যাবে কী করে?’
‘সমস্ত মানুষ যাঁর চোখে ন্যাতা, তিনিই নেতা।’
‘পুলিশদের কর্তব্য কী?’
‘লরির দিকে শ্যেন দৃষ্টি রাখা।’
‘রাজনীতির প্রধান অস্ত্র কি?’
‘বনধ!’
‘বনধ কত রকমের?’
‘লেজিটিমেট আর ইললেজিটিমেট।’
‘ব্যাখ্যা?’
‘স্বামী সহবাসে যে-সন্তান উৎপন্ন হয় তা বৈধ। পরপুরুষের সন্তান অবৈধ। শাসক দল যে-বনধ উৎপাদন করেন তা বৈধ! বিরোধী দল যে-বনধ উৎপাদন করেন তা অবৈধ।’
‘অবৈধ নিবারণের উপায়?’
‘অ্যাবরসান। তলপেটে কোঁৎ করে কোঁতকা মেরে খসিয়ে দেওয়া।’
‘মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর সম্পর্ক কবে মধুর হবে?’
‘যবে মুখ্যমন্ত্রী প্রধানমন্ত্রী হবেন।’
‘পশ্চিমবাংলা থেকে কেউ প্রধানমন্ত্রী হতে পারেন না কেন?’
‘ভারতের মানচিত্রের দিকে তাকান। মাথা হল উত্তর ভারত। পা হল দক্ষিণ। পেট হল বিহার। পশ্চিমবাংলা হল অ্যাপেন্ডিক্স। সেখানে চির-অ্যাপেন্ডিসাইটিস। বাবা-রে, মা-রে অবস্থা।’
‘নেতারা কখনও কেন গরিব হন না?’
‘কারণ তাঁদের টাকা ব্যাগে থাকে না, থাকে জনসাধারণের পকেটে-পকেটে।’
‘নেতা হতে হলে কী করতে হবে?’
‘প্রথম প্রথম খুব চেল্লা-চিল্লি করতে হবে, তার পরে বোবা আর কালা হয়ে যেতে হবে।’
‘আমাদের ভবিষ্যৎ কী হবে?’
‘ভলিবল খেলা। ওদিক থেকে আসবে, টুক করে পেছন দিকে টপকে দিতে হবে। ভবিষ্যৎ একটা ভাবনা। ভাবলে আছে, না ভাবলে নেই।’
‘আমাদের কর্তব্য?’
‘বাঁচতে বাঁচতে মরে যাওয়া।’
‘বার্তা কি?’
‘মরতে ভুলো না—জিন্দাবাদ!’
।। ৭ ।।
এইবার বলুন, আপনাকে কত টাকা দিতে হবে? আমাদের পরিবার তো দেখলেন। অ্যাডাল্ট তিনজন, দুটো বাচ্চা।’
‘দুবেলা রাঁধতে হবে?’
‘হ্যাঁ, দুবেলা।’
‘দেড় হাজার দেবেন। পুজোর সময় এক মাসের মাইনে বোনাস। কাপড় তো দেবেনই, বলার কিছু নেই। শীতের চাদর। রাত্তিরে ভাত না রুটি?’
‘দুজনের ভাত, বাকি সবাই রুটি।’
‘কখানা রুটি?’
‘ধরুন কুড়িখানা।’
‘বাবা, তিনজনে কুড়িখানা!’
‘তিনজনে অ্যাভারেজে বারোখানা।’
‘বাকি আটখানা?’
‘বলছি। ওই যে ছোট মেয়েটা খুচখাচ কাজ করে, ও রাত আটটার সময় বাড়ি যায়। আটখানা রুটি আর তরকারি ওকে দিতে হয়।’
‘তা হলে বড় তিনজন নয় চারজন। সকালেও তো খাবে?’
‘সকালে তো ভাত খাবে।’
‘বা:, ভাতের হাঁড়ির ওজন তো বেড়ে যাবে। আনাজ বেশি কাটতে হবে। রুটির আটা মেয়েটা মেখে দেবে?’
‘না। ও শুধু ফাইফরমাস। সেইরকমই চুক্তি।’
‘লুচি, পরটার বায়নাক্কা আছে নাকি?’
‘মাঝেমধ্যে।’
‘তা হলে তো ছোলার ডালও আছে। ধোঁকার বাতিক?’
‘রেয়ার। মাসে একবার কি দুবার।’
‘মোচা, এঁচোড়, থোড়?’
‘আছে।’
‘বাবা, তেরোস্পর্শ! মাছ, চারা না কাটাপোনা?’
‘বাচ্চাদের জন্যে কাটাপোনা বাঁধা, পাশাপাশি বাটা, পারসে, পাবদা, ট্যাংরা, মোরলা, পুঁটি, চিংড়ি, কাজরি।’
‘অত খান কেন? সঞ্চয় করুন, সঞ্চয় করুন। গুচ্ছের খাওয়া একটা বদঅভ্যাস। চা কি আমাকে করতে হবে?’
‘সকালের চাটা তো করতেই হবে।’
‘জল খাবার?’
‘সকালের জলখাবার।’
‘ফিরিস্তি বেড়েই চলেছে। আত্মীয়-স্বজনদের আসার হিড়িক আছে?’
‘তা তো আছেই।’
‘মাসে কবার?’
‘ওই দুবার, গরমের ছুটি, পুজোর ছুটি।’
‘কজন?’
‘চার-পাঁচজন। আর মাঝেমাঝে মেয়ে আসতে পারে শ্বশুরবাড়ি থেকে।’
‘কটা মাথা?’
‘বড় মাথা একটা, ছোট মাথা দুটো।’
‘তা হলে দু’হাজার।’
‘দুহাজার?’
‘শুনুন সকালে আমি তিন বাড়িতে রাঁধি। ভোর পাঁচটায় যে-বাড়িতে ঢুকি, স্বামী, স্ত্রী দু’জনেই কাজ করে আর একটা বুড়ি।’
‘বুড়ি মানে?’
‘বুড়ি মানে ছেলের মা। সে বিশেষ কিছু খায় না, খালি ওষুধ খায়। রান্নার মধ্যে এক তরবারি, ডাল, ভাত। ঝপাঝপ দুবেলার রান্না শেষ করে বেরিয়ে এসেই দ্বিতীয় বাড়ি। এই বাড়িটা ছেড়ে দোব। ভীষণ খিটখিটে। ছেলের বউটা খাণ্ডারনী। একমাস হল এসেছে। শ্বশুরবাড়ি থেকে একটা কুকুর এনেছে, আমাকে দেখলেই গড়ড়, গড়ড়। বউ বলে, কুকুর বুঝতে পারে কার কেমন চরিত্তির! ওই বাড়িটার জায়গায় এই বাড়িটা ঢুকবে।’
‘কটায় ঢুকবেন?’
‘সাতটায়।’
‘বেরোবেন কটায়?’
‘সাড়ে আটটায়।’
‘দেড় ঘণ্টায় সব হয়ে যাবে?’
‘সব আবার কী! এসেই এক ফ্লাস্ক লিকার করে একপাশে ঠেলে রেখে দোব। যে খায় খাবে। তারপর দুটো গ্যাস চড়া করে জ্বেলে, ঝপাঝপ একটায় ভাত, একটায় ডাল। তারপর ছ্যাকছোঁক মাছের ঝাল। আউট। বাকি সব ভিরকুটির রান্না নিজেরা করে নেবেন। সারাটা দিন পড়ে আছে।’
‘একটুও প্রেম নেই?’
‘আমি তো প্রেম করতে আসিনি, রাঁধতে এসেছি। আজকাল বিয়ে করা বউতেই প্রেম থাকে না। স্বামীগুলোও সব মাকাল ফল।’
‘এক হাজারে হয় না?’
‘তা হলে দু’হাজার পড়ে যাবে।’
‘কীরকম?’
‘পনেরো দিন আসব, পনেরো দিন আসব না। ইনকিলাব জিন্দাবাদ।’
।। ৮ ।।
‘দেশটা কি সত্যিই এতটা খারাপ হয়ে গেল!’
এই রে পাগল আজ সাতসকালেই বেরিয়ে পড়েছে। খবরের কাগজ পড়ার ফল। এন আর এস-এর ক্যান্টিনে যা হচ্ছে হোক না। জুনিয়ার ডাক্তারদের মেরে রক্তারক্তি করে দিয়েছে। খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে ছবিটা দেখার দরকার কী! ল্যাংড়া আম খাচ্ছ খাও না। তপসে মাছ জামাইষষ্ঠী করে গেছে। মহরত হয়ে গেছে। দু’চারটে ফ্রাই শ্বশুরমশাইরা এখন টেস্ট করে দেখতে পারেন। বেশ মুচমুচ। এক রাউন্ড বৃষ্টি হয়ে গেলেই চোঁচাঁ করে ইলিশ এসে গঙ্গায় ঢুকবে। ট্যাঁকের পাওয়ার থাকলে খাবেন। তা না থাকলে ‘এফ-এম’-এ আলোচনা শুনবেন। মনে রাখতে হবে, বাঙালিরা ইন্টেলেকচ্যুয়াল-জাত। সভা, সমিতি, সেমিনার, ডিবেট, সোনার গয়না, নেল পালিস, মাস্ক, বিউটি পারলার, শ্যাম্পু।
‘দাদা! দেশটা কি সত্যিই গেঁজে গেল?’
‘জানি না।’
‘এই যে অন্ধকার ময়দানে মেয়েটাকে খুন করলে!’
‘যে মেয়ে একটা পুরুষের সঙ্গে রাত দশটায় ময়দানে যায় তার সেফটি সম্পর্কে আমাদের বলার কিছু নেই।’
‘তাহলে ওই যে লোকটি, যাকে সবাই মিলে জ্যান্ত পুড়িয়ে মেরে ফেললে, বললে, হাপিস হয়ে গেছে। মাঝে-মাঝে হারিয়ে যায়। তারপরে একটা পোড়া কঙ্কাল পরিবার পরিজনের হাতে দিয়ে বলে যান, পুড়িয়ে দেন। যেটুকু বাকি আছে কমপ্টি করে দিন।’
রং পলিটিকস করলে ওইরকমই হবে। মনে নেই ওরঙ্গজেব ভাইয়ের মাথা কেটে খানা টেবিলে সোনার থালায় সাজিয়ে রেখেছিল। নিজের বুড়ো বাপকে শেকল দিয়ে বেঁধে রেখেছিল। সিংহাসন হল সিংহের আসন।
সেই আসনে ছাগল বসে ব্যা ব্যা করলে পাবলিকই তো হাসবে। রাজত্বের প্রেসটিজ চলে যাবে। রাজনীতি হল সাপ নিয়ে খেলা। হিম্মৎ থাকা চাই।
‘গুজরাট?’
‘আজ্ঞে না। বাঙালিকে মারা অ্যালাউড। মশা, মাছি মারলে জেল হয়?’
‘না। যদি তোমাকে মেরে ফেলে?’
‘মারবে না। আমি কোড মেনে, ট্র্যাফিক আইন মেনে জীবনপথে চলি। দুহাত তোলাই আছে। দেশের সঙ্গে আমার কী সম্পর্ক? আমি আমারটা বুঝি। এর বাইরে আমার কিছু বোঝার দরকার নেই। স্ত্রী, পুত্র, পরিবার, রোজগার। ব্যাস! মিটে গেল মামলা।’
‘তোমার মেয়ের ওপর যদি অত্যাচার হয়?’
‘হবেই না। কারণ আমার মেয়ে নেই। বৈজ্ঞানিক উপায়ে মেয়ে আসার পথ বন্ধ করে দিয়েছি। একটা ছেলে ব্যাঙ্গালোরে মানুষ হচ্ছে। মেয়েদের ওপর অত্যাচার হবে না তো কার ওপর হবে? গলাবাজি করে কোনও লাভ নেই। লজ্জার ব্যাপার চেপে রাখতে হয়। পাঁচ কান করতে নেই।’
‘তাহলে, ওই যে দুই মাস্টার। হেডমাস্টার কেটলি মেরে অ্যাসিস্টেন্ট হেডমাস্টারের মাথা কানা করে দিলেন!’
‘তাতে আপনার কী? আপনার কোন পাকা ধানে মই দিয়েছে? নিজেকে নিয়ে থাকতে শিখুন। অয়েল ইওর ওন মেশিন।’
‘দাদা! দেশটা তাহলে সত্যিই উচ্ছন্নে গেল?’
‘যদি গিয়েই থাকে আপনি কি করতে পারেন? বাড়ি যান। পাখার তলায় বসুন। বাইরে তাকাবেন না। নিজের ভেতরটা দেখুন। গান করুন—ঘুমপাড়ানি মাসি-পিসি ঘুম দিয়ে যাও। বাটাভরা পান দেব, বসে বসে খাও।’
।। ৯ ।।
ঘরে ঘরে একটা করে বাক্স বসান। তার ভেতরে দিন-রাত দাঙ্গা হাঙ্গামা, খুন খারাপি। চুল এলিয়ে কোমর দুলিয়ে বিবসনাদের নাচ। পাশের ঘরে গলা টিপে খুন। তার পাশের ঘরেই আগুন। তার পাশের ঘরে প্রেম। তার পাশের ঘরেই রেপ।
বন থেকে বেরল টিয়ার মতো বাক্সফুঁড়ে চরিত্ররা সব ছড়িয়ে পড়েছে সারা বাংলায়। রাত্তির বেলা সব নাচতে নাচতে চলেছে।
‘কোথায় চললে বাবাসকল?’
‘কাকাবাবু নিদ্রা আসছে না বুঝি? আমরা ডাকাতি করতে যাচ্ছি।’
‘তোমরা কোথায় চললে?’
‘মেসোমশাই দু-বোতল টানার পর মেজাজ এসে গেল, যাই একটা মেয়েকে তুলে কলেজের মাঠে রেপ করে নর্দমায় ফেলে দিয়ে আসি।’
‘সে কী?’
‘চমকে উঠলেন? ঝালমুড়ি খাওয়ার পর ঠোঙাটা কোথায় ফেলে? টাটা।’
‘তোমরা কোথায় চললে?’
‘শ্রেণি সংগ্রামে। ওই দোকান বন্ধ করে বেরবে, গোটাকতক পাম্প করে দোব।’
‘পাম্প মানে?’
‘বুলেট পুরে দোব।’
‘মরে যাবে যে!’
‘ও অনেক দিন বেঁচেছে, এইবার একটু রেস্ট করুক।’
‘তোমরা চললে কোথায়?’
‘আজ্ঞে প্রাোমোটার শিকার করতে।’
ত্রাসের পরে এসে গেছে সন্ত্রাস। সেটা কী? পাইকিরি দরে মানুষ মারা।
‘কেন ভাই?’
‘সব শ্মশান করে দোব।’
‘আপনারা কী করছেন?’
‘কেন মাইলের পর মাইল বক্তৃতা। তারপর বনধ। তারপর বনধ-বনধ করার জন্যে এলাহি ব্যবস্থা।
‘তারপর?’
‘রাত্তির বেলা ওই বাক্সে ঢুকে বনধ অসফল করার জন্যে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আমরা বনধ সফল করার জন্যে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।’
‘আপনারা কারা?’
‘কেন? কেন? আমরা শাসন করি।’
‘আর, আমরা শাসনের বিরোধিতা করি।’
‘রেজাল্ট?’
‘গলাবাজি ভার্সাস গলাবাজি। মার আর মারি। মারামারি।’
‘দেশ?’
‘ও বাবা! সেকেলে বুড়োটা সেন্টিমেন্টের কথা বলছে! ও মশাই দেশ আবার কী? বলুন, সন্দেশ—কড়াপাক, নরম পাক, কাঁচাগোল্লা, মাখা।’
।। ১০ ।।
কী চাই?
শান্তি আর আনন্দ! সুখ চাই। বেশ সুখে, শান্তিতে, আনন্দে বাঁচতে চাই।
যাঁরা সাধক, যাঁরা ভগবানের মহল্লায় ঘোরাফেরার করেন, তাঁরা বলবেন, আনন্দ? তুমি তো নিজেই আনন্দস্বরূপ। ভগবান এক বিরাট আনন্দ, মানুষ সেই আনন্দেরই টুকরো। মানুষের স্বভাবই আনন্দ। নতুন করে তুমি কোন আনন্দ তৈরি করবে, তুমি শুধু বেঁচে থাকো। তুমি আনন্দের তারে ঈশ্বরের বিদ্যুপ্রবাহে বালবের মতো জ্বলে থাকো। ফিউজ হয়ে যেও না।
কিন্তু সারা পৃথিবীটা যেন একটা জঘন্য জায়গা। বেঁচে থাকাটা একটা মহা ‘পানিশমেন্ট’। টাকা, পয়সা, বিষয়, সম্পত্তি, হ্যানা-ত্যানা সুখও দিতে পারে না, শান্তিও দিতে পারে না। সর্বত্রই ভূত-প্রেতের নৃত্য। কামড়া কামড়ি, আঁচড়া আঁচড়ি। সুখে সুখী।—এত সহজ কথা। সুখ তো ভোরের শিশির। চড়া রোদে আর নেই। জীবন যেন দু:খের পরটা। পরতে পরতে গ্যাদগ্যাদে অশান্তি, উৎকণ্ঠা। সেই টেকনিক রপ্ত করতে হবে—দু:খে সুখী। আমার ভেতরে সুখ। দু:খ আমার করবেটা কি? ইংরিজিতে দুটি শব্দ আছে—’হ্যাপিনেস’ আর ‘ব্লিস’। সুখ আর প্রশান্তি। সুখ আছে বাইরে, প্রশান্তি আছে ভেতরে।
এসব অনেকদিনের অনেক পুরোনো কথা। অর্থাৎ ‘মা’-এর দরজা দিয়ে ট্যাঁ-ভ্যাঁ করে পৃথিবীতে প্রবেশ করেই মানুষ দেখল, একগাদা বিচ্ছিরি-বিচ্ছরি মানুষ আসর সাজিয়ে বসে আছে। মুগুর ঘুরিয়ে, মুলোর মতো গজাল, গজাল দাঁত বের করে শাসন করছে; ফেমাস, ফেমাস সব রাক্ষস আর অসুর। বকাসুর, অঘাসুর, বৃত্রাসুর, মহিষাসুর। ‘হিরোইন’ পুতনা। মিস পুতনা, মিস হিড়িম্বা, মিস সূর্পনখা।
সেই যুগের ‘সেনসাস রিপোর্টে’ পাচ্ছি কয়েকটি বিভাগ—অসুর দৈত্য, দানব। এঁরা হলেন ঋষি, মুনিদের পদস্খলন বংশধর। ধুনি জ্বালিয়ে জপ, ধ্যান করতে করতে মশার কামড়ে অস্থির আর উত্যক্ত হয়ে, ধ্যাত তেরিকা বলে এমন সব কাণ্ড করলেন দমাদ্দম এসে গেল ‘সিরিজ অব রাকসস।’ দাঁত আর মুখের গঠন অনুসারে গোত্রবিভাজন—অসুর, আসুরী, দানব, দানবী, দৈত্য। মানুষ কাঁদতে-কাঁদতে জন্মায়, অসুররা হা: হা: করে হাসতে-হাসতে জন্মায়। দানবীয় হাসি। এরা সব সময় ‘ইন টার্মস অফ মৃত্যু’ কথা বলে। ‘শোলের’ গব্বর। ঋষি কন্যা, দেবকন্যাদের ধরে এনে ঠ্যাং চিবোতে-চিবোতে নাচ দেখে। এদের গুরু হলেন ‘শুক্রাচার্য।’
কম্পিউটারের যেমন ‘ফার্স্ট জেনারেশান’, ‘সেকেন্ড জেনারেশান’ ইত্যাদি আছে সেইরকম অসুরদেরও ‘ফার্স্ট জেনারেশান’, ‘প্রেজেন্ট জেনারেশান’ আছে। দেবতারা সব ‘স্ট্যাটিক’। তাঁদের কোনও ‘ডেভালাপমেন্ট’ নেই, অগ্রগতি নেই, পরিবর্তন নেই। চার মাথা ব্রহ্মা। পাঁচ মাথা মহাদেব, চার হাত বিশিষ্ট নারায়ণ। ইন্দ্র, কুবের, কাতির্ক, এঁদের কোনও ক্যালেন্ডার-চিত্র নেই। মুম্বাইয়ের ক্রিকেটার শচিন আর গণেশ সমান পপুলার। মহাদেবের মার্কেট ভীষণ ভালো ‘নারকোটিকসের’ কৃপায়। শ্রীকৃষ্ণ ‘টপ’-এ আছেন। শ্রীমতী রাধিকা তাঁকে ফেভার করেছেন। কিন্তু এঁরা সব ছবি হয়েই রয়ে গেলেন মানুষ হতে পারলেন না। অসুররা সেই আদিযুগ থেকে আধুনিক যুগ পর্যন্ত বিকাশের ধারাবাহিকতা নির্মমভাবে বজায় রাখতে পেরেছেন। বল্কলধারী, খোঁচা খোঁচা চুল, কাঁচা খেকো, দুর্গন্ধী রাক্ষস থেকে আধুনিক পোশাকধারী ফিটফাট। বিলিতি সুগন্ধীর সুবাস অঙ্গে। পেটে কলকলে স্কচের কলরব। শরীরে লেপ্টে আছে রুপালি রূপসি।
সর্বাঙ্গে ‘সেলফোন’। এটায় দুবাই, ওটায় ব্যাংকক, সেটায় সিঙ্গাপুর। যেমন খেতে পারে সেইরকম মাল টানতে পারে, ‘হেভি সেক্স’ আর একটাই কাজ—অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে বাঘের বদলে মানুষ মারো। ‘ওয়াইল্ড লাইফ প্রাোটেকশান অ্যাক্ট’ অনুসারে একটা ছুঁচো মারাও অপরাধ। মানুষ মারার কোনও অপরাধ হয় না, বরং পুণ্য হয়। কাপালিকরা নরবলি দিত। হিন্দুরা কাঁচা কাঁচা টাটকা বউদের বুড়ো, আধবুড়ো স্বামীর চিতায় তুলে দিয়ে ‘হরি হরি’ বলে ক্যানিবল নাচ নাচত। মানুষ তো মরার জন্যেই জন্মায়। অর্জুন বলছেন ‘সখা! মানুষ আমি মারতে পারব না। আমার হাত কাঁপছে পা কাঁপছে।’ শ্রীকৃষ্ণ বললেন, ‘ননসেনস! আমি ভগবান বলছি, কেউ বেঁচে নেই। আমি সব মেরে খাড়া করে রেখেছি, দুর্গাপুজোর আগে নতুন বাজারের আখের মতো। তুমি শুধু এক ধার থেকে দমাদ্দম নামিয়ে দাও। ব্রাদার। জন্ম নেই, মৃত্যু নেই, দু:খ নেই, শোক নেই, অনুশোচনা নেই, পাপ নেই, পুণ্য নেই।’
‘দাঁড়াও দাঁড়াও সখা, সবই তো নেই করে দিলে, আছেটা কী?’
‘আছে একটা মজা।’
‘সেটা কী?’
‘সেটা হল—’আছে’ মনে করলে ‘আছে,’ ‘নেই’ মনে করলে ‘নেই।’ এই অব্দি এসে প্রশ্ন হল, ‘সুখ শান্তি, আনন্দ কীভাবে পাওয়া যায়!’
স্বামীজি শিষ্যকে বলছেন,
‘ত্যাগ ভিন্ন এই গভীর জীবনসমস্যার রহস্যভেদ কিছুতেই হওয়ার নয়। ত্যাগ ত্যাগ ত্যাগ। সধং বস্তু ময়ামিতং ভুব ঘৃণাং বৈরাগ্যসেবাভয়ং।’
।। ১১ ।।
দুনিয়াটা ভগবানের চিড়িয়াখানা। সবাই শুনেছি। আগেও শুনেছি, পরেও শুনব।
প্রশ্ন হল, ভগবান কে? ঐশ্বর্যশালী কেউ একজন। চৌরঙ্গী কী আলিপুরে কয়েক কাঠা জমির ওপর যার একটা বাড়ি আছে, সে তো সাংঘাতিক বড়লোক। গেটে উর্দিপরা দারোয়ান। ভেতরে তিনটে অ্যালসেসিয়ান। দোলায় দোল খাচ্ছে বোম্বাইমার্কা ফুলুফুলু মেয়ে। গোটা দশ-বারো মানুষের সঙ্গে তার ওঠাবসা। সারাদিন চাঁদির চাকতির ধান্দা। রাতে সায়েবদের ফেলে যাওয়া ক্লাবে পানভোজন। মধ্যরাতে ব্যারেল হয়ে বাড়ি ফেরা।
তাহলে? ভগবানের ঐশ্বর্যটা ভাবা যায়! সারা পৃথিবীতে ক বিঘে জমি আছে? হিসেবে করে দেখেছে কেউ। গোটা ভূমণ্ডলের মালিক। সূর্য তাঁর, চন্দ্র তাঁর, এক আকাশ তারা। সাতটা সমুদ্রের মালিক। এভারেস্ট তাঁর মঁ ব্লাঁ তাঁর। চার-পাঁচটা বালিভরা বিশাল মরুভূমি। আবার কত বড় দাতা! নি:শর্তে সব দান করে দিয়েছেন মানুষকে।
ভগবান যে মানুষের সঙ্গে মেলামেশা করেন না, মন্দিরে-মন্দিরে মূর্তি হয়ে বসে আছেন, তার একটা অর্থ বোঝা যায়। অতবড় একজন মানুষ, তাঁর সমকক্ষ না হলে মেশেন কী করে। রাজা রাজার সঙ্গেই খানা খাবেন। মাঝেমধ্যে সময়ের অনেক অনেক ব্যবধানে, তাঁর প্রতিনিধি অবতার হয়ে আসেন। কেউ আসেন জ্ঞান নিয়ে, কেউ আসেন প্রেম নিয়ে। কুকুরের বাঁকা লেজ সোজা করার ব্যর্থ চেষ্টায় কেউ কঙ্কালসার বুদ্ধ, কেউ দুহাত তুলে নাচতে নাচতে, প্রেম বিলোতে বিলোতে, জগাই মাধাইয়ের ছোড়া কলশির কানা উপেক্ষা করে সোজা সমুদ্রে বিলীন। কেউ ঝুলে গেলেন ত্রুশে, চিরকালের সিম্বল। মানুষের ভালো করতে চেয়েছ, কি মরেছ।
ভগবানের অন্য সব জন্তুজানোয়ারদের স্বভাব চরিত্র খুবই সহজ সরল। বোকা ছাগল মানুষের পেটে যাবে। বোকা পাঁঠার গায়ে বোটকা গন্ধ। সুযোগ পেলেই গুঁতোতে আসবে। রামছাগলের দার্শনিকের মতো চোখ, ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি হতে পারত, যদি একটু কষ্ট করে সেলুনে যেত। তার জীবনের একটাই দর্শন, পাতা, শালপাতা, কাগজ, কাপড় যা পাবে, মুখে পুরে আধবোজা চোখে সারাদিন চিবিয়ে যাও। ছাগল মাংস হবে, দামি জুতোর চামড়া হবে।
ভেড়া আবার পরোপকারী। মাংস তো দান করবেই। গায়ের লোম দান করে ভগবানের দেওয়া শীত থেকে মানুষকে উষ্ণতা দিয়ে আরাম দেবে। ফুটপাথের মানুষকে নয়, হর্ম্যতলের হরেকরকম মানুষকে। আর একটি শৌখিন জিনিসও ভেড়া মানুষকে দেয়, নিজে যতই ভেড়া হোক না কেন? সেটি হল উলফ্যাট, অন্য নাম ল্যানোলিন। দামি ফেসক্রিমে ল্যানোলিন থাকে, সোজা সুন্দরীদের গোলাপি গালে। এটাও জানা আছে, রাগি ভেড়া স্ট্রেট লাইনে ছুটে এসে এমন ঢুঁ মারতে পারে, মরে যাওয়াও অসম্ভব নয়। এ ছাড়া ভেড়ার আর কোনও ইজ্জত নেই।
বাঘের একটা সৌন্দর্য আছে ঠিকই, কিন্তু নিজের কোনও সৌন্দর্য বোধ নেই। সুন্দরী হরিণ দেখলেই হল। ঝোঁপঝাড় ভেঙে মাইলের পর মাইল দৌড়। ঝাঁপিয়ে পড়বে ঘাড়ে। সামান্যমাত্র কবিত্ব নেই! আহা! অমন চোখ, এত সুন্দর চামড়া! তাতে কী, কড়মড় চিবোও। বাঘের মতো আধ্যাত্মিকতা সব তার ছালে। মহাদেব পরে আজও ঘুরছেন। বাঘছালে না বসলে তান্ত্রিকের কুলকুণ্ডলিনী জাগবেই না। আর কুণ্ডলিনীশক্তি না জাগলে ভগবানের দরবারে যাওয়াই যাবে না। বাঘ হল জঙ্গলের রাজা। বিউটি।
সিংহ একেবারে অন্যরকমের। মাথার দিকটা অবশ্যই বিউটিফুল। কেশর-ফেসর নিয়ে যেন মহাকবি। দেহের নীচের দিকটা বিশ্রী। সিংহ বাঘের মতো অত খাব-খাব করে না। কখন কী করে জানাই যায় না। একা থাকতে ভালোবাসে। তা ছাড়া সিংহের সম্মান বাড়িয়েছেন দেবী দুর্গা। সিংহ যদি পিঠ পেতে না দিত, মা দুর্গার ডান পাটা থাকত কোথায়। আবার অসুর। মরবে জেনেও এমন ভদ্রতা বুক পেতে দিয়েছে যাতে মা বাঁ-পাটা রাখতে পারেন, টাল খেয়ে পড়ে না যান, ঘটমট, চালচিত্র-ফালচিত্র নিয়ে হুড়মাড় করে। মায়েরও ছিরি কী, ওটা একটা যুদ্ধের পোজ হল! একে তো নিজে হ্যান্ডিক্যাপড। দশটা হাতের ঠেলায় হিমসিম অবস্থা। হাত আর অস্ত্রশস্ত্রের জট ছাড়াবেন না যুদ্ধ করবেন। অসুর শুধু দয়াপরবশ হয়ে এবং মায়ের অমন রূপে কিছুটা কামমোহিত হয়ে ছাপ্পান্ন ইঞ্চি বুক চিতিয়ে মায়ের পদতলে—নাও মা, তোমার টিনের তৈরি বরশার খোঁচায় আমাকে ফিনিশ করে দাও। অত:পর পৃথিবীতে যা হবে, তার ইন্ট্রোডাকশান, ভূমিকাটা হয়ে থাক। নারীর সঙ্গে সংগ্রামে পুরুষ কোনওদিন জয়ী হতে পারবে না। পুরুষ জাতির এই নিয়তি।
সিংহ দেবীর বাহন। তার একটা আলাদা সম্মান জীবজগতে। মা দুর্গার সঙ্গে সিংহের পূজা হয়। গণেশের সঙ্গে গণেশের ইঁদুরের, মা লক্ষ্মীর সঙ্গে প্যাঁচার, কার্তিকের সঙ্গে ময়ূরের, মা সরস্বতীর সঙ্গে হাঁসের।
ভগবানের চিড়িয়াখানায় হাতি এক বিশাল ব্যাপার। কয়েক টন ওজন। ব্রেকফাস্ট আর লাঞ্চে গোটা একটা কলাবাগান শেষ। রাজা, মহারাজাদের বাহন হত একসময়। যুদ্ধেও যেত। ঊনবিংশ ও বিংশ শতকের প্রথম পাদে হাতিতে হাওদা চড়িয়ে শোলার হ্যাট মাথায় দিয়ে সাদা আর বাদামি শিকারিরা বাঘ শিকারে যেতেন। চেনবাঁধা হাতিও ছিল। মানুষ অত বড়, অত শক্তিশালী প্রাণীকেও দাস বানাতে পারত। মাহুতের কোড ওয়ার্ডে হাতি ওঠবোস করত। হাতি আবার রূপালি পরদার নায়ক অথবা নায়িকা। হাতি মেরা সাথী। সফেদ হাতি। হাতির মধ্যে একটা মানুষ মানুষ ব্যাপার আছে। রেগে গেলে ভয়ংকর। পোষ মানাতে পারলে শান্তশ্লিষ্ট এক পালোয়ান। মানুষের গজদন্ত সৌন্দর্যের বিড়ম্বনা, হাতির দাঁত ঐশ্বর্য। এই দাঁতের কারণে কত হাতি যে মারা পড়েছে মানুষের হাতে! শুনেছি, হাতির স্মৃতিশক্তি খুব জোরালো। ভীষণ মনে রাখতে পারে। যে ভালোবাসে তার জন্যে জীবন দিতে প্রস্তুত। যে অনাদর করবে তার জন্যে মৃত্যু। সুযোগ পেলেই মারবে। গণেশ ঠাকুরের সেই কারণেই অঙ্কের মাথা অত ভালো। মারোয়াড়িদের গদিঘরের কুলুঙ্গিতে-কুলঙ্গিতে তিনি বসে আছেন। জ্বলছে লাল টুনি। ভ্রাম্যমান ওড়িশি পুরোহিতরা বিড়বিড় করে পুজো করে যান। ছ্যাটাং ছ্যাংটাং গঙ্গাজলের ছিটে। ওইটুকুতেই কোটি-কোটি টাকা। গণেশ এমনই দেবতা, উলটে গেলেও লাভ।
এক নম্বরেও গণেশ, দু-নম্বরেও গণেশ। সাদাতেও গণেশ লালেতেও গণেশ। আর্টিস্ট আর স্কালপটাররা গণেশকে ধরেছেন। নানা ধরনের ছবি আর মূর্তি। ছাতা মাথায় গণেশ। তবলাবাদক গণেশ। বই পড়ছেন গণেশ। গণেশ বেচেই কিছু মানুষ বড়লোক।
ভগবানের আর এক সৃষ্টি ঘোড়া। আদি যুগে বলিষ্ঠ মানুষের দ্রুতগামী বলিষ্ঠ বাহন। বেশ একটা আভিজাত্য আছে। ঘোড়ার মতো মুখ হলেও লেজের বাহার অসম্ভব। মেয়েরা কায়দা করে চুল বেঁধে বলে, পনি টেল। ভালোই দেখায়। ঘোড়ার ত্বকও খুব সুন্দর। কোনওটার রং চেস্ট নাট, কোনওটার ব্রাউন। সাদা ঘোড়া তো স্বপ্ন। সেকালের যুদ্ধে অপরিহার্য ছিল। একালের যুদ্ধেও কম যায় না। সব দেশের আর্মিতেই ক্যাভালরি আছে। তার আলাদা শিভ্যালরি। ইংরেজ আমলে রাজা-মহারাজারা ঘোড়ার পিঠে চেপে পোলো খেলতেন। অলিম্পিকে হর্সরাইডিং একটা আইটেম। আমাদের পুলিশে এখনও ঘোড়া আছে, মাউন্টেড পুলিশ, আমরা ছেলেবেলায় ভুল উচ্চারণে বলতুম, মাউন্টেন পুলিশ।
টেকসাসের কাউবয়রা কাউতে চাপে না। সব ঘোড়ার ব্যাবসা করে। অস্ট্রেলিয়া ঘোড়ার জন্যে বিখ্যাত। এক একটা ঘোড়ার দাম মানুষের দামের চেয়ে বেশি। একালের নতুন রাজারা রেসের ঘোড়া তৈরি করেন। ভীষণ তার দাম। এক একজনের নাম কী! সিলভার, ওক, ব্লু লিলি। রেসের বইয়ে এইসব নাম লেখা থাকে, সঙ্গে পেডিগ্রি। বাপ-ঠাকুরদার নাম। কে কোন রেস জিতেছে। মুম্বাই, দিল্লি, ব্যাঙ্গালোর, কলকাতা, রেসের মাঠে ছুটছে ঘোড়া। কে মারবে ডারবি! গ্যালারিতে, স্ট্যান্ডে যাঁরা বাজি ধরেছেন, তাঁদের লম্ভঝম্প। ডারবি জেতা ঘোড়ার পাশে দাঁড়িয়ে সুন্দরী মালিক। ছবি তোলা হচ্ছে। ঘোড়া হাসলেও বোঝার উপায় নেই। সুন্দরীর মুখে বিজয়িনীর হাসি। জকিদেরও অসামান্য খাতির। সেলিব্রিটি। হাওয়ায় উড়ে উড়ে গিয়ে দেশবিদেশে ঘোড়া ছোটায়। ওই ঘোড়াদের জগৎটা যত সহজ এই ঘোড়াদের জগৎটা তত সহজ নয়। ভেতরে টাকার খেলা, বাইরে টাকার খেলা।
কুরুক্ষেত্রে ঘোড়া, তৈমুর, চেঙ্গিজের ঘোড়া, শিবাজির ঘোড়া, রাণা প্রতাপের ঘোড়া, ঘোড়া এক সেলিব্রিটি। হরেক সব নাম, চৈতক রৈবতক ইত্যাদি। গীতার মলাটে রথের ছবি। দুটো তাগড়াই সাদা ঘোড়া। গাণ্ডীবধারী পার্থ। লাগাম ধরে আছেন পার্থসখা শ্রীকৃষ্ণ। ছবি দেখে ভক্তের চোখে প্রেমাশ্রু। দেবী দুর্গা কখনও আসেন ঘোটকে, কখনও হাতিতে, কখনও, পালকিতে কখনও নৌকোয়। আসা আর যাওয়া ভিন্ন ভিন্ন বাহনে। বাহন অনুসারে রাষ্ট্রফল। গজ সদা শুভ, অশ্ব সদা অশুভ। ঘোড়া যোদ্ধা হওয়ায় মনে হয় এই বদনাম। খরা, দেশ ছত্রভঙ্গ, এইসব বলা হয়। আবার নারীর দেহলক্ষণে হস্তিনী শব্দটা ভালো নয়।
পেঁচা মা লক্ষ্মীর বাহন। সে-পেঁচা অবশ্যই সাদা, দুধু দুধু চেহারা, ডাগর ডুগুর নধরকান্তি। ঐশ্বর্যের প্রতীক। মাঝরাতে ঘরের ছাতে ওই পেঁচা এসে বসলে গৃহস্থের ভাগ্য খুলে যেতে বাধ্য। কালো পেঁচা বা কালপেঁচার কদর নেই।
বাদুড়ও নিশাচর; কিন্তু বাদুড়ের সঙ্গে মানুষের সুস্থজগতের সম্পর্ক নেই। ড্রাকুলা, ভ্যাম্পায়ার, ভাঙা বাড়ি, জাদুকর, ডাইনি, মরণ, মারণ-উচাটন, মৃত্যু এই সবের যোগ। ভিটায় চামচিকি মানে হয়ে গেছে। কেউ নেই। মৃত্যু, মামলা-মকর্দমায় শুভদিন হাওয়া। বিগ্রহশূন্য মন্দিরে চামচিকির বাসা।
ঘুঘু অত সুন্দর পাখি, তবু বলা হবে, ভিটেয় ঘুঘু চরাব। একমাত্র এক ইংরেজ কবি, প্রেমিকার বুকের সঙ্গে ঘুঘুর নরম বুকের তুলনা করেছেন।
পায়রা অহরহ বেড়ালের পেটে গেলেও শান্তির প্রতীক। আবার ডাকহরকরা। একালের কোরিয়ার সার্ভিস আসার ঢের আগেই পায়রাকে কোরিয়ার হিসেবে মানুষ কাজে লাগিয়েছে। বন্দি রাজকন্যার চিঠি নিয়ে দেশান্তরে উড়ে গেল পায়রা। রাজকুমার আসবে উদ্ধারে। গুপ্তচররাও পায়রার সাহায্যে খবর পাচার করত। আবার পায়রাকে গুলি করে আকাশ থেকে নামিয়ে গুপ্তচরের হদিশ করে।
ভগবানের চিড়িয়াখানায় উট এক অসাধারণ প্রাণী। মাইলের পর মাইল রোদে পোড়া বালি। কোথাও এতটুকু ছায়া নেই, জল নেই। যে ঈশ্বর মরুভূমি তৈরি করেছেন, তাঁর পক্ষেই উট তৈরি করা সম্ভব। শিপ অফ দি ডেজার্ট। খাদ্য হল কাঁটা গাছ। দু-কষ বেয়ে রক্ত ঝরছে, ভ্রূক্ষেপ নেই। আর তার জলের আধার পিঠেই আছে, সেটি হল তার কুঁজ। মরুদ্যান পেলেই জল ভরে নেবে নিজের কুঁজে। উত্তপ্ত মরুভূমি। বালিয়াড়ি ঢেউ তুলেছে। সীমাহীন অনন্ত প্রান্তর। উটের কাফেলা চলেছে। পিঠে সাদা আচকান পারা বেদুইন। দৃশ্যটা চলচ্চিত্রেই ভালো। মরুভূমি বালির কবিতা, ভীষণ রোমান্টিক। ভয়ংকর সুন্দর।
জিরাফ এক আজব প্রাণী। একালের মানুষের উচ্চাকাঙ্খার মতো এতখানি একটা লম্বা গলা। মুখটা এতটুকু ছুঁচোর মতো। গাছের সবোর্চ্চ ডাল থেকে অক্লেশে পাতা খেতে পারে মশমশ করে। পেছন দিকে চাঁট মারায় ওস্তাদ। লম্বা গলা উঁচিয়ে দলে দলে যখন দৌড়োয় মনে হয় কলকাতার রাস্তায় মিছিল ছুটছে পার্টির ব্যানার উঁচিয়ে।
নতজানু ক্যাঙারু আর এক বিচিত্র সৃষ্টি। পেটের কাছে পকেট। সেই পকেটে বাচ্চা। বসে বসেই চলে। একটা খরগোশকে সার দিয়ে বাড়াতে পারলেই ক্যাঙারু।
সবচেয়ে দু:খের প্রাণী গরু। মানুষ গোমাতা, ভগবতী এই সব মিষ্টি-মিষ্টি কথা বলে দুইছে আর খাচ্ছে। দুধ, ক্ষীর, সর, ননী, ছানা, সন্দেশ, ঘি, মাখন। খাচ্ছে আর ভুঁড়ি বাগাচ্ছে। কেউ কেউ বলে, ভাই, দুধ আমার একেবারেই সহ্য হয় না। তাই, হয় ছানা, না হয় ক্ষীর খাই। রাবড়িটাও সহ্য হয়। গাভীর মুক্তি নেই, বলদের অবস্থা আরও কাহিল। একমাত্র মুক্ত পুরুষ ষাঁড়। বিরাট বপু নিয়ে ঘুরে বেড়াও, যেখানে যা পাও, টেনেটুনে খাও, মাঝেমাঝে খেপে গিয়ে গুঁতোগুঁতি করে প্রমাণ করো শিবঠাকুরের বাহন।
বাঁদর আর মানুষ প্রায় একইরকম দু:খী। রামচরিত মানসে তুলসিদাসজি বাঁদরের মুখ দিয়ে এই দু:খের কথা প্রকাশ করেছেন। এক বেদে গৃহস্থের দ্বারে দ্বারে নাচ দেখিয়ে বেড়াচ্ছে, বাঁদর নাচ। বাঁদর তখন দু:খ করে বলছে,
কুদকে সাগর উতারা, কোহি কিয়া মিৎ।
কোহি ওখরা গিরি দরখৎ, কোহি শিখায়া নীৎ।
ক্যা কহুঙ্গা সীতানাথকো, মেয়নে কিয়া চোরি।
সোহি কুল উদ্ভব রো, বেদিয়া খিঁচে ডোরি।
অতীতে এই বানরবংশে জন্মে কেউ একলাফে দুষ্পার সাগর টপকেছে, কোন কোন বানর বীরকুলশ্রেষ্ঠ রঘুপতির বন্ধু হয়ে জগৎখ্যাত, কেউ ভুজবলে বৃক্ষ, গিরি উৎপাটন করেছে, কোন কোন বানর অসাধারণ নীতিবিশারদ হয়ে জগজ্জনকে নীতিশিক্ষা দিয়েছে, কিন্তু আমি সীতাপতি রঘুবরকে প্রশ্ন করছি, আমি কি কিছু চুরি করেছিলাম, তা না হলে ওই বংশে জন্মে আমার এই হাল কেন প্রভু। এক বেদে আমার গলায় দড়ি বেঁধে মানুষের দোরে দোরে আমাকে নাচিয়ে বেড়াচ্ছে।
ভগবানের এই চিড়িয়াখানায় আমাদেরও ওই একই প্রশ্ন—মানুষ থেকে মানুষ গেল কোথায়! বাঘের মতো মানুষ, সিংহের মতো মানুষ, পরমহংসের মতো মানুষ! এ যে সব শেয়াল!