কেমনে পাইলা নামটা
দ্রুত দিন ঘনাচ্ছিল। অবাক না হয়ে পারছিলাম না শেফালিকে দেখে। চোখে-মুখে, আগে যেমন বলেছিলাম লাবণ্য ধরা দিচ্ছে, সে লাবণ্যে নিত্যনতুন ফুল ফুটছে। দেখি আর ভাবি এ তো সাধারণ গ্রামের মেয়ের মুখ না, আঁকাজোখা ছেড়ে দিয়েছি কবে, না হলে এ মুখে কত কিছু আবিষ্কারের ছিল—এই-ই কি আবহমান বাঙালি নারীমুখ? পানপাতা গড়ন, থুতনির ঢালে পানপাতার চিরল বাঁধুনিতে মাংসল মায়া, গাঢ় পাপড়ির ঝালরে কোটরভরা ঝকঝকে চোখ, আর চুল যে এ ক-মাসে এমন ঢল নামাতে পারে আগে কী করে বুঝব!
শেফালির ব্যবস্থা করা হয়েছিল হলি ফ্যামিলিতে। ওষুধ-পথ্যসহ খরচাপাতি রেডক্রস দেবে। আগেও ওখানে কয়েকজনকে প্রসবের সময় ভর্তি করা হয়েছিল, তবে বেশিরভাগই ঢাকা মেডিক্যালে। আশ্চর্য, শেফালির হাবভাবে কোনো পরিবর্তন নাই, শরীরে পানি জমায় হাত-পা কিছুটা ফোলা, মুখও। ফোলা, ঢলোঢলো মুখে যখন তাকাত, চোখ ফেরাতে পারতাম না। তাকে বললাম কবে হাসপাতালে নেওয়া হতে পারে, চিন্তা যেন না করে, আমি থাকব সাথে।
এর মধ্যে গ্রাম থেকে তার বাবা-মা বারকয়েক এসেছে। মন মানে না বলেই এসেছে, তবে মেয়ের কাছে গিয়ে বসে কী বলবে খুঁজে না পেয়ে গ্রাম কে কেমন আছে, কারা মারা গেছে, এমনকি ধান কেমন হয়েছে এ নিয়েও কথাবার্তা চালাতে গিয়ে চোরের মতো ঘাড়-মাথা গুঁজে থেকেছে।
একবার একটা ছেলে এলো, শুনলাম আমাকে খুঁজছে। দেখা হতে বলল সে শেফালির ছোট ভাই, নামও নিশ্চয় বলেছিল, মনে নাই। ষোলো-সতেরো বছরের বাচ্চা ছেলে, মুক্তিবাহিনীতে ছিল শুনে আগ্রহী হলাম। বললাম শেফালি আমাদের কাছেই থাকবে, কিন্তু সে আজব কথা শোনাল, সে তার বোনকে বাড়ি নিয়ে যেতে চায়। বোঝানোর চেষ্টা করলাম, নিয়ে রাখতে পারলে তো ভালোই হতো, কিন্তু পারবে তো না, তখন কী হবে? ছেলেটা গোঁয়ার ধরনের, বলল, ওসব নিয়ে আমার চিন্তা করতে হবে না, সে শেফালিকে নেবেই নেবে। রাগ হলো খুব, রেগে গেলে আমার মুখ থেকে উল্টাপাল্টা কথা ছোটে। বললাম, যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছে, বোনকে তো রক্ষা করতে পারেনি, লাভ কী হলো! আসলে এ কথার তো কোনো মানে হয় না, আর অল্প বয়সি ছেলেটার ওপর রাগ দেখানোও অর্থহীন।
কথা শুনে সে কেমন কুঁকড়ে গেল। ওকে বললাম, শেফালির বাচ্চা হবে, কয়েক দিনের মধ্যেই হবে। বোনকে যে নিতে এসেছে, পারবে বোনের বাচ্চাকে পালতে? বলেছি না ছেলেটা গোঁয়ার, আমার কথা শেষ না হতেই একটু আগের ভঙ্গি পাল্টে তেজ দেখিয়ে বলল, ‘জাউরার বাচ্চা জাউরারে টুকরা টুকরা কইরা গাঙে ভাসায়া দিমু।’ আমার তখন ধৈর্য ধরা সম্ভব হলো না, চেঁচিয়ে বললাম, ‘বেরোও, কোন সাহসে এখানে এসেছো? মুক্তি হয়ে দুনিয়া উদ্ধার করে বসে আছো, এক্ষনি বেরোও, না হলে পিটিয়ে লাশ বানিয়ে ফেলব। আমিও মুক্তি কম না।’
আমার কথায় সত্যি ভয় পেয়েছিল কি না বলতে পারব না, ছেলেটা চলে গিয়েছিল, আর আসেনি। আসলে ওর এভাবে আসা ও কথা বলায় ওর নিজের দিক থেকে হয়তো যুক্তি ছিল। কারণ আমার জানা মতে এমন কিছু কিছু ঘটনা ঘটেছে যেখানে আত্মীয়-স্বজনেরা মেয়েদের নিয়ে দূরে কোথাও রেখে বাচ্চা হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করেছে, তার পর আর বাচ্চার খোঁজ মেলেনি। কেউ কেউ মাদার তেরেসার শিশু ভবনে বাচ্চা রেখে গেছে, চুপিচুপি রেখেছে, আবার জানিয়েও রেখেছে। ওদের উদ্দেশ্য বাচ্চাদের নিজেরা যখন পালতে পারবে না, কেউ দত্তক নিতে চাইলে নিক। নিয়েছেও। দেশে কারা নিয়েছে বা নিচ্ছে সে খবর প্রচার না পেলেও বিদেশিরা যে নিচ্ছে তা চাপা থাকছে না। একদিনে শুধু কানাডাতেই এক ফ্লাইটে পনেরোটা বাচ্চা চলে গিয়েছে বলে খবর পেয়েছি। এ ছাড়া আমেরিকা, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মেনিসহ নানা দেশে বাচ্চারা যাচ্ছে।
শেফালির জায়গা হলো হলি ফ্যামিলির দোতলায় পূর্ব দিকে একটা ছোট তিন বেডের ওয়ার্ডে। নম্বরটা সম্ভবত ছিল তিন। মেয়েদের হাসপাতালে নেওয়ার সময় কখনো আমি গিয়েছি, কখনো অন্য কেউ। ডাক্তারদের সঙ্গে কথা বলে চলে এসেছি বা পরেও গিয়েছি, তবে সব সময় সঙ্গে থাকিনি। শেফালিকে বলেছিলাম আমি ওর সঙ্গে থাকব, কথার খেলাপ হতে দিতে পারি না, তাই পাশের খালি বেডটা আমার দখলে চলে এলো। যেহেতু ওখানে পুনর্বাসনকেন্দ্রের মেয়ে রয়েছে, অন্য কারো আসার কথা নয়। আমি নিশ্চয়তা পেলাম।
একজন বয়স্কা নার্স যিনি এর আগে কেন্দ্রের কয়েকজনের ডেলিভারির সময় কাজ করেছেন, শেফালির ব্যাপারে আমাকে সাবধান করে দিয়ে বললেন, ওর ব্যাপার-স্যাপার তার কাছে ভালো ঠেকছে না। জানতে চাইলাম শারীরিক সমস্যার কথা বলছেন কি না। তিনি বললেন শারীরিক তেমন কিছু দেখতে পাচ্ছেন না, তবে ওর হাবভাব নাকি তার মোটেও স্বাভাবিক মনে হচ্ছে না। কথা শুনে আমার খটকা লাগল। মহিলা তেমন কিছু ভেঙে না বলে বললেন যেন চোখে চোখে রাখি। আমার তখন মাস তিনেক আগে রুবিনার কথা মনে পড়ল, যে তার বাচ্চাকে দুধ দেওয়ার নাম করে গলা টিপে মেরেছিল। আমরা যদিও তখন কেন্দ্রের মেয়েদের বলেছিলাম রুবিনার মরা বাচ্চা হয়েছে, তারা ঠিকই আসল ঘটনা জেনে গিয়েছিল। আর রুবিনা হাসপাতাল থেকে ফিরে কী করে মাত্র এক হাতে শ্বাসনালি চেপে বাচ্চার কান্না চিরদিনের মতো থামিয়ে দিয়েছিল, সে কাহিনি জনে জনে বলে বেড়াত। আমার বদ্ধমূল ধারণা ছিল ও পাগল হয়ে যাবে। বাচ্চাটা তো দশ মাস ওর পেটেই ছিল, সেখানেই একটু একটু করে বেড়েছে, বাড়তে গিয়ে মায়ের সঙ্গে একটা যোগাযোগও হয়েছে, সেই বাচ্চা পেট থেকে বেরিয়ে যেই মায়ের দুধ খেতে কাঁদল, তখনি গলা টিপে কান্না থামাতে রুবিনার হাত নিশপিশ করে উঠল। পাগলামির লক্ষণ ছাড়া কী! কিন্তু ঘটনা হলো, তার মধ্যে পাগলামির কোনো চিহ্ন দেখতে পাইনি, বরং মাসখানেকের মধ্যে বাড়িতে খবর পাঠিয়ে তার মাকে আনিয়ে সবার কাছে বিদায় নিয়ে চলে গিয়েছিল।
পুব দিকে বলে ভোর-ভোর আলোয় ভরে যেত ওয়ার্ড। শেফালি ভারী শরীর টেনে জানালার পর্দা ফাঁক করে বাইরে কী দেখত সে-ই জানে। আমি জেগে থাকলে আমার বেডে কষ্টেসৃষ্টে উঠে আঙুল টেনে দিত, নয়তো একটা হাত কোলে নিয়ে বসে থাকত। শরীর খারাপ লাগছে কি না জানতে চাইলে সব সময় ঘাড় নেড়ে জানাত ঠিক আছে। একদিন আচমকা জিজ্ঞেস করল, ওর ছেলে হবে না মেয়ে হবে। আমি ভণিতা করে কয়েক সেকেন্ড চোখ বুজে থেকে বললাম, মেয়ে। ঠিক তার মতো একটা সুন্দর মেয়ে হবে। মেয়ে হবে বলেই ওর চোখমুখ মোম-গলা নরম আলোয় ভরে থাকে। ও কি খেয়াল করে না এসব? আমার কথায় কিছু বলছে না দেখে হঠাৎ বলে ফেললাম মেয়ের নাম আমি রাখব। আগে এ নিয়ে ভাবিনি, তখনি মাথায় যা এলো বললাম, ‘তোর মেয়ের নাম রাখব চম্পা, শেফালির মেয়ে তো চম্পাই হবে, তাই না?’ বলতে ভুলে গেছি, শেফালিকে তত দিনে তুমি থেকে তুই বলা ধরেছি।
মেয়ে হবে, আবার মেয়ের নামও আগাম রাখা হয়ে গেছে শুনে সে অবাক চোখে আমার দিকে তাকাল—সেই প্রথম-প্রথম যেমন কোনো কারণ ছাড়াই আমাকে দেখত। বলতাম, কী দেখে, জবাব দিত না। কিন্তু সেদিন সে নিজে থেকে আমাকে এমন কথা বলল যা জীবনে আমাকে কেউ বলেনি। শেফালি বলল, ‘নিজে যে কত সুন্দর এই খবর তো রাখো না।’
সুন্দর বললে যে কী ভালো লাগে সেদিন শেফালির মুখ থেকে না শুনলে জানতেই পারতাম না। কেন কেউ বলেনি, আমার মতো কাঠখোট্টা মেয়ের মনেও একটু অভিমান হলো। বললে তো পয়সা খরচ হতো না, কেন বলেনি কেউ? আশ্চর্য, শেফালি আমাকে কী অবিশ্বাস্য কথা শোনাল!
তখন সন্ধ্যা হয় হয়। হঠাৎ খেয়াল করলাম শেফালি আধশোয়া অবস্থায় কোমরে দুই হাত চেপে উঠে বসতে চেষ্টা করছে, বারবার চেষ্টা করছে, পারছে না। জোরে শ্বাস টানতে গিয়ে গলা থেকে গোঙানির আওয়াজ বেরোচ্ছে। দেরি না করে আমি করিডরের মাঝামাঝি নার্সদের কাচঘেরা ঘরের দিকে ছুটলাম।
ছোট ডেলিভারি রুমের বাইরে বেশ কিছু সময় দাঁড়িয়ে থেকে আমার মনে হলো ভেতরে যাওয়া দরকার, কেন মনে হলো বলতে পারব না। সেই আমলে সাধারণ হাসপাতালে তেমন কড়াকড়ি ছিল না, তবে হলি ফ্যামিলিতে ছিল। ভেজানো দরজা ঠেলে ঢুকতেই আমি থ, এ কি! একটা আওয়াজও পেলাম না। মাথা নিচে, পা ওপরে ধরা একজন নার্সের হাতে ঝুলন্ত লালচে মাংসের পুঁটলি, রক্তে মাখামাখি গ্লাভস পরা হাত, নীল অ্যাপ্রোন। তখনি দুর্বল গলায় কান্নার শব্দে আমি কাছে এগিয়ে গেলাম। রক্তমাখা, প্রায় কড়ে আঙুলের আকারের, অন্তত হাত দেড়েক লম্বা নাড়ি ঝুলছে তখনো। নার্স পুঁটলিটাকে দুই হাতের ওপর চিৎ করে শোয়াতে আমি দেখলাম মেয়ে। গলায় কান্নার শব্দ বাড়ছে। শেফালির দিকে আমার নজর ছিল না, শুধু দেখতে পাচ্ছিলাম রক্তেভাসা গাঢ় নীল ওয়েলক্লথের ওপর কাত হয়ে পড়ে আছে। জ্ঞান আছে কি নেই খেয়াল করিনি।
কান্নার শব্দে শেফালি চোখ টানটান করে পাশ ফিরল আর ওই অবস্থায় কোথা থেকে যে এত জোর পেল শরীরে, নার্সের অ্যাপ্রোন ধরে আচমকা এমন হ্যাঁচকা টান দিল, বাচ্চাটা হাত ফস্কে পড়ে আর কি। নার্সের হকচকিত মুখে এক নজর তাকিয়ে আমি বাচ্চাটাকে প্রায় ছিনিয়ে নিয়ে আমার শাড়ির আঁচলে পেঁচিয়ে একটু সরে দাঁড়ালাম, বেশি দূরে যেতে পারলাম না, নাড়িতে টান লাগছে। আর তখনই শেফালির চেরা চিৎকার, ‘ফালাও এইটারে, বাইরে ফিক্কা ফালাও।’
সেই বয়স্কা নার্স কী আন্দাজ করে শেফালিকে চোখে চোখে রাখতে বলেছিলেন আমার মাথায় এলো না। ও তো শান্ত, স্বাভাবিক ছিল। যদিও রুবিনার ঘটনা আমার মাথায় ছিল, কল্পনাও করিনি শেফালি রুবিনার মতো কিছু করতে পারে। ও কেন তবে জানতে চেয়েছিল ছেলে হবে না মেয়ে। মনে তো হয়নি ওর মধ্যে খারাপ প্রতিক্রিয়া হয়েছিল।
নাড়ি কেটে বাচ্চাকে পরিষ্কার করা হলেও সমস্যা দেখা দিল শেফালির কোলে ওকে কী করে দেওয়া যায়। মায়ের দুধে গলা না ভেজা পর্যন্ত কান্না থামবে না। ততক্ষণে কাঁদতে কাঁদতে গলা ভেঙে ফেলেছে, কান্নার আওয়াজও মিইয়ে আসছে। শেফালির কাণ্ড ততক্ষণে গাইনি ওয়ার্ডে কারো জানতে বাকি নেই। কী করা যায়, দুধ যে লাগবেই। কিন্তু কে নিয়ে দেবে শেফালির কোলে? হাতের নাগালে পেলে ওর এক মিনিটও লাগবে না কান্না থামাতে—রুবিনা যেমন থামিয়েছিল। তখন বেশ রাত। এ সময় একজন আয়া এসে জানাল পাশের ওয়ার্ডে একজন প্রসূতি মাকে পাওয়া গেছে যে দুধ দিতে রাজি। শুনে মনে হলো দুধ পেয়ে রাতটা অন্তত পার হোক। বাচ্চাকে—নামটা বলি না কেন—চম্পাকে সেই মহিলা যার দিন কয়েক আগে একটা ছেলে হয়েছে আর বুকে দুধ বেশি এসেছে বলে পাম্প করে ফেলতে হচ্ছে, যত্ন করে কয়েকবার দুধ খাওয়াল। জন্মানোর পর মায়ের দুধ না পেলেও চম্পা শান্ত হলো।
পরদিন আমার সামনে বড় পরীক্ষা। ভোর-ভোর চম্পাকে কোলে নিয়ে শেফালির কাছে একটা চেয়ার টেনে বসলাম। কথাবার্তা বললাম না। চম্পার খুদে খুদে হাতের আঙুল নেড়েচেড়ে ওর ঘুমন্ত মুখে চেয়ে ভাবছিলাম কী বলে কোলে দেব, যদি মেঝেতে ছুড়ে ফেলে। হঠাৎ খেয়াল করলাম শেফালি শোয়া অবস্থায় চোরা চোখে আমার কোলের দিকে তাকাচ্ছে। কাঁথায় মোড়া বলে চম্পাকে তার দেখতে পাওয়ার কথা নয়, তবু তাকানোর ভঙ্গিটা যেন কী বলল। আমি তেমনি চম্পার আঙুল নেড়ে, কপালে হাত বুলিয়ে চলেছি। শেফালি যে দেখছে বা দেখতে গিয়েও দেখতে পাচ্ছে না এ নিয়ে যেন আমার গরজ নেই। এ সময় সেই বয়স্কা নার্স, পদবি হয়তো স্টাফ নার্স, ঘরে ঢুকে আমাকে একটু বাইরে যেতে বলে চম্পাকে কোলে নিলেন। আমার চিন্তিত মুখ দেখে ইশারায় আশ্বস্ত করে কী বোঝালেন বুঝলাম না। আমি দাঁড়িয়ে রয়েছি দেখে মহিলা আবার কী ইশারা করলেন, তাও বুঝলাম না। করিডরে এসে ভাবছি ভেতরে থাকলে কী হতো! আর আসল কারণ তো ভয়, উনি ওর কোলে চম্পাকে দিয়ে দেন আর ও যদি …
বেশ কিছু সময় গেল। ভেতর থেকে সাড়া-শব্দ পাচ্ছি না, শুধু মনে আছে আমি বেরোনোর পর পর মহিলা কড়া গলায় কী সব বলছিলেন। দাঁড়িয়ে আছি, দাঁড়িয়ে আছি। কতক্ষণ অপেক্ষা করব? এক সময় দরজা ঠেলে ভেতরে পা দিতে মহিলা ইশারায় ডাকলেন। এ যে দেখব কিছুক্ষণ আগেও কি কল্পনা করেছি? শেফালি তার মেয়েকে দুধ দিচ্ছে। দেওয়ালে পিঠ দিয়ে বসে ভাঁজ করা এক হাতের ওপর কাঁথামোড়া চম্পাকে শুইয়ে অন্য হাতে আলতো মাথা আঁকড়ে মুখে স্তন গোঁজার কায়দা মহিলাই ঠিকঠাক করে দিয়েছিলেন। আমি স্থির চোখে তাকিয়ে আছি, মহিলা তাকিয়ে আছেন, আর শেফালি ঘাড় বাঁকিয়ে পৃথিবীর অত্যাশ্চর্য জিনিসটা দেখতে এতই মশগুল, একবারও চোখ তুলে দেখছে না সামনে কেউ রয়েছে কি না।
.
‘এমন করছিলি কেন বল তো?’
তিন-চার দিন হয়ে গেছে। সেদিন সম্ভবত হাসপাতাল ছাড়ার দিন। আমার কথার জবাব দেবে কি, শেফালি একবার গাঢ় গোলাপি রঙের কাঁথা বের করছে, পরপরই পছন্দ হচ্ছে না বলে অন্য আরেকটা দিয়ে মেয়েকে মোড়াচ্ছে। কাঁথার তো শেষ নাই, সেই যে ছোট কাঁথা থেকে বড় কাঁথা সেলাইয়ে মন দিয়েছিল, কেন্দ্রের সব বাচ্চাদের মোড়ানোর পরও কাঁথার কমতি হয়নি।
প্রশ্নটা পরে আরও কয়েকবার করেও জবাব পাইনি। চম্পা নামটা তার পছন্দ হয়েছিল, পরে বলেছিল, ‘কেমনে পাইলা নামটা?’
স্মৃতি-বিস্মৃতির অতল তল
কী মুসিবত চম্পার! মান্তুকে ঘরে ডেকে এনে থাকতে দেওয়ার ফল এখন কী করে সামলায়! সে রাতে মান্তুর কথাগুলো শোনার পর দুই-তিন দিন একটা কথাই ভেবেছে—কী করল! না হয় প্রথম দিন ফ্যাক্টরি থেকে ঘরে নিয়ে এসেছিল, আদর করে খাইয়েছিল, রাতে চৌকিতে বিছানা পেতে জবার ফেলে যাওয়া ফাঁকা জায়গায় শুতে দিয়েছিল, তাই বলে জিনিসপত্র নিয়ে চলে আসতে কেন বলল? যেদিন এসে উঠল সেদিনই খটকা লেগেছিল ওর সঙ্গে বড়, দামি ব্যাগ দেখে। বলে তো ছিল টানবাজার থেকে এক কাপড়ে বেরিয়েছিল, তা হলে ব্যাগ ভরতি এত জামা-কাপড়! ব্যাংকে টাকা জমানোর কথা অবশ্য বলেছিল, সেই টাকায়ই জামা-কাপড়? টাকা রেখেছিল নিশ্চয় টানবাজারের আশপাশে কোনো ব্যাংকে, খুনের আসামি হয়ে সেখানে টাকা তুলতে গিয়েছিল? কোন কথা বিশ্বাস করে, কোনটা না—চম্পা দিশা পায় না। মনে মনে চম্পা ভাবে, বললেই পারে যা বলেছে সব মিথ্যা, মিথ্যা তো আগেও বলত। এও ভাবে, কেন তাকে বলতে গেল?
বলে ভুল করেছে, না বললেই ভালো করত—এমন দোটানা মান্তুর মধ্যে আছে বলে মনে হয় না। খুনের ঘটনায় তার হাত নেই, এ কথা চম্পা মেনে নিয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে পড়লে যে কেউ, এমনকি সে নিজেও যে একই কাজ করত না তা বলা যায় না। খুন নিয়ে তাই চম্পা ভাবে না। কিন্তু অবাক লাগে মান্তু কেমন হেসে হেসে বলল, খুনিকে খুঁজে পেলে তো—সে আর বাসন্তী না, বাসন্তী মরে গেছে।
মান্তুর না বোঝার কথা না যে চম্পা তার কাহিনি শুনে ধাক্কা খেয়েছে। দিন কয়েক যেতে এক রাতে বলল, ‘আমার লগে ঘুমাইতে ডর লাগে, না ঘিন্না লাগে কও তো। মুখ তো চুন বানাইয়া রাখো। আইজ থাইকা আমি নিচে ঘুমামু।’
‘তর যা খুশি’ বলে চম্পা চৌকির এক পাশে সরে শুয়ে পড়েছিল, আর শুতে না শুতে মান্তু পাশে শুচ্ছে না মেঝেতে বোঝার আগেই ঘুমে চোখ অন্ধকার হয়ে এসেছিল। রাত তখন কত কে জানে, ঘুম ভাঙল পায়ে মান্তুর ছোঁয়ায়। প্রথমে ভেবেছিল হাত, ঘুম পুরোপুরি কেটে যেতে টের পেল হাত না, মান্তু তার পায়ে মুখ চেপে উপুড় হয়ে আছে। উঠে বসতে মান্তু পা ছেড়ে মুখ তুলল। অন্ধকারে কুঁজো হয়ে বসা ঢিবির মতো মান্তুকে তখন ভয় পাওয়ারই কথা।
মান্তু ধরা গলায় কী বলল চম্পা বুঝতে পারল না। একটু পরে সে আবার তার পায়ে মুখ নোয়াতে যাবে, চম্পা সাহস করে বলল, ‘মাইজরাইতে কী শুরু করছস?’
মান্তু এবার সোজা হয়ে বসে বলল, ‘মনো করছিলাম তুমারে কমু না, অনেক চিন্তা করছি, কী মনো করবা! শেষে থাকতে না পাইরা কইলাম। তুমি ঘিন্নাও আপিত্তি নাই, কিন্তুক ডরাইবা না।’
‘আমি ঘিন্নাইলে কী আর ডরাইলেই কী! যা করছস চিন্তা-ভাবনা কইরা করছস।’
মান্তু চুপ করে থাকল। একটু পরে বলল, ‘আমার এই ঘটনা জানলে তোমার ধারে আইতে কইতা?’
তাইলে কইলি ক্যান?’
‘না কইয়া থাকতে পারলাম না। আমি আর তুমি তো দুইন্যার দশজনের মতো না, আমরা ঘরছাড়া, জামাই খেদাইন্যা। পথে-ঘাটে লাথি-উষ্টা খাইয়া এই পর্যন্ত আসছি। মনো করলাম, তুমারে কওন যায়, তুমি তো আগের চম্পাবু না।’
‘মানে?’
‘আমি তুমারে ভুল বুজছিলাম। ভাবি নাই তুমি আমার কথা শুইন্যা এমন করবা। আমারে মাফ কইরা দেও। বুজি নাই। তুমি যে বদলাও নাই, একদম বুজি নাই।
‘তর কতা বুজি না।’
মান্তু জবাব দিল না।
চম্পা বলল, ‘আমি বদলাই নাই এর মানে কী?’
‘তুমি বদলাও নাই গো চম্পাবু, এট্টুও বদলাও নাই। এত কষ্ট কইরাও বদলাও নাই। ক্যামনে পারলা?’
চম্পা তার আগের প্রশ্নটাই করতে যাচ্ছিল, এমন সময় হঠাৎ পাশের ঘর থেকে মর্জিনার চিৎকারে কানে তালা লাগার জোগাড়। ‘ও মা গো ও আল্লা গো’ বলে সে গলা ছেড়ে কাঁদছে। চম্পা চৌকি ছেড়ে নেমে দরজা খুলতে যাবে, মাস্তু বলল, ‘রাখো, বাত্তি জ্বালাই।’
পাশের ঘরের দরজা খোলা, বাতি জ্বলছে, আর মর্জিনা দরজার মুখে হাঁটু গেড়ে বসে বুক চাপড়ে আহাজারি করছে। মর্জিনার মা-র জ্বর ছিল, আগের দিন চম্পা ঘর থেকে নাপা ট্যাবলেট নিয়ে খাইয়েছিল, পরে আর খোঁজ করেনি। কিন্তু বুড়ি মরে যেতে পারে একবারও ভাবেনি। মর্জিনাকে ঠেলে সরিয়ে চম্পা ভিতরে ঢুকল, চৌকিতে টানটান শোয়া মর্জিনার মাকে দেখতে ঝুঁকে পড়ে নাকে হাত দিল, বুকে হাত চাপল। বুড়ি সম্ভবত বেশ আগেই মারা গেছে, পাশে শুয়েও মর্জিনা টের পায়নি। আশপাশের ঘর থেকে মেয়ে-পুরুষ ভিড় জমাতে শুরু করেছে। চম্পার হঠাৎ জবার কথা মনে পড়ল। দিনের বেলা প্রায় দিন জবা-ই দেখত মর্জিনার মাকে। বুড়িকে যে পছন্দ করত তা না, তবে নাম ধরে ডাকলে ঠিকই যেত, কিছু লাগলে করে দিত, আবার বুড়ির আগের দিনের ভরা সংসারের গল্প শুনে চম্পাকে বলত, ‘সব মিছা।’ জবা যখন শুনবে, খুব কষ্ট পাবে!
রাতের অল্পই বাকি ছিল, ফজরের আজান হলো। চম্পা এক সময় খেয়াল করল মান্তু মর্জিনাকে ধরে বসে আছে। কান্নাকাটি থামিয়ে মর্জিনা দুশ্চিন্তায়— কিভাবে কী করবে। মান্তু তাকে শান্ত করতে বলছে সে থাকবে, মুর্দার গোসল করানো সে জানে, দোয়া-দরুদও কিছু জানা আছে। বস্তির মসজিদের ইমাম বা মুয়াজ্জিনকে দিয়ে জানাজা পড়িয়ে কাছে কোথাও দাফনের ব্যবস্থা করা যাবে, মর্জিনা যেন চিন্তা না করে। ঘরে এসে সে এক ফাঁকে টাকা বের করে কাকে যেন পাঠাল কাফনের কাপড় কিনে আনতে। চম্পা তার কাজকর্মে অবাক হলো। বেলা একটু বাড়তে চম্পাকে বলল সে ফ্যাক্টরিতে যাবে না, মর্জিনার সাথে থাকবে, আর ও-ঘরে চুলা ধরানো যাবে না, রান্নার ব্যবস্থা সে-ই করবে। মর্জিনা কাজ করে খানিকটা দূরে এক প্লাস্টিক কারখানায়, সেখানে কাকে দিয়ে খবর পাঠায় এ নিয়েও মাস্তুকে এর-ওর সঙ্গে কথা বলতে দেখা গেল।
চম্পার ইচ্ছা করছিল ফ্যাক্টরি কামাই দিয়ে মর্জিনার কাছে থাকে। কিন্তু উপায় নাই, অনেক কাজ, সামনের সপ্তায় বড় একটা চালান যাবে, রোজ ওভারটাইম করেও কুলানো যাচ্ছে না।
দেরি হয়ে যাচ্ছে দেখে চম্পা রাতের বাসি ভাত পেঁয়াজ-মরিচ ডলে বার দুই মুখে তুলে ঘরের বাইরে আসতে দেখল মর্জিনার ঘরের সামনে ভিড় কমেছে। কে যেন ভিতরে ক্যানকেনে গলায় কোরান পড়ছে, টানা পড়তে পারছে না, হোঁচট খেয়ে খেয়ে মেয়ে গলায় আওয়াজটা কোরান তেলাওয়াতের বলে মনে হচ্ছে না।
অনেক দিন পর বস্তিতে কেউ মারা গেল। যেতে যেতে ভাবল আম্মার বাসায় ফোন করে জবাকে খবরটা দেওয়া দরকার। শুনে মন খারাপ করবে, হয়তো কাঁদবেও। কয়েক দিন ধরে ভাবছে আম্মার ওখানে যাবে, সময় করতে পারছে না। ফ্যাক্টরিতে চাপ কিছুটা কমলে একদিন আধবেলা ছুটি নিয়ে যাবে। আম্মা ফোন করেছিলেন সেদিন, বলেছিলেন তার মা-র ফোন এসেছিল। মা-র ফোন মানে তো অন্য কেউ মা-র হয়ে ফোন করে। কিন্তু আম্মা বলেছিলেন তার মা নিজে ফোন করেছিল, কার সঙ্গে নাকি ফরিদপুর এসেছিল। শুনে সে খুব অবাক হয়েছিল। আম্মার সাথে কী কথা হয়েছে শোনা হয়নি। চম্পার মোবাইল আছে তার মায়ের জানার কথা না, কিন্তু আম্মার কাছে তার নম্বর ছিল, নম্বরটা যদি দিতেন, চম্পাকে তা হলে তার মা ফোন দিতে পারত। কথাটা বলতে আম্মা হায় হায় করে উঠেছিলেন, এ ভুলটা কেমন করে করলেন! কী কথা হয়েছিল না বলে আম্মা বলেছিলেন, ‘বাসায় আয়, বলব।’
মা ফরিদপুর কেন আসতে গেল, এ চিন্তাটা কয়েক দিন ধরে মাথায় ঘুরছে। কলকারচর ছেড়ে মা কোনো দিন বের হয়েছে শোনেনি। সেই কবে চম্পার এগারো-বারো বছর বয়সে মা তাকে আম্মার কাছে রেখে যে গেল, তার পর দেখা দূরের, মুখের কথাও শোনেনি। আম্মা যেতে মানা করেছিলেন, মা শোনেনি, চম্পাকে যেমন বলেছিল এ ছাড়া উপায় নাই, আম্মাকেও সে কথা বলে ভরসা দিয়েছিল, খবর দেবে, তবে আসবে না। কী আশ্চর্য মিল, মায়ের মতো সেও জবাকে এখন আম্মার কাছে রেখে এসেছে, তবে হারিয়ে যায়নি মায়ের মতো। সব সময় যোগাযোগ রাখছে, গিয়ে দেখেও আসছে। আম্মা জানতে চেয়েছিলেন কার সঙ্গে, কোথায় যাচ্ছে? জবাবে মা বলেছিল যাচ্ছে তার মতো আরেক ছিরাঙ্গনার সাথে, দুইজনে এক চরে গিয়ে কপালে যা আছে করবে। ছিরাঙ্গনা কথাটা মায়ের মুখে সেই যে চম্পা শুনেছিল, ভোলেনি। তখন পর্যন্ত সে বীরাঙ্গনা কথাটাও শোনেনি। যে চরে যাচ্ছে সেখানকার কথাও বলেছিল। আম্মা আর কিছু জানতে চাননি, খামে ভরে কিছু টাকা দিয়েছিলেন, চম্পার মনে আছে। যাওয়ার আগে আম্মাকে ধরে কেঁদেছিল, আর বারবার রেখাবু রেখাবু বলে তাকে মাফ করে দিতে বলেছিল। চম্পা তখনি জানতে পেরেছিল আম্মার নাম রেখা। কত বছর আগের ঘটনা, জবার এখন যে বয়স, তখন তারও তা-ই। একের পর এক মিল তাকে চমকে দিচ্ছে।
ফ্যাক্টরির কাছাকাছি চলে আসতে চম্পা মত বদলাল, আজ কামাই দেবে, কপালে যা থাকে। সে মালিবাগে আম্মার বাসায় যাবে। কাজের যা চাপ, মন্টু সিকদারের পা ধরলেও এ সময় ছুটি মিলবে না, তার চেয়ে না যাওয়াই ভালো। এক দিনের বেতন কাটবে, কাটুক।
.
দরজা খুলে আম্মা বললেন, ‘আয়।’
ভেতরে ঢুকে চম্পা এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে দেখে বললেন, ‘জবা ইশকুলে। পড়ালেখা সব খেয়ে বসে আছে। থ্রি পর্যন্ত না বলছিলি পড়ছে? ঠিক হয়ে যাবে। বাচ্চারা ভোলে যেমন তাড়াতাড়ি, শিখতেও সময় লাগে না।’
চম্পা উসখুস করে, সে কি জবার খবর নিতে ফ্যাক্টরি কামাই দিয়ে এসেছে? জবা ভালো থাকবে জানা কথা। ইশকুলে ভর্তির দিন আম্মা ফোনে খবরটা দিয়েছিলেন। জবার জন্য সে একটুও ভাবে না। আম্মা তার মায়ের কথা বলতে দেরি করছেন কেন?
আম্মা বললেন, ‘শেফালির শরীরটা ভালো না রে। এত বছর পরে আমার সাথে কথা বলল, গলার আওয়াজে মনে হলো আমার চেয়েও বুড়ি হয়ে গেছে। বলল, পেটে ব্যথা হয়, আগে মাঝে মাঝে হতো, এখন প্রায়ই হয়। যাদের সাথে থাকে ওরাই ডাক্তার দেখাতে ফরিদপুর এনেছে। এত বললাম বিকাশ করে কিছু টাকা পাঠাই, রাজি হলো না। তোর কথা বললাম। জবা আমার কাছে, এ খবরও দিলাম। কিছু বলল না।’
‘আমার কতা কিছু জানতে চাইল না?’
‘কী জানতে চাইবে বল! বিভিন্ন সময় যারা ওর হয়ে ফোন করত, তাদের তোর খবর দিয়ে বলতাম শেফালিকে গিয়ে যেন বলে। ওরা আমার কথা কতটুকু বুঝত, গিয়ে কী বলত, বলত কি না, কে জানে! সেদিন ওর ফোন পেয়ে তো আমি থ। প্রথমে বুঝতে পারছিলাম না কে কথা বলছে। যখন বলল রেখাবু আমারে ভুইল্যা গেছো, আমি শেফালি শেফালি বলে এত জোরে চিল্লিয়ে উঠেছিলাম কুলসুমের মা রান্নাঘর থেকে দৌড়ে এসেছিল। ভেবেছিল পড়ে হাত-পা ভেঙে চিল্লাচ্ছি।’
‘আমার কথা কি সব জানে?’
‘তোর কথা যদি বলতে শুরু করতাম, ওর কিছুই শোনা হতো না। তবু অল্প কথায় যা বলার বলছি। জবা ইশকুলে ছিল, না হলে জবার সাথে কথা বলতে বলতাম। অসুখটা ছাড়া মনে হলো ভালো আছে। ওখানে এক খামারির পরিবারের সাথে থাকে, ওরা মোষ পালে। বলল ওর দিকে তারা খেয়াল রাখে, যত্ন করে। খেয়াল যে রাখে তা তো বোঝা-ই যাচ্ছে, না হলে ডাক্তার দেখাতে ফরিদপুর আনে!’
‘আমার কথা কিছুই জানতে চায় নাই?’
আম্মা থতমত খেয়ে বললেন, ‘কত বছর তোকে ছেড়ে গেছে, এক-দুই কথায় জানা যায়! আর ফোনে কথা বলছিল মিনিট পাঁচেক … মনে হয় কোনো দোকানে পয়সা দিয়ে ফোন করেছিল, ভালোমতো শোনা যাচ্ছিল না।’
চম্পাকে চুপ থাকতে দেখে আম্মা বললেন, ‘শোন, যোগাযোগ যদি থাকত, অনেক কিছুই জানতে চাইত। তোকে যখন রেখে গেল, তোর তখন বয়স কত, তার পর এতগুলো বছর, সোজা কথা! কী জানতে চাইত বল?’
‘আমি কেমন আছি?’
কথাটা বলতে গিয়ে চম্পা যেমন কেঁপে উঠল, আম্মাকেও কাঁপিয়ে দিল। আম্মা তাকে টেনে নিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে একটা নিঃশ্বাস ছাড়লেন, নিঃশ্বাসের দোলাটা চম্পা টের পেল তার কপালে এসে পড়ল আর এও টের পেল সঙ্গে সঙ্গে মিলিয়ে গেল না, কিছুক্ষণ চরে-ফিরে চামড়ার সঙ্গে মিশে থাকল।
‘তোর সব কথা এক সাথে কী করে বলি বল! তবে বললাম না, যাদের দিয়ে শেফালি ফোন করাত, তাদের সময় সময় বলেছি ওরা যেন গিয়ে বলে। সব সময় একটা কথা বলতাম, তুই ভালো আছোস, তোর জন্য যেন চিন্তা না করে।
‘মায় আমারে দেখলে চিনব?’
‘কী করে বলি! তুই কি এখন আগের মতো? কী টিঙটিঙা ছিলি, আর খালি তো লাফাইতি, এক জায়গায় দুই মিনিট বসতে পারতি না। জবা কিন্তু তোর মতো না, ও কত বুঝদার! আমাকে তোর কথা কত বলে!’
‘আমি চিনতে পারুম মা-রে দেখলে?’
‘বললাম না, গলা শুনে মনে হলো আমার চেয়েও বুড়ি হয়ে গেছে। তবে তুই ঠিকই চিনবি, আর তোকে চিনবে না কী করে বলি! শেফালি তোকে দেখলে ঠিকই চিনবে। দেখতে ইচ্ছা করে?’
চম্পা সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিল না। উঠে গিয়ে রান্নাঘর থেকে পানি খেয়ে কুলসুমের মাকে ‘কী রান্না গো, সুন্দর বাস ছাড়ছে’ বলে দরজা ধরে কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে ফিরে এলো। আম্মা বললেন, ‘তোর ডিউটি নাই?’
চম্পা সে কথায় না গিয়ে আম্মার পায়ের কাছে বসে পড়ে বলল, ‘বড় মন পোড়ায়। আগে এমন হইত না, মা যেমন শিখাইয়া গেছিল আমারে ভুইল্যা যাইবি, ভুইল্যাই গেছিলাম। অখন খালি মনে অয় একবার যুদি যাইতে পারতাম …’
‘যাবি? যা দেখে আয়।
‘আপনেও লন। ঠিকানা তো জানি, ফরিদপুর সিএমবি ঘাট, এর পর টলারে কলকারচর।’
আম্মা আবার একটা নিঃশ্বাস ছাড়তে গিয়েও চেপে গেলেন। বললেন, ‘তোর কি মনে হয় আমার মন চায় না ওকে দেখি। কিন্তু কিভাবে বল, ঘরে হাঁটাহাঁটিতেও হাঁপাই, আমাকে তুই ট্রলারে তুলবি!’
‘আমরা টলারে রিজাব যামু।’
‘আমার মাঝে মাঝে ইচ্ছা হয় কোনোভাবে যদি ওকে এখানে আনা যেত, থাকত আমার কাছে। পেটে ব্যথার কথা শুনে কয়দিন ধরে এ কথাই ভাবছি। বড়সড় যদি কিছু হয়ে থাকে, ওখানে কী চিকিৎসা হবে! রাজি হবে না জানি, ও যা জিদ্দি!’
‘চলেন না আম্মা, মায়রে একবার চোক্ষের দেখা দেখি। ছুটুকালের দেখা, ভালামতো মুখটাও মনে নাই। ডাইন চোউখের উপরে মেঞ্জ আছিল মনে আছে? জড়ুল কয় না? মনে আছে? টাইট কইরা মাথায় ঘোমটা দিত, খুইল্যা না যায় এই জইন্য কিলিপ দিয়া আটকাইত।’
‘মনে থাকবে না কেন? শেফালির চেহারা আমাকে মনে করাতে চাস! জড়ুলটা নাকি ছোটবেলা ছিল না, অনেকের জন্মের সময় থাকে। শেফালি আমাকে বলেছিল ওরটা পরে হয়েছিল, তবে খুব ছোট ছিল, ভুরুতে ঢাকা পড়ে থাকত। ক্যাম্পে পোকার কামড়ে ইনফেকশন হয়ে বড় হয়ে গিয়েছিল। আর কী মনে আছে বল তো?’ ক্যাম্প কথাটা শুনে চম্পার গা শিরশির করে উঠল। বহু কাল বাদে কথাটা শুনল।
আম্মার সেদিকে খেয়াল নাই। চম্পা এত কাল পর তার মা-র মুখ মনে করতে চাচ্ছে, এ সুখে হোক বা দুঃখে, একই কথা আবার বললেন, ‘বল, আর কী?’
চম্পা হতাশ মুখ করে তাকাল, যার মানে আর কিছু মনে নাই।
‘চুলের কথা মনে নাই তোর? মুখটা হুবহু পানপাতার মতো। আমি এক সময় ছবি আঁকতাম, শেফালিকে দেখে, ওর চোখমুখ, থুতনির গড়ন দেখে খুব ইচ্ছা করত ওর মুখটা আঁকতে বসি। হয় নাই, কেন্দ্রে তখন কত কাজ! আর শুনলে তো বিশ্বাস করবি না শেফালি গানও গাইত।
‘কী কন!’
‘কেন্দ্রে মালতী ওকে নিয়ে গাইত। মালতীকে তুই চিনবি না। শেফালির গলা ভালো ছিল, তবে গান-টান আগে গায় নাই, মালতীর পাল্লায় পড়ে গাইত, ঝুমুর বয়াতির গান, অন্য কিছু না। ঝুমুর বয়াতিকেও চিনবি না।’
‘না চিনলাম, একবার লন না আম্মা যাই।’
শেফালির মাইয়া তো চম্পা-ই
কেন্দ্রে তো বাচ্চাসহ শেফালি ফিরল। মমতার কথা আগে বলেছি, এ বুঝি আরেক মমতা। কী যে করবে যেন বুঝে উঠতে পারছে না। বাচ্চাকে এই একটা জামা পরাচ্ছে, পরপরই অন্য একটা, আর আশপাশে কেউ থাকুক বা না থাকুক, ও সোনা ও সোনা বলে কত যে কথা বলত, হেসে গড়িয়ে পড়ত! অন্য মেয়েদের কেউ কেউ মুখ টিপে হাসত। শেফালি ফিরেও দেখত না। চম্পা ডাকটা ওর মুখে তখন কদাচিৎ শুনেছি। আমাকে বলত, এত সুন্দর নাম, সে যদি মা হয়ে এ নামে মেয়েকে ডাকে, নজর লাগতে পারে। এও বলত গ্রামের দিকে বাচ্চা যদি দেখতে সুন্দর হয়, ছোটবেলা এলেবেলে যা খুশি—খেদি, বুচি, মেনি একটা কিছু ডেকে মা-রা বাচ্চার গায়ে খারাপ বাতাস লাগতে দেয় না। বলতাম, ও যে সোনা-সোনা করে, এতে বাতাস লাগে না? চটজলদি জবাব দিত, তার মেয়েকে খেদি, বুচি ডাকতে পারবে না। তবে চুপিচুপি চম্পা ডেকে দেখেছে, নাকে হুবহু চাঁপা ফুলের ঘ্রাণ পায়, আর মেয়ের গায়ে তো ঘ্রাণটা আছেই। অবাক হতাম, এ সেই শেফালি যার মুখ থেকে কথা বের করা দূরের, নামটা পর্যন্ত জানতে কত দিন অপেক্ষা করতে হয়েছিল!
এদিকে কেন্দ্রে তখন অন্যরকম ঘটনা ঘটতে শুরু করেছে যার জন্য আমরা কেউ প্রস্তুত ছিলাম না। বরং আমরা যারা গোড়া থেকে ছিলাম তাদের ধারণা ছিল আসল সমস্যাগুলো মেটানো গেছে। অনেক মেয়েকে, বিশেষ করে যারা শহরের বা মধ্যবিত্ত পরিবারের, তাদের আত্মীয়-স্বজন এসে নিয়ে গেছে। এ ছাড়া কিছু মেয়ে নিজেরাই বাড়ি-ঘরে ফিরে গেছে। গিয়ে কে কী ধরনের অসুবিধায় পড়েছে সেসব খবরও পেতাম, তবে কেন জানি মনে হতো এত ঝড়-ঝাপটার পর মেয়েরা নিজেরা বা তাদের পরিবার মিলে পরিস্থিতি ধীরে ধীরে সামাল দেওয়ার কায়দা-টায়দা রপ্ত করে ফেলবে। নির্বোধের মতো এসব ভাবতাম।
মধ্যবিত্ত বা শহরের বা মোটামুটি অবস্থাপন্নরা যে কাজটা করত তা মোটামুটি এক ধাঁচের। তারা মেয়েদের নিয়ে সোজা বাড়িতে গিয়ে উঠত না, দূরে কোনো আত্মীয়ের বাড়িতে বা অন্য জায়গায় ঘর ভাড়া করে কয়েক মাস কাটিয়ে ফিরত। এতে নিশ্চয় ফাঁকিঝুঁকি বা মিথ্যার কারসাজি থাকত, তাতে হয়তো কারো কারো বেলায় সুবিধা হতো, আর সেটা নির্ভর করত কে কতটা চালাকি বা ক্ষেত্রবিশেষে সামাজিক প্রতিপত্তি দিয়ে পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে পারছে। কোনোটাই সোজা কাজ ছিল না। হাসা নামে একটা মেয়ের কথা মনে আছে, অবস্থাপন্ন ঘরের মেয়ে, কেন্দ্রে আনার কিছু দিন পরই ওর বাবা-মা তাকে নিয়ে কলকাতায় চলে গিয়েছিল। অন্তঃসত্ত্বা হলেও প্রেগনেন্সি টারমিনেট করার অবস্থায় ছিল। সুস্থ হওয়ার পর মেয়েকে তারা ওখানেই এক কলেজে ভর্তি করে এসেছিল। হাসা অবশ্য বছরখানেক পরে ফিরে এসেছিল, বাবা-মা তখন তাকে অন্য কোনো শহরে রাখার ব্যবস্থা করেছিল। এরপর কী হয়েছিল জানতে পারিনি।
কেন্দ্রে তখন যে ঘটনাগুলো ঘটছিল সেসব বাড়ি-ঘরে চলে যাওয়া মেয়েদের ফিরে আসা নিয়ে। কয়েকজনের কথা ভোলার না। মানিকগঞ্জের মালতীর কথা আগে বলেছি। বাবা-ভাইদের তার চোখের সামনে বাড়ির উঠানে লাইন করে মেরেছিল। কেন্দ্রে আনার পর থম ধরে বসে থাকত, জোর করে কিছু খাওয়ালে খেত, নয়তো বসেই থাকত। শুতে দেখিনি কখনো। ঘুমাত কখন বুঝতে পারতাম না, ঘুম এলে হয়তো বসে বসেই চোখ বুজত। বেশ কিছু দিন পরে এক জ্ঞাতির সঙ্গে চলে গিয়েছিল। কথা ছিল সেই পরিবারই তার দেখাশোনা করবে। পাঁচ মাস পরে ফিরে যখন এলো, বলল সেই পরিবার তার খুব যত্ন করত। তবে চলে এলো যে? মালতী জানাল তার কারণে সেই জ্ঞাতি কাকা না জেঠার অসুবিধা হচ্ছে। লোকজন আজেবাজে কথা বলে। সে তাই কেন্দ্রেই থাকবে, কাজ করবে যা দেওয়া হবে, শুধু থাকা আর এক বেলা খাবার হলেই চলবে। অন্যদের চেয়ে ছোট বলে আমাকে মাসি ডাকত। আগে মুখে খিল এঁটে থাকা মালতী তখন অনর্গল কথা বলত। বলত, ‘মাসি গো, আমি সব কাম পারি, যা দিবা সব পারব।’ অবশ্য সে যে গান জানে, আর দুই দিন বাদে তার গানের কারণে কেন্দ্রের পরিবেশ অনেকটা পাল্টে যাবে তা তখন বোঝা যায়নি।
মালতীর কিছু আগে-পরে আরও যারা ফিরে এলো তাদের মধ্যে ছিল হবিগঞ্জের পিয়াসা, মাদারীপুরের রিজিয়া আর আনোয়ারা সম্ভবত নরসিংদীর। সে সময় খবর পাচ্ছিলাম বাড়িঘরে মেয়েরা টিকতে পারছে না। রিজিয়া বলল সে যেদিন গেল, বাড়িভরতি গ্রামের মেয়ে-পুরুষ। কী? তারা বীরাঙ্গনাকে দেখতে এসেছে। পিয়াসার একটা ঘটনা খুব মনে পড়ে। হবিগঞ্জ রেলস্টেশনের কাছে তাদের বাড়ি। পাশেই কয়েক ঘর হিন্দু। মিলিটারিরা হিন্দু বাড়ি ভেবে তাদের বাড়িতে ঢুকে প্রথমেই তার দুই ভাই ও বোনজামাইকে লাইন করে দাঁড় করাল। পিয়াসা লুকিয়েছিল ভাঁড়ার ঘরে। ভাই ও বোনজামাইকে গুলি করবে-করবে এমন সময় সে চিৎকার করে এসে ওদের পায়ে পড়েছিল। যুবতী, আবার সুন্দরী মেয়ে দেখে তাক করা রাইফেল নামিয়ে সৈন্যদের যে সর্দার, সে সঙ্গের অন্যদের কী হুকুম দিল, ওরা লাইন করা ভাই ও বোনের জামাইকে ফেলে ওকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে গাড়িতে তুলেছিল। পিয়াসার কথা পরিষ্কার, তার কারণে হিন্দুপাড়া তো বাঁচলই, দুই ভাই ও বোনের জামাই গুলির মুখে পড়েও জান ফিরে পেল। কেন্দ্র ছেড়ে সে যখন গেল, ভাবল তার জন্য এতগুলো মানুষ বাঁচল, এবার নিশ্চয় তারা সবাই মিলে তাকে বাঁচাবে।
কীসের কী? ভাইরা তার সামনে পর্যন্ত পড়ে না, পালিয়ে পালিয়ে থাকে। আর বোনের জামাই যে তাকে বোনের পীড়াপীড়িতে কেন্দ্র থেকে নিয়ে গিয়েছিল, সে পারে তো লজ্জা-শরমে ইঁদুরের গর্তে লুকায়, যেন পিয়াসাকে না, মিলিটারিরা ওকেই ধরে নিয়ে বাংকারে দিন-রাত বলাৎকার করত। পিয়াসা ছিল জেদি মেয়ে, বাড়ির অবস্থা দেখে নিজে নিজেই একদিন কাউকে কিছু না বলে ঢাকায় চলে এসেছিল। তার একটাই দুঃখ, তার জন্য এতগুলো মানুষ বাঁচলেও সে বেঁচে থেকে মরল।
শেফালির চম্পাসহ তখন সম্ভবত আরও পাঁচ-ছটা বাচ্চা ছিল কেন্দ্রে। মমতার বাচ্চা এদের মধ্যে বড়। মমতার স্বামী ছিল, দুটো ছেলেমেয়েও। একদিন আমাদের অবাক করে মমতার স্বামী এসে হাজির। বলল, নিয়ে যেতে এসেছে। মাঝবয়সি লোক, মুখে দাড়ি দেখে বোঝা যায় নিয়মিত ধর্ম-কর্ম করে। আমরা অপেক্ষা করলাম সে আর কী বলে, এতদিন কেন আসেনি? যা বলল তা তার কাছে থেকে আশা করিনি। বলল, অনেক চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নিয়েছে মমতাকে নিয়ে সে আগের মতো সংসার করবে। যা ঘটেছে তাতে মমতার হাত ছিল না, সে স্বামী হয়ে স্ত্রীকে রক্ষা করতে পারেনি, রোজকেয়ামতে এর কী জবাব দেবে! আমরা এতদিন মমতাকে রেখেছি, সেজন্য সে খুব কৃতজ্ঞ। মমতার বাচ্চা হওয়ার খবর সে জানে, বাচ্চারই-বা কী দোষ! সে সব দিক দিয়ে তৈরি, আমরা যেন মমতাকে বাচ্চাসহ তার হাতে তুলে দিই। কথাগুলো বলছিল আস্তে আস্তে, থেমে থেমে। এক সময় খানিকটা গলা চড়িয়ে বলল, দুনিয়ায় কে কী ভাবল, সে পরোয়া করে না, সে তার স্ত্রীকে চায়, আমরা যদি দয়া করি। মমতাকে ডাকা হলো। প্রথমে আসতে চায়নি, পরে যখন এলো, যা দেখলাম এক কথায় হৃদয়বিদারক। দুজন একে অন্যকে জড়িয়ে ধরে খুব কাঁদল। কিছুক্ষণ পর মমতা চোখ মুছে আমাদের সামনে ঘটনা ঘটিয়ে ফেলার লজ্জায়ই হয়তো স্বামীকে হাত ধরে টেনে পাশের ঘরে নিয়ে গেল। আমরা বোকার মতো এ ওর দিকে তাকালাম। সেদিনই মমতা তার ছেলেসহ চলে গিয়েছিল।
ফিরে আসা মেয়েদের পরিবর্তনটা ছিল চোখে পড়ার মতো। তারা অনেক কথা বলত, রাগ-দুঃখের কথাই যে বলত তা না, হাসি-ঠাট্টাও করত। ততদিনে কেন্দ্রে সমাজসেবা দপ্তরের সাহায্যে মেয়েদের নানা ধরনের হাতের কাজ শেখানো শুরু হয়েছে। কেউ সেলাই শিখছে, কেউ এমব্রয়ডারি, পুতুল বানানো, বাঁশ-বেতের নানা কাজ। আশ্চর্য যা, যা শেখানো হচ্ছিল, অল্প দিনেই তারা ধরে ফেলছিল। কাজ করতে করতে কেউ কেউ গুনগুন করে গান গাইত। দিনকতক যেতে গানের গলাগুলো কিছুটা উঁচুতে চড়তে দেখা গেল—মূল যে সে মালতী। গাইত সে তার এলাকার গান, বলত ঝুমুর বয়াতির গান। নিজের তার চমৎকার গলা, অন্যদের গলা মেলাতে বলত তার সাথে। এক দিন দেখি শেফালিও দলে ভিড়েছে।
এ সময় একটা অন্যরকম ঘটনা ঘটল। আনোয়ারা, যাকে খুব সম্ভবত নরসিংদী থেকে আনা হয়েছিল, তার বিয়ের প্রস্তাব এসে হাজির। আনোয়ারা বাড়িতে গিয়ে মাস দুয়েকের মধ্যে ফিরে এসেছিল। প্রথমে বলতে চায়নি কেন, পরে একদিন নিজে থেকেই বলল বাড়িতে বাবা-মা নাই, থাকে তার বড় বোন ও তার ঘরজামাই বর। সেই বোনের বর-ই নাকি আকারে-ইঙ্গিতে কুপ্রস্তাব দিত, সাড়া না পেয়ে বলতে ছাড়ত না, ‘পাঞ্জাবি মিলিটারিরে দিবা, আমারে ক্যান দিবা না?’ বোনকে জানিয়ে কাজ হয়নি। বোনের জামাই উল্টো তার কয়েকজন ইয়ার-দোস্ত নিয়ে বাড়িতে তাসের আড্ডা বসানো শুরু করেছিল। বোন একদিন এক আত্মীয়ের বাড়ি গেছে, এ সুযোগে দলবেঁধে চার-পাঁচজন মিলে তারই ঘরে তাকে ধর্ষণ করে। শুনেছে দলে মুক্তিবাহিনীর একজন ছিল। সেই মুক্তি পাঞ্জাবিদের ওপর রোখ মেটাতেই নাকি শামিল হয়েছিল। আনোয়ারার কথায় দুঃখ-কষ্টের ছাপ ছিল বলে মনে পড়ে না; একটা প্রশ্ন করেছিল, ‘পাঞ্জাবিগো হাতো ধরা না খাইলে আপনেরা আমারে এইখানে রাখতেন? বাঙালিরা করলে তো কিছু না।’
একদিকে এই ভয়ঙ্কর ঘটনা, আবার বিয়ের প্রস্তাব! যে প্রস্তাব দিয়েছে সে নাকি পত্রিকায় বিজ্ঞাপনও দিয়েছে বীরাঙ্গনা বিয়ে করতে চায়। পরে রীতিমতো ঘটক পাঠিয়ে প্রস্তাব। সে সময় পত্রিকায় মাঝে মাঝে ‘বীরাঙ্গনাকে বধূ করতে চাই’ এমন বিজ্ঞাপন চোখে পড়ত। আনোয়ারা ছিল সুন্দরী, লোকটা নাকি তাকে কোথাও দেখেছে। কেন্দ্রের মেয়েরা বেশ কৌতূহল দেখাল এ নিয়ে। তারা অবশ্য আনোয়ারার পরের ঘটনা বা ফিরে আসার কারণ জানত না। কিন্তু সে অবস্থায় আনোয়ারাকে বিয়ের কথা বলা আমার পক্ষে কিছুতেই সম্ভব ছিল না। একদিন খোদ পাত্র আমার বাসায় এসে নিজের পরিচয় দিল। বলল, বঙ্গবন্ধুর ডাকে সে এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তার বাবা-মা-র এতে আপত্তি নেই। এও জানাল তার বাড়ির অবস্থা ভালো, তবে সে ঠিক করেছে শহরে, মানে ঢাকায় থাকবে। দেখলাম পোশাক-আশাকে মোটামুটি পরিপাটি, দেখতেও মন্দ না। আমার স্বামী তখন বাসায় ছিলেন, তিনিও শুনলেন। মামুলি কিছু প্রশ্ন-ট্রশ্ন করলেন। পাত্রের এক কথা—তার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত, বঙ্গবন্ধুর ডাকেই সে উদ্বুদ্ধ হয়েছে। তাকে তখন কিছু বললাম না। এই নীরবতা হয়তো তাকে আশাবাদী করে থাকবে। দুই দিন পরে আবার এলো, এবার বলল সে তার পুরো পরিকল্পনা শোনাতে এসেছে। কী সেটা? বলল, আগেই তো জানিয়েছে বিয়ের পর ঢাকায় থাকবে, ঢাকায় থাকতে গেলে ব্যবসাপাতি করতে হবে। কী ব্যবসা ঠিক করেনি, তবে তার ইচ্ছা ইন্ডেন্টিং করবে, দেশে তো ব্যবসা বলতে এক ইন্ডেন্টিং-ই। ব্যবসার ক্যাপিটাল বাবদ তার কিছু আছে, আরও কিছু লাগবে। সেদিনও স্বামী বাসায় ছিলেন। আমি কিছু বলার আগেই গম্ভীর গলায় বললেন, তা তো বটেই, ক্যাপিটাল ছাড়া ব্যবসা কী করে হবে! তা কত লাগবে, মানে কত পেলে সে বীরাঙ্গনাকে বিয়ে করে বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সাড়া দেবে? বলল, বেশি না, লাখখানেক হলে চলবে। আমি অপেক্ষা করছিলাম এর পর কী হয়, জানতাম কিছু একটা হবে। তবে অতটা ভাবিনি। একটা গর্জনে বসার ঘরটা কেঁপে উঠল, ‘গেট আউট, আউট।’ আমি ভয়ে ছিলাম, ঠান্ডা মানুষ, খেপে গিয়ে না গায়ে হাত তোলেন। কোন ফাঁকে পালিয়ে বেঁচেছিল খেয়াল করার সুযোগ পাইনি। পরে শুনেছি এমন ঘটনা অনেক ঘটেছে। বাবা-মা বা আত্মীয়-স্বজন দেদার টাকা-পয়সা দিয়ে আপদ বিদায় করার পথ খুঁজেও ফল পায়নি। বিয়ে হয়েছে, পরে টাকা-পয়সা হাতিয়ে কেটে পড়েছে।
শেফালিকে নিয়ে মোটামুটি নিশ্চিন্ত ছিলাম, যেভাবে চম্পাকে নিয়ে মেতেছিল তাতে দুশ্চিন্তার কারণ দেখিনি। কারণ কিন্তু সে ঘটাল। চম্পার বয়স তখন চার মাসের মতো, ঘাড় শক্ত না হলেও ডাকলে চোখ ঘুরিয়ে তাকায়, হাসে, হাত-পা নাড়ে। এক দিন দুপুরের দিকে চেঁচামেচি কানে আসতে ছুটে গিয়ে দেখি চম্পাকে মেঝেতে ফেলে শেফালি দূরে বসে হাত-পা ছুড়ে চিৎকার করছে। তাকে ঘিরে আছে চার-পাঁচজন। চিৎকার করে শেফালি বলছে, ‘এর নাক-মুখ আমাগো মতো না, চউখ দেখলে ডর লাগে, এরে আমি পালমু না। এই জাউরারে আমি ক্যান দুধ খাওয়াই!’
নতুন বিপদ। কী করি! চম্পার চেহারায় একটা রুখু ভাব জন্মের কিছু দিন পরেই খেয়াল করেছিলাম। ছোট বাচ্চা হিসাবে নাকটা বেশি খাড়া, কটা চোখ, উঁচু চোয়াল, আর গায়ের রঙ ফ্যাকাসে সাদা। শেফালি কি আগে এসব খেয়াল করেনি? যেভাবে সারাক্ষণ চম্পাকে নিয়ে পড়ে থাকত, খেয়াল না করার কথা নয়। আর সত্যি যা তা মেনে নিয়েই তো সে চম্পার মা বলে নিজেকে এত দিন ব্যস্ত রেখেছিল। হঠাৎ কী হলো?
আমাকে দেখামাত্র সে আরও উত্তেজিত হয়ে পড়ল। আমিই যত নষ্টের মূল, কেন চম্পা হওয়ামাত্র নার্সের হাত থেকে কেড়ে নিয়ে পরনের শাড়িতে মুড়ে ফেলেছিলাম?
রাগ হচ্ছিল খুব। কেন্দ্রে এতগুলো মেয়ে, সবাই তারই মতো ভুক্তভোগী, তফাত বলতে সবাই গর্ভবতী ছিল না বা বাচ্চার মা হয়নি। কিন্তু আমি যে এতগুলো মেয়ের মধ্যে তাকে কখনো চোখের আড়াল হতে দিইনি, সেই প্রথম থেকে বলতে গেলে বুকে করে রেখেছি, এর প্রতিদান এভাবে দিচ্ছে!
কথা না বলে সরে গিয়েছিলাম। যাওয়ার আগে অন্য যারা ছিল তাদের ইশারায় চম্পার দিকে খেয়াল রাখতে বলেছিলাম। মনে আছে সেদিন সোজা বাসায় এসে পুরো দুই দিন কেন্দ্রে যাইনি। সেই প্রথম। তিন দিনের দিন গিয়ে শুনলাম আমি চলে আসার পর চম্পাকে কেউ নিজের কাছে নিয়ে রেখেছিল। গুঁড়োদুধ খাইয়েছিল। শেফালি নাকি বেশ কিছুক্ষণ পরে আমার খোঁজ করেছিল, আর পরের দুই দিন একটু পর পর যাকে পাচ্ছিল জিজ্ঞেস করছিল আমি কোথায়। আমার আর ওর সম্পর্ক জানতে কারো বাকি ছিল না, কেউ কেউ নাকি বলেছিল আমি আর আসব না, ও যে কথা বলেছে এর পর আমি হয়তো ওর মুখ দেখতে চাইব না।
একে তো আমাকে পাচ্ছে না, তার ওপর এমন কথা, শেফালি ভেঙে পড়েছিল। শোনার পরও আমার ইচ্ছা হয়নি ওকে দেখি। চম্পার খবর নিতে গিয়ে জানতে পেরেছিলাম যে তাকে নিয়েছিল, ভালোভাবেই দেখাশোনা করেছে। দ্বিতীয় দিনে নাকি শেফালি হন্যে হয়ে খুঁজছিল চম্পা কোথায়, কে নিয়েছে? তাকে বলা হয়নি চম্পা কার কাছে। শেফালি পাগলের মতো কেন্দ্রের সব কটা ঘর ঘুরে চম্পাকে পেয়ে বুকে চেপে নিজের জায়গায় গিয়ে অনেকক্ষণ ঠায় বসেছিল।
তিন দিনের দিন যখন আমার সামনে এসে চুপচাপ দাঁড়িয়েছিল, আমি বলেছিলাম নিজের তার কিছু করার দরকার নেই, এমন একটা বাচ্চার খবর পেলে দত্তক নিতে অনেকে ছুটে আসবে। দেশের মানুষ ছাড়া বিদেশিরাও আসতে পারে। বিদেশিরা তো কত বাচ্চা নিয়ে চলে যাচ্ছে। কথা শুনে শেফালি কাঁপতে কাঁপতে বসে পড়েছিল।
আমার তখন মনে হয়েছিল শেফালির দিকে আমার এতটা মনোযোগ দেওয়া ঠিক হয়নি। আমার আশকারাই হয়তো ওকে স্বাভাবিক হতে দিচ্ছে না। পরের কয়েক দিন ওকে এড়িয়ে চলেছিলাম। কেন্দ্রে কাজের অভাব নেই, শুধু শেফালি শেফালি করলে আমার চলবে না। কষ্ট হতো, তারপরও নানা কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখতে চাইতাম। শেফালি সুযোগ খুঁজছিল। এক বিকালে বসে আছি, শেফালি ঢুকেই দরজা বন্ধ করে মেঝেতে বসে পড়ল। আমি দেখেও না দেখার ভান করলাম। ভেবেছিলাম কান্নাকাটি জুড়ে মাফ চাইবে। সে চুপচাপ বসে থেকে বলল ক্যাম্পে থাকার সময়ের কোনো ঘটনা তো আমাকে বলেনি, আমিও শুনতে চাইনি। আমি সাড়া দিলাম না। সে আরও কিছু সময় চুপ থেকে বলতে শুরু করল তাকে ধরে নিয়ে যাওয়ার পর প্রায় সময়ই তার খেয়াল থাকত না সে জেগে না ঘুমিয়ে। কখনো কখনো অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকত। এ অবস্থায়ও একটা শুঁটকো, দড়িপাকানো চেহারার মিলিটারির মুখ ভোলেনি। সেদিন চম্পাকে তেল মাখাচ্ছে, হঠাৎ সেই মুখটা চোখে ভেসে উঠতে তার মনে হলো চম্পার মুখে অবিকল সেই মুখ। ভাবামাত্র তার মনে হয়েছিল সে এখানে নেই, সেই ক্যাম্পে পড়ে আছে, শরীরের ওপর পাথরের মতো দড়িপাকানো লোকটা। মাথা ঘুরছিল, আর ভাবছিল এ কে, কাকে তেল মাখাচ্ছে, দুধ খাইয়ে বড় করছে!
কেন্দ্রের মেয়েদের কাছে আমরা তাদের নির্যাতনের কাহিনি কখনো শুনতে চাইতাম না। কেউ কেউ বলতে চাইলেও না, তবু কেউ কেউ বলে ফেলত। শেফালি টু শব্দ করেনি কোনো দিন।
শেফালি বলল শীত পড়ে গেছে, কাঁথায় চম্পার শীত ধরবে না, ওর জন্য নরম আর ছোট একটা কম্বল যদি পায়। কতক্ষণ ওকে অগ্রাহ্য করি, বিশেষ করে প্রথমবারের মতো ক্যাম্পের ঘটনা শোনার পর। বললাম এনে দেব। শেফালি মুখ তুলল, অপেক্ষা করল যেন আমি তাকাই ওর দিকে। তাকালাম। বলল, ‘ওরে অখন থাইক্যা চম্পা ডাকুম, নজর লাগলে লাগুক, শেফালির মাইয়া তো চম্পা-ই।’
কাউয়া ও পলায়ন পর্ব
সেদিন মায়ের চুলের কথা আম্মার মুখে শুনে চম্পা অবাক হয়েছিল। কই, তার তো মনে পড়ে না। হয়তো আগে অনেক চুল ছিল, পরে কমে গিয়েছিল বা ছেঁটে ফেলেছিল। না ছেঁটে কী করবে! মাথাটা তো সারাক্ষণ হয় ঘোমটা নয় ওড়নায় টাইট করে ঢেকেঢুকে রাখত।
অনেক দিন তাকে অপেক্ষায় রেখে মা যখন নিজের কাহিনি বলতে মুখ খুলেছিল, চম্পার সেই ছোট বয়সেই মনে হয়েছিল কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে দিনের পর দিন আটকে থাকার যন্ত্রণা-কষ্ট মা হয়তো এক সময় ভুলে যেত, যদি না চেনা-পরিচয়ের মানুষের দেখা মিলত বা অজানা-অচেনা মানুষজনও তাকে চিনে ফেলত। মা বলত, ‘যেইখানে যাই দুই দিন বাদে কেউ না কেউর দেখা মিলে। ভাগি কি এমনে! আমার কী, পলাই তো তোর লাইগ্যা। ঢাকা ছাড়লাম, মনো করলাম চিটাগান অচিন জায়গা, কে কার খোঁজ পাইব! লাভ অইছে কিছু! কাউয়া নাই কুনখানে!
মায়েরও যে দোষ ছিল না চম্পা কী করে বলে! মা নিজেই বলত, ‘সরকার একটা মার্কা দিয়া মনো করল কামের কাম করছে—বীরাঙ্গনা। যুদ্ধে যারা গেছে— ঠেকায় পইড়া যাউক বা সাইধা যাউক, গুলি ফুটাউক আর না ফুটাউক—তারা বীর। কিন্তু আমরা বীর হই কুন আক্কেলে! মিলিটারিরা বাংকারে আটকাইয়া দিনের পর দিন অইত্যাচার করছে—এই বীরের নমুনা! আর সরকারের লগে তাল দিয়া যারা সারা দেশ ঢুইড়া আমরারে বাইর করল—কত মিঠা বুলি, কত মায়া, দুঃখে পরান ফাটে আর কি—তারা কি কম বীর! নাম-ধাম, ফটো ছাইপ্যা দুনিয়ারে জানান দিল এরা আরেক কিসিমের বীর, বাংকারের বীর!’
মায়ের দোষ বেকুবের মতো ক্যামেরার সামনে নিজের এত বড় শরমের কথা বলেছে, মুখে কিছু আটকায়নি। এর পর আর কিছু থাকে! বড় বড় ছবি দিয়ে কাগজে নাম ছাপা হবে, দেশে-বিদেশে বই বের হবে, মা কি কোনো দিন চিন্তা করেছে! করেনি বলেই কাউয়া পেছনে লেগেছে। যারা চিনত না জানত না, তারাও বীরাঙ্গনাকে চিনল। চিনে ফেলার ঘটনাগুলোর মধ্যে কয়েকটার কথা চম্পা এত বছর পরেও পষ্ট মনে করতে পারে।
ঢাকা ছেড়ে মা তাকে নিয়ে চিটাগাংয়ে এক বড় ব্যবসায়ীর বাড়িতে কাজ নিল। জায়গার নাম যত দূর মনে পড়ে নাসিরাবাদ। মা হয়তো ভেবেছিল যে ভুলটা করেছে ক্যামেরার সামনে মুখ খুলে, ছবি তুলতে দিয়ে, তার খেসারত যদি বান্দিগিরিতে হয়!
মাস ছয়েক কোনো বিপদের আলামত পায়নি। চম্পার বাপ মারা গেছে তার জন্মের পরপর, কলেরায় এক রাতে সব শেষ—এ গল্প নিয়ে যেমন সন্দেহের কারণ ছিল না, তেমনি ওর বাপের চেহারার নকশা কি ও পেয়েছে, গায়ের রঙ, বিড়ালের মতো কটা চোখ, মা-র চেহারার সঙ্গে তো মিল নাই, এ ধরনের কথাবার্তায়ও রাতের ঘুম হারাম হওয়ার কারণ ছিল না। কিন্তু মায়ের কপালের ফের। সেই যে ক্যামেরার সামনে তাকে অনেকক্ষণ দাঁড় করানো হয়েছিল, মাথায় ঘোমটা থাকলেও কড়া আলোর ঝলকানিতে চেহারাটা যে তার পরিষ্কার, না চেনার উপায় নাই, মা তা জানবে কী করে! বাড়িওয়ালি মহিলা যাকে তার মা আম্মা ডাকত আর যিনি তাদেরও বেশ পছন্দ করতেন—না করার কারণ ছিল না, মন পাওয়ার জন্য তার মা জান-প্রাণ দিয়ে খাটত, তাকেও খাটাত—সেই মহিলার হঠাৎ একদিন কী চেহারা!
ঘটনা সোজা। বিজয় দিবস ছিল সেদিন। এক সাগর রক্ত আর কত মা-বোনের ইজ্জতের দামে দেশ স্বাধীন হয়েছে এ কথা তো খালি-খালি বললে হবে না। প্রমাণ হাজির করতে হবে। যারা মারা গেছে মানে শহিদ হয়েছে তাদের তো আর পাওয়া যাবে না; পাওয়া যাদের যাবে, তারা এ জাতির প্রাণের ধন—বীরাঙ্গনা, অনেক কষ্টে আর মেহনতে যাদের বুকভাঙা দুঃখের কথা ক্যামেরায় ধরে রাখা হয়েছে যা না দেখলে নয়, না শুনলে নয়। তো সেদিন সেই যে মা কয়েক বছর আগে ক্যামেরার সামনে রাখঢাকহীন কথা বলেছিল, সে ঘটনা টিভিতে দেখে মাকে চিনতে পারা কঠিন কাজ ছিল না। গায়ে-গতরে একই রকম, কপালের এক পাশে গুটলি পাকানো জড়ুল। বাড়িওয়ালি মহিলার তখন কী চিল্লাচিল্লি! কত বড় সাহস, আমার বাড়িতে মিছা পরিচয়ে এমন বদ মেয়েমানুষ! বলে কি জামাই মরে গেছে মেয়ের জন্মের পরেই! আরে তোর যদি জামাই-ই ছিল, শ্বশুরবাড়ি পাকিস্তান গেলি না কেন! ক্যামেরার সামনে নিজের কাহন গাইতে শরম লাগল না তোর! বের হো হারামজাদি।
মা ছিল হদ্দ বোকা। যদি ক্যামেরার সামনে না যেত, খবরের কাগজে বড় করে ছবি না উঠত, কাছের আত্মীয়-স্বজনের বাইরে মায়ের কাহিনিটা চাউর হতো না। আর কী কপাল! মায়ের নামটা ছিল শেফালি, ফুলের নামে নাম, সেজন্যই হয়তো নামটা ফাটল। বীরাঙ্গনা বলতে শেফালি বেগম নামটাই আগে আসে। লোকে নিশ্চয় নামটা পছন্দ করে। জহর বিবি, তহুরা খাতুনদের তুলনায় শেফালি নামটা মানুষকে বেশি টানে।
ফলে কিছু দিন পর পর জায়গাবদল। দিন-রাতের বাঁধা কাজের মানুষ কে না চায়, বিশেষ করে অবস্থাপন্নরা। শেফালি বেগমের কাজের অভাব হতো না। সঙ্গে আট-নয় বছরের চম্পার কারণে আপত্তির বদলে কেউ কেউ বাড়তি আগ্রহও দেখাত। ফুটফরমাশ খাটবে, কাজকর্ম শেখানোর জন্য মা তো আছেই, টিকে গেলে মায়ের পরে মেয়েকে রেখে দেওয়া যাবে। কিন্তু কয়েক মাস যেতে একটা না একটা ঝামেলা উড়ে আসত। একবার তো, তারা তখন আগ্রাবাদে এক জাহাজ কোম্পানির বড়লোক মালিকের বাড়িতে, মা-সহ তাকেও পুলিশে দেয় আর কী!
সে বাড়িতে আরও কাজের মানুষ ছিল—মালী, দারোয়ান, ড্রাইভার ছাড়াও একজন মাঝবয়সি নার্স থাকত মালিকের বুড়ি মায়ের দেখাশোনার জন্য। তো সেই নার্স মহিলা কী কারণে কে জানে চম্পাকে বেশ পছন্দ করত। কাজের ফাঁকে ডেকে নিয়ে গল্প করত। বাড়িঘরের কথা উঠলে মায়ের শেখানো মতো বলত ‘নারানগঞ্জ’, আবার এও বলত ছোটবেলা থেকে মায়ের সঙ্গে ঢাকায়, বাড়ির কথা তার মনে নাই। নার্স হয়তো এসব এমনিই জানতে চাইত। সমস্যা বাধিয়েছিল মা নিজে। সারাক্ষণ মাথা-কপাল, এমনকি গালের আধাআধি ঢাকা আঁটোসাঁটো ঘোমটা-ই মার কাল হলো। বাড়িতে এত কাজ—ঝাড়-পোছ, কোটা-বাছা, রান্নাবাড়া—ঘোমটাটা যে কী করে সব সময় এত টাইটফিট থাকে এ নিশ্চয়ই কারো না কারো মাথায় ঢুকে গিয়েছিল। বাইরে তো যেতে হচ্ছে না, ঘরের ভেতরেই কাজ-কর্ম, তবু ঘোমটার এমন জবরদস্তি কেন! কী হলো হঠাৎ, সেই নার্স মহিলাই মায়ের পেছনে লাগল। কবে থেকে লেগেছিল মা নিশ্চয় টের পায়নি, পেলে সাবধান হতো। সে সুযোগ মা পেলে তো! আর তাই একদিন কায়দা করে পেছন থেকে জোরে টেনে মায়ের টাইটফিট ঘোমটাটা খুলে নার্স শায়লা যখন আঁতকে উঠে চেঁচাল, ‘তুমি শেফালি বেগম না? এই যে এ বইতে ফটো আছে, এইটা তোমার না?’ সারা বাড়িতে তখন হুলুস্থুল, চোর ধরা পড়েছে।
আম্মা যে বললেন মা দেখতে সুন্দরী ছিল, মুখের গড়ন পানপাতার মতো- এসব চম্পার কখনো মনে হয়নি। মায়ের মুখ আম্মার এত পছন্দ ছিল, মুখটা আঁকতে পর্যন্ত ইচ্ছা হয়েছিল। সেদিন মাকে নিয়ে আম্মার সঙ্গে এসব কথাবার্তায়ই কি না, চম্পা যতই চেষ্টা করছে মা-র মুখটা মনে করতে, পারছে না। ভাসা ভাসা মনে পড়ে, কিন্তু স্থির হয়ে মুখটা চোখে বসে না। শরীর খারাপের খবরে তার ভয় হলো যদি শেষবারের মতো দেখা না দিয়ে মা মরে যায়! আম্মাকে বলেছে ঠিকই যেতে, তবে তাকে এ শরীরে নিয়ে যাবে কী করে, আর ঠিকানা তখন যা জানত, মা কি এত বছর পর সেখানেই আছে?
চম্পা আম্মার মুখে প্রায়ই একটা কথা শোনে, ‘তোর জীবন আর শেফালির জীবন এক না, শেফালির সঙ্গে নিজেকে মেলাতে যাস কেন?’ আম্মা হয়তো তাকে সাহস দেওয়ার জন্যই বলেন। না হলে মা তাকে নিয়ে যেভাবে পালাত, সেও কেন জবাকে নিয়ে তাই করতে যাবে? মা পালাতে পালাতে বিরক্ত হয়ে তাকে আম্মার কাছে গছিয়ে চলে গিয়েছিল, আর সে যা করল তা কি আলদা কিছু? অবশ্য সে মায়ের মতো দূরে চোখের আড়ালে চলে যায়নি, জবার কাছাকাছি আছে, চাইলেই খোঁজ-খবর করতে পারছে। সে কি ইচ্ছা করে মায়ের সাথে নিজেকে মেলাতে যায়! মিলটা তারপরও যখন বেরিয়ে পড়ে, চম্পা অবাক না হয়ে পারে না। তারপরও এটা ঠিক, সে আর তার মা এক না। সে ধরা পড়ে যেত চেনা মানুষের কাছে। আগারগাঁও ছেড়ে যে রাতে এ বস্তিতে এসে উঠেছিল, তার আগের দিন বাজার নিয়ে ঘরে ফেরার সময় একজন পথ আগলে জানতে চেয়েছিল, ‘তুমি এইখানে থাকো?’ সামনে যাকে দেখেছিল সে মাঝবয়সি চেনা-চেনা মেয়েলোক। ভালো করে তাকিয়ে চিনেছিল, চেরাগি বস্তি—চম্পা আগে যেখানে ছিল, সেখানে পানের দোকান ছিল তার। জরিনার মা বলে তাকে ডাকত সবাই। কিছু সময় চম্পাকে খুঁটিয়ে দেখে বলেছিল ওই বস্তি উঠিয়ে দেওয়ায় কয়েক দিন হলো আগারগাঁওয়ে এসে উঠেছে। চম্পা কিছু বলেনি, লম্বা পা ফেলে ঘরে ঢুকে জবাকে বাইরে যেতে মানা করে সারা দিন দরজা আটকে বসেছিল। পরদিনই ভাগার বন্দোবস্ত পাকা করে ফেলেছিল। মাকে চেনা মানুষ তো বটেই, অজানা-অচেনা মানুষও চিনে ফেলত, কারণ সে শেফালি বেগম।
মাকে খারাপ-ভালো যে অর্থেই হোক বিখ্যাত করেছিল একজন। চম্পা শুনেছে লোকটা বিদেশে ছিল, দেশে এসে মাথায় নাকি ভূত চেপেছিল যুদ্ধের সময় মেয়েদের নির্যাতনের কাহিনি দুনিয়ার মানুষকে জানাবে, সেই সাথে বিচারের দাবিও তুলবে। সে-ই মাকে নিয়ে খবরের কাগজে লিখেছিল, ছবি তুলেছিল, এমনকি মায়ের কথাবার্তাসহ কয়েক মিনিটের একটা ছবিও বানিয়েছিল। সে বইও লিখেছিল, আম্মার কাছে শুনেছে, বইতে মায়ের বেশ কিছু ছবি ছিল। বইয়ের মলাটে যে ছবি ছিল, সেটাও মায়ের। লোকটার বই থেকেই মায়ের ছবিগুলো চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। আর পাঁচ-সাত মিনিটের যে ছবিটা বানিয়েছিল সেটার কিছু অংশ বিজয় দিবসে, স্বাধীনতা দিবসে টিভিতে তখন প্রায়ই দেখাত। মায়ের মতো আরও কয়েকজনের ছবি তুলেছিল সাংবাদিকেরা, কিন্তু সেসব নিয়ে মানুষের তেমন আগ্রহ ছিল না, লোকে তাদের মনে রাখেনি। এর বড় কারণ নাকি মা ক্যামেরার সামনে এমন একটা কথা বলেছিল যা মায়ের মতো যারা তাদের মনের কথা হলেও কেউ কোনো দিন বলেনি বা বলতে সাহস পায়নি। কী বলেছিল মা, এ নিয়ে আম্মাকে অনেকবার জেরা করেছে চম্পা। শেষে আম্মা মুখ খুলেছিলেন, ‘শেফালি যা বলেছিল সেটা ধরলে দেশের স্বাধীনতার গায়ে কালি লাগে।’ আম্মা আরও বলেছিলেন, ‘টিভিতে যখন ওকে দেখায়, তখন ওর সেই কথাগুলো বাদ দিয়ে দেয়।’
কী বলেছিল মা?
.
জবা না থাকায় ঘরের কাজকর্ম কমে গেছে। তাও যা করার মান্তু ঝটপট করে ফেলে। ফ্যাক্টরি থেকে মান্তু ফেরে চম্পার আগে। কোনো দিন এসে দেখে মান্তু রান্নাবাড়া সেরে পাড়া বেড়াতে বের হয়েছে। মর্জিনার মা মারা যাওয়ার দিন সে অনেক খেটেছে, বস্তিতে সে এখন অনেকের প্রিয়। চম্পার সাথে তার সম্পর্ক যে আলগা হয়ে পড়েছে, এ নিয়ে মান্তুর যেন কিছু যায় আসে না, সুযোগ পেলেই চম্পার সঙ্গে গালগল্পে মেতে ওঠে—চম্পা সাড়া দিক বা না দিক। চম্পা ভেবে দেখেছে মান্তুর মাথায় বুদ্ধিশুদ্ধি কম, যদিও তাকে ঠিক বোকা বলা যাবে না। চম্পা এটুকু বোঝে, নানা আঘাটায় ভিড়ে বোকা মানুষও বোকা থাকে না। মান্তুকে নিয়ে সে বেশি ভাবতে যায় না, শুধু তিন বছর টানবাজারে কাটিয়ে এসেছে মনে হলেই গা রি রি করে ওঠে। চম্পা ঠিক করেছে মান্তু যত দিন তার সঙ্গে থাকতে চায় থাকুক। নিজে থেকে তাকে কিছু বলতে যাবে না। সে যদি চায়, চম্পা তাকে অপারেটরের কাজে লাগাতে চেষ্টা-তদবির করবে।
সেদিন ওভারটাইম সেরে ফিরতে ফিরতে রাত দশটার ওপর। চম্পা ভেবেছিল তেহারি কিনে ঘরে যাবে। বস্তিতে ঢোকার মুখে কানাফুরকানের তেহারির দোকান। কানাফুরকানের এক চোখ সাদা, ছোটবেলায় খেলতে গিয়ে কে যেন কাদা ছুড়েছিল, অন্য চোখে সে ঠিকই দেখতে পায়, চম্পার ধারণা একটু বেশিই পায়, না হলে তেহারিতে যে মাংসের টুকরা দেয় সেগুলোকে এত কুচি কুচি করে কাটে কী করে! আর মাংস তো নামেই, গরুর কান, লেজ, ভুঁড়ি, খুরা কিছু বাদ দেয় না। জবা তেহারি পেলে খুব খুশি হতো। খেতে চম্পারও ভালো লাগত। জবাকে বাদ দিয়ে খাবে এ নিয়ে খানিকটা দোটানায় থাকলেও দোকানের কাছাকাছি হতে দেখল কানাফুরকান তার তেহারির হাঁড়ি মাজতে বসেছে, মানে শেষ। তাকে দেখে ভালো চোখটাকে টানটান করে বলল, ‘কী গো আইজকাইল আহো না। আমার তেহারির সোয়াদ কি কমছে নিহি? আইজ তো ফিনিশ। মজ্জিদে মৌলুদ দিছিল, একশ বাস্কো লিয়া লিছে।’ চম্পা লোকটার দিকে তাকিয়ে তার খুশিতে শরিক হতে একটু হাসল। মনে মনে বলল, ভালোই হলো, শেষ বেলায় হাঁড়ির তলা চেঁছে কী না কী দিত!
ঘরের কাছে আসতে মনে হলো ভিতরে মানুষ। মেয়েগলার সাথে পুরুষের গলাও শোনা যাচ্ছে। খোলা দরজা দিয়ে আলো ঠিকরাচ্ছে ঘরের সামনে সরু নালার কাদা-পানিতে। মান্তু তবে ঘরেও মচ্ছব বসানো শুরু করেছে। চম্পাকে দেখে মান্তু অন্যদের তাড়া দিল, ‘হইছে বহুত গুলতানি মারছো, অখন ঘরে যাও, বুজান আইসা পড়ছে।’
চম্পা দেখল মান্তু ছাড়া ঘরে মর্জিনা, কয়েক ঘর পরের লিলি আর চৌকিতে বসে যে সিগারেট টানছে তার সঙ্গে কথাবার্তা না হলেও মুখ চেনে—শাহজাদা। একে একে সবাই বেরিয়ে যেতে মান্তু তড়বড় করে বলে উঠল, ‘তুমার আইতে দেরি দেইখ্যা এগো লগে গল্প করতেছিলাম। মর্জিনা কানতেছিল, ওরে নিয়ে আইসা বসতে হেরা আসল।’
চম্পাকে কিছু না বলতে দেখে মান্তু বলল, ‘তুমি গোস্সা অইছো?’
চম্পা মেজাজ রাখতে না পেরে ঝামটে উঠল, ‘মর্জিনা, লিলিরে আনছস বুঝলাম, কিন্তু ওই ছ্যামড়া ক্যান? ওর কী কাম তর ধারে? ও যে এই বস্তির মস্তান এইডা জানস? না, জাইনাশুইনা গুণ্ডা-বদমাইশের লগে খাতির জমাইতে লাগছস? তা তো জমাইবিই …’
মান্তু বলে উঠল, ‘সত্যই গোস্সা করছো? শাজাদা ভাই হেইদিন মর্জিনার মা-র দাফনের সব কাম-কাজ করছে। মসজিদের ইমাম হুজুররে পায় নাই, মুয়াজ্জিন হুজুররে দিয়া জানাজা পড়াইছে, গোরস্তানে কবর খোদাই, লাশ নেওয়া হে তার দুই দোস্তো মিল্যা সারছে।’
‘শাজাদা ভাই! ও তর থাইক্যা বড় যে ভাই কস!’
‘নাম ধইরা ক্যামনে ডাকি? মস্তান কও আর যাই কও, মাইনষ্যে ইজ্জত করে। আগে তো চিনতাম না, হেইদিন পয়লা দেখলাম, বস্তিতে তার দাম আছে গো। বয়স তো বেশি না সাতাশ-আটাইশ আইব, ঠিকই কইছো আমার থাইক্যা এক-দুই বছরে ছোডই অইব।’
কথা শেষ করেই মান্তু বলল, ‘আইজ কী রানছি দ্যাখো। শিমের বিচি দিয়া মাগুর মাছ, কত দিন খাই না, মনো করলাম তুমিও পছন্দ করবা। ভালা করি নাই?’
চম্পা গোসল করতে বেরিয়ে যেতে যেতে বলল, ‘তর মাগুর মাছ তুই খা।’
ফিরে যখন এলো, দেখল মাস্তু মাদুর বিছিয়ে ভাত-তরকারি বেড়ে রেখেছে। মাছের ঝোল থেকে সুন্দর গন্ধ বেরোচ্ছে। টের পেল রাগটা পড়ে যাচ্ছে। মান্তুকে সে কী বলল আর সে কী জবাব দিল! খেতে খেতে চম্পা বলল, ‘ভালা অইছে। আমিও বহুত দিন বিচি দিয়া মাগুর মাছ খাই না।
এক কথায়ই মান্তু খুশি হয়ে শুরু করল কবে তার মা-র হাতে এই রান্নাটা খেয়েছিল। মা-র রান্নার প্রশংসা করতে করতে হঠাৎ যেন বেফাঁস বলে বসল, ‘আবদুর রহমানের বাপও আমার হাতের রান্না পছন্দ করত।’
চম্পা ভুলেই গিয়েছিল মান্তুর ছেলের নাম আবদুর রহমান। কিন্তু কথাটা যে মোটেও বেফাঁস বলেনি তার প্রমাণ মিলল পরের কথাতেই। বলল, ‘আবদুর রহমানের বাপ আর কি পছন্দ করত জানো? শুনলে হাসবা।’
‘ক হাসুম না।’
‘গান।’
‘গান গাইতে তো তরে শুনি নাই।’
‘আরে ওই সময় গাইতাম আর কি, ওইগুলা কি গান নাকি!’
চম্পা অবাক হলো দেখে মান্তুর মুখ অনেকটা ঝুঁকে পড়েছে থালার ওপর। মুখ তুললে চম্পা দেখে ফেলবে, তাই ঝুঁকিয়ে রাখাটা জরুরি। এই পাগলিকে কী বলবে! যে জামাই যৌতুক না পেয়ে বউকে তালাক দেয়, তার কথা এত বছর পরও এমনভাবে কেউ মনে করতে পারে, আবার করতে গিয়ে মুখ লুকায়! চম্পা ভাবত ওর বুদ্ধিশুদ্ধি কম, এখন দেখছে মাথায় মগজ বলতে কিছু নাই, বুদ্ধিশুদ্ধি দূরের।