কেবলই ছায়া – ৪

চার

এখন আমার বয়েস হয়ে গেছে। শরীরে সে শক্তি নেই। স্মৃতি ক্ষীণ। অতীতের সব কথা স্পষ্ট মনে পড়ে না। প্রায় দশ বছর হল রাধা মারা গেছে। সেই আমার দেখাশোনা করত। কবে কোথায় যেতে হবে। কোন আসরে কখন গান হবে, সেই সব ঠিক করত। টাকাপয়সার হিসেব সবই ছিল তার কাছে। টাকাপয়সা আমি কোনো কালেই তেমন বুঝতুম না। লোকের কাছে হাত পেতে নিতেও পারতুম না। হাতের আঙুলগুলো কেমন যেন বেঁকে যেত। মনে মনে আওড়াতুম রামকৃষ্ণদেবের কথা—রাজার ছেলের মাসোহারার অভাব হয় না। আর সত্যিই তাই, বাবার মৃত্যুর পর কাকারা ভিটে থেকে তুলে ফেলে দিলে, তখন আমাদের না খেয়েই মরার কথা। কী থেকে কী হয়ে গেল, প্রায় রাজার হালেই ছেলেবেলা কেটেছে। এই বৃদ্ধ বয়েসেও আমার কোনো অভাব নেই। একমাত্র অভাব মানুষের। বড়ো একা আমি। সংগীতকে সহধর্মিণী করেছিলুম। রাধাদি ছিল আমার অভিভাবিকা, আর মহীদা ছিলেন আমার দাদা। দাদারও বেশি। কারুর বাবাও অত করতেন না। আমার মায়ের শক্তিতে জীবনের পথ সহজ—সরল হয়ে গিয়েছিল। মা কোথা থেকে শক্তি পেয়েছিলেন? সাধুবাবা বলতেন, বিশ্বাস থেকে। সবচেয়ে বড়ো কথা বিশ্বাস। বিশ্বাসের জোরে মহীদা অতবড়ো অভিনেতা হয়েছিলেন। বিশ্বাসের জোরে মা হয়েছিলেন অতবড়ো সাধিকা। বিশ্বাসের জোরে পঙ্গু মাসিমা বিছানায় উঠে বসেছিলেন। শুধু বসেননি শেষ জীবনে মায়ের সঙ্গে তীর্থে তীর্থে ঘুরেছেন। বিশ্বাসের জোরে আমার কণ্ঠে সুর এসেছে। আমার মা বলতেন, চরিত্র, চরিত্রই হল সব। আর সাধুবাবা বলতেন, শিশুর সরলতা। কিছু কিছু কথা, কিছু কিছু অভিজ্ঞতা আমার লেখা আছে। অন্যের জন্যে লিখিনি। লিখেছি আমার নিজের জন্যে, পাছে নিজেকে ভুলে যাই। সাধুবাবা বলতেন, পূর্ণ পৃথিবীকে মানুষ নিজের দোষে অপূর্ণ করে ফেলে। সবই অমৃত, বেশি চটকালেই গরল। সুখ চাইলে সুখ পাবে, শান্তি চাইলে শান্তি, আর নিজেকে হারালেই দুঃখ। শয়তানের কাছে নিজেকে বিকিয়ো না। শক্তির হাত ধরে থাকো।

আমার মায়ের জীবনটা কীভাবে সাধারণ থেকে অসাধারণ হয়ে গেল! এসব না দেখলে কেউ বিশ্বাস করবে! বলবে গাঁজা খেয়েছি। নয়তো বলবে, নিজের মা তো তাই বানিয়ে বানিয়ে লিখছ। হঠাৎ মাকে একদিন ভোরবেলা কয়লার গাদায় কাঁকড়াবিছে কামড়ে দিল। কামড়াল হাতের আঙুলের মাথায়। অসম্ভব যন্ত্রণা। চোখ—মুখ নীল হয়ে গেছে। মুখে কোনো শব্দ নেই। কবজির কাছটা চেপে ধরে রকে বসে আছেন। শরীর যেন অবশ হয়ে আসছে। আমরা সবাই ছোটাছুটি করছি। মহীদা ডাক্তার ডাকার জন্যে মামাকে বলছেন। মা অতিকষ্টে মৃদু স্বরে বলছেন, ডাক্তারের প্রয়োজন নেই। চব্বিশ ঘণ্টা যন্ত্রণা সহ্য করতে পারলেই বিষের জ্বালা কেটে যাবে।

মামা আর আমি রাস্তায় বেরোতেই, ধুতি আর হাফশার্ট পরা সৌম্য চেহারার প্রবীণ এক মানুষ থমকে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কোনো বিপদ হয়েছে বাড়িতে?

মামা সামান্য ইতস্তত করে বললেন, দিদিকে কাঁকড়াবিছে কামড়েছে।

আমি একবার দেখতে পারি?

আপনি কি ডাক্তার?

ভদ্রলোক মৃদু হেসে বললেন, আরোগ্য চাও, না ডাক্তার চাও।

ভদ্রলোকের মুখের দিকে তাকিয়ে আমরা দুজনেই চমকে উঠলুম। মৃদু হাসি যেন চাবুকের মতো ঝুলছে।

মামা বললেন, আরোগ্য।

তবে চলো।

ভদ্রলোক উঠোনে পা রাখতেই মহীদা বললেন, এ আবার কাকে ধরে আনলি বি টি এম।

ভদ্রলোক একনজরে মহীদাকে দেখে নিলেন। বড়ো অপমানজনক কথা বলে ফেলেছেন দাদা। তাঁর চোখের দৃষ্টিতে এমন কিছু ছিল মহীদা কেমন যেন হয়ে গেলেন। আর সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত জায়গাটা তীব্র চন্দন—গন্ধে ভরে গেল। সঙ্গে সঙ্গে আমরা সকলেই বুঝে গেলুম, যিনি এসেছেন তিনি সাধারণ মানুষ নন। সকালে মহীদা আতর মাখেন না।

ভদ্রলোক মায়ের দিকে এগিয়ে গেলেন। আমাকে বললেন, কাচের গেলাসে করে এক গেলাস পরিষ্কার জল নিয়ে এসো। জল নিয়ে এলুম। তিনি কিছুই জিজ্ঞেস করলেন না, কোথায় কামড়েছে। সবই যেন জানেন। মায়ের সামনে গেলাসটা রেখে বললেন, আঙুলটা ডোবাও তো মা।

অত সুন্দর মা ডাক আমি কখনো শুনিনি। মা আঙুলটা ডোবালেন। ভদ্রলোক পলকহীন দৃষ্টিতে মায়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন। বেশি না, মাত্র মিনিট পাঁচেক সময়। গেলাসের জলের রঙ দেখতে দেখতে নীলচে সবুজ বর্ণ হয়ে গেল।

একসময় তিনি বললেন, নাও আঙুল তুলে নাও। একটু বিষ শরীরে থাক। ঈশ্বরের ইচ্ছে। উপকারেই লাগবে। সহজে কোনো অসুখ ধরবে না।

মায়ের মুখে হাসি ফুটেছে। আঁচলে আঙুল মুছে, তাড়াতাড়ি নেমে এসে সেই অচেনা, অদ্ভুত মানুষটিকে হেঁট হয়ে প্রণাম করলেন।

তিনি মায়ের মাথায় হাত রেখে বললেন, দেখছি জমি বেশ তৈরি। পূর্বজন্মের সংস্কার। বীজ ছড়াও, বীজ ছড়াও মা, বেশ ভালো ফসল পাবে।

ভদ্রলোক দরজার দিকে পা বাড়ালেন। মহীদা ছুটে গিয়ে সামনে পথ আটকে দাঁড়ালেন। একি আপনি এসেই চলে যাবেন? তা কী হয়? আমাদের কী সৌভাগ্য, যে আপনাকে পেয়েছি।

মহীদার একটা হাত ধরে তিনি বললেন, বাবা, তুমি হলে শিবের অংশ, এখন অভিনয় করে মানুষকে আনন্দ দিচ্ছ দাও, এরপর আর অভিনয় নয়, আসল জীবন শুরু করতে হবে। তখন ঠিক ঠিক মানুষের দেখা পাবে। আমি যে বেঠিক মানুষ!

আপনি জানেন, আমি একজন অভিনেতা?

হ্যাঁ বাবা জানি।

আপনি এ পাড়ায় থাকেন?

না বাবা। আমি অনেক দূরের মানুষ। যাচ্ছিলুম এই পথে, তা মনে হল, মা আমার কষ্ট পাচ্ছে, তাই একটু থমকে দাঁড়ালুম। এরা দুজন বেরিয়ে এল উদভ্রান্তের মতো। যা জানি তা করে দিয়ে গেলুম বাবা।

নিশ্চয়ই আপনি কোনো মহাপুরুষ।

আমি পুরুষ, আর এ হল আমার পাহাড়ি বিদ্যা। মহাপুরুষরা লোকালয়ে থাকেন না। তোমরা কাচখণ্ডে হীরক ভ্রম এনো না। সাবধান!

মা বললে, আপনার সঙ্গে অনেক কথা ছিল।

তিনি মৃদু হেসে বললেন, হবে, হবে, সময়ে সব হবে। এখনও একটু বাকি আছে। ভোগই বলো আর দুর্ভোগই বলো এখনও ক্ষয় হতে বাকি আছে। সময় হলে পথ খুলে যাবে।

মহীদা বললেন, বাবা, এলেন যখন আর একটু দয়া করে যান।

দয়া? দয়া কী গো! বলো সেবা। দয়া করার মালিক হলেন তিনি।

বলো কী করতে হবে?

আমার মা দীর্ঘদিন পঙ্গু হয়ে পড়ে আছেন। একবার যদি অনুগ্রহ করে দেখে যান।

তোমরা ভুল করছ, আমি ডাক্তার নই।

মহীদার যেমন কথা। দুম করে বলে বসলেন, আপনি ডাক্তারের বাবা।

তিনি কথা শুনে হাসলেন। উদাস সুরে বললেন, চলো দেখি একবার।

তাঁর হাঁটাচলার ধরনটা ছিল ভারি অদ্ভুত। যেন বাতাসে ভেসে চলেছেন। কোনো ভেক ছিল না; কিন্তু মহাপুরুষ। কোনো সন্দেহ নেই। প্রকৃতই মহাপুরুষ। এসব কথা লিখে কী হবে! না দেখলে সন্দেহবাদী মানুষের বিশ্বাস আসে না। আমাকে সেই সাধুবাবা বলেছিলেন, কাঠে যে আগুন আছে, একখণ্ড কাঠ দেখলে বোঝা যায়? দেহে যে প্রাণ আছে, তা বুঝতে পারিস? পারিস না। যতক্ষণ না মৃত্যু এসে ক্যাঁক করে তোর টুঁটি চেপে ধরছে, ততক্ষণ প্রাণের অস্তিত্ব তুই বুঝিস না। একেই বলে আচ্ছন্ন জ্ঞান। বিশ্বাসীর দুনিয়া অনেক বড়ো। আরও বৈচিত্র্যপূর্ণ। তাঁর কাছে শুধু একটু বিশ্বাস চেয়ে নে। সবাই মাগ চায়, ছেলে চায়, ধন—দৌলত চায়। আসল জিনিসটাই চাইতে ভুলে যায়, বিশ্বাস।

তিনি ধীরে ধীরে মাসিমার ঘরে গিয়ে ঢুকলেন। মাসিমা কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই মহীদা হাতের ইশারায় বুঝিয়ে দিলেন, প্রশ্ন কোরো না।

তিনি মাসিমার মাথার কাছে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন বেশ কিছুক্ষণ। এত স্তব্ধ যে আমরা আমাদের নিশ্বাসের শব্দ শুনতে পাচ্ছি। বাইরে একগাদা পাখি কিচিরমিচির করছে। সারা ঘরের বাতাস যেন থমকে গেছে।

তিনি মাসিমার কপালে হাত রেখে সেই সুরে ডাকলেন, মা।

মাসিমার সারা শরীরটা যেন চমকে উঠল। কীসের একটা তরঙ্গ যেন বয়ে গেল। তিনি বললেন, মা, তোমাকে আজ থেকে উত্তরে মাথা করে শুতে হবে।

উত্তর? সকলেই যেন অবাক হলেন।

কেন সংস্কারে লাগছে? যমের দুয়ারে মাথা পেতে শুতে ভয় করছে? তোমার উপকার হবে মা। দেখি একটুকরো কাগজ দাও তো, আর যা হয় একটু কিছু লেখার।

সেই মহাপুরুষ মাসিমার জন্যে একটা ব্যবস্থাপত্র দিয়ে গেলেন। তামা, লোহা, দস্তা, সিসে বিভিন্ন মাপে একসঙ্গে গালিয়ে একটা বালা তৈরি করে ধারণ করাতে হবে। আর বললেন, দিনকতক টকটকে লাল কাপড় পরতে।

তাঁকে আর ধরে রাখা গেল না। কোনো গৃহীর বাড়িতে তিনি জলগ্রহণ করেন না। প্রসাদ ছাড়া তিনি কিছু খান না। মা, মহীদা, মামা ঠিকানার জন্যে অনেক অনুরোধ করলেন। তিনি কেবল হাসেন আর বলেন, আমার ঠিকানা আমি নিজেই জানি না মা। যখন যেখানে থাকি তখন সেইটাই আমার ঠিকানা।

মা আবার বললেন, আমার যে অনেক কথা ছিল।

একটা হাত তুলে বললেন, হবে, হবে মা, সময়ে সব হবে। এ জীবনে না হয় পরের জীবনে হবে। জন্ম—জন্মান্তর শুধু ধৈর্য ধরে বসে থাকা। তবে তোমার ভয় নেই মা, তোমার পথ খুলবে।

সেই অদ্ভুত মানুষ হনহন করে চলে গেলেন। কোনো দৃকপাত নেই। যেমন ভাসতে ভাসতে এসেছিলেন সেইরকম ভাসতে ভাসতে চলে গেলেন। চলে যাবার পরই মনে হল বাড়ি যেন খালি হয়ে গেল।

শিবুকাকা বলেছিলেন সূর্য ওঠার আগে আকাশ লাল হয়। বর্ষা আসার আগে কামিনী গাছ ফুলে ফুলে সাদা হয়ে যায়। ওই মহাপুরুষ কতক্ষণই বা ছিলেন; কিন্তু সংসারের আবহাওয়া সম্পূর্ণ পালটে গেল। মহীদার আলমগির আর ভালো লাগছে না। তিনি নতুন নাটক শুরু করার আয়োজন নিলেন। আমার মা সবসময় যেন হাসছেন। আর আমার পঙ্গু মাসিমা দিনতিনেক পরেই সন্ধের দিকে রাধাদিকে ডেকে বললেন, দ্যাখ তো মা পায়ে মনে হয় মশা কামড়েছে।

মশা কামড়ানোর সে কি আনন্দ। সারা বাড়িতে যেন উৎসব শুরু হয়ে গেল। মা রান্না ফেলে ছুটে এলেন। মহীদা থিয়েটারে যাবার সাজপোশাক পরে ঘরে এলেন। মামা এলেন। হইহই ব্যাপার। এতকালের অসাড় পা মশার কামড় টের পেয়েছে।

মা মাসিমার পায়ে একটু চিমটি কাটতেই পা যেন নড়ে উঠল। মহীদা হাত জোড় করে বললেন, জয় অজ্ঞাতবাবার জয়।

বেশ নাম। যাঁর কিছুই জানা নেই তিনি তো অজ্ঞাতই। অজ্ঞাতবাবা। সেই যে একটা তীব্র চন্দনের গন্ধ তিনি ছড়িয়ে গিয়েছিলেন, সেই গন্ধ এখনও বাড়ির যেখানে সেখানে বিশেষ বিশেষ মুহূর্তে পাওয়া যেতে লাগল।

সাত কি আটদিনের দিন মাসিমা পা নড়াতে পারলেন। পায়ের তলায় সুড়সুড়ি দিলে পা টেনে নেবার চেষ্টা করলেন। শরীরের বিবর্ণ ভাব কেটে গেছে। মোমের মতো সাদা গালে লালের আভা লেগেছে। সেই উদাস, বিষণ্ণ ভাব আর নেই। সাধুবাবা বললেন, সব মানুষই বাঁচতে চায়। জন্মাতে চায়, বড়ো হতে চায়। এই প্রবল ইচ্ছার কাছে মৃত্যু পরাজিত। প্রকাশ আর লয়, লয় আর প্রকাশ, এর নাম অনন্ত লীলা।

এখন আমার যা বয়েস, তাতে মৃত্যুর চিন্তাই আসা উচিত; কিন্তু মৃত্যুর চিন্তা আমার আসে না। মনেই হয় না আমি একদিন মারা যাব। জানি আমার ভেতরের দম ফুরিয়ে আসছে। এ এমন এক ঘড়ি যার দম দেবার চাবিকাঠিটি তাঁর হাতে। যাদের নিয়ে পৃথিবীর এই রম্য উদ্যানে বেড়াতে এসেছিলুম তারা সকলেই প্রায় ফিরে গেছে। আমিই শুধু বসে আছি স্মৃতি নিয়ে। তবে আমি ট্রেনের অপেক্ষায় বসে থাকা যাত্রী নই। আমি মনে মনে চলছি। অনবরতই চলছি।

এক যুগ পরে মাসিমা যেদিন খাট থেকে নেমে দাঁড়ালেন, সেদিন মহীদা বললেন, আজ আমি বুঝলাম, মানুষের শক্তির বাইরে মহাশক্তিমান একজন কেউ আছেন। তিনিই ঈশ্বর। তিনি কখনো মানুষের রূপ ধরে আসেন, তিনি কখনো সুর হয়ে আসেন, আবার কখনো বেসুরে আসেন। পৃথিবীর পাঠশালে পড়ে তাঁর গতিবিধি বোঝা যায় না।

মাসিমা চলতে পারছেন, এই আনন্দে কিছুদিন বিভোর হয়েছিলুম। একে বলে অলৌকিক ঘটনা। চোখের সামনে যা ঘটলে গল্পকথা। জীবনে অনেক দেখেছি। শুনেছি তার বেশি। এক জীবনে কতটাই বা জানা যায়! সামনের বার ফিরে আসব বিস্মৃতি নিয়ে। আবার কী শুরু থেকেই শুরু! এবারের কোনো জ্ঞানই কী কাজে লাগবে না! সাধুবাবা বলেছিলেন, না রে মূর্খ তা নয়। এবারে যেখানে শেষ করলি, সামনের বার সেইখান থেকেই শুরু হবে। মানুষ পেছোয় না এগোয়। সব জীবই তাই। স্তর থেকে স্তরে অগ্রগতি। এসব আশার কথা ভাবতে ভীষণ ভালো লাগে। ভাগ্যিস বেশি লেখাপড়া শিখিনি। তাহলে ঘোরতর অবিশ্বাসী হয়ে পড়তুম। অবিশ্বাসী মানুষ বড়ো দুঃখে, বড়ো হতাশায় মরে।

একদিন দুপুরে মাসিমা মাকে বললেন, আমার পুরনো জায়গাগুলো ঘুরে ঘুরে দেখতে ইচ্ছে করে। সেই দক্ষিণেশ্বর, কালীঘাট, কল্যাণেশ্বর, বড়ালে বাপের বাড়ির ভিটে, মহীর অভিনয়। মৃত্যুর ছায়া সরে গেছে। এখন বাঁচার আগ্রহ একশো গুণ বেড়ে গেল।

মা বললেন, চলুন দিদি, সবার আগে দক্ষিণেশ্বরে মাকে দেখে আসি। ভোর ভোর গিয়ে বেলাবেলি ফিরে আসব। রোদের কষ্ট হবে না।

সেদিন, কী বার, কী তারিখ, কী যোগ ছিল মনে নেই। সকালবেলা আমরা চারজন, আমি, মা, মাসিমা, মামা মহীদার গাড়ি চেপে দক্ষিণেশ্বরে চললাম। সেই ছিল আমার প্রথম দক্ষিণেশ্বর দর্শন। ঠাকুর রামকৃষ্ণের কথা, রানি রাসমণির কথা কত শুনেছি! যেতে যেতে মনে হচ্ছিল, গেলেই তাঁদের দেখতে পাব। কেউ না পাক, আমি পাব। আমার সেই মেলার সাধুবাবু বলেছিলেন, মানুষের দেহ চলে গেলে তার ভালো কাজ, তার শক্তি থেকে যায়। বাতাস বইছে। তুমি হয়তো তো বুঝতে পারছ না। একটা পালক যেই উড়তে লাগল, অমনি তুমি বুঝলে বাতাস বইছে। মনপালকে সুবাতাস লাগা, দেখবি তোর আর কোনো কষ্ট নেই। বাতাসই তোকে টেনে নিয়ে যাবে লক্ষ্যের দিকে। যখন বলেছিলেন তখন আমার বোঝার বয়েস ছিল না। যেদিন বুঝতে শিখলুম, সেদিন দেখলুম আরে, সত্যি তো তাই। পরে যখন গানের জগতে ঢুকলুম, তখন আসরে আসরে ঠাকুরের গাওয়া, ঠাকুরের শোনা গান খুব গাইতে লাগলুম। যে গান আমার সবচেয়ে প্রিয় ছিল, তা হল,

পড়িয়ে ভবসাগরে ডুবে মা তনুর তরী।
মায়া—ঝড় মোহ তুফান ক্রমে বাড়ে গো শঙ্করী।।
একে মনমাঝি আনাড়ি, তাহে ছ—জন গোঁয়ার দাঁড়ি
কুবাতাসে দিয়ে পাড়ি, হাবুডুবু খেয়ে মরি।
ভেঙে গেল ভক্তির হাল, ছিঁড়ে পড়ল শ্রদ্ধার পাল
তরী হল বানচাল উপায় কি করি
উপায় না দেখি আর, অকিঞ্চন ভেবে সরে
তরঙ্গে গিয়ে সাঁতার, শ্রীদুর্গা নামের ভেলা ধরি।।

সকালের দক্ষিণেশ্বরের বড়ো স্নিগ্ধ চেহারা। পশ্চিমে গঙ্গা বয়ে চলেছে। বালির ব্রিজ ভোরের রোদে রুপোর মতো চকচক করছে। স্নানস্নিগ্ধ শরীরে সব মন্দিরে চলেছে। চারপাশ ভিজে ভিজে। ধূপের গন্ধ। ফুলের গন্ধ, লাল লাল জবা, পুজোর নৈবেদ্যে লটপট করছে। ছেলেমানুষ, তবু মনটা কেমন যেন হয়ে গেল। বাবা প্রায়ই দক্ষিণেশ্বরের কথা বলতেন। তাঁর আর দর্শন হয়নি। আমার হল। আমার মধ্যেও তো আমার বাবা আছেন। মনে মনে বলতে লাগলুম, বাবা, আমার চোখ দিয়ে তুমি মাকে দেখে নাও। প্রাণভরে দেখে নাও।

শিবুকাকা আমাকে বলেছিলেন, দ্যাখ খোকা, তোর বাবা ছিল সংসারে এক সন্ন্যাসী। অমন মনের মানুষ সহজে পাওয়া যায় না। হাঁসের মতো। পালক ঝাড়লে সব জল ঝরে যেত। তুইও হবি তার মতো। বাপকা বেটা, সিপাহিকা ঘোড়া, কুছ নেহি তো থোড়া থোড়া। সংসারে বিশেষ সুবিধে করতে পারবি না। সংসার হল দালালদের জন্য। শুরু থেকেই সন্ন্যাসী হবার চেষ্টা কর।

দক্ষিণেশ্বরের মন্দিরে দাঁড়িয়ে সেদিন মনে হয়েছিল আর ফিরব না। মাকে বলি, মা তোমরা ফিরে যাও। ওই চার দেয়াল আর মাথার ওপর ছাদ ঘেরা, আলো—অন্ধকার কুঠুরিতে ফিরে কী হবে? আমার বাবা তো সারাজীবন, সারাদিন মাঠে ঘাটে, জলে জঙ্গলে কাটাতেন। পুকুরে ছিপ ফেলাটা ছিল খেলার মতো। মাথায় একটা মানপাতা চাপিয়ে গান গাইতেন, জাল ফেলে জলে বসে আছে জেলে। কেউ যদি বলতো, সারাজীবন কী করলে? ভেরেণ্ডা ভেজে কাটিয়ে দিলে? বাবা অমনি বলতেন, ব্রাহ্মণের তো ভিক্ষে করাই কাজ। এখনও তো হাত পাতিনি কারুর কাছে।

সেই বাপের ছেলে আমি। আমি কী বেনে—মশলার দোকান দোবো। না সেরেস্তায় বসে খাতা লিখব, আর মালিককে সেলাম বাজাব। সেইদিনই ঠিক করেছিলুম, পাখির মতো স্বাধীন হব। আকাশে উড়ে বেড়াব। খাঁচায় আর বন্দি হব না।

মায়ের মূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে আমার মা হুহু করে কেঁদে ফেললেন। মাসিমাকে বলতে লাগলেন, যতদিন মানুষটা বেঁচে ছিল ততদিন শুধু খোঁটাই দিয়েছি। বোকা ছিলুম তাই দেবতাকে চিনতে পারিনি। এ জীবনে আমাকে সেই পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে।

নাটমন্দিরে ভক্ত গান ধরেছেন, শ্যামা মা উড়াচ্ছে ঘুড়ি/ভবসাগর বাজার মাঝে।

মন্দির থেকে বেরিয়ে আমরা পঞ্চবটীর দিকে চলেছি। বাঁপাশের ঘাটে একটা নৌকো ভিড়ছে। তাকিয়ে দেখি একজন মাত্র যাত্রী ঘাটে নামছেন। আমি আনন্দে উল্লাসে চিৎকার করে উঠলুম, মা, অজ্ঞাতবাবা। মা আর মাসিমা তাকালেন। দুজনেই আনন্দে এগিয়ে গেলেন সেদিকে। অজ্ঞাতবাবার সেই এক পোশাক। ধুতি, হাফ হাতা সাদা জামা। মাথার ফুরফুরে চুল গঙ্গার বাতাসে উড়ছে। আমাদের দিকে হাসিমুখে তাকিয়ে বললেন, জোয়ারের টানে আসতে একটু দেরি হয়ে গেল মা। কেমন আছো সব?

মাসিমা কাঁদতে কাঁদতে পায়ের ওপর লুটিয়ে পড়লেন। মা হাতজোড় করে দাঁড়িয়ে রইলেন। অজ্ঞাতবাবার মুখে শিশুর হাসি। ভোরের আকাশের মতো লাল রঙ। রামকৃষ্ণদেবের ছবি আমি দেখেছি। আমার মনে হল সামনে তিনিই দাঁড়িয়ে আছেন। আমারও ভীষণ কান্না পেয়ে গেল। তিনি হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস করলেন, আরে কি মুশকিল, তোমরা সবাই মিলে অমন কাঁদছ কেন!

আমার মাথায় হাত রেখে তিনি বললেন, এই পাগলা কাঁদছিস কেন?

আমি বললুম, কী করলে আপনার মতো হওয়া যায়?

ছোট্ট উত্তর, সাধনা, আর তাঁর দয়া।

আপনি কি রামকৃষ্ণ?

তিনি জিভ কেটে বললেন, আমি তাঁর সেবক, দাস।

অজ্ঞাতবাবা বললেন, চলো, আমি তোমাদের নিতে এসেছি। সাবধানে নৌকোয় ওঠো।

মাসিমা জিজ্ঞেস করলেন, কেমন করে জানলেন আমরা আসব?

অজ্ঞাতবাবা হাসলেন, জানা যায় মা। ও অমন কিছু কঠিন ব্যাপার নয়। জলে ডুব দিলে, বহুদূরের নৌকোর নোঙর ফেলার শব্দ শোনা যায়। জীবন—নদীতে ডুব দিলে, সব জীবনের শব্দ শোনা যায়। যেমন বুকে কল বসালে ফুসফুসের শব্দ শোনা যায়। আমরা বহু নই মা, আমরা একা। নাও, নাও উঠে পড়ো দেরি হয়ে যাচ্ছে মা।

জোয়ারের টানে তরতর করে নৌকো চলল উত্তর দিকে। ছোটো ছোটো ঢেউয়ে রোদ মুচকি হাসছে। নৌকোর মাঝখানে অজ্ঞাতবাবা বসে আছেন ভাবে বিভোর হয়ে। একমাথা চুল বাতাসে উড়ছে ফুরফুর করে। দুপাশে ভালো ভালো বাগানবাড়ি, নির্জন স্নানঘাট, দেবালয়। কী ভালো যে লাগছিল সেদিন।

যে ঘাটে নৌকো ভিড়ল, সে জায়গাটার নাম রিষড়া। ঘাটের পাশেই সুন্দর একটি আশ্রম, সঙ্গে মন্দির। দুধের মতো সাদা শ্বেতপাথরে তৈরি। চারপাশ ফুলে ফুলে ছেয়ে আছে। ক্লান্ত মৌমাছি ফুলের নেশায় ফুলের পরাগকোষে এলিয়ে পড়েছে। ভোঁ ভোঁ করার চেষ্টা করছে, পারছে না।

আমাকে অবাক হয়ে থাকতে দেখে, অজ্ঞাতবাবা বললেন, বুঝলে ঠাকুর ওই হল সাধকের অবস্থা।

সুরা পান করিনে আমি/সুধা খাই জয় কালী বলে। একেবারে মজে গেছে। কীরকম শব্দ করছে দেখেছো, ওঁ, ওঁ।

অনেক পরে বুঝেছিলুম জীবনের সবকিছুকেই সাধনার স্তরে তুলতে না পারলে, জীবনের মানে দাঁড়ায় জন্মের দ্বার দিয়ে প্রবেশ আর মৃত্যুর দ্বার দিয়ে প্রস্থান, আর ফেলে যাওয়া কিছু আবর্জনা।

আমরা আশ্রমে ঢুকলাম। সামনেই বিশাল এক বেলগাছ। সারাবছর সে গাছে ফল ফলে। সবসময়েই লেগে থাকে সবুজপাতা। সেই বেলগাছের তলায় জুতো পায়ে যাওয়া নিষেধ। কিছু দূরেই একটি আমগাছ। সেই আমগাছ নাকি মধুক্ষরা। ফাল্গুন, চৈত্র মাসে শিশিরের মতো মধু বর্ষণ করে।

বাঁপাশে শ্বেতপাথরের ঘরে চাদ ছোঁয়া বিশাল এক তৈলচিত্র। বাঘছালে বসে আছেন জটাজুটধারী মহাযোগী। বিশাল দুটি চোখ থেকে আগুন যেন ঠিকরে বেরোচ্ছে। তাকালেই গা ছমছম করে। পাশেই আর এক মহাপুরুষের তৈলচিত্র। চেহারা অনেক শান্ত, সৌম্য। অনেকটা ওই ফুলে বসে থাকা মধুমাতাল ভ্রমরের মতো।

অজ্ঞাতবাবা বললেন, ওই ছোটো পটটি তাঁর গুরুর, আর বড়ো পটটি তাঁর গুরুর গুরু। উত্তর ভারতের এক মহাসাধক ছিলেন তিনি। রাজা—মহারাজারা যাঁর পায়ে এসে লুটিয়ে পড়তেন।

সেই মেলার সাধুবাবা আমাকে বলেছিলেন, মৃত্যুর পরেও মানুষ বেঁচে থাকে সাধনার জোরে। সাধনা মানুষকে সাধারণ থেকে অসাধারণ করে। নামকরা চোরও সাধক, ডাকাতও সাধক আবার সাধকও সাধক। শুধু ভেক ধরে বসে থাকলে কিছু হয় না।

আমরা আশ্রমে ঢুকলুম। সেই বয়েসেই মনে হয়েছিল, কী সুন্দর শান্তির জায়গা। এখানে আমার ভুঁড়িঅলা, ঢেঁকুরতোলা কাকা নেই। অসভ্যের মতো পান—চেবানো কাকিমা নেই। তেল জ্যাবজেবে পাতাকাটা চুল, খ্যানখেনে গলা। কথায় কথায় ভুরু নাচিয়ে বলা, ওমা কী হবে গো? ওঁরে ওঁ মঁধু, দ্যাখনা তোর বাপ কোথায় গেল।

মধু হল আমার ভাইপো। বড়ো হয়ে সে খুব বড়ো চোরাকারবারি হয়েছিল। একটা বিয়েকরা বউ আর তিন তিনটে মেয়েছেলে সামলাত। নকশাল আমলে তার সুরেলা সরু গলাটি কাটা হয়েছিল। মৃত্যুর খবর শুনে আমার খুব দুঃখ হয়েছিল। আমরা দুজনেই সমবয়সি ছিলুম। ছেলেবেলায় আমাকে কথায় কথায় কিল—চড়—লাথি মারত। তা মারত। আমি কিছু মনে করতুম না। দুর্বলেরাই ওসব করে। মন দুর্বল না হলে দেহ সবল হয় না। এ সিদ্ধান্ত আমার মহিষাসুরকে দেখে। অতবড়ো একটা লাশ, মায়ের পায়ের তলায় ত্রিভঙ্গ হয়ে পড়ে আছে। আমার জ্যাঠামশাই। গ্রামের লোক তাঁর ভয়ে কাঁপত। আর তিনি কাঁপতেন জ্যাঠাইমার ভয়ে।

আশ্রমের ভেতরে ছোটো একটি গর্ভগৃহ। অনেকটা চোরকুঠুরির মতো। সেই ঘরে শ্বেতপাথরের এক নারীমূর্তি। যেন ধ্যান করছেন চোখ চেয়ে। ঘরের আলো—অন্ধকারে সেই সাদা মূর্তি, দেখেই কেমন যেন ভয় ভয় করে উঠল।

সেই মেলার সাধুবাবা বলেছিলেন, এই যে মানুষ আসে আর যায়, একি শুধুই যাওয়া আর আসা! তরঙ্গ উঠল আর তরঙ্গ মেলাল। তা নয়। রূপ থেকে অরূপ! অরূপেরও রূপ আছে। সে রূপ দেখলে সাধারণ মানুষের গা ছমছম করবে। ভয় করবে। হয়তো জ্ঞান হারিয়ে ফেলবে।

অজ্ঞাতবাবা বললেন, ইনি আমার গুরুদেবের মা। তিনি বলতেন মায়ের কৃপা ছাড়া এ জগতে কিছু হয় না। তিনিই সৃষ্টি করেন, তিনিই লয় করেন। ভালোমন্দ সবকিছু তাতেই জন্মাচ্ছে, লয়ও হচ্ছে তাতেই। তিনি ধারণ করছেন তাই জীবের আগমন, তিনি গ্রাস করছেন তাই জীবের গমন। এই আশ্রমে প্রতিদিন মায়ের পুজো হয় ষোড়শোপচারে।

গঙ্গার দিকের শ্বেতপাথর বাঁধানো ঢাকা বারান্দায় আমরা বসলুম। আমি বললুম, আমরা আপনার নাম রেখেছি, অজ্ঞাতবাবা।

তিনি হেসে বললেন, বেশ ভালো নামই রাখা হয়েছে। জীবনের আসল সত্য এখনও অজ্ঞাত। যে জানে সে আর জানতে চায় না। স্বার্থপরের মতো একাই ভোগ করে। যা প্রকাশিত তাই জ্ঞাত। মানুষ যা দেখে, যা শোনে, তাকেই মনে করে প্রকাশিত। যা দেখে না, তা অপ্রকাশিত। মনে করে অসত্য, কল্পনা মাত্র। তা কিন্তু নয়। মেরুপ্রদেশে সমুদ্রে বরফের চাঙড় ভাসছে। জাহাজের কাপ্তেন ভাবলে, ও তো সামান্য একটা টুকরো। যাই পাশ কাটিয়ে যাই। ধাক্কা লেগে জাহাজ ডুবে গেল। তখন জানা গেল, প্রকাশিত অংশের তলায় ছিল পর্বতপ্রমাণ অপ্রকাশিত অংশ।

মা গঙ্গার দিকে তাকিয়ে চুপ করে বসে আছেন। ধীরে ধীরে দু—চোখে ফুটে উঠেছে সেই অদ্ভুত দৃষ্টি। যে দৃষ্টিতে মা অন্যের ভূত ভবিষ্যৎ ছবির মতো দেখতে পান। মা এখন অন্য জগতে চলে গেছেন। মাসিমা কী বলছেন, কিছুই শুনতে পাচ্ছেন না। দুপুরে আমরা এখানেই প্রসাদ পাবো। অজ্ঞাতবাবা সেই ব্যবস্থা করতে ভেতরে গেছেন।

মা হঠাৎ বললেন, আমি আর ফিরবো না। তোমরা ফিরে যাও।

মাসিমা বললেন, সে কী কথা! এখানে তুমি কী করবে? এ হল সাধুদের আস্তানা।

আমি আমার ভবিষ্যৎ দেখে ফেলেছি। স্পষ্ট ছবির মতো দেখতে পাচ্ছি।

কী দেখছ শুনি?

সে বড়ো সুন্দর ছবি। আহা, সে বড়ো সুন্দর ছবি।

কী ছবি, আমাদের একবার বলো না।

বলে কী হবে? আমি করে দেখাবো। আমি গিয়ে দেখাবো। কেউ আর আমাকে সংসারে ধরে রাখতে পারবে না।

তোমার ছেলে? তার কী হবে?

তোমরা দেখবে। কেন তোমরা দেখতে পারবে না? মহী আমাকে ছোটোমা বলে। মহী তো এর দাদা।

ওর মন খারাপ হবে না। এই বয়েসে বাপকে হারিয়েছে, মা হয়ে যাবে আশ্রমবাসী। তুমি নিজের পথে চলতে গিয়ে ওকে দুঃখী করবে?

যে মায়ের নাম ও সারাজীবন করবে, সে মা যদি মায়ের মতো মা হয় তাতে মন খারাপের কী আছে? সে তো মহা আনন্দের। যার ছেলে তিনিই দেখবেন। মানুষ ভাগ্য নিয়ে আসে, সাধনায় সিদ্ধিলাভ করে। ও কী হবে আমার জানা আছে।

কী হবে?

হয়ে দেখবে। এখন আমি কিছু বলব না।

আমার কী হবে?

আমার সঙ্গে তুমিও হয়তো জড়িয়ে যাবে। তবে এখন নয়, আরও কিছুকাল পরে।

অজ্ঞাতবাবা ফিরে এলেন। কী বলছ গো তোমরা?

মা বললে, আমি আর ফিরবো না।

তিনি হাসলেন, ফিরবে না কী? সকলকেই তো ফিরে যেতে হবে মা।

যেখানে থেকে আসা, সেইখানেই আবার ফিরে যাওয়া। আবার আসা, আবার যাওয়া।

 আমার সাধ হয় সদা, যাই গো ভেসে,

 কুলে আমায় কে আনে

 প্রাণের কথা প্রাণই জানে।।

কী সুন্দর গলা। অজ্ঞাতবাবা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে তিনটি লাইন বারকয়েক গাইলেন। কাচের মতো ভাসা ভাসা চোখ। সেদিন আবার ভীষণ ইচ্ছে করছিল, যত তাড়াতাড়ি পারি বড়ো হয়ে যাই। পারলে একমাসের পথ একদিনে হেঁটে যাই। অজ্ঞাতবাবাকে এত ভালোবেসে ফেলেছিলুম, আজও তার কথা ভুলতে পারিনি। মানুষই দেবতা হয়, মানুষই অসুর।

অজ্ঞাতবাবা গান থামিয়ে বললেন, তোমার এখনও তিনটে কাজ বাকি আছে মা। কী কী কাজ তা আমি বলব না।

মা বললেন, আমি জানি।

তুমি তো জানবে মা। জানোই যখন তখন তাড়াতাড়ি সব সেরে নাও।

এদিকে পাট চোকালে তবেই না ওদিকটা সহজ হবে। তুমি তো জানোই মা, আগেরবার কী হয়েছিল?

হ্যাঁ, তাও জানি। একটুর জন্যে পা পিছলে গিয়েছিল।

অজ্ঞাতবাবা চোখ বুজিয়ে সুর করে বলতে লাগলেন—

উত্তিষ্ঠত জাগ্রত
প্রাপ্য বরান্ নিবোধত
ক্ষুরস্য ধারা নিশিতা দুরত্যয়া
দুর্গং পথস্তৎ কবয়ো বদন্তি।।

মনে গেঁথে গিয়েছিল উপনিষদের শ্লোকটি। পরে খুব কাজে লেগেছিল। টনিকে দেহ ভালো হয়। মনের কোনো টনিক নেই। মহাপুরুষের সঙ্গ আর শাস্ত্রপাঠই মনের টনিক। মন যখনই অন্ধকারে ঘুমোতে চেয়েছে, তখনই চোখের সামনে অজ্ঞাতবাবাকে দাঁড় করিয়েছি, আর তিনি বলেছেন, ঘুমোসনি।

ওঠো জাগো, মোহনিদ্রা ত্যাগ করো।
আত্মার তত্ত্ব জানার চেষ্টা করো।

সে তো সহজ কাজ নয়। ক্রান্তদর্শী যাঁরা, তাঁরা বলেন, আত্মজ্ঞানের পথ ক্ষুরধারার মতো দুর্গম। সহজে সে পথ অতিক্রম করা যায় না।

শৈশবে মন যখন সমুদ্রের ভিজে বালির মতো মিহি আর নরম তখনই যেসব দাগ ধরে তা আর মোছে না। যিনি হেঁটে গেলেন তাঁর পদচিহ্ন ধরা থাকে চিরকাল। অজ্ঞাতবাবা আমার মনে ঢুকে গিয়েছিলেন। চোখ বন্ধ করলেই তাঁকে দেখতে দেতুম। ধ্যানাসনে বসে আছেন, জীবন্ত পাথরের মূর্তি। ধূসর চুল ফুরফুর করে বাতাসে উড়ছে। যখনই মনে হয়েছে জীবন অপবিত্র হতে চলেছে, চোখ বুজিয়ে একবার তাঁকে স্মরণ করা মাত্রই গাড়ি আবার সোজাপথ ধরেছে। তিনি ছিলেন আমার গুরু। অজ্ঞাতবাবা এই বিশ্বাস এনে দিয়েছিলেন, মনের স্টিয়ারিং শক্ত হাতে যে ধরতে পেরেছে, তার আর মার নেই।

প্রসাদ পাবার পর ভাটার টানে আবার আমরা ফিরে এলুম কলকাতায়। আসার আগে অজ্ঞাতবাবা স্থির দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন আমার দিকে। মৃদু স্বরে বললেন, আবার আসবি তো?

বললুম, আমি তো আর ফিরে যেতে চাই না। আমাকে এঁরা জোর করে নিয়ে যাচ্ছেন।

তুমি ব্রাহ্মণ হয়ে ফিরে এসো।

সূর্য নেমেছে পশ্চিমে। আকাশ লাল। টিপটিপ পাখি উড়ছে। পালে ভরা—বাতাস। নৌকোর পাশে ঢেউ উঠছে ছলাৎ ছলাৎ শব্দে। এক একটা দিন, অন্য সব দিনের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *