2 of 2

কেপ মে’-র সেই বাড়ি – শমীতা দাশ দাশগুপ্ত

কেপ মে’-র সেই বাড়ি – শমীতা দাশ দাশগুপ্ত

এই বাড়িটা ভারি সুন্দর। এতদিন ধরে চেয়ে—চিন্তে, কেঁদে কঁকিয়ে, একটা মনের মতো বাড়ি পেয়েছে দীপা। সারা জীবন এমনি একটা বাড়ি চেয়েছিল। অবশ্য এ নিয়ে অমরকে দোষ দেওয়া যায় না। এদেশে এসেছিল আট ডলার পকেটে আর একটা ছোট্ট সুটকেস সম্বল করে—পড়াশোনা করতে। তখন একটা ডিম কিনতেও পাঁচবার ভাবতে হত ওদের। তারপর চাকরি—ছেলেমেয়ে মানুষ করা। বাঙালি মানসিকতায় দু—জনেই ভেবেছে বিদ্যালাভই জীবনের প্রধান উদ্দেশ্য। তাই ছেলেমেয়েকে পড়িয়েছে নামি—দামি কলেজে। আমেরিকায় ভালো কলেজে পড়ানো মানে প্রতি বছর একটা নতুন মার্সিডিস বেনজ গাড়ি কিনে পাহাড়ের ওপর ফেলে দেওয়া। আট বছর ধরে তাই করেছে। শখের বাড়ি কেনার সংগতি বা অবসর, দু—টোই ছিল না! ভাগ্য ভালো দু—জন ছেলেমেয়েই চৌকস—স্নাতকোত্তর পড়ার খরচ নিজেরাই জোগাড় করেছে। এখন তারা নিজেদের মতো সংসার গুছিয়ে সরে গেছে। এতদিনে ওদের হাত—পা ঝাড়া। এতদিনে দীপার শখ পূরণের সময় হয়েছে।

জীবনের কাজ সামলাতে গিয়ে কখন যেন বেলা পড়ে গেল। একদিন ওর দিকে তাকিয়ে অমর বলল,

‘আর বেশি সময় নেই। যা করার তাড়াতাড়ি সেরে নেওয়াই ভালো।’

নিউ জার্সির দক্ষিণ প্রান্তের ছুঁচলো চিবুকে বসে আছে কেপ মে শহর। সেই চিবুক ঘিরে রয়েছে ডেলাওয়্যার উপসাগর আর অতলান্তিক মহাসাগরের দুরন্ত জল। কেপ মে—র কাছাকাছি গেলেই সমুদ্রের সোঁদা গন্ধ পাওয়া যায়। সমুদ্রের পাড় ঘেঁষে রয়েছে পুরোনো বাড়ির সারি—সামনে চওড়া রাস্তা।

বাড়ির অবস্থিতি দেখে নেচে উঠল দীপা। রাস্তা থেকে কিছুটা দূরে সমুদ্রের দিকে মুখ করা একটা দোতলা বাড়ি—একটু একটেরে। চোখ মেললে সমুদ্রের ঢেউ, পাড়ের বালি, দিনে রাতে হু হু করে বয়ে চলা খোলা হাওয়া। আঃ, এত সুখও কপালে ছিল! ভিক্টোরিয়ান স্থাপত্যের প্যাটার্নে বানানো একশো বছরের বেশি পুরোনো বাড়ি। অবশ্যই বহুবার মেরামত হয়েছে, কিন্তু কী চমৎকারভাবে রক্ষা করা হয়েছে ভিক্টোরিয়ান যুগের বৈশিষ্ট্য! বাড়ি ঘিরে ঢাকা বারান্দা—ছাঁইচ থেকে ঝুলে আছে লোহার জাফরি। সামনে খানিকটা জমি, তাতে নানান ধরনের ফুলের কেয়ারি, কিছু ঝোপঝাড়, আর একটা গাছ। সেই ছোটো বাগান থেকে তিন—চারটে সিঁড়ি বেয়ে বারান্দায় উঠতে হয়। সারা বাড়িতে গোল কাচের জানালা, বাইরের দিকে ঠেলে বার করা ‘বে উইন্ডো।’ ছাদের একদিকে উঁচু গম্বুজ। ঠিক এমনি একটা বাড়িই দীপা চেয়েছিল সারা জীবন। ওর স্বপ্নের বাড়ি!

ওর মুখের দিকে তাকিয়ে অমর বলল,

‘বিয়ের পর তো তোমাকে কোনোদিন মধুচন্দ্রিমায় নিয়ে যাইনি, কিছু দিইওনি। ধরে নাও, এটাই তোমার বিয়ের উপহার, মধুচন্দ্রিমা টন্দ্রিমা শুদ্ধু।’

দীপা হেসে ফেলল। অমর যে রোমান্টিক, তেমন অপবাদ ওর শত্রুরাও দিতে পারবে না। কিন্তু রাগও করতে পারল না। ওর স্বপ্নের বিবরণ শুনে শুনে অমর ঠিক সেই মতো বাড়িই খুঁজে দিয়েছে। ওর ভালোবাসার বাড়ি!

সবচেয়ে বড়ো বেডরুমটা হবে ওদের শোবার ঘর; ছেলে—মেয়ের জন্যে দুটো আলাদা ঘর থাকবে। একটা ঘর বই আর কম্পিউটার রাখার স্টাডি, আর অতিথিদের জন্যে তোলা একটা ঘর। রান্নাঘর, ড্রয়িং রুম, খাওয়ার ঘর, বাথরুম, চওড়া বারান্দা মিলিয়ে বাড়িটা বিশাল।

বাড়ির আয়তনে সামান্য ঘাবড়াল দীপা। এখানে সব কাজ নিজের হাতে করতে হয়। এত বড়ো বাড়ি সাফ সুতরো রাখতে যথেষ্ট খাটতে হবে—বয়স বাড়ছে, কমছে তো আর না! তাও, দীপার মন ভরে গেল।

বাড়িটা প্রায় গুছিয়ে ফেলেছে দীপা। কাজ প্রচুর, কিন্তু গায়ে লাগছে না। সময় অসময়ে সমুদ্রের সামনে দাঁড়ানো—সে এক সঞ্জীবনী অভিজ্ঞতা। ঢেউয়ের ছন্দে কী এক অদৃশ্য হাতছানি ওকে টেনে নিয়ে যায় জলের কাছে, বার বার। দীপা সম্মোহিতের মতো তাকিয়ে থাকে ঢেউয়ের পর ঢেউয়ের দিকে।

এখনও প্রতিবেশীদের সঙ্গে তেমন আলাপ হয়নি। গ্রোসারি স্টোরে আসতে যেতে কয়েকবার চোখাচোখি—একটু হাসি, ‘হাই’, ‘হ্যালো,’ ব্যাস, ততটুকুই।

গুছিয়ে বসতে না বসতেই অমর জানাল অফিসের কাজে দু—দিনের জন্যে বাইরে যাবে। একবার বেরোলে কাজ ছাড়া বাকি পৃথিবী সম্পর্কে অমরের খেয়াল থাকে না। দীপা মনে করিয়ে দিল, ‘আসার পরের দিনই কিন্তু আমাদের হাউস ওয়ার্মিং পার্টি। সবাইকে নেমন্তন্ন করা হয়ে গেছে—শেষ মুহূর্তে ‘পারছি না’ বলে বাতিল করলে চলবে না।’

বাড়িতে পার্টি হলে দীপাই সবকিছু করে—খাবারদাবার, গোছানো, সব। মাঝে মাঝে দীপার মনে হয় নিজের বাড়ির পার্টিতে অন্যান্য অতিথির মতো অমরও গেস্ট হয়ে এসে বসে, আড্ডা—গল্পে আসর মাত করে। অতিথি সেবার খুঁটিনাটি দায়িত্ব থাকে একা দীপার ওপর।

গৃহপ্রবেশ—হাউস ওয়ার্মিং। নিউ জার্সির বিভিন্ন শহর থেকে অনেকেই ঘণ্টা দুই গাড়ি চালিয়ে আসবে, যতটা না অমর—দীপাকে ভালোবেসে, তার চেয়ে বেশি সমুদ্রের ধারে ওদের ভিক্টোরিয়ান বাড়ি দেখার কৌতূহল মেটাতে। ফলে অমর চলে যাওয়ার পর দীপার কাজের কমতি হল না। বাজার, রান্না, টুকটাক গোছগাছ, বাড়িটাকে সুন্দর করে সাজানো। কাজ শেষ করতে সেদিন বিকেল হয়ে গেল। সারাদিনের ক্লান্তি কাটাতে দীপা স্নান করে নিল ভালো করে।

হেমন্তের প্রায় শেষ, দিন ছোটো হয়ে গেছে। এই সময়টা বড়ো অদ্ভুত—কখনো হালকা শীত, কখনো গরম। বারান্দায় আরাম কেদারায় বসে ঢেউয়ের ওঠা পড়া দেখতে দেখতে দীপার গা শিরশির করে উঠল। সূর্য ডুবতেই ঠান্ডা পড়ছে। সন্ধে হয়ে এলেও এক্ষুনি ভেতরে যেতে ইচ্ছে করল না ওর। গায়ে একটা শাল জড়ালে আরও কিছুক্ষণ বাইরে বসা যাবে। শাল আনতে ভেতরে গেল দীপা।

শোবার ঘরের ক্লজেট থেকে একটা গরম শাল নিয়ে নীচে নামতে পা বাড়াল। ঘরের দরজার দিকে যেতে গিয়ে বাঁ চোখের কোনায় মনে হল ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় কারোর ছায়া পড়েছে। গায়ে কাঁটা দিল—বুকের পাঁজরে ধকধক শব্দ! দৌড়ে পালাবার দুর্বার প্রবৃত্তি রোধ করে দীপা দাঁড়াল। বুকে আতঙ্কের চাপ অবজ্ঞা করে সাহস খুঁজল নিজের মধ্যে—জোর করে মুখ ঘুরিয়ে তাকাল আয়নার দিকে।

বাড়িতে অন্য কেউ নেই, থাকতে পারে না। অমর আসবে দু—দিন পরে। আয়নার দিকে তাকাতে গিয়ে হৃৎপিণ্ডের ধুকপুকুনি বেড়ে গেল আরও। ভয় করছে—তবু তাকাল দীপা। নাঃ, কেউ নেই। ঘরের চারদিকে, সিঁড়ির দিকে দেখল ভালো করে। যেখান থেকে আয়নায় প্রতিচ্ছবি পড়তে পারে সে সব জায়গায় চোখ ফেরাল। পুরো ঘর এক্কেবারে ফাঁকা—যেমন হওয়া উচিত।

নিজের দুর্বলতায় হাসি পেল ওর। নতুন বাড়িতে একা থাকতে ভয় করছে? এ ছাড়া অন্য কী কারণ হতে পারে? সারাজীবন বহু, বহু দিন একা থেকেছে দীপা—ছেলেমেয়েরা যখন ছোট্ট ছিল তখনও। এত বয়সে পৌঁছে এখন একা থাকতে ভয় করছে? তবু, নিজের চোখের অভিজ্ঞতা সহজে উড়িয়ে দিতে পারল না। আয়নায় একটা মুখ ও দেখেছে ঠিকই! অজান্তে বাড়িতে কেউ ঢুকে পড়েছে কি?

কেপ মে যথেষ্ট নিরাপদ শহর। তাদের পাড়া তো বটেই। এখানে কবে শেষ ছিনতাই, চুরি—ডাকাতি হয়েছে খুঁজতে ইতিহাসের পাতা খুলতে হবে। শক্ত হয়ে নিজেকে জড়ো করে পায়ে পায়ে ঘরগুলো ঘুরে দেখতে লাগল দীপা। শরীরের মধ্যে রক্তের ওঠা পড়ার হুসহুস শব্দ শুনতে পাচ্ছে কানে, কাঁধের টানটান পেশিতে কাঁপন! একটা ঘরে যদি কেউ সত্যিই লুকিয়ে থাকে, কী করতে পারবে ও? দৌড়ে বাইরে বেরিয়ে যাবে? সে সময় পাবে কি? তাহলে কি ধরে নেবে বাড়িতে কেউ নেই? যেমন ফাঁকা থাকার কথা তেমনি আছে?

পা টিপে টিপে চারটে ঘর ঘুরে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল দীপা। নিশ্চয়ই মনের ভুল। নীচে নামার জন্যে সিঁড়িতে পা ফেলে সামান্য ঘাড় ঘুরিয়ে দোষী আয়নাটার দিকে তাকাল আর একবার।

আবার…আবার! আবার একটা মুখ! এক পলকের জন্যে একটা মুখ ভেসে উঠল আয়নায়! এবারে কোনো সন্দেহ নেই! একটা মুখ, একটা মেয়ের মুখ! চারদিকে মাথা ঘুরিয়ে দেখার দরকার আছে বলে মনে হল না। ও জানে কোথাও কেউ নেই। তবে কী দেখল—প্রেতাত্মা? নাকি আলোছায়ার খেলা? হিম হয়ে গেল দীপা।

একটা সহজবোধ্য, যুক্তিসম্মত ব্যাখ্যা আছে নিশ্চয়ই! হ্যালুসিনেশন? অলীক প্রত্যক্ষ? এত সহজে ভূত মানতে রাজি নয় ও। নিজের অন্তর্দৃষ্টির প্রতি সেটুকু আস্থা আছে। কী করবে দীপা বুঝতে পারল না। বাড়ি পালটাবার চাপে কি এ ধরনের মানসিক বিকৃতি ঘটতে পারে? একা থাকতে ভয় করছে বলে ওর মন সঙ্গী উদ্ভব করছে? অনেক সময় একা ছোটো বাচ্চারা যেমন অদৃশ্য বন্ধুর জন্ম দেয়! ভয় পেতে অস্বীকার করল ও। সারা জীবন নাস্তিকতায় বিশ্বাস রেখে এখন অশরীরী ভূতে বিশ্বাস করবে?

সামনের দরজা এঁটে বন্ধ করে ছেলেমেয়ে দু—জনকে ফোন করল। ছেলেকে পাওয়া গেল না, তবে মেয়ের সঙ্গে গল্প হল কিছুক্ষণ। বেশ কয়েকবার ‘কী হয়েছে’ জানতে চাইলেও আয়নায় ছায়ার কথা কিছুতেই বলতে পারল না দীপা। তবে বাইরের জগতের সঙ্গে যোগাযোগ করে কিছুটা বাস্তবের ছোঁয়া পেল। আয়নার মুখ—মনের ভুল হতেই হবে!

ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে এল দীপার চেতনা। প্রতি মুহূর্তে আয়নার দিকে তাকাতে হচ্ছে না, ছায়া দেখে চমকে উঠছে না। তবে আগের উত্তেজনার পরিসমাপ্তিতে ক্লান্ত লাগছে। অমর নেই—ডিনার রান্নার ঝামেলাও নেই। এক বাটি স্যুপ আর একটা স্যান্ডউইচই ওর পক্ষে যথেষ্ট। গল্পের বই নিয়ে তাড়াতাড়ি বিছানায় শুয়ে পড়ল ও। ঘণ্টাখানেক পড়ার পরে চোখ বুজে এল আপনা আপনি। হাত বাড়িয়ে বেড ল্যাম্পটা নিবিয়ে দিয়ে চোখ বুজতেই একটা মৃদু সুগন্ধি ভেসে এল নাকে। তন্দ্রায় ডুবে যেতে যেতে দীপা ভাবতে চেষ্টা করল, এ গন্ধ কি তার চেনা? কোনো পারফিউমের বোতল উলটেছে? প্রশ্নগুলো বেশিক্ষণ মাথায় ধরে থাকতে পারল না—ঘুমের অতলে তলিয়ে গেল।

একটা ছোট্ট ছেলে—বয়স কত হবে? দশ? ওর শোবার কামরায় আপনমনে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এতটুকু ইতস্তত করছে না—যেন জায়গাটা ওর চেনা। আচ্ছা, ছেলেটা ঘরে ঢুকল কী করে? দীপা কি তাহলে বাইরের দরজা বন্ধ করেনি? কিন্তু ওর তো বেশ মনে আছে বন্ধ করেছে!

ছেলেটা খাটের পায়ের কাছে দাঁড়িয়ে দীপার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। অমন করে কী দেখছে ও? দীপাকে? কেন? বাইরে মেঘ ঘিরে এল কখন? ঘরের ভেতরে অন্ধকার ছেয়ে এসেছে; একটু যেন ঠান্ডাও বেড়েছে! হালকা নীল রঙের পাজামা আর শার্ট পরে রয়েছে ছেলেটা—রাতে শোবার পোশাক! এই দিনদুপুরে রাতের পোশাক পরেছে কেন? এখন কি দিন? তাহলে দীপাই বা শুয়ে আছে কেন? সব কিছু গোলমাল লাগল ওর! সবচেয়ে বড়ো প্রশ্ন, কেমন করে ঘরে ঢুকল ছেলেটা? কে দরজা খুলে দিল? অমর ফিরলে বাড়িতে তালার উন্নতি করতে হবে। দিনে রাতে মানুষ ঢুকে পড়ছে, সেটা তো কাজের কথা নয়! নতুন জায়গায় এ সব ব্যাপার ভালো মনে হল না দীপার। কিন্তু ছেলেটা কে?

একদৃষ্টে ছেলেটা তাকিয়ে রয়েছে। ও কি দীপাকে কিছু বলতে চায়? ঘরের শৈত্য বেড়েছে অনেক— বেশ ঠান্ডা লাগছে ওর। কেন এসেছে ছেলেটা? কী চায়? দীপার গলা শুকিয়ে গেছে, কথা বেরোচ্ছে না। ঘরের ঠান্ডা বেড়েই চলেছে! মোটা কম্বলের তলায় ঠকঠক করে কাঁপছে ও। হঠাৎ কেমন ভয় লাগল। নিজেই অবাক হল, ছোটো একটা ছেলেকে ভয়!

ছেলেটার পেছনে একটা বিশাল কালো ছায়া এগিয়ে এসেছে—প্রায় ঘিরে ফেলেছে ছেলেটাকে। ছোটো ছেলেটা খেয়াল করছে না পেছনে কী রয়েছে! ঘন ছায়ার অবয়ব বোঝা যাচ্ছে না—শুধু আকার। আর, সেই ছায়ার ভেতর থেকে অশুভ, অমঙ্গলাসূচক ঢেউ ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে!

দীপা দেখল চাপচাপ ছায়ার বৃত্তের মধ্যে দুটো আলোর ফুলকি—লাল রঙের বিন্দু! রাত্রে জন্তুর চোখের মতন জ্বলছে! অত হিংস্র দেখাচ্ছে কেন আলোর টুকরো দুটো? এ কি দীপার মনের ভুল?

ছেলেটা কিছু বলছে ওকে। কী বলছে? রাগ করছে? রাগ করছে ওর বাড়িতে দীপারা থাকছে বলে? ঘ্যাঁসঘ্যাঁসে গলায় ছেলেটার ভুল ভাঙাতে চেষ্টা করল ও,

‘এই বাড়িটা আমরা কিনেছি। এটা এখন আমাদের বাড়ি…’

ছেলেটা শুনল কিনা বোঝা গেল না—কিন্তু পেছনের ঘোর কালো ছায়া নড়ে উঠল। দীপার খুব ভয় করছে! ছেলেটা কথা বলছে না—ঠোঁট চেপে দাঁড়িয়ে আছে। অতি কষ্টে মুখ থেকে কয়েকটা শব্দ বের করল দীপা,

‘তুমি কে? কে তুমি? এ বাড়ি এখন আমাদের। বল, তুমি কে?’

আচ্ছা এতটুকু একটা ছেলেকে ভয় পাচ্ছে কেন দীপা? ছেলেটার মা—বাবা কোথায়? বিছানায় উঠে বসতে গেল ও—পারল না। কী হল? প্যারালিসিস? দীপার কি স্ট্রোক হয়েছে? পেছনের ছায়ার ক্রোধ যেন বেড়েই চলেছে! ওর কোনো ক্ষতি করতে পারে কী ওই অন্ধকার?

হঠাৎ ছেলেটার পাশে একজন মহিলা এসে উপস্থিত হলেন। ওর মা? কেমন করে এখানে এলেন উনি? মহিলার মুখ শঙ্কায় বিকৃত হয়ে উঠেছে। ঘরের তাপমাত্রা আরও নীচে নেমেছে! আর কিছুক্ষণ এমন চললে দীপা জমে যাবে! ছেলেটার অসহায়ত্ব, ছায়ার বেপরোয়া রাগ, আর মহিলার আতঙ্ক কোনোটাই বুঝতে পারছে না ও। কারা এরা, বাড়িতে ঢুকল কী করে, কী বলতে চায় ওকে?

নড়তে পারছে না দীপা। সম্পূর্ণ স্থবির হয়ে গেছে—পুরোপুরি নিষ্ক্রিয়। নাকি ঠান্ডায় জমে গেছে ওর শরীর, তাই উঠে বসতে পারছে না। ভয়ে সিঁটিয়ে গেছে ও। সেই নিরালোক ছায়াবৃত্তের আক্রোশ ধীরে ধীরে সমস্ত ঘর ঢেকে ফেলছে—হঠাৎ কী ঘটবে বলা যায় না! ছেলেটার পাশে দাঁড়ানো মহিলার চেহারা গভীর বিষণ্ণতায় পূর্ণ। কোনো গভীর দুঃখে ভেঙে পড়ছেন তিনি। দু—গাল দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে টপটপ করে, ঠোঁট কাঁপছে। কিসের এত দুঃখ? কেন এই সর্বগ্রাসী বিষাদ? কিচ্ছু জিজ্ঞেস করতে পারছে না দীপা, তার দু—ঠোঁট কেউ আঠা দিয়ে আটকে দিয়েছে।

বাঁ হাত দিয়ে ছেলেটার কাঁধ জড়িয়ে ধরে জলভরতি চোখ তুলে দীপার দিকে তাকালেন মহিলা। কান্না ভেজা স্বরে সতর্ক ধ্বনি করলেন একবার। এক ঝটকায় জাপটে ধরলেন ছেলেটাকে। আচ্ছা, এই মহিলাকেই কি আয়নায় দেখেছিল?

ধড়মড় করে উঠে বসল দীপা। ভেঙে গেল জড়তা—সব অসাড়তা। ঘরে কেউ নেই! ও ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছিল। স্বপ্ন? এত বাস্তবের মতো হয়? ঘরে হালকা সুগন্ধি।

নতুন বাড়িতে একা থাকার উদ্বেগ নিশ্চয়ই ওকে জড়িয়ে ধরেছে। দিনের যাবতীয় দুশ্চিন্তা স্বপ্নের মধ্যে এক মা আর ছেলের রূপ নিয়ে ওর মনে এসে ধাক্কা মেরেছে। যখন অমর বাড়িতে ছিল, এ ধরনের অভিজ্ঞতা কখনো হয়নি। একা হতেই ভূতেরা এসে জমিয়ে বসেছে। নিজের প্রতি বিরক্তিতে দাঁতে ঠোঁট কাটল দীপা। ভূতেদের স্বাধীন যাওয়া—আসার নিয়ন্ত্রণ দিতে মনে মনে অস্বীকার করে চোখ বুজল আবার।

পরের দিনটা কেটে গেল কাজকর্মে। শোয়ার ঘরের লাগোয়া বাথরুমে জলের ঝরনার তলায় দাঁড়িয়ে সেই হালকা সুগন্ধি নাকে ভেসে এল আবার। আচ্ছা, দীপার কি এপিলেপ্সি হয়েছে? ও শুনেছে মৃগীরোগে খিঁচুনি হওয়ার আগে রোগীরা অনেক সময় কোনো একটা গন্ধ শুঁকতে পায়। তার মানে এই নয় যে বাস্তবে সেখানে সত্যি কোনো গন্ধ রয়েছে। নাকের স্নায়ু উত্তেজিত হয়ে উঠলে মস্তিষ্ক বুঝে নেয় গন্ধ বলে। সে রকম কিছু হল নাকি? অনেক সময় খুব ছোট্ট, হালকা ধরনের খিঁচুনিও তো হয়—কয়েক সেকেন্ডের জন্যে সংজ্ঞা থাকে না। একটুক্ষণের জন্যে স্থানু হয়ে যাওয়া, চোখের পলক না ফেলে তাকিয়ে থাকা, কথোপকথনের মধ্যে অন্যমনস্ক হয়ে চুপ করে যাওয়া। অন্যেরা বোঝেও না কোনো তফাত হয়েছে বলে। সে রকমই কিছু?

স্নান সেরে বেরোতে সুগন্ধি তীব্র হল। এতটাই যে উপেক্ষা করা চলে না। কোনো পারফিউম বোতলের ছিপি খুলে গেছে? অমরের আফটার শেভ লোশন? কিন্তু এই গন্ধ ওর অচেনা। এই ঘরের কোথাও, কোনো কোণে, অজানা কিছু পড়ে আছে কি?

চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে আয়নায় একটা মুখ ভেসে উঠল। চমকে গেল দীপা। ঘুরে পেছন দিকে তাকাল। এবারে সোজাসুজি তাকিয়ে ছিল আয়নার দিকে—ভুল হবার কোনো কারণ নেই। শিরদাঁড়া বেয়ে বরফ গলা জল নামছে। এত শক্ত করে চিরুনি ধরেছে যে আঙুল শক্ত হয়ে আটকে গেছে। মুখটাকে এড়িয়ে যাবে ভেবেও দীপা চোখ বন্ধ করতে পারল না।

আয়নায় ফুটে উঠেছে একটা মেয়ের মুখ—একটু আবছা, যেন কুয়াশার মধ্যে দিয়ে দেখা যাচ্ছে। শ্বেতাঙ্গী। একটা পুরোনো ধরনের জামা পরা—লম্বা চুলে উঁচু করে খোঁপা বাঁধা। আজকাল লম্বা চুলের মেয়ে দেখাই যায় না! মহিলা কম বয়সি—বছর তিরিশ? দেখে মনে হয় খেটে খাওয়া ঘরের বউ। ওর মুখের এক পাশ দেখতে পাচ্ছে দীপা—মেয়েটা মুখ ঘুরিয়ে তাকিয়ে আছে বাইরের দিকে।

ঘরে কেউ নেই অথচ আয়নায় প্রতিচ্ছবি! মেয়েটা কি আয়নার মধ্যে বাসা বেঁধেছে? ভাবনার কাল্পনিকতায় দীপার ভয় পাওয়া উচিত, কিন্তু আশ্চর্য, ওর ভয় করল না। কৌতূহল বিরাট আকারে সামনে এসেছে। কে ওই মেয়েটা?

যেন ওর অনুচ্চারিত প্রশ্ন শুনেই মহিলা সামান্য মুখ ঘোরালেন। এই মহিলাই কি রাতে ওই ছোটো ছেলেটার সঙ্গে দীপার বিছানার কাছে দাঁড়িয়েছিলেন? কিন্তু সেটা তো স্বপ্ন, তাই না?

দেখতে দেখতে আয়নার ছবি মিলিয়ে গেল—যেন সিনেমার ফেড আউট! দীপা বুঝতে পারছে ব্যাপারটা ওর মানসিক বিকৃতির লক্ষণ। ডাক্তারের কাছে যাওয়া ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। অমর ফিরলে ওকে বলতে হবে, ডাক্তারের সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করতে হবে। তবে যখন শরীর ভালো আছে, কাজকর্ম করতে পারছে, তখন অত জরুরি কিছু হতে পারে না। সামান্য ওষুধ হলেই হয়তো চলবে। দু—হাতে শক্ত করে মাথা চেপে ধরে নিজেকে নির্দেশ দিল দীপা,

‘অত সহজে হাল ছেড়ে দিলে চলবে না। মানসিক রোগ ভয় পাওয়ার মতো কিছু নয়। স্থান পরিবর্তনের ফলে এ সব নিশ্চয়ই সাময়িক সমস্যা!’

দীপা এখনও অনেক বছর বেঁচে থাকতে চায়, সুস্থ জীবন উপভোগ করতে চায়। ওর সুখের প্রথম উপাদান হাতে তুলে দিয়েছে অমর—এই বাড়ি।

সন্ধে নেমেছে। আজকাল প্রতিদিনই একটু একটু করে দিন ছোটো হয়ে আসছে। এই রকম হতে হতে বিকেল সাড়ে চারটেয় অন্ধকার হয়ে যাবে—আর সকালের আলো ফুটবে সাড়ে আটটায়। গরমকালে এই আলোই থাকবে সকাল সাড়ে পাঁচটা থেকে রাত সাড়ে ন—টা অবধি। সে যাই হোক, অন্ধকার নেমে গেলেও একটুক্ষণ বারান্দায় বসে সমুদ্র না দেখলে দীপার মন ভরবে না।

রাতে ভালো ঘুম হয়নি। আজ তাড়াতাড়ি শোবে। ঢেউয়ের নিয়মিত ওঠা পড়ার সম্মোহনের সামনে বসে দীপার দু—চোখের পাতা লেগে গেল। সেই মহিলা আবার এসে দাঁড়ালেন। এবারে ছেলে সঙ্গে নেই। দীপা সমুদ্রের সামনে বারান্দায় বসে নেই।

মহিলা খুবই বিচলিত। কোনো এক অজানা কারণে বিহ্বল—দু—হাতের আঙুলে আঙুল জড়িয়ে নিংড়িয়ে চলেছেন। বারবার বাইরের দিকে তাকাচ্ছেন—ওখানে কি কোনো দরজা আছে? কার জন্যে অপেক্ষা করছেন উনি? এই প্রতীক্ষায় মধুর অধীরতা নেই, রয়েছে ত্রাস, শঙ্কা, ভীতির সময় গোনা। কে মহিলাকে এমন করে আতঙ্কিত করেছে?

হঠাৎ মহিলা মুখ ঘুরিয়ে ওর দিকে তাকালেন। চোখ বিস্ফারিত। উনি কি দীপাকে কিছু বলতে চান? বুঝে ওঠার আগেই ধোঁয়ার মতো মিলিয়ে গেল ছায়াশরীর। চমকে ঘুম ভেঙে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল দীপা। ‘আঃ, স্বপ্ন দেখছিল আবার। বাঁচা গেল!’ রাতের অন্ধকার গাঢ় হয়ে এসেছে—ঘরে ঢুকে পড়ল ও। আর মাত্র একটা দিন—কাল অমর ফিরে আসছে।

পরদিন অমর বাড়ি আসার পর গত দু—দিনের বিকট দুঃস্বপ্ন মিলিয়ে গেল ফুস করে। পার্টি প্রস্তুতির ব্যস্ততার দু—একবার আগের ঘটনাগুলো মনে পড়লেও হেসে উড়িয়ে দিল দীপা। বড়ো দূরের মনে হল সে সব ঘটনা। তাও দু—বার শোবার ঘরে গিয়ে তদন্ত করে এল—অন্য কোনো কিছু নেই তো? দীপা চায় না হঠাৎ অপ্রত্যাশিত কিছু দেখে অমর ঘাবড়ে যায়। একবার মনে হল ঘর থেকে বেরিয়ে আসার সময় খসখস আওয়াজ শুনতে পেল। লম্বা সিল্কের জামা পরে হাঁটার সময় পায়ের ঘষায় যেমন ফিসফিসে বাজনা বাজে! দীপা ধরে নিল সমুদ্রের হাওয়ায় জানালার পর্দা নড়ে শব্দ হচ্ছে।

রাত্রে শোবার সময় পরের দিনের কাজগুলো মনে মনে ঝালিয়ে নিতে নিতে অমরকে মনে করিয়ে দিল দীপা,

‘সামনের গাছটার নীচের ডাল ক—টা কাল সকালে ছেঁটে দিতে ভুলো না। একেবারে হাঁটার পথের ওপর এসে পড়েছে। তা ছাড়া শীত এসে পড়ছে—এরপর আর কাটা চলবে না।’

বাড়ির কাজ করতে সব সময়ই পরাঙ্মুখ অমর এবারেও ব্যতিক্রমী হল না।

‘না করলে চলে না? ঠিক আছে যেটুকু না কাটলে নয়, করে দেব। বাকি সব গরম পড়লে হবে।’

বিছানায় বসে অমরের দিকে পিঠ ঘুমিয়ে পায়ে ক্রিম লাগাচ্ছিল দীপা, মুখ টিপে রইল। বেশি চাপ দিলে ফল উলটো হবে।

‘বিকেলে অত লোক আসবে বাড়ি দেখতে। যতটা পারা যায় সাজাতে হবে না বাড়িটা!’

অমরের কাছে এ সব যুক্তি অবান্তর। ওর মতে ‘লোকে’ বাড়ি দেখতে উৎসুক নয়, ওদের সঙ্গে গল্প করতে আসছে। গাছের ডাল বেঁকে বাড়ি আসার পথের ওপর পড়ছে কি না তা নিয়ে কারোর মাথাব্যথা নেই।

শুয়ে পড়ে বেডসাইড ল্যাম্পটা নিবিয়ে দিল দীপা। সারাদিনের পরিশ্রমের পর পায়ের কম্বল টেনে বিছানার প্রশ্রয়ে চোখ বুজল। ঘুমিয়ে পড়তে পড়তে অমরের গলা কানে ভেসে এল,

‘নতুন পারফিউম কিনেছ মনে হচ্ছে? বেশ সুন্দর গন্ধ।’

পরের দিন সকালে না বলতেই অমর দু—তিন রকমের প্রুনিং কাঁচি নিয়ে সামনের গাছের ডাল কাটতে গেল। এই একটি গাছই রয়েছে ওদের বাগানে—বাকিটা সবই ফুলের কেয়ারি, ঘাসের লন, আর ঝোপঝাড়। সমুদ্রের লোনা জলহাওয়ায় কেমন করে যে এই গাছটা বেঁচে আছে কে জানে! পাতা ভরতি মাঝারি সাইজের তরতাজা গাছ। শীত এসে গেলেও এখনও পাতায় রং ধরেনি, একটা পাতাও ঝরেনি। কী গাছ দীপা জানে না। হয়তো দেরিতে পাতা ঝরে!

রান্নাঘরে দু—একটা রান্নার পদে ফিনিশিং টাচ দিচ্ছে দীপা। জানালার দিকে চোখ তুলে দেখল বরফ পড়ছে ঝুরঝুর করে। আঃ, আজকের দিনে বরফ না পড়লেই হত না? পার্টিটা মিটে গিয়ে কালকে থেকে পড়লে কী হত! আবহাওয়া রিপোর্টে ঘোরতর বরফের কথা তো বলেনি আগে!

দড়াম করে দরজা খুলে অমর ঢুকল ঘরে। দু—হাত দিয়ে বাঁ চোখ চেপে ধরেছে, স্পষ্টত ব্যথায় কাতর। দৌড়ে রান্নাঘরের সিংকে গিয়ে ঠান্ডা জল দিতে লাগল চোখে। ঘাবড়ে গেল দীপা,

‘কী হল? কী হয়েছে তোমার?’

‘বরফ দাও—বরফ দাও আমাকে।’ অমরের স্বর কাতর, উত্তর দেবার সময় নেই।

আরও মিনিট পনেরো পরে কিচেন টেবলের একটা চেয়ারে বসে বরফের টুকরো ভরা তোয়ালে চোখে ধরে অমর বলল,

‘নাঃ, দেখতে পাচ্ছি। চোখটা যে বেঁচে গেছে তাতেই আমি ধন্য। কিছুক্ষণের জন্যে ভেবেছিলাম গেছে বাঁ চোখটা।’

‘এত সাংঘাতিক ব্যথা লাগল কী করে? কাঁচি লাগল নাকি?’

‘নাঃ, একটা অদ্ভুত ব্যাপার হল। তোমার কথামতো গাছের ঝোলা ডালটা প্রথমে কাটতে গেছি। খুব একটা মোটা ডালও নয়—কিন্তু কী রকম যেন পালিশ করা। ঠিক সাইজের প্রুনিং শিয়ার্সই ব্যবহার করেছি বলে তো মনে হল। কিন্তু কিছুতেই কাঁচি বসাতে পারলাম না ডালে। একটু বেশি চাপ দিতেই ডালটা রাবার ব্যান্ডের মতো ছিটকে এসে চোখে মারল।’

দীপার গলার কাছে এক টুকরো ভীতির কয়লা জমা হয়েছে।

‘মারল? ছিটকে এসে লাগল বল!’

অমরকে একটু চিন্তিত লাগল।

‘কেমন মনে হল ডালটা এসে একটা চড় মারল। ঠিক উদ্দেশ্যহীন ছিটকে এসে লাগা নয়।’

তারপর বক্তব্যের অবাস্তবতায় নিজেই হেসে ফেলল আবার।

‘আসলে চোখ খোয়াবার অবস্থা হলে সবারই অমন মনে হতে পারে। তখন ধারণা হয় সমস্ত পৃথিবী ষড়যন্ত্র করছে আমার বিরুদ্ধে!’

সোজা সাপটা ব্যাখ্যা। তবু দীপা মন খুঁতখুঁত করতে লাগল। অমরের কেন মনে হল গাছটা বিদ্বেষভরে ওকে শাস্তি দিয়েছে? একটা গাছ, একটা আয়না, কিছু দুঃস্বপ্ন! এ বাড়িতে এমন কেন হচ্ছে ওদের? কোনো অদৃশ্য শক্তি ওদের জীবন এমন ধন্দ আর আতঙ্কে ভরিয়ে দিচ্ছে? এখন অবধি কারোর বিশেষ ক্ষতি হয়নি। কিন্তু হতে কতক্ষণ! তার স্বপ্নের বাড়ি এমন ভয়ংকর হয়ে উঠছে কেন?

আগ্রাসী গাছটাকে দেখতে দীপা বাইরে গেল। গাছের সঙ্গে মোলাকাতের পরিণাম নিয়ে অমর তখনও হন্তদন্ত হয়ে আছে। চোখের ঠিক ওপরে, কপালে একটা বড়োসড়ো ডিম গজিয়েছে। কাঠের দরজা খুলে কাচের স্টর্মডোরের পেছন থেকে দীপা দেখল গাছটা শান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। দেখে মনে হয় না বীভৎস জিঘাংসা পুষে রেখেছে মনে—বা প্রতিশোধের বশে অমরকে আহত করেছে। সবুজ পাতা ভরতি ডালগুলো এখনও পথের ওপর ছড়িয়ে আছে। গাছের চেহারা দেখে মনে হয় সময়টা বসন্তের প্রারম্ভ, শীতের প্রাক্কাল নয়।

বরফ পড়ে চলেছে—বরং আগের চেয়ে অনেক বেশি জোরে। ঝুরো বরফ জমে মাটি, ঘর, গাছপালা এখন সাদা। সমুদ্রের বুকে ধোঁয়ার চাদর—ঢেউ স্তিমিত। বছরের এই সময়ে অনেক সময় এমনই আচমকা বরফ পড়ে চারদিক ‘উইন্টার ওয়ান্ডারল্যান্ড’ হয়ে ওঠে। এত এলোমেলো চিন্তার মধ্যেও বড়ো সুন্দর লাগল দীপার।

সেই রাগী গাছটার গায়ে এতটুকু বরফ নেই। একটা পাতায় বরফের চিহ্ন নেই। আশেপাশের ঘাস, ঝোপ, বরফে ঢেকে গেলেও গাছটার গায়ে সাদার ছিটেফোঁটা লাগেনি। এমনকী গুঁড়ির চারদিকে গোল করে কোনো বরফ নেই। কী করে এমন হতে পারে? গায়ে গরম জামা না পরে, বাড়ির চটি পায়ে দৌড়ে নেমে গেল দীপা। এমন কী বিশেষত্ব থাকতে পারে গাছটায় যে প্রকৃতির সাধারণ নিয়মের বাইরে যেতে পেরেছে? গাছটা এত রহস্যময় কেন?

গাছের তলায় এসে ওর মনে হল হিটারের গরম হাওয়ায় দাঁড়িয়ে আছে। হতভম্ব দীপা বুঝতে চেষ্টা করল এখানে এমন গরম হল কী করে? মাটির তলায় গরম জলের উৎস আছে কি? বা হয়তো অন্য কোনো ভূতাপীয় কারণ রয়েছে? তার কী করা উচিত এখন?

কিছু একটা সরে গেল গাছের পাতার আড়ালে। গা ছমছম করে উঠল দীপার। ওখানে কে? কে দেখছে ওকে? মানুষ, না…

গাছের তলা থেকে বেরিয়ে কম্পাউন্ডের গেটের দিকে এগিয়ে গেল দীপা। চেঁচিয়ে উঠল,

‘হু, হু ইজ দেয়ার? কে ওখানে?’

ঝোপের আড়াল থেকে বেরিয়ে এলেন একজন বৃদ্ধ শ্বেতাঙ্গী মহিলা। শনের নুড়ির মতো ধবধবে সাদা চুল, একটা সাদা কোট পরা, পায়ে সাদা মিউল জুতো। ফ্যাকাসে মুখের চামড়া কোঁচকানো, ছানির প্রকোপে দু—চোখ ডিমের সাদার মতো ঘোলাটে। কী বলবে বুঝতে পারল না দীপা। উনি কে, এখানে কেন?

‘ইয়েস, হাউ ক্যান আই হেল্প হউ?’

মহিলা অসহায় ভাবে ওর মুখের দিকে তাকালেন। ক্ষীণ স্বরে বললেন,

‘আই অ্যাম ইওর নেবার। ওই বাড়িটাতে থাকি, ডানদিকের তিনটে বাড়ি পেরিয়ে। পারহ্যাপস এ কাপ অফ কফি? তোমার সঙ্গে কিছু কথা বলতে চাই।’

বিকেলে পার্টি। এখন এই মহিলাকে এন্টারটেন করতে হবে? তবু বৃদ্ধাকে ফিরিয়ে দিতে পারল না দীপা। আমন্ত্রণ জানাল,

‘প্লিজ কাম ইন।’

দু—কাপ কফি আর পার্টির জন্যে তোলা কেকের দু—টো টুকরো প্লেটে সাজিয়ে বৃদ্ধাকে ড্রয়িং রুমে বসাল দীপা। বৃদ্ধা কফিতে চুমুক দিলেন, কিন্তু কেক ছুঁলেন না।

‘তোমরা পাড়ায় নতুন এসেছ—ওয়েলকাম। না জানিয়ে তোমার কাছে এলাম, প্লিজ ডোন্ট মাইন্ড।’

মহিলা নিশ্চয়ই ওর অনীহা টের পেয়েছেন। লজ্জা পেয়ে দীপা বলল,

‘নো, নো, অমন ভাববেন না। আই অ্যাম গ্ল্যাড আপনি এসেছেন। এই সুযোগে আমাদের আলাপ হল।’

সামান্য মাথা নাড়িয়ে মহিলা ওর মাপ চাওয়া স্বীকার করলেন।

‘আমি তোমার বেশি সময় নেব না। বাট আই নিড টু টক টু ইউ। আমি যা বলছি তোমার যদি ভালো না লাগে, ভেবে নিও এক বৃদ্ধার প্রলাপ। আমি কিছু মনে করব না।’

ভদ্রমহিলা এত আমড়াগাছি করছেন কেন? দীপার অসোয়াস্তি হল। মহিলার গম্ভীর মুখের দিকে তাকিয়ে ওর বুকে গুড়গুড় বাজনা বাজছে আবার।

‘তোমার মতোই আমি সমুদ্র ভালোবাসি। ওহ, ইয়েস। আমি রোজ হাঁটতে বেরিয়ে দেখি তুমি বারান্দায় বসে জলের দিকে তাকিয়ে আছ। ইউ লুক পিসফুল, তাই আমি কিছু বলিনি। নাহলে আগেই আসতাম। আজ সকালে দেখলাম এ জেন্টলম্যান ওয়াজ অ্যাটেস্পটিং টু প্রুন দ্য ট্রি। তোমার স্বামী?’

মহিলার প্রশ্নের জবাবে দীপা মাথা নাড়ল। মহিলা কী বলবেন তা না জানার পূর্বাভাস দীপার পেটের মধ্যে মুঠো পাকাতে থাকল।

‘প্লিজ, ডোন্ট হেজিটেট। আপনি বলুন, আমি শুনছি।’

‘আমি জানি না তোমার হাজব্যান্ডের কী অভিজ্ঞতা হয়েছে। তাকে বারণ করতে যাচ্ছিলাম কিন্তু তার আগেই উনি পালিয়ে গেলেন। আই হোপ হি ইজ ওকে!’

এই ধীর অগ্রগতি দীপা আর সহ্য করতে পারল না।

‘আপনি বলুন কী বলতে চাইছেন। আই অ্যাম গেটিং অ্যাংশাস!’

মহিলা ঠোঁটে কাপ তুলে আর এক চুমুক কফি খেলেন। আলতো করে ন্যাপকিন ঠোঁটে বুলিয়ে প্রস্তুত হলেন তাঁর বক্তব্য রাখতে।

‘তোমার বাড়ি সম্পর্কে কতটা জান? আমি যতদিন দেখছি, তোমার বাড়ির সামনের ওই গাছটা একইরকম রয়েছে—বাড়েওনি, কমেওনি। আমার বয়স তিরাশি বছর—এখানে এসেছিলাম আঠারো বছর বয়সে, র‌্যান্ডলফকে বিয়ে করে। র‌্যান্ডলফ তখন তেইশ।’

মহিলা কিছুক্ষণের জন্যে চুপ করে রইলেন—বোধহয় প্রয়াত স্বামীর স্মৃতির ভারে। তারপর ঝাড়া দিয়ে উঠলেন আবার।

‘ওই গাছ অনেকেই কাটতে চেষ্টা করেছে—পারেনি। যারা শুধু ডাল কেটে প্রুন করতে গেছে, তাদের ছোটোখাটো দুর্ঘটনা ঘটেছে। যে দু—জন গোড়া থেকে কাটতে গেছিল তারা মারা গেছে। একজন নিজের ইলেকট্রিক করাতে হাত কেটে ফেলল। অ্যাম্বুলেন্স আসার আগেই রক্তক্ষরণে সে মারা যায়। অ্যান্ড আই ন্যু হিম ওয়েল। অন্যজন কুড়ুল তুলতেই হার্ট অ্যাটাক হল। বাড়ির লোকজন তাকে পেল গাছের নীচে—ভয়ার্ত চোখের দৃষ্টি স্থির। সকলে বলেছিল দুটোই কাকতালীয় দুর্ঘটনা। কিন্তু আমি জানি, এর মধ্যে অন্য কিছু আছে। তুমি তো দেখেছ গাছটার কী প্রচণ্ড তাপ। তীব্র শীতেও পাতা ঝরে না, এক বিন্দু বরফ গায়ে লাগে না।’

দীপার গায়ে কাঁটা দিল। তাহলে ও যা প্রত্যক্ষ করেছে তা ভ্রান্তি নয়! মহিলা বলে চললেন,

‘তুমি কি বাড়ির মধ্যে কিছু টের পেয়েছ? এ স্মেল, এ সাউন্ড, এ রিফ্লেকসন?’

দীপার মাথা ঘুরছে। কী করবে এখন? কী ভয়াবহ সংবাদ প্রকাশ করতে চলেছেন এই বৃদ্ধা! ওর মুখের দিকে তাকিয়ে মহিলার বোধহয় দয়া হল।

‘ডোন্ট বি অ্যাফ্রেড। দ্য উওম্যান উইল নট হার্ট ইউ। বাট দ্য ম্যান ইজ আনাদার ম্যাটার।’

এ কী কথা শুনছে মহিলা—কোনো উওম্যান, ম্যানই বা কে! কথা বলতে গিয়ে দীপার গলা থেকে বেলুন চুপসে যাওয়ার মতো শব্দ বেরল।

‘হোয়াট ইজ গোয়িং অন! আমাকে দয়া করে বলুন।’

‘শোন, এ অনেকদিন আগের কথা। আমার ধারণা হয়তো আমার জন্মেরও কয়েকর বছর আগে। কেপ মে ওয়াজ অ্যান অ্যাগ্রিকালচারাল স্মল টাউন। বড়ো ফার্মের মালিক চাষিরা সমুদ্রের এই অর্ধচন্দ্রাকার পাড়ে নিজেদের বসতবাড়ি তৈরি করেছিল সার বেঁধে। ১১৬ বছর আগে তোমাদের বাড়ি বানিয়েছিল তেমনই এক ধনী চাষি। তার বউ ছিল সুন্দরী, আর একটি সন্তান ছিল। তখনকার দিনের নিয়মমাফিক বউটি বাড়িতেই কাজ করত—ছেলে মানুষ করত। এক রাতে কী হল কেউ জানে না, হয়তো সন্দেহ, হয়তো হিংসে, হয়তো স্রেফ ঝগড়া, লোকটা তার বউ—বাচ্চা আর বাড়ির সব কাজের লোককে খুন করে নিজের হাতের শিরা কেটে ওই গাছের নীচে শুয়ে রইল। পরদিন প্রতিবেশীরা তাকে খুঁজে পায়—তখন গাছের তলার মাটি রক্তে ভিজে গেছে।

‘তারপর বহুদিন বাড়িটা খালি পড়েছিল। বাড়ির ওয়ারিশ কে তাই নিয়েই অনেকদিন বিতণ্ডা চলল। পরে এক উত্তরাধিকারী বাড়িটা নিলামে বিক্রি করে দিল। সেই থেকে কোনো লোকই এখানে টিকতে পারেনি। কিছুদিন পরপরই এটা বিক্রি হয়েছে। কী যে তাদের কমপ্লেন, কোনোদিন কেউ ভালো করে বলেনি। এখানে থাকলে তোমরা নিজেরাই সে সব বুঝতে পারবে। বাট আই থট আই শুড ওয়ার্ন ইউ।’

নির্বাক দীপাকে বিদায় জানিয়ে মহিলা চলে গেলেন। কপালে বরফের পুঁটলি ধরে ঘরে ঢুকে অমর বলল,

‘উফ! বুড়ি পারেও বাবা! কি, নিজের ভাইপো বাড়িটা কিনতে চায় তাই এত আষাঢ়ে গপ্পো?’

দীপা তখনও অনড় রয়েছে দেখে বলল,

‘তা তোমার সিদ্ধান্ত কী, বাড়িটা বিক্রি করে দেবে?’

সম্বিত ফিরে অমরের দিকে তাকাল দীপা। তার এত সাধের বাড়ি—এই চওড়া বারান্দা, সমুদ্র— সবকিছু ফেলে তাকে আবার চলে যেতে হবে। বাড়ির সেই মহিলা—সেই চাষি—বউ তো তার কোনো ক্ষতি করেনি, কোনো ভয় দেখায়নি। বরং তার ঘরে সুগন্ধি ছড়িয়েছে—তার কাছেই করুণ সাহায্য চেয়েছে। তার কী দোষ!

‘নাঃ, ছাড়ব কেন! আমরা ভালোই থাকব এখানে। শুধু কথা দিতে হবে তুমি ওই গাছটা কাটার কোনো চেষ্টাই করবে না কোনোদিন। ওটা থাকুক যেমন আছে।’

দীপা ভাবল আরও অনেক প্রতিবন্ধকতা সামনে রয়েছে। এতটুকু থেকে পালালে চলবে কেন!

____

পাদটীকা

*এই গল্পের ঘটনাগুলি নিউ জার্সির জনপ্রিয় লোককথা (folklore) থেকে সংকলিত। কেপ মে শহরের একটি পুরোনো বাড়ি, এখন যেটি ব্যবসায়িক ভিত্তিতে বেড অ্যান্ড ব্রেকফাস্ট হিসেবে ভাড়া দেওয়া হয়, সেখানে একটি বিশেষ ঘরে রাত কাটাতে গিয়ে বহু অতিথি বলেছেন তাঁরা ঘরের আয়নায় এক মহিলার ছায়ামূর্তি দেখেছেন। অনেকে অচেনা সুগন্ধি পেয়েছেন, জামার খসখস শব্দ শুনেছেন। কিন্তু কেউই এই অভিজ্ঞতাকে ভীতিপ্রদ মনে করেননি। এমনকী অনেকে বলেছেন মহিলা তাঁদের দিকে তাকিয়ে মুখ টিপে হেসেছে।

বার্নার্ড টাউনশিপের একটি গাছের উপকথাও (folklore) এখানে যোগ করেছি। ‘শয়তানের গাছ’ (Devil’s Tree) হিসেবে বিখ্যাত এই গাছটি অনেক দুঃখজনক ঘটনার সঙ্গে যুক্ত—আত্মহত্যা, খুন, ফাঁসি। এক চাষি নাকি তার পুরো পরিবারকে খুন করে এই গাছের ডালে গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেছিল। গাছটি দেখতে গিয়ে অনেকে বলেছেন এর বাকল অত্যন্ত উষ্ণ। তাই এই গাছের ডাল, পাতা, এবং গুঁড়ির চারদিকে কখনো বরফ জমে না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *