কেনেথ এডওয়ার্ড জনসন

কেনেথ এডওয়ার্ড জনসন

কেন জনসনের সঙ্গে আমার প্রথম আলাপ ষাটের দশকের গোড়াতে—নামনি আসামের ধুবড়ির সার্কিট হাউসে। তখন জনসন আসামের আয়কর কমিশনার। পুঞ্জিভূত অনাদায়ী আয়কর scaling down করতে সেন্ট্রাল বোর্ড অফ ডায়রেক্ট ট্যাক্সের মেম্বার কোদন্ডরমন সাহেব দিল্লি থেকে শিলঙে গিয়েছিলেন। কলকাতার মুখ্য কমিশনার তখন ছিলেন এফ এইচ ভল্লিভয় সাহেব। ছ ফিট দু ইঞ্চি লম্বা, মুম্বইয়ের ভোরা মুসলমান। গল্ফ খেলেন, হুইস্কি খান। লোকে বলত ‘গে ব্যাচেলর’। তখন GAY শব্দটির মানে অন্য ছিল। তিনিও গিয়েছিলেন। কোদন্ডরমন দিল্লি ফিরে গেলে জনসন আর ভল্লিভয় সাহেব ভুটিয়া অফিসার ডি ওয়াংডি সাহেবের গাড়িতে করে শিলং থেকে এসে ধুবড়ি সার্কিট হাউসে উঠেছিলেন। আমাদের মক্কেল ধুবড়ির টাউন স্টোর্সের শচীন রায় মশায় যমদুয়ারে বাংলো বুক করেছিলেন এবং শিকারের অন্য সমস্ত বন্দোবস্ত করেছিলেন। আমি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে বহুল ব্যবহৃত আমেরিকান অল—পারপাজ ড্যাকোটা প্লেনে করে জ্যামেয়ার কোম্পানির দয়াতে কলকাতা থেকে যুদ্ধের সময়েই আমেরিকানদের বানানো ‘রূপসী’ এয়ারস্ট্রিপে পৌঁছে টাউন হোটেলে গিয়ে উঠেছিলাম। পরদিন সকালেই যাত্রা। গৌরীপুর—তামাহাট—বরবাধা—কচুগাঁও রাইমানা হয়ে যমদুয়ারের উদ্দেশে। আমি বিকেলে ওঁদের সঙ্গে দেখা করতে গেছি সার্কিট হাউসে। ওয়াংডি কাকু আমাদের সঙ্গে আগেও শিকারে গেছেন। ক্যাপ্টেন জনসন যেমন আর্মি থেকে আয়কর দপ্তরে এসেছিলেন তেমনই এয়ারফোর্সের পাইলট ডি ওয়াংডিও এসেছিলেন। ওয়াংডি কাকুই বাবাকে বারবার চিঠি লিখেছিলেন শিলং থেকে, জনসন সাহেবের জন্যে বাঘ শিকারের বন্দোবস্ত করতে। তাই বাবার অনুরোধেই শচীনবাবু সব বন্দোবস্ত করেছিলেন। টাইম—বারিং অ্যাসেসমেন্টের নানা ঝামেলা থাকাতে নিজে আসতে না পেরে বাবা আমাকে পাঠিয়েছিলেন।

সার্কিট হাউসে গিয়ে দেখি ওঁরা স্কচ হুইস্কি খাচ্ছেন এবং তাস খেলছেন। স্কচ—হুইস্কি কথাটাতে অনেকেরই অবশ্য আপত্তি আছে। ধুর্জটিপ্রসাদ মুখার্জির নানা গুণে গুণান্বিত পুত্র কুমারপ্রসাদ মুখার্জি আমাদের কুমারদা বলতেন হুইস্কি আবার স্কচ ছাড়া হয় নাকি? ততক্ষণে সান—ডাউন হয়ে গেছে। বাবা বলতেন, শিকারের সব ভাল শুধু মদ আর মেয়েমানুষ বাদে। ”আমি ওসব খাই না” বলাতে ভল্লিভয় বললেন, ‘উ্য ডোন্ট ড্রিঙ্ক, দেন হোয়াই ড্যু উ্য লিভ ফর?’ সবিনয়ে ওঁকে বললাম, থ্যাঙ্ক উ্য! আই হ্যাভ আদার রিজনস ফর লিভিং।’

তাসও খেলব কি? বাবার কড়া শাসনে তাস চিনতাম না পর্যন্ত। তখন আমার বয়স ঊনত্রিশ। একবার স্কুলের ছাত্র থাকাকালীন রঙ মেলানো খেলা শিখেছিলাম। তাও বহুদিন আগেই ভুলে গিয়েছিলাম। বাবা বলতেন, তাস, পাশা, দাবা, লুডো এসব একদম খেলবে না। খেলতে হলে ফুটবল, টেনিস, ক্রিকেট এসব খেলবে। তাই…।

আমাদের সঙ্গে আবু সাত্তারও যাচ্ছে। সাত্তারের সঙ্গে স্কুলে পড়ার সময় থেকেই এ অঞ্চলে অনেক শিকার করেছি। তামাহাট ও সংলগ্ন অঞ্চলে। আমাকে ‘লালদা’ বলত ও। এমনিতে সে লুঙি পরত। আর খাকি হাফশার্ট। বড় বড় সাহেবদের সঙ্গে যাচ্ছে, তাই সেবারে খাকি প্যান্ট পরেছে। সাইকেলের সঙ্গে তার আটাশ ইঞ্চি দোনলা বন্দুকটি বাঁধা থাকত। কখনও কখনও পিঠেও ঝোলানো থাকত স্লিঙে। প্রচণ্ড সাহসী ছিল সাত্তার। তার চোয়ালে দৃঢ়প্রত্যয় আঁকা ছিল। মুখে সব সময়ে পান আর গুয়া—মানে, মজা সুপুরি। তার কথা অনেকই আছে আমার ‘বনজ্যোৎস্নায়, সবুজ অন্ধকারে’র প্রথম খণ্ডতে।

সাত্তারের জীবনের শেষ পরিণতিটা বড় করুণ। ভীষণই বদরাগী ছিল সে। বাঘ ও চিতার আক্রমণে আহত হয়ে সে একাধিকবার যমের মুখ থেকে বেঁচে এসেছে। ওর নিবাস ছিল ধুবড়ি শহরের কাছেই। জমিজমা নিয়ে পারিবারিক বিবাদে সে দিশাহারা হয়ে একই দিনে তার এগারোজন আত্মীয়কে গুলি করে মেরে ফেলে তাদের প্রত্যেকের বাড়ি বাড়ি গিয়ে। আবু সাত্তার জঙ্গলের রহস্য বুঝত, জানত, জানোয়ারদের চিনত কিন্তু মানুষকে চিনত না। তাই মানুষের বিশ্বাসঘাতকতা সে সহ্য করতে পারেনি। ফাঁসির আদেশ হয়েছিল ধুবড়ির কোর্টে। গুয়াহাটি হাইকোর্টে আপিল করেছিল। তখন আমাকে একটা পোস্টকার্ড লিখেছিল আর্থিক সাহায্য চেয়ে। আমার সাধ্যমতো পাঠিয়েওছিলাম। কিন্তু ফাঁসির আদেশ রদ হয়নি। তার ফাঁসি হয়ে গিয়েছিল।

যমদুয়ারের জঙ্গল ছিল দেখার মতো। অত বড় বড় শাল ও সেগুন খুব কম বনেই দেখেছি, মধ্যপ্রদেশ ও মহারাষ্ট্রের কোনও কোনও বনে ছাড়া। সিংভূমের সারান্ডার (ল্যান্ড অফ সেভেন হান্ড্রেড হিলস) শালবন বিখ্যাত, মণিপুরের বার্মা সীমান্তের সেগুনও বিখ্যাত কিন্তু সংকোশ নদীর অববাহিকার যে শাল—সেগুন তার সঙ্গে তুলনীয় কম গাছই দেখেছি।

যমদুয়ারের দোতলা বনবাংলোটি (আসাম এবং উত্তরবঙ্গের প্রায় সব বনবাংলোই শালের খুঁটির ওপরেই হয়, দোতলা, হাতির ভয়ে) একেবারে সংকোশ নদীর ওপরেই ছিল। শুনেছি, এখন সে বাংলোটি আর নেই। বক্সার ভুটানঘাট বাংলোরই মতো। অনেক বছর যমদুয়ারে যাইনি। ভুটান পাহাড় থেকে নেমে আসা স্বচ্ছতোয়া সংকোশ নদীতে মাছও পাওয়া যেত। জল এতই স্বচ্ছ ছিল যে জলের মধ্যে মাছেদের ঝাঁক দেখা যেত। শীতের দিনে পৃথিবীর নানা দেশের পরিযায়ী হাঁসেরাও আসত সেখানে। নদীর এক পারে ভুটান, অন্য পারে আসাম এবং তার গায়েই পশ্চিমবঙ্গ। যমদুয়ারের এমনই খ্যাতি ছিল যে ভুটানের মহারাজা ভারত সরকারের অতিথি হিসেবে সোজা থিম্পু থেকে হেলিকপ্টারে এসে নামতেন বাংলোর সামনের হাতাতে শিকারের জন্যে। থাকতেন অবশ্য নিজস্ব তাঁবুতে। কখনও—বা ওই বাংলোতেও থাকতেন।

আমরা বাঘের খোঁজ পাওয়ার জন্যে পরদিন আর্লি—ব্রেকফাস্ট করেই সাত্তারকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম জিপে। ভল্লিভয় গেলেন না। মাইল তিরিশ দূরে রাঙ্গা নামের একটি বিস্তীর্ণ নদী ছিল, তখন শুকনো। যেখানে লালজির হাতি—ধরার ক্যাম্পের কথা আগেই বলেছি। সেই নদীর বুকে সাত্তারের সন্ধানী চোখ থাবার দাগ খুঁজে পেল। রাঙ্গার একটি শাখানদী পেরিয়ে ডানদিকের জঙ্গলে গেছে বাঘ। সেখানেই সে দিনের বিশ্রাম নেয়। রাঙ্গার বাঁদিকে নীলাভ হিমালয়। তার পদপ্রান্ত অবধি বিস্তৃত ঘাসবন। সেখানে একটি দহ ছিল। যখন তাতে ভরা জল ছিল তখন হাতি, বুনো মোষ, গাউর, গণ্ডার এবং নানা জানোয়ার wallowing করত। সেই সব জানোয়ারের গায়ের লোম ওই দহর চারপাশের গাছে কাদার সঙ্গে তখনও লেগেছিল। হাতিদের পায়ের চাপে কাদার মধ্যে যে গর্ত হয়েছিল তা তখন শুকিয়ে হামনদিস্তার মতো হয়ে থেকে গিয়েছিল। তার ওপরে লতা লতিয়ে থাকাতে যে কোনও সময়ে অসাবধানীর গোড়ালি ভাঙতে পারত। সেই দহতে সামান্য জল তখনও ছিল। বাঘ সেই ঘোলাজল খেতে আসত। ওই নোংরা জলের পাশের কাদাতেই বাঘের থাবার দাগ দেখা গেল।

অত বড় শাল গাছে মাচা বাঁধা অসম্ভব। প্রথম ডালের উচ্চচতাই প্রায় দু মানুষ হবে। তাছাড়া, মাচা বাঁধার সাজসরঞ্জাম ও জনবলও আমাদের ছিল না। তাই বাংলোতে ফিরে তাড়াতাড়ি লাঞ্চ খেয়ে আবার ওইখানে এসে ওই শাখানদীর দুটি প্রান্তে আমরা দু দলে ভাগ হয়ে মাটিতেই আড়াল নিয়ে বসব ঠিক করলাম।

বলতে ভুলে গেছি, অত বড় দুজন আমলা এসেছেন, যাঁরা দুজনেই যথাসময়ে সেন্ট্রাল বোর্ড অফ ডায়রেক্ট ট্যাক্সেসের মেম্বার তো বটেই চেয়ারম্যানও হবেন, তাই ধুবড়ির ইনকাম—ট্যাক্স অফিসার নীতিরঞ্জন ভট্টাচার্য, (যিনি পরে ডেপুটি কমিশনার হিসেবে কলকাতা থেকে অবসর নেন) গোপালের ভাষায়, ‘এক গাছা’ বন্দুক নিয়ে শামিল হয়েছিলেন আমাদের সঙ্গে। তিনি কখনও বকও মারেননি। সরকারি চাকরি করতে গেলে যে সময়ে সময়ে প্রাণও বন্ধক রাখতে হয় তা পরেও বহুবার দেখেছি।

লাঞ্চের সময়ে ভল্লিভয় সাহেব বললেন, আই অ্যাম নট ইন্টারেস্টেড। আই হ্যাভ মাই স্কচ অ্যান্ড আগাথা ক্রিস্টি। অতএব লাঞ্চের পরে আমরা ভল্লিভয় সাহেবকে রেখেই গেলাম। তারপরে এবং তার পরের দিন কী হল তার সবিস্তার বর্ণনা আছে ‘বনজ্যোৎস্নায়, সবুজ অন্ধকারের’ প্রথম খণ্ডে। তাই এখানে পুনরাবৃত্তি করব না।

শিলঙে ফিরে Ken জনসন আমাকে একটি চিঠি লিখেছিলেন। যমদুয়ারের বন্ধুত্ব পরে গভীর ও চিরস্থায়ী হয়েছিল এবং কেন ও জিন জনসনের মতো ভদ্র, সৎ এবং সম্ভ্রান্ত বন্ধু আয়কর বিভাগের অগণ্য তাবড় তাবড় আমলাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হওয়ার পরেও বলতে পারি যে, বেশি পাইনি। জনসনদের সঙ্গে আমার বন্ধুত্বের রকমের কথা বলতে গেলে আলাদা বই লিখতে হয়।

সেই চিঠির শেষে Ken লিখেছিলেন, ইংরেজি হরফে, কিন্তু হিন্দি ভাষায়, ‘ক্যা বদনসীবী হামারা, শের আয়া নেহি মারা।’

Ken জনসন পরে কলকাতার মুখ্য কমিশনার হয়ে আসেন। কয়েক বছর পরে সেন্ট্রাল বোর্ড অফ ডায়রেক্ট ট্যাক্সেসের মেম্বার হয়ে দিল্লি চলে যান। ওঁরই চেয়ারম্যান হওয়ার কথা ছিল কিন্তু নির্বাচনের আগে ইন্দিরা গান্ধীর একজন অন্যরকম মানুষের দরকার ছিল। চেয়ারম্যান হিসেবে তাই ওঁকে মেম্বার হয়েই অবসর নিতে হয়। দিল্লিতে মেম্বার থাকার সময়ে তো প্রায়ই দেখা হত দিল্লিতে, এবং অবসর নেওয়ার পরেও বহুদিন পর্যন্ত আমাদের চিঠির মাধ্যমে যোগাযোগ ছিল। উনি চলে গেছেন। খুবই শূন্যতা বোধ করি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *