কেমন আছেন
মাঝে-মাঝে ভীষণ ভয় করে। পরীক্ষায় বসা পরীক্ষার্থীর মতো। পারব তো! সংসার অর্ণবে জীবনতরণী কুলে শেষ পর্যন্ত ভেড়াতে।
পারব তো। মাঝ দরিয়ায় ভরাডুবি হবে না তো। স্ত্রী পুত্র পরিবার সমেত ভুড়ভুড় করে ডুবেই গেলুম। ষাট-সত্তর বছরের দীর্ঘ এই পাড়িতে ফ্যুয়েল তো কম লাগে না। সংসার তো এক জাহাজ। সময়ের নদীতে ভাসছে। সেই জাহাজের যাত্রী সংখ্যা কম নয়। গোটা পরিবার সেই জাহাজে দোল খাচ্ছে। ইঞ্জিন হলেন কর্তা। ডিজেল হল তাঁর উপার্জন। আয়ের অঙ্ক বড়সড় হলে জাহাজটি হবে ‘লাকসারি লাইনার’। বেশ বড় বড় খোলামেলা কেবিন। নরম গদি-আঁটা বিছানা। রঙিন টিভি। স্টিরিও মিউজিক সিস্টেম। ফ্রিজ। ভি. সি. আর। ভোগ আরও ভোগ। দুর্ভোগ জাহাজের কাপ্তেনের। বড় আয়ের সমুদ্রে জাহাজ বড় দোল খায়। রোলিং, পিচিং দুটোই আছে। পাশেও দোলে, সামনে পেছনেও ঢেঁকির মতো ওঠা নামা। বড় চাকরি মানে বড় ঝড় ঝাপটা। সবই সামলাতে হয় কর্ণধারকে। বিকট প্রতিযোগিতা। ঘোষ, বোস, মিত্তির একই ট্র্যাকে ছুটছেন। কে কাকে মেরে বেরিয়ে যায় কখন! যে যখন গুডবুকে, তার পোয়া বারো। দুধে চিনি। আর ব্যাডবুকে তো শাকে বালি! পরিবারের কেউ বোঝে না কত্তার কি টেনসান! সবাই যখন সুখে ভোঁস-ভোঁস, ভোরে শিস মারছে নিশ্চিন্ত দোয়েলের মতো, কথা তখন ছিঁড়িক, ছিঁড়িক ঘুমের রাত পেরিয়ে আর একটি নতুন দিনের, নতুন বিভীষিকার মুখোমুখি। টাইট রোপওয়াকার। দড়িতে হাঁটা, পদমর্যাদার বাহারী ছাতা মাথায় দিয়ে। একটু বেসামাল হলেই সাপলুডো। নেমে এস শুরুর ঘরে। এক চাকরি থেকে আর এক চাকরি করতে-করতে বয়েস যখন বাড়ে তখন শেষ চাকরিটাই হনুমানের মতো আঁকড়ে ধরতে হয়। কলা মিললে কলা, মুলো মিললে মুলো। কখনও সিন্নি, কখনও কোঁতকা। আত্মসম্মানে আঁচড় লাগলেও জাহাজের যাত্রীদের কথা ভেবে হাল ছাড়া যায় না। ভোগ বেড়ে গেছে। হাজার আলোর রোশনাই। বিল না মেটাতে পারলেই পেয়াদা এসে ধরবে। স্ট্যান্ডার্ড অব লিভিং পড়ে যাবার আতঙ্কে চুল পাকে, রক্তে চিনি ঢোকে, চাপ বাড়ে। টেনসান রিলিজের জন্যে অনেকে ঈশ্বরকে ধরেন, অনেকে বোতলীশ্বরকে। রাতে কাপ্তেন টলোমলো। জাহাজের দুলুনি বাড়ে। যাত্রীদের আতঙ্ক বাড়ে। কাপ্তেন গাইতে থাকেন ভেসে যাক তরী ডুবে যাক। আমেরিকার এক কোটি-কোটি কোটিপতি তাঁর সুরম্য বহুতল হর্মের স্টাডি থেকে মারলেন সবুজ লনে ঝাঁপ। কি ব্যাপার! আত্মহত্যার কারণ হিসেবে লিখলেন হঠাৎ মনে হল আমার আয় যদি কমে যায় তাহলে কি হবে। সত্যিই তাই, বাজনার খাজনা যোগাবে কে! ওইজন্যেই বলে, বড় ব্যবসায়ী, বড় চাকরে ভেবে ভেবেই হার্টঅ্যাটাকে মরেন। মজা মারেন পরিবারের ছেলে, বউ।
যাঁদের বস্তা-বস্তা টাকা, পায়রার মতো উড়ছে তাঁদেরও যেমন সমস্যা, যাঁদের মাপা আয় তাঁদের আবার অন্যরকম সমস্যা। সাধ আর সাধ্য কিছুতেই মেলে না। আশা আর আকাঙ্ক্ষা যেন দু-পাশে দুটো হুক। আর আয় হল ছোট মাপের পর্দা টাঙাবার একটি স্প্রিং। টানো আরও টানো, কিছুতেই আর আসে না। শেষে হুকটাই উপড়ে গেল। কর্তা নামক হুকটি সংসার-জানলা থেকে উৎপাটিত হয়ে ভবপারে। চোট খেলেন তাঁরা যাঁরা ধরে টানাটানি করছিলেন। কত্তাকে কেবলই খোঁচাচ্ছিলেন—ছেলেকে বড় স্কুলে দাও। তিনজন গৃহশিক্ষক রাখো, মেয়েকে একই সঙ্গে গাইয়ে, বাজিয়ে, নাচিয়ে, সাঁতারু, তীরন্দাজ, গোলন্দাজ, ডকটরেট করো। দুধ, ঘি, ছানা, মাছ, মাংসের বন্যা বইয়ে দাও, লোক-লৌকিকতায় হাত খোলো, আবার সঞ্চয়ও করো। মেয়ের বিয়ে, বুড়োবুড়ির ভবিষ্যতের কথা ভাবো। আধুনিক জীবনের অনুষঙ্গের কথা ভাবো। একটা ফ্ল্যাট কিনে ফেল। দেয়াল মেজে দাও মাছি-পেছলানো মসৃণ রঙে। বসার ঘরে ফেল কার্পেট। চকচকে, ঝকঝকে ফার্নিচার, ভ্যাকুয়াম ক্লিনার, ওয়াশিং, মেশিন, আউটিং। বাড়িতে আসবেন বিক্রেতা, গছিয়ে যাবেন শাড়ি। চৈত্রের সেল। পুজোর কেনাকাটা। কিস্তির টিভি, ফ্রিজ, ভি সি আর, বাক্সখাট, সিন্থেটিক গদি, গরমের সরবত, শীতের কমলালেবু। কত্তার চোখে সরষে ফুল। চাহিদার পর চাহিদা। কয়েকশো পাওনাদার। একবার এর মাথায় টুপি, একবার ওর মাথায়। চাকরির পর পার্টটাইম। সাইড বিজনেস।
ইনসিওরেন্সের দালালি। জীবনে কোনও ফুরসত নেই। ধান্দার পর ধান্দা। কোথাও দু-দণ্ড স্থির হয়ে বসার উপায় নেই। খরচ বাড়ছে, আয় বাড়াতে হবে। ভেতরটা যেন ফলুই মাছের মতো লাফাচ্ছে। অ্যাম্বিসান কুরে কুরে খাচ্ছে। ওর হয়ে গেল, আমার হল না। আয় বুঝে ব্যয় কথাটা একালে আর খাটেনা। সব কিছুই যে হারে বাড়ছে আয় আর তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারছে না। সেতার আর তবলার লড়াইয়ের মতো অবস্থা। চুল ঝাঁকিয়ে দু-পক্ষের কোস্তাকুস্তি। খুব বলশালী না হলে বাসে ওঠা যাবে না। ফলে মিনি বাসে ছড়ির মতো ঘাড় বেঁকিয়ে অফিস যাত্রা। সুখ কিছুই বাড়ল না, বাড়ল খরচ। শরীর যেদিন ভীষণ নড়বড়ে সেদিন ট্যাক্সি। পা দিলেই চার টাকা। ওদিকে কেন্দ্র বসে আছে বাজেটের খাঁড়া ধরে। বছর-বছর কোপ পড়বে তেলের উপর। সঙ্গে-সঙ্গে শুরু হবে যানচালকদের ক্যাঁচোরম্যাঁচোর। বিদ্যুৎ আর এক সমস্যা। আলো জ্বলুক না জ্বলুক, ‘এসেছিলে তবু আস নাই জানায়ে গেলে’, কি ভাবে? বিরাট অঙ্কের একটা বিল এসে বলে দেবে এ চাঁদ বাইরের আলোর নয়, অন্ধকারের অন্তরে যে আলোর সম্ভাবনা থাকে তার। কবিতার সেই লাইনটি মনে করিয়ে দিয়ে যায়—ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সব শিশুরই অন্তরে। অন্ধকারের অন্তরে আছে আলোর শিশু। তিনি জাগুন আর না জাগুন দর্শনীটি মাসে-মাসে জমা দিয়ে যাও। আর এক সমস্যা দুধ। টিনের গরু দুধ দেয়। থেকে থেকেই তার দাম বাড়ে। মাস গেলে থোক একটা টাকা ওই সাইকোলজিক্যাল দুধ দোহন করে আনার জন্য। দোহনই বটে। বুথের সামনে কাতারে-কাতারে দুগ্ধপোষ্য আমরা, যেন ব্যান্ডপার্টি, হাতে-হাতে সুদৃশ্য কুদৃশ্য কেনেস্তারা। কতটা জোর হচ্ছে পরীক্ষার জন্যে মাঝে-মাঝে কুস্তি। পুরুষ আছে, আছে রমণী। কাঙালি ভোজনের দৃশ্য। আর এক সমস্যা কেরোসিন। সেখানে আবার টেকসাসের কাউবয়। পাব, পাব হবার মুখেই লাইন থেকে বের করে দিলে ঝুঁটি ধরে। হয় এক লিটার গলিত সোনা হাতে বাড়ি, নয় পরাজিত হয়ে ফাটা মাথা বা ফাঁসা ভুঁড়ি নিয়ে হাসপাতাল। হাসের সঙ্গে পাতাল যিনি যোগ করেছিলেন—ভবিষ্যৎদ্রষ্টা। গেলে হাস্য আর আসে না, পাতালের অভিজ্ঞতাই হয়। আর এক সমস্যা গ্যাস। ঠাকুর গেয়েছিলেন, ‘সুর ভুলে যেই ঘুরে বেড়াই…’। এখন আমরা গাই, কয়লা ভুলে যে ঘুরে বেড়াই। রিকশায় ঘামতে-ঘামতে চলেছেন গৃহবধূ। পায়ের কাছে দামড়া সিলিন্ডার। ‘দাও ফিরে সে অরণ্য’ আবার কাঁচা খাই। অরণ্য অবশ্য অন্যদিকে ফিরছে। ঝলর-ঝালর যেমন তেমন পোশাক পরে বেরোতে ভয় করে। হয় তো স্প্রিং ম্যান বলে পিটিয়ে শেষ করে দেবে। শৈশবে গল্পে পড়েছিলুম—একটা ডোবা, কিছু ব্যাং। ছেলেরা ইঁট মারছে। দরদী এসে বলছেন নিরীহ প্রাণীকে অকারণে মেরো না। তোমাদের যাহা আনন্দ অন্যের তাহা দু:খের কারণ। এইবার দেয়ালে হয় তো অফসেটে ছাপা, উচ্চাঙ্গের আর্টওয়ার্ক করা বহুমূল্য পোস্টার পড়বে—অকারণে মানুষ মেরো না। ব্যাং মরে গেলে, ব্যাঙাচিরা কোথায় যাবে!
নিজেরা নোকরি ছাড়া অন্য সব কাজের অভ্যাস হারিয়েছি। ঘর মোছে একজন, বাসন মাজে আর একজন। দুধ আনে একজন তো তেলের লাইনে আর একজন। তাদের ফি আর বছরে চারপ্রস্ত জামা কাপড়, শীতের চাদর আর তাদের সংসার সচল রাখার জন্যে মাঝে মধ্যে গ্রেস দিতে গিয়ে নিজের ভাঁড়ে মা ভবানী। যত তেল পরিবার পরিজন তাদের দেয়, সেই তেল কত্তাকে দিলে কলু হয়ে যেত। অমন খেসকুটে চেহারা হত না।
পিতার নাম গোপেশ্বর। তিনি কিং গোপু। ছেলে প্রিনস ভুতো। তিনি নটায় খাটিয়া থেকে ভূমিষ্ঠ হন। হ্যাঁ রে কিছু কাজ তো করতে পারিস। এই যেমন দুধটা, তেলটা, কি যে যার ঘরটা মুছে নিলি। এত বেলায় উঠলে ভবিষ্যৎ অন্ধকার। কিং পটল তুললেই প্রিনসের হাতে হারিকেন। ‘কি করব মা! সারাটা রাত আমি দেশের ভবিষ্যতের ওপর মেডিটেশান করি।’ কিং গোপু রাত আটটায় বাড়িতে এসে বডি ফেলে দেন। একশো পালোয়ানে ময়দাঠাসা করেছে। পথে কনুইবাজেরা কানকি মেরেছে। কর্মস্থলে বড়, ছোট, মেজ নানা আকারের আছোলা পরীক্ষা করেছে। তিনি স্টিম নেবেন পরের দিনের সংগ্রামের জন্যে। এ শয্যা সুখ শয্যা নয় শরশয্যা। নিজের ভবিষ্যতের মেডিটেশান। পাঁচটা প্রাণী, ছ হাজারেও কুল পাওয়া যাচ্ছে না। মধ্য মাসেই ট্যাঙ্ক ঢনঢন। মেয়ে বেড়েছে। বাবাজীবন ধরতে এক লাখ। ছেলে দেশের ভবিষ্যৎ যত ভাবে নিজের ভবিষ্যৎ তত নয়। বাবার ক্রাচ খসে গেলেই এক ঠ্যাঙা। চাকরিবাকরিই বা কোথায়! কোনও সঞ্চয় নেই। যা হতে পারত সামান্য, কোনও ‘বাম্বুভিলার’ ইনকাম ট্যাকস বাম্বু টেনে নিয়েছে লগা মেরে। ছানা বড়ার মতো চোখ মেলে কত্তা রাতের বৈতরণী পার হচ্ছেন। ‘কেমন আছেন?’ ‘খোব ভালো।’ আপনি কেমন?’ ‘খোব ভালো।’ দুজনেরই মুখে ‘কান্নার মতো’ হাসি।