কেন?
০১.
তিমি-শিকারী দলটাকে পাঁচটি ভাগে বিভক্ত করা হল। হ্যাঁ, ‘তিমি-শিকারীর দল। যুগ্মসচিবের নির্দেশ নিয়ে এফ. বি. আই. চিফের কাছে যখন অনুসন্ধানের আদেশ এল তখন তৈরি হল এই ‘হোয়েলার্স–স্কোয়াড। তিমি-শিকারীরা হারপুন দিয়ে বিঁধে আনবে সেই অতলসঞ্চারী তিমি মাছটিকে–ডেক্সটার! একা ডেক্সটার নয়, ইতিমধ্যে জানা গেছে, আরও দুজন ছোট-মাপের বিশ্বাসঘাতক এই দুষ্কার্যে প্রত্যক্ষ অংশ নিয়েছে। তাদের ছদ্মনাম যথাক্রমে ‘অ্যালেক্স’ আর ‘ডগলাস’। এফ. বি. আই. অনুসন্ধান করে বুঝেছে–ওই তিনজন পৃথক পৃথকভাবে গুপ্তচরবৃত্তিতে অংশ নিয়েছে, তারা সম্ভবত পরস্পরকে চেনে না। মানে স্বনামে হয়তো চেনে–গুপ্তচর হিসাবে ছদ্মনামে চেনে না। আরও জানা গেছে, সর্বনাশের সিংহভাগ দাবী করতে পারে একমাত্র ডেক্সটার একাই। অ্যালেক্স এবং ডগলাস মিলিতভাবে যদি চার-আনা ক্ষতি করে থাকে, তবে ডেক্সটার একাই করেছে বারো আনা।
খুব ধীরে ধীরে অগ্রসর হতে হবে। রাতারাতি রাঘববোয়াল জালে ধরা পড়বে না! প্রথমে চিহ্নিত করতে হবে ওই দুটি চুনোপুঁটিকে : অ্যালেক্স এবং উল্লাস। তাদের স্বীকারোক্তি থেকেই হয়তো পাওয়া যাবে ডেক্সটার-বধের ব্রহ্মাস্ত্র।
যুদ্ধসচিবের নির্দেশ পাওয়ার পর কর্নেল ল্যান্সডেল মূল পরিকল্পনাটা ছকে ফেলেছেন। কর্নেল প্যাশকে নিজের চেম্বারে ডেকে নিয়ে তিনি পরিকল্পনাটা বুঝিয়ে দিলেন
হোয়েলার্স-স্কোয়াডে থাকবে পাঁচটি ইউনিট। পাঁচটি বিভাগের পাঁচজন দলপতি থাকবেন। বিভাগের নামগুলি মূলত দেশ অনুসারে।
হাঙ্গেরিয়ান-য়ুনিট অনুসন্ধান করবেন তিনজন বিজ্ঞানীর বিষয়ে, তারা হলেন ফন নয়ম্যান, ৎজিলাৰ্ড এবং টেলার। এর মধ্যে মূল লক্ষ্য হলেন ৎজিলাৰ্ড। তিনি বরাবর অ্যাটম-বোমা নিক্ষেপের বিরুদ্ধে কাজ করে গিয়েছেন। গোপনীয়তার নির্দেশ অমান্য করে লস-অ্যালামসের বৈজ্ঞানিকদের ভিতর প্রচার-পুস্তিকা বণ্টন করেছেন–বোমা-বিরোধী ফ্রন্ট গঠনে মুখ্য ভূমিকা নিয়েছিলেন।
দ্বিতীয় বিভাগ হচ্ছে রাশিয়ান-য়ুনিট। তার মূল লক্ষ্য ক্রিস্টিয়াকৌস্কি। রোবিনোভিচ অবশ্য বোমা-নিক্ষেপের বিরুদ্ধে দল ও মত গঠনে সক্রিয় অংশ নিয়েছিলেন; কিন্তু গুপ্তচরবৃত্তি যেন তার চরিত্রের সঙ্গে খাপ খায় না। তা হোক–খবরটা পাচার হয়েছে রাশিয়ায়। ফলে দুজন রাশিয়ান বৈজ্ঞানিককেই যাচাই করে দেখতে হবে।
তৃতীয় অনুসন্ধানী দল পরীক্ষা করবে অপর চারজন বৈজ্ঞানিককে। এই দলের কার্যপ্রণালী উপবৃত্তের আকার নেবে। কেন্দ্র একটা নয়; দু-দুটো। উপবৃত্তের এক কেন্দ্র ডি ফাইনম্যান-সেই আপাত-ছেলেমানুষ দুর্ধর্ষ প্রতিভাবান ব্যক্তিটি, এবং দ্বিতীয় কেন্দ্র অটো কার্ল।
চতুর্থ দল যাচাই করবে ভিক্টর ওয়াইস্কফ আর এনরিকো ফের্মিকে। প্রফেসর নীলস বোহরকে তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। তার মতো অন্যমনস্ক মানুষের পক্ষে কোনো ষড়যন্ত্রে অংশ নেওয়া একেবারেই অসম্ভব।
পঞ্চম দলের লক্ষ্য একমাত্র একজন বৈজ্ঞানিক : রবার্ট জে ওপেনহাইমার।
কর্নেল ল্যান্সডেলের বিশ্বাস ‘ডেক্সটার’ একা নয়, অ্যালেক্স এবং ডাসকেও এই পাঁচটি দলের অন্তর্ভুক্ত এই বারোজনের সন্ধানকালেই হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে, হয়তো উপগ্রহ হিসাবে। কর্ণেল প্যাশকে তিনি বললেন, পাঁচটি যুনিটের জন্য পাঁচজন দলপতিকে এখনই নির্বাচিত করতে হবে, এবং তুমি থাকবে এই পাঁচজনের শীর্ষস্থানে, যোগাযোগ-রক্ষাকারী হিসাবে।
কর্নেল প্যাশ জবাবে সবিনয়ে বললেন, স্যার, আপনি যদি অনুমতি করেন তবে আমি একটি বিকল্প প্রস্তাব রাখতে চাই।
–বল।
–আপনি নিজেই এই পাঁচটি দলের শীর্ষস্থানে অধিষ্ঠিত হয়ে হোয়েলার্স-স্কোয়াড’ পরিচালনা করুন। আমি ওই পাঁচটি দলের একটি বিশেষ দলের দলপতি হতে চাই।
-কেন? কোন্ দলের?
–পঞ্চম দলের। আমি ওই ডক্টর ওপেনহাইমারের কেসটার তদন্তভার নিতে চাই।
কর্নেল ল্যান্সডেল নীরবে কিছুক্ষণ ধূমপান করেন। তারপর বলেন, ও. কে.। তাই হোক। এবার বাকি চারটি দলপতি কাকে কাকে করতে চাও বল?
-আমার মনে হয় তৃতীয় দলটিকেও আপনি দুভাগ করুন। তার কারণ প্রফেসর অটো কার্ল শীঘ্রই ইংল্যান্ডে ফিরে যাচ্ছেন, অথচ প্রফেসর ফাইনম্যান কলোম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি নিয়েছেন। একজন গোয়েন্দার পক্ষে পৃথিবীর দু প্রান্তে
-কারেক্ট। তাহলে আমাদের পাঁচজন লোকের প্রয়োজন।
প্রফেসর ফাইনম্যানের পেছনে লেগে থাকবে ম্যাককিলভি–যে ছিল লস অ্যালামসে আমাদের সিকিউরিটি অফিসর। ম্যাককিলভি আমাকে জানিয়েছে যে, ইতিমধ্যেই প্রফেসর ফাইনম্যানের বিরুদ্ধে কিছু গোপন তথ্য সংগ্রহ করেছে। ব্যাপারটা কী তা সে বলেনি, ওর মতে আরও একটু নির্ভরযোগ্য তথ্য সংগৃহীত না হলে সে রিপোর্টটা দিতে পারছে না। ভাবছি, ম্যাককিলভিকে কলোম্বিয়ায় বদলি করে দেব। দ্বিতীয়ত, প্রফেসর অটো কার্ল-এর বিরুদ্ধে নিযুক্ত করতে চাই উইলিয়াম জেমস্ স্কার্ডনকে। ছোকরা আমেরিকান নয়, ব্রিটিশ-বর্তমানে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডে নিযুক্ত আছে। আমার সঙ্গে দীর্ঘদিনের আলাপ। আপনি অনুরোধ জানালে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড স্কার্ডনকে হারওয়েলে বদলি করবে।
–হারওয়েল কোথায়? সেখানে কেন?
–হারওয়েল অক্সফোর্ডের কাছাকাছি একটা আধা-শহর। সেখানে একটা নিউক্লিয়ার ল্যাবরেটরি তৈরি হচ্ছে। পারমাণবিক-শক্তিকে যুদ্ধোত্তরকালে মানবকল্যাণে লাগানো যায় কিনা গ্রেট ব্রিটেন তাই দেখতে চায় হারওয়েলে। প্রফেসর অটো কার্ল সেই প্রকল্পে একটা চাকরি নিয়ে যাচ্ছেন। স্যার জন কক্ৰক্ট-এর অধীনে। ক্লাউস ফুকসও যাচ্ছেন সেখানে।
***
লস অ্যালামসে তখন ভাঙা হাট। শিবির ভাঙার পালা। অথবা বলা যায় ফুলশয্যা-বৌভাত মিটে যাবার পর বিয়েবাড়ির অবস্থা। দেশ-বিদেশ থেকে বরযাত্রীরা এসে জুটেছিল নিমন্ত্রণ পেয়ে। শুভকাজ নির্বিঘ্নে মিটে গেছে। পরের ঘরের মেয়ে এ বাড়িতে নববধূ হয়ে ঘোমটা টেনে বসেছে অন্দরমহনের গোপন একান্তে। এবার বরযাত্রীরা যে যার ডেরায় ফিরে যাবে। বিজ্ঞানীর দল প্রতিদিনই নতুন নতুন চাকরির নিয়োগপত্র পাচ্ছেন। ঘরোয়া বিদায়পর্ব লেগেই আছে। যুদ্ধজয়ের মাত্র দু-মাসের মধ্যে ওপেনহাইমার পদত্যাগ করলেন। কার্যভাব বুঝে নিলেন ব্র্যাডলি। ওপেনহাইমার তখন জাতীয় বীর। প্রথম মাসখানেক অভিনন্দন-সভায় উপস্থিত থাকাই ছিল তার একমাত্র কাজ। টের হাইড্রোজেন-বোমা আবিষ্কারের নতুন প্রকল্প নিয়ে মেতেছেন। ৎজিলাৰ্ড বিরক্ত হয়ে ফিরে এসেছেন এ নারকীয় মারণযজ্ঞ থেকে। অটো কার্ল আর ক্লাউস ফুৰ স্ ফিরে যাচ্ছেন ইংল্যান্ডেহারওয়েল-এ এ পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে, পারমাণবিক-শক্তিকে মানব কল্যাণে ব্যবহার করা যায় কিনা তাই পরীক্ষা করে দেখতে।
মার্কিন কর্মকর্তারা এতদিনে পৃথিবীর ভবিষ্যৎ ভেবে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন। ভুল বললাম, পৃথিবীর নয়, আমেরিকার। রাশিয়ার সঙ্গে একটা চুক্তিবদ্ধ হলে ভালো হয়। ওঁদের বক্তব্য : হে বন্ধু, তোমাদের অ্যাটম-বোমা নেই, আমাদের আছে–তবু বিশ্বশান্তির মুখ চেয়ে আমরা নিজে থেকেই প্রস্তাব তুলছি; এস, একটা ভদ্রলোকের চুক্তি করা যাক–আমরা দুজন কেউ কারও ওপর অ্যাটম-বোমা ঝাড়ব না।
1945 সালে মস্কোতে হল একটি মহাসম্মেলন–চতুঃশক্তির শীর্ষ বৈঠক। ফোর-পাওয়ার কনফারেন্স। অথচ কিমাশ্চর্যমতঃপরম। যাদের এ-বিষয়ে সবচেয়ে উৎসাহিত হবার কথা, তারাই ধামা চাপা দিল প্রস্তাবটা। রাশিয়ার ডেলিগেট মলোটভ বললেন, আপাতত ও আলোচনাটা মুলতুবি থাক। পরবর্তী অধিবেশনে এটা নিয়ে আলোচনা করা যাবে বরং।
আমেরিকা এটা আদৌ প্রত্যাশা করেনি। মলোটভের ঔদাসীন্যের কোনো হেতুই সেদিন বোঝা গেল না।
সেটা বোঝা গেল আরও চার বছর পর। 1949-এর অগাস্ট মাসে একটি মার্কিন বি-29 বিমান কতকগুলি ফটো দাখিল করল। ওয়াশিংটনের বিশেষজ্ঞরা সেই ফটো পরীক্ষা করে বুঝলেন, সাইবেরিয়ার কোনো নির্জন অঞ্চলে রাশিয়ান বিজ্ঞানীরা পরমাণু বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়েছেন। তাই ফটো-প্লেটে রেডিও-অ্যাকটিভিটির দাগ পড়েছে! অর্থাৎ পাল্লা এতদিনে সমান-সমান হয়েছে। এতদিনে বোঝা গেল, পটসড্যামে স্তালিন এবং মস্কো সম্মেলনে মলোটভ কেন অমন ঔদাসীন্য দেখিয়েছিলেন। কিন্তু রাশিয়ায় তো ইউরেনিয়াম নেই। কেমন করে পরমাণু-বোমা বানালো ওরা?
তখন ওরা তা বুঝতে পারেননি। ৎজিলাৰ্ডকে তো বার্জে ঠাট্টা করে একদিন বলেই ছিলেন, ফর্মুলাটা পেলেও রাশিয়া কোনোদিন অ্যাটম বোমা বানাতে পারবে না। তার ভাঁড়ারে ইউরেনিয়াম নেই। আজ এ গ্রন্থ রচনাকালে পৃথিবী অবশ্য জানতে পেরেছে এ ধাঁধার সমাধান। রাশিয়ান জিওলজিস্ট বিখ্যাত পণ্ডিত ভরনাভস্কি মহান নেতা লেনিনের প্রতি শ্রদ্ধা জানাবার অবকাশে এ ধাঁধার সমাধানটা ঘটনাচক্রে জানিয়ে দিয়েছেন আমাদের। ভরনাভস্কি বলেছেন, 1921 সালেই লেনিন তাকে নির্দেশ দিয়েছিলেন রাশিয়ায় প্রত্যেকটি প্রত্যন্ত দেশে যেসব খনিজ সম্পদ আছে তার বিধিবদ্ধ অনুসন্ধান চালাতে। ওঁরা অর্থাৎ ভূতত্ত্ববিদেরা ইউরেনিয়ামের সন্ধান পেয়েছিলেন। বস্তুত লেনিন জীবিত থাকতেই (1870 1924) সোভিয়েত রাশিয়ার পাঁচ-পাঁচটি কেন্দ্রে নিউক্লিয়ার রিসার্চের কাজ শুরু হয়ে যায়। এই চারটি কেন্দ্র হল–লেনিনগ্রাডের রেডিয়াম ইন্সটিটুট এবং ফিজিক্স ইন্সটিটুট আর মক্সোর লেবেডফ ইন্সটিটুট এবং ইন্সটিটুট ফর ফিজিকাল প্রবলেম। পঞ্চম প্রতিষ্ঠানটি ছিল খারখভে অবস্থিত। অটো হানের আবিষ্কারের ঠিক পরেই রাশিয়ার শিক্ষামন্ত্রী–বৈজ্ঞানিক কাফতান-বার্লিনে এসেছিলেন। অটো হানের বিজ্ঞানাগার তিনি খুঁটিয়ে দেখেন এবং অটো হানকে নানান প্রশ্ন করে ব্যাপারটা জেনে নেন। তখনও, সেই 1939-এও, এটাকে গোপন তথ্য বলে কেউ মনে করত না। লেনিনের দূরদর্শিতা, রাশিয়ার মূল-ভূখণ্ডে ইউরেনিয়াম আবিষ্কার, এবং ওদের এতদিনের সাধনার কথা লৌহ-যবনিকার এপারে কেউ জানত না। প্রথম জানল ওই বি-29 প্লেনের রিপোর্ট পেয়ে, সাইবেরিয়ার আকাশে অ্যাটম-বোমা বিস্ফোরণের নিশ্চিত প্রমাণ পাওয়ার পর।
***
কিন্তু সেসব কথা তো অনেক পরের। আগের কথা আগে বলি।
দুসপ্তাহের মধ্যেই কর্নেল প্যাশ এসে রিপোর্ট করল কর্নেল ল্যান্সডেলের কাছে : স্যার, জাল ক্রমশ ছোটো হয়ে আসছে। আপনার নির্দেশ অনুযায়ী পাঁচ-পাঁচটি টিমই কাজে লেগে গিয়েছে; কিন্তু আমার দৃঢ় ধারণা হচ্ছে তিনজনের মধ্যেই মূল অপরাধীকে খুঁজে পাওয়া যাবে।
-কোন তিনজন?
–ডিক ফাইনম্যান, ওপেনহাইমার অথবা অটো কার্ল।
কর্নেল ল্যান্সডেল বলেন, ফাইনম্যান আর ওপেনহাইমার সম্বন্ধে সন্দেহ করার যথেষ্ট কারণ আছে। ওঁদের দুজনের মধ্যে একজন যদি ডেক্সটার হন আমি বিস্মিত হব না। কিন্তু আমার এক মাসের বেতন এক বোতল হুইস্কির বিনিময়ে তোমার সঙ্গে বাজি রাখতে রাজি আছি, অটো কার্ল এর ভেতর নেই।
কৌতুক উপচে পড়ল প্যাশের দু-চোখে। বলল, স্যার, আপনার গোটা মাসের মাইনেটা এভাবে হাতিয়ে নিতে আমার বিবেকে বাধছে। যা হোক, এত বড় কথাটা কেন বললেন?
–অটো কার্ল-এর ‘অ্যালেবাই’টা আমি যাচাই করে দেখেছি। নিখুঁত, নীর। পাঁচই অগাস্ট প্রফেসর কার্ল সান্তা ফে থেকে প্লেনে চড়েন। ছয়ই সমস্তটা দিন তিনি ছিলেন নিউইয়র্কে। ছয়ই তারিখ সন্ধ্যায় তিনি স্বয়ং জেনারেল গ্রোভসসের সঙ্গে কথা বলছিলেন।
–সো হোয়াট?
-কী আশ্চর্য। তুমি ভুলে গেছ প্যাশডেক্সটার ছয়ই অগাস্ট রাত্রে সান্তা ফে-র একটা আসবাগারে মাইক্রোফিল্মটি হস্তান্তরিত করে। যেহেতু ওই সময়ে প্রফেসর কার্ল সান্তা ফে থেকে কয়েক হাজার মাইল দূরে ওয়াশিংটনে ছিলেন তার অকাট্য প্রমাণ রয়েছে–
বাধা দিয়ে প্যাশ বলে, স্যার! ও ‘অ্যালেবাই’টা আমিও যাচাই করে দেখেছি। শুধু তাই নয়, প্রফেসর কার্লের হঠাৎ ওয়াশিংটনে আসার কোনো জোরালো যুক্তি আমি খুঁজে পাইনি–একমাত্র যুক্তি ওই ‘অ্যালেবাই’ প্রতিষ্ঠা করা। তা থেকেই আমার মনে হয়েছে
কর্নেল ল্যান্সডেল বাধা দিয়ে বলেন, তুমি পাগল না আমি পাগল বুঝে উঠতে পারছি না। কার্ল কেমন করে একই সময়ে কয়েক হাজার মাইল দূরত্বে….
–তাহলে আমার ইনভেস্টিগেশন রিপোর্টটা বিস্তারিত শুনুন
ধুরন্ধর গোয়েন্দা কর্নেল প্যাশ। প্রতিটি পদক্ষেপ তার নিখুঁত। ছয়ই অগাস্ট কার কার ‘অ্যালেবাই’ আছে প্রথমেই সে সেটা যাচাই করে দেখে নেয়। ফাইনম্যানের। নেই, ওপেনহাইমারের নেই, ৎজিলার্ডের নেই। আছে যাদের তারা হলেন–ফন নয়ম্যান, ম্যাক্স বর্ন, ক্লাউস ফুকস, অটো কার্ল প্রভৃতির। নয়ম্যান লস অ্যালামসে ছিলেন, ম্যাক্স বর্ন রুদ্ধদ্বার কক্ষে সস্ত্রীক উপস্থিত ছিলেন, ক্লাউস ফুকস্ এদিন রাত্রে সবাইকে প্রচুর মদ এনে খাওয়ায়। মদের আসরে অধিকাংশই অংশগ্রহণ করেন। একমাত্র ৎজিলাৰ্ড ও ফাইনম্যান জাপানে বোমাবর্ষণের জন্য কোনো আনন্দ উৎসবে যোগ দিতে অস্বীকার করেন। তারা দুজনে ভোজনাগার ছেড়ে চলে যান। বাকি রাত তারা কোথায় কাটান তা কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারে না। আর অটো কার্ল আগের দিন থেকে ওয়াশিংটনে ছিলেন।
ফলে অ্যালেবাই-এর হিসাব অনুসারে তিনটি নাম লিপিবদ্ধ হল প্যাশ-এর ডায়েরিতে। ফাইনম্যান, ওপেনহাইমার এবং ৎজিলাৰ্ড।
***
দ্বিতীয় পর্যায়ের অনুসন্ধান প্যাশ শুরু করে অন্যদিক থেকে। ফটো তোলার। বাতিক কার আছে। মাইক্রোফিল্ম তৈরি করবার মতো উপযুক্ত যন্ত্র কার কাছে থাকতে পারে? এই সূত্র ধরে একটা অদ্ভুত তথ্য পেয়ে গেলো। ওর প্রথমেই মনে হল, লস অ্যালামসে ফটো-ডিলার কে কে খোঁজ করতে হবে। তার কাছেই সন্ধান পাওয়া যাবে কে কে তার গ্রাহক, ফটোগ্রাফির বাতিক আছে কার কার। কথাপ্রসঙ্গে সে ক্লাউস ফুকসকে প্রশ্ন করল, ‘আই সে ডক্টর, লস অ্যালামসে কোনো ফটোগ্রাফারের দোকান আছে? কিছু ফটো তুলেছি, ডেভেলপ করতে দিতাম।
ক্লাউস ফুকস্ জবাবে বলেন, লস অ্যালামসে কোনো ফটোগ্রাফার নেই। সান্তা ফে-তে পাবেন। তবে তাড়াতাড়ি থাকলে আপনি প্রফেসর কার্ল-এর দ্বারস্থ হতে পারেন। ওঁর ফটোগ্রাফিতে ভীষণ ঝোঁক। নিজস্ব ডার্করুম আছে : সব কিছু নিজ হাতে করেন।
প্যাশ নির্বিকারভাবে বললে, না, শৌখিন ফটোগ্রাফার দিয়ে চলবে না। আমি যেটা ডেভেলপ করাতে চাই তা হচ্ছে মাইক্রোফিল্ম।
হা, হা তার ব্যবস্থাও আছে। প্রফেসর কার্ল ছাত্রজীবন থেকেই ওই মাইক্রোফিলম ব্যবহার করছেন। লাইব্রেরিতে বসে উনি নাকি কখনও লঙহ্যান্ডে নোট নেননি। পটাপট ছবি তুলে নিয়ে চলে আসতেন।
এবারও নির্বিকার ভাবে প্যাশ বলে, তাই নাকি। তবে তো ভালই। ওঁর কাছেই যাই
–কিন্তু প্রফেসর বোধ হয় কাল সানফ্রান্সিস্কো গেছেন। দাঁড়ান, জেনে নেই
ফুকস্ একটি ফোন করলেন। ও প্রান্তে ধরলেন ফ্রাউ কার্ল। শোনা গেল, ফুকসের অনুমানই সত্য। প্রফেসর তার ডেরায় নেই।
প্যাশ বলে–এখানে আর কেউ নেই যে ওঁর ডার্করুমটা ব্যবহার করে এটা ডেভেলপ করে দিতে পারে? আপনি পারেন?
–সর্বনাশ! আমি ফটোগ্রাফির কিছুই জানি না। আমার ক্যামেরাই নেই। আর তাছাড়া তেমন ফটোগ্রাফি-বিশারদ পেলেও কাজ হবে না। আমি নিশ্চিত জানি, প্রফেসর ওঁর ডার্করুম তালাবন্ধ করে গিয়েছেন। কাউকে ব্যবহার করতে দেন না সেটা। ওই ডার্করুমটা ওঁর প্রাণ। কাউকে ঢুকতেই দেন না সে ঘরে।
কর্নেল প্যাশ তখন মনে মনে দুইয়ে-দুইয়ে-চার করছে। অটো কার্ল জার্মান। তার ইংরেজি উচ্চারণ বিদেশির মতো। তিনি মাইক্রোফিল্ম তৈরি করতে পারেন। যন্ত্র নিজস্ব। ডেভেলপ করেন নিজে। ডার্করুমটা তার প্রাণ। কাউকে ঢুকতে দেন না। বাড়ির বাইরে গেলে সেটা তালাবন্ধ থাকে।
ফুকস্ আন্দাজ করতে পারে না, প্যাশের মনে তখন ঝড় উঠেছে। সে তখনও খোশগল্প চালায়। বলে, অদ্ভুত ফটো-তোলার হাত ভদ্রলোকের। বিশেষ করে ট্রিক-ফটোগ্রাফি। আমি তো ওঁর সহকারী হিসাবে পাঁচ বছর কাজ করছি, দেখেছি কী চমৎকার…আচ্ছা দাঁড়ান, ওঁর তোলা একটি ট্রিক-ফটোগ্রাফ আপনাকে দেখাই
আলমারি খুলে একটি ফটো বার করে আনে। পোস্টকার্ড সাইজ। ছবির ক্যাপশন, ‘হোয়েন কার্ল কনগ্রাচুলেটস কার্ল’। প্রফেসর কার্ল এটা ফুকসকে উপহার দিয়েছিলেন।
আশ্চর্য ছবিটা। প্রফেসর কার্ল নিজেই নিজের করমর্দন করছেন। অর্থাৎ দুপাশেই অটো কার্ল। ফুকস্ বললে, কী একটা পরীক্ষা সাফল্যমণ্ডিত হওয়ায় কার্ল নাকি এই ফটোটা তোলেন। তিনি নিজেই নিজেকে অভিনন্দন জানাচ্ছেন। আমি তো আজও ভেবে পাই না, কেমন করে এটা ভোলা গেল–
–সুপার-ইম্পোজিশন! দু দিকে দাঁড়িয়ে দুখানা সেলফ-ফটো নিয়েছিলেন প্রথমে, তারপর প্রিন্ট করার সময়–জাস্ট এ মিনিট…
মাঝপথেই থেমে যায় প্যাশ। পকেট থেকে ম্যাগনিফাইং গ্লাসটা বার করে গভীর অভিনিবেশের সঙ্গে দু-তিন মিনিট পরীক্ষা করে ছবিটা। তারপর বলে, আশ্চর্য!
–আশ্চর্য নয়?
–না, সেজন্য নয়। আমি যে ব্যাখ্যা দিচ্ছিলাম তা ঠিক নয়। এ ছবি ‘সুপার-ইম্পোজিশন’ নয়। মানে দুবার ফটো তুলে একটি প্রিন্ট বানানো হয়নি। একবারই স্ন্যাপ হয়েছে।
-কেমন করে বুঝলেন?
প্যাশ হেসে বলেন, ডক্টর! এটা নিউক্লিয়ার ফিজিক্স নয়। কেমন করে আপনাকে বোঝাবো? ফটোগ্রাফি হচ্ছে ক্রিমিনোলজির একটি বিশেষ শাখা। এই গ্রেনগুলো লক্ষ্য করুন…ওয়েল, এককথায় এটা সুপার-ইম্পোজিশন আদৌ নয়।
–কী জানি মশাই, আমি ওসব বুঝি না।
একটু ইতস্তত করে প্যাশ বলে, আচ্ছা ফ্রাউ কার্লকে আপনি চেনেন?
–ঘনিষ্ঠভাবে। প্রফেসর কার্লের সহকারী হিসাবেই শুধু নয়, তার বিবাহ যুগ থেকে। কেন?
–আপনি ওঁকে আর একবার ফোন করুন। আমি ওঁর সঙ্গে দেখা করতে যাব। আপনিও আসুন না? অসুবিধা আছে?
-কিছু না। ফ্রাউ কার্ল আমার বান্ধবী পর্যায়ের। তার সান্নিধ্যে আধঘণ্টা সময় কাটাতে পারলে খুশিই হব আমি।
***
ফ্রাউ কার্ল অতি সুন্দরী। বয়স বছর ত্রিশেক। প্রফেসর কার্ল-এর চেয়ে অন্তত কুড়ি বছরের ছোটো। নিষ্ঠাবতী ক্রিশ্চান। কোয়েকার। জন্ম ভিয়েনায়-বাল্যকাল কেটেছে জার্মানিতে। ক্লাউস ফুকস-এর পিতা ডক্টর প্যাস্টর ফুকসের মন্ত্রশিষ্যা। ক্লাউস ফুকস-এর পিতৃদেব প্যাস্টর ফুকস্ ছিলেন তার আমলে একজন বিখ্যাত জার্মান কোয়েকার। বিশ্বভ্রাতৃত্বের পূজারী। নাৎসিদের হাতে নিগৃহীত হয়েছিলেন–জেল খেটেছেন, কিন্তু জার্মানি ত্যাগ করে যেতে অস্বীকার করেন। ফ্রাই রোনাটা কার্ল তার আদর্শে এই বিশ্বভ্রাতৃত্বে অনুপ্রাণিত, সেই সূত্রেই ক্লাউস ফুকস-এর সঙ্গে তার আলাপ। ছিপছিপে একহারা চেহারা, সাদা ধপধপে প্ল্যাটিনাম ব্লন্ড চুলের গোছা লুটিয়ে পড়েছে কাঁধের ওপর, যৌবন অটুট। এক সন্তানের জননী। সন্তানটি মারা গিয়েছে, অথচ দেখলে মনে হয় অবিবাহিতা তরুণী।
ওদের সমাদর করে বসালেন ফ্রাউ কার্ল। শ্যাম্পেন বার করে আনলেন। ফুকে ধমক দিলেন, আজকাল তো এ পাড়া মাড়াতেই দেখি না।
আর এ পাড়ায় আসব কী করতে? দরকার ছিল প্রফেসরের সঙ্গে অ্যাটম-বোমার জন্য। সে দরকার তো মিটেই গেছে।
–ও! অর্থাৎ আমার সঙ্গে তোমার কোনো সম্পর্ক নেই। কেমন তো? অকৃতজ্ঞ কোথাকার! একদিন তোমার বিছানা সাফা করা থেকে ঘরদোর পরিষ্কার করা সবকিছু আমাকে দিয়ে করাওনি?
নিশ্চয়ই না। তুমি নিজের গরজে ওগুলো করতে।
–নিজের গরজ! কী গরজ ছিল আমার?
–তোমার ফিগার ঠিক রাখতে।
প্যাশ বাধা দিয়ে বলে ওঠে–প্লিজ, মিসেস কার্ল। তৃতীয় ব্যক্তির সামনে এভাবে হাটে হাঁড়ি ভাঙবেন না।
রাঙিয়ে ওঠে রোনাটা। হাত দিয়ে মাথার চুলগুলো পিছনে সরিয়ে দিতে দিতে বলে, আপনি যা ভাবছেন মোটেই তা নয়। ক্লাউস যখন নাৎসিদের লাথি খেয়ে ইংল্যান্ডে পালিয়ে এল তখন প্রথমে আমাদের বাড়িতেই আশ্রয় পায়। ছেঁড়া পালুন, জুতোয় তাপ্লিমারা-নেহাৎ দয়াপরবশ হয়ে আমি তখন আমার পকেট-মানি থেকে
হঠাৎ নিজেই কী ভেবে থেমে পড়ে।
ফুকস্ বলে, কেন মিছে কথা বলছ রোনাটা? সত্যি কথাটা চেপে যাবার চেষ্টা করে লাভ নেই। কর্নেল প্যাশ জাত-গোয়েন্দা। ঠিকই আন্দাজ করছে সে।
-কী সত্যি কথা?–গর্জে ওঠে রোনাটা।
–সে সময় তুমি আমার প্রেমে পড়ে গিয়েছিলে!
রোনাটা হয়তো মেরেই বসত ফুকসকে। বাধা দিল প্যাশ। বললে, মিসেস কার্ল, আপনি কি ফাইনম্যানের সেই বিখ্যাত তানকাটা শুনেছেন, ডক্টর ফুকসের ওপর।
–’তানকা’ কাকে বলে?
–জাপানি কবিতা–তিন-চার লাইনের। প্রফেসর ফাইনম্যান মুখে মুখে অমন কবিতা-রচনায় সিদ্ধহস্ত। উনি ডক্টর ফুকস্ সম্বন্ধে বলেছেন :
“Fuchs…Looks…An ascetic… Theoretic.” অর্থাৎ ফুকসকে দেখলে মনে হয় ভালো মানুষ। আসলে ডক্টর ফুকস্..পাদপূরণ করে রোনাটা নিজেই–পাজির পা-ঝাড়া! অকৃতজ্ঞ! শয়তান!
ফুকস উঠে দাঁড়ায়। আভূমি নত হয়ে ‘বাও’ করে : থ্যাংকস ফর দ্য কমপ্লিমেন্টস্।
কাজের কথায় আসে প্যাশ। বলে, মিসেস কার্ল, আপনার দ্বারস্থ হয়েছি একটা বিশেষ কৌতূহল মেটাতে। এই ফটোখানি প্রফেসর কার্ল উপহার দিয়েছিলেন ডক্টর ফুককে। এটা তিনি কেমন করে তুলেছেন জানেন?
ফটোখানি হাতে নিয়ে রোনাটা হাসে। বলে, আপনিই বলুন না?
আমি প্রথমে ভেবেছিলাম–ট্রিক ফটোগ্রাফি। দুটো নেগেটিভ সুপার-ইম্পোজ করা। কিন্তু পরে পরীক্ষা করে দেখলাম, তা নয়। আপনি কিছু জানেন?
-জানি। আপনি যে অনবদ্য তানকাটা এই মাত্র শুনিয়েছেন, তার প্রতিদান হিসাবে এ গোপন রহস্যটা আপনার কাছে ফাঁস করে দেব। কেবল একটি শর্তে–প্রফেসরকে বলবেন না। এই ফটোখানা দেখিয়ে সে অনেককে তাক লাগিয়ে দিয়েছে।
বেশ বলব না, এবার বলুন।
এ ছবি একবার মাত্র এক্সপোজ করে তোলা হয়েছে। কোনো ফটোগ্রাফিক ট্রিক এর মধ্যে নেই। এ-পাশে অটো কার্ল, ও-পাশে হান্স কার্ল।
–হ্যান্স কার্ল! তিনি কে?
প্রফেসর কার্ল-এর যমজ ভাই। মস্কোতে আছেন। তিনিও ফিজিসিস্ট।
অনেক কষ্টে কর্নেল প্যাশ তার অভিব্যক্তি গোপন রাখল। কী আশ্চর্য! কী অপরিসীম আশ্চর্য! প্রফেসর অটো কার্লের এক যমজ ভাই আছে, যে নিজেও পদার্থবিজ্ঞানী, সেও নিউক্লিয়ার ফিজিসিস্ট এবং মস্কোতে থাকে।
সেদিনই প্রফেসর অটো কার্ল-এর ব্যক্তিগত ফাইলটা প্যাশ আবার হাতড়ে দেখল। হ্যাঁ, ‘কোশ্চেনেয়ারে’ প্রফেসর কার্ল লিখেছেন, তার একটি ভাই আছে। সে বিজ্ঞানী। মস্কোর লেবেডফ ইন্সটিটুটে গবেষণা করছে। তার বয়স যা উল্লেখ করা হয়েছে তা প্রফেসর অটো কার্ল-এর সঙ্গে হুবহু এক। অর্থাৎ একটু অঙ্ক কষলেই এফ. বি. আই. বুঝতে পারত–ওই হান্স কার্ল হচ্ছেন অটো কার্লের যমজ ভাই। এতদিন সে অঙ্কটা কেউ কষে দেখেনি। কিন্তু সেকথা স্পষ্টাক্ষরে স্বীকার করা নেই।
…কাহিনিটা শেষ করে প্যাশ কর্নেল ল্যান্সডেলকে বললে, এবার বলুন স্যার, আপনার একমাসের মাইনে বাজি ধরবেন?
কর্নেল ল্যান্সডেল শুধু বললেন, স্ট্রেনজ!
–অর্থাৎ ওই হান্স কার্ল যদি কোনো ডিপ্লোম্যাটিক পাসপোর্ট নিয়ে আমেরিকায় এসে থাকে, এবং প্রফেসর অটো কার্ল-এর আইডেন্টিটি ডিস্ক-এর একটা নকল তাকে রাশিয়ান গুপ্তচরেরা দিয়ে থাকে তাহলে অনায়াসে লস অ্যালামসের প্রতিটি কেন্দ্রে হয়তো সে প্রবেশ করেছে। অপর পক্ষে ছয়ই অগাস্ট ওয়াশিংটনে গ্রোভসের ঘরে যে লোকটা অল্পসময়ের জন্য হাজিরা দেয় সে যদি হান্স কার্ল হয়, তাহলে প্রফেসার অটো কার্ল অ্যালেবাই সম্বন্ধে নিশ্চিন্ত হয়ে সান্তা ফে-তে গিয়ে মাইক্রোফিটা হস্তান্তরিত করতে পারেন।
–আই সি।বললেন সংক্ষেপে কর্নেল ল্যান্সডেল।
.
০২.
‘অ্যালেক’ ধরা পড়ল 1946-এর তেসরা মার্চ।
তার মাসতিনেক পরে স্যার জন, প্রফেসর কার্ল আর ডক্টর ফুকস চলে গেলেন হারওয়েলে।
অ্যালেকের প্রকৃত নাম ডক্টর এ্যালেন নান মে। ইংরেজ। যুদ্ধের প্রথম দিকে এসেছিল কানাডায়। সেখান থেকে শিকাগোতে। সে যে খবর পাঠিয়েছিল তা সামান্যই। প্রথমত বোমাটা ইউ-235 এর; দ্বিতীয়ত সে সময় ম্যাগনেটিক সেপারেশনে দৈনিক চারশ গ্রাম ইউ-235 পাওয়া যাচ্ছিল। এ ছাড়া 162 মাইক্রোগ্রাম পরিমাণ ইউ-235 সে ল্যাবরেটরি থেকে পাচার করে এবং রাশিয়ান গুপ্তচরের হাতে সমর্পণ করে। এই তার অপরাধ।
লন্ডনের ওল্ড বেইলি কোর্টে তার বিচার হয়। সংক্ষিপ্ত বিচার। নান দোষ স্বীকার করে। দশবছরের সশ্রম কারাদণ্ড হয়ে যায় তার।
অ্যালেন নান-এর জবানবন্দী থেকে ডেক্সটার অথবা ডগলাস সম্বন্ধে কোনো তথ্যই জানা গেল না। বস্তুত সে ওই দুজনের সঙ্গে কোনো সময়েই যোগাযোগ করেনি।
ইতিমধ্যে অন্যান্য সূত্র থেকে এটুকু বোঝা গেছে, ডগলাস মধ্য-য়ুরোপের লোক। আমেরিকান বা ইংরেজ নয়। প্যাশ-এর ধারণা ডগলাস এবং ডেক্সটার একযোগে কাজ করেছে। তারা পরস্পরকে চেনে। এ-ক্ষেত্রে তারা নিশ্চয়ই সেই যোগসূত্রটুকু বজায় রেখে চলেছে। এখন দুজনেই দুজনের মৃত্যুবাণ। একজন ধরা পড়লেই অপরজন বেশি করে বিপদগ্রস্ত হবে। এই যুক্তি অনুসারে কর্নেল প্যাশ তীক্ষ্ণ নজর রাখবার ব্যবস্থা করল সম্ভাব্য ডেক্সটারদের ওপর–অর্থাৎ ফাইনম্যান, অটো কার্ল এবং ওপেনহাইমারের সঙ্গে কে কে দেখা করতে আসছে। হারওয়েল থেকে এই সূত্রে তাকে স্কার্ডন জানালো একজনের নাম–ব্রুনো পন্টিকার্ভো। সংক্ষেপে ব্রুনো অথবা পন্টি। জাতে ইটালিয়ান। এনরিকো ফের্মির ছাত্র, কিছুদিন জোলিও-কুরির বিজ্ঞানাগারেও রেডিও অ্যাকটিভিটির ওপর কাজ করেছে। পরে পালিয়ে আসে কানাডায়। ‘চক-রিভার’-প্রকল্পে যুক্ত ছিল। পরমাণু-বোমার বিষয়ে অনেক কিছু জেনেছে সে। যুদ্ধান্তে ফিরে গেছে ইংল্যান্ডে। হারওয়েলে চাকরির ধান্দায় আছে। তাকে প্রায়ই দেখা যাচ্ছে অটো কার্লের বাড়িতে। মনে হয়, দুজনের দীর্ঘদিনের জানাশোনা। প্রফেসর অটো কার্ল বর্তমানে হারওয়েল ইনস্টিটুটের দু-নম্বর কর্ণধার। প্রধান কর্মকর্তা হচ্ছেন ডিরেক্টর স্যার জন ককট। ব্রিটিশ ডেলিগেশানের কর্ণধাররূপে মানহাটান প্রকল্পে যুক্ত ছিলেন যুদ্ধের সময়। তার অধীনে আছেন প্রফেসর কার্ল। তিন নম্বর চেয়ারে বসেছেন ডক্টর ক্লাউস ফুকস্। শোনা গেল, প্রফেসর কার্ল নাকি ভিতরে ভিতরে আপ্রাণ চেষ্টা করছেন যাতে ব্রুনো একটা চাকরি পেয়ে যায় ওখানে। কেন?
হারওয়েল-এ প্রথম আবির্ভাবের দিনটির কথা কোনোদিন ভুলবে না রোনাটা। জুন 1946। রৌদ্রকরোজ্জ্বল সুন্দর একটি প্রভাত। অক্সফোর্ড থেকে একটি ট্যাক্সি নিয়ে প্রথম এল ওরা। ওরা তিনজন। প্রফেসর অটো কার্ল, তার স্ত্রী রোনাটা আর ক্লাউস ফুকস্। তার মাসতিনেক আগে আমেরিকা থেকে ফিরে এসেছেন স্যার জন–হারওয়েলের ডিরেক্টার। মালপত্র তখনও এসে পৌঁছায়নি। লন্ডন থেকে ট্রেনে চেপে এসেছিল অক্সফোর্ড। সেখান থেকে ট্যাক্সি নিয়ে হারওয়েল।
রোদ ঝলমল সবুজ-প্রান্তরের মাঝখান দিয়ে কুমারী মেয়ের সিঁথির মতো পড়ে আছে সড়কটা। মাঝে মাঝে খামারবাড়ি-যব আর বার্লির ক্ষেত। পাতা-ঝরার দিন শুরু হয়নি, রৌদ্রে ঝলমল করছে সবুজ সতেজ পপলার আর এম গাছের সারি। বিসর্পিল পথে গাড়ি চলেছে। কেউ কোনো কথা বলছে না। নীরবে উপভোগ করছে এই প্রথম আবির্ভাব মুহূর্তটি; আর নতুন যুগে, নতুন পৃথিবীতে নতুন করে বাঁচার প্রভাতী সুর।
হঠাৎ দূর থেকে দেখা গেল পুরানো হারওয়েল গ্রাম। খড়, টালি আর স্লেটের ছাদ। যেন সারি সারি খেলাঘর। চিমনি দিয়ে কুণ্ডলী পাকিয়ে ধোঁয়া উঠছে। গ্রাম্য কুকুরগুলো এখনও বোধ হয় মোটর-কারে অভ্যস্ত হয়নি। তারস্বরে প্রতিবাদ জানাচ্ছে তারা। হঠাৎ রোনাটার নজরে পড়ল একটা উঁচু টিলা। তার মাথায় একটা ছোটো বাংলোর মতো মনে হচ্ছে।
-ওটা কী?–কৌতূহলী রোনাটা প্রশ্ন করে।
নিউক্লিয়ার-ফিজিক্স-এর দুই পণ্ডিত শ্রাগ করলেন। অজ্ঞতা প্রকাশ করা ছাড়া উপায় কী? জবাব দিল ক্যাব-ড্রাইভার। বললে, ম্যাডাম, ওটা হচ্ছে ‘হোয়াইট-হর্স অফ উফিংটন। এখানেই একদিন সেন্ট জর্জ সেই ড্রাগনটাকে বধ করেছিলেন। আজ সেই সেন্ট জর্জও নেই, ড্রাগনও নেই–পড়ে আছে শুধু সাদা ঘোড়াটা।
–সাদা ঘোড়াটা! বল কী! এতদিন ধরে আছে?
–আছে ম্যাডাম। বিশ্বাস না করেন তো দেখে আসুন। আমি না হয় আধঘন্টা অপেক্ষা করছি। কারবুরেটারটাও গণ্ডগোল করছে। এই ফাঁকে দেখে নিই।
রোনাটা তো তৎক্ষণাৎ একপায়ে খাড়া। নিষ্ঠাবতী খ্রিস্টান সে। বাইবেল তার কণ্ঠস্থ। সেন্ট জর্জ এখানেই সেই ড্রাগনটাকে বধ করেছিলেন শুনে রোমাঞ্চ হয়েছে তার। গাড়ি থামতেই সে নেমে পড়ে। বলে, এস তোমরা।
বৃদ্ধ প্রফেসর কার্ল বলেন, ওহ মাই! আমাকে মাপ কর ডার্লিং। আমি অত্যন্ত ক্লান্ত।
তবে তুমিই এস–রোনাটা ডাক দেয় ক্লাউসকে।
ক্লাউস ইতস্তত করে। প্রফেসর কালই তাকে উৎসাহ জোগান-যাও, দেখে এস। আমি বরং এখানেই আছি। একটু পায়চারি করি ততক্ষণে।
পায়ে পায়ে ওরা দুজন এগিয়ে চলে। রোনাটা আর ক্লাউস। বিসর্পিল পথে পাকদণ্ডীর একটা মোড় ঘুরেই রোনাটা বলে, তুমি অত মুখ গোমড়া করে আছ কেন বলতো ক্লাউস? জোর করে ধরে আনলাম বলে?
জোর করে মানে? আমি তো স্বেচ্ছায় এ চাকরি নিয়েছি। তোমার উপরোধ পড়ে মোটেই নয়।
-জানি। আমার উপরোধে পড়ে তুমি কবে কোন্ কাজটা করেছ?
মনে মনে কাঁটা হয়ে ওঠে ক্লাউস। এই প্রসঙ্গটিকে সে সবচেয়ে ডরায়। সে কিছুতেই ভুলতে পারে না সাত-আট বছর আগেকার একটা ঘটনা–চিরাচরিত রীতি লঙ্ঘন করে কুমারী রোনাটাই একদিন প্রস্তাব তুলেছিলক্লাউস ফুকসকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল তার জীবনের ভোগে। ক্লাউস নিজেই সে প্রস্তাবটা প্রত্যাখ্যান করেছিল সেদিন। তাই প্রসঙ্গটা ঘোরাবার জন্য তাড়াতাড়ি বলে ওঠে, সেন্ট জর্জ আর ড্রাগনের ব্যপারটা কী?
পথের মাঝখানেই থমকে পড়ে রোনাটা। প্রতিপ্রশ্ন করে, তুমি কি খ্রিস্টান?
–আমার বাবা তো বটেই!
–বাবার কথা তুলো না! তার নাম উচ্চারণ করারও যোগ্য নও তুমি।
–কী মুশকিল। আমার বাবার নাম আমি বলব না?
–না বলবে না। যে সেন্ট জর্জের নাম শোনেনি—
টিলার মাথায় সত্যই ছিল একটা অদ্ভুত জিনিস। প্রায় দু-হাজার বছরের প্রাচীন ছবি। পাথরের গায়ে খোদাই করে আঁকা-ঘোড়া একটা। সাদা চকের পাহাড়, তাই ওটা সাদা ঘোড়া। কিংবদন্তির সেন্ট জর্জ নাকি সাদা ঘোড়ায় চড়ে গিয়েছিলেন ড্রাগনকে বধ করে বন্দিনী ‘ড্যামসেল-ইন-ডিস্ট্রেস’কে উদ্ধার করে আনতে। বিগত যুগের ওই শিল্পকর্মটি দেখতে দূর-দূরান্ত থেকে যাত্রীরা আসে হারওয়েলে।
টিলার ওপর থেকে দেখা গেল ট্যাক্সিটা। খেলাঘরের গাড়ি যেন। প্রফেসর কার্ল পায়চারি করছেন; আর বনেট খুলে ক্যাব-ড্রাইভার হুমড়ি খেয়ে পড়েছে ইঞ্জিনের ওপর।
পাকদণ্ডী পথে ফেরার সময় রোনাটা বললে, আচ্ছা ক্লাউস, ধর আমি যদি একদিন ওইরকম বন্দিনী হয়ে পড়ি–তুমি অমন সাদা ঘোড়ায় চেপে আমাকে উদ্ধার করতে আসবে।
হঠাৎ আকাশ-ফাটানো অট্টহাস্য করে ওঠে ক্লাউস। বলে, কী পাগল তুমি, রোনাটা! এযুগে কি ড্রাগন পাওয়া যায় পথে-ঘাটে?
রোনাটা অপ্রস্তুত হল না মোটেই। বললে, কেন পাওয়া যাবে না? হয়তো তার চেহারাটা পালটেছে–তাই সহজে চেনা যায় না; কিন্তু ড্রাগন আছে বইকি আজও।
ওর কথার মধ্যে কী যেন একটা বেদনার সুর ছিল। চমকে উঠল ক্লাউস।
***
হারওয়েল জায়গাটাকে কিন্তু ভালো লেগে গেল ক্লাউস ফুকস-এর। শুধু জায়গাটাই নয়, গোটা প্রকল্পটা। আলাদিনের আশ্চর্য-প্রদীপ থেকে ওঁরা বার করেছেন একটা দৈত্যকে–কিন্তু তাকে দেওয়া হল শুধুমাত্র ধ্বংসের আদেশ। এ ঠিক হয়নি–এজন্য এ গুপ্তধনের সন্ধানে প্রাণপাত করেননি-রাদারফোর্ড-কুরি দম্পতি-চ্যাডউইক-ফের্মি আর অটো হান। হ্যাঁ, ফুকস্ স্বীকার করে, প্রথম সাফল্যে সে নিজেই আনন্দে আত্মহারা হয়ে মদ কিনতে ছুটেছিল–কিন্তু সেটাই শেষ কথা নয়। এতদিনে সে পথের সন্ধান পেয়েছে। মানব-কল্যাণে যদি এই মহাশক্তিকে কাজে লাগানো যায়, তবেই সার্থক হবে অর্ধশতাব্দীব্যাপী বিজ্ঞানীদের সাধনা। সেই আয়োজনই হচ্ছে হারওয়েলে। মনপ্রাণ তাই ঢেলে দিল ফুকস্।
সমস্ত কারখানাটা উঁচু কাটা-তারের বেড়া দিয়ে ঘেরা। সামনে লোহার বড় গেট। বন্দুকধারী পাহারা। তাকে ‘পাস্ দেখিয়ে তবে তুমি ঢুকতে পারবে এ-রাজ্যে। ঢুকতেই সামনে একটি দ্বিতলবাড়ি। অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ অফিস। এখানেই কাজ করতে হয় তাকে। স্যার জনের পাশের ঘরে। ও-পাশে প্রফেসর কার্লের অফিস। আগে এটা ছিল রয়েল এয়ার ফোর্সের একটা আস্তানা। বিমানবাহিনীর কর্মীদের ঘরগুলোই পাওয়া গিয়েছে আপাতত। নতুন নতুন বাড়িও হচ্ছে। একতলা বাড়ি সব–সামনে ফুলের বাগান, পিছনে সবজির। স্টাফ-কোয়ার্টার্সকে বাঁ-হাতে রেখে যদি এগিয়ে যাও তাহলে আবার একটা কাঁটাতারের বেড়ার সামনে গিয়ে দাঁড়াবে। আবার পাস দেখাতে হবে। ভেতরটা কারখানা নয়, বিজ্ঞানগার। সবচেয়ে অবাক হয়ে যাবে অ্যাটমিক পাইলটাকে দেখে। প্রকাণ্ড একটা গোলাকৃতি গম্বুজ–যেন রোমের কলোসিয়ামের অনুকৃতি। ওর কাছে গিয়ে দাঁড়াতে ভয় হবে তোমার। সজ্ঞানে হয়তো ঠিক হিরোশিমা-নাগাসাকির কথা মনে পড়বে না, তবুও গা-ছমছম করবে। মনে হবে অজানা-অচেনা এক অরণ্যের মাঝখানে এসে পড়েছ বুঝি। চারদিক ঝকঝক তকতক করছে–হ্যাঁসপাতালের অপারেশন থিয়েটার যেন। হঠাৎ নজরে পড়বে একটা বিজ্ঞপ্তি : ধূমপান নিষেধ। হয়তো ধড়াস করে উঠবে বুকের ভেতর। হাতের জ্বলন্ত সিগারেটটা কোথায় ফেলবে ভেবে পাবে না। তখনই একজন কর্মী হয়তো এগিয়ে আসবে, বলবে–অমন আঁৎকে উঠবেন না স্যার; অ্যাটমিক-পাইলটা কোনো ডিনামাইটের স্তূপ নয়–সিগারেটের আগুনে ওটা জ্বলে। উঠবে না। ওই বিজ্ঞপ্তি দেওয়া আছে যাতে জায়গাটা নোংরা না হয়।
ফুকস্ আর কার্ল এখানে পৌঁছানোর বছর দেড়েক আগেই এ প্রকল্পে হাত দেওয়া হয়েছে। এখন এখানে শ-দুয়েক কর্মী কাজ করে। তার মধ্যে জনাত্রিশেক হচ্ছে বিজ্ঞানী। বিজ্ঞান-চর্চা তারা করেছে সামান্যই, জ্ঞানও অল্প। বয়স বিশ-পঁচিশ। আসলে ওরা সবাই যুদ্ধ-ফেরত। ফিজিক্সের চর্চা ছেড়েছে তিন-চার বছর আগে–কেমব্রিজ-অক্সফোর্ড- হ্যাঁরো-ইটনে। চলে গিয়েছিল মরণপণ যুদ্ধে–ওরা মূলত টেকনিশিয়ান, হাতে-কলমে কলকজার কাজই শুধু জানে। স্যার জন তাই ব্যবস্থা করেছেন সপ্তাহে চারদিন তাদের নিয়ে থিওরেটিক্যাল ক্লাস করতে হবে। ক্লাস নেন তিনি নিজে, আর তার দুই সহকর্মী–প্রফেসর কার্ল আর ডক্টর। ছেলেগুলো প্রাণবন্ত-মৃত্যুকে বারে বারে দেখেছে চোখের সামনে। নীতিবাধের বালাই কম-কিন্তু নতুন পৃথিবী গড়ে তোলার সংকল্প আছে।
ওঁরা তিনজনই মাত্র পদস্থ অফিসার-বাদবাকি তো ছেলে-ছোকরা। আরও দুজনের সঙ্গে আলাপ হয়েছে ফুকস-এর। উইং-কমান্ডার হেনরি আর্নল্ড আর ডক্টর স্যামুয়েল স্কট। আর্নল্ড ছিলেন বিমানবাহিনীতে, প্রৌঢ় গম্ভীর স্বভাবের মানুষ, বিপত্নীক। তিনি হারওয়েলের স্পেশাল সিকিউরিটি অফিসার। এখানে অবশ্য সিকিউরিটির অতটা কড়াকড়ি নেই, যেমন ছিল লস অ্যালামসে। সেখানে প্রত্যেকের ছদ্মনাম ছিল, স্বনামে কারও পরিচয়ই ছিল না। এখানে সেসব কিছু নেই। তবু পারমাণবিক-তত্ত্বের পরীক্ষা-নিরীক্ষা যখন হচ্ছে তখন গোপনীয়তার প্রয়োজন আছে বইকি। আর ডক্টর স্কট এখানকার মেডিক্যাল অফিসার। ছোটো একটা আউটডোর ডিসপেন্সারি আছে তার। অমায়িক মানুষ। আছেন সপরিবারে, স্ত্রীপুত্র পরিজনদের নিয়ে। সুখী পরিবার।
এখানে এসে এতদিন পরে ক্লাউস-এর মনে হচ্ছে, জীবনে নোঙর ফেলার দিন এসেছে বুঝিবা। এখন ওর বয়স পঁয়ত্রিশ। এতদিন সংসার করার কোনো ইচ্ছাই ছিল না। এখন আর পাঁচজনের পরিবারের দিকে তাকিয়ে ওরও মনে হচ্ছে এই নির্বান্ধব ব্যাচিলারের জীবনে সে কোনদিনই শান্তি পাবে না। 1946-এ প্রথম যখন। চাকরিতে ঢোকে তখন ওর রোজগার ছিল বছরে 275 পাউন্ড, এখন উপার্জন করছে 1,500 পাউন্ড। অর্থাৎ মাসে প্রায় আড়াই হাজার টাকা। 1946-এ যুদ্ধোত্তর ইংল্যান্ডে এ উপার্জন বড় কম নয়। কিন্তু বিবাহ করে সংসার করায় তার একটি প্রচণ্ড বাধাও আছে। সে বাধা–ফ্রাউ রোনাটা কার্ল।
***
এ ধাঁধার সমাধানটা বুঝতে হলে ক্লাউস ফুকস্-এর অতীত জীবনটাকে জানতে হবে। ক্লাউস জার্মানি থেকে প্রাণ নিয়ে যখন ইংল্যান্ডে পালিয়ে এসেছিল তখন ওর বয়স মাত্র বাইশ। জার্মানির কিয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন উৎসাহী ছাত্রনেতা ছিল সে। রাজনীতির ঘূর্ণাবর্তে সে ছিল ন্যাশনাল সোসালিস্ট পার্টির বিরুদ্ধ দলে। ছাত্র-আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছিল। হঠাৎ দেখা গেল ওর বিরুদ্ধ দল, ওই ন্যাশনাল সোসালিস্ট পার্টি, জার্মানির ক্ষমতা দখল করেছে তার নাম হয়েছে নাৎসি পার্টি। ওই দলের নেতা অ্যাডলফ হিটলার হয়েছে জার্মানির দণ্ডমুণ্ডের কর্তা। 1933-এর তিরিশে জানুয়ারি–যেদিন হিটলার জার্মানির ক্ষমতা দখল করল, সেদিন কিয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ে হিটলারের অনুগামীরা তন্নতন্ন করে খুঁজেছিল বিপক্ষদলের ওই ছাত্রনেতাকে–পাদরি ফুকসের সেই দুর্বিনীত পুত্র ক্লাউস-কে। খবর পেয়ে ক্লাউস আত্মগোপন করে। প্রথমে পালিয়ে যায় পারিতে, সেখান থেকে কপর্দকহীন অবস্থায় ইংল্যান্ডে।
ফ্রলাইন রোনাটা হেল্মহোল্টৎজ-এর বয়স তখন মাত্র সতেরো। হাইস্কুলের ছাত্রী। তার বাবা ছিলেন পাদরি ফুকসের একজন গুণগ্রাহী। ফুকস্ আশ্রয় পেল তার পরিবারে। সমারসেট-এ। মিস্টার হেল্মহোল্টজ বিপত্নীক। তার বড় মেয়ে ফ্রলাইন রোনাটাই ছিল গৃহকর্ত্রী–মাত্র সতেরো বছর বয়সে। আরও দুটি ছোটো ছোটো ভাইবোন-এর দায়িত্ব ছিল তার ওপর। এর ওপর এসে জুটল। ক্লাউস-বাইশ বছরের প্রাণবন্ত তরুণ ফুকস ভর্তি হল ব্রিস্টল বিশ্ববিদ্যালয়ে। চার। বছর সে ছিল এই পরিবারে, রোনাটার অভিভাবকত্বে। শুধু তাই নয়, রোনাটা ছিল তার মাস্টারনি, দিদিমণি আর কি। তার কাছেই ইংরেজি ভাষাটা শিখেছিল। পরিবর্তে ক্লাউস রোনাটার শক্ত শক্ত অঙ্কগুলো কষে দিত। সে সময় ক্লাউস ছিল মুখচোরা, বইপোকা। চার বছর পরে ব্রিস্টল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সে যে বছর দর্শন ও অঙ্কশাস্ত্রে ডক্টরেট পায় রোনাটা সে বছরই গ্রাজুয়েট হল। আর সেই বছরই মারা গেলেন ওর আশ্রয়দাতা–রোনাটার বাবা।
জার্মান বিজ্ঞানের সেই দুর্লভ প্রতিভা বাস্তুচ্যুত মাক্স বর্ন তখন এডিনবরায় পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক। ক্লাউস ফুকস-এর প্রতি তিনি আকৃষ্ট হন এবং তার অধীনে একটি স্কলারশিপ জুটিয়ে দেন। ক্লাউস সমারসেট ছেড়ে চলে আসে স্কটল্যান্ডে, এডিনবরায়।
সেই বিদায়মুহূর্তেই ঘটল একটা ঘটনা যার প্রতিক্রিয়া সারাজীবন ধরে অনুভব করছে ক্লাউস। রোনাটা ততদিনে একটা চাকরি জুটিয়ে নিয়েছে। সংসারটা চালাবার মতো ব্যবস্থা হয়েছে তার। একুশ বছরের তারুণ্যে ভরপুর। ক্লাউস এতদিনে প্রফেসর ম্যাক্স বর্নের অধীনে রিসার্চ করার সুযোগ পেয়েছে শুনে সে অভিনন্দন জানাতে এল ক্লাউসকে। কথা প্রসঙ্গে বললে, তুমি তো এবার এডিনবরায় চলে যাচ্ছ। আমাদের সঙ্গে এই বোধহয় ছাড়াছাড়ি হয়ে গেল।
ক্লাউস বললে, তা কেন? এডিনবরা এমন কিছু সাগরপারে নয়। যোগাযোগ রাখলেই রাখা যেতে পারে। অবশ্য তোমার যদি গরজ থাকে।
–আমার? কী মনে হয় তোমার?
–কী জানি। চিঠি লিখলে জবাব দেবে তো?
হঠাৎ মুখটা নিচু করলে রোনাটা। বললে, আর আমি যদি বলি–চিঠি লেখার দূরত্বে থাকতে চাই না আমি?
-মানে?
ওর চোখে চোখ রেখে রোনাটা বললে, আমি তোমার কাছেই থাকতে চাই। লেটস্ গেট ম্যারেড, ক্লাউস।
–তা কেমন করে সম্ভব? আমার ছাত্রজীবন এখনও শেষ হয়নি।
একটা দীর্ঘশ্বাস পড়েছিল রোনাটার। তারপর বললে, আমি কি তাহলে তোমার প্রতীক্ষায় থাকব?
এবার জবাব দিতে দেরি হল ফুকস-এর। একটু ভেবে নিয়ে বললে, আমি দুঃখিত রোনাটা। তা হবার নয়। বাধা যে কী, তা তোমাকে আমি বুঝিয়ে বলতে পারব না। কিন্তু আমি আমার জীবনের সঙ্গে তোমাকে কোনোদিনই জড়িয়ে নিতে পারব না।
স্তম্ভিত হয়ে গেল যেন রোনাটা। বহু কষ্টে সে আত্মসম্বরণ করল। তারপর প্রতিটি শব্দ স্পষ্ট উচ্চারণ করে বললে, তাহলে তোমার আগের প্রশ্নটার জবাব দিই, আমাকে চিঠি লিখ না। কারণ জবাব আমি দেব না।
ক্লাউস শুধু বলেছিল, আয়াম সরি।
ঝড়ের বেগে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েছিল রোনাটা।
***
সে আজ নয়-দশ বছর আগেকার কথা। ক্লাউস কিন্তু ওর কথা মেনে নেয়নি। এডিনবরায় পৌঁছে চিঠি লিখেছিল। একাধিক পত্র। রোনাটাও ছিল তার সংকল্পে অটুট। একটি চিঠিরও জবাব দেয়নি। তারপর যেমন হয়। ক্রমশ ক্লাউস ভুলে গেল তার প্রথম যৌবনের বান্ধবীকে। তিন বছর পর ম্যাক্স বর্নের কাছে থিসিস দাখিল করে পেল ডক্টর অফ সায়েন্স উপাধি। ইতিপূর্বে হয়েছিল পিএইচ. ডি.এবার হল ডি. এসসি.। খবরটা উৎসাহভরে জানালো রোনাটাকে।
এবারও কোনো জবাব এল না।
ক্লাউস ক্রমশ ভুলে গেল মেয়েটিকে। তারপর রোনাটার সঙ্গে ওর দেখা হল সুদূর সাগরপারের দেশে। আমেরিকায়। লস অ্যালামসে। ততদিনে রোনাটা হয়েছে মিসেস কার্ল। একটি সন্তানের জননী। দুর্ভাগ্যক্রমে সন্তানটি বাঁচেনি। তাকে চোখেই দেখেনি ক্লাউস। দেখেছে ফটো। অসংখ্য ফটো। একটা গোটা অ্যালবাম ভরা ছিল অ্যালিসের ছবিতে। রঙিন ছবি। সদ্যোজাত অবস্থা থেকে তার সংক্ষিপ্ত তিন-বছরের জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত। প্রফেসর কার্ল-এর ছিল ফটো তোলার বাতিক। রঙিন ছবিও তুলেছেন অনেক। মুভি ক্যামেরাতেও। তাই চোখে না। দেখলেও রোনাটার কন্যা অ্যালিসকে ক্লাউস ভালোভাবেই চেনে। মেয়েটা রোনাটার মতো দেখতে হয়নি মোটেই। রোনাটা ‘ব্লন্ডি’–সোনার বরণ তার। মাথাভরা চুল, রোনাটার মুখটা টিকলো–মেয়েটি ছিল ‘ব্রুনেট’; তার মুখটাও গোলগাল।
রোনাটার চেয়ে তার স্বামী বাইশ বছরের বড়। এমন বিবাহে রোনাটা যে জীবনে সুখী হয়নি তা বুঝতে অসুবিধা হয় না। এমন অসম বয়সের পুরুষকে কেন পছন্দ করল রোনাটা? এ প্রশ্নের জবাব খুঁজে পায়নি ক্লাউস। জিজ্ঞাসাও করা যায় না এ কথা। প্রফেসর কার্ল মহাজ্ঞানী-অধ্যাপক অথবা পণ্ডিত হিসাবে তাকে যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয় নির্বাচন করবে; কিন্তু পঁচিশ বছরের একটি মেয়ে তার কোন্ গুণে অভিভূত হয়ে স্বামী হিসাবে তাকে নির্বাচন করল?
তাই আজ এতদিন পরে সেই মেয়েটির চোখের সামনেই সংসারী হতে কেমন যেন অস্বোয়াস্তি বোধ করে ক্লাউস। বান্ধবী তার হয়েছে অনেক। তার রূপ, যৌবন এবং রোজগার দেখে অনেক মেয়েই উৎসাহ বোধ করছে। ও নিজেই কেমন যেন অপরাধী বোধ করে তাতে। মদের মাত্রাটা বাড়িয়ে দেয় শুধু।
হারওয়েলে এসে আরও একটা অনুভূতি হয়েছে। তার মনে হয়, সর্বদাই যেন একজোড়া অদৃশ্য চোখ লক্ষ্য করছে ওকে–ওকে নয়, ওদের। প্রফেসর কার্ল, রোনাটা আর ক্লাউসকে ক্রমাগত লক্ষ্য করে যাচ্ছে কেউ। প্রত্যক্ষ প্রমাণ নেই, কিন্তু সর্বদাই যেন এক অদৃশ্য সন্ধানীর দৃষ্টির শিকার হয়ে রয়েছে ওরা। কেন এমন মনে হয় ওর? রোনাটার প্রতি তার, অথবা তার প্রতি রোনাটার অন্তরে যে গোপন অনুভূতি আছে সেটাই কি আবিষ্কার করতে চায় ওই অদৃশ্য গোয়েন্দা চোখজোড়া? স্যোসাল স্ক্যান্ডাল? বুঝে উঠতে পারে না। শেষ পর্যন্ত একদিন সে মরিয়া হয়ে এসে হাজির হল হেনরি আর্নল্ডের দরবারে। খুলে বললে তার ওই অদ্ভুত অনুভূতির কথা। সব কথা শুনে হো-হো করে হেসে উঠল আর্নল্ড। বললে,–না না, ডক্টর ফুকস, আমি আপনার পেছনে কোনো গোয়েন্দা লাগাইনি। বৃদ্ধস্য তরুণী ভার্যা। সুন্দরী মিসেস কার্ল এবং যৌবনদীপ্ত প্রফেসর ফুকস্ যে পরস্পরকে কী চোখে দেখেন, তা আমার ভালোই জানা আছে। এবং এ কথাও জানি যে, মিসেস রোনাটা কার্লের প্রাকবিবাহ জীবনের বন্ধু ছিলেন আপনি। নিশ্চিত থাকুন ডক্টর ফুকস, আপনাকে কোনো সামাজিক কেলেঙ্কারির মধ্যে ফেলবার শুভ উদ্দেশ্য আমার আদৌ নেই।
ডক্টর ফুকস্ রাঙিয়ে ওঠে। বলে, না না, আপনার বিরুদ্ধে আমা? কোনো অভিযোগ নেই। আপনি গোয়েন্দা লাগিয়েছেন এ কথাও বলছি না। কি আমার এমন মনে হচ্ছে কেন?
এর জবাবে হেনরি আর্নল্ড হ্যামলেট থেকে একটি উদ্ধৃতি শুনিছিলেন— ডক্টর অফ ফিলসফি তার দর্শনের মাধ্যমে যে স্বপ্ন দেখতে অক্ষম তাও নাকি দুনিয়ায় সম্ভব।
আদ্যোপান্ত কিছু বোঝা যায় না। উঠে আসছিল ক্লাউস। তাকে আবার ফিরে ডাকল আর্নল্ড, বাই দ্য ওয়ে ডক্টর, এই ফটোগুলো দেখুন তো। এদের কাউকে চেনেন?
খান তিন-চার ফটো বার করে দেখায়। ক্লাউস ছবিগুলো উল্টেপাল্টে দেখে। আর্নল্ড বলে, এঁদের কাউকে কখনও লস অ্যালামসে দেখেছেন? ধরুন প্রসের কার্ল-এর বাড়িতে?
–হ্যাঁ, এঁকে দেখেছি। এঁকে চিনিও। এঁর নাম ডক্টর অ্যালেন নান মে।
–আর দুজনকে?
–না চিনি না। কিন্তু কেন বলুন তো? কে এঁরা?
–আপনি খবরের কাগজ পড়েন না?
–বিশেষ নয়। কেন?
–ডক্টর অ্যালেন নান মে-র নাম এ সপ্তাহে প্রতিদিন খবরের কাগজে ছাপা হচ্ছে। দেখেননি?
–না। কেন? তিনি কি নতুন কিছু আবিষ্কার করেছেন?
-না। বাড়ি গিয়ে ক-দিনের পুরানো খবরের কাগজ উল্টে দেখবেন। আর একটা কথা। এখানে, এই হারওয়েলে-বিশেষ করে প্রফেসর কার্ল-এর বাড়িতে–অস্বাভাবিক কিছু দেখলে আমাকে গোপনে এসে জানিয়ে যাবেন।
অবাক হয়ে যায় ক্লাউস। বলে, কেন বলুন তো? কী ব্যাপার?
আর্নল্ড জবাব দেয় না। র্যাক থেকে খানকতক ‘লন্ডন টাইমস’ নিয়ে গুঁজে দেয়। ওর হাতে। বলে, শুধু নিউক্লিয়ার ফিজিকস্ পড়লেই চলবে না ডক্টর, একটু-আধটু দুনিয়ার খবরও রাখতে হবে। যান, এগুলো পড়ে দেখুন। আপনার প্রশ্নের জবাব ওতেই পাবেন।
তা পেল ক্লাউস। কাগজে সাড়ম্বরে বার হয়েছে অ্যালেন নান মের গুপ্তচরবৃত্তির কাহিনি।
***
তার দিনসাতেক বাদে ঘটল ঘটনাটা। অদ্ভুত একটা অভিজ্ঞতা।
কী একটা কাজে ক্লাউস এক সপ্তাহান্তে লন্ডনে গিয়েছিল। একাই মাসে দু-একবার সে এভাবে শহরে যেত। সঙ্গে নিয়ে যেত লম্বা লিস্ট। হারওয়েল মিসেসদের নানান শৌখিন জিনিসের অর্ডার। কোনো কোনো দিন রবিবারটা সে লন্ডনেই কাটিয়ে আসত–কোনো হোটেলে। সেবার কী মনে হল, ও ফিরে আসবে বলে স্থির করল। সাউথ কেনসিংটন স্টেশনের দিকে যাচ্ছে, হঠাৎ পথের মাঝখানেই ওকে পাকড়াও করলেন প্রফেসর কার্ল, কোথায় চলেছ হে?
-হারওয়েলেই ফিরব। আপনি এখানে?
-ওয়েম্বেলেতে গিয়েছিলাম। জি. ই. সি. কোম্পানিতে। কাজ মিটে গেল, এখন ফিরে যাচ্ছিলাম।
প্রফেসর কার্ল গাড়ি নিয়ে এসেছিলেন। নিজের গাড়ি। এখানে এসে কিনেছেন। নিজেই ড্রাইভ করছেন। ফুকস্ উঠে বসল ওঁর পাশে। মালপত্র তুলে দিল পিছনের সিটে।
–প্যারাম্বুলেটার কী হবে হে? তুমি তো ব্যাচিলার।
–ওটা মিসেস স্কটের অর্ডার। ডাক্তারবাবুর বাচ্চার জন্য।
–বেশ আছ তুমি। এবার নিজের ল্যাজটা কাটো। আমাদের দলে নাম লেখাও।
ক্লাউস হাসল। জবাব দিল না।
শহর ছেড়ে শহরতলীতে এল ওরা। ক্রমে অক্সফোর্ডের দিকে ফাঁকা রাস্তায় পড়ল। বেলা তখন পাঁচটা। গ্রীষ্মকাল। সূর্য অস্ত যেতে তখনও ঘণ্টাচারেক। বেশ রোদ আছে। ফাঁকা অ্যাসফল্টের রাস্তায় পড়ে স্পিড বাড়ালেন প্রফেসর। বললেন, অনেকদিন আমার বাড়ি আসছ না তো। কেন?
কী বলবে ক্লাউস? প্রফেসর কার্ল-এর বাড়ি তাকে টানে; কিন্তু ইচ্ছে করেই সে এড়িয়ে চলে। রোনাটার মুখোমুখি দাঁড়ালেই আজকাল সে বিবেকের দংশন অনুভব করে। রোনাটা দিন দিন কেমন যেন হয়ে যাচ্ছে। বেশ রোগা হয়ে গিয়েছে। মানসিক অবসাদে ভুগছে যেন। দেখলেই মনে হয়, মেয়েটা অসুখী। ওর নীরবতাকে পাত্তা না দিয়ে প্রফেসর আবার বলেন, সময় পেলে এস। মাঝে মাঝে তোমাকে দেখলে রোনাটা তবু একটু খুশি হয়।
কেমন আছে সে আজকাল?-মামুলি প্রশ্ন।
–ভালো নেই ক্লাউস। মাঝে মাঝে ফিট হচ্ছে আজকাল।
–ফিট হচ্ছে! কেন? ডক্টর স্কট দেখেছেন? কী বলছেন তিনি?
–বলছেন মানসিক অসুখ। সাইকিয়াট্রিস্টকে দিয়ে দেখাতে বলছেন।
–আশ্চর্য তো। এ খবর তো জানতাম না।
–এস একদিন, কেমন? কালই এস না। কাল তো রবিবার। আমার ওখানে ডিনার খাবে। ডক্টর ব্রুনোর সঙ্গেও আলাপ হয়ে যাবে।
–ডক্টর ব্রুনো কে?
–কাল এস। আলাপ করিয়ে দেব।
***
সূর্য পশ্চিম দিগ্বলয়ে হেলে পড়েছে। সড়ক জনমানব শূন্য। অক্সফোর্ড রোডে ওরা তখন গেরার্ড ক্রস আর বেকন্সফিল্ডের মাঝামাঝি। সন্ধ্যা তখন ঠিক ছটা বেজে সাত মিনিট। কোথাও কিছু নেই হঠাৎ কী একটা বস্তু এসে প্রচণ্ড আঘাত করল সামনের উইন্ডস্ক্রিনে। চৌচির হয়ে ফেটে গেল সেটা। গাড়ি তখন ঘণ্টায় ষাট কিলোমিটার বেগে যাচ্ছিল। ক্লাউস ফুকস্ এ আকস্মিক ঘটনায় একেবারে ভয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছে। তার হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে যেন। প্রফেসর কিন্তু নির্বিকারভাবে মাইলতিনেক অত্যন্ত দ্রুতগতিতে এগিয়ে এলেন। তারপর গাড়ি থেকে নেমে ভাঙা উইন্ডস্ক্রিনটা পরীক্ষা করে বললেন–ইট মেরেছে কেউ।
ততক্ষণে অনেকটা স্বাভাবিক হয়েছে ক্লাউস। ইতিমধ্যে সে লক্ষ্য করে দেখেছে, ড্রাইভার আর তার সিটের মাঝামাঝি খাড়াপিঠ গদির মাঝখানে একটা নিটোল ছোট্ট গর্ত হয়েছে। তার ভিতর আঙুল চালিয়ে সে উদ্ধার করে আনল ছোট্ট একটা সীসার গোলক। বললে, না। একটা রাইফেল থেকে ছোঁড়া হয়েছে এটা।
প্রফেসর কার্ল গুলিটাকে হাতে নিয়ে পরীক্ষা করলেন অনেকক্ষণ ধরে। তারপর বললেন, ঠিক বলেছ। এটা রাইফেলের গুলি বলেই মনে হচ্ছে। নিশ্চয় কোনো শিকারীর কাণ্ড। খরগোশ মারতে গিয়ে আমাদের শেষ করে ফেলেছিল একেবারে।
পাহাড়ের ওপরে চারিদিকে তাকিয়ে দেখেন। খুঁজতে থাকেন শিকারীকে।
ক্লাউস বললে, বুলেটটা দিন। ওটা আর্নল্ডকে দেখাতে হবে।
-পাগল। ঘুণাক্ষরেও এ-কথা ওকে বোলো না। বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা। আমাদের ধরে টানাটানি শুরু করবে। নাও ওঠ। চল, ফেরা যাক।
ফুকস গাড়িতে ওঠে না। বলে, প্রফেসর, আপনি একটা কথা খেয়াল করছেন না। এখানে বাঘ, হরিণ বা বাইসন নেই। খরগোশ মারতে শিকারীরা এ অঞ্চলে আসে বটে, কিন্তু খরগোশ শিকারে কেউ এ জাতীয় বুলেট ব্যবহার করে না।
ভ্রূদুটি কুঁচকে যায় প্রফেসর কার্লের। গম্ভীর হয়ে বলেন–কী বলতে চাইছ তুমি?
–আমি বলতে চাইছি, কেউ আপনাকে অথবা আমাকে হত্যা করবার উদ্দেশ্য নিয়ে একটা রাইফেল থেকে এটা ফায়ার করেছে। খবরটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এখনই গিয়ে আমাদের আর্নল্ডকে সব কথা বলতে হবে।
দু-এক মিনিট চুপ করে বসে থাকেন প্রফেসর। তারপর গম্ভীরভাবে বলেন, আমার সেটা ইচ্ছে নয়।
–আমি এক শর্তে ব্যাপারটা গোপন রাখতে রাজি আছি।
চমকে মুখ তুলে ওর দিকে তাকালেন প্রফেসর কার্ল-কী শর্তে?
–আপনি যদি স্বীকার করেন, আমাকে নয়–আপনাকে গুলি করতেই হত্যাকারী গুলিটা ছুঁড়েছে।
-বাঃ। তা কেমন করে জানব আমি?
–আপনি জানতেন। না হলে উইন্ডস্ক্রিনটা চুরমার হয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গে আপনি ব্রেক কষতেন। এমন দশ মিনিট পাগলের মতো ড্রাইভ করে এসে তিন মাইল দূরে গাড়ি দাঁড় করিয়ে পাহাড়ের ওপর শিকারীকে খুঁজতেন না।
মুখটা সাদা হয়ে গেলো প্রফেসর কার্লের। জবাব দিতে পারলেন না তিনি।
–দ্বিতীয়ত, ব্যাখ্যার প্রয়োজন ছিল না-রাইফেল দিয়ে এমন বুলেটে যে খরগোশ শিকার করা হয় না, তা আপনারও জানা ছিল। এবং তৃতীয়ত, আমি ঘটনাচক্রে এ গাড়িতে উঠেছি। হত্যাকারী অনেক আগে থেকেই এখানে আপনার পথ চেয়ে বসে আছে। আমি যে এ-গাড়িতে ফিরব-তা সে আদৌ জানত না। জানতে পারে না।
আবার অনেকক্ষণ চুপ করে বসে থাকলেন প্রফেসর কার্ল। তারপর হঠাৎ মুখ তুলে বললেন, ডক্টর ফুক। প্রত্যেকের জীবনেই এমন কিছু অধ্যায় থাকে যা অন্যকে বলা যায় না। আমি স্বীকার করছি–আমাকে হত্যা করবার জন্যই রাইফেলধারী এ কাজ করেছে। কিন্তু আমি চাই না সেটা উইং কমান্ডার আর্নল্ড জানতে পারুক। সময় হলেই আমি তাকে বলব। কথা দাও, তুমি নিজে থেকে কিছু বলবে না?
-বেশ। জিজ্ঞাসিত না হওয়া পর্যন্ত আমি এ-কথা তাকে জানাব না।
–ধন্যবাদ।
এতদিনে একটা সমস্যার সমাধান হল ক্লাউস ফুকস-এর : কেন ওর মনে হত একজোড়া অদৃশ্য চোখ ওদের দিবারাত্র পাহারা দিয়ে চলেছে। অদৃশ্য চোখের শিকারী সে নয়, রোনাটা নয়–প্রফেসর অটো কার্ল!
***
পরদিন প্রফেসর কার্ল-এর বাসায় গিয়ে আলাপ হল আর একটি পরিবারের সঙ্গে। ডক্টর ব্রুনো পন্টিকার্ভো। প্রফেসর কার্ল-এর বন্ধু-বন্ধু ঠিক নয়, বয়সে অনেক ছোটো। ক্লাউস-এর চেয়েও দু বছরের ছোটো। সে সপরিবারে এসে উঠেছে প্রফেসর কার্ল-এর বাসায় অতিথি হয়ে। নামকরা নিউক্লিয়ার ফিজিসিস্ট। প্রফেসর কার্ল অত্যন্ত স্নেহ করেন তাকে। হারওয়েলে তার যাতে একটি চাকরি হয় তার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। ক্লাউস থাকে ব্যাচিলার্স ডর্মিটারিতে, কিন্তু প্রফেসর কার্ল পাঁচ-কামরার বাংলো পেয়েছেন। সংসারে তো কুল্লে দুটি প্রাণী–স্বামী-স্ত্রী। তাই বাকি দুখানা ঘর ছেড়ে দিয়েছেন ব্রুনো পরিবারকে।
ব্রুনো ইটালিয়ান। জন্ম পিসায়। বৃহৎ পরিবারের সন্তান। সাত-আটটি ভাইবোন। তারা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে সারা পৃথিবীতে। অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র। প্রিয়পাত্র ছিল এনরিকো ফের্মির। তার অধীনে গবেষণা করেছে রোমে থাকতে। সেখান থেকেই ডক্টরেট করে। পরে চলে আসে পারিতে। সেখানে জোলিও কুরির গবেষণাগারে রিসার্চ করে। এখানেই সে বিবাহ করে–হেলেনকে। তার কুমারী জীবনের নাম হেলেন মেরিয়ান। সুইডেনে বাড়ি। স্টকহমে ছিল তার বাপ-মা। ওদের তিনটি সন্তান–জিল, টিটো আর অ্যান্টোনিও। অ্যান্টোনিও সবার ছোটো। বছরদেড়েকের ফুটফুটে বাচ্চা। তিনটি বাচ্চাকে পেয়ে রোনাটার বঞ্চিত মাতৃত্ব যেন এতদিনে একটা অবলম্বন খুঁজে পেয়েছে। হেলেনকে সে সব দায়-দায়িত্ব থেকে মুক্তি দিয়েছে। তিন বাচ্চা নিয়ে মেতে আছে রোনাটা।
ডিনারের আসর জমিয়ে রাখল ব্রুনো একাই। নানান গল্পে, চুটকি রসিকতায়। রোনাটা বাচ্চাদের নিয়ে মেতে আছে, ক্লাউস-এর সঙ্গে ভালো করে কথা বলার সময়ই যেন নেই।
এ ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন দুজন পরিচিত ব্যক্তি-সস্ত্রীক ডক্টর স্কট এবং সিকিউরিটি অফিসার আর্নল্ড। খানাপিনা মিটতে বেশ রাত হল। বিদায় নিয়ে বের হবার সময় আর্নল্ড বলল, ডক্টর ফুকস্ আসুন আমার গাড়িতে। আপনাকে পৌঁছে দিয়ে যাই।
–চলুন।
গাড়িতে উঠে আর্নল্ড বললে, কেমন লাগল ওই ব্রুনো পরিবারকে?
–চমৎকার। ডক্টর ব্রুনো তো খুবই অমায়িক লোক। খুব হাসিখুশি, আমুদে। ভদ্রলোক এখানে চাকরি পেলে আমাদের জীবনযাত্রাটাই বদলে যাবে।
-তা হবার নয় ডক্টর। খুব সম্ভব ডক্টর ব্রুনো এখানে চাকরি পাবেন না।
–কেন? উনি তো নিজের বিষয়ে অত্যন্ত পণ্ডিত।
–পাণ্ডিত্যের জন্য আটকাবে না। ওঁর সিকিউরিটি ক্লিয়ারেন্স পাওয়া শক্ত।
ক্লাউস ধমক দিয়ে ওঠে, ওই আপনাদের এক বাতিক। সব কিছুতেই বাড়াবাড়ি। সবাইকে শুধু সন্দেহ করেই জীবনটা গেল আপনাদের
-কী করব বলুন? এটাই তো আমাদের চাকরি। ডক্টর ব্রুনোকে চাকরি দেওয়ার মানে হয়তো আপনার মতো একজন নিরীহ বৈজ্ঞানিকের প্রাণ বিপন্ন করা।
–আমার? কেন, আমার প্রাণ বিপন্ন হতে যাবে কোন দুঃখে?
ধরুন দূর থেকে কেউ হয়তো একটা রাইফেল তাক করল ডক্টর ব্রুনোকে বধ করতে। লং রেঞ্জের রাইফেল। এবং গুলিটা আপনার সিটের আরও চোদ্দো ইঞ্চি ডাইনে সরে এসে বিধল। আপনাকে বাঁচাতে পারব তাহলে?
স্তম্ভিত হয়ে গেল ক্লাউস। বাক্যস্ফূর্তি হল না তার। আর্নল্ড নিজেই হেসে বলল, কই, নামুন এবার। আপনার বাসায় এসে গেছেন যে।
.
০৩.
ওই ঘটনার মাসখানেক পরে হঠাৎ মুক্তিপথের সন্ধান পেল ক্লাউস ফুকস। নতুন করে বাঁচবার একটা সম্ভাবনা দেখা দিল আচমকা। ওর বাবা প্যাস্টর এমিল ফুকস্ ওকে কিয়েল থেকে হঠাৎ একটা চিঠি লিখে এই নূতন জীবনের ইঙ্গিত পাঠিয়েছেন। ডক্টর এমিল ফুকসের বয়স তখন আশির কাছাকাছি। যুদ্ধ চলার সময় তিনি দীর্ঘদিন নাৎসি বন্দীশিবিরে কাটিয়েছেন। যুদ্ধান্তে মুক্তি পেয়ে চলে গেছেন কিয়েল-এ। এখন সেখানে চার্চের যাজক তিনি। এই কিয়েল-এই একসময় পড়ত ক্লাউস। বৃদ্ধ চিঠিতে জানিয়েছেন, কিয়েল বিশ্ববিদ্যালয় ডক্টর ক্লাউস ফুকে পদার্থবিদ্যার অধ্যাপকপদে বরণ করতে ইচ্ছুক। সে যদি তার বর্তমান চাকরি ছেড়ে দেয় এবং ন্যাশনালিটি পরিবর্তন করতে রাজি থাকে তবে এই বৃদ্ধ বয়সে তিনি পুত্রের কাছাকাছি থাকতে পারেন।
ক্লাউসের জীবনে ওই বৃদ্ধের অবদান অসামান্য। এই দুনিয়ায় সে যে-কজন মহাপুরুষকে শ্রদ্ধা করে তার অন্যতম তার জনক ওই পাদরি ফুক। সারা জীবন তিনি সংগ্রাম করে গিয়েছেন। একা হাতে। নাৎসি অত্যাচারের চুড়ান্ত হয়েছিল ওদের পরিবারে–যদিও ওরা ইহুদি ছিল না। ক্লাউসের মা সে অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করেন, ক্লাউসের ছোটোবোনও আত্মহত্যা করে। ক্লাউসের দাদা নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। তবু ঈশ্বরে বিশ্বাস হারাননি বৃদ্ধ। আজীবন একা হাতে লড়াই করে গেছেন। ক্লাউস নিজে জার্মানি থেকে পালিয়ে আসায় বৃদ্ধকে কোনোভাবেই সাহায্য করতে পারেনি। তাই বৃদ্ধ পিতার আহ্বানে সে বিচলিত হয়ে উঠল। বৃদ্ধ অবশ্য কিয়েলে একা থাকেন। মানুষ করেছেন ওঁর মা-হারা একমাত্র নাতিটিকে। ও যদি কিয়েলে গিয়ে অধ্যাপনা শুরু করে, সংসার পাতে, তাহলে ওই নাবালকটিরও ব্যবস্থা হয়। এ বিষয়েও ওই বৃদ্ধটি বিচলিত।
পিতৃদেবের চিঠিখানি নিয়ে সে গিয়ে দেখা করল হারওয়েলের সর্বময় কর্তা স্যার জনের সঙ্গে। স্যার জন বাস্তববাদী। সোজা কথার মানুষ। বললেন, হারওয়েলের তিন-নম্বরের চাকরির চেয়ে নিঃসন্দেহে কিয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকের পদ আকর্ষণীয়। কিন্তু আরও একটা প্রশ্ন আছে। তুমি কি নিজের ন্যাশনালিটি বদলাতে প্রস্তুত? কিয়েল বর্তমানে রাশিয়ান গভর্নমেন্টের এক্তিয়ারে। কম্যুনিজমকে মেনে নিতে পারবে তো?
ভেবে দেখি–বলে ফিরে এসেছিল ক্লাউস।
এরপর দেখা করেছিল প্রফেসর কার্ল-এর সঙ্গে। রোনাটা খুব খুশি হয়েছে এমন ভাব দেখালো। বললে, নিশ্চয়ই নেবে এ চাকরি। প্যাস্টর ফুকসকে এই শেষ সময়ে কে দেখবে, তুমি ছাড়া? তাছাড়া ব-এর কথাটাও ভাবা দরকার। কিয়েলে গিয়ে সংসার পেতে বস। আর একটা কথা। বিয়ে কর এবার। তাহলে বব-এর একটা হিল্লে হয়ে যায়।
–আর আমি যদি বাবাকে লিখি ববকে এখানে পাঠিয়ে দিতে?
–তুমি মানুষ করতে পারবে? একা?
–কেন? তুমি তো আছ? ও তোমার কাছে থাকবে।
–দেবে আমাকে?-উৎসাহ উপচে পড়ে রোনাটার দু-চোখে। তারপরেই হঠাৎ সে কেমন বদলে যায়। বলে, কী স্বার্থপরের মতো কথা বলছি। তা কেন? তুমিই বরং কিয়েলে চলে যাও। সংসারী হও।
–প্রফেসর কার্ল কী পরামর্শ দেন?–ক্লাউস জিজ্ঞাসা করে।
–আমার আদৌ এতে সম্মতি নেই–প্রফেসর কার্ল-এর সাফ জবাব।
–কেন?
–সেটা পরে তোমাকে বলব।
রোনাটা চট করে উঠে দাঁড়ায়। বলে, পরে কেন? এখনই বল; আমি চলে যাচ্ছি।
-না না, তা বলিনি আমি।–প্রফেসর বিব্রত হয়ে ওঠেন।
রোনাটাও হেসে হালকা করে পরিবেশটা। বলে, না, রাগ করে উঠে যাচ্ছি না। কফি করে আনি।
প্রফেসর কার্ল তৎক্ষণাৎ বলেন, ক্লাউস, তুমি ডক্টর কাপিৎজার নাম শুনেছ? ফুঁ হেসে বলে, স্যার দুনিয়ার এমন কোনো নিউক্লিয়ার ফিজিসিস্ট আছে যে, লর্ড রাদারফোর্ডের শ্রেষ্ঠ ছাত্রটির নাম শোনেনি।
–তিনি এখন কোথায় জান?
–ঠিক জানি না। আন্দাজ করতে পারি। মস্কো অথবা লেনিনগ্রাডে–কিয়েলেও হতে পারেন। ডক্টর কাপিৎজা আজকের রাশিয়ার সবচেয়ে বড় নিউক্লিয়ার ফিজিসিস্ট।
তোমার দ্বিতীয় বক্তব্যটা ঠিক, প্রথমটা নয়। ডক্টর কাপিৎজা বর্তমানে আছেন সাইবেরিয়ায়। বন্দীজীবন যাপন করছেন তিনি। তার অপরাধ, স্তালিনের হুকুমে তিনি অ্যাটম-বোমা বানাতে অস্বীকার করেছিলেন। বলেছিলেন এজন্য লর্ড রাদারফোর্ড প্রোটন আবিষ্কার করেননি।
বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যায় ক্লাউস। অস্ফুটে বলে, আমি বিশ্বাস করি না। কী করে জানলেন?
-কী করে জানলাম সেটা বলব না। তবে আমার কথা অভ্রান্ত সত্য বলে মেনে নাও।
ডক্টর কাপিৎজা ছিলেন লর্ড রাদারফোর্ড-এর ডান হাত। কেমব্রিজ বীক্ষণাগারে রাদারফোর্ড-এর তখন তিনজন শিষ্য প্রতিভার স্বাক্ষরে ভাস্বর–কাপিজা, চ্যাডউইক আর অটো কার্ল। সে হিসাবে প্রফেসর কার্ল হচ্ছেন কাপিজার সতীর্থ। এর মধ্যে কাপিজার সম্ভাবনাই ছিল সবচেয়ে বেশি। যদিও বাস্তবে চ্যাডউইকই সবচেয়ে নাম করেছেন–নিউট্রন আবিষ্কার করে নোবেল লরিয়েট হয়েছেন।
কাপিৎজা ছিলেন প্রাণবন্ত, উচ্ছল! রাদারফোর্ড-এর সবচেয়ে প্রিয় ছাত্র। রাদারফোর্ড ছাত্রকে একটি সুন্দর ল্যাবরেটরি বানিয়ে দিয়েছিলেন। কাপিৎজা সেই ল্যাবরেটারির প্রবেশপথে বসিয়েছিলেন একটি মর্মরমূর্তি–বিখ্যাত ইংরেজ ভাস্কর এরিক গিলকে দিয়ে। একটি কুমিরের মূর্তি! কুমির কেন? সাংবাদিকরা প্রশ্ন করল দ্বারোদ্বাটনের দিন। কাপিৎজা গম্ভীর হয়ে বললেন–’কুমীর কখনও ঘাড় ঘোরাতে পারে না। সে সিধে সামনের দিকে চলে। সেই হচ্ছে আমার বিজ্ঞান-সাধনার প্রতীক।‘
সাংবাদিকরা অবাক হয়। প্রফেসর রাদারফোর্ড তাদের জনান্তিকে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন–আমার ছাত্রটির মাথায় দু-চারটে স্ক্রু আলগা।
এবার সাংবাদিকেরা হেসেছিল।
হেসেছিল কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররাও। মুখ লুকিয়ে। তারা জানত, জনান্তিকে কাপিৎজা রাদারফোর্ড-এর নতুন নামকরণ করেছে-’কুমীর-সাহেব। রাদারফোর্ড তা জানতেন না, কিন্তু ল্যাবরেটারির বেয়ারাটা পর্যন্ত জানত এ গুপ্তরহস্য। কাপিজা তাই তার বিজ্ঞানমন্দিরে বসিয়েছে কুমীরের মূর্তি-গুরুদক্ষিণা।
নতুন ল্যাবরেটারির উদ্বোধন হল 1933-এ। ঠিক তার পরেই রাশিয়া থেকে একটি আমন্ত্রণ পেয়ে কাপিৎজা গেল স্বদেশে। মক্সো বিজ্ঞান-অধিবেশনে যোগ দিতে। সেটাই হল ওর সর্বনাশের সূত্রপাত। ফিরে আসতে দেওয়া হলনা কাপিৎজাকে। স্তালিন জানালেন, অতঃপর ওকে রাশিয়াতে থেকেই বিজ্ঞানচর্চা করতে হবে। কাপিজ্জা নিজের জন্মভূমিতে অন্তরীণ হল। গোপনে সে খবর পাঠালো রাদারফোর্ডের কাছে–জানালো, সে কেমব্রিজে ফিরে আসতে চায়। তার নতুন ল্যাবরেটারিতে। লর্ড রাদারফোর্ড মস্কোর কর্তৃপক্ষের কাছে চিঠি লিখলেন। তার ছাত্রকে ফিরে আসতে দেবার অনুমতি দেওয়া হোক। রাশিয়ান সরকার প্রত্যুত্তরে লিখল-ইংল্যান্ডের পক্ষে একথা লেখা খুবই স্বাভাবিক। তারা খুশি হবে কাপিৎজা যদি কেমব্রিজে গবেষণা করেন। অনুরূপভাবে আমরাও খুশি হব, যদি লর্ড রাদারফোর্ড মস্কোতে এসে গবেষণা করেন।
রাদারফোর্ড এরপর ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বল্ডউইনের দ্বারস্থ হলেন। লর্ড রাদারফোর্ডের অনুরোধে বল্ডউইন সরকারি পর্যায়ে এ অনুরোধ জানালেন। কিন্তু কিছুতেই কিছু হল না। কাপিৎজার এক আত্মীয়া লন্ডনে সোভিয়েত এম্বাসিতে গিয়ে স্বয়ং অ্যাম্বাসাডারকে নাকি বলেছিলেন, এভাবে ইচ্ছার বিরুদ্ধে কাপিজাকে আপনারা কিছুতেই আটকে রাখতে পারবেন না। ওর মাথা পাথরের মতো শক্ত। বুঝেছেন?
রাশিয়ান রাষ্ট্রদূত নাকি জবাবে হেসে বলেছিলেন, ফর য়োর ইনফরমেশন ম্যাডাম, জোসেফ স্তালিনের মাথাটাও জেলির মতো নয়।
রাদারফোর্ডকে লেখা কাপিজার শেষ চিঠিটায় (1933) ছিল একটা বিজ্ঞানোত্তর দার্শনিক তত্ত্ব : After all, we are only small particles of floating matter in a stream which we call Fate. All that we can manage is to deflect our tracks slightly and keep afloat–the stream governs us.
[যত যাই বলুন, আমরা প্রবহমান খরস্রোতে ভাসমান তৃণখণ্ড বইতো নই? ওই স্রোতটারই অপর নাম নিয়তি। বড় জোর খড়কুটোর মতো একটু এপাশ-ওপাশ সরে-নড়ে বেড়াতে পারি, কোনোক্রমে ভেসে থাকতে পারি–আমাদের গতি নিয়ন্ত্রিত হবে ওই স্রোতেরই নির্দেশে।]
এরপর রাদারফোর্ড যা করে বসলেন তা তার মতো আত্মভোলা বৈজ্ঞানিকের পক্ষেই শুধু সম্ভব। তিনি কাপিৎজার জন্য তৈরি সদ্যসমাপ্ত ল্যাবরেটারির সব যন্ত্রপাতি খুলে ফেললেন। বড় বড় ক্রেটে সমস্ত যন্ত্রপাতি ভরে পাঠিয়ে দিলেন মস্কোতে। রাশিয়ান সরকারকে লিখলেন–কাপিৎজার সঙ্গে কেমব্রিজ ল্যাবরেটারির অঙ্গাঙ্গী সম্পর্ক। এটা রাজনীতির কথা নয়, বিজ্ঞানের হিসাব! ও আপনারা বুঝবেন না। তাই কাপিজা যখন কেমব্রিজে আসতে পারল না, তখন কেমব্রিজই তার কাছে যাক।
এমনকি তিনি জাহাজে করে পাঠিয়ে দিলেন সেই পাথরের কুম্ভীর মূর্তিটাকেও।
মস্কোর সোনার খাঁচায় ময়না ‘রাধাকৃষ্ণ’ পড়েছিল কিনা পশ্চিম দুনিয়া সেকথা জানতে পারেনি।
এরপর লৌহ যবনিকার এপারে বহির্বিশ্বে কাপিৎজার কণ্ঠস্বর মাত্র একবার শোনা গিয়েছিল। 1946-এ। বিকিনি অ্যাটলে যখন আমেরিকা থার্মোনিউক্লিয়ার বোমার বিস্ফোরণ ঘটালো তখন কাপিৎজার একটা বাণী কেমন করে জানি লৌহ যবনিকা ভেদ করে এপারে আসে। কাপিৎজা বলেছিলেন :
“To speak about atomic energy in terms of atomic bomb is comparable with speaking about electricity in terms of electric chair.”
[পারমাণবিক শক্তির প্রয়োগ হিসাবে যাঁরা পারমাণবিক-বোমার কথাই শুধু চিন্তা করতে পারেন, তারা বোধকরি বিদ্যুৎ-শক্তির প্রয়োগ-হিসাবে শুধু ইলেকট্রিক চেয়ারের কথাই ভাবেন।]
***
অনেক পরে জানা গেছে কাপিৎজা সোভিয়েত সরকারের নির্দেশে বেশ কিছুদিন তার বিজ্ঞানমন্দিরে কাজ করেন। সরকারের সঙ্গে তাঁর প্রথম বিরোধ বাধল যখন নির্দেশ এল এবার পরমাণু-বোমা বানাতে হবে। বিরোধ ঘনীভূত হল; কারণ কাপিৎজা অস্বীকৃত হলেন। তার চাকরি যায়। ওই বিজ্ঞানমন্দিরে প্রবেশের অধিকার খোয়ালেন কাপিৎজা। এরপর গৃহবন্দীর জীবন। তবু স্তালিনের প্রস্তাবে স্বীকৃত হলেন না তিনি। তাঁর সাফ জবাব–এজন্য তার গুরু রাদারফোর্ড অথবা গুরুভাই চ্যাডউইক পরমাণুর হৃদয় বিদীর্ণ করেননি। বলেছিলেন, ওই উদ্দেশ্যে পরমাণুর হৃদয় বিদীর্ণ করার আগে আমি নিজের হৃৎপিণ্ডটা বিদীর্ণ করব।
স্তালিনের আদেশে কাপিৎজাকে নির্বাসনে পাঠানো হল। টেস্টটিউব, ব্যুরেট আর সাইক্লোট্রোন নিয়ে যাঁর জীবন কেটেছে এবার তার হাতে তুলে দেওয়া হল গাইতা আর হাতুড়ি। সশ্রম কারাদণ্ড। সাইবেরিয়ায়।
কাপিৎজার সমাধি কোথায় কেউ জানে না।
..দীর্ঘ কাহিনি শেষ করে প্রফেসর কার্ল বলেন, আই হেট দিজ কম্যুনিস্ট। আমার সনির্বন্ধ অনুরোধ তুমি কিয়েল-এ চলে যেও না। তার চেয়ে অনেক-অনেক ভালো হারওয়েলের এই তিন নম্বর চাকরি। এখানে আমরা মানুষের কল্যাণের জন্য প্রাণপাত করছি। স্যার জন তো এ বছরেই অবসর নিচ্ছেন। আমি আর কদিন? হয়তো তিন-চার বছরের ভিতরেই তুমি এখানকার কর্ণধার হয়ে বসবে। তা ছাড়া
বাধা দিয়ে ক্লাউস বলে, প্রফেসর, আপনি কাপিৎজার সম্বন্ধে এত খবর পেলেন কোথায়?
প্রফেসর কার্ল একটু বিব্রত হয়ে বলেন, সে যেখান থেকেই পাই।
তবু বলুন না?
–না। বলায় বাধা আছে। তবে যা বলছি তা নিছক সত্য।
–আপনি শুনেছেন একপক্ষের কথা। সোভিয়েত-বিরোধীদের প্রচার।
–না না। আই হ্যাভ হার্ড ইট ফ্রম দ্য হর্সেস মাউথ। খাঁটি লোকের মুখ থেকে।
–কিন্তু কে সেই খাঁটি লোক?
–বলছি তো–তা বলা চলে না তোমাকে।–প্রায় ধমকের সুরে বলেন উনি।
ক্লাউস চুপ করে যায়। প্রফেসরও একটু বিব্রত হয়ে পড়েন। একেবারে অন্য সুরে বলেন, তার চেয়ে তুমি তোমার বোনপো বব-কে নিয়ে এস। সে আমাদের পরিবারেই থাকবে। রোনাটার একটা অবলম্বন হবে। আর তাছাড়া…
আবার চুপ করে যান। ইতস্তত করেন। শেষ পর্যন্ত মনের দ্বিধা ঝেড়ে ফেলে বলেন, তুমি চলে গেলে ও একেবারে মুষড়ে পড়বে। ও তোমাকে খুব ভালোবাসে।
ঠিক সেই মুহূর্তেই কফির ট্রে হাতে নিয়ে এ ঘরে আসছিল রোনাটা। কথাটা কানে গেল তার। থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে সে। আর এ ঘরে এল না। পর্দা সরিয়ে একটু পরে রোনাটার মেড-সার্ভেন্ট ডরোথি কফির ট্রে নিয়ে প্রবেশ করল। সেদিন আর রোনাটা ওদের সামনে আদৌ এসে দাঁড়াতে পারেনি।
কিন্তু দিনতিনেক পরে সে এসে দাঁড়ালো ফুকস-এর মুখোমুখি। জনান্তিকে। বলল, প্লিজ ক্লাউস, তুমি ওই চাকরি নিয়ে কিয়েল চলে যাও।
ক্লাউস অবাক হয়। বলে, কেন বলতো? তোমার গরজ কী?
রোনাটার কণ্ঠস্বর একটুও কাঁপল না। সে স্পষ্ট গলায় পরিষ্কার ভাষায় বললে, তুমি বুঝতে পার না? আমি আর সহ্য করতে পারছি না। তোমার দূরে চলে যাওয়াই মঙ্গল। তোমাকে আমি ভুলতে চাই। তোমাকে…তোমাকে আর সহ্য করতে পারছি না আমি।
কী জবাব দেবে বুঝে উঠতে পারে না ক্লাউস। চট করে সে উঠে দাঁড়ায়। হ্যাট-র্যাক থেকে টুপিটা নিয়ে বলল, চলি।
তারপর দরজা কাছ পর্যন্ত এগিয়ে বললে, তুমি আজ উত্তেজিত। না হলে আমিও মন খুলে দু-একটা কথা বলতাম।
শান্ত সমাহিত স্বরে রোনাটা বললে, কেন? আমাকে কি উত্তেজিত মনে হচ্ছে?
–হ্যাঁ। তুমি জোর করে তোমার উত্তেজনা ঢেকে রেখেছ।
-মোটেই নয়। তোমার কিছু বলার থাকলে স্বচ্ছন্দে বলতে পার। আমি প্রস্তুত।
ক্লাউস ফিরে এসে বসে তার চেয়ারে। বলে, সব কথা প্রফেসরকে খুলে বললে কেমন হয়?
–সব কথা মানে?
-তুমি তাকে ডিভোর্স করতে চাও। আমি তোমাকে বিবাহ করতে চাই। বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো উঠে দাঁড়ায় রোনাটা। মুখখানা সাদা হয়ে যায় তার। ঠোঁট দুটো নড়ে ওঠে। তারপর সে অসীম বলে আত্মসম্বরণ করে। স্পষ্টভাবে বলে, এ কথা আর কোনোদিন উচ্চারণ কোরো না।
ধীরপদে চলে যাবার জন্যে পা বাড়ায়। ক্লাউস পিছন থেকে বলে, কারণটা বলে যাবে না?
দ্বারের কাছে দাঁড়িয়ে পড়ে রোনাটা। বলে, প্রয়োজন ছিল না। দশ বছর আগে কারণটা তুমিও বলেনি। তবে প্রশ্ন যখন করলে তখন আমি কারণটা জানাব। আমি মনে-প্রাণে রোমান ক্যাথলিক। বিবাহ আমার কাছে ইন্দ্রিয় ব্যভিচারের একটা পাসপোর্ট নয়। তুমি যা ভাবছ তা নয়। প্রফেসরকে আমি ভালোবাসি, শ্রদ্ধা করি–ঠিক যতটা আমার বাবাকে ভালোবাসতাম।
ক্লাউস আরও কিছু কথা বলতে চায়; কিন্তু তাকে থামিয়ে দেয় রোনাটা : আমার মনে হয়, এর পর তোমার এ বাড়িতে না আসাই মঙ্গল।
.
০৪.
হারওয়েলে ব্রুনো পন্টিকার্ভোর চাকরি শেষ পর্যন্ত হল না, প্রফেসর কার্লের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও। তবু একটা ব্যবস্থা হল, প্রফেসর কার্ল-এর সুপারিশেই। লিভারপুল ইনস্টিক্ট ওকে একটা ভালো চাকরির অফার দিল। পারমাণবিক শক্তিকেন্দ্রে নয়, পদার্থবিজ্ঞানীর মামুলি কাজ। তবে মাইনেটা ভালো। ব্রুনো এককথায় রাজি হল। ধন্যবাদ জানালো প্রফেসরকে। তৎক্ষণাৎ সে লিভারপুল কর্তৃপক্ষকে জানালো অনতিবিলম্বেই সে ওই চাকরিতে যোগ দেবে। তবে তার আগে সে একবার ইটালিতে যেতে চায়। মিলানে আছেন তার বৃদ্ধ পিতামাতা। যুদ্ধান্তে তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়নি। ওই সঙ্গে সে একবার সুইডেনেও যেতে চায় সস্ত্রীক। সুইডেন-এর রাজধানী স্টকহম হচ্ছে ব্রুনোর শ্বশুরবাড়ি। সেখানে আছেন ফ্রাই পন্টিকোর্ভোর পিতা মিস্টার নর্ডব্লম এবং তাঁর স্ত্রী। দিন-পনেরোর ব্যাপার। এ ছাড়া সুইজারল্যান্ডের শ্যামনীতে একটি বিজ্ঞান-কংগ্রেস থেকে সে আমন্ত্রণ পেয়েছে। সেখানেও যেতে হবে ফেরার পথে। সব মিলিয়ে প্রায় তিন সপ্তাহ। লিভারপুল কর্তৃপক্ষ রাজি হলেন। চাকরিটা তারা মাসখানেক খালি রাখবেন। ব্রুনো কন্টিনেন্ট যাবার জন্য তৈরি হয়।
আর্নল্ড ইতিপূর্বেহ খবর পেয়েছে, ব্রুনো পন্টিকার্ভো একজন সন্দেহভাজন ব্যক্তি। কিন্তু তার বিরুদ্ধে কোনো প্রত্যক্ষ অভিযোগ নেই। কোনো প্রমাণ নেই। ব্রুনো ন্যাচারালাইজড ব্রিটিশ প্রজা। ইটালিতে তার বাবা-মা এবং সুইডেনে শ্বশুর-শাশুড়ি আছেন। ইয়োরোপে ভ্রমণের পাসপোের্টও আছে তার, আছে ওইসব দেশের ভিসা। তাকে আটকানোর কোনো প্রশ্নই ওঠে না। তাছাড়া সে তো কিছু পালিয়ে যাচ্ছে না, যাচ্ছে মাত্র এক মাসের জন্য। তার টিকি বাঁধা আছে। লিভারপুলে। হুঁ হুঁ বাবা! চাকরি বলে কথা।
অধ্যাপক কার্ল ব্রুনোর জন্য একটি বিদায় ভোজের আয়োজন করলেন। ব্রুনো আপত্তি করেছিল। বলেছিল, আমি তো মাত্র এক মাসের জন্যে যাচ্ছি প্রফেসর। বিদায় ভোজ কীসের?
-তা কেন? তুমি তো হারওয়েলে আর ফিরছ না। ফিরছ লিভারপুলে।
–তা বটে।
এই বিদায় ভোজে ঘটল পর পর দুটো ঘটনা যাতে চঞ্চল হয়ে উঠল আর্নল্ড। প্রথম ঘটনা ঘটল টেনিস-কোর্টে।
ব্রুনো খুব ভালো টেনিস খেলত। য়ুনিভার্সিটিতে সে বহুবার কাপ-মেডেল পেয়েছে। এমনকি যুদ্ধের সময় কানাডাতে চক-রিভারে যখন অ্যাটমিক এনার্জি কমিশনে চাকরি করত তখনও ব্যক্তিগত চ্যাম্পিয়নশিপে সে প্রথম হয়েছিল। বিদায় ভোজের সন্ধ্যায় খেলার আয়োজন হল। শেষ গেমটা খেললেন মিসেস সেলিগম্যান আর ব্রুনো। ব্রুনোই জিতল। প্যাভেলিয়নে ফেরার পথে–ব্রুনো হঠাৎ বললে, কে বলতে পারে, আবার হয়তো একদিন আমরা খেলব। সেদিন আপনি জিতবেন।
মিসেস সেলিগম্যান থমকে দাঁড়িয়ে পড়েন। বলেন, মানে? আমরা তো আবার খেলব নিশ্চয়ই। একমাস পরেই। আপনি এমনভাবে বললেন কথাটা!
উচ্চৈঃস্বরে হেসে ওঠে ব্রুনো। সামলে নিয়ে বলে, এসব কথা একটু রোম্যান্টিক গলায় বললেই শুনতে ভালো লাগে না কি?
ততক্ষণে মিসেস সেলিগম্যানও হেসে ফেলেন।
দ্বিতীয় ঘটনা ঘটল রাত্রে খাবার সময়। সবাই যখন আনন্দ উৎসবে মগ্ন তখন রোনাটার হঠাৎ খেয়াল হল, হেলেনা খানাকামরায় নেই। রোনাটা একটু অবাক হয়ে বেরিয়ে এল ঘর থেকে বারান্দায়। সেখানেও হেলেনা নেই। একটু খোঁজ করতেই দেখা গেল হেলেনা নিজের ঘরে চুপ করে বসে আছে। তার চোখ দুটো ভেজা।
-তুমি এখানে?
মুহূর্তে হেলেনা নিজেকে সামলে নেয়। রুমালে মুখটা মুছে নিয়ে বললে, কিছু নয়, চল ওঘরে যাই।
ঘটনাটা সামান্য। তবুও অদ্ভুত। মিসেস ব্রুনো যাচ্ছে বেড়াতে-ইটালি আর সুইডেনে। তাহলে?
***
পঁচিশে জুলাই ওরা রওনা হয়ে গেল। ডানকার্ক হয়ে প্রথম যাবে সুইজারল্যান্ডে। সেখান থেকে ইটালি। ওরা যেদিন রওনা হয়ে গেল ঠিক তার পরের দিন, ছাব্বিশ তারিখে, আর্নল্ডের কাছে এসে পৌঁছালো একটা কেবলগ্রাম। সুদূর মার্কিন মুলুক থেকে। কোড মেসেজে এফ. বি. আই. স্কটল্যান্ড-ইয়ার্ডকে জানাচ্ছে : অনুমান করার যথেষ্ট কারণ দেখা যাচ্ছে যে, ব্রুনো পন্টিকার্ভোই আসলে ডগলাস। তাকে অবিলম্বে গ্রেপ্তার করুন। প্রমাণাদি পাঠাচ্ছি।
এ তারবার্তা যখন এসে পৌঁছালো তখন ব্রুনো সপরিবারে চলেছে। সুইজারল্যান্ড ছেড়ে ইটালির দিকে। একটু ঘুরপথে দেশ দেখতে দেখতেই যাচ্ছে। ব্যস্ততা কী? তাকে তো আর বাঘে তাড়া করেনি। অস্ট্রিয়ার ইনস্বার্গের কাছাকাছি এসে ‘ইন’ নদীর অববাহিকা ধরে চলেছে সে ব্রেনার পাস্-এর দিকে, যেখানে এককালে ইউরোপ-কেক কাটার প্ল্যান করতে বসেছিলেন হিটলার আর মুসোলিনি! স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের অভিজ্ঞ গোয়েন্দা স্কার্ডন রওনা হয়ে গেল প্লেনে। ব্রুনো ক্রমাগত দেশ থেকে দেশান্তরে যাচ্ছে। বিদেশে তাকে গ্রেপ্তার করা সহজ নয়। বিদেশে তাকে গ্রেপ্তার করতে হলে সে দেশের অনুমতি চাই। তবে ব্যস্ত হবার কিছু নেই–ব্রুনোর জন্য খাঁচা বানানো হয়েছে লিভারপুলে। পাখি খাঁচায় ফিরে আসবেই। তখনই ঝাঁপ বন্ধ করতে হবে। স্কার্ডন-এর ওপর আদেশ ছিল শুধু নজর রেখ সে যেন সাম্যবাদ-ঘেঁষা কোনো দেশে না যায়। অবশ্য সে সব দেশে যাওয়ার ছাড়পত্রও ছিল না ব্রুনোর পাসপোর্টে।
ব্রুনো সপরিবারে মিলানে এসে পৌঁছলো বারোই আগস্ট। বাবা-মার সঙ্গে দেখা করল। মিলানের দ্রষ্টব্য জিনিসগুলি দেখাল স্ত্রীকে। স্কালা, মিলান-গির্জা, লেঅনার্দোর লাস্ট সাপার। জেমস্ স্কার্ডন এখানেই তার সন্ধান পায়। টুরিস্টের বেশে সে বরাবরই ছিল কাছে কাছে। এরপর ব্রুনো চলে যায় সিসেরোতে। সেখানে বাইশে আগস্ট স্কার্ডন দেখল কী একটা উৎসব হচ্ছে। কী ব্যাপার? শোনা গেল, ব্যাপার এমন কিছু গুরুতর নয়, ব্রুনো পন্টিকার্ভোর সেটা সাঁইত্রিশতম জন্মদিন। তার পর দিন ওরা চলে এল রোমে। ছায়ার মতো অনুসরণ করে চলেছে স্কার্ডন। তবে বারে বারে ভোল পালটাচ্ছে। মিলানে সে ছিল আমেরিকান টুরিস্ট–চোখে চশমা, দাড়ি-গোঁফ কামানো। রোমে সে হচ্ছে ফরাসি চিত্রকর। একমাথা চুল, একমুখ দাড়ি, চোখে গগল্স, হাতে রং-তুলি, ঈজেলের ব্যাগ। ব্রুনো অথবা হেলেনা যেন লক্ষ্য না করে একজন তোক ক্রমাগত তাদের পেছন পেছন। ঘুরছে–মিলান থেকে সিসেরো, সেখান থেকে রোম।
***
উনত্রিশে আগস্ট ব্রুনো সস্ত্রীক রোমের সিটি অফিসে এল একদিন। স্ক্যান্ডিনেভিয়ান এয়ারওয়েজ-এর বুকিং কাউন্টারে। সেখানে গিয়ে সে জিজ্ঞাসা করল সুইডেন-এর রাজধানী স্টকমে যাওয়ার ভাড়া কত। ব্রুনো নিশ্চয় খেয়াল করেনি, কিউ-সরীসৃপে ঠিক ওর পেছনেই দাঁড়িয়ে ছিল একজন ফরাসি আর্টিস্ট। চাপ দাড়ি, চোখে গগস, মাথায় বাউলার হ্যাট। বুকিং ক্লার্ক কী জবাব দিল তা। শুনতে পেল না স্কার্ডন। কিন্তু দেখল ব্রুনো তার ওয়ালেট খুলে নোট বার করছে। ঠিক এই সময় হেলেনা তার স্বামীর জামার হাতটা ধরে টানল। কী যেন বলল, জনান্তিকে। ব্রুনো লাইন ছেড়ে একটু দূরে সরে গেল। স্বামী-স্ত্রীতে কী জাতীয় জনান্তিক আলাপচারিতা হল তাও শুনতে পেল না স্কার্ডন। কিউ-সরীসৃপে স্কৰ্ডনের পিছনে যে ছিল সে তাকে একটা কুনুইয়ের গোঁত্তা মেরে বললে, ততক্ষণ আপনি টিকিটটা কেটে ফেলুন না মশাই? ওঁদের দাম্পত্যসম্ভাষণ শেষ হতে হতে কাউন্টার বন্ধ হয়ে যাবে।
স্কার্ডন আর কোনমুখে বলে–তা কি পারি স্যার? উনি যখন যেখানে যাবেন তখন সেখানেই যে যাব আমি। সে বরং ভাব দেখায় যেন ভদ্রলোকের কথা আদৌ বুঝতে পারছে না। তা তো হতেই পারে–সে ফরাসি আর্টিস্ট, ইটালিয়ান ভাষা সে জানে না। পেছনের লোকটি তখন ওকে গোঁত্তা মেরে সরিয়ে দেয়। ভাষা না বুঝলেও গোঁত্তা সবাই বোঝে। স্কার্ডন সরে আসে। ভদ্রলোক তখন তার টিকিট কাটে। ইতিমধ্যে কথাবার্তা সেরে ব্রুনো ফিরে এল কাউন্টারে। বললো, চারখানা স্টকহমের টিকিট দিন। টুরিস্ট ক্লাস। আমার, স্ত্রীর আর বাচ্চাদের। আমারটা হবে রিটার্ন টিকিট।
হিসাব করে কাউন্টারের লোকটা বললে, সবশুদ্ধ ছয়শ দুই ডলার।
ব্রুনো তার ব্যাগ খুলে সাতখানা কড়কড়ে একশ ডলারের নোট বার করে। লোকটা বললে, দু ডলার খুচরো দিন।
ওয়ালেট হাতড়ে ব্রুনো বললে, দুঃখিত। খুচরো নেই।
কথাবার্তা আদ্যন্ত হচ্ছিল ইটালিয়ান ভাষায়। ফরাসি চিত্রকরটির বোঝার কথা নয়। কিন্তু সে মনে মনে হাসল। দুটি ব্যাপারে খুশি হয়েছে সে। প্রথমত, ব্রুনো নিজের টিকিট রিটার্ন কাটল। দ্বিতীয়ত, বেশ বোঝা যাচ্ছে সে কোনো সূত্র থেকে ডলার পাচ্ছে। অঢেল টাকার মালিক-আমেরিকান টুরিস্ট ছাড়া সচরাচর এমন একশ ডলারের করকরে নোট কেউ বার করে না। ভাঙানি আটানব্বই ডলার নিয়ে ব্রুনো চলে যেতেই স্কার্ডন এগিয়ে এল কাউন্টারে। টিকিট কাটল। স্টকহমের। একই দিনের। একই প্লেনের।
পয়লা সেপ্টেম্বর এস. এ. এস. প্লেনে মিউনিক-কোপেনহেগেন হয়ে সপরিবারে ব্রুনো এসে পৌঁছালো স্টকহমে। প্লেন থেকে নেমে এয়ার-টার্মিনালে এল ওরা। ছায়েবানুগত যথারীতি ফরাসি চিত্রকর ভদ্রলোকও। মালপত্রগুলি তখনও এসে পৌঁছায়নি। ব্রুনো ট্যাগ হাতে মালের জন্য প্রতীক্ষা করছে। স্কার্ডন ওর হাত থেকে হাত- তিনেক দূরে একটা বুকস্টলে দাঁড়িয়ে অন্যদিকে ফিরে সিগারেট খাচ্ছে আর ফরাসি ম্যাগাজিনের পাতা ওল্টাচ্ছে। হঠাৎ একটা কথায় চমকে উঠল স্কার্ডন। ব্রুনোর বড় ছেলে ইটালিয়ান ভাষায় প্রশ্ন করল, মাম্মি! এটাই কি রাশিয়া!
ব্রুনো হঠাৎ ধমক দিয়ে উঠল, বকবক কর না। চুপ করে দাঁড়িয়ে থাক।
স্কার্ডন তখন মনে মনে ভাবছে ওর চমকটা কি লক্ষ্য করেছে ব্রুনো? নিশ্চয় নয়। সে তো এক-সেকেন্ডের দশভাগের একভাগ সময় মাত্র চমকে চোখ তুলে তাকিয়েছে ওর ছেলের দিকে। ব্রুনো নিজেও নিশ্চয় চমকে উঠেছিল। সে খেয়াল করবে না। তাছাড়া ব্রুনো স্কার্ডনকে হারওয়েলে কোনোদিন দেখেনি। তার ওপর সে ছদ্মবেশে আছে। সর্বোপরি সে বর্তমানে ফরাসি চিত্রকর, ইটালিয়ান ভাষা জানে না। ফলে ব্রুনো নিশ্চয়ই আতঙ্কিত হবে না।
হেলেনা তার স্বামীকে বললে, এয়ারপোর্ট থেকেই সোজা বাবার ওখানে চলে। যাই না কেন?
ব্রুনো বললে, সেটা ভালো দেখায় না। আমি ওইজন্যে হোটেল কঁতিনেতালে আগে থেকেই ঘর বুক করে রেখেছি। হোটেলে পৌঁছে তোমার বাবাকে ফোন করব।
স্কার্ডন পাকা গোয়েন্দা। কোনো ফাঁদে পা দিতে সে প্রস্তুত নয়। সে তৎক্ষণাৎ সরে যায় ‘ওয়েটিং হল’-এর অপরপ্রান্তে। পাবলিক টেলিফোন বুথে ঢুকে পড়ে। কাঁচের ঘর। ওখান থেকে ব্রুনো পরিবারকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। নজর এড়াচ্ছে না। গাইড হাতড়ে বার করে হোটেল কঁতিনেতাল-এর নম্বর। ডায়াল করে সেই নম্বরে। রিসেপশান ধরতেই বললে, একটু দেখে বলুন তো ডক্টর ব্রুনো পন্টিকার্ভোর নামে ঘর বুক করা আছে কিনা।
ওপ্রান্তে সুকণ্ঠী মহিলাটি বললেন, আছে। আপনিই কি ডক্টর পন্টিকার্ভো?
-না না। আমি ওঁর একজন বন্ধু। তার সঙ্গে ওখানে আমার একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে। যাই হোক রুম নম্বরটা কত?
–825 এবং 126।
–ধন্যবাদ।
এবার নিশ্চিন্ত হয়ে ও বেরিয়ে আসে পথে। তখনও ব্রুনোর মালপত্র প্লেনের গর্ভ থেকে ওখানে এসে পৌঁছায়নি। একটা ট্যাক্সি নিল স্কার্ডন। বললে, হোটেল কঁতিনেতাল।
ওখানেই উঠল সে। আটতলাতেই ঘর পেল। 811। এটা 826-এর ঠিক উল্টোদিকে এবং রাস্তার দিকে। মালপত্র নিয়ে ঘরে চলে গেল স্কার্ডন। ঘরটা বন্ধ। করে গিয়ে বসল জানলার ধারে। যেখানে বসে হোটেলের প্রবেশপথটা দেখা যায়। সুটকেস থেকে বাইনোকুলারটা বার করল। যতক্ষণ ব্রুনো পরিবার হোটেলে এসে
পৌঁছাচ্ছে ততক্ষণ ও নিশ্চিন্ত হতে পারছে না। অবশ্য চিন্তা করার কিছু নেই। এখানেই ঘর রিজার্ভ করা আছে তার। ঘণ্টাখানেক অপেক্ষা করে কেমন যেন। সন্দিগ্ধ হয়ে পড়ে স্কার্ডন। ব্যাপার কী? ঘরে তালা মেরে সে নেমে এল রিসেপশানে। কাউন্টারে যে মেয়েটি ছিল তাকে প্রশ্ন করে, ডক্টর ব্রুনো পন্টিকার্ভোর নামে কোনো রিজার্ভেশান আছে?
মেয়েটি একটি রেজিস্টার দেখে বললে, আছে। দুখানা ঘর। নাম্বার 825 এবং 826। আজই তার আসার কথা। এয়ারপোর্ট থেকে তিনি ফোনও করেছেন। এখনই আসছেন বললেন।
–ধন্যবাদ। আচ্ছা কতক্ষণ আগে তিনি ফোন করেছেন বলুন তো?
–ধরুন ঘণ্টাখানেক আগে।
–ডক্টর ব্রুনো কি নিজেই ফোন করেছিলেন? না তার বন্ধু?
বন্ধু আগে করেছিলেন। তার মিনিট পনেরো পরে ডক্টর নিজেই ফোন করেন।
স্কার্ডন নিশ্চিন্ত হয়ে নিজের ঘরে ফিরে এল।
কিন্তু একী! আরও ঘণ্টা দুই কেটে গেল। ব্রুনো এলো না। এবার আর। কাউন্টারে গিয়ে খোঁজ নিতে সাহস হল না। বেশি কৌতূহলী হলে চিহ্নিত হয়ে পড়বে। ফোন করল পরপর 825 এবং 826 নং ঘরে। দু জায়গাতেই ফোন বেজে গেল। কেউ ধরল না। অর্থাৎ ওর নজর এড়িয়ে কোনো অসতর্ক মুহূর্তে ব্রুনো পরিবার আসেনি। এতক্ষণে একটু নার্ভাস হয়ে পড়েছে স্কার্ডন। চাকরির রেকর্ডে তার দাগ পড়েনি ইতিপূর্বে। এমন হাতের মুঠো থেকে শিকার ফসকালে সে মুখ দেখাবে কী করে? কিন্তু ওরা যাবে কোথায়? তবে নিশ্চয় মিসেস ব্রুনোর পীড়াপীড়িতে শেষ পর্যন্ত মত বদলেছে ব্রুনো। সোজা চলে গেছে শ্বশুরবাড়ি। এমনও হতে পারে ওর শ্বশুর এয়ারপোর্টে গিয়েছিলেন। দেখা হয়ে গেছে। মেয়ে-জামাইকে পাকড়াও করে নিয়ে গেছেন। এইটেই একমাত্র সমাধান। স্কার্ডন ঘড়ির দিকে তাকায়–রাত এগারোটা। অর্থাৎ ইতিমধ্যে চারঘণ্টা হয়ে গেছে। টেলিফোন ডাইরেক্টারি হাতড়ে বার করল একটা নম্বর। ডায়াল করল। মহিলাকণ্ঠে কেউ বললেন, হ্যালো!
ইটালিয়ান ভাষায় স্কার্ডন বলে, মিস্টার নর্ডব্লম-এর বাড়ি?
–হ্যাঁ। মিসেস নর্ডব্লম বলছি। কাকে চান?
–দেখুন, আপনি আমাকে চিনবেন না। আমি ডক্টর ব্রুনোর একজন বন্ধু। সে আমাকে লিখেছে আজ সে এখানে আসবে–
–আমরাও তো তাই জানি। ব্রুনো একা নয়। তার সপরিবারে আসার কথা। কিন্তু তারা তো এখনও এসে পৌঁছায়নি।
–কিন্ত রোম-সার্ভিস তো ঠিক সময়েই এসেছে। সে তো ঘণ্টাচারেক হল।
তবে বোধহয় কোনো হোটেলে উঠেছে। আপনার নামটা বলুন। ও এলে বলব।
-কিছু মনে করবেন না। তাকে একটা সারপ্রাইজ দিতে চাই। সে এলে দয়া করে ওকে বলবেন না আমি ফোন করেছিলাম।
-ও আচ্ছা, আচ্ছা। তবু আপনার নাম্বারটা বলুন। ও এলে আপনাকে রিং করব।
–আমি একটা পাবলিক বুথ থেকে ফোন করছি। আমি কাল সকালে নিজেই ফোন করব বরং। শুভরাত্রি
কিন্তু রাত্রিটা বোধহয় ‘শুভ’ নয়। ও তৎক্ষণাৎ বের হয়ে পড়ল হোটেল থেকে। ট্যাক্সি নিয়ে চলে গেল এয়ারপোর্টে। সমস্ত ব্যাপারটাই কেমন যেন ধোঁয়াটে লাগছে। ওখানকার সিকিউরিটি অফিসারকে আত্মপরিচয় দিল। তার সাহায্য চাইল। আন্তর্জাতিক সৌজন্যের খাতিরে সিকিউরিটি অফিসার ওকে সাহায্য করতে রাজি হলেন। রাত সাতটার পর যে সব যাত্রীবাহী প্লেন বিমানবন্দর ত্যাগ করেছে তার তালিকাটি দেখাই হল প্রথম কাজ। বেশি খুঁজতে হল না। দেখা গেল রাত নটার একটা প্লেনে ডক্টর ব্রুনো স্বনামে টিকিট কেটে সপরিবারে হেলসিঙ্কি চলে গেছেন। ফিনল্যান্ড যাবার পাসপোর্ট ছিল তার।
সর্বনাশ! পরবর্তী প্লেনে স্কার্ডন চলে গেল হেলসিঙ্কি। বৃথাই। সেখানে সংবাদ পাওয়া গেল, পূর্ববর্তী প্লেনে ডক্টর ব্রুনো সপরিবারে এসেছিলেন। কিন্তু তিনি তারপর কোথায় গেলেন কেউ জানে না।
অনেক পরে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড অনুমান করেছে–হয় এখান থেকে রাশিয়ান এম্বাসির সহযোগিতায় ডিপ্লোম্যাটিক পাসপোর্টে ব্রুনো ছদ্মবেশে রাশিয়ায় চলে যান। অথবা মোটরে করে তাদের সঙ্গে সীমান্ত পার হয়ে যান। মোট কথা, ব্রুনোর খবর আর পাওয়া যায়নি।
অ্যালান নান মে ধরা পড়ল। আর ব্রুনো পন্টিকার্ভো–এ কাহিনির দু-নম্বর গুপ্তচর ডাস-হাওয়ায় মিলিয়ে গেল।
সাত বছর পরে প্রাভদায় প্রাকশিত একটি প্রবন্ধে ব্রুনোর অন্তর্ধান-রহস্যে শেষ যবনিকাপাত ঘটল। জানা গেল, ব্রুনো বহাল তবিয়তে মস্কোতে একটি বৈজ্ঞানিক গবেষণাকার্যে নিযুক্ত আছেন। হেলেনার সঙ্গে তার বাপ-মায়ের আর কোনোদিন সাক্ষাৎ হয়নি।
নিঃসন্দেহে ব্রুনো বুঝতে পেরেছিল তাকে সন্দেহ করছে এফ. বি. আই. এবং স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড। লিভারপুলে চাকরি নেওয়া, শ্যামনীতে কনফারেন্সে যাবার প্রতিশ্রুতি, রোমে রিটার্ন-টিকিট কাটা, স্টকহমের হোটেলে দুখানি ঘর ভাড়া করা সবই তার দীর্ঘমেয়াদি পলায়নপ্রকল্পের প্রস্তুতি। নিঃসন্দেহে সে মিলানের আমেরিকান টুরিস্ট এবং রোমের ফরাসি আর্টিস্টটিকে চিহ্নিত করেছিল। আর সেই জন্যেই সে স্টকহম এয়ারপোর্টে স্ত্রীকে উচ্চকণ্ঠে জানিয়েছিল তার হোটেলের নাম। স্কটল্যান্ড-ইয়ার্ডের পাকা গোয়েন্দার নাকে ঝামা ঘষে দিয়ে যেভাবে সে পালালো সেটা গোয়েন্দা গল্পেই সম্ভব–যদিও এটা আদ্যন্ত বাস্তব ইতিহাস।
ব্রুনো বোধকরি আর একটা প্রমাণ রেখে গেল ফাইনম্যানের সেই ঋষিবাক্যটির :E = mc^2 অপরাধ-বিজ্ঞানী কোনোদিনই বুঝবে না; কিন্তু ধূর্ততার প্রতিযোগিতায় নিউক্লিয়ার ফিজিসিস্টের কাছে পাকা-গোয়েন্দাও-ফুস।
‘অ্যালেক’ শেষ হয়েছে, ‘ডগলাস’ শেষ হল–এবার বাকি রইল পালের গোদা : ডেক্সটার। তার কথাই বলি :