‘কেন আরো ভালোবেসে যেতে পারে না হৃদয়’

‘কেন আরো ভালোবেসে যেতে পারে না হৃদয়’

মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায় নামটি একজন শিল্পীর নাম, না একটা সঙ্গীত-প্রতিষ্ঠানের নাম! এক মহান সুরস্রষ্টার নাম, না একজন সঙ্গীত-আচার্যের নাম তা সংজ্ঞায়িত করা আমার মতো এক ক্ষুদ্র সঙ্গীত-পথিকের পক্ষে খুবই দুঃসাধ্য৷ কারণ বিস্তৃত পরিধির ব্যক্তিত্বের মূল্যায়ন করতে হলে স্ববিস্তৃত ভূমির সীমানা জানা খুব জরুরি, যা আমার সম্পর্কে আমার জানা আছে বলেই, বিচিত্রগামী সঙ্গীতসাধক শ্রদ্ধেয় মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায় সম্পর্কে আমার লিখতে যাওয়া নিশ্চিতভাবে সীমানা অতিক্রম করা বলে আমি মনে করি৷ তবু ‘আজকাল’-এর অনুরোধে ঢোক গিলেছি একটিমাত্র প্রলোভনে যে, আমি আমার প্রিয় মানবদা সম্পর্কে সামান্য কিছু হলেও লিখতে পারার সুযোগ পাব বলে৷ পাঠকবর্গ দয়া করে আমার দৃষ্টির ও বোধের ব্যাসার্ধ ছোট জেনেই আমার আঁকা ছবির দৃশ্যায়নকে মূল্যায়ন করবেন৷ আমি তাঁর জীবনপঞ্জির ইতিহাস লিখতে বসিনি৷ সে কাজ আমার না৷ আমি নাড়াচাড়া করব কেবল মানুষ হিসেবে এবং সঙ্গীতজ্ঞ হিসেবে আমার সীমানায় মানবদা যতটুকু ধরা পড়েছেন ততটুকুই, তার অধিক একটুও নয়— বোধহয় সেটা সম্ভবও নয়৷

মনে পড়ছে, আমার সুরে গাওয়া প্রথম দুটি গান রেকর্ডিংয়ের কথা৷ গান দুটির একটি ‘মুক্ত ছড়া নেইকো কন্যা’ ও অপর পিঠে ‘এই নিরিবিলি স্বর্ণালি সন্ধ্যায়’৷ দুটিরই রচনা আনন্দ মুখোপাধ্যায়ের৷ মুক্ত ছড়া গানটিতে যে কন্যার রূপকল্প আমার ভাবা ছিল তা একজন চতুর্দশী থেকে ষোড়শীর মধ্যে হবে৷ কিন্তু যখন রেকর্ড হচ্ছে, আমি দেখছি, মানবদা ও তবলার কিংবদন্তি কারিগর রাধাকান্ত নন্দী সেই পাড়াগেঁয়ে পাঠশালায় পড়া মেয়েটিকে একজন সুশিক্ষিত কলেজের ছাত্রী করে উপস্থাপনা করছেন৷ আমার আঁকা নিরাভরণ কন্যাটিকে যখন দেখলাম জড়োয়া ও খাঁটি সোনার অলঙ্কারে সুসজ্জিতা এক সম্ভ্রান্ত নারী, তখন আমি স্থিরভাবে দাঁড়িয়ে ভাবছি— এটা কী হল? আমার interpretation তো পুরো বদলে গেল; কিন্তু যেটা হল সেটা কী হল? কী দাঁড়াল এমনই ভাবছি, আর এই সাঙ্গীতিক জটিলতাকে সরলীকরণ করে নেব কিনা৷ আমার স্বীকার করতে এতটুকু কুণ্ঠা নেই, শ্রদ্ধেয় তবলাশিল্পী রাধাকান্ত নন্দী ও সুদক্ষ লয়কারী শ্রদ্ধেয় মানবদা লয় ও তাল নিয়ে এমন খেলা খেলছেন যে, আমি সঙ্গীত-পরিচালক হয়ে এবং গানটির সুরকার হয়েও তালের মাত্রাকে সঠিকভাবে বুঝে উঠতে পারছি না৷ অত্যন্ত বুদ্ধিমান ও সঙ্গীতবোদ্ধা ছিলেন তখনকার যিনি গ্রামোফোন কোম্পানির প্রতিনিধি, স্বনামধন্য গীতিকার পবিত্র মিত্র৷ তিনি একটি বিড়ি খেতে খেতে, প্যান্টের বাঁ পকেটে হাত ঢুকিয়ে ফ্লোরের মধ্যে এলেন৷ কিছুক্ষণের মধ্যেই নির্ভুলভাবে অনুধাবন করেছিলেন ওঁদের ও আমার অবস্থার মধ্যে একটা প্রাচীর তৈরি হয়েছে৷ পবিত্রদা তাঁর স্বভাবোচিত ভঙ্গিতে বললেন— ‘মিঃ মুখার্জি! আমি জানি আপনি তালে খুব পাকা, কিন্তু একটু তালে গাইবার চেষ্টা করেন৷’ অর্থাৎ আড়ি, কো আড়ি এই সব জটিল অঙ্কতে গানের সরল মেয়েটি অত্যন্ত জটিল হয়ে পড়ছিল, তিনিও তার সরলীকরণ চাইলেন৷ পবিত্রদা, মানবদার মধ্যে যে নিবিড় ও আন্তরিক সম্পর্ক ছিল তারই মজাদার প্রকাশ পবিত্রদার ওই ‘মিঃ মুখার্জি’ সম্বোধন৷ না হলে ওটার ভাষা হত— ‘মানব৷ আড়ি কো আড়ি কইর্যা গাইও না৷’ একটা সৃষ্টিশীল কাজে যখন একাধিক ব্যক্তির মিলিত প্রচেষ্টায় সেটা রূপ পায়, তখন সবাই সহজ সরল আন্তরিক মনোভাব নিয়ে এই সাবলীলভাবেই বাণী বিনিময় করে, তা না হলে কাজটির মধ্যে প্রাণ প্রতিষ্ঠা হয় না, জড়তা আসে৷

ততক্ষণে আমি নিজে কিন্তু মানবদার ওই পারফরমেন্স ও সঙ্গে রাধাকান্তবাবুর অনবদ্য সঙ্গতে মুগ্ধ৷ তাই বাধা দিলাম না তাঁদের মিলিত প্রচেষ্টায়৷ আমার হিসেবে গানটি গীত হলে কেমন হত জানি না, কিন্তু যেভাবে গীত হয়েছে গানটি তাতেই প্রবল জনপ্রিয় এবং মানবদার গায়কী চিহ্নিত যে-সব গান তার মধ্যে এই গানটিও যুক্ত হয়েছে৷ এ প্রসঙ্গে আমার সবথেকে বড় একটি স্বীকারোক্তি হচ্ছে এই যে, তাঁদের লয়কারী তা পরবর্তী সময়ে মানবদার গান শুনে শুনে আমার সঙ্গীতবোধে তালের মধ্যে লয়ের যে খেলা, তার শিক্ষার বেশ কিছুটা আয়ত্ত করতে সাহায্য করেছিল৷ চেষ্টা করতাম যখনই একটি গানে লয়কারী করার সুযোগ আছে বুঝতাম বা এখনও বুঝি, তখনই আমার মাথায় ক্রিয়া করেন মানবদা— তাঁর অভিব্যক্তির শারীরিক ভাষা৷ মানবদার গান মানেই শিক্ষিত সঙ্গীতসাধকের সাধনলব্ধ উপলব্ধির হৃদয়-মূর্ছনা৷

আমার এই উক্তি শুনে পাঠকবর্গ হয়ত ভাবতে পারেন মানবদার গান মানেই ওস্তাদের কেরামতি আর পাণ্ডিত্যের গৌরব, তা কিন্তু নয়৷ তাঁর জ্ঞানলব্ধ সঙ্গীতবোধ বৈষ্ণবের প্রেম নির্ঝর হয়ে যে বারবার বিদগ্ধজনের হৃদয় স্পর্শ করেছে, আপ্লুত করেছে, তার অজস্র প্রমাণ আছে৷ একটি গান তো আমি বলব যে, যে প্রবাদবাক্য আছে ‘প্রিয়রে করেছি দেবতা আর দেবতাকে করেছি প্রিয়’— এই বাণীরই এক আলোময় দীপ্ত অভিব্যক্তি৷ সেই গানটি হচ্ছে, ‘আমি এত যে তোমায় ভালোবেসেছি/তবু মনে হয়/এ যেন গো কিছু নয়/কেন আরো ভালোবেসে যেতে পারে না হৃদয়’৷ শ্রদ্ধেয় কবি শ্যামল গুপ্তের এই রচনায় মানবদার সুর সংযোজন ও পরিবেশন আমায় এই বিশ্বাসের অনুভূতি সম্পৃক্ত করে যে, মৃন্ময়ীকে ভালবেসে তার মধ্যে যে চিন্ময়ীর মূর্তি প্রকাশ হয়, তা সত্য, সত্য, সত্য৷ আমি আবেগাপ্লুত হয়ে ভাবি শরীরের ক্ষুধা তৃষ্ণা আহার পানীয় দ্বারা নিবৃত্ত হয়, কারণ তা নশ্বরের সেবা করে, আর প্রেম করে অবিনশ্বরের পূজা৷ তাই যতই প্রেমের বিকাশ হয় ততই তার বিস্তৃতি৷ ততই তার অন্তরের অভিসার, অন্তরের খোঁজ, যার শেষ নেই, লয় নেই৷ যেমন এক প্রেমিক বা প্রেমিকা তার দয়িত বা দয়িতাকে ভালবেসে আকাঙ্ক্ষার হৃদয়ের পরিধিকে অসীমের প্রতি ধাববান করে, এ গান যেন সেই অসীম ভালবাসার স্রোতে অনন্তে অবগাহন করার৷ প্রেমিক বা প্রেমিকা যেমন মানুষী বোধে ভাবে আমার এ ভালবাসারজনকে কেন আরও ভালবাসতে পারি না— ভগবতসাধক বা সাধিকাও তেমনই ভাবেন কেন গুরুকে তেমনভাবে ভালবাসতে পারি না? এই গান যেমন ভাষায় সমৃদ্ধ, সুরে ঐশ্বর্যময়, গায়নে মাধুর্যময়, তেমনই আধ্যাত্মিক রস-বৈভবযুক্ত৷ এই গান শুনলে আমার চোখে জল আসে, মন আত্মমগ্ন হয় আপন প্রেমের কান্তাবোধে৷ শিল্পী, প্রেমিক মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের এই গান তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ প্রেমসঙ্গীত, যা শিল্পমাধুর্যে বৈষ্ণবের ভাব লীলাময় অনুষঙ্গ৷

এই গানটির বিষয় বলতে গিয়ে মনে পড়ে গেল অন্য একটি গানের কথা৷ ‘কত আশা নিয়ে তুমি এসেছিলে’— এই গানটির স্থায়ীর অংশের দ্বিতীয় লাইনটি সুরের আন্তরিকতায় ও গায়কীর সত্যনিষ্ঠ প্রেমবোধের আর একটি ঐশী অভিদ্যোতনা৷ ‘কেন পেয়ে তবু হারাতে হল’ এবং তার concluding line-এর সুর ও প্রকাশের অভিব্যক্তি মিলিয়ে-মিশিয়ে প্রেমের একটা আত্মিক সহবাসের বিভূতি বিধৃত করেছে৷ যা রাধাকৃষ্ণ প্রেমের অন্তর্নিবাস৷ মনে পড়ে যায় রবীন্দ্রনাথের বাণী— ‘বাংলা গানে বাণী ও সুরের সম্পর্ক সার্থক দাম্পত্য সম্পর্কের মতো৷’ অর্থাৎ কেউ কারও ওপরে জোর খাটাতে পারবে না৷ উভয়ের মিলিত একমর্মী বোধে সংসার হবে সুন্দর৷

এই গানের বাণীর প্রেক্ষিতে কিছু বাড়তি কথা বলছি এবং তা সোজাসুজি মানবদা বিষয়ক নয়, কিন্তু পরোক্ষভাবে কথাগুলো প্রাসঙ্গিত হয়ে পড়ে৷ এক সময় গীত-রচয়িতা অজয় ভট্টাচার্য, শৈলেন রায়, প্রণব রায়কে যেভাবে কবি বলে স্বীকার করা হত, তা গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার, শ্যামল গুপ্ত, পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়, পবিত্র মিত্র, মুকুল দত্ত ও অন্য গীতিকারদের বেলায় আজও গণ্য করা হয় না৷ সলিল চৌধুরিও সেভাবে কবি বলে আদৃত হনইনি— যাঁর রচিত একটি আস্ত কবিতাগ্রন্থ আছে৷ ‘শপথ’-এর মতো কবিতা যাঁর রচনা৷ কথাটা উত্থাপন করলাম এই জন্যে, আধুনিক কবিদের দরবারে গীত-রচয়িতারা শুধুই গীতিকার, কবি নয় বলে পরিমাপিত৷ কথাটা অত্যন্ত আপত্তিকর৷ গীতিকবিতাও কবিতা৷ আর সেই সব গীতিকবিতার কবিত্ব স্বীকৃত না হলে কিন্তু লালন ফকিরও বাদ যাবেন কবি হিসেবে; কিন্তু আধুনিক কবিরা তাঁর মতো জীবনকে ক’জন উপস্থাপনা করতে পেরেছেন! গৌরীদার ‘মুছে যাওয়া দিনগুলি আমায় যে পিছু ডাকে’, পুলকবাবুর ‘কোনদিন বলাকারা এত দূরে যেত কি ঐ আকাশ না ডাকলে?’ পবিত্রদার ‘কাজল নদীর জলে’, মুকুল দত্তের ‘যখন ডাকল বাঁশি তখন রাধা যাবে যমুনায়’, ভাস্কর বসুর ‘আমি চরণ কোথা নূপুর’— এমন অজস্র লাইন আছে যা সাধারণ মানুষের বুকের অনুভবে, আপন প্রেমসাধানায় জড়িয়ে আছে৷ এই স্বীকৃতি কটা আধুনিক কবিতার ভাগ্যে জুটেছে জানি না৷ আর এই গীতিকবিতার কাব্যধর্মিতাই ছিল মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের লিরিক নির্বাচনের মূল প্রেরণা৷ মানবদার সাঙ্গীতিক শিক্ষা ও ব্যক্তিগত শিক্ষার মিলিত অনুভবই মানবদাকে কাব্যধর্মী সঙ্গীতবাণী বেছে নেওয়ার প্রেরণা দিত এবং সেই পুষ্টির জন্যে তাঁর দরবারে প্রথম স্থান ছিল কবি গীত-রচয়িতা শ্যামল গুপ্তের৷ চলচ্চিত্রেও সব সময় শ্যামল গুপ্তকে সঙ্গী করেই মানবদা কাজগুলো করতেন, যা কেবল বন্ধুত্বের তাগিদে নয়, গীতিকবিতার কবিত্ব ও বড় আদর্শগত অনুপ্রেরণায়৷

মানবদা মানে শাস্ত্রীয়সঙ্গীত, মানবদা মানে ওস্তাদি গান, সঙ্গীতের উপক্রমণিকা— এমন ভাবনা কেবল অমূলক নয়— অন্যায়, অবিচার৷ মানবদা যদিও শেষ দিকে এই অচলায়তনের মধ্যে নিজেকে একটু আবদ্ধ করে ফেলেছিলেন, যা তাঁর শিল্পনন্দন বোধকে মানুষের কাছে কিছুটা আড়াল করে দেয়৷ কিন্তু এই মহান শিল্পীকে ভালবেসে তাঁর উৎকর্ষতা যদি আন্তরিকভাবে অনুসন্ধান করা যায় তখন বোঝা যাবে, নিশ্চিতভাবে হৃদয়ঙ্গম হবে কত বড় একটা জাতশিল্পী আমাদের প্রিয় মানবদা৷ নচিকেতা ঘোষের দৃষ্টি ছিল পাকা জহুরির দৃষ্টি৷ তাই তিনি তাঁর কণ্ঠে গান নির্বাচন করলেন, ‘ও আমার চন্দ্রমল্লিকা’৷ গভীর প্রেমের অভিব্যক্তি মানবদাকে নিবিড়ভাবে আকর্ষণ করত৷ মারপিট, দাঙ্গা-হাঙ্গামা পছন্দ ছিল কিন্তু প্রেমিক মনটা ছিল ঐশী বোধে নৈসর্গিক৷ নচিদা মানবদাকে নানা দিক থেকে দেখেছেন, তাই তো ‘নবজন্ম’ ছবিতে গাওয়ালেন, ‘মনমাঝি তোর বৈঠা নে’৷ ওই গানটি না শুনলে আমি ভাবতে পারতাম না মানবদার কণ্ঠে ফোক এলিমেন্ট এত সুন্দরভাবে মানিয়ে যায়৷ আমার ‘মুক্ত ছড়া নেইকো কন্যা’ গান তাঁকে দেওয়ার কথাও ভাবতে পারতাম না৷

আমি অবশ্য তার আগেই অন্য একটি ছবিতে পুরো folk flavour-এ একটা গান মানবদাকে দিয়ে গাওয়াই৷ অসাধারণ rendering, কিন্তু আমার দুর্ভাগ্য সে ছবিটি শেষ পর্যন্ত release করেনি৷ আরও দুর্ভাগ্য, গানটি সংগ্রহ করে আমার কাছে রাখতেও পারিনি নানা কারণে৷ গানটিকে সংগ্রহে রাখলে আমার লাভ হত৷ পরম সম্পদ হিসেবে প্রমাণ থাকত folk element মানবদার কণ্ঠে কতটা বোধে বোধসম্পৃক্ত৷ সত্যিকার নির্মাতারা নির্মাণের পূর্বে যে উপাদান দিয়ে নির্মাণ করতে হবে তার উৎকর্ষতা সম্পর্কে সম্পূর্ণ সজাগ থাকেন৷ অবিসংবাদিত সুরস্রষ্টা সলিল চৌধুরিও জাত চিনতে ভুল করেনিন৷ তাই তিনি এমন একটি গান মানবদাকে দিয়ে গাওয়ালেন যা আগে অন্য কেউ ভাবতেই পারেননি৷ রত্নেশ্বর মুখোপাধ্যায়, সিদ্ধেশ্বর মুখোপাধ্যায়ের শোণিতবাহী শিল্পী মানবদাকে দিয়ে একটি এমন গান রেকর্ড করলেন, যা জাতে টপ্পা, প্রয়োগে-প্রকাশে আধুনিক৷ গানটির প্রথম লাইন ‘আমি পারিনি বুঝিতে পারিনি’৷ এই গানটিও মানবদার সঙ্গীতজীবনে একটা আলাদা জায়গা করে নিয়েছিল৷

Popular song maker সুধীন দাশগুপ্ত আর এক মহান শিল্পস্রষ্টা৷ তিনি জানতেন, বুঝতেন, কোন শিল্পীর কণ্ঠ ও দক্ষতায় নির্ভর করে কী কী উপাদান মিলতে পারে৷ তাই তিনি তাঁকে দিয়ে গাওয়ালেন একটা highly romantic গান, ‘ময়ূরকণ্ঠী রাতের নীলে’, একটা western number— যে গানটি শুনলে আমি শরমে সঙ্কুচিত হই, কারণ সেই বছর পুজোয় এই গানটি প্রকাশিত হওয়ার জন্যে রেকর্ড হয়, কিন্তু সেটা না হয়ে প্রকাশিত হল ‘মুক্ত ছড়া নেইকো কন্যা’৷ অথচ সুধীনদা নির্মিত ও মানবদার অসাধারণ গাওয়া এ গান যখন আমার প্রেমের অনুভবকে মুক্ত ছড়ার চেয়ে অনেক বেশি রোমান্টিকতায় নিয়ে ফেলে, তখন সত্য-স্বীকৃতি আত্মপ্রবঞ্চনা করতে পারে না— এ আমার লজ্জা৷ শাস্ত্রীয়সঙ্গীতের দিকপালদের দিয়ে বিদেশি সঙ্গীত-পরিকাঠামোয় গান করানোর পরীক্ষা-নিরীক্ষা এভাবে সুধীনদা ধনঞ্জয়দা, মান্নাদাকে নিয়েও করেছেন৷ তবে ‘ময়ূরকণ্ঠী রাতের নীলে’ যেন অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে তার নিজের গান হয়ে উঠেছে৷ পাঠকবর্গ একবার গানটি আমার কথার বিচার করার জন্যে নতুন করে শুনে দেখুন৷ লক্ষ্য করবেন শিল্পীর কণ্ঠের আশ্চর্য রোমান্টিকতা৷ আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বলি৷ কোনও একটি বিশেষ গানের বাণীর মধ্যে, যে জায়গায় নিবিড় গভীর প্রেমের অনুভব লেখা থাকত, সেটা পড়ে মানবদা একটু সংযমী মুচকি হাসি দিতেন৷ সে হাসি রোমান্টিকতার চরম অনুভাবী প্রকাশ— সে হাসি ‘মোনালিসা’র হাসির মতো রহস্যযুক্ত৷ এ হাসিকে হয়ত বৌদি সঠিকভাবে চিনতে পারতেন৷ তিনি সদ্যপ্রয়াত হয়েছেন, নয়ত জেনে নিতাম৷ যেমন জেনেছিলাম৷ যেদিন বুকে pain উঠল চলে যাওয়ার পূর্বে, বৌদি বলেছিলেন, তখন দাদা বলেছিলেন তাঁকে ‘আমায় বুকের মধ্যে আরও চেপে ধরো’৷ আমার মন্তব্য— প্রেম শাশ্বত৷

আবার দেখুন স্বনামধন্য সুরকার রবীন চট্টোপাধ্যায় মানবদাকে কেমন সুন্দরভাবে ব্যবহার করেছেন৷ রবীন চট্টোপাধ্যায়ের শিল্পী নির্বাচনে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় যেমন তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ প্রিয় গায়িকা— গায়কের বেলায় তা ছিল না৷ তাঁর সব বিখ্যাত বিখ্যাত গানে তিনি শিল্পী নির্বাচন করেছেন শ্যামল মিত্র বা হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে৷ যেমন ‘দীপের নাম টিয়া রঙ’ ছবিতে তাঁর মূল গায়ক শ্যামল মিত্র৷ ‘সাগরিকা’ ছবির ‘স্বপ্নে দেখা রাজকন্যা’র গায়ক শ্যামল মিত্র৷ কিন্তু ‘লালুভুলু’ ছবিতে নিলেন মানবদাকে৷ এবং এই নির্বাচন যে কতটা যথাযথ ছিল তা ‘লালুভুলু’ ছবির গানের বাজার মাত করা জনপ্রিয়তা থেকে অনুধাবন করা যায়৷ আমি বারবার দেখালাম ‘ওস্তাদ বা পণ্ডিত’-এর তকমা দিয়ে মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের সাঙ্গীতিক বিস্তৃতিতে তাঁর শিল্পীসত্তাকে অসম্মানিত করা শুধু অন্যায় বা অপরাধ নয়, ওটা একটা ঐতিহাসিক বিকৃতি৷ কেবল গায়ক হিসেবেই নয়, তিনি তাঁর সুরস্রষ্টা জীবনেও নিজে তার ছাপ রেখে গেছেন— যেখানে তিনি একশো ভাগ প্রমাণ রেখেছেন যে তাঁর সঙ্গীত-বিশ্বাস, সঙ্গীতের উপক্রমণিকা-নির্ভর নয়৷ সম্পূর্ণ কাব্যসাহিত্য অনুসারী৷ তাঁর গান mostly কাব্যসঙ্গীত৷

অনেক কম বয়স থেকেই তিনি চলচ্চিত্রে সঙ্গীত পরিচালনা করেছেন৷ যার অল্পবিস্তর তাঁকে এগোবার জায়গাও করে দিয়েছিল৷ কিন্তু মার কাটারি বলে ‘মায়ামৃগ’-তে যা করলেন, তাতে প্রমাণ হল তাঁকে সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে স্থান কেউ দয়া করে দেয়নি— স্বদক্ষতায় নিজের আসন বলব না, সিংহাসন পেতে নিতে নিজেই সক্ষম হলেন৷ সেই ছবিতে ‘ও বক বক বকুম বকুম পায়রা’ গানটিতে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠস্বর, পর্দার চলনে ওঠা-পড়ায় এমন একটি romantic আবেশে ও আবেগে শ্রোতাদের নিয়ে গেল, যা আমার বিচারে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়-গীত সমস্ত ছবির থেকে আলাদা ও রোমান্টিকতায় অদ্বিতীয়৷ আর ‘যা চলে যা’, এই Cross line-এ একটি Chello-র Counter part ব্যবহার করেছেন, Instrumental harmony করে, যা প্রেমিকার হৃদয়ে প্রেমিকের অনুভবকে প্রতিষ্ঠা করে দেয়৷ আর একটি অনবদ্য সঙ্গীত, ‘যারে যা ওরে শোন শোন গেরো বাজ’৷ এই গানটি দিয়ে আমি আজও আমার ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষা দিই৷ দেখো, ছবি আঁকতে যেমন নানা রঙ লাগে, একটা গান গাইতেও কণ্ঠে বিষয় অনুযায়ী নানা রঙ লাগে৷ যা করতে হয় tone ও তার modulation দিয়ে৷ যে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়-উত্তমকুমার Combination-এ ‘সুরের আকাশে তুমি যে গো শুকতারা’, ‘গত রজনীর অশ্রু তিমির ভেঙেছ অন্ধকারা’ গীত, সেই combination-এই ‘যারে যা’ গানটি পরিবেশিত৷ কিন্তু ‘সুরের আকাশে’র নায়ক একজন পরিশীলিত রুচিবোধের গভীর অনুভবের ব্যক্তিত্ব আর ‘মায়ামৃগ’র চরিত্রে সেই উত্তমকুমার একজন ভালমানুষ কিন্তু বেআক্কেলে রেসুড়ে৷ আর মেসে থাকা ব্যক্তি হিসেবে ভিন্ন মানসিকতার বাসিন্দাদের বন্ধু৷ তাই তার গানের মধ্যে চরিত্র অনুযায়ী সাঙ্গীতিক অভিব্যক্তি ভিন্ন ধরনের৷ মানবদা যেমন অনবদ্যভাবে, সংযমী বিবেচনা দিয়ে, সাঙ্গীতিক আঙ্গিক বদলে বদলে সুর করলেন, তেমনিভাবে গাইয়েও নিলেন হেমন্তদাকে দিয়ে৷ আমি ছাত্রছাত্রীদের প্রায় সময়েই এই গানটির দৃষ্টান্ত দিয়ে শেখাই একটা গান মানে একটা নাটক— আর নাটকটির বিষয় ও তার বিবর্তনের ওপর কুশীলবের বৈচিত্র্যময় আচরণের ওপর vocal modulation৷ Tonal variation কী করে প্রয়োগ করতে হয় শেখো— তবেই গানে বিষয়কে, বোধকে যথাযথভাবে communicate করতে পারবে৷ সর্বশেষ যে গানটি বলব সেটা মানবদার নিজের গাওয়া ‘মেটিরিয়া মেডিকার কাব্য’৷ এই গানটায় নিশ্চিতভাবে মানবদা স্বাক্ষর রাখতে সক্ষম হয়েছেন যে, তিনি puritan নয়— তিনি ঐতিহ্যনিষ্ঠ আধুনিক৷ আধুনিক শব্দবাণী ব্যবহারে তাঁর গোঁড়ামি নেই— তা বোধের খাতিরে যথাযথ৷ ইউরোপীয় সঙ্গীত ও ভারতীয় সঙ্গীতের সার্থক রসায়ন এই গানটি৷ এই রসায়ন কতটা যে সার্থক হয়েছিল তা আমায় বলে দিতে হবে না, যাঁরা এই রচনা পাঠ করছেন তাঁরা আমার থেকে সে-বিষয়ে কম ওয়াকিবহাল, এমন নয়৷

আর একটি ছবির নির্মানের কথা বলব যা মানবদার সঙ্গীতস্রষ্টা জীবনের অনবদ্য নির্মাণ৷ সেটা হচ্ছে, ‘জয়জয়ন্তী’৷ একেবারে ভিন্ন স্বাদের কাহিনী৷ এক ভিন্ন স্বাদের ছবি৷ চরিত্র বিন্যাস, treatment of charactors সব একেবারে অন্য৷ কাজেই সাঙ্গীতিক বিন্যাসও ছিল ভিন্ন আস্বাদনের৷ মানবদা সেই ছবির গানও একেবারে জাত বদলে তৈরি করেছিলেন৷ আমার সমস্ত সঙ্গিতরসিক সমাজের কাছে আন্তরিকভাবে বিনীত প্রার্থনা, আপনারা দয়া করে মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের মতো বিস্তৃত সঙ্গীতব্যক্তিত্বকে শুধুই নজরুলগীতির শিল্পী করে বা ওস্তাদ, পণ্ডিত করে রাখবেন না— মানবদার সঙ্গীতসমুদ্রে স্নাত হোন, অবগাহন করুন, সাঁতার দিন৷ খোঁজ করুন, দেখবেন আলপনা বন্দ্যোপাধ্যায় (মুখোপাধ্যায়)-এর গানে সুর করতে গিয়ে ‘মন বলছে এই সন্ধ্যায়’ গানে রাধাকান্ত নন্দীর খোরাক রাখেননি৷ উৎকর্ষতার আঙ্গিককে নির্ভর করিয়েছেন, Base Guiter, Piano, Spanish-এর ওপর৷ অপ্রয়োজনীয় সাঙ্গীতিক সঙ্কীর্ণতা মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের একেবারেই ছিল না৷ তিনি ছিলেন রবীন্দ্রনাথের গানের বাণী, ‘গানে গানে তব বন্ধন যাক টুটে’-র সনিষ্ঠ অনুগামী৷

মানুষ মানবদার সম্পর্কে দুটি ঘটনার উল্লেখ করব, যাতে পাঠকবর্গ বুঝবেন মানবদা একটি মনে দুটি স্বভাবের অধিকারী ছিলেন— একটি ক্ষমতা আর একটি মমতা৷ একদিকে মেজাজি হৃদয়, অন্যদিকে ভালবাসার স্নিগ্ধতা৷ প্রথম ঘটনাটি শ্রদ্ধেয় দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়ের কাছে শোনা৷ তার আগে একটা কথা সকলকে জানাতে চাই৷ যদি দূরবর্তী কোনও অনুষ্ঠানে, ট্রেনে করে দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়, তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায় ও নির্মলেন্দু চৌধুরি একসঙ্গে যান, সেই যাত্রায় গানটা বাদ দিয়ে আর কী কী ঘটতে পারে তা স্বয়ং ঈশ্বরের কল্পনার বাইরে৷ সেরকমই ছোট্ট একটি ঘটনা বলছি৷ মানবদা, দ্বিজেনদা ও অন্য দু-একজন শিল্পী একটি গাড়িতে কলকতার বাইরে কোনও জায়গায় অনুষ্ঠান শেষ করে ফিরছেন৷ মজা হচ্ছে, দ্বিজেনদা একটু sofisticated, aristrocrate আচরণে অভ্যস্ত আর তরুণদা হচ্ছেন চাপা দুষ্টুমির একজন সার্থক কুশীলব৷ কিন্তু মানবদা আর নির্মলদা একেবারে ডাকাবুকো ডানপিটে৷ তা, অনুষ্ঠান থেকে ফেরার পথে দ্বিজেনদা পাশে বসে থাকায় মানবদার মাথায় দুর্বুদ্ধির পোকা নড়ে উঠল৷ হঠাৎ শরীরটায় একটা আড়মোড়া ভেঙে বলে উঠলেন মানবদা— দ্বিজেন, শরীরটা বড় ম্যাজম্যাজ করছে রে (একটু ইঙ্গিতে বোঝাতে চাইলেন ঘুসোঘুসি বা মারামারির ক্ষেত্র প্রস্তুত করে উত্তাপ বাড়ানোর প্রয়োজন) হলে একটু ভাল হয়৷ দ্বিজেনদা বুঝলেন এইবার কেলেঙ্কারি একটা কিছু হবে, তিনি নিষেধ করলেন— না না মানব, এখন এ-সব করিস না৷ কে কার কথা শোনে! একটা check post-এ গাড়ি দাঁড়িয়েছে৷ মানবদা নেমে গেল৷ দ্বিজেনদা বললেন, ও মশাই কী বলব পাঁচ মিনিটের মধ্যে check post-এর কাছে একজনের সঙ্গে চিৎকার-চেঁচামেচি, প্রায় হাতাহাতি হওয়ার উপক্রম৷ দ্বিজেনদা বাধ্য হয়ে নেমে গেলেন মধ্যস্থতা করতে৷ মানবদা তখন ঘুরে দাঁড়িয়ে বললেন, চল দ্বিজেন আমার কাজ হয়ে গেছে অর্থাৎ মানবদার শরীর গরম হয়ে গেছে আর হুজ্জুতির প্রয়োজন নেই৷ ইনি সেই মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, যিনি গান গেয়েছিলেন, ‘আমি এত যে তোমায় ভালোবেসেছি/তবু মনে হয় সে যেন গো কিছু নয়/কেন আরও ভালোবেসে যেতে পারে না হৃদয়৷’

আর একটা ঘটনা৷ এটাও দ্বিজেনদার কাছে শোনা৷ একটি অনুষ্ঠানে তন্ময় হয়ে বেশ কিছু গান পরপর গেয়ে চলেছেন দ্বিজেনদা৷ ঘণ্টাখানেকের মাথায় যে গানটি শেষ হল— তারপর একটা ধাক্কা৷ দ্বিজেন তুই ওঠ, এবার আমি গাইব৷ নিজেই microphone-এ ঘোষণা করলেন, এতক্ষণ আপনারা গান শুনছিলেন দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে৷ এবার আমি মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায় গান গাইব৷ আবার দ্বিজেনদাকে— তুই ওঠ৷ আজ এই সম্পর্ক সংহতিহীন বিচ্ছিন্ন একাকিত্বের জীবনে এই সব নিবিড় বন্ধুত্বের কথা স্বপ্নেও কি ভাবা যায়? পাঠকবর্গ, বলুন?

আবার হৈমন্তীর কাছে শুনেছি ঠিক উল্টো ধরনের একটি ঘটনা৷ যেখানে তাঁর আচরণ এক হৃদয়বান বড় ভাইয়ের ভূমিকার মতো৷ সেটাও একটা বাইরের অনুষ্ঠান৷ তখন হৈমন্তীর শরীরটা ভাল যাচ্ছে না৷ সবে একটা পেটের সমস্যা থেকে আরোগ্যলাভ করেছে৷ বাইরের হোটেলের খাবার৷ হৈমন্তী খেতে বসবে, মানবদা এসে বললেন, ‘এই ছেমড়ি, তুই এই সব খাবার খাইস না৷ বিকালে গান আছে না! তোর বৌদি আমার জন্যে মাছের ঝোল ভাত দিসে— আয় হুইজনে ভাগ কইর্যা খাইয়া লই৷’ কী অনাবিল, নির্দ্বিধাগ্রস্ত স্বতঃস্ফূর্ত অভিব্যক্তি! এঁরা সাধক— যেদিন রেডিও অনুষ্ঠান থাকত, বাড়ি থেকে আগে বের হতেন৷ লিখতে লিখতে আর একটা কথা মনে পড়ছে৷ মানসী তখন জন্মায়নি৷ আমার একমাত্র কন্যা (একমাত্র সন্তান না— কারণ আমার দুই ছেলে আছে) তখন নবজাতিকা৷ মানবদা ও বৌদি ওকে নিয়ে এমন করতেন যে নিজ কন্যা নয় বলে কেউ বুঝতে পারবে না৷ একদিন অনুষ্ঠান-ফেরত রাত বারোটায় আমার বাড়ি হাজির৷ মশারি উঠিয়ে মহাশ্বেতাকে দেখে, আদর করে, আবার স্নেহবিগলিত কণ্ঠে বৌদিকে বলছেন, ‘না না চল, চলে যাই৷ ওর ঘুম ভেঙে যাবে৷’ তখন মানবদার যে মুখটার ভাব দেখেছিলাম, বর্তমান সময়ে সেই পিতৃত্বের অভিব্যক্তির প্রকাশ আর বড় দেখা যায় না৷ এক ডাকসাইটে ব্যক্তির মধ্যে কত কমনীয় রস ছিল তাই ভাবি৷ কেবল তাই নয়, সমগ্র মানুষটির স্বভাবের ছাপ ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন গানে তিনি রেখে গেছেন৷ পঙ্কজকুমার মল্লিকের মতো নিপুণ কারিগরের তত্ত্বাবধানে যখন মহালয়ায় ‘তব অচিন্ত্য’ গানটি শুনি, তখন ভাবি ধরতাইতেই কী সুরের কায়েম, কণ্ঠের মাধুর্যময় আঁকা! একটা কোমল হৃদয়ের স্পর্শ ছাড়া এ বোধিদীপ্ত প্রকাশ হয় না৷ আর এক সঙ্গীত প্রতিষ্ঠান, সর্বপ্রণম্য শ্রদ্ধেয় জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ, তিনি এমন একটি গানের বাণী তাঁর কণ্ঠে তুলে দিলেন, আমি শুনে স্তম্ভিত৷ যে বাণী সমস্ত শিল্পী কবির জীবনে এক চিরকালীন সত্য— যা আগে বোধহয় এভাবে কেউ বলেননি— যেন শিল্পীর সেই বুকের ভাষা— ‘আঁধারে আমি তোমায় খুঁজে মরি৷’ তিনি তুলে দিলেন মানবদার কণ্ঠে৷ সৃষ্টিশীল শিল্পীরা বেদনাকে নিজেরাই সৃষ্টি করে নেন, কারণ প্রসবযন্ত্রণা ছাড়া তো নবজন্ম হবে না৷ সৃষ্টিশীল হৃদয়ের সেই শাশ্বত ভাষা শ্রদ্ধেয় জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ উচ্চারণ করালেন এমন একজন শিল্পীকে দিয়ে, যাকে ঐতিহাসিক ভুল বিচারে বর্তমান সময়ে কেবলমাত্র নজরুলগীতির গায়ক বলে চিহ্নিত করছেন৷ ভুল— ভুল— ভুল৷ মানবদা ব্যক্তিজীবনে অত্যন্ত পারিবারিক ছিলেন— tender ছিলেন৷ আর সেই tenderness-এর পথ ধরে অজস্র সঙ্গীত তিনি উপহার দিয়ে গেছেন৷ সজাগ গবেষণা না করলে এত বড় মাপের শিল্পীকে বিচার করা যায় না৷ ঈশ্বর আমায় করুণা করে এই সব মহান শিল্পীর জীবন ও শিল্পনৈপুণ্যকে নানাভাবে দেখিয়েছেন, তাই আমি এত মুগ্ধ হতে পেরেছি— তাই আমি নিজেকে খুবই ধন্য বলে মনে করি৷ আমি আপনি বলে সম্বোধন করতাম কিন্তু উনি আমায় তুই বলতেন৷ তাঁর এই তুই সম্বোধন ছিল তাঁর একটি সর্বজনীন ও আন্তরিকভাবে সমৃদ্ধ৷

আবার তাঁর গানে ফিরি৷ চেনা-চেনা অন্ধ গলিপথে যাঁরা মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের গানকে বিচার করবেন, তাঁরা তাঁর প্রতি অসম্ভব অবিচার করবেন৷ তাঁর গান বারবার মনে করিয়ে দেয় কবিগুরুর ‘গানে গানে তব বন্ধন যাক টুটে’র দুটি লাইন—

‘ছন্দ তোমার ভেঙে দিয়ে দ্বন্দ্ব বাধায় প্রাণে

অন্তরে আর বাহিরে তাই তান মেলে না তানে৷’

যাঁরা ভাবেন ঘরানার ঘরের বীণা তিনি বাজিয়েছেন, তাঁরা ভুল-ভুল-ভুল৷ তাঁর কন্যা মানসী, জামাতা রাহুল, তাদের বয়স কম, তারা সম্ভবত নজরুলগীতির মানবদাকে যতটা চেনে, ততটা চেনে না প্রেমিক মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়কে— তারা অনুভব করতে পারবে না সঠিকভাবে ‘যদি আমাকে দ্যাখো তুমি উদাসী— তবু যেও না ফিরে যেও না’র সেই আন্তরিক গভীর অভিব্যক্তিকে৷ তাদের কাছে আমার বিনীত অনুরোধ, নিবেদন, তোমরাও উঁচুমাপের শিল্পী, তোমারা এই রাজপথে বুক ফুলিয়ে হাঁটা প্রেমিক-শিল্পীকে, সত্যবোধসম্পৃক্ত সুরস্রষ্টাকে শুধুই ওস্তাদের ও পণ্ডিতের মজলিশে বা পাঠশালায় বন্দী করে রেখো না৷ গবেষণা করে আবিষ্কার করো তাঁর মহান শিল্পীসত্তাকে— আকাশের পাখিকে দুটো দানা দিয়ে কৌশলে খাঁচার পাখি করে রেখো না৷ মানসীর কণ্ঠে উঠুক প্রেমিকার আবেগ৷ রাহুলের সেতারে বাজুক বিষাদী বেহাগ, রোমান্টিক ‘খাম্বাজ’৷ ‘গানে গানে তব বন্ধন যাক টুটে’৷ আমি এই প্রার্থনা তোমাদের কাছে রাখছি— বাস্তবিকই ‘গানে গানে সব বন্ধন যাক টুটে’ এই বোধ মানবদার স্বভাবের স্বতঃস্ফূর্ত ঐশ্বর্য৷ সাঙ্গীতিক আত্মমর্যাদা এবং পারিবারিক ঐতিহ্য নিয়ে তাঁর যে একটা যোগ্য, সত্য, ন্যায্য মানসিক বাতাবরণ ছিল সেটা ভাবতেও তাঁর দ্বিধাবোধ হত না— সঙ্গীতের প্রতি তাঁর সত্যনিষ্ঠ শ্রদ্ধাবোধ থেকে৷ বুক ফুলিয়ে রাজপথ দিয়ে চলার অভিপ্রেত শিক্ষা যেমন তাঁর ছিল, তেমনি স্ব-অস্তিত্বের প্রতি একটা দৃঢ় প্রত্যয়ও ছিল৷ কিন্তু তিনি রক্ষণশীলও ছিলেন না, আর শিল্পীদম্ভও তাঁর ছিল না৷ তাই সত্যের পায়ে, সঙ্গীতের পদতলে নতজানু হতে কোনও কুণ্ঠাও তাঁর ছিল না৷ মনে পড়ে যাচ্ছে একটা ঘটনা৷

সলিলদা তখন বোম্বেবাসী৷ পুজোর আগে হঠাৎ কলকাতা এসেছেন এবং তাঁর কসবার ভাড়াটে বাড়িতেই উঠেছেন৷ পাড়ার ছেলেরা এসে ধরল পাড়ায় একটা বিজয়া সম্মেলন করার জন্যে৷ মনে আছে সলিলদার বাড়ির কাছেই একটি বাড়ির রক হচ্ছে স্টেজ আর সামনের কচি উঠোনে দর্শকদের বসার স্থান৷ নামীদামি বড় শিল্পীদের নিয়ে এসে গান করানোর অত প্রশস্ত জায়গা সেটা আদৌ নয়৷ কিন্তু সলিলদার ভাবনার জাত হচ্ছে বড় কিছু ভাবে যে-কোনও কাজ করা৷ Big canvas ছাড়া সলিলদা ছবি আঁকতে পারতেন না৷ একদিনের মধ্যে আয়োজন— এখানে নামীদামি শিল্পীদের ডাকা উচিত কিনা এ-সব সলিলদার ভাবনার অন্তর্গত নয়৷ যাকে যাকে পারলেন আসতে বলে দিলেন৷ দ্বিজেনদা, তরুণদা, নির্মলদা— সব নাম মনে নেই৷ মনে হয় নির্মলা, ইলা, প্রতিমাদি কেউ বাদ নেই৷ সবিতাকে সেখানে প্রথম দেখি৷ কিন্তু মানবদাকে বলতে মনে ছিল না৷ অনুষ্ঠান চলছে, হঠাৎ অনুষ্ঠান চলতে চলতে দেখি— নিজের হারমোনিয়াম নিয়ে মানবদা হাজির৷ ‘সলিলদা, আপনার অনুষ্ঠান, আমি নেই কেন?’ সলিলদা বেশ লজ্জিত হয়ে পড়লেন, বললেন— ‘আরে আরে মানব, এসো এসো— খুব ভাল হয়েছে তুমি এসেছ৷’ লক্ষ্য করলাম মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায় নামক পাহাড় থেকে কল্লোলিনী ঝরনার মতো নেমে আসা মানব-শ্রদ্ধাবোধ৷ স্রোতকে৷ এ-সব দেখেই আমরা জীবন সম্পর্কে অনেক চেতনা লাভ করেছি৷

প্রিয় রাহুল, মানসী তোমরা প্রবীর মজুমদার সুরারোপিত, ‘এই নীল নির্জন সাগরে’ ও ‘এখনও এই রাত অনেক বাকি, ওগো এই তো বেশ’ গান দুটি নিশ্চয় শুনেছ৷ আরও একবার আজই শোনো৷ তার পাশাপাশি শৈলেন মুখোপাধ্যায় সুরারোপিত ‘বারে বারে কে যেন ডাকে আমারে’ গানটাও শোনো, বুঝবে সঙ্গীতজ্ঞান ও প্রেম হাত ধরাধরি করে সজীব হয়েছিল৷ জাগতিকভাবে বুঝবে সঙ্গীতে সুরের রসায়ন কাকে বলে৷

উপসংহারে বর্তমান প্রজন্মের শিল্পীদের কাছে নিবেদন করব, তোমরা যদি এঁদের কর্মকাণ্ড নিয়ে আলাপ-আলোচনা, গবেষণা করো আত্মসমৃদ্ধি লাভ করবে৷ আর সঙ্গীত-গবেষকদের বলব, এই ব্যতিক্রমী এক আলাদা জাতের শিল্পী মানব মুখোপাধ্যায়কে হৃদয়ের দরজা খুলে জানার, বোঝার চেষ্টা করুন৷ তৈরি করুন তাঁর কর্মপঞ্জি৷ দেখবেন আপনাদের কাছে বাংলা গানের ইতিহাস অনেক অনেক অমূল্য সম্পদ উপহার পাবে— যা মানব চলমানতায় সংস্কৃতির শুভযাত্রার পাথেয় হয়ে উঠবে৷

মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়— এ মেলডি, এ হার্মনি, এ মিউজিক— এক মহান সঙ্গীতসাধক৷ তাঁর উদ্দেশে জানাই আমার আন্তরিক শ্রদ্ধা৷ মানবদা, আপনার সঙ্গীত-বিচিত্রতার ভাণ্ডার তবু সমস্তর মধ্যে যেন লেগে আছে একটি অভিব্যাক্তি— ‘কেন আরো ভালোবেসে যেতে পারে না হৃদয়?’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *