2 of 3

কেন চোখের জলে

কেন চোখের জলে

ঠাকুর বলছেন, বেদাদি অনেক শাস্ত্র আছে, কিন্তু সাধন না করলে তপস্যা না করলে ঈশ্বরকে পাওয়া যায় না। ষড়দর্শনে দর্শন মেলে না, মেলে না আগম- নিগম তন্ত্রসারেও। তবে শাস্ত্রে যা আছে, সেইসব জেনে নিয়ে সেই অনুসারে কাজ করতে হয়। একজন একখানা চিঠি হারিয়ে ফেলেছিল। কোথায় রেখেছে মনে নেই, তখন সে প্রদীপ নিয়ে খুঁজতে লাগল। দু-তিনজন মিলে খুঁজে চিঠিখানা পেলে। তাতে লেখা ছিল পাঁচ সের সন্দেশ আরেকখানা কাপড় পাঠাবে। সেইটুকু পড়ে নিয়ে সে আবার চিঠিখানা ফেলে দিলে। তখন আর চিঠির কি দরকার।

ঠাকুর বলছেন, পড়ার চেয়ে শোনা ভাল, শোনার চেয়ে দেখা ভাল। গুরুমুখে বা সাধুমুখে শুনলে ধারণা বেশি হয়, আর শাস্ত্রের অসার ভাগ চিন্তা করতে হয় না। হনুমান বলেছিল, ‘ভাই, আমি তিথি-নক্ষত্র অতসব জানি না, আমি কেবল রাম-চিন্তা করি। শোনার চেয়ে দেখা আরো ভাল। দেখলে সব সন্দেহ চলে যায়।’ তাহলে তাঁর দিকে এগোবার প্রধান বাধা হলো সন্দেহ। তিনি আছেন, না তিনি নেই! প্রবল সংশয়। তিন সংশয়। তিনি আছেন; তাহলে আমি যা চাই, তা পাই না কেন? আমার সব আশা পূর্ণ হয় না কেন?

ঠাকুর হাসলেন। ঈশ্বরের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক কি দেনদার আর পাওনাদারের! তুমি চাইবে আর তিনি দিয়ে দেবেন! ঠাকুর হাসতে হাসতে বললেন : “তা বটে; সময় নাহলে কিছু হয় না।… যাকে যা দেবার তাঁর সব ঠিক করা আছে। সরার মাপে শাশুড়ি বৌদের ভাত দিত। তাতে কিছু ভাত কম হতো, একদিন সরাখানি ভেঙে যাওয়াতে বৌরা আহ্লাদ করছিল। তখন শাশুড়ি বললেন, ‘নাচ কোঁদ বৌমা, আমার হাতের আটকেল আছে। ‘

তিনি দেবেন, তাঁর ব্যবস্থা মতো, মাপ মতো, মর্জি মতো! মানুষ যেমন প্রার্থীকে, ভিখারিকে, স্তাবককে, তোষামোদকে ঘৃণা করে, তিনিও সেইরকম ঘ্যানঘ্যানেকে সহ্য করতে পারেন না। উপেক্ষা করেন। মা জানেন অবোধ শিশুটির কখন কি প্রয়োজন। ছেলে সকালে উঠে কি খাবে, কোন্ জামা পরবে! কখন তাকে স্নান করাতে হবে, ঘুম পাড়াতে হবে। শিশুর মতো নিজেকে সমর্পণ করে দিতে হবে তাঁর কোলে। বিশ্বাস, অবিশ্বাসের প্রশ্ন নেই। যদি সেই প্রশ্ন মনে উঁকি মারে তাহলে বুঝতে হবে তুমি ছিটকে গেছ। ঠাকুর প্রশ্ন করছেন, তাহলে কি হবে?

কি করব তা তো জানি না। দুঃখে, সুখে, সংশয়ে, বিশ্বাসে, দোল খাচ্ছি। আপনিই বলুন ঠাকুর।

“তাঁকে আমমোক্তারি দাও। তিনি যা ভাল হয় করুন। বড়লোকের ওপর যদি ভার দেওয়া যায়, সে লোক কখনো মন্দ করবে না।”

কিন্তু সাধনার প্রয়োজন আছে। সে-সাধনা হলো ধীরে ধীরে তাঁর দিকে সরে যাবার প্রয়াস। নিজের হাতটি তাঁকে ধরিয়ে দেবার সাধনা। এখন তুমি কোন্ পথ নেবে? বানরের না বেড়ালের? সে আবার কি? ঠাকুর বলছেন : “একরকম সাধকের বানরের ছা-র স্বভাব, আরেক রকম সাধকের বিড়ালের ছা-র স্বভাব। বানরের ছা নিজে যো-সো করে মাকে আঁকড়িয়ে ধরে। সেইরূপ কোন কোন সাধক মনে করে, এত জপ করতে হবে, এত ধ্যান করতে হবে, এত তপস্যা করতে হবে, তবে ভগবানকে পাওয়া যাবে। এ-সাধক নিজে চেষ্টা করে ভগবানকে ধরতে যায়। বিড়ালের ছা কিন্তু নিজে মাকে ধরতে পারে না। সে পড়ে কেবল মিউ মিউ করে ডাকে। মা যা করে। মা কখনো বিছানার ওপর, কখনো ছাদের ওপর, কাঠের আড়ালে রেখে দিচ্ছে। মা তাকে মুখে করে এখানে ওখানে লয়ে রাখে, সে নিজে মাকে ধরতে জানে না। সেইরূপ কোন কোন সাধক নিজে হিসাব করে কোন সাধন করতে পারে না—এত জপ করব, এত ধ্যান করব ইত্যাদি। সে কেবল ব্যাকুল হয়ে কেঁদে কেঁদে তাঁকে ডাকে। তিনি তার কান্না শুনে আর থাকতে পারেন না, এসে দেখা দেন।

চাওয়া নয় কান্না। তাঁর ঐশ্বর্য নয়, খোদ তাঁকেই চাওয়া। যমরাজ নচিকেতাকে খুব লোভ দেখাচ্ছেন—রাজ্য নাও, বাহন নাও, এমন ভোগ নাও, যা কেউ কখনো ভোগ করেনি, দীর্ঘতম জীবন নাও। তুমি সব নাও; কেবল আত্মতত্ত্ব জানতে চেও না। আত্মদর্শনের বাসনা ত্যাগ কর। কারণ আত্মা সম্পর্কে দেবতাদেরও সংশয় আছে। নচিকেতা বললে, দেবতাদেরও সংশয়? আপনার মুখেই শুনলুম তবু জেনে, রাখুন, আত্মজ্ঞান ছাড়া আমার কাছে সবই তুচ্ছ।

“যস্মিন্নিদং বিচিকিৎসন্তি মৃত্যো
যৎ সাম্পরায়ে মহতি ক্ৰহি নস্তৎ।
যোহয়ং বরো গূঢ়মনুপ্রবিষ্টা
নান্যং তস্মান্নচিকেতা বৃণীতে।।” (কঠ উপনিষদ্, ১।১।২৯ )

আত্মতত্ত্ব ছাড়া নচিকেতা আর কিছুই চায় না।

বড়বাবুকে যখন পেয়েছি তখন বড়বাবুকেই চাই। নচিকেতার গোঁ। কি চাই তোমার? বড়বাবু কৃপা করবেন। নায়েবকে বলবেন, দাও, দু-দশটাকা দিয়ে দাও। তখন খপ করে তাঁকে চেপে ধরে বলব প্রভু! আর তো চাহি না কিছু, তোমাকেই চাই।

“প্রভু, তোমা লাগি আঁখি জাগে,
দেখা নাই পাই পথ চাই,
সেও মনে ভাল লাগে।।
ধুলাতে বসিয়া দ্বারে, ভিখারি হৃদয় হা রে
তোমারি করুণা মাগে;
কৃপা নাই পাই
শুধু চাই,
সেও মনে ভাল লাগে।।”

ঠাকুর আপনি বলেছেন—”জীব প্রথমে অজ্ঞান হয়ে থাকে। ঈশ্বরবোধ নাই, নানা জিনিস বোধ—অনেক জিনিস বোধ। যখন জ্ঞান হয় তখন তার বোধ হয় যে, ঈশ্বর সর্বভূতে আছেন। যেমন পায়ে কাঁটা ফুটেছে, আরেকটি কাঁটা যোগাড় করে এনে ঐ কাঁটাটি তোলা। অর্থাৎ জ্ঞান-কাঁটা দ্বারা অজ্ঞান-কাঁটা তুলে ফেলা। আবার বিজ্ঞান হলে দুই কাঁটাই ফেলে দেওয়া—অজ্ঞান-কাঁটা এবং জ্ঞান-কাঁটা। তখন ঈশ্বরের সঙ্গে নিশিদিন কথা, আলাপ হচ্ছে—শুধু দর্শন নয়। যে দুধের কথা কেবল শুনেছে সে অজ্ঞান, যে দুধ দেখেছে তার জ্ঞান হয়েছে; যে দুধ খেয়ে হৃষ্টপুষ্ট হয়েছে তার বিজ্ঞান হয়েছে।”

যদি কিছু নাও হয় এই জন্মে, অজ্ঞান থেকে যেন জ্ঞানে যেতে পারি। বিশ্বাস। সর্বোত্তম হলো বিশ্বাস। আপনি বলেছেন : “ইনিই আমার ইষ্ট।” এইটি ষোল আনা বিশ্বাস হলে—তাঁকে লাভ হয়, দর্শন হয়। আগেকার লোকের খুব বিশ্বাস ছিল।

আমি যেন সেই ‘আগেকার লোক’ হতে পারি। হলধারীর পিতার মতো। ওইটাই আমার অ্যাম্বিশান। স্নানের পর জলে দাঁড়িয়ে তিনি মন্ত্র পড়তেন, রক্তবর্ণং চতুর্মুখম্—চোখ জলে ভেসে যেত।

মা তুমি আর কিছু না দাও, চোখের জল দাও। তাঁর কথায় যেন বুক ভেসে যায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *